রাজমহল ছোটনাগপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অরন্যাঞ্চল দামিন-ই-কোহ ছিল সেই সময় সরল শান্তিপ্রিয়
সাঁওতালদের বাসভূমি। ইংরেজ আসার আগে তারা এখানে সুখেই বাস করতো। জঙ্গল কেটে তারা চাষের জমি হাসিল করেছিল। এই
পরিশ্রমী সৎ মানুষগুলোর জীবন আক্ষরিক অর্থেই নরক হয়ে উঠলো যখন ইংরেজ ও তার দেশী
অনুচরদের নজর পড়লো এইখানে। ইতিপূর্বে মুঘল ও মুর্শিদাবাদের নবাবরা এই ভূভাগ থেকে
খাজনা আদায় করেনি কিন্তু ইংরেজরা অরণ্য সম্পদ ও জমিদারি ইজারার লোভে শোষণ নৃশংসতার
সব চরমসীমা অতিক্রম করে গেলো।
জমিদারি
খাজনার সঙ্গে শুরু হল মাসিক তেত্রিশ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি সুদের মহাজনী কারবার।
প্রদত্ত টাকার দশগুণ খত লিখে টিপছাপ নেওয়া, ঋণের দায়ে জড়িয়ে সপরিবারে ক্রীতদাস বানানো, তাদের সরলতার
সুযোগে তাদের কৃষিজাত দ্রব্য বড়ো বাটখারায় মেপে নেওয়া হত আর তার বিনিময়ে
ছোট বাটখারায় মেপে দেওয়া হোত সামান্য লবন, আগুন জ্বালানোর গানপাউডার(দেশলাই) বা অন্য প্রয়োজনীয় জিনিস। আর সবচেয়ে বড়ো
অত্যাচার ছিল সাঁওতাল নারীর সম্ভ্রম হরণ, তাদের দিনের পর দিন কুঠীতে বা কাছারিতে আটক করে ধর্ষণ ও পাশবিক অত্যাচার। সরল
সাঁওতালদের সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন ভগনাডিহির মাঠে নিকটবর্তী
চারশো গ্রামের দশহাজার মানুষের জমায়েতে
সিদো মূর্মূ, কানহো মুর্মূ
বিদ্রোহের ঘোষণা করলেন, শুরু হল হুল।
১৮৫৫ সালের ৩০শে
জুন ভগনাদিহির মাঠের জমায়েতে সিদো, কানহু, চাঁদ ও ভৈরব, তাদের দুই বোন ফুলো ও ঝালোর
ঐতিহাসিক আহ্বান —
“দেলায়া বেরেৎ
পে-দেলায়া তেঙ্গোন পে
জানাম দিশম লাগিৎ তে
দোলায়া পায়ারঃ
তাবিন পে - - -।”
মাতৃভূমির জন্য
সবাই ওঠো জাগো — ৩০ শে জুনের
সমাবেশ থেকে বিশাল সংখ্যায় সাঁওতাল বড়লাটের কাছে তাদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ
জানাতে কোলকাতা রওয়ানা হলেন, এই হোল
ভারতের প্রথম পদযাত্রা। স্বামীজী, নেতাজী, রবীন্দ্রনাথের জাতের চোখ ফোঁটার বহু আগে মিছিল,মিটিং,প্রতিবাদ,সমাবেশ শুরু
করেছিল এরাই।
ভীত জমিদার আর
ইংরেজ কর্মচারীরা দারোগা মহেশ দত্তকে ঘুষ দিয়ে পাঠালো সিদো, কানহুকে ধরে আনতে। কুখ্যাত এই মহেশ দারোগা
সাঁওতালদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, জমিদার ও
ইংরেজদের জন্য সাঁওতাল নারী অপহরণে ছিল সিদ্ধহস্ত। নারী অপহরণ তার কাছে ছিল
সাঁওতাল গ্রাম থেকে ফোকটে মুরগি ও ডিম নিয়ে যাবার মত। ৭ই জুলাই সিদো কানহুকে
গ্রেফতার করতে এসে টাঙ্গির ঘায়ে প্রাণ হারালো মহেশ দারোগা, মহাজন মালিক মুদি সহ ১৯জন সেপাই। অরণ্যবহ্নি ছড়িয়ে
পড়লো গোটা দামিন অঞ্চলে। এই দাবানলের ভয়ে ভীত ইংরেজ মার্শাল আইন লাগু করলো,
সেভেন্থ নেটিভ
রেজিমেন্ট ও ফরটি নেটিভ রেজিমেন্ট সহ
একাধিক সেনা রেজিমেন্ট নামলো মাস্কেট আর কামান নিয়ে, মুর্শিদাবাদের নবাবের থেকে হাতি নিয়ে এলো
ইংরেজ। ৩০ হাজার বিদ্রোহী সাঁওতালকে হত্যা করে, হাতির পায়ে পিষে তাদের গ্রাম ভেঙে
জ্বালিয়ে আরো অসংখ্য নারী ও শিশুকে হত্যা
করে বিদ্রোহ দমন করতে প্রবৃত্ত হোল ইংরেজ।
১৮৫৫ সালের ৩০ শে
জুন সিদো ও কানহুর নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ শুরু হয় তা ১৮৫৬ সালের নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত
চলে। ইংরেজ সেনাপতি মেজর জার্ভিস বলেন “এটা কোনো যুদ্ধই নয়, ওরা এক জায়গায়
দাড়িয়ে মাদল বাজিয়ে যাচ্ছিল আর আমাদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হচ্ছিল তবু পালিয়ে যাচ্ছিল না, ওদের ছোড়া তীরে আমাদের খুবই কম ক্ষয়ক্ষতি
হচ্ছিলো, এক জায়গা থেকে
ছত্রভঙ্গ করে দিলে সিকি মাইল দূরে গিয়ে আবার মাদল বাজিয়ে জড়ো হচ্ছিল। এমন কোনো
সিপাহী ছিলনা যে এই অসম যুদ্ধে লজ্জাবোধ করেনি।” আসলে এ যুদ্ধ অস্ত্রের যুদ্ধ নয় - এ যে সভ্যতার
যুদ্ধ, মানবিকতার যুদ্ধ, পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র জাতি ইংরেজকে(যাদের প্রভু নাকি
করুণাময় যিশু!!)পৃথিবীর সবচেয়ে নম্র জাতি সাঁওতাল(যারা নাকি অসভ্য ?) মানবতার পাঠ দিচ্ছিল। ক্লাস নেওয়া হয়েছিল দেশীয়
সিপাহীদের আর মাস ছয়েক পরে যারা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে মহান সিপাহী
বিদ্রোহের পরীক্ষায় বসবে। কোনো টোটার শুয়োর গরুর চর্বি নয়, সিপাহীবিদ্রোহের কারণ দেশীয় সৈন্যদের উপলব্ধি
ইংরেজ কতো নৃশংস নীতিহীন স্বার্থপর, তাদের স্বদেশবাসীর হত্যাকারী।
১৮৫৬ সালের
ফেব্রুয়ারী মাসে বীরভূমের সীমানার অনতি দূরের এক
যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতায় বন্দী হলেন সিদো ও কানহু, তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। আবার অনেকে বলেন
কানহুকে নাকি ১৮৫৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল এবং মৃত্যুর আগে সে
বলেছিল আমি ছয় মাসের মধ্যে আবার ফিরে আসবো। ভগলপুরে এক ভয়াবহ যুদ্ধে শহীদ হন চাঁদ
ও ভৈরব। ফুলো বা ফুলমনির ধর্ষিত ক্ষত বিক্ষত দেহ পাওয়া যায় রেললাইনের ধারে। সবচেয়ে
ছোট বোন ঝালোর কোনো খোঁজ মেলেনি। কী অদ্ভুত মিল! মনিপুরের থাংজাম মনোরমার সাথে
ফুলোর, সেই একই ধর্ষিত
ক্ষত বিক্ষত দেহ, আজও তো বস্তারে
কতো আদিবাসী মেয়ে নিখোঁজ ঝালোর মতো, এই মৃত ধর্ষিত নারীদেহগুলো প্রমাণ করে ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্র
সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের ঔরসে সামন্ততান্ত্রিক জমিদার জোতদার মহাজনের গর্ভজাত।
সাঁওতাল বিদ্রোহ কতগুলো রাজনৈতিক সত্যকে
দেশবাসীর সামনে তুলে ধরলো তার মধ্যে যেটা প্রধান তা হোল, এতদিন বৃটিশ আগ্রাসনকে মানুষ ভাবতো এতদিনের
দেখা রাজায় রাজায় যুদ্ধের মতো। কতই তো শক,হূন,পাঠান,মোগল এসেছিল তারা মিশে গেছে এই দেশে। কিন্তু
ইংরেজ তা নয়, সে উপনিবেশ বানিয়ে শুধু শোষণ করতে এসেছে, এদেশ বা এদেশের মানুষের প্রতি তাদের কোনো দয়া
মায়া দায়বদ্ধতা নেই। আর তা সবথেকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশীয় সিপাহীরা।
আর সাঁওতাল বিদ্রোহ কিন্তু এখানেই শেষ নয় এইতো বিদ্রোহী ভারতের যাত্রার শুরু। সিদো
কানহোর ধারাবাহিকতায় আবার লড়াইয়ের ডাক দিলেন আরেক সাঁওতাল বীর ভগীরথ মাঝি ।
সাঁওতাল বিদ্রোহের
ফলে ইংরেজ উপলব্ধি করল বারবার রক্তস্রোতের বন্যা বইয়ে বিদ্রোহ দমন করা যাবেনা, এই নৃশংসতা দেখে কোটি কোটি ভারতবাসী যদি জেগে
ওঠে শুধুমাত্র বন্দুকের জোরে তাকে ঠেকানো যাবেনা। ইংরেজরা
মেজিষ্ট্রেট এডিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে সাঁওতালদের অভিযোগগুলি লিপিবদ্ধ করলো। সাঁওতাল মানঝি, পরানিক, পারাগনার নিয়ন্ত্রণে তাদের আইনে বিচারের
ক্ষমতা দেওয়া হোল। ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল
টেনেন্সি অ্যাক্ট অনুযায়ী আদিবাসী জমি অহস্তান্তরযোগ্য ঘোষিত হোল, যা ভারতে আজও বর্তমান।
ইংরেজের এই
সাময়িক ক্ষোভ প্রশমনের চালে সাঁওতালদের প্রতিরোধ সংগ্রাম কিন্তু বন্ধ হলনা,
কারণ শোষণ তখনও অব্যাহত।
১৮৭৪ সালে রাজমহল আবার জেগে উঠলো ভগীরথ মাঝির নেতৃত্বে খেরওয়াল বা খেরওয়ার
আন্দোলনে। ভগীরথ বললেন জঙ্গল কেটে আমরা চাষজমি হাসিল করেছি তাই আমরা ইংরেজকে কোনো
খাজনা দেবোনা। ভগীরথ মাঝিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৮৭৯ সালে তাঁর মৃত্যু হলে দুবিয়া
গোসাই বা বাবজীর নেতৃত্বে খেরওয়াল আন্দোলন তার চরমে পৌছোয়। দুবিয়া গোসাই
হাজারিবাগে প্রথম আন্দোলন গড়ে তোলেন, পরবর্তীতে তিনি রাজমহল ও ছোটনাগপুর সহ সমস্ত পূর্ব ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত
এলাকায় ঘুরে ঘুরে খেরওয়াল আন্দোলনের প্রচার করেছিলেন। তার নেতৃত্বে জনগণ ডুমকার
ম্যাজিষ্ট্রেটকে সারারাত অবরুদ্ধ করে
রাখেন। ইংরেজ তাকে সাঁওতাল পরগনা থেকে অনেক দূরে লখনউ নির্বাসিত করে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বোচ্চ অবদান আদিবাসী মানুষের।১৭৭৪ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ ১২৫ বছর নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ঢেউ কখনও থেমে থাকেনি। ১৭৭৪-এ তিলকা মাঝি,১৮৫৫-৫৬-তে সিদো-কানহুর হুল,১৮৭৯—৮১ ভগীরথ মাঝি ও দুবিয়া গোসাইয়ের খেরওয়াল ১৮৯৭—১৯০০ বিরসার উলগুলান ছাড়াও গঙ্গানারায়ন সিংসর্দারের নেতৃত্বে ভূমিজ বিদ্রোহ,হো বিদ্রোহ,কোল বিদ্রোহ এবং খুবই উল্লেখযোগ্য মেদিনীপুরের লোধা শবর বিদ্রোহ,শতাধিক বছর ধরে এই ছিল বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের মূলস্রোত। বিদ্যালয়ে যে ইতিহাস পড়ানো হয় তাতে আমরা শিখি গান্ধি,সুভাষ,নেহেরু, অরবিন্দ,জিন্না,প্যাটেল শুধু এরাই নাকি দেশোদ্ধার করেছেন।সে ইতিহাসের রাজনীতির চালে বেইমান সাভারকরও বীর।১৯০০ সালের পরবর্তীতেও আদিবাসী মানুষ ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন, সে ৪২-এর ভারত ছাড়ো হোক বা অবিভক্ত বাংলার তেভাগা আন্দোলন ভারতের ভূমিপুত্ররা কখনো হাল ছাড়েনি।ক্ষমতা হস্তান্তরে(স্বাধীনতা নয়)পরে থেকে আজ পর্যন্ত সে সংগ্রাম চলছে। নিয়মগিরির পাহাড়ে,দাল্লি রাজহারার গ্রামে, পালামৌ,হাজারিবাগ, সুকমায় অরণ্য আজও তো বহ্নিমান ।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বোচ্চ অবদান আদিবাসী মানুষের।১৭৭৪ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ ১২৫ বছর নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ঢেউ কখনও থেমে থাকেনি। ১৭৭৪-এ তিলকা মাঝি,১৮৫৫-৫৬-তে সিদো-কানহুর হুল,১৮৭৯—৮১ ভগীরথ মাঝি ও দুবিয়া গোসাইয়ের খেরওয়াল ১৮৯৭—১৯০০ বিরসার উলগুলান ছাড়াও গঙ্গানারায়ন সিংসর্দারের নেতৃত্বে ভূমিজ বিদ্রোহ,হো বিদ্রোহ,কোল বিদ্রোহ এবং খুবই উল্লেখযোগ্য মেদিনীপুরের লোধা শবর বিদ্রোহ,শতাধিক বছর ধরে এই ছিল বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের মূলস্রোত। বিদ্যালয়ে যে ইতিহাস পড়ানো হয় তাতে আমরা শিখি গান্ধি,সুভাষ,নেহেরু, অরবিন্দ,জিন্না,প্যাটেল শুধু এরাই নাকি দেশোদ্ধার করেছেন।সে ইতিহাসের রাজনীতির চালে বেইমান সাভারকরও বীর।১৯০০ সালের পরবর্তীতেও আদিবাসী মানুষ ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন, সে ৪২-এর ভারত ছাড়ো হোক বা অবিভক্ত বাংলার তেভাগা আন্দোলন ভারতের ভূমিপুত্ররা কখনো হাল ছাড়েনি।ক্ষমতা হস্তান্তরে(স্বাধীনতা নয়)পরে থেকে আজ পর্যন্ত সে সংগ্রাম চলছে। নিয়মগিরির পাহাড়ে,দাল্লি রাজহারার গ্রামে, পালামৌ,হাজারিবাগ, সুকমায় অরণ্য আজও তো বহ্নিমান ।
0 মন্তব্যসমূহ