( ২০০৫ সালে তালাক প্রাপ্ত একটি কম বয়সি মেয়ে বলাই ভাল আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসে যাতে অকারণে তাকে যে তালাক,তালাক,তালাক বলে তালাক দিয়েছে তা রোধ করার জন্য । সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল যদি আইনের সাহায্য নেয়া যায় তবে কেমন হবে? আমার সাহায্যে সে পুরুলিয়া আদালতে মামলা করে। তখন একটি পত্রিকায় ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক বিষয়ে ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ লিখি এবং সেই প্রকাশিত প্রবন্ধটি মাননীয় বিচারককে দেওয়া হয়। তিনি ওই প্রবন্ধটি পড়েন এবং খুবই প্রভাবিত হন। তিনি তার ঐতিহাসিক রায়দানে তা উল্লেখ করে ২০০৭ সালে ওইভাবে তালাককে অবৈধ বলেন এবং ওই মহিলাকে মাসে ২০০০ টাকা খোরপোশ দেওয়ার আদেশ দেন। পুরুলিয়া বলে ওই রায় সেভাবে প্রচার পায়নি। সেই লেখার একটি সারাংশ এখানে পুনরায় দিলাম যা "সংবাদ বন্ধু" পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে )
“তোমাকে তালাক,তালাক,তালাক।” এই তিনটি ভয়ংকর শব্দ যে কোন মুসলিম বিবাহিত নারী তাঁর জীবনে শুনতে পারেন এবং এর দ্বারা শুধু তাঁর বিবাহিত জীবনের ইতি ঘটে না,তিল তিল করে সংসার নামক যে ইমারতটি গড়ে তুলেছিলেন তা যেন এক নিমেষে ভয়ংকর ভুমিকম্প দ্বারা খান খান হয়ে যায় । বহু বছর ধরে ভালবাসা ও মমতার স্পর্শে যে ইমারত গড়ে উথেছিল তা সামান্য এই কথা উচ্চারণের মাধ্যেমেই কি শেষ হয়ে যায়? মুখে তিন তালাক বললেই সুখ দুঃখের সাথি অর্ধাঙ্গিনী চিরদিনের জন্য হারাম হয়ে যাবে, এই বিধানটি অমানবিক বলেই মনে হয়। এ কেমন কথা? রাগের মাথায় তিন তালাক বললাম আর আমার এতদিনের জীবন সঙ্গীনী হারাম হয়ে গেল? বড়ই বেমানান লাগে এই বিধানটি এবং আমাদের ধর্মজ্ঞানহীন মনে হয়। কিন্তু আসলেই কী তাই?
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে যথার্থ ইসলামিক ধ্যান ধারণা তাথা জ্ঞানের অভাবেই সমাজে নানা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তালাক নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে ইসলাম ধর্মে তালাক বলতে কি বোঝায় এবং কখন ও কিভাবে তা প্রয়গ করা যেতে পারে । বিষয়টি কি এতই সহজ এবং সস্তা যে যখন খুশি অর্থাৎ ফোনে ,হোয়াটস আপে বা ইমেলে স্বামী ইচ্ছামত স্ত্রীকে,” তালাক,তালাক,তালাক” বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেবে?
ইসলামে বিবাহ হল দুটি নরনারীর মধ্যে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করার জন্য একটি সামাজিক চুক্তি। স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরের উপর কতকগুলি দায়িত্ব ও কর্তব্য এসে পড়ে। বিবাহ হল নরনারীর পারস্পারিক সম্মতি ও সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে আইন সঙ্গত মিলন। বিবাহের দ্বারা উভয়ের মধ্যে শান্তি ও ভালবাসা এবং সেই সঙ্গে সুখ দুঃখে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কথা বলা হয়ছে ।
দাম্পত্য জীবনে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে বিবাদ-বিরোধ, মত পার্থক্য বা মনমালিন্য দেখা দিতেই পারে। কারন স্বামী-স্ত্রী উভয়েই আলাদা পরিবেশ,আলাদা রুচি সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পরিবেশে লালিত হয়ে তারা পরস্পরে মিলিত হয়েছে। পারস্পারিক দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যেও পার্থক্য থাকতে পারে । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে কি করা উচিত স সম্পর্কে কোরানের নির্দেশ হল,” যদি কোন স্ত্রীলোক তার স্বামীর কাছ থেকে দুর্ব্যবহার কিংবা অবজ্ঞার আশংকা করে, তাহলে(সে অবস্থায়) পারস্পারিক আপোষে নিস্পত্তি করে নিলে তাঁদের কোন দোষ নাই। আপোষ হচ্ছে উত্তম পন্থা।“(সুরা নিসা-আয়াত নং ১২৮)
এরপরও যদি স্বামীর সাথে ঝগড়া হয়, তাহলে ইসলামের বিধান হল-স্ত্রীর বিছানা আলাদা করে দিবে, অর্থাৎ স্বামী এক স্থানে ঘুমাবে আর স্ত্রী অন্য স্থানে এক বাড়িতেই। যেন উভয়ের প্রতি বিচ্ছেদের যাতনা অনূভুত হয়।
এ পরেও যদি দাম্পত্য জীবনে বিরোধ মীমাংসা করতে নিজেরা ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে কোরানের নির্দেশ , “ তবে স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে একজন সালিশি নিযুক্ত করবে।“ (সুরা নিসা বাক্য নং-৩৫) এখানে তৃতীয় পক্ষ দ্বারা মীমাংসার প্রচেষ্টার কথা বলা হয়েছে। এই প্রচেষ্টাও যদি ব্যর্থ হয় অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বেঁধে রাখার শেষ চেস্তাও যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তখন বিবাহ নামক রশ্মিকে ছিন্ন করে পরস্পরের অস্তিত্বকে রক্ষা করাই তালাকের উদ্দেশ্য ।যেখানে মিলন একেবারে অসম্ভব সেখানে জোর করে টিকিয়ে রাখার কোন যৌতিকতা নাই।
তালাকের প্রক্রিয়া নিয়ে কোরানে বলা হল,” তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। তোমরা তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিস্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়।“( সুরা তালাক) স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে পবিত্র অবস্থায় অর্থাৎ মাসিক অবস্থায় নয়। প্রথম তালাক(একবারেই তিন তালাক নয়) বা এক তালাক দেওয়ার পরও স্ত্রী তার স্বামীর ঘরে বসবাস করবে। এর মধ্যে বিরোধ মীমাংসার একটা ইঙ্গিত বহন করে । কারন একত্র বা একই গৃহে থাকার ফলে তাদের মধ্যে একটা সহানুভুতি গড়ে উঠার সম্ভাবনা প্রবল। প্রথম তালাকের পর যদি সম্পর্কের কোন উন্নতি না হয় অর্থাৎ একমাস পর স্বামি দ্বিতীয় তালাক প্রদান করতে পারে। প্রথম বা দ্বিতীয় তালাকের পর স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে । দ্বিতীয় তালাকের পর কোন সমঝতা ছাড়া একমাস অতিবাহিত হলে তৃতীয় তালাক প্রদানের মাধ্যমে চূড়ান্ত ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে। কোরানে বলা হল,” তালাকে রাজঈ’ হল দুবার পর্যন্ত,তারপর নিয়ম অনুযায়ী রাখবে না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে।“(সুরা বাকারা,বাক্য নং ২২৯)
তিন তালাকের অর্থ তিনবার অর্থাৎ তিন সময়ে। তিন আর তিন বার কি এক বিষয়? বাঙলা ভাষায় তিন হল অংকের সংখ্যা আর তিনবার হল সময়ের কোন ধাপ বা নির্দিষ্ট পর্যায়কে বোঝায় । কাজেই কেউ যদি একসাথে তিন তালাক দেয়, তাহলে তা হবে একবার তালাক, তিনবার তালাক নয়। হজরত মুহাম্মদ(স) এর যুগে প্রথম খলিফা আবু বকর(রা) এবং দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা) এর যুগে তিন তালাককে এক তালাক ধরা হত(সুনাই নাসাই শরিফ নং ৩৪০৭)
অনেকে তালাকের পর হিল্লা বিয়ে অর্থাৎ তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে নাম মাত্র বিয়ে দিয়ে পুনরায় ফিরিয়ে আনাকে বোঝায় । হজরত মুহাম্মদ (স) একে ভাড়া করা পাঁঠার সঙ্গে তুলনা করে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন । ইসলামে মেয়েদেও অধিকার আছে স্বামীকে তালাক দেবার এবং তাকে বলা হয় খোলা তালাক।
পরিশেষে একথা বলতে চাই রাগের বশবর্তী হয়ে বা কোন ঝোঁকের মাথায় লাল,তালাক,তালাক বলে সংসার ভেঙ্গে ফেলা কি সঠিক, তা আজ ভাল করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কের মধ্যেও যদি ভাঙ্গনের সুর রণিত হয় যা বহু চেষ্টা করেও রোধ করা যায় না, তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিচ্ছেদ বা তালাকের এবং তার প্রয়োজন আছে।
0 মন্তব্যসমূহ