প্রসঙ্গ স্টিফেন হকিং || বিপ্লব সৎপতি


ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমণ্বয় বহুদিনের, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান ছাড়া ধর্মের অস্তিত্ব অসম্ভব, একটি  অন্যটির পরিপূরক - এমনটাই  মনে  করেন  তামাম   পৃথিবীর  বহু   বুদ্ধিজীবি  ও বিজ্ঞানী। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে তথা ভারতে এদের  সংখ্যা   একটু  বেশি   মাত্রায় । এখানে   উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে  বিজ্ঞানের সাথে  আধ্যাত্মবাদের যোগসূত্র খোঁজার  জন্য  মূর্খের  মতো  বা  রাজনৈতিক  ফায়দা  লোটার উদ্দেশ্যে একটি অপপ্রয়াস চালানো হয়। বিভিন্ন উপাসনা ধর্মের আবার  গ্রন্থ  সমূহ  থেকে  সংগ্রাহিক  উদ্ধৃতিকে  বিকৃত  করে, বিজ্ঞানের নতুন আবিস্কারের বর্ণনা করে দেখানো হয় ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অসম্ভব। সত্যিই কি ধর্ম আর বিজ্ঞানের যোগসূত্র আছে? না পুরোটাই  ধাপ্পাবাজী করে বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে নিজ-নিজ ধর্মের সত্যতা প্রমাণ করার ব্যর্থ প্রয়াস! এর উত্তর খোঁজার জন্য ভণিতা না করে  বর্তমানের সেরা বিজ্ঞানী  'স্টিফেন হকিং এর ধর্ম সম্বন্ধে অভিমতের কথা বলবো।

       'ঈশ্বর নিয়ে 'হকিং' এর কোনো মাথাব্যথা নেই। বিখ্যাত 'গার্ডিয়ান' পত্রিকার বিশিষ্ট বিজ্ঞান সাংবাদিক - 'ইয়ান স্যাম্পল' যিনি 'নিউ সায়েন্টিস' জার্নালে কাজ করেছেন, হকিংকে সরাসরি জিজ্ঞাসা  করেন- 'আপনি কি স্বর্গ বা মৃত্যুর পরেও আরও জগৎ আছে বলে বিশ্বাস করেন'? উত্তরে  হকিং  সাহেব বলেন- 'ওসব রূপকথার গল্প ভীতু মানুষের চিন্তাভাবনা' । একুশ  বছর  বয়সে হকিং  জেনেছেন  তাঁর  মোটার  নিউরোণ  অসুখ করেছে। সে বিষয়ে তিনি বলেছেন- 'আমার  বেঁচে  থাকার  কথা  নয়, তবুও বেঁচে আছি! মরণকে  ভয় পাই না। তাড়াহুড়ো  করে  মরতেও চাই না, মাথায় অনেক ভাবনা ঘুরছে, ইচ্ছে সে সব কাজ  আমিই প্রথম করে যাই '! হকিং বলেন 'মস্তিষ্ক' একটি কম্পুটার, কম্পিউটারের একটি পার্টস খারাপ  হলে  সে  যেমন  কাজ  করতে  পারে না, মস্তিষ্কও তেমনই। কম্পিউটারের স্বর্গ আছে? মৃত্যুর পর জীবন আছে? ওসব ভীতু মানুষের ভাবনা,রূপকথার গল্প।

        পরবর্তী ক্ষেত্রেও হকিং সাহেব তাঁর মত বদল করেন নি। 2010 সালে তাঁর লেখা --'দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন' বইটিতে সোজাসুজি বলেছেন --'এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য  কোনো স্রষ্ট্রার প্রয়োজন হয়নি'। 2012 সালে  বিশ্বসৃষ্টি ও ভৌত-প্রকৃতিক নিয়মনিয়ে আলোচনা করা, শীর্ষ বিক্রিত বই 'অ্যা ব্রিফ হিস্টোরি অফ-টাইমস (কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস)-এ তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন 'মহাবিশ্ব  সৃষ্টি  হয়েছে  বিজ্ঞানের  নিয়ম মেনে, এবং পরিচালিত হয় বিজ্ঞানের নিয়ম দ্বারাই। 2010 সালে 'ওয়াল্ড সায়েন্স ফ্যাস্টিভ্যালে' যোগ দিতে তিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেখানে 'এবিসি' নিউজ তাঁর  একটি  সাক্ষাতকার নেয় এবং তাঁরা জানতে  চায় --'ধর্ম  আর  বিজ্ঞানকে  কী  কোনোভাবেই মেলানো যায় না'? প্রত্যুত্তরে  হকিং যা বললেন তা সক্কলেই বুঝতে পারবেন --'ধর্ম আর  বিজ্ঞানে  একটা সুপষ্ট ভাগ রয়েছে, ধর্মে  রয়েছে একজন  সর্বময়  কর্তা, আর  বিজ্ঞান  পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির  উপর  দাঁড়িয়ে আছে, শেষ  পর্যন্ত  জয় হবে বিজ্ঞানের-ই।

                     ঈশ্বরের কথা কেউ জিজ্ঞেস করেন নি, এমন সাক্ষাতকার হকিং বোধহয় একটিও দেন নি। প্রসঙ্গত একবার একজন হকিং সাহেবকে বলেছিলেন যে -'কেউ প্রমাণ করতে পারবেন না যে, ঈশ্বর নেই'। হকিং দিয়েছিলেন ছোট্ট উত্তর --- 'সায়েন্স মেকস্গড আননেসেসারি'। বিজ্ঞানে ঈশ্বর অপ্রয়োজনীয়। তাঁকে  নিয়ে  নির্মিত  প্রমাণ্য  চিত্রের উদ্বোধনীতে  উপস্থিত দর্শকদের  উদ্দেশ্যেও  একই  কথা  বলেছেন হকিং। এই সমস্ত কথাতে  ধর্মের  জগতে ধ্বজ্জাধারী তথা ধর্মের জগৎ- এ বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়  এবং  তিনি  বিতর্কিত  বিজ্ঞানী  হিসেবে চিহ্নিত হোন।

               এ-তো গেল হকিং এর কথা। এখন যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা  ও  ঈশ্বর  কণা  নিয়ে  বিশেষ  করে 'হিন্দু ও মুসলিম প্রভৃতি উপাসনা' ধর্মের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবি ও বিজ্ঞানীরা নিজ ধর্মের  সত্যতা, গ্রহণযোগ্যতা ও শ্রেষ্টত্ত্ব প্রমানের এক সু-চতুর অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। এখন ধর্মের পৃষ্ঠপোষক-বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবি ও সাংবাদিকরা যতই লিখুক ও প্রচার  চালান না  কেন, 2008 সালের  সাক্ষাতকারে 'ঈশ্বর কণার'  আবিস্কারক 'পিটার হিগস' কি বলেছিলেন তা আমরা দেখে নেব, যা দেখে উবে যায় অনেক রসস্য-উন্মাদনার ভ্রান্তবিলাস। তৎকালীন সাংবাদিক বন্ধুটি পিটার হিগসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন --'বোসন কণার ধর্মীর ডাক নাম তো নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী 'লিও লেডার ম্যান' দিয়েছেন, আপনি দেননি'। প্রতুত্ত্বরে পিটার হিগস বলেছিলেন - 'না,না লেডারম্যানে-রও ওই  নাম  পছন্দ  ছিল না, তিনি বরং 'গডড্যাম পার্টিক্যাল' (ধুর ছাই কণা) বলতে চেয়েছিলেন'। সে নাম আবার প্রকাশকের পছন্দ হয়নি। নিজের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে পিটারহিগসের মতো বিনয়ী মানুষ  অনেকটা ক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, 'ঈশ্বর কণা' কথাটিকেই তিনি ঘৃণার চোখে দেখেছেন। প্রশ্নের উত্তরে পিটার আরো যা  বলেছেন  তা  তুলনাহীন। তিনি বলেন--'এমন নাম আমার কাছে অস্বস্তিকর ,আমি নিরীশ্বরবাদী আমার কথা ছেড়ে দিন, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখেন তারা নামের  এমন অপব্যবহার দেখে কেমন  দুঃখ  পাবেন সে  কথাটাই ভাবছি', বিজ্ঞান থাকুক বিজ্ঞানের জগতে, ঈশ্বর থাকুক ঈশ্বরের জগতে। বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত খুঁজে লাভ নেই, কেননা বিজ্ঞানের একাজ নয়।

            ঈশ্বরকণা আবিস্কারের সঙ্গে জড়িত আর এক বিজ্ঞানি লিওলেডার ম্যানের বক্তব্য --'ঈশ্বর কণা বুঝতে যদি গোটা বিশ্বব্রম্ভান্ডের দরকার হয় তবে ঈশ্বরের মহিমা তুচ্ছ বলে না মেনে উপায় আছে? সর্বোপরি বলি যে এখন ঈশ্বর  ও পরজন্ম ইত্যাদি সম্বন্ধে  বিজ্ঞানীদের  যদি  এই  মত  হয় , তবে  আমাদের ঠিক করতে  হবে যে  আমরা কল্পিত ঈশ্বর, পরজন্ম, স্বর্গ-নরক নামক মার্কা  বিষয়  বস্তুকে  আঁকড়ে  বসে  থাকব, না  সামনের দিকে এগোবো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

সিদ্ধাথ বলেছেন…
বিজ্ঞান নিজের নিয়মে চলে। বিজ্ঞান বোঝাতে দয়া করে ঈশ্বর এর আমদানি করবেন না।
Saif Raju বলেছেন…
দুবার পড়লাম। খুবই মনোযোগী হয়ে পড়লাম। আনন্দিত হলাম।