ডেভিড, মাইকেলেঞ্জেলো |
কেনেথ ক্লার্কের
সিভিলাইজেশন থেকে অনুবাদ – আসমা সুলতানা ও
কাজী মাহবুব হাসান
‘কখনো কখনো মানুষ
ভেবেছে যে রেনেসাঁ পর্বের ইতালীয়রা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুহলতা থাকা সত্ত্বেও কেন
চিন্তা বা দর্শনের ইতিহাসে আরো অনেক বেশী অবদান রেখে যায়নি। এর কারণ হচ্ছে সেই
সময়ের সবচয়ে গভীরম ভাবনা শব্দে প্রকাশিত হয়নি বরং সেটি প্রকাশিত হয়েছিল দৃশ্যমান
চিত্রকলায়।’ কেনেথ ক্লার্ক
ছবি: মাইকেলেঞ্জেলো, মানব সৃষ্টি |
ফ্লোরেন্স থেকে
রোম, দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়
অনেকটাই, একরোখা, দ্রুতবুদ্ধির, ধীর আর সুন্দর গতিময় মানুষদের শহর থেকে
গুরুগম্ভীর ভারী এমন একটি শহরে, যা মানুষের আশা
আর উচ্চাকাঙ্খার সুবিশাল একটি কম্পোষ্ট বা জৈবসারের স্তুপের মত; সব অলঙ্কার থেকে বঞ্চিত, প্রায় দূর্ভেদ্য রহস্যাবৃত, রাজকীয় চাকচিক্যময়তার একটি জঙ্গল, যেখানে শুধুমাত্র একজন প্রাচীন সম্রাট, মারকাস অরেলিয়াস (১), দাড়িয়ে আছেন মাটির উপরে, বহু শতাব্দী জুড়ে সুর্যের আলোয়। মানদণ্ডও
পরিবর্তিত হয়েছে। আমি ভ্যাটিকানের কোর্টইয়ার্ডে বা প্রাঙ্গনে দাড়িয়ে আছি, যার শেষ প্রান্তে স্থপতি ব্রামান্টে (২) একটি
সান-ট্র্যাপ (৩) তৈরী করেছিলেন, যা পরিচিত
বেলভেদেয়ার (৪) নামে, যেখান থেকে পোপ
প্রাচীন এই শহরটির দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। এর আকৃতি যদিও কোনো নিশের (৫) মত,
তবে কোনো বিশাল আকারের
ভাস্কর্যকে ধারণ করার বদলে, এটি আকারে ছিল
সুবিশাল- আসলেই সবসময় এটি পরিচিত ছিল ‘ইল নিককিওনে’ নামেই- যার অর্থ ‘দানবাকৃতির নিশ’- এটি সুবিশাল পরিবর্তনের একটি বহির্মূখি এবং
দৃশ্যমান প্রতীক, যা রেনেসাঁর
সভ্যতাকে গ্রাস করেছিল ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো একটি সময়ে। স্বাধীন আর
সক্রিয় মানুষদের পৃথিবী ছিল না সেটি আর বরং দানব আর বীরদের একটি পৃথিবী।
এই নিশের মধ্যে
একটি মানুষকে ধারণ করতে পারে এমন বড় আকারের ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরী একটি পাইন-কোনের
ভাস্কর্য আছে। এটি এসেছে এর আগের দানবদের জগত থেকে, প্রাচীন রোমের সেই পৃথিবী থেকে, এবং এটি সম্ভবত হেড্রিয়ানের (৫) সমাধির ফিনিয়াল
(৬) ছিল; কিন্তু মধ্যযুগে
মনে করা হতো এটি হিপপোড্রোমের (৭) সেই বিন্দুর প্রতিনিধিত্ব করছে, রথ বা চ্যারিওট প্রতিযোগিতার সময় যেখান থেকে রথ
চালকরা তাদের ঘোড়া ঘুরিয়ে আনতেন। এবং যেহেতু এই হিপপোড্রোমে বহু খ্রিস্টীয় শহীদদের
মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, এই জায়গাটাকেই
খ্রিস্টীয় চার্চ তাদের প্রধান কেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য নির্বাচন করেছিল। বিশাল,
অস্পষ্ট একটি ধারণা,
যদি ফ্লোরেন্স এর তীক্ষ্ম
সুস্পষ্ট ধারণাগুলোর সাথে এর তুলনা করা হয়। কিন্তু রোমে এই সব ধারণাগুলো খুব একটা
অস্পষ্ট ছিলনা, কারণ
প্রাচীনকালের সুবিশাল আকারের ভবনগুলো সেখানে ছিল (৮০), আজ আমরা যতটা দেখি, সেই সময় তার চেয়ে আরো অনেক বেশী ছিল তাদের
সংখ্যা। এমনকি তিন শতাব্দী পরও, যখন এই সব
ভবনগুলোকে মার্বেল পাথরের খনির মত ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখানেই আমাদের অনুপাত ও
মাত্রাবোধটি আরো বেশী সম্প্রসারিত হয়েছিল, বিস্ময়করভাবেই তারা এখনও আকারে অনেক বড়। মধ্যযুগে মানুষ এই দানবীয় আকার ও
মাত্রায় নিষ্পেষিত বোধ করেছে নিজেদের। তারা দাবী করেছে এই সব ভবনগুলো নিশ্চয়ই
নির্মাণ করেছে দানবরা অথবা বড় জোর, তারা এদের মনে
করে নিয়েছে প্রাকৃতিক কোন প্রপঞ্চ হিসাবে – যেমন কোনো পর্বত – এবং এই সব দানবাকৃতির ভবনের মধ্যে তারা তাদের
কুড়ে ঘর নির্মাণ করেছিল, ঠিক যেমন করে কেউ
উপত্যাকা বা আশ্রয়দানকারী পাহাড়ের ঢালের সুযোগ নেয় তাদের বসতি বানাতে। রোম ছিল
গরুর পাল আর ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো ছাগলদের শহর, অল্প কিছু দূর্গসদৃশ টাওয়ার ছাড়া যেখানে কোন
কিছুই নির্মাণ করা হয়নি, যেখান থেকে
প্রাচীন পরিবারগুলো তাদের অর্থহীন ও বিরাহীন দ্বন্দ চালিয়ে যেত – যে দ্বন্দ আক্ষরিকার্থেই সমাপ্তিহীন, কারণ তারা এখনও তাদের কলহ অব্যাহত রেখেছে।
১৫০০ খ্রিস্টাব্দ
নাগাদ রোমানরা বুঝতে শুরু করেছিল যে, এগুলো আসলেই মানুষদের দ্বারা নির্মিত। প্রাণবন্ত এবং বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাক্তিরা
যারা রেনেসাঁ সৃষ্টি করেছিলেন, প্রাণশক্তি আর
আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এই মানুষগুলো প্রাচীনকালের কাছে পরাজয় মেনে নেবার জন্য
প্রস্তুত ছিলেন না। তারা এই সব নির্মাণের সৃজনশীলতাকে আত্মস্থ করে নিতে চেয়েছিলেন,
চেয়েছিলেন এর সমকক্ষ হতে,
এর নির্মাণ কৌশলের উপর
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। নিজস্ব বিশালকায় দানবীয় ক্ষমতার অধিকারী মানুষ আর বীরদের
সৃষ্টি করেছিল তারা।
৮০ রোমান স্নান ধ্বংসাবশেষ, ভিলা আদ্রিয়ানা, রোম |
রোমের দৃশ্যপটও
বেশ বদলে গিয়েছিলো রাজনৈতিক কারণে। অনেক বছরের নির্বাসন এবং প্রতিকুল পরিস্থিতি
পার হবার পরে, সার্বভৌম পোপ
ফিরে এসেছিলেন তার পার্থিব ক্ষমতার আসনে। সাধারণভাবে যেটি বর্ণিত প্যাপাসি বা
পোপের ক্ষমতার কেন্দ্রের অবক্ষয় পর্ব হিসাবে, যখন পোপরা ছিলেন কিছু অসাধারণ দক্ষতা সম্পন্ন
মানুষ, যারা তাদের
আন্তর্জাতিক মিত্রদের, তাদের দক্ষ
আমলাতন্ত্র এবং ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকা সম্পদ ব্যবহার করেছিলেন সভ্যতার
স্বার্থে। পঞ্চম নিকোলাস (৯) , আলবার্টির (১০)
বন্ধু এবং মানবতাবাদী, ছিলেন প্রথম
মানুষ যিনি পোপের অধিকৃত রোমে, প্যাগান (১১)
রোমের মহিমাময় বিশালতাকে পুণরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছিলেন। দ্বিতীয়
পায়াস(১২) , একজন কবি,
প্রকৃতি প্রেমী, এবং সব ধরনের সৌন্দর্যপ্রেমী, অথচ তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তুর্কীদের
আক্রমন থেকে খ্রিস্টীয় বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য। এমনকি চতুর্থ সিক্সটাস (১৩) ,
যিনি মেলেৎসো দা ফরলি’র (১৪) (ছবি ৮১) আঁকা দেয়াল চিত্রের মতই
নিষ্ঠুর আর ধূর্ত ছিলেন, ভ্যাটিক্যানের
লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং প্রথম পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন মহান
মানবতাবাদী প্লাটিনাকে ( ১৫)। এই একই দেয়াল চিত্রে আমরা প্রথমবারের দেখি একটি
সুদর্শন তরুণ কার্ডিনালের মুখমণ্ডল, যিনি অন্য আর যে কোন ব্যক্তির তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী নিয়তি দ্বারা নির্দিষ্ট
হয়েছিলেন উত্তর পর্বের (১৬) রেনেসাঁকে বীরোচিত দিক নির্দেশনা দেবার জন্য, তার নাম জুলিয়ানো দেলা রোভেরে (১৭) । পোপের
সচিবালয়ের স্থুলবুদ্ধির ভীরু ব্যক্তিগুলোর তুলনায় তিনি ছিলেন সিংহের মত, এবং পরবর্তীতে যখন তিনি পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস
হয়েছিলেন, তিনি তার উদারতা
এবং তীব্র ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অনুপ্রাণিত এবং একই সাথে জোর করে কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন
তিনজন প্রতিভাবান মানুষকে – ব্রামান্টে (১৮) ,
মাইকেলেঞ্জেলো (১৯) এবং
রাফায়েল (২০) । তিনি না থাকলে মাইকেলেঞ্জেলো সিস্টিন চ্যাপেলে (২১) আঁকতেন না এবং
রাফায়েলও পোপের বাসভবন অলঙ্কৃত করতেন না। এবং আমরাও বঞ্চিত হতাম আধ্যাত্মিক শক্তি
ও মানবতাবাদী দর্শনের শ্রেষ্টতম দুটি দৃশ্যমান অভিব্যক্তি দেখতে পাওয়ার সুযোগ
থেকে।
এই চমৎকার জীবনের
চেয়ে বিশাল চরিত্রটি এমন একটি প্রকল্পর কথা ভেবেছিলেন, সেটি এত বেশী সাহসী, এত বেশী আড়ম্বরময় যে আজও সেই পরিকল্পনাটির
কথাটি ভাবলে আমি খানিকটা চমকে উঠি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পুরোনো সেইন্ট পিটারস
ব্যাসিলিকা (২২) ভেঙ্গে ফেলবেন (৮২); পশ্চিমা বিশ্বে এটি সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীনতম চার্চগুলো মধ্যে অন্যতম একটি,
এবং অবশ্যই এটি পৃথিবীর
সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় চার্চ, কারণ এটি দাড়িয়ে
আছে সেই জায়গায় যেখানে সেইন্ট পিটার (২২) শহীদ হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
৮২ প্রাচীন সেইন্ট পিটার্স এর অভ্যন্তর (ষোড়শ শতাব্দীর ফ্রেস্কো |
জুলিয়াস এটিকে
ভেঙ্গে ফেলে এবং এর জায়গায় আরো অনেকবেশী দৃষ্টিনন্দন কিছু নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলেন। নতুন ভবনটি কেমন দেখতে হবে সেই ভাবনায় তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন রেনেসাঁর
দুটি আদর্শের দ্বারা, অবশ্যই এই
নির্মানকে হতে হবে ক্রটিমুক্ত নিখুঁত জ্যামিতিক রুপের ভিত্তিতে – বৃত্ত এবং বর্গক্ষেত্র। এবং অবশ্যই এমন একটি
অনুপাতের মাত্রায় আর শৈলীতে নির্মিত হতে হবে যা প্রাচীন রোমের ধ্বংসাবষের
বিশালতাকে যেন অবশ্যই অতিক্রম করে। তিনি ব্রামান্টেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এমন একটি
ভবনের পরিকল্পনা করতে। কিন্তু তিনি তার সেই পরিকল্পনাটি নিয়ে বেশী দূর অগ্রসর হতে
পারেননি। শিল্পকলার বিশাল কোন পরিবর্তন, বিপ্লবের মতই, প্রায় পনেরো
বছরের বেশী সেটি টিকে থাকতে পারেনা, এবং পরিবর্তনের অগ্নিশিখা নির্বাপিত হবার পর, মানুষ সাধারণ স্বস্তিময় আভা প্রদান করে এমন
আলোক উৎসকে শ্রেয়তর মনে করে থাকে। দ্বিতীয় জুলিয়াস পোপ ছিলেন মাত্র দশ বছর,
১৫০৩ থেকে ১৫১৩
খৃষ্টাব্দ। সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার কাজ সমাপ্ত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর প্রায় একশ
বছর পর (১৬২৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং সেই সময় নাগাদ এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দর্শনের
অভিব্যক্তিতে রুপান্তরিত হয়েছিল। তবে খ্রিস্টধর্ম আর প্রাচীন গ্রীক-রোমান জগতের
মধ্যে এই দৃশ্যমান সম্প্রীতির প্রথম পদক্ষেপটি নেয়া হয়েছিল তখনই, যখন জুলিয়াস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ,পুরোনো ব্যাসিলিকাটি ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে
নির্মাণ করার জন্য।
অ্যান্টিকুইটি বা
প্রাচীন সভ্যতার পর্ব, পঞ্চদশ শতকের
ফ্লোরেন্সের মানুষরা আগ্রহের সাথে পেছন ফিরে তাকিয়েছিলেন গ্রীস ও রোমের সভ্যতার
প্রতি। তারা প্রাচীন লেখকদের লেখা অনুসন্ধান করতেন এবং আবেগের সাথে সেগুলো অধ্যয়ন
এবং পরস্পরের সাথে ল্যাটিন ভাষায় লিখে যোগাযোগও করতেন। তাদের সবচেয়ে গর্বের উৎস
ছিল সিসেরো’র (২৩) মত গদ্য
লিখতে পারার দক্ষতা প্রদর্শনে। কিন্তু যদি তাদের মন পরিপূর্ণ ছিল প্রাচীন ধ্রুপদী
পাণ্ডুলিপির ভাষায়, তাদের কল্পনা ছিল
পুরোপুরিভাবে গথিক। অবশ্যই এটি সত্যি যে, ডোনাটেলো (২৪) এবং গিবার্টি (২৫) বহু প্রাচীন ভাস্কর্য থেকে উদ্ধৃতি তাদের
কাজে যুক্ত করেছিলেন। কিন্তু যখনই কোন গড়পড়তা চিত্রকর প্রাচীন সাহিত্য থেকে কোন
দৃশ্য আঁকার প্রচেষ্টা শুরু করেন, তিনি সেটি করতেন
তার নিজের সময়ের পরিচ্ছদে, লাবণ্যময় অবাস্তব
কল্পনাপ্রসূত শারিরীক গতিময়তাসহ, যেখানে শারীরিক
ওজন সম্বন্ধে সামান্যতম সচেতনতার কোন আভাসের উপস্থিতি যেমন থাকতো না, তেমননি থাকতো না প্রাচীন সেই সময়ের প্রবাহমান
ছন্দময়তা।
৮৩ মানতেনইয়া, সিজারের বিজয়োৎসব |
৮৪. মাইকেলেঞ্জেলো, ডেভিড |
এবং কৌতুহলের
একটি বিষয় হলো যে মানবতাবাদীরা, যারা কিনা এত
বেশী পরিশ্রম করেছিলেন লিভির (২৬) মতো কোন লেখকের লেখা অনুধাবন করতে, তারা জুলিয়াস সিজারের (২৭) মৃত্যুদৃশ্যের একটি
চিত্রকে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, যে দৃশ্যে প্রতিটি মানুষ সুস্পষ্টভাবে পঞ্চদশ
শতাব্দীর কোন ফ্যাশন দুরস্ত ব্যক্তির মতই কাপড় পরে আছেন। লিখিত শব্দ আর ছবির মধ্যে
যতক্ষণ এই কৌতুকময় বিভেদটি থাকবে, প্রাচীনকাল কখনোই
কল্পনার উপর তার মানবিকিকরণের শক্তিটি আরোপ করতে পারবেনা।
আমার মনে হয় যে,
প্রথম যে ক্ষেত্রে
প্রাচীন রোমান পর্বের স্বপ্ন কম বেশী নিখুঁত দৃশ্যমান রুপ নিয়েছিল, সেগুলো হচ্ছে ধারাবাহিক কিছু অলঙ্করণ যেগুলো
সিজার এর বিজয়কে প্রতিনিধিত্ব করছে (ছবি ৮৩)। এটি সৃষ্টি করেছিলেন মানতেনইয়া
মানতুয়ার রাজদরবারের জন্য ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময়। রোমান্টিক
প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার এটি প্রথম শিল্পকর্ম। মানতেনইয়া (২৮) প্রাচীন রোমের শহরগুলোর
ধ্বংসাবশেষে তীব্র আগ্রহের সাথে অনুসন্ধান করেছিলেন প্রতিটি পাত্রের আর
ট্রাম্পেটের প্রকৃত আকারের প্রমাণ খুঁজতে এবং পুরাকীর্তি সংক্রান্ত তার জ্ঞানকে
তিনি ব্যবহার করেছিলেন রোমের শৃঙ্খলা এবং কোন কিছু সৃষ্টি করার তাড়নার প্রতি একটি
অনুভূতিতে রুপান্তরিত করার জন্য। কিন্তু যে মানুষটি সত্যিকারভাবে প্রাচীন
শিল্পকলাকে আত্মস্থ ও পুনঃসৃষ্টি করেছিলেন, তার সব অভিব্যক্তির শক্তিসহ এটিকে সৃষ্টি
করেছিলেন আরো বেশী প্রানবন্ত আরো বেশী মর্মস্পর্শী রুপে- তিনি হলেন মাইকেলেঞ্জেলো
। মাইকেলেঞ্জেলো রোমে এসেছিলেন ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে এবং সেখানে এসে তিনি তা
দেখেছিলেন, সেটি তাকে এত
বেশী প্রভাবিত করেছিল যে, গ্রীক-রোমান
ভাস্কর্যগুলোর আদলে ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিলেন। যাদের একটি (এখন যেটি হারিয়ে গেছে)
আসলেই বিক্রয় হয়েছিল সত্যিকারের কোন অ্যান্টিক বা প্রাচীন রোমান পর্বে নির্মিত
সৃষ্টি হিসাবে – এটাই ইতিহাসে
লিপিবদ্ধ প্রথম জাল শিল্পকর্ম যা বিক্রয় করা হয়েছিল।
১৫০১ এ
মাইকেলেঞ্জেলো ফ্লোরেন্সে ফিরে আসেন। আমি বলেছিলাম উত্তর রেনেসাঁর সুবিশাল আর
বিরোচিত প্রাণশক্তিটি ছিল মূলত রোম নির্ভর। কিন্তু ফ্লোরেন্সে এর এক ধরনের ভূমিকা
সূচিত হয়েছিল। মেদিচি পরিবার (২৯) , যারা ফ্লোরেন্সের শাসক ছিলেন গত ষাট বছর জুড়ে, তারা ক্ষমতাচ্যুত হন ১৪৯৪ খৃষ্টাব্দে, এবং ফ্লোরেন্সবাসীরা, সাভোনারোলার (৩০) প্রভাবে একটি প্রজাতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের সব মহান উদ্দেশ্য আর বিশুদ্ধতম আবেগ সহ, প্রাক-মার্কসবাদী বিপ্লবীরা যা খুঁজে বের
করেছিলেন প্লুটার্ক (৩১) এবং লিভি’র রচনা থেকে।
তাদের সেই অর্জনকে প্রতিকীরুপ দেবার জন্য, ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্র বেশ কিছু শিল্পকর্ম নির্মাণের দ্বায়িত্ব দিয়েছিলেন
বীরোচিত-দেশপ্রেম নির্ভর মূলভাবনায়। তাদের মধ্যে একটি ছিল অত্যাচারী শাসককে
পরাজয়কারী ডেভিড (৩২) এর সুবিশাল একটি ভাস্কর্য। এই শিল্পকর্মটি নির্মাণ করার জন্য
দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভীতিকর একজন তরুণ ভাস্করকে, যিনি সম্প্রতি রোম থেকে ফিরে এসেছিলেন। মাত্র
পঁচিশ বছরের ব্যবধান ছিল, মাইকেলেঞ্জেলোর
মার্বেল নির্মিত এই বীর (ছবি ৮৪) থেকে পরিপাটি ছোটখাট ভাষ্কর্য, মেদিচি আভিজাত্যের শেষ কথা ছিল যেটি, ভেরোক্কিও’র (৩৩) ডেভিড ভাস্কর্যটির: এবং সত্যিকারভাবে
মানবীয় শক্তিময়তার একটি ক্রান্তিকালকে এখানে দেখা যে কারো পক্ষেই সম্ভব হবে।
ভেরোক্কিও’র ডেভিড হালকা,
তীক্ষ্ম, ক্ষিপ্রগতিময়, মুখে স্মিতহাসি – এবং পরণে পোষাক। আর মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড
সুবিশাল, নগ্ন এবং
স্পর্ধিত তার সাহসে। এটি বরং সেই একই রকম সুবিশাল পরিবর্তন যা আমরা খুজে পাই
মোৎসার্ট (৩৪) ও বিটহোভেনের (৩৫) সঙ্গীতের মধ্যে।
শুধু এককভাবে
ডেভিড এর শরীরের দিকে তাকালে তার শরীরকে মনে হতে পারে অস্বাভাবিকভাবে টানটান হয়ে
থাকা সেই প্রাচীন সময়েরই কোন প্রাণবন্ত সৃষ্টি। কিন্তু শুধুমাত্র যখনই আমরা এর
মাথাটি পর্যবেক্ষণ করি, আমরা তার
আধ্যাত্মিকতার শক্তিটাকে অনুভব করতে পারি, প্রাচীন সেই পৃথিবীর মানুষদের কাছে যা ছিল অজানা। আমি মনে করি এই বৈশিষ্ট্যটাই,
যা আমি হয়তো বলতে পারি ‘বীরোচিত’, হয়তো বহু মানুষের সভ্যতা সংক্রান্ত ধারণার অংশ
নয়। কারণ এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে সুবিধাবাদের প্রতি একটি ঘৃণার মনোভাব এবং সেই
সব স্বাচ্ছন্দগুলোর একটি বিসর্জণ – যেগুলো – আমরা যাকে বলি ‘সভ্য জীবন’ – সেটি সৃষ্টি করে। সুখের শত্রু হচ্ছে এটি।
৮৫ মাইকেলেঞ্জেলো, কাসকিনা’র যুদ্ধ’র ড্রইং অনুশীলন থেকে |
১৯ রাফায়েল, মাছের মড়ক বা খরার অলৌকিক ঘটনা |
২০ রাফায়েল, স্কুল অব এথেন্স (বিস্তারিত |
৮৬ মাইকেলেঞ্জেলো, বন্দী |
এবং তারপরও আমরা
শনাক্ত করতে পারি যে, বস্তুবাদী
প্রতিবন্ধকতাগুলোকে ঘৃণা করা এবং এমনকি নিয়তি অন্ধ শক্তিকে উপেক্ষা করা, হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠতম অর্জন, এবং যেহেতু, পরিশেষে, সভ্যতা নির্ভর করে মানুষের মনের শক্তি আর আত্মার
চুড়ান্ত সম্প্রসারণ করার ক্ষমতার উপর, আমাদের অবশ্যই মাইকেলেঞ্জেলোর উত্থানকে বিবেচনা করতে হবে পশ্চিমা মানুষের
ইতিহাসে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে।
নব্যসৃষ্ট
প্রজাতন্ত্রীয় তীব্র উৎসাহের সেই একই মুহূর্তে মাইকেলেঞ্জেলোকে দ্বায়িত্ব দেয়া
হয়েছিল ফ্লোরেন্সের গ্রেট কাউন্সিল হলটি অলঙ্করণের জন্য চিত্রকর্ম সৃষ্টি করতে,
যে কাউন্সিল হলটি
প্রস্তুত করা হয়েছিল নতুন গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শীর্ষ সেই সময়ে। উদ্দেশ্য ছিল
চিত্রকর্মটি ফ্লোরেন্স এর ইতিহাসের কোন বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করবে।
কিন্তু আসলেই মাইকেলেঞ্জেলোর বিষয়বস্তুটি বরং এই ভাবনার পরিপন্থী একটি বিষয়ই ছিল,
তিনি ফ্লোরেন্সের একদল
সৈন্যদের একেঁছিলেন, যাদের অতর্কিতে
আক্রমন করা হয়েছে: খুব সরল যে কারণে তিনি এই বিষয়টি বেছে নিয়েছিলেন, সেটি হলো এই স্নানরত সৈন্যরা তাকে নগ্ন শরীর
আঁকার একটি সুযোগ দেবে। তবে তিনি পুরো মাত্রার রেখাচিত্র অবধি শেষ করতে পেরেছিলেন
( যাকে বলা হয় কার্টুন) এবং এমনকি সেটিও হারিয়ে গেছে। কিন্তু এর একটি বিশাল প্রভাব
ছিল, এবং এই কাজটির যেসব
অনুশীলন এখনও টিকে আছে, সেগুলো
স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করছে এর কারণটি কি ছিল (৮৫)।
মানব শরীর
সম্বন্ধে এটি ছিল প্রথম কর্তৃত্বময় একটি বার্তা – সেই শরীর যা, গথিক সময়ে, লজ্জা আর গোপনীয়তার বিষয় ছিল। সেই শরীর -যার
উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন আলবার্টি – যাকে মহৎ অনুভূতি, জীবন সঞ্চারণকারী
কর্মশক্তি এবং দেব-সদৃশ ক্রটিহীন হিসাবে প্রকাশের একটি উপায় হিসাবে তৈরী যেতে
পারে। এমন একটি ধারণা ছিল এটি, যা মানুষের মনের
উপর প্রায় চারশ বছর ধরে অপরিমাপযোগ্য একটি প্রভাব বিস্তার করে ছিল – হয়তো আমরা বলতে পারি পিকাসো’র (৩৬) ডেমোয়াজেল দা’আভিনিয়ঁ (৩৭) অবধি। মূলত অবশ্যই এটি একটি গ্রীক
ধারণা: এবং শুরুতে মাইকেলেঞ্জেলো সরাসরিভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন প্রাচীন
ভাস্কর্যের নানা অংশ দেখে, কিন্তু বেশী
দিনের জন্য সেটি নয়। যাকে আমি হয়তো বলতে পারি ‘বিটহোভেন এলিমেন্ট বা উপাদান’- ডেভিড মাথার সেই প্রাণশক্তি আর আধ্যাত্মিকতা –
শীঘ্রই তা পুরো শরীরেও
সম্প্রসারিত হয়েছিল।
এবং এই বিষয়টি
পুনরায় আমাদের রোমে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, এবং সেই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসী পোপের কাছে। দ্বিতীয় জুলিয়াস (৩৮) ক্যাথলিক চার্চের
মানদন্ডেই শুধু উচ্চাকাঙ্খী ছিলেন না, তিনি দ্বিতীয় জুলিয়াসের জন্যও উচ্চাকাঙ্খী ছিলেন এবং তার নতুন চ্যাপেলে তিনি
পরিকল্পনা করেছিলেন, হেড্রিয়ানের সেই
সময়ের পরে যে কোন শাসকের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম সমাধিসৌধ তিনি নির্মাণ করবেন। দাম্ভিকতা
আর গর্বের হতবুদ্ধি করে দেবার মত এটি একটি উদহারণ ছিল। এবং সেই সময় মাইকেলেঞ্জেলো
নিজেও এই সব বৈশিষ্ট থেকে মুক্ত ছিলেন না। আমি সেই প্রশ্নে যাবার প্রয়োজন বোধ করছি
না যে কেন সেই সমাধি স্মৃতিসৌধটি কখনোই নির্মাণ করা হয়ে ওঠেনি। একটি বিবাদময়
পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল – বীররা সাধারণত
অন্য বীরদের সান্নিধ্য খুব একটা সহজে সহ্য করতে পারেন না। একই সাথে সেই সমাধিটি
কেমন দেখতে হতো সেটি নিয়েও আমাদের ভাবনার কোন প্রয়োজন নেই। যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি
হচ্ছে সেই পরিকল্পনার জন্য সৃষ্ট কয়েকটি ফিগার বা শারীরিক অবয়বের অনুশীলনী ড্রইং
টিকে গেছে, এবং তারা ইউরোপীয়
মূলভাবনার সাথে নতুন কিছু সংযোজন করেছিল – এমন কিছু যা, গ্রীক-রোমান
সভ্যতা কিংবা ভারত এবং চীনের মহান সভ্যতাও কখনো কল্পনা করতে পারেনি। বাস্তবিকভাবে
এদের মধ্যে যেগুলো প্রায় সমাপ্ত সেগুলোর উৎস আমরা গ্রীক-রোমান যুগেই খুঁজে পাবো।
কিন্তু মাইকেলেঞ্জেলো তাদের খেলোয়াড় থেকে রুপান্তরিত করেছিলেন বন্দীতে, যাদের একজন মুক্ত হবার জন্য সংগ্রাম করছে –
নৈতিকতা থেকে? এবং অন্য শারীরিক অবয়বটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবেই
আত্মসমর্পিত (৮৬), ‘সহজ মৃত্যুর সাথে
অর্ধেক প্রেমে নিমজ্জিত’। মাইকেলেঞ্জেলোর
মনে ছিল নাইওবীর (৩৯) মৃত্যুপথযাত্রী পুত্রের গ্রীক শরীর। সেই দুটোই পুরোপুরিভাবে
আমরা বুঝতে পারবো, কিন্তু অন্য
ফিগারগুলো, সাধারণত যাদের
মনে করা হয় একই সেট এর অংশ হিসাবে, সেগুলো অসমাপ্ত
(৮৭)। মার্বেল থেকে তাদের শরীরগুলো বেরিয়ে আসে এক ধরনের পূর্বাভাষসূচক গুরুগম্ভীর
শব্দ যা আমরা নবম সিম্ফোনীতে (৪০) শুনতে পাই, এবং তারপর আবার মার্বেলেই নিমজ্জিত হয়। কিছু
পর্যায় অবধি অমসৃণ মার্বেলগুলো অনেকটা রেমব্রাঁ’র (৪১) কাজে দৃশ্যমান ছায়ার মত – কোন একটি অংশের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার একটি
উপায়, যা খুব তীব্রভাবে অনুভব
করা সম্ভব হয়। কিন্তু এটি দেখেও কিন্তু মনে হয় কোন একটি শরীরকে এটি বন্দী করে রাখে
– বাস্তবিকভাবে তারা সবসময়ই
পরিচিত বন্দী হিসাবে, যদিও কোন বন্ধন
বা শিকলের চিহ্ন নেই। পুরোপুরিভাবে সমাপ্ত ক্যাপটিভের ড্রইং দেখলে আমরা অনুভব করতে
পারি তারা মাইকেলেঞ্জেলোর গভীরতম ভাবনাটিকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল: বস্তুর কারাগার
থেকে আত্মার নিজেকে মুক্ত করার সংগ্রাম।
কখনো কখনো মানুষ
ভেবেছে যে রেনেসাঁ পর্বের ইতালীয়রা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুহলতা থাকা সত্ত্বেও কেন
চিন্তা বা দর্শনের ইতিহাসে আরো অনেক বেশী অবদান রেখে যায়নি। এর কারণ হচ্ছে সেই
সময়ের সবচয়ে গভীরম ভাবনা শব্দে প্রকাশিত হয়নি বরং সেটি প্রকাশিত হয়েছিল দৃশ্যমান
চিত্রকলায়। এই সত্যটির দুটি অসাধারণ উদহারণ সৃষ্টি হয়েছিল রোমের একটি ভবনে। দুটি
কাজ পরস্পর থেকে একশত গজের বেশী দুরে নয়, এবং তাদের সৃষ্টিও হয়েছে ঠিক একই বছরে। মাইকেলেঞ্জেলোর সিস্টিন চ্যাপেলের (৪২)
ছাদ এবং স্টানজা ডেলা সেইনয়াটুরা (৪৩) নামের একটি কক্ষে রাফায়েলের ফ্রেস্কোগুলো।
এই দুটি মহান শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য আমরা সম্পূর্ণভাবে ঋনী দ্বিতীয় জুলিয়াসের
কাছে। বহু শতাব্দী ধরে মাইকেলেঞ্জেলোকে নিয়ে যারা লিখছেন তারা জুলিয়াসকে সমালোচনা
করেছেন, মাইকেলেঞ্জেলোকে
সমাধি স্মৃতিসৌধর কাজ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন বিশেষ করে যে কাজের জন্য তিনি নিজেকে
পুরোপুরিভাবে পুরোপুরিভাবে নিবেদন করেছিলেন, এবং তার পরিবর্তে দ্বায়িত্ব দিয়েছিলেন সিস্টিন
চ্যাপেল এর ছাদে আঁকার জন্য, যদিও
মাইকেলেঞ্জেলো সবসময়ই বলে এসেছেন, ছবি আঁকার
প্রক্রিয়াটি তিনি ঘৃণা করেন।
৮৭ মাইকেলেঞ্জেলো, বন্দী |
৮৮ মাইকেলেঞ্জেলো, আলো থেকে অন্ধকারের পৃথকীকরণ |
আমি মনে করি
বিষয়টি অনুপ্রেরণা হিসাবেই তাঁকে স্পর্শ করেছিল। সমাধি স্মৃতিসৌধের মূল নকশায়
প্রায় চল্লিশটি মার্বেলের ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, যাদের প্রতিটি প্রমাণ সাইজের চেয়ে অনেক বড়।
এতগুলো ভাস্কর্যের কাজ কিভাবেই বা মাইকেলেঞ্জেলো শেষ করতে পারতেন? আমরা জানি যে কোনো পাথরের খোদাই কারিগরের চেয়ে
অনেক দ্রুত তিনি মার্বেল খোদাই করতে পারতেন। কিন্তু এমনকি তার সেই বীরোচিত
কর্মশক্তির সত্ত্বেও বিশ বছর সময় লাগতো কাজটি শেষ করতে, বিশেষ করে যখন সেই সময়ে তার মানসিক অবস্থার
পরিবর্তন ও বিকাশ হচ্ছিল। এছাড়া বাস্তব সত্যটি হচ্ছে যে, ছাদের উপর, তিনি প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন তার মূল
ভাবনাগুলোকে, শুধুমাত্র একটি
কোন শরীরের অবয়বের উপর মনোযোগ না দিয়ে, এটি তাকে বরং মুক্ত করেছিল মানুষের সম্পর্ক আর মানুষের নিয়তি সংক্রান্ত তার
ভাবনাকে আরো বেশী সম্প্রসারণ করার জন্য। এগুলো কি তার নিজের ভাবনা ছিল? দার্শনিক ভাবনাপূর্ণ রেনেসাঁর সব মহান চিত্রকর্মগুলোয়
মূল ভাবনাগুলো প্রস্তাব করেছিল কবি এবং ধর্মতাত্ত্বিকরা। কিন্তু মাইকেলেঞ্জেলোর
একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, পোপ তাকে
বলেছিলেন, তার ইচ্ছামত কাজ
করার জন্য, সুতরাং আমি মনে
করি, এই ছাদের বিষয়বস্তু
প্রধানত তার নিজেরই ধারণা: অথবা বরং, বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বীয় উৎস থেকে সংগৃহীত তাঁর নিজস্ব কম্পোজিশন। এবং এটি হচ্ছে
একটি কারণ, কেন এত কঠিন এটি
ব্যাখ্যা করা।
মাইকেলেঞ্জেলো
সংক্রান্ত লেখকরা এর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যাদের কোনোটাই পুরোপুরিভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কিন্তু একটি বিষয় সুনিশ্চিৎ। সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদ তীব্র আবেগময়তার সাথে মানুষের
শরীর, মন এবং আত্মার একাত্মতার
বিষয়টি দৃঢ়তার সাথে দাবি করে। আপনি শরীরের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এটি দেখে মুগ্ধতা
প্রকাশ করতে পারেন – উনবিংশ শতাব্দীর
সমালোচকরা যেমন করতেন – তারা প্রথম
তাকিয়েছিলেন সেই সব তথাকথিত ক্রীড়াবিদদের মত সুগঠিত শরীরের দিকে। অথবা মনের
দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, যেমন করে কেউ
তাকান ঐসব বুদ্ধিমত্ত্বাময় কর্মশক্তির মূর্তপ্রতীকগুলো, ঈশ্বরের প্রেরিত দূত, নবী এবং সিবিলদের (৪৪) প্রতি। কিন্তু যখনই কেউ
জেনেসিস এর ধারাবাহিক কাহিনীগুলোর দিকে তাকাবেন, আমি মনে করি তারা অনুভব করতে পারবেন যে,
মাইকেলেঞ্জেলো প্রধানত
ব্যস্ত ছিলেন আত্মা এবং আধ্যাত্মিকতা প্রকাশে। কাহিনী হিসাবে সেটি শুরু হয়েছে
প্রথম সৃষ্টি থেকে, আর শেষ হয়েছে
নোয়া’র মদমত্ততা দিয়ে। কিন্তু
মাইকেলেঞ্জেলো আমাদের বাধ্য করেন এটি বীপরিত দিক থেকে পড়তে – এবং সত্যি তাদের আকাঁও হয়েছে বীপরিত দিক থেকে।
যখন আমরা প্রবেশ করি, আমাদের মাথার উপর
নোয়া’র দৃশ্য (৪৫), যেখানে শরীর পুরোপুরি ভাবে তাদের অধিকার
প্রতিষ্ঠা করেছে। এবং এর অন্য প্রান্তে, বেদীর উপরে আমরা দেখি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে, যেখানে তিনি আলো থেকে অন্ধকারকে বিচ্ছিন্ন
করছেন (৮৮): শরীর রুপান্তরিত হয়েছে আত্মার একটি প্রতীককে, এমনকি মাথাও, যা সুস্পষ্ট মানবিক সংশ্লিষ্টতাসহ রুপান্তরিত
হয়েছে অস্পষ্টতায়।
এই দুটি দৃশ্যের
মাঝখানে আছে সৃষ্টির কেন্দ্রীয় পর্বটি, মানব সৃষ্টি (১৮)। এটি সেই সব দূর্লভ শিল্পকর্মগুলোর একটি, যা এই সাথে চুড়ান্তভাবে যেমন তার শ্রেষ্ঠত্বকে
প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, তেমনি এটি
পুরোপুরিভাবে বোধগম্য, এমনকি সেই সব
মানুষদের কাছেও, সাধারণত যারা
শিল্পকর্মের প্রতি কোন প্রতিক্রিয়া অনুভব করেন না। প্রথম দৃষ্টিতেই এর অর্থ স্পষ্ট
এবং হৃদয়কে স্পর্শ করে মোহনীয় মুগ্ধতায়। এবং তারপরও যত বেশী সময় ধরে কেউ এটির সাথে
পরিচিত হবে, আরো গভীরভাবে এটি
তাকে স্পর্শ করবে। মানুষ, অভূতপূর্ব
সৌন্দর্যের একটি শরীর সহ মানুষ, মাটিতে হেলান
দিয়ে শুয়ে আছে, প্রাচীন পৃথিবীর
সেই সব নদীর দেবতা এবং মদের দেবতাদের মত দেহভঙ্গিমা করে, যারা পৃথিবীর বাসিন্দা এবং যে পৃথিবী পরিত্যাগ
করার কোন ইচ্ছাই তাদের নেই। মানুষটি তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এমনভাবে যেন সেটি প্রায়
স্পর্শ করে ঈশ্বরের হাত এবং কোন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ যেন প্রবাহিত হয় তাদের দুজনের
আঙ্গুলের মধ্যে দিয়ে। এবং এই অসাধারণ সুন্দর শারীরিক উপাদানের মধ্য দিয়েই ঈশ্বর
সৃষ্টি করেন একটি মানব আত্মা। এবং পুরো সিস্টিন চ্যাপেলকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব
কবিতা হিসাবে, যার মূল বিষয়
হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টির সেই মুহুর্ত, সেই ঐশ্বরিক আশীর্বাদ যা রেনেসাঁর মানুষদের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আর
সর্বশক্তিমানের পেছনে, তার পরিচ্ছদের
আলাখেল্লার ছায়ায়, ইভের (৪৬) অবয়ব,
যে ইতিমধ্যে সৃষ্টিকর্তার
ভাবনায় জায়গা করে নিয়েছে, এবং যাকে আমরা
অনুভব করতে পারি, ইতিমধ্যে,
বহু সমস্যার সম্ভাব্য উৎস
হিসাবে।
অ্যাডামকে (৪৭)
জীবন দান করার পর (এখনও আমরা পুরো ধারাক্রমটি বীপরিত দিক থেকে পড়ছি), সৃষ্টিকর্তার ইতিপূর্বে করা অন্যান্য সৃষ্টির
দৃশ্যগুলোর আগমন ঘটে। তারা একধরনের ক্রমশ তীব্রতর হয়ে ওঠার মতে পরিস্থিতি সৃষ্টি
করে, ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করে
যেন সঙ্গিতের ক্রিসেন্ডো মত কোন কিছু, যেখানে দৃশ্যগুলো দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন করতে থাকে। প্রথমত, ঈশ্বর মাটি থেকে পানিতে আলাদা করেন। ‘এবং ঈশ্বরের আত্মা এর পর পানির উপর অবস্থান
নেন।’ আমি জানি না কেন এই
শব্দমালা এর যে কোন পাঠককে প্রশস্তির একটি অনুভূতি প্রদান করে, কিন্তু তারা সেটি অবশ্যই করে এবং মাইকেলেঞ্জেলো
সেটি প্রকাশ করতে পেরেছিলেন একটি ধীর শান্ত গতিময়তা আর আশীর্বাদের ভঙ্গিমা সৃষ্টি
করার মাধ্যমে। এর পরের দৃশ্য, সুর্য এবং
চন্দ্রের সৃষ্টি, এখানে কোন
আশীর্বাদের ভঙ্গিমা নেই বা কোন কিছুকে আবির্ভূত হবার আবেদন নেই, বরং তিনি এখানে নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন এই সব অগ্নিময় উপাদানগুলো সৃষ্টি করার জন্য
তার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব আর দ্রুততার প্রয়োজন, এবং বায়ে তিনি অনায়াসে উড়ে গিয়ে আরেকটি দৃশ্যে
সৃষ্টি করেন সব গ্রহগুলো। পরিশেষে আবার আমরা ফিরে আসি আলো থেকে অন্ধকারকে পৃথক
করার দৃশ্যে। সীমাবদ্ধ মানুষের অসীম শক্তির দৃশ্যকে চিত্রায়িত করার সব প্রচেষ্টার
মধ্যে, এটাই আমার কাছে
সবচেয়ে বেশী বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে; এমনকি আমরা বলতে পারি সবচেয়ে বাস্তবঘনিষ্ট, কারণ নক্ষত্র কেন্দ্র সৃষ্টি হবার
আলোকচিত্রগুলো প্রায় একই রকম ঘূর্ণায়মান গতিময়তা প্রদর্শন করে।
মাইকেলেঞ্জেলো’র ভবিষ্যতসূচক অন্তর্দৃষ্টির শক্তি আমাদের মনে
সেই অনুভূতির জন্ম দেয় যে, তিনি আসলে সকল
যুগেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং সবচেয়ে বেশী, হয়তো গ্রেট রোমান্টিকদের যুগটির, আমরা এখনও যে যুগের প্রায় সর্বস্বান্ত
উত্তরসূরি। আর এই বৈশিষ্ট্যই তাকে খুব স্পষ্টভাবে স্বতন্ত্র করেছে তার অত্যন্ত
মেধাবী প্রতিদ্বন্দীদের থেকে। রাফায়েল তাঁর যুগেরই একজন মানুষ ছিলেন। তিনি
আত্মীকৃত আর সমন্বয় করেছিলেন সবকিছুকে যা তার সময়ের সেরা মানুষরা অনুভব করেছিলেন
আর ভেবেছিলেন।
৮৯ রাফায়েল, স্কুল অব এথেন্স |
তিনি ছিলেন
সবচেয়ে সেরা সমন্বয়কারী – আর সেকারণেই আজ
তার পক্ষে তিনি সমর্থন হারিয়েছেন। কিন্তু ইউরোপীয় সভ্যতা বর্ণনা করার কোন
প্রচেষ্টায় তার নাম অবশ্যই সবার আগে আসবে। পোপের বাসভবন বা পাাপাল আপার্টমেন্ট এর
অলঙ্করণে যে ভাবনাগুলোকে তিনি দৃশ্যমান একটি রুপ দিয়েছিলেন সেগুলো আসলেই একটি
সংশ্লেষণ, যা সবকিছুকে
অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যেমন মধ্যযুগীয়
মহান ধর্মতাত্ত্বিকদের সারসঙ্কলনগুলো।
যুক্তিসঙ্গত
কারণে মনে করা যেতে পারে যে রাফায়েলকে পোপের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিল তার
একই শহরের অধিবাসী ব্রামান্টে, পোপ দ্বিতীয়
জুলিয়াস এর সাথে তার অপেক্ষাকৃতভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রাফায়েল কোন একটি ড্রইং
দেখা মাত্র জুুলিয়াস এর বুঝতে কোন সমস্যা হয়নি যে ঈশ্বর তাকে আরো একজন অসাধারণ
প্রতিভাবান মানুষের সন্ধান দিয়েছেন। তাসত্ত্বেও জুলিয়াস এর জন্য একটি সাহসী পদক্ষেপ
ছিল সাতাশ বছরে তরুন রাফায়েলকে নির্বাচন করা, বিশেষ করে যখন দেয়ালচিত্র বা ম্যুরাল আকাঁর
জন্য রাফায়েল এর আগে মাত্র একবারই চেষ্টা করেছিলেন। এবং এমন কোন কিছু প্রমাণও
প্রদর্শন করতে পারেননি যে সুবিশাল ধারণাগুলোর সাথে দৃশ্যগতভাবে তিনি আদৌ খাপ খাইয়ে
নিতে পারবেন কিনা। পোপ তাকে দ্বায়িত্ব প্রদান করেন তার নিজের জীবন কেন্দ্রিক,
বিশেষ করে যে কক্ষগুলো
পোপ ধ্যান করেন ও তার সিদ্ধান্তগুলো নেন, সেই কক্ষগুলো অলঙ্করণ করার জন্য।
‘স্টানজা দেলা
সেইনাচুরা’ পোপের ব্যক্তিগত
লাইব্রেরী হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। রাফায়েল উরবিনোর লাইব্রেরীর সাথে পরিচিত ছিলেন
যেখানে কবি, দার্শনিক এবং
ধর্মতাত্ত্বিকদের প্রতিকৃতি সাজানো থাকতো তাদেরই লেখা বই সাজানো তাকের উপর এবং
তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন সেই একই ভাবনাকে আরো বহুদুর এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। তিনি
শুধুমাত্র মাত্র নীচের তাকে সাজানো বইগুলোর লেখকদেরই প্রতিকৃতি আঁকবেন না বরং
তাদের একে অপরের সাথে এবং জ্ঞানের সম্পূর্ণ জগতের সাথে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক
তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে জগতের তারা
একটি অংশ। তিনি অবশ্যই উপদেশ পেয়েছিলেন শিক্ষিত আর জ্ঞানী মানুষদের কাছ থেকে যারা
পোপের কুরিয়া বা প্রশাসনিক ব্যবস্থার এক তৃতীয়াংশ গঠন করেছিলেন। কিন্ত তার
সৃষ্টিতে এইসব অসাধারণ মানুষদের সঙ্গ কোন কমিটির পরামর্শের মাধ্যমে একত্র করা
হয়নি। যেমন ‘স্কুল অব এথেন্স’
(৮৯) এর দুটি কেন্দ্রিয়
চরিত্র, আদর্শবাদী প্লেটো
বাদিকে এবং তিনি উপরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন স্বর্গীয় অনুপ্রেরণাকে স্বীকৃতি
দিয়ে। তাকে ছাড়িয়ে আরো বায়ে আছে দার্শনিকরা, আমাদের সহজাত অর্ন্তজ্ঞান আর আবেগের প্রতি যারা
আবেদন রেখেছিলেন। তারা অ্যাপোলোর প্রতিরুপটির অপেক্ষাকৃত নিকটে – এবং তারা আমাদের পারনেসাসের (৪৮) দৃশ্য আঁকা দেয়ালটির দিকে নির্দেশ করে। ডানদিকে
আমার দেখি অ্যারিস্টোটলকে, শুভবুদ্ধির এক
মানুষ, মধ্যস্থতা করার
মত করে যিনি হাত বাড়িয়ে আছেন। এবং তাকে ছাড়িয়ে আমরা দেখি যৌক্তিক কর্মকান্ডের
প্রতিনিধিদের: যুক্তি, ব্যকরণ এবং
জ্যামিতি। অদ্ভুত ব্যাপারটি হচ্ছে রাফায়েল তাঁর নিজের প্রতিকৃতিকে এই গ্রুপের সাথে
যুক্ত করেছিলেন। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির পাশে। তাঁদের নীচে আমরা দেখতে পাই
জ্যামিতি বিশেষজ্ঞ একজনকে -আমার মনে হয় তিনি ইউক্লিড। এটি অবশ্যই ব্রামান্টের
প্রতিকৃতি, এবং এখানে
ব্রামান্টের উপস্থিতি থাকাটাই সঠিক, কারণ যে ভবনে মানব যুুক্তির প্রতিনিধিরা সববেত হয়েছে সেটি ব্রামান্তের নতুন
সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার স্বপ্নকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। রাফায়েল নিজে পরবর্তীতে
স্থপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন – খুবই ভালো মানের একজন স্থপতি – কিন্তু ১৫১০
খ্রিস্টাব্দে তার পক্ষে সম্ভব ছিল এমন কোন ভবনের পরিকল্পনা করা: জীবনকে সমৃদ্ধ
করার জন্য শিল্পকলায় স্পেস বা বিস্তারের অন্যতম সেরা ব্যবহার। এটি হয়তো ব্রামান্তে
পরিকল্পনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু রাফায়েল
এটিকে তার নিজের করে নিয়েছিলেন। সব মহান শিল্পীদের মতই তিনিও একজন ঋণগ্রহীতা তবে
প্রায় অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশী তিনি তার ঋণ করা বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করে নিতে
পেরেছিলেন।
কারো হয়তো সেই
অস্পষ্ট অনুভূতিটি হতে পারে যে তাঁর সব ভঙ্গিমাগুলোই অনুপ্রাণিত হয়েছে গ্রীক বা
হেলেনিষ্টিক ভাস্কর্য দ্বারা, কিন্তু স্টাঞ্জে
বা রাফায়েল এর সেই কক্ষে প্রতিটি শারীরিক অবয়বই বিশুদ্ধভাবে রাফায়েল এর – তবে একটি শারীরিক অবয়ব ছাড়া। ফ্রেস্কোর সামনের
দিকে বসে থাকা বিষন্ন দার্শনিককে ফ্রেস্কোর পূর্ণাঙ্গ ড্রইং এ আমরা দেখিনা (পূর্ণ
সাইজের ড্রইংটি এখনও টিকে আছে প্রায় অলৌকিক ভাবেই); আমরা দেখতে পারি কোথা থেকে সে আসলে এসেছে –
সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদ
থেকে। সিস্টিন চ্যাপেল এ কাজ করার সময় মাইকেলেঞ্জেলো কাউকেই সেখানে ঢুকতে দিতেন না,
কিন্তু ব্রামান্টের কাছে
একটি বাড়তি চাবি ছিল, এবং একদিন যখন
মাইকেলেঞ্জেলো সেখানে ছিলেন না, তিনি রাফায়েলকে
তাঁর সাথে নিয়ে সেখানে ঢুকেছিলেন। কার কি এসে যায় তাতে, বড় শিল্পীরা তাদের যা প্রয়োজন সেটাই তারা গ্রহন
করেন। যখন মানব যুক্তিবাদীতা বাস্তব পৃথিবীতে তার শিকড় প্রোথিত করে আছে একটি
দেয়ালে, এর বীপরিত দেয়ালে
আমরা দেখতে পাই স্বর্গীয় জ্ঞানকে শুন্যে ভাসমান অবস্থায়, সেই সব দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক আর চার্চের নেতাদের মাথার উপর,
যারা সেটি ব্যাখ্যা করার
চেষ্টা করেছেন। উন্মোচিত সত্য বা ঐশী প্রত্যাদাশের মাধ্যমে প্রাপ্ত সত্যের
অনুসন্ধানকারী এই দুটি গ্রুপকে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে ঠিক একই
মনোযোগ দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো কক্ষটির দার্শনিক ভাবধারা অনুযায়ী, যার অস্তিত্ব আমরা অনুভব করি ‘দি স্কুল অব এথেন্স’ এ। যতদুর অবধি সভ্যতা বলতে আমরা বুঝি সৃজনশীল
কল্পনা মাধ্যমে সমকালীন চিন্তার সব শ্রেষ্ঠত্বকে ধারণা করা একটি প্রচেষ্টা,
এই দুটি দেয়াল কোন সন্দেহ
নেই সভ্যতার শিখরকে প্রতিনিধিত্ব করছে। তৃতীয় দেয়ালে, পারনাসাস এর ফ্রেস্কো রাফায়েল এর চরিত্রের
ভিন্ন একটি দিককে প্রকাশ করে।
৯০ রাফায়েল, পারনাসাস (আংশিক) |
মাইকেলেঞ্জেলো
বীপরিত লিঙ্গের প্রতি কখনোই কোন আকর্ষণ অনুভব করেননি; প্রজননের একটি প্রক্রিয়া ছাড়া লিওনার্দো
নারীদের নিয়ে অন্য কিছু ভাবেননি, কিন্তু রাফায়েল
রমণীদের ভালোবেসেছিলেন যে কোন ভেনিসবাসীর মত এবং তার মিউজেস (৯০) ইন্দ্রিয়ঘন
কাব্যময়তার একটি সুস্পষ্ট বোধকে দৃশ্যমান রুপ দিয়েছে, যা তার নিজস্ব একটি উপায়ে, বুদ্ধিবৃত্তিক নৈর্ব্যাক্তিতার মতই সেটিও ঠিক
একই ভাবে সভ্যতা সৃষ্টিকারী।
ভ্যাটিকান
প্যালেস এর কক্ষগুলো তখন অসমাপ্ত অবস্থায়, ১৫১৩ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় জুলিয়াস মৃত্যুবরণ করেন এবং তার পরবর্তীতে
দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত পোপ দশম লিও, জুলিয়াসের মত
বীরোচিত কোন মানসিকতার মানুষও ছিলেন না। মাইকেলেঞ্জেলো ফ্লোরেন্স এ প্রত্যাবর্তন
করেন, তবে রাফায়েল থেকে যান
রোমে। কোন কিছু সম্পাদন করার এবং তার অতুলনীয় উদ্ভাবনী ক্ষমতার চুড়ান্ত ব্যবহার
করে এবং এমনকি তার আবিষ্কার করার অতুলনীয় শক্তি ব্যবহার করে, এক দল মেধাবী তরুনকে তিনি বেশ কিছু ড্রইং এবং
প্রকল্পের নক্সা প্রদাণ করেছিলেন, যারা সেই কক্ষে
তাদের রুপান্তরিত করেছিল দেয়াল চিত্রে এবং অন্যান্য স্থাপত্য শৈলীর অলঙ্করণ হিসাবে,
– পোপের প্রাসাদের
কক্ষগুলোর বাকী অংশে, ফারনাজিনার
লুনেটগুলো , লজ্জি , ভিলা মাডামা এবং কার্ডিনাল বিবিয়েনার জন্য একটি
প্যাগান অলঙ্করন সহ স্নানঘর, আর
ট্রান্সফিগারেশন নিয়ে তো কিছুই বলার অপেক্ষা রাখেনা, সপ্তদশ শতাব্দীর অ্যাকাডেমিজম এর ভবিষ্যতসূচক
একটি কাজ, যে কাজটি অবশ্যই
তিনি নিজের উপরেও করেছিলেন: অর্ধশতাব্দীর কাজ মাত্র তিন বছরে। তাদের মধ্যে আছে আরো
কিছু অসাধারণ শিল্পকর্ম যা ইউরোপীয় কল্পনায় যুক্ত হয়েছে, যেমন রেনেসাঁয় প্যাগানিজমের উত্থাণের একটি
শ্রেষ্ট নিদর্শন – গ্যালাতিয়া (৯১),
ভিলা ফারমাজিনায় যেটি
এঁকেছিলেন। মাত্র পনেরো বছর আগেও এর পূর্ববর্তী প্যাগান প্রাচীনতাকে অদ্ভুতভাবে
উপস্থাপন করা হয়েছিল, খুবই নম্র এবং
কৌণিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে। এখন এটি নিখুঁতভাবে অনুধাবন ও বোঝা সম্ভব। যখন রেনেসাঁর
কবিরা ল্যাটিন ভাষায় পদ্য লিখতে শুরু কওে ( খুবই সুন্দর ল্যাটিন কবিতাও), তাদের কাছে বহু আদর্শই ছিল। কিন্তু কি পরিমান
অসাধারণভাবে বিস্ময়কর কল্পনাপ্রবণ অন্তর্দৃষ্টি দরকার ছিল রাফায়েল এর জন্য কোন
সারকোফাগাই এর খন্ডাংশ ও টুকরো থেকে একটি দৃশ্যকে পুণসৃষ্টি করার জন্য, যা দেখতে অবশ্যই অনেকটাই সেই প্রাচীন হারিয়ে
যাওয়া চিত্রকর্মের মত ছিল।
এই সব বছরগুলোয়
রাফায়েল এর অন্যান্য অর্জনগুলো ছিল আরো বেশী প্রশ্নবিদ্ধ, যদিও ইউরোপীয় মননে তার প্রভাব অতুলনীয়ভাবে
বিশাল। আমরা সেটি স্পষ্ট দেখতে পাই সিস্টিন চ্যাপেল এর জন্য বানানো এক সেট
ট্যাপেস্ট্রির পরিকল্পনায়, যা যীশুর নিকট
শিষ্যদের জীবনের বেশ কিছু পর্বকে প্রতিনিধিত্ব করছে। শিষ্যরা ছিল খুবই দরিদ্র
মানুষ, তারা সাধারণ
মানবতার একটি অংশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। রাফায়েল তাদের সুসম ভাবে রুপান্তরিত করেছেন
অভিজাত আর সুদর্শন রুপে। আমাদের জন্য হয়তো ভালো কিছুক্ষনের দৈনিন্দিন জীবনের নানা
কর্মকান্ড থেকে অব্যাহতি নিয়ে এই উচ্চ পর্যায়ের একটি অবস্থায় অবস্থান করা। কিন্তু
যে প্রথাগত ধারায় বাইবেল এবং ধর্ম নিরপেক্ষ নানা ক্ষেত্রের ইতিহাসে ঘটনাগুলো
সংঘটিত হয়েছিল – সুদর্শন এবং আচরন
ও পরিচ্ছদে পরিপাটি – সেই ধারাটি দীর্ঘ
সময় ধরে অব্যাহত ছিল – উনবিংশ শতাব্দীর
মাঝামাঝি পর্যন্ত। শুধুমাত্র অল্প কিছু শিল্পী – হয়তো শুধুমাত্র রেমব্রান্ট এবং কারাভাজিও আছেন
প্রথম সারিতে – যথেষ্ট পরিমান
স্বাধীন ছিলেন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার জন্য। এবং আমি মনে করি এই প্রথা, যা তথাকথিত গ্রান্ড ম্যানার বা মহান আচরণের
একটি উপাদান ছিল, সেটি রুপান্তরিত
হয়েছিল ইউরোপীয় মননে সব কিছুকে প্রাণহীন করে দেবার মত একটি প্রভাবে। এটি আমাদের
সত্যকে অনুভব করার অনুভূতিটাকে দূর্বল করেও দিয়েছিল, এমনকি আমাদের নৈতিক দ্বায়িত্ববোধকেও, এবং যা আমাদের নির্দেশ করেছিল এখন আমরা যা
দেখছি – একটি কুৎসিত
প্রতিক্রিয়া অভিমূখে। ১৫১৩ সালের শরতে, জুলিয়াস এর মৃত্যুও অল্প কিছুদিন পর, ভ্যাটিকানে বেলভেদেয়ারে থাকার জন্য আর একজন বিশাল চরিত্রের আগমন ঘটেছিল –
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ।
ইতিহাসবিদরা প্রায়শই তাকে চিহ্নিত করেন একজন বৈশিষ্ট্যসূচক রেনেসাঁ মানব হিসাবে।
কিন্তু এটি ভ্রান্ত একটি ধারণা।
৯১ রাফায়েল, গ্যালাতিয়া |
যদি লিওনার্দো
কোন একটি বিশেষ সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেই থাকেন, সেটি সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দীর শেষাংশ। কিন্ত
বাস্তবিকভাবেই তিনি কোন সময়ের পর্বেই বন্দী নন, কোন পর্বের সাথে তিনি সামঞ্জষ্যপূর্ণ ছিলেন না।
এবং তাকে আপনি যত বেশী চিনবেন, আরো বেশী
রহস্যময়তা তাকে আবৃত করে। অবশ্যই রেনেসাঁ পর্বের কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট তার
ছিল। তিনি সৌন্দর্য আর রুচিশীল অঙ্গভঙ্গি ও গতিময়তা পছন্দ করতেন। তিনি নিজেও এটি
ভাগ করে নিয়েছিলেন, এমনকি পূর্বধারণা
করেছিলেন ষষ্ঠদশ শতাব্দীর শুরুর অতিআত্মমন্যতাকে: যে ঘোড়াটিকে তিনি মডেল হিসাবে
ব্যবহার করেছিরেন ফ্রানচেসকো এসফোরজা প্রতি নিবেদিন একটি স্মৃতিসম্ভ হিসাবে সেটি
হবার কথা ছিল ছাব্বিশ ফুট উঁচু। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, আরনো নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে যা এমন কি
আধুনিক প্রযুক্তিও করতে সক্ষম হয়নি। এবং এছাড়াও, অবশই, চুড়ান্ত একটি মাত্রায়, তার সময়ের একটি
ক্ষমতা তার ছিল – চোখে যা কিছু
পছন্দ, সেই সবকিছুই
লিপিবদ্ধ করা এবং বোধগম্য সংক্ষিপ্ত একটি রুপ দেওয়া।
কিন্তু তার এইসব
দক্ষতাগুলোর উপর প্রাধাণ্য বিস্তার করেছিলো একটি শক্তিশালী তীব্র আবেগ, যেটি কোন রেনেসাঁর বৈশিষ্ট নয় – কৌতূহল। ইতিহাসে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী
অবিশ্রান্তভাবে কৌতুহলী একজন মানুষ। যা কিছুই তিনি দেখেছেন, সব কিছুই তাকে অনুপ্রাণিত করেছে প্রশ্ন করতে –
কেন এবং কিভাবে ? কেন আমরা পর্বতের চুড়ায় সামুদ্রিক ঝিনুকের খোলশ
পাই? ফ্ল্যান্ডারস কিভাবে তারা
লক তৈরী করে? কিভাবে পাখি ওড়ে?
দেয়ালে ফাটল ধরার কারণই
বা কি? বাতাস এবং মেঘ এর
জন্ম হয় কিভাবে? কিভাবে একটি
পানির ¯্রােত অন্য একটি
পানির ¯্রােতকে ভিন্ন
দিকে পরিচালিত করে? খুঁজে বের করতে
হবে, এবং লিখে রাখতে হবে। যদি
দেখা সম্ভব হয় তাহলে সেটি আঁকতে হবে। একই প্রশ্ন বার বার করতে হবে। লিওনার্দোর
কৌতুহলের সমকক্ষ ছিল অবিশ্বাস্য রকম একটি মানসিক কর্মশক্তি। লিওনার্দোর নোটবুকে
হাজার হাজার শব্দ পড়ে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন পাঠক এই কর্মশক্তির প্রাবল্যে পুরোপুরিভাবে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়বেন। কোন
উত্তর হিসাবে তিনি ‘হ্যা’ গ্রহন করতে রাজী ছিলেন না। আর কোন বিষয় জানার
জন্য তিনি কখনোই হাল ছাড়তে রাজী ছিলেননা। তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবতেন, এরপর আবার নতুন করে সেটি প্রস্তাব করতেন,
কাল্পনিক কোন
ভিন্নমতাবলম্বীর প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এই সব প্রশ্নগুলোর মধ্যে, যে প্রশ্নটি তিনি বারবার করতেন, সেটি মানুষ সম্বন্ধে: বুদ্ধি,যুক্তি আর অমর দেবতাদের মত স্মৃতি সহ আলবার্টি
অভিমন্ত্রণের সেই মানুষ নন বরং ‘মানুষ’ একটি প্রক্রিয়া হিসাবে। কিভাবে সে কথা বলে?
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন
কিভাবে দশটি উপায়ে পা আকা যায়, যাদের প্রত্যেকটি
এর গঠনগত কাঠামোর কোন না কোন একটি ভিন্ন দিক উন্মোচন করে। কিভাবে হৃদপিন্ড রক্ত
সঞ্চালন করে? কি ঘটে যখন সে
হাচি দেয় কিংবা হাই তোলে? কিভাবে একটি শিশু
জরায়ুতে বাস করে? পরিশেষে কেন সে
মারা যায় বৃদ্ধ বয়সে? ফ্লোরেন্স এর
একটি হাসপাতালে লিওনার্দো একজন শতবর্ষীয় মানুষের খোঁজ পেয়েছিলেন, এবং বেশ আনন্দের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তার
মৃত্যুর জন্য, যেন তিনি তার
রক্ত নালিকাগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
প্রতিটি প্রশ্নই
দাবী করে ব্যবচ্ছেদের এবং প্রতিটি ব্যবচ্ছেদই আঁকা হয়েছে বিস্ময়কর সূক্ষèতা সাথে ও নিখুঁতভাবে (৯২)। এবং পরিশেষে,
কি খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি?
যে মানুষ, যতই তার উল্লেখযোগ্য যান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকুক
না কেন, কোনভাবেই সে অমর
দেবতাদের মত নয়। সে শুধু নিষ্ঠুর আর হিং¯্রই নয় বরং অত্যন্ত দূর্বল প্রকৃতির শক্তির কাছে। যদি মাইকেলেঞ্জেলোর নিয়তির
বিরুদ্ধাচারণ অসাধারণ হয়ে থাকে, তাহলে প্রায় আরো
বেশী কিছুটা বীরোচিত বলা যেতে পারে, যেভাবে লিওনার্দো, বুদ্ধিবৃত্তির
একজন বীর, প্রকৃতির
ব্যাখ্যাতীত অদম্য শক্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। রোমে, যে বছরে রাফায়েল দেব-সদৃশ মানব বুদ্ধিমত্তার
প্রশস্তি রচনা করেছিলেন, লিওনার্দো
ধারাবাহিকভাবে কিছু ড্রইং করেছিলেন পানিতে প্লাবিত একটি পৃথিবীর (৯৩)। যেভাবে তিনি
এই বিপর্যয়টিকে উপস্থাপন করেছিলেন, সেখানে আমরা
উপভোগ আর উপেক্ষার একটি অদ্ভুত মিশ্রণ প্রদর্শিত হয়।
৯২ লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাতৃজঠরে শিশুর রেখাচিত্র |
৯৩. লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মহাপ্লাবন (রেখাচিত্র) |
একদিকে তিনি
হাইড্রোডিনামিক্স বা পানিগতিবিদ্যার একজন ধৈর্যশীল পর্যবেক্ষক: অন্যদিকে তিনি
হচ্ছেন কিং লিয়ার যিনি মহাপ্লাবনের উদ্দেশ্যে বলছেন:
প্রবাহিত হও,
বাতাস এবং তোমার গাল
ফাটিয়ে ফেলো! আরো তীব্রভাবে! প্রবাহিত হও!
জলের ধারা আর
ঘূর্ণিঝড়, প্রবল বেগে ছিটকে
বেরিয়ে আসো
যতক্ষণ না আমাদের
গীর্জার চুড়া ভেজাতে পারো, ডোবাতে পারো
চুড়ার মোরগগুলোকে।
বিপর্যয়গুলোর
সাথে আমরা অপরিচিত নই; প্রতিদিনই
টেলিভিশনের আমরা তাদের দেখছি, কিন্তু
নিখুঁতভাবে প্রতিভার আশীর্বাদের পুষ্ঠ কোন রেনেসাঁর মানুষের কাছ থেকে, এই সব অসাধারণ ড্রয়িংগুলো আসলেই ভবিষ্যতসূচক।
সেই সূবর্ণ মুহুর্তগুলো প্রায় শেষ। কিন্তু যতদিন এটি টিকে ছিল মানুষ এমন একটি
অবস্থান অর্জন করেছিল, যে অবস্থান যে
ধারে কাছে সে আসতে পারেনি আগে কখনোই। মানবতাবাদীদের বুদ্ধিমত্তার মত কোন সদগুনের
প্রতি আমরা যুক্ত করেছি বীরোচিত ইচ্ছাশক্তি। এবং কয়েক বছরের জন্য, মনে হয়েছিল যে এমন কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই যা
কিনা মানব মন তার কর্তৃত্বের অধীনে আনতে এবং সমন্বয় সাধন করতে পারবে না।
টিকা:
(১) মার্কাস
অরেলিয়াস, (মার্কাস অরেলিয়াস
আন্টোনিয়াস অগাষ্টাস – ১২১-১৮০
খৃষ্টাব্দ) ১৬১ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৮০ খৃষ্টাব্দ অবধি রোমান সম্রাট ছিলেন।
(২) ডোনাটো
ব্রামান্টে (১৪৪৪-১৫১৪) ইতালীয় স্থপতি, যিনি মিলান এবং রোমে উত্তর রেনেসাঁ পবের্র স্থাপত্যশৈলী সূচনা করেছিলেন। রোমে
তিনি সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা ( ভ্যাটিক্যান সিটির মূল চার্চ) পরিকল্পনা করেছিলেন,
তার ডিজাইনের উপর ভিত্তি
করে কাজটি শেষ করেন মাইকেলেঞ্জেলো। তার বিখ্যাত নির্মাণ টামপিয়েত্তো (সান পিয়েত্রো
ইন মনটরিও, এখানে সেইন্ট
পিটারকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল মনে করা হয়) বা ছোট স্মারক চার্চ ১৫০২ সালে রোমে
স্থাপত্য শৈলীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।
(৩) সান-ট্র্যাপ
হচ্ছে একটি খোলা বারান্দা কিংবা টেরেস অথবা কোন বাগান সেটি এমনভাবে পরিকল্পিত থাকে
যে সুর্যের তাপ ও আলোর উপস্থিতি যেমন থাকে, তেমনি এটি ঠান্ডা বাতাস থেকেও রক্ষা করে)।
(৪) দ্য কর্টিল
ডেল বেলভেদেয়ার, দ্য বেলভেদেয়ার
কোর্টইয়ার্ড, এটি পরিকল্পনা
করেছিলেন ডোনাটো ব্রামান্টে, ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দ
থেকে, রোমের ভ্যাটিক্যান
প্যালেস এর সবচেয়ে বড় স্থাপত্যের কাজ। বহু শতাব্দী ধরে পশ্চিম ইউরোপে বহু জায়গায়
এই পরিকল্পনাই ব্যবহৃত হয়েছে। একটি পরিকল্পিত হয়েছিল চারপাশে ঘেরা একটি জায়গা
হিসাবে, কিন্ত এটি পরে
সম্প্রসারিত হয়ে যুক্ত হয় দীর্ঘ বেলভেদেয়ার কোর্টটি ভিলা বেলভেদেয়ারকে ভ্যাটিকাল
প্যালেসের সাথে সংযুক্ত করছে।
(৫) নিশ হচ্ছে
দেয়ালের মধ্যে সৃষ্টি করা ফাকা জায়গা, যেখানে সাধারণত কোন ভাস্কর্য রাখা হয়।
(৬) পুবলিয়াস
ইলিয়াস হেড্রিয়ানাস অসাস্টাস (হেড্রিয়ান (৭৬-১৩৮), ১১৭ থেকে ১৩৮ খ্রিস্টাব্দ অবধি রোমের সম্রাট
ছিলেন।(৭) ফিনিয়াল স্থাপত্য নির্মাণের একটি অংশ, এটি এমন কোন উপাদান যা কোন কিছুর শীর্ষবিন্দু
বা শেষবিন্দুকে প্রতিনিধিত্ব করে, অলঙ্করণ হিসাবে
এদের তৈরী করা হয়। বেলভেদেয়ারের সাজানো পাইনকোন ও এর দুইপাশের দুটি ব্রোঞ্জ
নির্মিত ময়ুর এখানে নিয়ে আসা হয়েছি হ্যাড্রিয়ানের স্মৃতিসৌধ থেকে। এটি ভ্যাটিকান ও
পালাজ্জিও দে বেলভেদেয়ারে’কে সংযুক্ত
করে।(৮) হিপপোড্রোম হচ্ছে প্রাচীন গ্রীসের ঘোড় দৌড় বা চ্যারিওট বা রথ দৌড়
পতিযোগিতা জন্য নির্দিষ্ট স্টেডিয়াম।
(৯) পোপ পঞ্চম
নিকোলাস (১৪৪৭ থেকে তার মৃত্যুর সময় ১৪৫৫ অবধি পোপ ছিলেন।
(১০) লিওন বাতিস্তা আলবার্টি (১৪০৪-১৪৭২) ছিলেন একজন
ইতালীয় মানবতাবাতী, লেখক, শিল্পী, স্থপতি, কবি, যাজক, ভাষাবিদ, দার্শনিক এবং ক্রিপ্টোগ্রাফার, রেনেসাঁ’র মানুষের মূর্ত প্রতীক।
(১১) ঐতিহাসিকভাবে বহুইশ্বরবাদী এমন একটি ধারণাকে
প্রতিনিধিত্ব করে শব্দটি।
(১২) পোপ দ্বিতীয় পায়াস, ১৪৫৮ থেকে ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দ অবধি পোপ ছিলেন।
(১৩) পোপ চতুর্থ
সিক্সটাস, যিনি পোপ হিসাবে
আসীন ছিলেন, ১৪৭১ থেকে ১৪৮৪
খ্রিস্টাব্দ অবধি। তিনি ভ্যাটিকান আর্কাইভ ও সিস্টিন চ্যাপেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
(১৪) মেলোৎসো দা
ফরলি (১৪৩৪-১৪৯৪) ইতালীয় রেনেসাঁর শিল্পী ও স্থপতি ছিলেন।
(১৫) বার্টোলোমিও
প্লাটিনা (১৪২১-১৪৮১), ইতালীয় রেনেসাঁ
পর্বের একজন মানবতাবাদী ।
(১৬) শিল্পকলার ইতিহাসে হাই রেনেসাঁ পর্বটিকে
চিহ্নিত করা হয় ইতালী রেনেসা‘য় দৃশ্যমান
চিত্রকলার শীর্ষ বিন্দুটিকে চিহ্নিত করার জন্য। প্রথাগতভাবে মনে করা হয় এটি সূচনা
হয়েছিল ১৪৯০ এর দশকে, মিলানে
লিওনার্দোর দি লাস্ট সাপার ফ্রেস্কোর ও ফ্লোরেন্সে লরেনজো দে মেডিচি’র মুত্যুর সাথে এবং সমাপ্ত হয়েছিল পঞ্চম
চার্লসের সৈন্যদের রোম ধ্বংস করার মাধ্যমে (১৫২৭); এই শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দী
শুরুতে, এই সময়ে
চিত্রকর্ম ও স্থাপত্য নিয়ে শিল্পকলার ইতিহাসবিদ য়োহান জোয়াকিম ভিংকেলমান (১৭১৭
-১৭৬৮) এর বিবরণে ‘হাই স্টাইল’
শব্দটি থেকেই এই শব্দটিরও
উদ্ভব হয়েছিল।
(১৭) দ্বিতীয় জুলিয়াস নামে পোপের দ্বায়িত্ব পালন
করেছিলেন ১৫০৩ থেকে ১৫১৩ খৃষ্টাব্দ।
(১৮) ডোনাটো ব্রামান্টে (১৪৪৪-১৫১৪) ইতালীয় স্থপতি,
যিনি মিলান এবং রোমে
উত্তর রেনেসাঁ পবের্র স্থাপত্যশৈলী সূচনা করেছিলেন।
(১৯) মাইকেলেঞ্জেলো দি লোদোভিকো বুওনারোত্তি সিমোনী
(১৪৭৫-১৫৬৪) ইতালীয় ভাস্কর, চিত্রকর, স্থপতি, প্রকৌশলী পশ্চিমা শিল্পকলার বিকাশে তার প্রভাব
অতুলনীয়।
(২০) রাফায়েলো সানজিও দা উরবিনো (১৪৮৩-১৫২০),
শুধু রাফায়েল নামে যিনি
সুপরিচিত, উত্তর রেনেসাঁ
পর্বের একজন বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রকর, স্থপতি। মাইকেলেঞ্জেলো এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সাথে এই পর্বের ঐতিহ্যবাহী
তিনি সেরা মাস্টার শিল্পীর একজন।
(২১) সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা, ভ্যাটিক্যান সিটিতে অবস্থিত একটি চার্চ। এখানে
খ্রিস্টীয় চার্চের প্রথম পোপ হিসাবে স্বীকৃতি সেইন্ট পিটারকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
চতুর্থ শতাব্দী নির্মিত পুরোনো সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা ভেঙ্গে এখানে বর্তমানের
সুবিশাল এই চার্চটি নির্মিত হয়। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে।
(২২) সেইন্ট পিটার
( সাইমন পিটার), নিউ টেস্টামেন্ট
এর বর্ণনা অনুসারে যীশু খ্রিস্টের ১২ জন শিষ্যের একজন (মৃত্যু ৬৪ খ্রিস্টাব্দ),
খ্রিস্টীয় চার্চের সূচনা
পর্বের একজন নেতা, ক্যাথলিক চার্চ
তাঁকে প্রথম পোপ হিসাবে গন্য করেন, যাকে নির্বাচিত
করেছিলেন যীশু খ্রিস্ট। তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলো রোমান সম্রাট নিরো অগাষ্টাস
সিজার। তার দেহবশেষ রক্ষিত আছে ভ্যাটিকানে সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার অভ্যন্তরে
একটি ছোট চ্যাপেল, ক্লেমেন্টাইন
চার্চে। (২৩) মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো, ১০৬ -৪৩ খৃষ্টপূর্ব, ছিলেন একজন রোমান
দার্শনিক, রাজনীতিবিদ,
আইনজীবি, বক্তা, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, উপদেষ্টা এবং
সংবিধানবাদী। সিসেরো’রে রোমের অন্যতম
সেরা বক্তা এবং গদ্য রচয়িতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
(২৪) ডোনাটো দি
নিকোলো দি বেত্তো বার্দি (১৩৪৬ -১৪৬৬), যিনি মূলত পরিচিত ছিলেন ডোনাটেলো নামে, ফ্লোরেন্স এর রেনেসাঁর সূচনাপর্বের একজন
ভাস্কর।
(২৫) লরেনজো গিবার্টি (১৩৭৮-১৪৫৫) ফ্লোরেন্স এর
ভাস্কর, যিনি সবচেয়ে
পরিচিত ফ্লোরেন্স বাপিস্টেরীতে বিখ্যাত ব্রোঞ্জ এর দরজার জন্য, মাইকেলেঞ্জেলো তাকে বলেছিলেন স্বর্গের দরজা।
(২৬) টাইটাস লিভিয়াস পাটাভিনাস (৬৪ বা ৫৯ খ্রিস্ট
পূর্বাব্দ -১৭ খ্রিস্টাব্দ) একজন রোমান ইতিহাসবিদ, যিনি রোমের ইতিহাস লিখেছিলেন, তার Ab Urbe Condita Libri (Books from
the Foundation of the City ;
(২৭) গেইয়াস
জুলিয়াস কাইজার (ল্যাটিন ভাষায় সিজার এর উচ্চারণ কাইজার), (১০০-৪৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) রোমান সেনাপতি,
রাজনীতিবিদ, যার মাধ্যমেই রোমান প্রজাতন্ত্রের পতন ও রোমান
সা¤্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল।
(২৮) আন্দ্রিয়া মানতেনইয়া ( ১৪৩১-১৫০৬) ছিলেন ইতালীর
একটি চিত্রশিল্পী এবং রোমান প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা ছাত্র ছিলেন।(২৯) মেদিচি পরিবার (
দি হাউস অব মেডিচি) ধনাঢ্য ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ী পরিবার, রাজনৈতিক বংশ ও পরে রাজপরিবার, যার সুপরিচিত হয়েছিলেন কসিমো দে মেডিচি’র অধীনে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষে ফ্লোরেন্স
প্রজাতন্ত্রে।
(৩০) জিরোলামো সাভোনারোলা (১৪৫২-১৪৯৮) একজন ধর্মযাজক
ছিলেন রেনেসাঁ পর্বের ফ্লোরেন্সে সক্রিয় ছিলেন।
(৩১) প্লুটার্ক( ৪৬ থেকে ১২০ খৃষ্টাব্দ), ছিলেন গ্রীক ইতিহাসবিদ,জীবনীকার এবং প্রাবন্ধিক।
(৩২) ডেভিড ( আরবী দাউদ) বাইবেল অনুযায়ী ইসরায়েল ও
জুডাহ’র দ্বিতীয় রাজা, এবং নিউ টেষ্টামেন্ট অনুযায়ী যীশু খ্রিস্টের
একজন পূর্বসুরী। তার জীবনকাল সাধারণত মনে করা হয় (১০৪০-৯৭০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ);
বাইবেল এর কাহিনী অনুসারে
রাজা সল এর শাসনামলে ফিলিস্তিন দানব সদৃশ গলিয়াথ ইসরায়েলবাসীদের বিরুদ্ধে
চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল তাদের শ্রেষ্ঠতম বীরকে যুদ্ধে পাঠাতে। ডেভিড গলিয়াথের বিরুদ্ধে
যুদ্ধে যাবার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে, এবং গলিয়াথকে প্রথমে পাথর ছুড়ে পরে গলিয়াথের তলোয়ার দিয়ে তার শিরোচ্ছেদ করে।
আক্রমনকারী ফিলিস্তিনরা পালিয়ে যায় এই ঘটনার পরে।
(৩৩) আন্দ্রিয়া
দেল ভেরোক্কিও (১৪৩৫-১৪৮৮) (আন্দ্রিয়া দি মিশেল দি ফ্রানচেসকো দে সিওনী) ইতালীয়
চিত্রকর, ভাস্কর ও
স্বর্ণকার, ফ্লোরেন্সের একটি
গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্কশপের মালিক ছিলেন। তিনি পরিচিত ছিলেন ভেরোক্কিও নামে, ইতালীয় ভাষায় যার অর্থ সত্যিকারের দেখার মত চোখ,
তার অসাধারণ দক্ষতার জন্য
তাকে এই খেতাব দেয়া হয়েছিল।
(৩৪) উলফগাঙ আমাদিউস মোৎসার্ট (১৭৫৬-১৭৯১) জার্মান
সঙ্গীতজ্ঞ ( ইয়োহানেস ক্রাইসোস্টোমাস ওলফগ্যাঙাস থিওফিলাস মোৎসার্ট), ক্লাসিক্যাল পর্বে অন্যতম সুরকার।
(৩৫) ল্যুদভিগ ভান বিটহোভেন (১৭৭০-১৮২৭) জার্মান
সঙ্গীতজ্ঞ এবং পিয়ানোবাদক, পশ্চিমা ধ্রুপদী
সঙ্গীতের ক্ল্যাসিকাল থেকে রোমান্টিক পর্বে পট পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ একটি
চরিত্র।
(৩৬) পাবলো রুইজ ই
পিকাসো ( পাবলো পিকাসো) (১৮৮১-১৯৭৩) স্প্যানিশ চিত্রকর, ভাস্কর; কিউবিজম আন্দোলনের সহ প্রতিষ্ঠাতা।
(৩৭) Demoiselles
d’Avignon
(৩৮) পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস ( ১৪৪৩-১৫২৩) (যাকে ভয়ঙ্কর
পোপ বা যোদ্ধা পোপ বলা হতো) তার আসল নাম ছিল জুলিয়ানো দেলা রোভেরে, ১৫০৩ থেকে ১৫১৩ অবধি পোপ ছিলেন। পোপ থাকাকালীন
সময়ে তিনি বিশেষ খ্যাত ছিলেন সক্রিয় বিদেশ নীতি, উচ্চাকাঙ্খী নির্মাণ প্রকল্প, শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা, তিনি পুরো সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা ভেঙ্গে নতুন
করে নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, এছাড়াও
মাইকেলেঞ্জেলোকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদ অলঙ্কৃত করার জন্য।
(৩৯) নাইওবী গ্রীক পূরাণের একটি ট্র্যাজিক চরিত্র।
থিবীস এর রানী ছিলেন, তার ১৪ টি ছেলে
মেয়ে ছিল। অ্যাপোলো আর আর্টেমিস এর মা দেবী লেটো’র একটি অনুষ্ঠানে তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে গর্ব
করার জন্য লেটো তার ১৪ টি ছেলে মেয়ে মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। গ্রীক পূরাণে
নাইওবী চিরন্তন শোকের প্রতীক।
(৪০) সিম্ফোনী নং
৯ ইন ডি মাইনর, অপ ১২৫ (
সাধারণভাবে যেটি পরিচিত দি কোরাল হিসাবে) এটি লুদভিগ ভ্যান বীটহোভেন (১৭৭০-১৮২৭)
এর শেষ পুর্ণাঙ্গ সিম্ফোনী, এটি সমাপ্ত
হয়েছিল ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে।
(৪১) রেমব্রাঁ
হারমাঁসন ভান রাইন (১৬০৬-১৬৬৯) ডাচ চিত্রকর।
(৪২) চারটি
রাফায়েল রুম (স্ট্যাঞ্জে দি রাফায়েলো) একসাথে একটি অভ্যর্থনা কক্ষ তৈরী করে
ভ্যাটিকাল প্যালেসে পোপের অ্যাপার্টমেন্টের জন্য। রাফায়েল এর ওয়ার্কশপ এবং
ফ্রেস্কোর জন্য যে কক্ষগুলো বিখ্যাত। স্টাঞ্জা দেলা সেইনাতুরা ( রুম অব দি
সিগনাটুরা) প্রথম কক্ষ যেখানে রাফায়েল তার ফ্রেস্কো দিয়ে অলংকৃত করেছিলেন। এটি ছিল
স্টাডি, যেখানে দ্বিতীয়
জুলিয়াস লাইব্রেরী হিসাবে ব্যবহার করতেন।
(৪৩) সিস্টিন চ্যাপেল ( কাপেলা সিস্টিনা) একটি বড়
এবং পরিচিত চ্যাপেল যার অবস্থান আপোস্টলিক প্লেস এ ( পোপের বাসভবন); এটি মূলত পরিচিত ছিল ক্যাপেলা ম্যাগনা নামে,
চ্যাপেলটি তার বর্তমান
নাম নিয়েছে পোপ চতুর্থ সিক্সটাস এর নামে, যিনি এটি সংস্কার করেছিলেন ১৪৭৭ থেকে ১৪৮০ র মধ্যে। বর্তমানে এখানে পাপাল
কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয় ( যেখানে পরবর্তী পোপ নির্বাচন করেন কার্ডিনালরা)। সিস্টিন
চ্যাপেল বিখ্যাত এর ছাদে মাইকেলেঞ্জেলো দি ল্যাস্ট জাজমেন্ট ফ্রেস্কোর জন্য।
(৪৪) সিবিলরা হচ্ছে সেই রমণীরা যাদের ভবিষ্যদ্বানী
করার ক্ষমতা আছে বলে প্রাচীন গ্রীসে মনে করা হতো। বাইবেলে বর্ণিত কাহিনী অনুযায়ী
ঈশ্বর মহাপ্লাবনের সময় নোয়া‘র পরিবারকে রক্ষা
করেছিলেন তাকে নৌকা বানানোর নির্দেশ দিয়ে।
(৪৫) বাইবেলে
বর্ণিত কাহিনী অনুযায়ী ঈশ্বর মহাপ্লাবনের সময় নোয়া‘র পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন তাকে নৌকা বানানোর
নির্দেশ দিয়ে।
(৪৬) ইভ, ক্ল্যাসিকাল হিব্রুতে যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে হাওয়া নাম; আব্রাহামিক ধর্মীয় পুরাণে যিনি প্রথম নারী যাকে
ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন।
(৪৭) অ্যাডাম (
আদম) আব্রাহামিক ধর্মীয় পুরাণে ঈশ্বর সৃষ্ট প্রথম মানব।
(৪৮) পারনেসাস (The parnesus) উত্তর রেনেসাঁ পর্বের একটি ফ্রেস্কো, প্যালেস অব ভ্যাটিক্যানের রাফায়েল রুম বা
স্টানজা দেলা সেগনাচুরার একটি দেয়ালে রাফায়েল এটি এঁকেছিলেন, সম্ভবত এটি ১৫১১ সালে আঁকা হয়েছিল, রুমে অন্য দুটি ফ্রেষ্কো লা ডিসপিউটা (La
dsiputa) আকার পরে এবং দি স্কুল অব
এথেন্স (The School of Athens) আঁকার আগে,
যা কক্ষের অন্য দেয়ালগুলো
দখল করে আছে। পুরো রুমটি মানব জ্ঞানের মোট চারটি ক্ষেত্রকে পরিদর্শন করছে: দর্শন,
ধর্ম, কবিতা এবং আইন। পারনেসাস এখানে কবিতার
প্রতিনিধিত্ব করছে। ফ্রেস্কোতে আমরা দেখতে পাই একটি পুরাণ কাহিনীর মাউন্ড পারনেসাস,
যেখানে অ্যাপোলোর বাস।
ফ্রেস্কোর ঠিক কেন্দ্রে তিনি বসে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন ( সমসাময়িক পর্বের ভায়োলিন,
প্রাচীন লায়ার নয়),
তাকে পরিবেষ্টিত করে আছে
নয়জন মিউজ ও নয়জন কবি।
(৪৯) হেলেনিস্টিক পর্ব হচ্ছে প্রাচীন গ্রীক এবং
পূর্ব ভূ-মধ্যাসাগরীয় ইতিহাস ৩২৩ খৃষ্ট পূবাব্দে আলেক্সজান্ডার দি গ্রেপ এর মৃত্যু
থেকে রোম সাম্রাজ্যের উত্থাণ, বিশেষ করে ৩১
খৃষ্টপূর্বাব্দে ব্যাটল অব অ্যাকটিয়াম, এবং ৩০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে টলেমিদের মিশর বিজয়ের মাধ্যমে।
(৫০) গ্রীক পুরাণে
মিউজরা হচ্ছে শিল্প, সাহিত্য বিজ্ঞানে
অনুপ্রেরণাদানকারী দেবী।
(৫১) ফারনাজিনা
ইতালীর রোমে অবস্থিত একটি ভিলা, যা তৈরী হয়েছিল
১৫০৮ থেকে ১৫১১ সালের কোন একটি সময়ে।এর মূল স্থপতি ছিলেন পেরুৎসী। এটি বিখ্যাত
রাফায়েল ও তার ছাত্রদের আঁকা বেশ কিছু ফ্রেস্কোর জন্য))
(৫২) স্থাপত্যর
ভাষায় লুনেট ( ছোট চাঁদ) অর্ধ চন্দ্রাকৃতির একটি এলাকা, কোন খিলান বা আর্চের উপরর অর্ধচন্দ্রাকৃতির অংশ,
সাধারণত এখানে ফ্রেস্কো
আঁকা হতো।
(৫৩) লজ্জি বা
ভল্টেড বা উঁচু ছাদ যুক্ত কক্ষটি ভ্যাটিকানের পোপের অ্যাপার্টমেন্টের প্রথম তলায়
অবস্থিত, এটি পরিচিত খব
খড়মমরব ফর জধভভধবষষড় নামে। দশম লিও র কমিশনে অলঙ্করনের কাজটি করেছিলো রাফায়েল এর
ওয়ার্কশপের ছাত্ররা, বিশেষ করে
জিওভান্নি দা উদিন, ফ্রেস্কো এবং
চিত্রকর্মেও মূল বিষয় ছিল ওল্ড টেষ্টামেন্টের নানা কাহিনী।
(৫৪) উত্তর রেনেসা
পর্বে স্থাপত্যের একটি অসাধারণ উদহারণ ভিলা মাদামা,এর স্থপতি ছিলেন রাফায়েল।
(৫৫) দি
ট্রান্সফিগারেশন, রাফায়েল এর আঁকা
শেষ চিত্রকর্ম, কার্ডিনাল জুলিও
দে মেডিচি’র পৃষ্ঠপোষকতায়
এটি এঁকেছিলেন, যিনি পরে পোপ
সপ্তম ক্লিমেন্ট হয়েছিলেন (১৫২৩-১৫৩৪), ফ্রান্সের নারবোন ক্যাথিড্রালের অল্টারপিস হিসাবে এটি পরিকল্পিত হয়েছিল,
এবং রাফায়েল তার মৃত্যু
(১৫২০) অবধি এটির উপর কাজ করেছিলেন। এই চিত্রকর্মটি স্মারক হয়েছে শিল্পী হিসাবে
রাফায়েল এর বেড়ে ওঠা এবং তার পেশাগত জীবনের শীর্ষ বিন্দুর। খ্রিস্টীয় ধর্মীয়
চিত্রকলায় যীশুর ট্রান্সফিগারেশন এর চিত্র যেভাবে আঁকা হয় এটি তার থেকে খানিকটা
আলাদা, কারণ
চিত্রকর্মটির নিচের অংশে গসপেল বা যীশুর জীবন কাহিনী থেকে কিছু পর্ব যুক্ত করা
হয়েছে। যীশুর ট্রান্সফিগারেশন নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত একটি ঘটনার প্রতিনিধিত্ব
করে, যেখানে যীশু শারীরিকভাবে
রুপান্তরিত ( টান্সফিগার অথবা মেটামরফোসিস) এবং দ্যুতিময় হয়ে উঠেছিলেন একটি
পর্বতের উপর। কাহিনীটি বর্ণিত করে যীশু এবং তার তিন শিষ্য একটি পর্বতের উপরে আরোহন
করেছিলেন, এবং এই পর্বতের
উপরে ওঠার পর যীশু উজ্জ্বল আলোয় দ্যুতিময় হয়ে ওঠেন, তার শরীর থেকে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে। আকাশ থেকে
কেউ তাকে তখন পুত্র বলে সম্বোধন করে, যে কন্ঠস্বরটিকে মনে হয় করা হয় স্বয়ং ঈশ্বর পিতার। খৃষ্টীয় শিক্ষা এটি খুবই
গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়, এটি মানব
প্রকৃতির সাথে ঈশ্বরের সম্মিলনের প্রতিনিধিত্ব করছে, ক্ষনিক সাময়িক এর সাথে অনন্তকালের সংযোগ,
যার সংযোগে যীশু স্বয়ং,
স্বর্গ ও মর্ত্যরে মধ্যে
সেতু বন্ধন রচনা করছেন।
(৫৬) অ্যাকাডেমিজম, ইউরোপীয় শিল্পকলা অ্যাকাডেমী বা প্রতিষ্ঠানগুলো
শিক্ষা নির্ভর সৃষ্টি। প্রথাগত ঐতিহ্যনির্ভর এবং রক্ষনশীলতা যার বৈশিষ্ট।
(৫৭) দি ট্রায়াম্ফ অব গালাতিয়া একটি ফ্রেস্কো
মাস্টারপিস, রাফায়েল এটির কাজ
শেষ করেছিলেন ১৫১৪ খৃষ্টাব্দে রোমের ভিলা ফারনাজিনার জন্য। এটি পূরাণ কাহিনী
নির্ভর, তবে রাফায়েল মূল
কাহিনীটি এখানে আকেননি, তিনি গ্যালাতিয়ার
দেবতুল্য হয়ে ওঠার দৃশ্যটি এঁকেছিলেন।
(৫৮) সারকোফ্যাগাস – সাধারণত পাথরে নির্মিত শবাধার ।
(৫৯) মাইকেলেঞ্জেলো মেরিসি ( অথবা আমেরিঘি) দা
কারাভাজ্জো (১৫৭২-১৬১০) – একজন ইতালীয়
চিত্রকর, যিনি সক্রিয়
ছিলেন ১৫৯২ থেকে ১৬১০ অবধি। তার চিত্রকর্ম মানবিক নানা পরিস্থিতির – শারীরিক এবং আবেগময়তার – বাস্তবতাপূর্ণ পর্যবেক্ষণের সমন্বয় করেছিলেন,
আলোক সম্পাতের নাটকীয়
ব্যবহারের মাধ্যমে, বারোক চিত্রকলার
উপর যার একটি মৌলিক প্রভাব ছিল।
(৬০) ফ্রানচেসকো
এসফোরজা (১৪০১-১৪৬৬) ইতালীয় সেনানায়ক, ইতালীর মিলানে যিনি এফোরজা রাজবংশ পত্তন করেছিলেন।
(৬১) ফ্ল্যান্ডার্স হচ্ছে বেলজিয়াম এর ডাচ ভাষাভাষী
উত্তরাঞ্চল ।
(৬২) লক হচ্ছে
একটি যান্ত্রিক কৌশল যা ব্যবহার করা হয় নৌকাদের উপরে বা নীচে নামাতে, যখন তারা দুটি ভিন্ন উচ্চতার স্তরে মধ্যে
যাতায়াত করার জন্য, যেমন নৌকা এবং
খালের জলপথ। লক এর বৈশিষ্ট হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট কক্ষ যেখানে পানি স্তর কম বেশী
ওঠা নামা করা যায়, তবে অন্যান্য লকে
পুরো কক্ষটি উঠা নামা করে। লক এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল নদীগুলো সহজ নাব্য করার জন্য
অথবা কোন খাল,যে স্থলভুমির উপর
দিয়ে সরাসরি একটি পথ নেবে, যখন সেটি একই
সমতলে নয়।
(৬৩) কিং লিয়ার, শেক্সপিয়ার এর একটি ট্রাজেডী।
(৬৪) Blow,
winds, and crack your cheeks! rage! blow!
You cataracts and hurricanoes, spout
Till you have drench’d our steeples, drown’d the cocks! `[ (কিং লিয়ার, শেক্সপিয়ার)।
0 মন্তব্যসমূহ