ভাষা আর সেতু নয়, ভাষা আজ অন্তরায় || চৈতালি


ভারতে দেড় থেকে দু হাজার ভাষা আছে। আচ্ছা, আমরা বাঙালিরা সেইসব অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষদের সাথে কতটা আন্তরিকতা অনুভব করি? আমরা, উত্তর ভারতীয়রা, যখন দক্ষিণ ভারতে যাই, আর সেখানকার কিছু মানুষ আমাদের জানা ভাষাগুলো বলতে পারে না, বুঝতেও পারে না, তখন আমরা কতটা সমস্যায় পরি? ঠিক তেমনই দক্ষিণ ভারতীয়রা যখন উত্তর ভারতে আসে তারাও ভাষার কারণে সমস্যায় পরে, বিরক্তও হয়। কোন হিন্দিভাষী মানুষ কলকাতায় এলে, আমরা বলি, "তারা আমাদের ভাষা শিখে, আমাদের ভাষাতে কথা বলুক, আমরা ওদের ভাষা কেন বলব"। আর বাঙালিরা যখন বিহার বা উত্তর প্রদেশে যায়, তখন সেখানকার মানুষও তো একই কথা বলে। এভাবেই তৈরি হয় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বিভেদ, ভাষাকে ঘিরে মানুষে-মানুষে ব্যবধান। ভাষা মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে তোলে, ভাষা মানুষে-মানুষে দুরত্ব তৈরি করে, ভাষা নিয়ে কত রাজনীতি হয়। পুর্ব-পাকিস্থান আর পশ্চিম-পাকিস্থান একটাই দেশ ছিল। সে দেশটা ভেঙে পাকিস্তান আর বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। এই দেশভাগের ক্ষেত্রে ভৌগলিক দুরত্ব যতনা সমস্যা তৈরি করেছে, তার থেকে বেশি সমস্যা তৈরি করেছে ভাষার বিভেদ। সেখানে উর্দু ভাষা আর বাংলা ভাষা নিয়ে নোংরা রাজনীতি হয়েছে। পুর্ব-পাকিস্থানে যারা মাতৃভাষা-বাংলার সমর্থনে আন্দোলন করেছে, তাদের আন্দোলন দমিয়ে দেবার জন্য জঘন্যভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। সেই কলঙ্কের দিনটাকে মনে রাখার জন্য আজও আমরা ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালন করি। এরকমই প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে পৃথিবী জুড়ে।

অথচ, একটা মজার ব্যপার হচ্ছে, আমরা যখন দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াই, তখন যদি কোন বাংলাভাষী মানুষকে দেখতে পাই, আমরা যেচে গিয়ে আলাপ জমাই। আমরা খুশি হই এটা ভেবে যে, এই মানুষটা আমার চেনা-পরিচিত ভাষাটা বোঝে, এর সাথে প্রাণ খুলে গল্প করা যাবে। এখানে কিন্তু সেই ভাষাই যোগসূত্র তৈরি করল। ভাষার মুখ্য উদ্দেশ্য কিন্তু তাই ছিল - মানুষ-মানুষে যোগসূত্র স্থাপন করা, মানুষে-মানুষে সেতুবন্ধন করা। কিন্তু সেই ভাষাই অনেক ক্ষেত্রে মানুষে-মানুষে দুরত্ব তৈরি করছে, মানুষের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান তৈরির পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাড়াচ্ছে।

সুতরাং, ভাষা দিয়ে ভাব প্রকাশ করতে পারাটা মানুষকে কাছে আনতে পারে, আর না পারাটা দুরে সরিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি, আপনি পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের থেকেই একটা ব্যবধানে অবস্থান করছি। কারণ পৃথিবীর সব মানুষের জন্য কোন একটা সাধারণ ভাষা এই মুহূর্তে আমাদের নেই।  আর সারা পৃথিবী জুড়ে এত ধরনের ভাষা আছে যে, কোন একজন মানুষের পক্ষে সব ভাষা শেখার চেষ্টা করাটা অবাস্তব স্বপ্ন। নচিকেতার একটা গানের লাইন মনে পড়ছে। "ভাষা আর সেতু নয়, ভাষা আজ অন্তরায়"।

আমরা তো আজকের দিনে গোটা পৃথিবীকে একটা ছোট গ্রাম বলে ভাবছি। একটা দেশের সাথে আরেকটা দেশের বর্ডার তুলে দিয়ে গোটা পৃথিবীটাকে একটাই দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছি। আজকের এই সোস্যাল মিডিয়ার যুগে, পৃথিবীর একপ্রান্তের মানুষ, আরেক প্রান্তের মানুষের বন্ধু হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কি উচিত না, এই ভাষা সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে বার করা ? আমাদের কি যুগের চাহিদাকে মাথায় রেখে, এই পরিস্থিতিতে একটা কোন সাধারণ যোগাযোগের মাধ্যমের পরিকল্পনা করা উচিত না ? আমরা, যারা নিজেদেরকে যুক্তিমনস্ক, প্রগতিশীল বলে দাবি করি তাদের কি উচিত না, এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে, এমন একটা কিছু করা যাতে, ভাষা আর অন্তরায় না হয়ে, গোটা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে।

আচ্ছা, কেমন হয় যদি এবারে এমন একটা ভাষা তৈরি করা যায়, যা দিয়ে পৃথিবীর যে কোন মানুষের সাথে ভাবের আদান-প্রদান সম্ভব হবে। সেই ভাষার ব্যাকরণ হবে খুব সহজ-সরল, যাতে যে কেউ শিখতে চাইলে, সেটা শিখতে বেশি সময় না লাগে। সেই ভাষা টাকে খুব বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে, ভাষাটার মধ্যে কোন রকম অ্যাম্বিগুইটি বা অস্পষ্টতা না থাকে। অর্থাত্, একটা শব্দের দু রকম মানে না থাকে, বা একটা বাক্যের দু রকম মানে বার করা না যায়। বর্তমানে যেসব ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ আছে তাদের সবার মধ্যে কিন্তু এই সমস্যাগুলো আছে। আর সেই কারণেই কিন্তু একটা ভাষার মানুষের পক্ষে অন্য একটা ভাষা শেখা টা খুব সহজ হয় না। হ্যঁ তবে, এটা আমি বলছি না যে,  একেবারে একটা নতুন ভাষা আমদানি করতে হবে। বর্তমানে পৃথিবীতে যেসব ভাষাগুলো রয়েছে তাদেরই মধ্যে কোন একটা ভাষা, যেটাকে একটু পাল্টে নিলে, আর কিছুটা বিজ্ঞানসম্মত করে নিলে, ভাষাটাকে সহজ-সরল করে ফেলা যায়, সেরকম একটা ভাষাকেও আমরা ব্যবহার করতে পারি। প্রয়োজনে দু চারটে ভাষার ভাল বৈশিষ্ট্যকে এক জায়গায় করে, একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে একটা নতুন ভাষা তৈরি করা যায়। আর হ্যাঁ, সেক্ষেত্রে কিন্ত যেসব ভাষা বর্তমানে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ জানে, সেইসব ভাষাগুলো অগ্রাধিকার পাবে।

এরকম বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ভাষা তৈরি করার অন্য একটা দিকও আছে। বর্তমানে কম্পুটারের জগতে বা তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়াতে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে "ন্যাচরাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং"। খুব সহজ ভাবে বলতে গেলে, কম্পিউটার বা যন্ত্রের কাছে, মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ন্যাচরাল ল্যাঙ্গুয়েজ গুলোকে বোধগম্য করে তোলা। আজকের দিনে প্রযুক্তির দুনিয়াতে এই ব্যপারটা বিভিন্ন কারণে খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। আর, ভবিষ্যতে এই ব্যাপারটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু এই কাজ টা খুব সহজ হয় না ভাষার সেই অস্পষ্টতার জন্য। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ গুলো যতটা যুক্তিসঙ্গত ভাবে তৈরি, মানুষের কথা বলার ভাষা ও যদি ততটাই যুক্তিসঙ্গত ভাবে তৈরি হয়, তাহলে যন্ত্রের সাথে মানুষের ভাষার এই আদান-প্রদানটাও খুব সহজ হয়।

কিন্তু প্রযুক্তিগত দিক গুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করাটা এই মুহূর্তে আমার উদ্দেশ্য না। আমার উদ্দেশ্য হল এটা বলা যে, আজকের যুগে দাঁড়িয়ে, সমাজে যে যে উপাদান গুলো মানুষে-মানুষে বিভেদ তৈরি করছে, তার মধ্যে ভাষাও একটা। এই পরিস্থিতিতে এর সমাধান খুঁজে বার করারও প্রয়োজন আছে। আসুন আমরা একটু অন্যরকম ভাবে চিন্তাভাবনা করি, একটু যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করি। সবচেয়ে  বড় কথা ভাষা নিয়ে সাম্প্রদায়িক কম হয়ে, মানবিক বেশি হই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ