দক্ষিন বিহারের
অনেক গ্রামে গঞ্জে "দোলা" বলে এক নিয়মের প্রচলন এখনও আছে। জানেন বিষয়টা
কি? কোনো দলিত ভূমিদাস বিয়ে
করলে তার নতুন স্ত্রীর সাথে ফুলশয্যার রাত কাটাতে পারেন না, ফুলশয্যার রাতে তার নববধুকে দিয়ে আসতে হয়
ভূস্বামীর কোঠায়। শুনে ভাবছেন এসব আজকাল আর হয় না তাই তো? বিহারে দলিত রাজনীতির সাথে যুক্ত এমন কাউকে
জিগ্গেস করে দেখতে পারেন। বিহারের ৭৫% দলিত পরিবার ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক আজও। শুধু
অর্থনৈতিক না, তাদের যে
সামাজিক শোষণের সম্মুখিন হতে হয় প্রতিনিয়ত
তা শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ব বিশ্বাসই করবে না। এই দলিত ভূমিহীন শ্রমিকদের একটা বড়
অংশ Bonded Labour, অর্থাত তারা
চাইলেও ভূস্বামীর জমি ছেড়ে অন্য কোথাও কাজ করতে পারবে না। আর এই ব্যবস্থা চলে
বংশানুক্রমে। বিহারের ভূমিহার ও রাজপূত ভূস্বামীরা দলিত কৃষি শ্রমিকদের শুধু শ্রম
অধিকার করেনা তাদের পরিবারকেও নিজেদের সম্পত্তি মনে করে। দলিতের ছেলে মেয়েরা
জন্মাই এই ভূস্বামীদের জমিতে শ্রম দেওয়ার জন্যে, তাদের পরিবারের বউ মেয়েরা ধর্ষিতা হওয়ার জন্যে।
৭-এর দশকের শেষের
দিকে বিহারে ভূমি সংস্কারের আন্দোলন শক্তিশালী হতে থাকে মূলত নকশালদের হাত ধরে।
পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে জমি দখল হয়েছিলো তার এক দশক আগে সেইভাবেই বিহারের গ্রামে
গ্রামে দলিত ভূমিহীন কৃষকরা নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে একজোট হতে থাকে। আর এই
আন্দোলন ঠেকাতে তখন থেকেই উঁচু জাতের ভূস্বামীরা শুরু করে একের পর এক দলিত
গণহত্যা। বেলচি, পিপড়া, পারসবিঘা একের পর এক গ্রামে উঁচু জাতের
ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী রাষ্ট্রের পরোক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ মদতে ঘটাতে থাকে
হত্যালীলা। ৮-এর দশকে মাঝামাঝি তৈরী হয় সেই কুখ্যাত রনবীর সেনা। অত্যাধুনিক
অস্ত্রে সজ্জিত এবং পুরোদস্তুর সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এই বাহিনী দলিত গণহত্যাকে
এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। একের পর এক ঘটতে থাকে বাথানি তোলা, একয়ারী, হইবাসপুর, লক্ষণ বাথের মত গণহত্যা। প্রায় প্রতিটি
ক্ষেত্রেই আক্রমনের ধরন এক। রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত দলিত বস্তিতে হামলা চালিয়ে মূলত
নারী ও শিশুদের খুন। মুসলমান ও OBC রাও ছাড় পায়নি
কিছু ক্ষেত্রে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে বাথানি তোলা বা লক্ষণপুর বাথেতে এক দু বছরের শিশুদের জ্যান্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলে
দেওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। লক্ষণপুর বাথেতে
৬১ জন দলিত নিহত হন যাদের অধিকাংশই মহিলা ও শিশু। এই গণহত্যার জন্যে কতজনের সাজা হয়েছে
বলতে পারবেন? উত্তর হলো একজনও
না। ২০১৩ তে পাটনা হাই কোর্ট শেষ ২৬ জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দেয় প্রমানের
অভাবে। এতে আশ্চর্য্য হবেন না, তাও তো আদালত
অবধি গেছে। অনেক হত্যাকান্ডকে পুলিশ গ্যাং ওয়ার বলে ধামা চাপা দিয়েছে। এমনকি ৮৬
সালে আরয়াল জেলায় গণহত্যার দায়িত্ব পুলিশ নিজের কাঁধে তুলে নেয়, বেয়াইনি
জমি দখলের প্রতিবাদ রত ২১ জন নিরস্ত্র দলিতকে গুলি করে মারে পুলিশ। ঠিক তার
কয়েক দিন আগেই ততকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওই
এলাকার ভূস্বামীদের একটি জনসভায় আশ্বাস দিয়েছিলেন যে নকশালদের টাইট দেওয়ার
ব্যবস্থা করছেন এবং ওই গণহত্যার ৩ দিন আগে এক নতুন পুলিশ সুপারকে নিয়োগ করা হয়।
তা আজকে হঠাত এই
প্রসঙ্গ উত্থাপন করার কারণ কি?
সম্প্রতি
কোবরাপোস্ট নামের এক সংবাদসংস্থা এক স্টিং অপারেশন করেছে বিভিন্ন রনবীর সেনা
কম্যান্ডারদের ওপর। সেখানে এই কম্যান্ডাররা যারা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা
খোলামেলা ভাবে স্বীকার করেছে সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদতের কথা। তারা বিশেষ
ভাবে কৃতজ্ঞ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতি। নাম এসেছে তাদের একাধিক নেতার এমনকি
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদেরও। যশবন্ত সিনহা,
সি পি ঠাকুর, মুরলী মনোহর জোশী, সুশীল মোদী সকলের মদতের কথা অকপটে স্বীকার করতে
দেখা গেছে রনবীর সেনার কম্যান্ডারদের। অস্ত্র দেওয়া, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং যাতে
জেল না যেতে হয় তার সমস্ত ব্যবস্থা করা এই সবই করেছে বিজেপির নেতারা। অন্যান্য
রাজনৈতিক দলেরও নাম জড়িয়েছে তবে বিজেপির সাহায্য যে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে এতে কোনো
সন্দেহ নেই। বিজেপিরও যে খুব রাখঢাক আছে এই বিষয়ে এমন না। ব্রহ্মেশ্বর মুখিয়া
যে ছিলো রণবীর সেনার সুপ্রিম কম্যান্ডার,
লক্ষণপুর বাথের
গণহত্যার মূল চক্রী, তাকে বিজেপির
এমপি এবং প্রাক্তন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ "বিহারের গান্ধী"
বলে সম্মানিত করেছেন।
আমার কাছে এ খুবই
স্বাভাবিক ঘটনা। বিজেপি উচ্চবর্ণ হিন্দুদের দল, তারা যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে সেটা আসলে বর্ণ হিন্দুদের জমিদারী। রাম রাজত্বে
ব্রাহ্মনদের জান মাল সুরক্ষিত থাকার কথা রামায়নে থাকলেও "নিম্ন" বর্ণের
কি দশা ছিলো তা রামায়নে নেই। পশ্চিমবঙ্গের অনেক বিজেপি ভক্ত দেখি যারা "নিম্ন" বর্ণের বা তফসিলি
জাতির পরিবার থেকে এসেছেন। তাদের কাছে প্রশ্ন যে আপনারা যাকে সমর্থন করছেন তাদের ইতিহাসটা জেনে
করছেন তো?
কোবরাপোস্টের
স্টিং অপারেশন সম্পর্কিত লিংকঃ http://thewire.in/2015/08/17/ confessions-from-bihars- killing-fields-set-to-singe- bjp-and-nitish-too-8661/
0 মন্তব্যসমূহ