ভারতের বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে '৯২ পরবর্তী ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলাদেশেও। হাজার হাজার হিন্দুরা বাস্তুভিটা হারা হোন। অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্তরা দেশ ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমান। এর রেশ সিলেটে চাক্ষুষ তেমন না পরলেও ছোটোখাটো হামলা, অগ্নিসংযোগ হয়েছিলো। সিলেটের অনন্ত বিজয়দের বাসার কাছেই তাঁদের আত্মীয়-জ্ঞাতিদের বাসায়ও এক-দুই বার হামলা হয়েছিলো। হামলাকারীরা অনেকেই ছিলো পরিচিত। চেনামুখ। প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও প্রায়ই একে অন্যের মুখোমুখি হতেন, এমন লোকজন-ই হামলায় অংশ নিয়েছিলো। সে সময় নিহত, আহত বা বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি খুব একটা হয় নি। অনন্ত বিজয় সে সময় হয়তো প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন। ভয়ে-আতঙ্কে তাঁরা চার ভাই-বোনরা দিন সাতেক স্কুলেও যান নি। দরকার না পরলে বাসা থেকেও খুব একটা বের হতেন না। মা-বাবা পারতপক্ষে বের হতে দিতেন না। চোখে চোখে রাখতেন তাঁদের। অনন্ত বিজয় ছাড়া আজ অন্য ভাই-বোনদের কি আজও তাঁর মা চোখে চোখে রাখেন? নাকি কাঁদতে কাঁদতে আজ আর চোখেও খুব একটা ভালো দেখেন না...? ভাই-বোনেরা সর্বকনিষ্ঠ, তাঁদের আদরের রিপন এতো দিন বাড়ি ফিরে না দেখে কি প্রতীক্ষায় থাকেন? মৃত্যুর আগে আগেও কি বাবা রবীন্দ্র দাশ সবচেয়ে আদরের রিপনকে খুঁজেন নি?
ডানপিটে অনন্ত বিজয় তারপরেও কোনো এক ফাঁকফোকরে গলে হয়তো বেরিয়ে যেতেন। বাসা থেকে মিনিট খানেকের হাঁটা পথ পেরোলেই বেশ বড় দিঘিটা। দিঘির পাড়ে তাঁর খেলার বন্ধুরা তখনও তাঁর জন্য অপেক্ষায় থাকতো। এতো কিছুর পরও সেই বন্ধুরাই রিপনকে পেলে সব ভুলে খেলায় মেতে উঠতো। বন্ধুরা আজও সুস্থ সবল আছেন। অনেকেই নিজ নিজ ক্যারিয়ার, চাকুরিবাকুরি নিয়ে ব্যস্ত। কেউবা সুন্দর ঘর-সংসারও করছেন। সবই ঠিকঠাক আছে। দিব্যি আছে দিঘিটাও। সাঁতার না জানা অনন্ত বিজয় দিঘির অথৈ জলে ভরসা ছিলো। হয়তো দিঘিরও ভরসা ছিলো অনন্তের প্রতি! ভরসা ছিল না শুধু ভয়াল ঘাতক ইসলামি জঙ্গিদের! এবারের ঘন ভারি বৃষ্টি, বর্ষাময় জলে হয়তোবা উপছে পড়েছে দিঘিটা। জল গড়িয়ে গড়িয়ে খাল, নদীনালা পেরিয়ে সাগরে গিয়ে হয়তো সেই জল মিলেমিশে যাচ্ছে। রিপন নাম্নী অনন্ত বিজয়ের শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতি ধুয়ে মুছে দিতে কী পারবে এই বহুপথ গড়ানো এঁদোজল?
অনন্ত বিজয় ব্লু-বার্ড স্কুলে পড়াকালীন সেবা প্রকাশনীর বইয়ের সাথে পরিচিত। বড় ভাইও ছিলেন সেইরকম বইয়ের পোঁকা। বিশেষ করে তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু'র একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন তিনি। তাঁর পড়ার অভ্যেস পারিবারিক ভাবেই ছিলো। স্কুলে কিছু বন্ধু-বান্ধবও জুটে গিয়েছিলো সেইরকম। পড়ুয়া। কৈশোরে অনন্ত বিজয়ের তিন গোয়েন্দা খুব প্রিয় ছিলো। সে হিসেবে গোয়েন্দাদের মধ্যে রবীন, মুসা অন্য যে কেউ হলেও কিশোর পাশা ছিলেন অনন্ত বিজয় নিজে! বন্ধুরা প্রথমে ঘাইঘুই করলেও পরে কিশোর পাশারুপী অনন্ত বিজয়কে তাঁর আনুগত্যকে মেনে নেয়। এডভেঞ্চার প্রিয় অনন্তকে পেয়ে তাঁরাও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। অনন্ত বিজয়ের মতো তাঁর বন্ধুরাও তিন গোয়েন্দার ভীষণ ভক্ত ছিলেন। ক্লাসে, টিফিনের ফাঁকে তাঁঁর বন্ধুদের এক মাত্র কাজ ছিলো রহস্য খোঁজা! রহস্যকাহিনীর পোঁকা অনন্তের মৃত্যুটা প্রকাশ্যে, সকাল বেলায় প্রকাশ্যে দিনের আলোয় হয়েছিলো। রহস্য-মৃত্যু হয় নি। রহস্যসন্ধানী অনন্তের দিনের আলোয় ঘাতকদের এলোপাতাড়ি চাপাতির আঘাতে মৃত্যু হয়। মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে প্রকাশ্য মৃত্যুর খানিকটা প্রস্তুতিও কী নিয়ে নিয়েছিলেন কিশোর পাশারুপী অনন্ত বিজয় দাশ?
মদনমোহন কলেজ থেকে বিজ্ঞানে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। প্রথম বিভাগে। মাধ্যমিকেও প্রথম বিভাগ। মদনমোহন কলেজ তখন ছাত্র রাজনীতির দূর্বৃত্তদের দখলে। ছাত্র শিবির, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ সমানে সমান। কেউ থেকে কেউ কম নয়। যাকে বলে আওয়ামি শেষ যমানা আর বিএনপি'র শুরুর দিকের সময়কার ছাত্র তিনি। বিগত শতক শেষ আর নতুন শতকের শুরুর দিকের ছাত্র তিনি। সেই উত্তাল সময়ে অনন্ত বিজয় মদনমোহন কলেজের ছাত্র। ক্যাম্পাস তুলনায় ছোটো ও গিঞ্জি। পিলপিল করছে ছাত্রছাত্রীরা। এর মধ্যে ছাত্র রাজনীতির অন্তর্ঘাত কোন্দল মারামারিতে ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক পরিবেশ নেই। যেকোনো সময় অস্ত্রের ঝনঝনানি, অস্ত্র প্রদর্শন চলে। পড়াশুনোর থেকে অস্ত্রের ঝনঝনানি বেশি চলে। অন্তর্ঘাতী সংঘর্ষে পড়ে নিরীহ ছাত্ররা লাশ হয়। দলীয় ছাত্র, অছাত্রদের লাশ পড়ে। সেই মরণ্মোখ সময়েও অনন্ত বিজয় মৃত্যুকে ঝাঁটা মেরে জীবনের স্বপ্নজাল বুনে চলেছিলেন! প্রিয় মদনমোহন ক্যাম্পাস, ক্লাসমেট, রাজনৈতিক দলাদলি ও প্রিয় শিক্ষকেরা আজও অনেকেই সুস্থ আছেন। দিব্যি আছেন। শুধু অনন্ত বিজয় আর নেই!
ভারতে গিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিলো। নানান কারণে হয়ে উঠেনি আর। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য দু'বোনের মতো তিনিও পড়ার সুযোগ পান। বিষয় পান সমাজকর্ম। ইচ্ছে ছিলো না পড়ার। শেষমেশ বাধ্য হয়ে, মনের বিরুদ্ধে গিয়ে পড়েন। একই সাথে প্রিয় মানুষ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। বড়বোনের শিক্ষক। সে হিসেবে মাঝেমধ্যে সুযোগ ছিলো দেখা সাক্ষাতের। এসব মিলিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মন্দ হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ও নানান কাজেকর্মে সময় ভালোই কাটছিলো। চমৎকার কিছু ক্লাসমেট, বন্ধু-সুহ্নদ পেয়েছিলেন। মদিনা মার্কেট, হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিষয়ভিত্তিক ফিল্ডওয়ার্ক করতে করতে সমাজকর্ম বিষয়কে কখন যে নিজের করে নিয়েছিলেন তা আর টের পান নি। বছর বছর পিকনিক হতো তাঁর বিভাগের। এসবের অগ্রভাগে থেকে দ্বায়িত্ব পালন করা থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সবই হাসিমুখে করতেন। এছাড়াও সময়ে অসময়ে বন্ধুদের নানাভাবে সাহায্য সহযোগীতা করা এসবের মধ্যেই বিষয়ভিত্তিক পড়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সবই কেমন করে জানি প্রিয় হয়ে যায়। শাবিপ্রবি ক্যাম্পাস, ক্লাসমেট, বন্ধুরা, প্রিয় সমাজকর্ম বিভাগ ও প্রিয় শিক্ষকেরা সবই আজও প্রায় একই আছে। বন্ধুরা যার যার পেশায় ব্যস্ত। অনেকেই দেশ ও দেশের বাইরে। শিক্ষকেরাও রোজকার মতো করে পড়াচ্ছেন। সেই আলোর মিছিলে নেই শুধু অনন্ত! আচ্ছা, তাঁর শিক্ষকেরা কি ভালো করে অনন্ত বিজয়ের মুখ মনে করতে পারেন? একটু লাজুক, হাসিমাখা মুখটা কি মনে পড়ে তাঁদের...?
মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ই মৌলিক পড়াশোনা শুরু হয় অনন্ত বিজয়ের। তখন নানান বিষয়ে পড়াশুনো শুরু করেন। পাঠ্যপুস্তক পড়া হতো শুধু সেমিস্টার পরীক্ষার সময়। পরীক্ষা বৈতরণী পার হওয়ার জন্য সবসময়, সব কালে কিছু উদার বন্ধু থাকে। সিরিয়াস টাইপের এইসব বন্ধুদের কৃপায় নোট-টোট দিয়ে পরীক্ষা পাশ কমবেশ সবাই-ই করেছেন। অনন্তেরও সেইরকম কিছু উদার বন্ধু-বান্ধব ছিলেন। যাঁরা বাস্তবিকই অনন্তপ্রাণ ছিলেন। এর মধ্যেই মুক্তমনায় তখন নিয়ম করে পড়ার জন্য মদিনা মার্কেট, আম্বরখানা, দরগাগেইট, জিন্দাবাজারে ঘন্টার পর ঘন্টা সাইবার ক্যাফেতে বসে বসে পড়তেন। কোনো কোনো দিন পাঁচ, ছয় ঘন্টাও ঠায় বসে পড়তেন। কমেন্ট করতেন। ততোদিনে 'বিজয় টাইপ' শিখে নিয়েছেন। তখন যোগাযোগ হয় অভিজিত রায়, রাফিদা আহমেদ বন্যা, জাহেদ আহমদ, ফরিদ আহমেদ, আকাশ মালিক, বিপ্লব পাল প্রমুখদের সাথে। এরপরে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয় অজয় রায়, অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদের সাথে। সেই সূত্রে সাক্ষাতও হয় বার কয়েক।
আর এভাবেই একদিন লেখালেখির শুরুটা হয়। অনন্ত বিজয়ের ঈশ্বরকেন্দ্রিক সংশয়বাদীতার প্রশ্নে যিনি তাঁকে শুরুর দিকে সমাধান দিয়েছেন তিনি প্রবীর ঘোষ। 'আমি কেনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না' দিয়ে শুরু। তারপর একে একে প্রবীর ঘোষের 'অলৌকিক নয় লৌকিক' সিরিজ হয়ে আরজ আলী মাতুব্বর ড. আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখরা তাঁকে ঋদ্ধ করেছেন। তো সেই পর্বে আর ঠিক তিনি আটকে থাকেন নি। থিওলজিকাল বিষয়-আশয় ধারণ করেই অধ্যাপক অজয় রায়, অভিজিত রায়, বন্যা আহমেদদের লেখা পড়া ও নিজের আগ্রহ ও ভালোবাসা থেকে জীব বিবর্তন নিয়ে পড়তে, ভাবতে থাকেন। ব্যক্তিগত পড়াশোনাটা তখন নিজের মতো জমিয়ে শুরু করে দিয়েছেন। প্রয়োজনে মুক্তমনার লেখাগুলোর প্রিন্ট নিয়েও পড়তেন। অন্যদেরও পড়াতেন।
যদি ভুল না করে থাকি তবে অনন্ত বিজয়ের প্রথম লিখার হাতেখড়ি খুব সম্ভবত দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে। দুই হাজার তিন বা চার সালে। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে। যতদূর মনে পড়ে দৈনিক সংবাদে বোধহয় লেখাটি ছাপা হয়েছিলো। আমি তাঁর কাছে সেই লেখার ফটোকপি দেখেছিলাম। পত্রিকাটি বেশ যত্ন নিয়ে উপসম্পাদকীয়-মতামতাকারে ছেপেছিলো। তখন তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন মাত্র। এভাবেই লেখালেখির শুরুটা হয়েছিলো। তারপর ধারাবাহিক লিখেছেন মুক্তমনাতে। 'যুক্তি' বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের মূখপত্র, তাঁর-ই সম্পাদনা। 'যুক্তি'তে নিয়মিত লিখেছেন। দেশের আরও অন্যান্য বিজ্ঞান সাময়িকীতে লিখছেন। যদ্দুর মনে পড়ে বাংলা একাডেমির ত্রৈমাসিকের জন্যও লিখেছেন। ছেপেছিলো কি না এখন আর মনে পড়ছে না। এর মধ্যেই পার্থিব (যৌথ), ডারউইনঃএকুশ শতকের প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা, সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লবঃলিসেঙ্কো অধ্যায়, জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ (যৌথ, অনুবাদিত)। এই-ই হলো মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বই। আজ অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় ছাড়া মুক্তমনা তথা বাংলা ভাষায় জৈব-বিবর্তন ও বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি প্রায় থমকে-ই আছে। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিলো না। শুরু হওয়ার আগেই সব কেমন শেষ হয়ে গেলো! থমকে গেলো।
তখন সবে আমি অনার্সে ভর্তি হয়েছি। দুই হাজার চার সালের শেষ দিকে খবর পাই সিলেটে বিজ্ঞানপ্রিয়, যুক্তিবাদী লোকজন অনেকেই আছেন। তারা একত্র হতে চাচ্ছেন। একত্রের জন্য বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন। বিজ্ঞাপনে যোগাযোগের জন্য নাম্বার দিয়েছেন। খবরটা আরও এক ক্লাসমেট-বন্ধুর মাধ্যমে পেলাম। দু'জনেই একদিন হাজির হলাম। অপরজন অবশ্য আগে থেকেই লিটন দাসকে চিনতো। উপশহরের এক জায়গায় সেদিন আমরা বেশ ক'জন মিলিত হয়েছিলাম। প্রায় সবাই-ই আমরা অপরিচিত। কিন্তু চিন্তা-চেতনায় আমরা ঘনিষ্ঠ। তাই সহজ ও স্বাভাবিক হতে আমাদের বেশিক্ষণ লাগে নি। অনন্ত বিজয়, লিটন দাস, সৈকত চৌধুরী ও আমি আমরা সেদিন প্রথম প্রাণখুলে কথা বলেছিলাম। বাকিরাও। অন্যদের নাম ইচ্ছে করেই দিলাম না। পরিবর্তিত অবস্থায় অনেকেই নানান ভয়-ভীতির মধ্যে আছেন। এভাবেই একদিন বাকি সদস্যসহ সবাই মিলে আমরা ২৭ জুন, ২০০৫ সালে 'বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল' গঠন করি। শুরুর দিকে আমাদের সদস্য সংখ্যা হাতেগোনা-ই ছিলেন। হাতে গোনা সদস্যের সবাই-ই বেঁচেবর্তে আছেন। আজ নেই শুধু নেতৃত্ব দেওয়া লোকটি। বয়সী, সম-বয়সী সকলের দাদা, অনন্ত'দা!
শহিদ মিনারে রোজ শুক্রবারে বসতাম আমরা। এরজন্য যে কতো হ্যাপা সইতে হয়েছে তা আর না বলি। বসার জন্য অনুমতিপত্রও সংগ্রহ করতে হয়েছিলো। শেষতক ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমরা শহিদ ডা. শামসুদ্দিনের কবরের পাশে ঘাসের উপরে বসতাম। রোদ-বৃষ্টি এসব পাশ কাটিয়েই আলোচনা, বিতর্ক চলতো। সময় গড়িয়ে সন্ধ্যে হতো। অথচ আমাদের আলোচনা তখনো সমানে চলতো। অনেকেই দূর-দুরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে আসতেন। তাঁরা জরুরি কাজ ছাড়া খুব একটা উঠার নাম নিতেন না। এই ফাঁকেফাঁকে মুড়ি, চানাচুর, পেঁয়াজু, বেগুনি ও ছোলা পত্রিকার উপরে মিশিয়ে খাওয়া-দাওয়া চলতো। সেই শহিদ মিনার, শহিদ শামসুদ্দিন কবরস্থানেও আমরা টিকতে পারিনি। তখন নগরনাটের অসীম দাসের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সেই সূত্রে ভোলানন্দ নৈশ স্কুলে আমরা জমায়েত হই। আড্ডা দেই। নগরনাট তাদের মহড়া চালোতো সেখানেই। এভাবে আসলে আর ঠিক চলছিলো না আরকি। সেই তাগিদ থেকেই মূলত আমরা সবাই একটা বসার মতো জায়গা খুঁজছিলাম। সেটা একদিন পেয়েও গেলাম। স্টেডিয়াম সংলগ্ন। রিকাবি বাজার। চার তলায়। ভাড়ার টাকা কয়েকজন সদস্য পরিমাণে বেশি দিতেন। বাদবাকি সবাই কমবেশ ভাগাভাগি করেই হতো। এতেও টান পরলে পরে অনন্ত বিজয় বাকিটা ম্যানেজ করতেন। হাসিমুখে কিভাবে জানি না সব ম্যানেজ করতে পারতেন। শুধু ম্যানেজ করতে পারেন নি ঘাতক জঙ্গিদের!
ততোদিনে আমরা বেশ গুছিয়ে নিয়েছি। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করেছি ঘটা করে। ঢাকঢোল পিটিয়েই। বিজ্ঞানবক্তা আসিফ ও তাঁর ডিসকাশন প্রজেক্ট নিয়ে আসেন প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। সে সময় বৈরী আবহাওয়া ছিলো সপ্তাহ জুড়ে। অনুষ্ঠানের দিন আবহাওয়া ছিলো আরও খারাপ। সে কি ঝড়বৃষ্টি! তারপরেও প্রচার প্রচারণা থেমে ছিলো না। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সামর্থ্যের থেকেও বেশি করার চেষ্টা করে গিয়েছিলাম। ব্যানার, পোস্টার নানান স্থানে সাঁটানো থেকে চিঠিপত্র বিলি করা সবই কম সময়ের মধ্যেই দ্রুত গতিতে আমরা করে ফেলেছিলাম। সিলেটের প্রায় সব বড়, ছোটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আমরা প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিলাম। সিলেটের ক্যাবল টিভিতে টানা দিন সাতেক বিজ্ঞাপনও হয়েছিলো। প্রেস রিলিজ সব স্থানীয়, জাতীয় পত্র-পত্রিকায় আমরা পাঠিয়েছিলাম। নিউজও হয়েছিলো। সমকালে বিজ্ঞান পাতায় নিউজটা হয়েছিলো। টিভিতে 'সারা দেশের খবরে' সংবাদও হয়েছিলো। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেও সেদিন লোক সমাগম হয়েছিলো দেখার মতো। নব পর্যায়ে 'শারদা স্মৃতি হল'র দ্বিতল অবধি লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী, বিজ্ঞানপ্রিয়, গুণগ্রাহী থেকে ছিলেন অনেক বিশিষ্ট জনেরা। এই প্রথম বড় বাজেটের বড় কোনো অনুষ্ঠান করি আমরা। বলা ভালো প্রথম অনুষ্ঠান হিসেবে সামান্য ভুলত্রুটি বাদে আমরা সফল হয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে অনেকেই আমাদের প্রশংসা করেছিলেন। সে বার-ই প্রথম প্রকাশ্যে আমরা নতুন করে কমিটি ঘোষণা করি। নতুন করে জনসমক্ষে আসি। আজ সময় পরিক্রমায় সব, সবাই আছেন। নেই শুধু অনন্ত বিজয় দাশ!
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনোর পর অনন্ত বিজয় দাশ প্রথমে কিছু দিন একটি নিউজ এজেন্সিতে কাজ করেন। এরপর প্রায় বছর খানেক এনজিও প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকে চাকুরি করেন। বড্ড খাটাখাটুনি দরুন তাও একদিন ছেড়ে দেন। পরে পূবালি ব্যাংকের জাউয়া বাজার শাখায় চাকুরি নেন। নিহত হওয়ার দিন পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। এরমধ্যেই রাজাকার কাদের মোল্লার ন্যায়বিচারের দাবিতে দেশের প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগের 'গণজাগরণ মঞ্চ' গড়ে ওঠে। সারা দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সেই ঢেউ সিলেটকেও আন্দোলিত করে। অনন্ত বিজয়ও অন্য আট দশজনের মতো সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের চেনা মুখ, প্রিয় মুখ। উদ্যোক্তাদের একজন। রোজকার অফিস করে যত তাড়াতাড়ি পারেন গণজাগরণ মঞ্চে এসে হাজির হতেন। ক্লান্তিশ্রান্তি ভুলে সবার সাথে ন্যায়বিচারের দাবিতে শ্লোগান মিছিলে মুখর হতেন। এইরকম মুখরময় সময়েই রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। এর সাথে 'আমার দেশ' পত্রিকার লাগাতার কুৎসামূলক একের পর এক লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। গণজাগরণ মঞ্চ, ব্লগ, ব্লগারদের সম্পর্কে পূর্ব পরিকল্পনার নীল নকশার জেরে সম্পূর্ণ কুৎসিতভাবে একের পর এক খবর প্রকাশ করতে থাকে মাহমুদুর রহমান। সব কেমন নিমিষে ধুলিসাৎ হয়ে যায়। ব্লগারদের নাম ধরে ধরে পত্র-পত্রিকায় একের পর একক নিউজ আসতে থাকে। ব্লগারদের লিস্ট বের হতে থাকে। অনেকের ছদ্মনামের আড়ালে ব্যক্তিগত পরিচিতিও বের হয়ে যায়। সে এক ভীতিকর অবস্থা।
সময় গড়ায় আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে যায়। ব্লগাররা গ্রেফতার হোন। হেফাজতের উত্থান ঘটে। ব্লগারদের উপর হামলা চলে। নিরাপত্তা পান কেউ কেউ। অনেকেই নিজ নিরাপত্তায় চলেন। কেউবা আত্মগোপনে থাকেন। এর মধ্যেই শংকায়-আশংকায় দুই বছর গড়ায়। বইমেলা উপলক্ষে দেশে আসেন অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদ দম্পতি। অনন্ত বিজয় আশংকায় ছিলেন তাঁদের নিয়ে। ২৬ ফেব্রয়ারি,২০১৫ ঢাকার একুশে বইমেলা থেকে ফেরত আসার পথেই ইসলামি জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হোন দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়। গুরুতর আহত হোন বিজ্ঞান লেখক, অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। এর পরের দিনই অনন্ত বিজয় ভোরে ছুটে যান ঢাকায়।
অভিজিৎ রায় ও এর পরে ওয়াশিকুর বাবু হত্যার মধ্যেই অনন্ত বিজয়কে অনেকটা অনুসরণ করে ফেলে জঙ্গিরা। অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসা থেকে বাসার আশেপাশে, অফিসের আশেপাশেও রহস্যজনক লোকের উপস্থিতি টের পান তিনি। দেখা গেলো আমরা কোথাও বসে গল্প করছি, চা-সিগারেট খাচ্ছি হঠাৎ অনন্ত বিজয়কে দেখতাম আশপাশ দেখে নিয়ে ইশারা করতেন উঠে যাওয়ার জন্য। বা রেস্টুরেন্টে বসে খেতে খেতে দেখতাম এক দুইজন কোনো না কোনভাবে আড়চোখে নজর রাখছে। আম্বরখানায় যে গলিটার মুখে আমরা আড্ডা দিতাম সেখানে শেষ দিকে একবার দু'জন কোত্থকে হঠাৎ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমি কি করি, না করি সব গড়বড় বলে গেলো।
ঘটনার হতভম্বতায় আমরা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারি নি। অনেক পরে টের পাই। তখন সব শেষ।তখন আর অনন্ত বিজয় তাঁর পুরাতন নাম্বার নিয়মিত ব্যবহার করেন না। দরকারে হঠাৎ হঠাৎ ফোন অন করেন, চেক করেন। যার ফলে যুক্তি পত্রিকার দ্বিতীয় নাম্বার হিসেবে আমার নাম্বারটা ছিলো। আমার কাছে মাঝেমধ্যে ফোন আসতো। হেয়ালী করে রহস্যময় প্রশ্ন করে অনন্ত বিজয়ের ওই নাম্বার বন্ধ কেনো জানতে চাইতো। একেক রাত রাত গভীরে ফোন দিতো। যাই হোক এসব যখন হচ্ছে তখন একদিন রাত দশ সাড়ে দশটায় অনন্ত বিজয় আসেন। সেদিন বেশ বিষণ্ণ ছিলেন। বললেন যে, তিনি বাসায় ছিলেন না তখন। কারা যেনো মোটর বাইক করে এসে তাঁর খোজ করে গেছে। দু'জন ছিলো। দু'জনেরই মাথায় হেলমেট পরা ছিলো। লোডশেডিং তখন। হেলমেট পরা ও বিদ্যুৎ না থাকার কারণে কারা কিরকম বয়স কিছুই বুঝা যায় নি। মিনিট চারেক মোটর বাইক স্টার্ট রেখেই কথা বলে দ্রুত চলে গেছে। পরিচয় দিয়েছিলো জিন্দাবাজারের ইলেকট্রনিক দোকান থেকে এসেছে। দোকানের বাকি টাকার জন্য নাকি এসেছে। উল্লেখ্য যে, জিন্দাবাজারে অনন্ত বিজয়ের এক পরিচিতের ইলেক্ট্রনিক দোকান আছে। কিন্তু বাকিটাকি বা মাস সাতেকের মধ্যে ইলেক্ট্রিক পণ্য কিনেছেন আসলে এমন কোনো কিছুই হয় নি! প্রস্তুতি নিয়ে এসেও সেদিন তারা তাঁকে পায় নি। এর পরে ঠিকই তারা তাঁকে হাতের নাগালে পেয়ে যায়!
এইরকম মৃত্যু ভীতির মধ্যেই 'পেন ইন্টারন্যাশনাল' সুইডেনের জন্য ভিসা প্রসেস করতে থাকেন। পাশাপাশি আইকর্নেও যোগাযোগ রাখেন। ভয়-আতংক মাথায় করেই এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি, অফিস করা, ঢাকায় যাওয়া আসা সবই করে যাচ্ছেন। মোদ্দাকথা নিহত হওয়ার আগের শেষ দু'মাস ভয়ানক অস্থির ছিলেন। ঘুম, নাওয়া-খাওয়া ভালো হতো না। উস্কোখুশকো চুল, বিষণ্ণ-মলিন চেহারার অনন্ত বিজয়কে এর আগে আমি, আমরা পরিচিত বন্ধু-বান্ধবরা কেউই এভাবে তাঁকে দেখি নি। যেদিন সুইডিশ এমবাসি ডাকলো সাথে আমি ছিলাম। এর আগে প্ল্যান মোতাবেক আমি আমার পরিচিত এক বন্ধুকে বলি আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য। মূলত ভয় থেকেই তাঁকে ডাকা। সেদিন সেই বন্ধু প্রায় সারা দিন তিনি আমাদের সাথে ছিলেন। তো পরে দেখা গেলো ইন্টার্ভিউ ভালো হয় নি। এরা নানান ঘোরেল প্রশ্নে তাঁর এই বিপর্যস্ত অবস্থায় তাঁর লেখক-ব্লগার পরিচিতিকে সামনে এনে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। ফলে ইন্টার্ভিউ যাচ্ছেতাই হয়েছে। আমাদের তিন জনেরই মন খারাপ। আগের দিন হোটেলে উঠে বিশ্রাম নিয়ে, প্রস্তুতি নিয়েও কোনো লাভ হলো না! সব কেমন প্যাঁচ লেগে গেলো। কেমন অসাড়, শূণ্য মনে হতে থাকে আমাদের। এদিকে মৃত্যু তাড়া করে বেড়াচ্ছে অনন্তকে! ভুক্তভোগী ছাড়া এই ধরণের অসহ্য স্নায়ুবিক, বেঁচে থেকে মৃত্যু যন্ত্রণা অন্য কেউ হয়তো বুঝবেন না। যা অনন্তকে শেষতক তাঁর জীবন দিয়ে সব চুকিয়েবুকিয়ে শেষ করতে হলো!
অনন্ত বিজয় দাশ এরপরে আবারও নির্দিষ্ট দিনে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে ঢাকায় রওয়ানা হোন। সেদিনও আমি তাঁর সাথে। সারা পথ কথা নেই কারো মুখে। দুরুদুরু বুকে ভিএফএস সেন্টারে আমরা হাজির হই। অপেক্ষার প্রহর ফুরায় না যেনো। হাঁটাহাঁটি করি আমরা। তখনো কিছুই খাই নি কেউই। সারা দিনে একবার মাত্র কাসুন্দি দিয়ে পেঁয়ারা খেয়েছি। আমরা এক জায়গায় সেই সময় বেশিক্ষণ দাঁড়াই নি। এর মধ্যে বার তিনেক ভুমিকম্পও হয়ে যায়। হুলস্থুল কাণ্ডের মধ্যেই আমরা টের পাই আরও এক দুই জন আমাদের অনুসরণ করছে। যা এর আগের বেলায় সিলেট যাওয়ার পথে গাড়িতেও টের পেয়েছিলাম। আমরা ভিড়ে ভিড়ে হাঁটি। কথাবার্তা খুব একটা বলি না। সিগারেটও বিস্বাদ লাগে। এক সময় ভিএফএস সেন্টারের ভেতরে যান অনন্ত বিজয়। প্রায় আধাঘণ্টা পর আসেন। মুখ ভারি। গম্ভীর। মুখ দেখে আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। সাহস হয় না। আমরা আশপাশ তাকিয়ে সোজা হাঁটতে থাকি। একটা সিএনজি খুঁজি। অনেক্ষণ পর পেয়েও যাই। দু'জনেই প্রায় নির্বাক আমরা। এভাবেই ভৈরব অবধি উজানভাটি রেস্তোরাঁয় চা-নাস্তা করি। ফিরি গভীর রাত্রে। সেই-ই ছিলো আমাদের দু'জনের এক সাথে শেষ কোথাও যাওয়া। এক সাথে দু'জনের শেষ ভ্রমণ!
মৃত্যুর আগের দিনও শনিবারে আমাদের সাথে তাঁর শেষ দেখা হয়। আম্বরখানায়। শনিবার রাত। তখন নয়, সাড়ে নয় হবে হয়তো। আমরা সেদিন কিছুই খাই নি। শিঙাড়া ভালো না বিধায় সামসুল আমীন, সুমন রহমান ও আমি খাই নি। অনন্ত বিজয়ের প্রিয় খাদ্যের মধ্যে শিঙাড়া একটি। দু'টো নিয়ে একটি খেয়ে ছিলেন। এই-ই বন্ধুদের সাথে নিয়ে এক সাথে শেষ খাওয়া। যদিও আমরা খাই নি। নিশ্চিত মৃত্যু পথযাত্রীর জেনেই কী সেদিন আমরা কিছুই খাই নি?! নাহ, তাঁকে আর পাই নি আমরা। কোত্থাও খুঁজে আর পাই নি তাঁকে। না অফিসে, না আড্ডায় না বাসায়! কোত্থাও না! কোত্থাও নেই অনন্ত বিজয় দাশ! এই বোধ-অবোধ আর্তনাদ কান্না হাহাকার চাপিয়ে এখন শুধু শক্তি চাটুজ্যেই কানে বাজে... ... ...
আধেকালীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অনন্ত বাড়ি আছো?’
কৃতজ্ঞতা: Farzana Kabir Khan
2 মন্তব্যসমূহ
Excellent weblog right here! Additionally your site loads up very fast! What web host are you the use of? Can I get your associate hyperlink to your host? I wish my website loaded up as quickly as yours lol paypal mastercard login