আসলে ধর্ম বলতে আমরা কি বুঝি? মূলত কোন বস্তুর বা শক্তির ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি (যেমন আগুনের ধর্ম দহন করা,জলের ধর্ম তাপে বাষ্পীভূত হওয়া, এসিডের ধর্ম ধাতুর সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা ইত্যাদি), মানুষের ধর্ম বললে আমরা ঠিক তা বুঝি না। যদিও সে হিসাবে মানুষের ধর্ম হওয়া উচিৎ ছিল খাদ্য গ্রহণ, সন্তান উৎপাদন, অভিযোজন ইত্যাদি, কিন্তু মানুষের ধর্ম বলতে (বর্তমানে প্রচলিত ধর্মসমূহে বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম বাদে) আসলে বুঝায়, একটি অদৃশ্য, অশরীরী সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস (আল্লাহ, ভগবান, গড ইত্যাদি) সেই সৃষ্টিকর্তাকে খুশী রাখার নিমিত্তে কিছু উপাসনা করা (নামাজ, পূজা, নৈবেদ্য, উপবাস ইত্যাদি) এবং তাঁকে খুশী রাখতে কিছু আদেশ পালন করা ও কিছু নিষেধ মান্য করা। বর্তমানে প্রচলিত ধর্মের এই যে অবয়ব তা কখনো শুরু থেকে এ রকম বা এ পর্যায়ে ছিল না। নানা সময়ে বিবর্তিত হতে হতে আজকের এই পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এবং এই বিবর্তনে যথারীতি অর্থনীতি, ভৌগলিক অবস্থা, বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, রাজনীতি প্রভৃতিরও ভূমিকা রয়েছে নানা ভাবে।
হাজার হাজার বৎসর আগে মানুষ যে ‘প্রাকৃতিক পরিবেশে’ বসবাস করতো, সেই পরিবেশটাকে একটু কল্পনা করুন তো। তখন না ছিল গৃহ, না ছিল নির্দিষ্ট কোনো ভাষা, না ছিল পোশাক, না ছিল চলাফেরা করার মত রাস্তা-ঘাট, এমনকি খাদ্য উতপাদনের কোন উপায়। কাচা মাংস আর ফলমূল ছিল এদের খাবার। যদিও কিছুদিন পর আগুনের ব্যবহার, লৌহ ও তাম্র দিয়ে হাতিয়ার আবিষ্কার জীবনকে কিছুটা সহজ করে দিয়েছিল। হিংস্র জন্তুজানোয়ার থেকে রক্ষা পাবার জন্য গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে বসবাসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল, যাকে বলা হত টোটেম। এই বিভিন্ন টোটেম এর কাজ ছিল নিরাপত্তার চরম অভাব দূরীভূত করা, আর ছিল খাদ্য অন্বেষণের জন্য শিকার ও চাষবাসের নানাবিধ প্রচেষ্টা। আধুনিক যুগের মানুষ পৃথিবীর ইতিহাস ও জাগতিক বহুমুখী শিক্ষা থেকে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারে মানুষ জাতির অগ্রগতি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে শতাব্দি ও সহস্রাব্দির ধাপে ধাপে। তৎসঙ্গে মানুষের ভাষা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটেছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর শতাব্দির চাকায়। এই সভ্যতার ক্রমবিকাশের জন্য কোনো ইশ্বর কিংবা মহাপ্রভু মাটির পৃথিবীতে নেমে এসে প্রকাশ্যে মানুষকে দিয়ে যাননি কোন অলৌকিক ক্ষমতা কিংবা কোনো সংবিধান। মানুষ আদিম যুগ থেকে নিরাপত্তার কারণে ও বাঁচার তাগিদে নানাবিদ প্রচেষ্টা করেছে নিজ বুদ্ধিবলে। এই বুদ্ধি হচ্ছে প্রাকৃতিক। মানুষের এই প্রচেষ্টা ও বুদ্ধির প্রয়োগ আজ পর্যন্ত টিকে আছে অব্যাহত গতিতে। প্রতিকুল পরিবেশে আত্মরক্ষা, শিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য দুর্বলের উপর আক্রমণ, বুদ্ধির বলে নানাবিধ কৌশল দ্বারা অপরকে পরাজিত করা, ভাষার সুন্দর প্রয়োগ দ্বারা শান্তি , ঐক্য ও ভালবাসা স্থাপন করা, এসমস্ত মানুষ আয়ত্ত্ব করেছে নিজেদের বিবেক বুদ্ধির প্রয়োগ এবং তা থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার দ্বারা।
আমরা যদি ধর্মের উৎপত্তি বিষয়ে নানা গবেষণা চালাই ও ইতিহাসের পাতা ওল্টাই তা হলে দেখতে পাবো ভয়, বুদ্ধি, স্বপ্ন, ভাষা, এবং কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। এর পেছনে ইশ্বরের কোনো হাত নেই। পৃথিবীতে ধর্মের কি ভাবে শুরু কিংবা উৎপত্তি হয়েছিল তার ব্যাখ্যা ও ইতিহাস বিস্তর। তবে ৩ থেকে ৫ লক্ষ বছর আগে মধ্য প্রস্তরযুগে ধর্মীয় আচার আচরনের সাক্ষ্য প্রমান পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষ যখন মাত্র ৫০০০ বছর আগে লিখার প্রচলন শুরু করে কেবল তখনই ধর্ম লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে। ৫০০০ বছর পূর্বে ধর্ম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন জায়গায় তেমন কিছু বলা হয় নাই বলে জানি আমি যতদূর।আবার কালের আবর্তে অনেক ধর্মের উৎপত্তি,উস্থান,পতন এবং হারিয়েও গেছে।
তবে ধর্মের উৎপত্তি হিসেবে কয়েকটি তত্ত্ব আছে। যেমন-
১। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মতবাদ
২। মানবীয় বিচার-বুদ্ধি ভিত্তিক মতবাদ
৩। মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ
৪। নৃ-তাত্তিক মতবাদ
সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মতবাদব মানুষকে বিশ্বাস করতে বলে যে- পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকেই একজন ঈশ্বর আছেন এবং তিনিই ধর্মের প্রবক্তা।
মানবীয় বিচার-বুদ্ধি ভিত্তিক মতবাদ বিশ্বাস করে যে-পৃথিবীর সকল ধর্মের উৎপত্তি হল পুরোহিতদের মাধ্যমে।
নৃ-তাত্তিক মতবাদ এবং মনস্তাত্ত্বিক মতবাদের মতে ধর্মের উৎপত্তি বা ক্রমবিকাশ একদিনেই ঘটেনি। কালের বিবর্তে বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও ঘটনার মধ্যদিয়ে উদ্ভূত হয়েছে ‘ধর্ম’ শব্দটির। ক্রমবিকাশ বলতে বোঝায়- ক্রমোন্নতি,একটু একটু করে উন্নতি, অভিব্যক্তি, বিবর্তন, Evolution।অর্থাৎ কোন অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে ধর্মের উৎপত্তি হয় নাই। নৃতাত্ত্বিক, বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদদের মতে এই মতবাদটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞান সম্মত মতবাদ হিসাবি স্বীকৃত। বাকি দুটি মতবাদ প্রমাণহীন বিশ্বাস নির্ভর বলে এগুলি বিজ্ঞানীদের কাছে তত গ্রহণীয় নয়। বরং গোঁড়া ধার্মিকদেরই মতবাদ বলে সমধিক পরিচিত।
0 মন্তব্যসমূহ