বরাক উপত্যকা নামটি নেহাৎই অর্বাচীন । দক্ষিণ আসামের এই ভূগোল বরাবর কাছাড় জেলা নামেই পরিচিত ছিল । কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি এই তিনটি জেলা নিয়ে যে বর্তমান বরাক উপত্যকা এর জনসংখ্যা অন্ততঃ চল্লিশ লক্ষ এবং এই বিশাল জনসমষ্টির অন্তত আশি শতাংশই বাংলাভাষী । উত্তর-পূর্ব ভারতে, এটা সুপরিজ্ঞাত, ভাষা একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় এবং শতাধিক বছর ধরে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের যে ধারাটি এখানে পুষ্ট হয়ে উঠেছে তা মূলত ভাষাভিত্তিক ।ভাষাভিত্তিক এ ধারণাটির জন্মদাতা অবশ্যই অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি। উনবিংশ শতাব্দির শেষের দিক থেকেই বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক কারণে অসমিয়া মধ্যবিত্ত সমাজের মনে এক ধরনের ভীতি বিরূপতা গড়ে ওঠে বাঙালিদের সম্পর্কে ।
তাঁদের আশঙ্কা ছিল, ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিদের জন্য অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে । এই আতঙ্ক আসামের শাসকশ্রেণিকে বারবার বাঙালি-বিরোধী নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছে ।এরই ফলস্বরূপ হিসাবে ১৯৬০ সালে আসাম সরকার সরকারি ভাষা আইন পাশ করে অসমীয়াকে ইংরেজির পাশাপাশি একমাত্র রাজ্যভাষা হিসাবে মর্যাদা দান করে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন তৎকালীন কাছাড় জেলার মানুষ ।এই প্রতিবাদ গণআন্দোলনের রূপ নিলে আসাম সরকার তাদের দমন করার জন্য সীমাহীন অত্যাচার শুরু করে। ফলশ্রুতিতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেলস্টেশনে নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিস বিনা প্ররোচণায় গুলিবর্ষণ করে এগারোজন তরুণ তরুণীকে হত্যা করে । এই গুলিচালনায় প্রথম শহিদ হন কমলা ভট্টচার্য, যিনি সারা বিশ্বে ভাষা সংগ্রামের প্রথম মহিলা শহিদ ।
দেশের অন্যান্য রাজ্যের জনসাধারণ এর সমর্থনে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে আসাম সরকার নতিস্বীকার করে এবং দাবির আংশিক পূরণ হিসাবে তৎকালীন কাছাড় জেলার সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় এবং ১৯৬০ সালের ভাষা আইনে পরিবর্তন করা হয়।
পরবর্তীকালেও সরকারের মনোভাবের কোনও পরিবর্তন হয় নি, ফলে আবার আসামীয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্য ভাষা করার গোপন ফন্দি করা হয়। এক অগণতান্ত্রিক নির্দেশনামার মাধ্যমে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আসামে কলেজস্তরে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসাবে অসমীয়া ভাষা প্রচলনের উদ্যোগ নিলে ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট করিমগঞ্জ শহরে আত্মদান করেন আরো এক যুবক ।
এর পর মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ভাষাকে বাতিল করার প্রতিবাদে ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই আরো দুই যুবক পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন করিমগঞ্জে । এর পর ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ আরো একজন মহিলা পুলিশের গুলিতে শহীদ হন বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি ভাষার অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে ।
আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সম্ভবত এ অঞ্চলের এই প্রতিবাদী সংস্কৃতিই বহুভাষিক আসামের
সাংস্কৃতিক বহুত্বের প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে । প্রতি বছর বরাক উপত্যকাসহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ১৯ মে কে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বলিদানকৃত মহৎ প্রাণদের জানাই প্রণাম ।
ভাষা শহিদ অমর রহে ।
পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার জয় হোক ।
0 মন্তব্যসমূহ