পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এই দিনটি দুই বাংলায় নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। এই কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলেমিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষে মানুষজন বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকাল সকাল স্নানাদি সেরে নিয়ে নতুন জামাকাপড় পড়ে। একটি ধারনা আছে দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য ভাল বলে মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম বাঙালি খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলেও এখন বহুল প্রচলিত। ওপার বাংলায় এই দিনে সর্বজনীন লোক শিল্প মেলা হয় । স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন: চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে।
বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উৎযাপিত হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিন সাধারণত সব শ্রেণীর এবং সব বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে। এদিন সকালবেলা পানতা ভাত খাওয়া চল হয়েছে। সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা।
বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে ওপার বাংলায়। বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠান এক মিলন মেলার সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় এই জাতীয় উৎসবে। জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এখানকার চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহবানকে করে তোলে মনোরম এবং গভীর আবেদনময়। এই শোভাযাত্রা উপভোগ করে সব শ্রেণীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে।
পশ্চিমবাংলায় নববর্ষ উৎযাপন উপলক্ষে কলকাতায় রবীন্দ্র সদন, মহুলকুঞ্জ, একাডেমী, নন্দন চত্বরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ পালন করে আসছে। গোটা পশ্চিম বাংলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। সেসব কর্মসূচিতে থাকে গান, নাচ, কবিতাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, বর্ণাঢ্য মিছিল, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি। রেডিও ও টেলিভিশনে পহেলা বৈশাখের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। এছাড়া সংবাদপত্র, লিটিল ম্যাগাজিন গুলিতে বঙ্গাব্দ, নববর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধসহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। বছর দুইয়েক এই বাংলাতেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে রঙিন মুখোশ, কুলো, পাখা নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। রাস্তায় রাতভোর ধরে চলছে রঙিন আলপনা দেওয়া। গোটা বাংলা জুড়ে আপামর বাঙালি আজ পহেলা বৈশাখে নববর্ষকে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে। আর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বাদ দিয়েই আপামর বাঙালি এই উৎসব আজ পালন করছে। বর্তমানে ওপার বাংলার জাতীয় উৎসব এখন দুই বাংলা তথা বাঙালির 'সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবে' পরিণত হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ