পৃথিবীর আয়তনের প্রায় ৭১% জল। সেই জলের আবার প্রায় ৯৬% নোনা জল। অর্থাৎ জলের বেশিরভাগটাই সমুদ্রে। যা পান ও গ্রহণের অযোগ্য। বাকি থাকে ৪% মিঠে জল। সেই মিঠে জলের আবার ৬৯% বরফ হয়ে জমে, যা আবার মোট জলের ১.৭%। পড়ে থাকে দুই শতাংশের কিছু বেশি মিঠে জল। এই মিঠে জলও আবার সবটা ব্যবহারযোগ্য নয়। কড়ি গুনে পাইপয়সার হিসেব না দিয়ে বলা যায়, মোট জলের ১%-র কম জল নিয়ে পৃথিবীতে জীবন এগিয়ে চলছে।
এই জল নিয়ে গাছ, এককোষী জীব থেকে আপনি-আমি বহাল তবিয়তে আছি। জল আছে মানে জীবন থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তাই ভিনগ্রহে জীবনের খোঁজে অনুসন্ধানীরা জল খোঁজেন, জীবন নয়। জল ছাড়া পৃথিবীও থাকবে,কিন্তু মৃত গ্রহ হয়ে।পৃথিবীতে পরের যে বিশ্বযুদ্ধটা হবে, তা জলের অধিকার নিয়ে। তেল বা অন্য খনিজ সম্পদের থেকেও মহামূল্যবান হতে চলেছে জল। তার আভাস কিছুটা পেতে চলেছি। যা ছিল প্রকৃতির স্বাভাবিক দান, তা অনেক জায়গায় টাকা দিয়ে কিনতে হয়। আফ্রিকা বা উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় জল পেতে হচ্ছে রক্তের বিনিময়ে। সর্বোন্নত দেশ আমেরিকাও এই সংকটের বাইরে নয়। আমেরিকার পশ্চিমাংশ বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া জল সংকটে যুঝছে।
জলের কথা বলতে গিয়ে এক গ্রামের আখ্যান বলতে ইচ্ছে হল। ভারতের ছোটনাগপুর মালভূমির শেষপ্রান্তের গ্রাম কাজোড়া। এই ভূমি প্রাচীন গান্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ। বাংলার অন্যান্য অংশের মত পলিমাটি গঠিত নবীন নয় এই ভূমি, বরং এর গঠন অতি প্রাচীন। পাথরের আধারে কোটি কোটি বছর ধরে সঞ্চিত জল এখানের প্রাণীকূলকে বাঁচিয়ে রেখেছে। খনিজ সমৃদ্ধ এই জলের টানে মূল বাংলা থেকে ধনী বাবুরা হাওয়া পাল্টাতে আসতেন। গিরিডি, যশিডি, দেওঘর এই ছোটনাগপুর মালভূমিরই অংশ।
কাজোড়ার জল সংকটের কথা বললে গোটা পৃথিবীর জল সংকটের চিত্রটাও পরিষ্কার হবে। সমুদ্রে না গিয়ে ঘরের পাশের শিশির বিন্দু নিয়ে কথা বলি।তার আগে গ্রামের ছোট্ট ইতিহাস বলেনি। বাঙালি চিরকালই ইতিহাস বিমুখ। তাই কথ্য ইতিহাসের সাথে সামাজিক অবস্থানের তুলনা করে বাঙালির ইতিহাস রচনা করতে হয়।
কাজোড়া নাম কিভাবে এল তাও জানা যায় না। তৎসম শব্দের অনুরাগী বাঙালিদের মত এখানেরও প্রাচীনেরা বলেন কর্জটক অপভ্রংশিত হয়ে কাজোড়া এসেছে। যদিও মনে হয় কোন ছোট্ট নালা বা নদীর নাম থেকে গ্রামের নাম। প্রাচীনকালে এখানে জলের মূল উৎস ছিল মিষ্টি জলের ছোট ছোট নালা, যা স্থানীয় অধিবাসীরা জোড় বলে ডাকে। সেখান থেকেও গ্রামের নামের উৎপত্তি হতে পারে। জলকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রামের নাম।
নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়েও এখানের অধিকাংশ মানুষ বাংলার মূল স্রোতের সাথে যুক্ত নয়। তাদের শিকড় উড়িষ্যায় বাধা। লিখিত ইতিহাস নেই। যা আছে পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ। যেমন বেলেপাথরের তৈরি মন্দিরগুলোতে উড়িষ্যার স্থাপত্যরীতির ছাপ স্পষ্ট। বাংলার খুব কম গ্রামেই জগ্ননাথের মন্দির আছে, এখানে আছে। পতি, পন্ডা, জমিদার পদবী উড়িষ্যায় প্রচলিত, যা এখানেও বিদ্যমান। কথ্যরীতিতে এখনো উড়িষ্যার ছাপ সুস্পষ্ট।
এছাড়াও গ্রামে বাস করে ভারতের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর লোকজন। বাউরি, বাগদি, রুইদাস সম্প্রদায়ের লোকজন গ্রামের শেষপ্রান্ত ঘিরে বাস করে। গ্রামে বসবাসকারী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোকজন উড়িষ্যা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বর্গী আক্রমণের ভয়ে। আর এই প্রান্তিক ভূমিপুত্রদের হয়ত ব্যবহার করা হত দস্যু আক্রমণ থেকে নিজেদের বাচিয়ে রাখতে।
এই গ্রাম ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন গ্রামগুলোর মতই। নিজেদের প্রয়োজন নিজেরাই জুগিয়ে নেই। জলের জন্য গ্রামের চারিদিকে বড় বড় দিঘি খনন করা হয়েছিল। যা গ্রামের মানুষের স্নান থেকে পানীয় জলের সমস্যা মেটাত। পরে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়তে পাথর কেটে প্রচুর কুয়ো খনন করা হয়। প্রায় প্রতি বাড়িতেই কুয়ো দেখতে পাওয়া যায়।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানির দৌলতে এই অঞ্চলে ব্যানিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। সাথে জনবিস্ফোরণও ঘটতে থাকে। সারা ভারত থেকে কালো হিরের টানে ভিড় বাড়তে থাকে। কাজোড়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও বিপুল জনবৃদ্ধি ঘটতে থাকে।সঞ্চিত জলের সাথে জনসংখ্যা যে অনুপাতে থাকার কথা তা বিগড়োতে শুরু করে। সেই শৈশবের পাটিগণিতের মত। চৌবাচ্চায় একটা পাইপ দিয়ে যত জল বেরোচ্ছে তার থেকে অনেক কম চৌবাচ্চাতে ঢুকছে। কাজোড়া গ্রাম দামোদরের সন্নিকটে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দামোদর নদের উপর বাঁধ গড়ে উঠতে থাকে। ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ হয়। যে নদের বড় অবদান ছিল সঞ্চিত জলের সমতাকে বজায় রাখার, সে নিজেই মরাখাতে পরিণত হয়।
তার সাথে শুরু হয় অবাধে কলকারখানা স্থাপন, সাথে শ্রমিকদের জন্য বসতি স্থাপন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে প্রাচীন অরণ্যভূমি ধ্বংস করে ফেলা হয়। গাছ জল ধরে রাখা ও মাটির গভীরে পৌছে দেওয়ার এক অদ্ভুত যন্ত্র। ফলে মাটির গভীরের চৌবাচ্চায় জল ঢোকার পরিমাণ আরো কমতে থাকে। উপরন্তু শিল্পাঞ্চল ও আবাসানের জন্য জল অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাবহার হওয়া শুরু হয়। আবার সেই পাটিগণিত। জল ঢোকার পরিমাণ কম, নির্গমনের হার অধিক। ফলে প্রকৃতির সঞ্চয় খালি হতে শূরু করে। যদিও বিপদ কেউ গণনা শুরু করেনি।
২৫-৩০ বছর আগে থেকে মানুষেরা বুঝতে শুরু করে গন্ডগোল কোথাও হয়েছে একটা। সমস্যা বছর-বছর বাড়তে শুরু করে। এক অঞ্চলে জল নেই তো, অন্য অঞ্চলের যে নিশ্চয়তা ছিল, তা সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে। এখন শুধু কাজোড়া গ্রাম নয়, কাজোড়া থেকে চিত্তরঞ্জন পুরো অঞ্চলেই তিন-চারমাস জল না থাকাটা স্বাভাবিক ঘটনা।
কোন কিছু হলেই রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দোষ চাপানো স্বাভাবিক ঘটনা। আর নেতা কর্মীরাও নিজেদের আখের গোছাতে এতটাই ব্যস্ত যে জনরোষ কমাতে সাময়িক উপশমের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে। নেতাদের হাত ধরে কাজোড়া গ্রামে জলের ট্যাঙ্কার ঢুকতে শুরু করে। মানুষেরা সব ভুলে সেই জল যতটূকু পারে সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রশ্ন করা ভুলে যায়।
এত জল গেল কোথায়? জলের সমস্যা মেটাতে সরকারের দায়বদ্ধতা কোথায়? বাড়ি বাড়ি জলের পাইপ নেই কেন? আশেপাশের নদীগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে না কেন? যে বিশাল বিশাল কৃত্রিম জলাধারগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলো দিয়ে কেন গোটা শিল্পাঞ্চলে জল সরবরাহের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে না?
প্রশ্ন করার অভ্যেসটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জল চাই বললেই তা শাসক দলের কাছে ঘোর অপরাধ। ট্যাঙ্কার চাও, দেব। কিন্তু জলের স্থায়ী সমাধান খুঁজলে বিরোধী বা দেশদ্রোহী বানানোর অপচেষ্টা। যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে মানুষের গলা চেপে রেখেছে। জল চাওয়াটা না কোনদিন রাজদ্রোহিতা বলে আইনি স্বীকৃতি পেয়ে যায়!
যদিও এই সমস্যা রাজনৈতিক নয়। সরকারের একার পক্ষে এই সমস্যা প্রতিরোধ করাও সম্ভব নয়। জনগণ ও সরকারের মধ্যে মেলবন্ধন জরুরি। নেতাদেরও মানুষকে বোঝানো দরকার। কিন্তু যাবার সময়, সামর্থ বা সাহস কোনটাই এই নেতাদের নেই। নিরক্ষরেরা রাজদন্ড হাতে পেয়েছে। প্রশ্ন এলে নেতারা উত্তর দিতে গড়াগড়ি খেতে বাধ্য। বিরোধীদের চক্রান্ত আর পূর্বতন সরকারের অক্ষমতার বাধা বুলি আওড়াবে।মানুষের জন্য নিজের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গর্হিত অপরাধ। মানুষ গোল্লায় যাক, চুরিবাদ জিন্দাবাদ। মানুষকে বোঝানোর কেউ নেই।
বৃক্ষরোপণ, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, নিয়ন্ত্রিত উপায়ে জলের ব্যবহার, ব্যবহৃত জলের পুনঃব্যবহার বা সঞ্চয়, গভীর নলকূপ থেকে বিরত থাকা, দিঘি-পুকুরের সংস্কার বা ছোট ছোট জলাধার নির্মাণ - এগুলোর মাধ্যমে জলসমস্যা থেকে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে এগোনো যেতেই পারে। তা জনগণ ও সরকারের মিলিত উদ্যোগেই হতেই পারে। কিন্তু নেতাদের সময় কোথায়?
কোথাও পড়েছিলাম এক ঘনসেন্টিমিটার মাটি তৈরি হতে এক হাজার বছর লাগে, আর এক ফোটা জল তৈরি হতে কত লক্ষ বছর লেগেছিল কে জানে? আর আমরা কয়েক বছরে লক্ষ লক্ষ গ্যালন জল নষ্ট করে ফেলেছি। এভাবে চললে বাংলার এই অংশ জলশূন্য ও জনশূন্য হতে বেশি দূরে নেই। সকলকে এগিয়ে এসে জলের জন্য সামাজিক আন্দোলন করতেই হবে। নাহলে ইতিহাস বিমুখ জাতি আবার সেই চর্বিতচর্বণ করবে আমাদের আদিবাস ছিল সেই গ্রামে।
1 মন্তব্যসমূহ