সৎ-স্বচ্ছ বিচারপতি কারনানের
প্রতি চরমতম অন্যায় শুধু
তফসিলী (দলিত) বলে ?
জীবনটাই তাঁর প্রতিবাদ আর
প্রতিবাদ দিয়ে গড়া। জীবনের শুরু থেকেই
অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন বীর সৈনিক তিনি। তাই
হাইকোর্টে বিচারকের আসনে বসে মাথা
উঁচু করে তিনি বলতে
পারেন --" আমি দেখেছি পয়সার
কাছে একের পর এক
রায় বিক্রি হয়ে যেতে। রক্ষকই
সেখানে ভক্ষক হয়ে বসেছে। এসব
দেখে আমি প্রতিবাদ না
করে সুস্থ থাকতে পারি
না।" পরবর্তীকালে এই
স্পষ্ট সত্য কথা বলা তাঁর জীবনে কাল হয়ে
দাঁড়িয়েছে। বিচারপতি
কারনানের সুরে ভারতের বিচার
বিভাগ ও বিচারপতিদের বিরুদ্ধে
একই অভিযোগ করেছেন দুর্নীতি
রোধে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক সমীক্ষক সংস্থা "ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনাল" এর গত ৭-ই মার্চের একটি
রিপোর্ট। এই
রিপোর্টে বলা হয়েছে -- "ভারতবর্ষের
৬২% বিচার পতি দুর্নীতি
গ্রস্ত। টাকায়
তারা বিচার বিক্রি করে। ফলে
ভারতের গরিব মানুষেরা সঠিক
বিচার পায় না।"
এই দুর্নীতি গুলি বিচারপতি সি
এস কারনান নিজের চোখের
সামনে ঘটতে দেখেছেন এবং
বারবার প্রতিবাদ করেছেন। ফলে
আজ তিনি এই দুর্নীতিপরায়ন
বিচারপতিদের ষড়যন্ত্রে জেলে
বন্দী। সংবাদপত্র
ও মিডিয়া সত্য উদ্ঘাটন
থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতিদের বিরুদ্ধে তিনি জোরাল প্রতিবাদ
করেন চেন্নাই হাইকোর্টের বিচারপতি থাকার সময় ২০১৬
সালের জানুয়ারী মাসে। চেন্নাই
হাইকোর্টের ৬ জন বিচারপতির
বিরুদ্ধে আর্থিক সহ একাধিক
দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন এবং
প্রায় সমস্ত প্রমানের নথিপত্রও দেন, যারা কয়লা মাফিয়া,
বালি খাদান মাফিয়া, রাজনৈতিক
নেতা, কর্পোরেট, প্রমোটারদের কাছে অর্থের লোভে
বিচার বিক্রি করেছেন। ফলে মৌচাকে ঢিল
পড়লো। তাই
ঐ দুর্নীতিবাজ বিচারপতিরা
সেদিন একত্রিত হয়ে সৎ-নির্ভীক-ন্যায়পরায়ন বিচারপতি কারনানকে চেন্নাই হাইকোর্ট থেকে কলকাতা হাইকোর্টে
বদলি করে দিলেন। চেন্নাই হাইকোর্টের বিচারপতিদের এতোবড় একটা কেলেঙ্কারি
সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গেল। ভারতবর্ষের
বুদ্ধিজীবি, রাজনৈতিক নেতা, আমজনতা সবাই
সেদিন নীরব থাকলো।
এরপর কলকাতা হাইকোর্টে
এসে তিনি দীর্ঘদিন চলতে
থাকা একের পর এক
কেসের (১৩৮টি শক্ত কেস)
সমাধান করতে থাকলেন। সারা জীবন ধরেই
তিনি একজন সৎ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন,
ন্যায়পরায়ন, সরল, মানবতাবাদী, সর্বোপরি
অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন চরিত্র। তাই
২০১৭ সালের ৮-ই
মে সুপ্রিমকোর্টের ৭ বিচার পতির
বিরুদ্ধে চরম দুর্নীতির অভিযোগ
আনেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে
চিঠি সহ বিচার চান। অথচ
বিচার তো দূরের কথা
উল্টে দুর্নীতিতে
অভিযুক্ত ঐ ৭ বিচারপতিকে
নিয়ে গঠিত সাংবিধানিক বেঞ্চ
আদালত অবমাননার দায়ে গত ৯-ই মে চটজলদি
কারনানকে ছয় মাসের কারাদন্ডের
নির্দেশ দেন এবং বলা
হয় কারনান তাঁর কোন
মন্তব্য বা নির্দেশ সংবাদমাধ্যমকে
প্রকাশ করতে পারবে না ---"বিচারের বানী
নীরবে নিভৃতে কাঁদে"।
গত ২০ জুন কোয়েম্বাটোরের
রিসোর্ট থেকে তাঁকে গ্রেফতার
করে প্রেসিডেন্সি জেলে ঢোকানো হয়। এই
রায় সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। কারন
সুপ্রিমকোর্টের একটি রায়ে (এম.
ভট্টাচার্য মামলায়) পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে ---" বিচারপতি
থাকা কালীন কোন বিচারপতিকে
গ্রেফতার করা যাবে না
"। ইতিপূর্বে এই রায়ের বলে
সবাই পারপেয়ে গেলেও কারনানেন বেলায়
তার প্রয়োগ হলো না
-- দলিত বলে ?
স্বাধীন ভারতে এ পর্যন্ত
অসংখ্য বিচার পতিদের দেখেছি,
যারা আর্থিক, চারিত্রিক কেলেঙ্কারি, দুর্নীতিসহ মারাত্মক অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। অথচ
আদালত অবমাননার দায়ে একজন বিচার
পতিরও জেল হয়েছে এমন
নজির নেই। কলকাতা
হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমিত্র সেনকে সংসদে ইমপিচ
করা হয়েছিল তহবিল তছরূপের
দায়ে, যা পরে সব
চেপে যায়। পাঞ্জাব
ও হরিয়ানার প্রধান বিচারপতি ভি
রামস্বামী ও সিকিম হাইকোর্টের
প্রধান বিচার পতি দিনাকরনের
বিরুদ্ধে প্রথম ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব
এলেও শেষ পর্যন্ত তা
কার্যকর হয়নি। এরকম
উদাহরন হাজার হাজার রয়েছে। অথচ
ন্যায় বিচার চেয়ে জেলে
যেতে হলো কারনানকে -- শুধু
দলিত বলে ? অথচ সুপ্রিম
কোর্টের ঐ বিচার পতিদের
বিরুদ্ধে কারনান যে দুর্নীতির
অভিযোগ তুলেছিলেন তার কী হলো
? আইনজীবী অরুনাভ ঘোষ দুঃখের
সাথে বলেন ---" বিচারপতি কারনানের জেল প্রমান করেনা
তিনি দোষী। সুপ্রিমকোর্টের
ক্ষমতা বেশী, তাই কারনানের
জেল হয়েছে। কারনানের
ক্ষমতা বেশী থাকলে সুপ্রিমকোর্টের
বিচারকদের জেল হতো। এই রায় সুপ্রিমকোর্টের
সততার ভাবমূর্তি আঘাতপ্রাপ্ত হল। কারনানের
মতো একজন সৎ ও
নির্ভীক বিচারপতি আগে দেখিনি। সুপ্রিম কোর্টের সততা থাকলে RTI-এর
আওতায় আসুক ? "
ভারতবর্ষে দলিত হয়ে জন্ম
নেওয়া পাপ ? নাহলে একজন
হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়া সত্ত্বেও কোর্টের
ক্যানটিনে তাঁকে আলাদা টেবিলে
বসতে হয় কেন ? অন্যান্য
বর্নহিন্দু বিচারপতিরা এমনকি উকিলরা তাঁকে বারবার নিচুজাত বলে গালি দেয়
কেন একটু বলবেন ? হাইকোর্ট
ও সুপ্রিম কোর্টের বিচার পতিরা প্রায়
সবাই বর্নহিন্দু। ভারতের
২৭ টি হাইকোর্টের ৭৪৯
জন বিচারপতির মধ্যে ৭৩৫ জন
বর্নহিন্দু, আবার তার মধ্যে
৭১% ব্রাহ্মন। সুপ্রিমকোর্টের
বর্তমান ২৮ জন বিচার
পতির মধ্যে ২৫ জন
বর্নহিন্দু। এরাই
দেশের আইন-সংবিধান তৈরি
করে, বিচার করে, রায়
দেয় -- সেখানে এদের স্বার্থই
শেষ কথা। তাই
ভারতবর্ষে দলিত-বহুজন -মূলনিবাসীরা
ন্যায় বিচার আশা করতে
পারে না।বিচারপতি
কারনান প্রেসিডেন্সি জেলে ঢোকার সময়
বলেন --" আমার প্রতি অন্যায়ের
বিরুদ্ধে চারিদিকে আন্দোলন তৈরি হচ্ছে।
আমি তাদের নেতৃত্ব দিব।" তাই দলিত-বহুজনেরা এখনো চুপ করে
ঘরে বসে থাকবে ? এতো
বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে না
? পথে নামবে না ?
1 মন্তব্যসমূহ