মৃত লাশের সাথে আমি কখনোই একঘরে থাকতে রাজি হবো না। কিন্তু কেনো ? সে কি হঠাৎই জেগে উঠবে? জেগে উঠেই দৌড় দিবে? কিংবা, স্থির অবস্থানে থেকেই চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে? না। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এগুলোর কিছুই ঘটবে না। মৃতরা নড়তে পারে না। প্রচন্ড গরমেও তারা ঘামতে পারে না। মানুষ একবার মরে গেলে সে চিরদিনের জন্যই মৃত। মৃতদের নতুন করে জেগে ওঠার কোনো ইতিহাস নেই।
.
এতসব নিশ্চয়তা থাকার পরেও এযাবৎ মৃতরা কেনো জীবিতদের আস্থা অর্জন করতে পারলো না ? মৃতদেরকে এখনো কেনো জীবতরা অবচেতনে অবিশ্বাস করে ? সর্বোপরি ‘যদি একটা কিছু ঘটেই যায়’ এমন আশঙ্কাটি চিরন্তন-ধ্রুব বাস্তবতা হয়ে ফুটে উঠেছে মানুষের ভয়ার্ত মন-মস্তিষ্কে। যার সূত্র ধরে আপাতত চালিয়ে যাওয়ার মত একটি ভারসাম্য খুজে পাওয়া গিয়েছিল। সেটা হলো, জীবিত ও মৃত অবস্থা সম্পুর্ণ ভিন্ন দুটি জগত। হয়ত সে কারনেই মৃতের প্রতি জীবিতের কারণে অকারণে এত ভীতি। কিন্তু যে মানুষ তার মতই অন্য একজন মানুষের মৃত লাশের কারণে মাত্রাতিরিক্ত ভীত হয়ে উঠে, সেই মানুষই কিভাবে অসংখ্য মশার মৃত লাশের সাথে সমগ্র রাত্রি কাটিয়ে দেওয়ার সাহস রাখে ? মানুষ আসলে শুধুমাত্র মানুষের লাশকেই ভয় পায়। ঠিক একইভাবে মশারা কেবলমাত্র মশাদের লাশ দেখেই প্রভাবিত হয়, ভীত হয়। পিপড়াদের চলনপথে যদি কোনো মৃত পিপড়া পড়ে থাকে তবে সেখানে কিছুক্ষনের জন্য হলেও যাত্রা স্থগিত ঘোষিত হয়। যে যার মত যে দিক থেকে আসছিলো সেদিকে ফিরে যায়। এটা স্পষ্টতই ভীতি। সেই পিপড়ার দলই যদি কোনো মাছির লাশ খুজে পায় তবে তাদের আনন্দের সীমা থাকে না।
কিন্তু, মৃত মাছিটির আশেপাশে তখন তার জীবিতকালীন আত্নীয় স্বজন ও বন্ধু মশারা আশেপাশে অবস্থান নিয়ে হাহাকার করে।
.
স্বজাতির প্রতি এমন মমত্ববোধ কিংবা ভীতির অনুভূতি স্বজাতি ভিন্ন অন্য কোনো জতির প্রতি অনূভূত হয় না। প্রকৃতিতে এই বিষয়টা সার্বজনীন ইউনিটির ধারণা কে চরমভাবে মিথ্যা প্রমাণ করে। অর্থাৎ, মানুষ অন্যজাতির প্রতি যতই উদার হোক না কেন ‘মানুষ শেষপর্যন্ত কেবল মানুষেরই অনুরাগী’। যেমনভাবে, হায়েনারা হায়েনার অনুরাগী, সাপেরা সাপের অনুরাগী। যার যার জগতে তার তার আধিপত্য ও অগ্রাধিকার। অর্থাৎ, মানুষও অন্যসব প্রাণীর মতই আত্নকেন্দ্রিক। এ কারনেই- মানবসমাজে বিড়ালকে বলা হয় ‘একটি বিড়াল’ আর মানুষকে বলা হয় ‘একজন মানুষ’। যদি এমন অবস্থা হয় যে, একটি বিড়ালের বাচ্চা ও একটি মানুষের বাচ্চার মধ্যে যেকোন একটিকে বাঁচানো যাবে, এমন অবস্থায় আমরা মানুষের বাচ্চাটিকেই বাঁচিয়ে রাখতে চাইবো। ঠিক তেমন পরিস্থিতিতে একটি বিড়াল থাকলে বিড়ালের বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইতো। অর্থাৎ মানুষকে সার্বজনীন মহত্তম প্রাণী বলার কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও আশাবাদ ছিলো, আর যাই হোক অন্তত মানুষ তো মানুষের অনুরাগী ! কিন্তু তাও দেখলাম সত্য নয়। পৃথিবীর অন্যসব প্রাণীরাই তাদের নিজেদের প্রতি প্রশ্নহীন মমত্ববোধ লালন করলেও একমাত্র মানুষই সম্ভবত এইক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
.
এখানে মানুষের মাঝেও শত সহশ্র অসংখ্য মিনি ‘স্বজাতি’ বিদ্যমান। চীনা মার্কিন থাই আরবীয় পারসিক মিসরীয় আফ্রিকীয় ল্যাটিন ডাচ ইংরেজ বা পর্তুগিজরা সবাই এখানে আলাদা আলাদ স্বজাতি। হিন্দু মুসলিম ইহুদি পার্সিয়ান শিখ জৈন বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান নামক অসংখ্য ‘স্বজাতি’ এখানে কেবলমাত্র নিজেদের ওপর আঘাত এলেই প্রতিবাদী হয়। শোকাহত হয়। মনুষ্যসমাজে শেষ অবধি কৃত্রিম পরিচয়গুলোই মূল্যায়িত হচ্ছে, মানুষ পরিচয় নয়। দু:খজনক হলেও সত্য, মানুষ কখনোই শুধুমাত্র ‘মানুষ’ শব্দটিতে নিজেদের স্বজাত্যবোধ খুজে পায় নি। সম্ভবত আর পাবেও না। স্বতন্ত্র জাতিগত বৈশিষ্ট্যের যে ঐতিহাসিক গর্ব মানুষ করতো, সেটা নিছকই ‘সৌজন্যমূলক’ অহংকার ছিলো। কারন, মানুষ এখনো পিপীলিকাকেই ডিঙাতে পারে নি।.....
0 মন্তব্যসমূহ