আমাদের গ্রামের পাশে সজল ধারা প্রকল্পে পাইপ বসানোর জন্য কয়েকজন মিস্ত্রী এসেছিল। তারা সারাটাদিন এ গ্রামে ও গ্রামে পাইপ বসাত, রাতের বেলায় আমাদের গ্রামে নদীর ধারে তাবু খাটিয়ে থাকত। অধিকাংশের বাড়ি ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ক্যানিং ২ ব্লকের কোনো এক গ্রামে। ওরা জাতিতে ছিল মুসলমান। আমি অবশ্য মানুষ ভাবতে বেশি পছন্দ করতাম। ওদের মধ্যে একটি ছেলের সাথে আমার সবচেয়ে বেশি পরিচয় ছিল। ছেলেটির নাম মুজাম, পুরো নাম জানিনা , বছর ১৭র বেশ স্মার্ট সুপ্রতিভ চেহারা , চোখে-মুখে বুদ্ধির ঝিলিক যেন উঁকি মারছে। ও এলাইনে নতুন বলে কাজ কিছুই জানত না। ওর দ্বায়িত্ব ছিল মিস্ত্রীর সাথে ধরাধরি করে দেওয়া ও রাতে রান্না করা। যাকে হেল্পার বলা চলে, রোজ ১২০ টাকা বেতন।
প্রায় সন্ধ্যায় আমি ওই তাঁবুতে গিয়ে আড্ডা মারতাম। কয়েকজন খৈনী মলতে মলতে তাস খেলত আর বাকিরা পরের দিনের কাজের লিষ্ট তৈরী করত, ফলে ওদের সাথে গল্প ঠিক জমত না। তাঁবুর বাইরে মুজাম ইঁটের উনুনে ভাত চাপিয়ে নদীর দিকে একদৃষ্টি চেয়ে কী যেন ভাবত? আমাকে দেখলেই বালির বস্তার দিকে ইঙ্গিত করে বলত "বসেন"। ওর মুখে শুনেছিলাম , ওর লেখাপড়া করায় খুব আগ্রহ ছিল কিন্তু আব্বা ডায়রিয়াতে মারা যাওয়ার পর সংসারের সমস্ত দ্বায়িত্ব ওর কাঁধে এসে পড়েছে। ওরা তিন ভাইবোন, ওই সবচেয়ে বড়। ওর আম্মা অবশ্য বিঁড়ি বাধেন কিন্তু যা রোজকার তাতে চারজনের একবেলা পেটচালানোও অসম্ভব। ওর অবশ্য আশা আছে পরের বছর 'ও' পাইপ মিস্ত্রী হতে পারবে -- মানে রোজ ৩২০ টাকা।
ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কোনো কথা উঠলে মুজাম বলত , 'আপনারা ভগবান বলেন আর আমরা আল্লা বলি। এর মধ্যে পার্থক্য কোথায়? ' আমি অবশ্য কেন ভগবান নেই? কেন থাকতে পারে না ? যুক্তি তর্কে যেতাম না , হয়তো ওর সারল্য মুখখানা দেখে । একবার রোজার সময় ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ' তুমি রোজা করছ না কেন ?' আমাকে অবাক করে 'ও' বলেছিল ''আল্লা আমাকে খাওয়াবে না। গতর খাটিয়ে খেতে হবে। রোজাও করব আর কাজও করব, দুটো একসাথে হতে পারে না'' । তারপর আমি বলেছিলাম আচ্ছা মুজাম , ''তোমাদের ধর্মের মানুষদের মধ্যে চোর, গুন্ডা, খুনী কেন বেশী হয়? '' মুজাম উত্তেজিত না হয়ে বলল, "মূর্খ্যসুখ্য মানুষ অতসব বুঝিনা কিন্তু আপনি কোথায় জানলেন?'' অবাক হয়ে বললাম, বা রে ! প্যাপারে পড়েছি। মুজাম তাচ্ছিল্য হেসে বলল , "ও" !
তারপর
খানিকটা ফিসফিস করে বলল, ''আমাদের এই সাইটের মালিক
হিন্দু, কত নিম্নমানের সামগ্রী
দিয়ে কাজ করাচ্ছে, আপনি
জানলে শঙ্কিত হবেন। এরা
চোর নয় ? প্রতিদিন সকালে
চায়ের দোকানে হাজার হাজার
চুরির গল্প শুনি, ওরা
কী সবাই মুসলমান? আমরা
গ্রামে কীরকম ভয়ে সেঁটিয়ে
থাকি, আপনি ভাবতেও পারবেন
না। আমাদের পাশের গ্রামগুলি
সব হিন্দু, ওই সব গ্রাম
গুলি থেকে সাইকেল, গরু
এমনকি একটা ঘটি পর্যন্ত
চুরি হলে পুলিশ এসে
আমাদের গ্রাম তছনছ করে
চলে যায়। দু একজন
কে থানায় নিয়ে গিয়ে
অকথ্য অত্যাচার করে এবং মিথ্যে
চুরির দায়ে ফাঁসিয়ে দেয়। আমার আব্বা মারা যাওয়ার
বেশ কয়েক মাস আগে
পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল
গরুচুরির দায়ে, পরে গরুটি
খুঁজে পাওয়া যায় পাশের
গ্রাম থেকে। একজন ব্যক্তির
ফসল নষ্ট করার জন্য
তিনি তার গোয়াল ঘরে
বেঁধে রেখেছিলেন। তবুও পুলিশ গ্রেফতার
করার পারিশ্রমিক বাবদ দশহাজার টাকা
চায়, নয়তো মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়,
পাক্কা দুই বছরের জেল। আমরা গরীব মানুষ অত
টাকা কোথায় পাব? আম্মা
গ্রামের মোলবী কে ধরাধরী
করে দশহাজার টাকা ধার নিয়ে
আব্বাকে ছাড়িয়ে এনেছিল। যেহেতু
সাচ্চা মুসলমানদের সুদ নেওয়া হারাম, তাই মাকে প্রতিদিন মোলবীর
বাড়িতে ঝি এর কাজ
করতে হয়। ওই মোলবীর
তিনটি বিবি থাকা সত্ত্বেও
আমার বোনকে স্বাদী করতে
চায়, আমরা রাজী হয়নি
বলে প্রতিদিন ধর্মীয় ফতোয়া দিয়ে
শাঁসিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শয়তানটাকে
খুন করতে ইচ্ছে হয় ।"
দেখছি ওর চোখে আগুন ঠিকরে বার হচ্ছে। আমি প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বললাম , 'তাহলে ডিম ভাজা হলেই রান্না শেষ'।আমার কথা সামান্য কর্ণপাত না করেই বলল ''বলুন তো বিপ্লব দা, আমাদের জাতের ছেলেগুলোকে হোটেলে কাজ দেবেনা, দোকানে রাখবে না, অফিসে কাজ দেবেনা, ছেলেগুলো করবেই কী? আর খাবেই কী? ওরা আমাদের এই দেশের মানুষ বলে মনেই করে না। কথায় কথায় পাকিস্তান যাওয়ার হুমকি দেয়। আচ্ছা পাকিস্তান গেলে ভালো কাজ মিলবে ? ওটা কোথায় বিপ্লব দা ?" খানিকটা বিড়বিড় করে বলল, ''এখানে জন্মেছি অন্য কোথাও যাব কেন ?''
দেখছি ওর চোখে আগুন ঠিকরে বার হচ্ছে। আমি প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বললাম , 'তাহলে ডিম ভাজা হলেই রান্না শেষ'।আমার কথা সামান্য কর্ণপাত না করেই বলল ''বলুন তো বিপ্লব দা, আমাদের জাতের ছেলেগুলোকে হোটেলে কাজ দেবেনা, দোকানে রাখবে না, অফিসে কাজ দেবেনা, ছেলেগুলো করবেই কী? আর খাবেই কী? ওরা আমাদের এই দেশের মানুষ বলে মনেই করে না। কথায় কথায় পাকিস্তান যাওয়ার হুমকি দেয়। আচ্ছা পাকিস্তান গেলে ভালো কাজ মিলবে ? ওটা কোথায় বিপ্লব দা ?" খানিকটা বিড়বিড় করে বলল, ''এখানে জন্মেছি অন্য কোথাও যাব কেন ?''
না আমি আর সেখানে
বসতে পারিনি। ওর চোখের জলের
উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার
ছিলনা। পরের দিন সন্ধ্যায়
গিয়ে দেখি সবাই নিজের
কাজে ব্যাস্ত, ভাত চেপেছে কিন্তু
মুজাম কে কোথাও খুঁজে
পেলাম না। কারন জিজ্ঞেস
করাতেই একজন বললেন, 'ওর
ভাগ্যই খারাপ গরীব ঘরের
ছেলে দেখে এনে ছিলাম, কিন্তু আল্লা শেষ রক্ষা
করলেন না।' আমি চটে
গিয়ে বললাম মুজাম কোথায়
গেছে বলুন না ? একজন বললেন "বিকেলে বাড়ি চলে
গেছে "।
চলে গেছে ! মানে !
আজ বিকেলে ওর ফোন
এসেছিল গ্রাম থেকে। সকালে
পাশের গ্রামে গরু চুরি
কে কেন্দ্ৰ করে বড়সড় দাঙ্গা
ঘটে গেছে ওর গ্রামে। ঘর বাড়ির সঙ্গে ওর
মাকে জীবন্ত জ্বালিয়ে
দেওয়া হয়েছে। বোন কে খুঁজে
পাওয়া যায়নি। ভাই কে
দাঙ্গায় উস্কানির জন্য পুলিশে নিয়ে
গেছে।
সত্যি, কিছু মানুষ আছেন, যাদের
শোবার বিছানা পুড়িয়ে দিলেও
কিছু বলবেন না। কিন্তু
ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি হলেই, তারা হয়ে উঠেন হিংস্র, নিষ্ঠুর ও বর্বর। ফলে যা হওয়ার
তাই হল, নিরীহ মুজামের
পরিবারটা শেষ হয়ে
গেল।
মুজাম
হয়তো এখনো পৌঁছায় নি। চোখের জলে হয়তো বাস
ভিজছে। কিন্তু আমি মানসচক্ষে
দেখতে পাচ্ছিলাম, একটা আধজ্বলন্ত টালির
ঘর, জিনিস পত্ৰ সব
ছড়ানো-ছিটানো, সেই ঘরের বারান্দায়
পড়ে আছে অর্ধনগ্ন-আধপোড়া
মুজামের মা। পাশের ঝোপে
আকাশের দিকে চেয়ে আছে
একটি বিবস্ত্র ক্ষতবিক্ষত নারীর শরীর। তার
জীবনের সমস্ত স্বপ্ন হয়তো
ক্রমাগত অভিশাপ দিয়ে চলেছে
এই সমাজকে। জেলের লকাপে পুলিশের
মারের চোটে অজ্ঞান অবস্থায়
লুটিয়ে আছে একটি ছেলেস। হয়তো একটু পরেই ফায়ারিং
স্কোয়াডের সামনে দাড়াবার প্রস্তুতি
নিচ্ছে।
রাতের জমজমাট আসরে পদ্ম এবং চাদঁতারা মিলেমিশে একাকার। হয়তো ফায়দার হিসেব কষছেন আর আমি বালি বস্তার উপর বসে বোকার মতো ভাবছি, কাদের বাড়ি জ্বলছে ? মুজামের মতো পরিবারের বাড়ি গুলি। কারা জ্বালাচ্ছে? মুজামের মতো খেটে খাওয়া মানুষগুলি। কাদের স্বার্থে? কতকগুলি পরিশ্রম বিমুখ ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থে। সত্যিই মন্দিরের পুরোহিত হোক বা মসজিদের মৌলবী, নেতা হিন্দু হোক বা মুসলিম, তাদের বাড়ি জ্বলতে দেখা যায়নি আর কোনোদিন যাবেও না !!
রাতের জমজমাট আসরে পদ্ম এবং চাদঁতারা মিলেমিশে একাকার। হয়তো ফায়দার হিসেব কষছেন আর আমি বালি বস্তার উপর বসে বোকার মতো ভাবছি, কাদের বাড়ি জ্বলছে ? মুজামের মতো পরিবারের বাড়ি গুলি। কারা জ্বালাচ্ছে? মুজামের মতো খেটে খাওয়া মানুষগুলি। কাদের স্বার্থে? কতকগুলি পরিশ্রম বিমুখ ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থে। সত্যিই মন্দিরের পুরোহিত হোক বা মসজিদের মৌলবী, নেতা হিন্দু হোক বা মুসলিম, তাদের বাড়ি জ্বলতে দেখা যায়নি আর কোনোদিন যাবেও না !!
0 মন্তব্যসমূহ