বইয়ের নাম- "মৃত্যু"
লেখক- এ.এন.এম নুরুল হক
প্রকাশনী- ঐতিহ্য...!♥♥♥
'মৃত্যু'-
জীবিত বস্তুর এক চরম পরিণতি,
'মৃত্যু'-
প্রানীকূলের এক রহস্যময় আতঙ্ক,
'মৃত্যু'-
বুদ্ধিমান জীবের কাল্পনিক জগতের প্রণোদনা,
'মৃত্যু'-
সাহিত্য জগতের আত্মা স্বরূপ,
'মৃত্যু'-
জীবনের মহানির্বানের অনু্প্রেরণা...!!!
২২টি অনুচ্ছেদে আর ২৬৪পৃষ্ঠা ব্যাপী মৃত্যু সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্তের এক বৈচিত্র্যময় সম্ভার বললে কম বলা হবে। লেখক মৃত্যুর আদ্যোপান্ত লিখতে গিয়ে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক ভিত্তি, মনস্তত্ত্ব এবং পাশাপাশি আলোচিত মৃত্যু বিষয়ক তথ্যাদি ও বিশেষ করে আত্মহত্যা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন; যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি কাড়বে। বাংলাসাহিত্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য কিভাবে মৃত্যুকে দেখেছে তার একটি চমৎকার বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, সাথে বৈজ্ঞানিক মনস্তত্ত্ব ও বিভিন্ন ধর্মীয় আচারিক কার্যক্রম নিয়ে নিরপেক্ষ সমালোচনাও করেছেন। সম্ভবত বাংলাসাহিত্য অঙ্গনে মৃত্যু সম্পর্কিত এত তথ্যনির্ভর কোন প্রবন্ধ এ যাবত লেখা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাই পাঠকদের বইটি পড়ার প্রণোদনা হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ উপস্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছি।
বইয়ে লেখক যে বিষয়সূচি দিয়েছেন তা নিম্নরূপ-
১)মৃত্যুর সংজ্ঞা
২)মৃত্যুর সুলুকসন্ধান
৩)মৃত্যুর ধর্মীয় বিশ্লেষণ
৪)মৃত্যুর মধুরিমা
৫)অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
৬)অন্ত্যেষ্টিক ভোজ
৭)আত্মহত্যা
৮)মহাআত্মহনন
৯)মরণাভিলাষ
১০)সুইসাইড নোট
১১)করুণা মৃত্যু
১২)মৃত্যুভয়
১৩)মৃত্যুশোক
১৪)অমরত্বের সন্ধানে
১৫)অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান
১৬)অন্তিম অভিলাষ
১৭)কফিন বিলাস
১৮)সমাধিক্ষেত্র
১৯)সমাধিলিপি
২০)শেষ চিঠি
২১)কী আছে শেষে
২২)কেমন মৃত্যু চাই
অনুচ্ছেদ গুলোর নামগুলোই ধারণা দিবে জীবনের এ চরম সত্যটির কতরূপ রয়েছে। সারাবিশ্ব ব্যাপী এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবেনা যার মৃত্যু ভাবনা নেই, কিন্তু সেই ভাবনাও যে কত জটিল, কত ছান্দসিক, কত ভ্রমপূর্ণ এবং এর বিন্যাস আর সমাবেশ সত্যিই পাঠককে মৃত্যু ভীতিকেই এক ভিন্নত্ব দিবে- এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বইয়ের প্রারম্ভে লেখকের 'অনিবার্য কথকথা' লেখক ভাবনার এক উজ্জ্বলিত দীপ্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে, যা তাঁর পুরো বই জুড়ে অনুভূত হবে।
লেখক বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য হতে অনুবাদসহ উদ্ধৃতি মৃত্যু সম্পর্কে জনপ্রিয় কবি, সাহিত্যিক, উপন্যাসিক, গল্পকারদের ভাবনাগুলো জানার সুযোগ হবে; এছাড়া বিভিন্ন ধর্মগুলোতে মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে কি বলা আছে, তাদের সাযুজ্য, অন্ত্যমিল, অমিল, বিতর্ক নিয়ে বেশ তাত্ত্বিক ও যুক্তিগত আলোচনা লক্ষ্যনীয়; বৈজ্ঞানিক জার্নাল আর সংবাদপত্র গুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন ঘটনাবলী, বিভিন্ন সুপরিচিত, জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মৃত্যু ভাবনা, আত্মহননের ঘটনা, সুইসাইড নোট- সবমিলিয়ে মৃত্যুর চরমদশা নিয়ে পাঠক আগ্রহী হবে পড়তে ও জানতে।
এখন একটু অনুচ্ছেদ গুলো সংক্ষেপিত ভাবে অবগত করি-
'মৃত্যুর সংজ্ঞা'- এখানে লেখক কবিতা, ধর্ম আর চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে মৃত্যুর সংজ্ঞা উপস্থাপন করেছেন;
'মৃত্যুর সুলুকসন্ধান'- রবিঠাকুর, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের আলোচনা হতে মৃত্যুকে জানার প্রচেষ্টা প্রতিভাত হয়;
'মৃত্যুর ধর্মীয় বিশ্লেষণ'- ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম- এ ৫টি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মানুসারে মৃত্যুর স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে; মৃত্যুকে সবথেকে ভীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা অনস্বীকার্য;
'মৃত্যুর মধুরিমা'- রবিঠাকুর, জীবনানন্দ, বোর্দলেয়ার, লোর্কার কাব্যিক ছন্দে মৃত্যুর কাব্যরস পাঠক হৃদয়কে সচেতন করবে কাব্য মূর্ছনায়;
'অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া'- এর ২টি অংশ রয়েছে সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে; (১)ধর্মীয় আচার ও (২)সামাজিক আচার; এখানে প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর আচার-অনুষ্ঠান ছাড়াও চীন, বার্মা, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশেষ অনুষ্ঠান পরিলক্ষিত হয় এবং মহাকাশে শেষকৃত্য ও যৌনকর্মীদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসহ অদ্ভূত অজানা তথ্য লেখক সংযুক্ত করেছে;
'অন্ত্যেষ্টিক ভোজ'- প্রতিটি মৃত্যু একটি আয়োজনের যেন উপলক্ষ, এখানে ধর্মীয় আচারে ভোজ আয়োজন যেমন- শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, চেহলাম বা চল্লিশা, কুলখানি, ডেথ ডিনার, ডিগনিটি বুফে, অন্ত্যোষ্টিক বুফে নিয়ে আলোচনা করেছে, যা পাঠক উপভোগ করবে;
'আত্মহত্যা'- এটি একটি তথ্যসমৃদ্ধ অনুচ্ছেদ, যেখানে লেখক আত্মহত্যার দেশবিদেশ-এর বিভিন্ন তথ্যাদি যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তার সংযোজন ও আত্মহত্যার বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানে সচেষ্ট হয়েছেন;
'মহাআত্মহনন'- লেখক প্রথমেই অনুচ্ছেদটির নামকরণ নিয়ে বেশ রসবোধযুক্ত বক্তব্য দিয়েছেন। এ পর্যায়ে লেখক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিটলার, ক্লিওপেট্রা, জুলিয়াস সিজার, অ্যান্টনি, সম্রাট নিরো, সর্বশেষ কাদম্বরী দেবী'র আত্মহনন নিয়ে যৌক্তিক কাব্যিক আলোচনা করেছেন;
'মরণাভিলাষ'- আত্মহত্যা বা নিজের মৃত্যু ভাবনা নিয়ে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের বালখিল্যতা আর তা নিয়ে সাহিত্য রচনা মৃত্যুকে যেন এক সুখকর, বিলাসী ও উপভোগ্য একটি বিষয়বস্তুতে রূপান্তরিত করেছে, এরা কেউ মৃত্যু ভয়ে ভীত নয়, দীর্ঘ সুখকর যাত্রা ব নিদ্রারূপে উপস্থাপন করেছে; সেখানে অভিমান, ভালোবাসা, অনুযোগ, বিরহ সব ছিল, কিন্তু অনুপস্থিতি ছিলো অন্যের ক্ষতি করার ভাবনা, স্বচ্ছ ভাবনা;
'সুইসাইড নোট'- নাম শুনেই বোঝা যায় মৃত্যু পূর্বে কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনার বহিঃপ্রকাশ লেখনির মাধ্যমে, পাশ্চাত্য সাহিত্য সমাজে বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বদের সুইসাইড নোট নিয়ে লেখক দৃষ্টিপাত করেছেন;
'করুণা মৃত্যু'- Euthanasia বা ইচ্ছামৃত্যু নিয়ে লেখক এখানে বিস্তারিত আইনগত দিকগুলো তুলে ধরেছেন, যার মধ্য দিয়ে পাঠক একটি নতুন ভাবনার সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে চাইবে, অনুভব করতে চাইবে এর যৌক্তিকতা-অযৌক্তিকতা গুলো;
'মৃত্যুভয়'- মানুষের ভিতর মৃত্যুভয় চিরস্থায়ী একটি আবহ সৃষ্টির জন্য ধর্মের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যে এ মৃত্যুভয় কেমন তা নিয়েই আলোচনা এগিয়েছে;
'মৃত্যুশোক'- ধর্মীয় ও সাহিত্য আলোচনার মাধ্যমে লেখক এ পারলৌকিক চর্চার এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা করেছেন, পাঠকের কাছে এ ছান্দিক গতি ভালো লাগবে;
'অমরত্বের সন্ধানে'- ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি জাত হচ্ছে মৃত্যু পরবর্তী জীবনকাল, আর সাহিত্যিকগণ বিভিন্ন কর্মের মধ্য দিয়ে অমরত্বের সন্ধান করেছেন, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান কিভাবে এতে কালক্ষেপণ ঘটিয়ে আয়ুষ্কাল বর্ধিতকরণসহ মস্তিষ্ককে চিরস্থায়ী কাঠামো প্রদানের প্রচেষ্টারত তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে;
'অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান'- এটি এ বইয়ের প্রাণস্পন্দন বললে ভুল হবেনা নিশ্চয়, কারণ লেখক এখানে একটি মৃত ব্যক্তি মৃত্যু পরবর্তী দেহদানের মতো মহৎকর্মের মাধ্যমে চিরকাল বেঁচে থাকবেন মানবজগতে তারই অনুপ্রেরণা জাগিয়েছেন তথ্য ও তত্ত্বের আলোকে; ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবতার নিরীখে নিজস্বতা পরিবর্তিত করতে বাধ্য হয়েছে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে তা উল্লেখ করা হয়েছে, চমৎকার একটি অনুচ্ছেদ এককথায়;
'অন্তিম অভিলাষ'- প্রতিটি শেষ ইচ্ছে বলে কিছু থাকে, ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড়ানো অপরাধীরও শেষ ইচ্ছে পূরণে কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট থাকে, সেই ইচ্ছেও যে বৈচিত্র্যময় কৌতুহল উদ্দীপক হতে পারে তা এ অনুচ্ছেদ পড়লে পাঠকের তৃষ্ণা নিবারণ হবে;
'কফিন বিলাস'- মৃতদেহ সমাধিস্থ বা কবরস্থ করা নিয়ে বিভিন্ন পাশ্চাত্য সমাজে বিভিন্নতা লক্ষ্যণীয়, আর তা নিয়ে এখানে আলোচনা চলেছে;
'সমাধিক্ষেত্র'- কবরস্থান ও শ্মশান এ ২টি জায়গার গুরুত্ব সকল সমাজেই রয়েছে; লেখক এখানে বিশ্বের বিখ্যাত সমাধিক্ষেত্র ও তার সাথে বাংলাদেশের সমাধিক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে; উল্লেখ্য যে- পাঠক এখানে অনেক নতুন তথ্যের আনাগোনা দেখতে পাবে, যদিও পুরোটা জুড়েই এটি রয়েছে;
'সমাধিলিপি'- বাংলাসাহিত্য থেকে পাশ্চাত্য সাহিত্য সমাজের মানুষ, সাধারণ জনগণ সব জায়গায় মৃত ব্যক্তির সমাধিক্ষেত্রে সমাধিলিপির প্রচলন নিয়ে লেখক আলোকপাত করেছেন;
'শেষ চিঠি'- এ অনুচ্ছেদে লেখক বিভিন্ন ঐতিহাসিক চিঠির চুম্বকাংশ নিয়ে হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করেছেন;
'কী আছে শেষে'- এখানে পরলোক সম্পর্কিত আলোচনা যেমন আপনাকে টানবে, তেমনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাটিয়ে আসা মানুষের অভিজ্ঞতা আপনাকে অনুসন্ধানী করে তুলবে, ভাবনাকে করে তুলবে রহস্যঘেরা;
'কেমন মৃত্যু চাই'- কবি রাইনার উক্তিটুকু উল্লেখ করে শেষ করছি-
প্রভু, সকলকেই তাঁর নিজের পছন্দের মৃত্যুটি দাও,
জীবনের পথ বেয়ে সে যেন পৌঁছে যায় মরণের ঠিকানায়,
তাঁর নিজস্ব মূল্যবোধ, ভালোবাসা আর সংকটের হাত ধরে।
বইটি পাঠক হৃদয়কে যুক্তি, তত্ত্ব, তথ্যের আলোকে মৃত্যু'কে জানতে সহায়তা করবে; হয়তো এর মধ্য দিয়ে আমরা অনেকেই খুঁজে নিতে পারবো জীবনের মৌলিকত্ব...!♥♥♥
0 মন্তব্যসমূহ