লিদিৎসে’র শিশুরা।। কে. এম. হাসান


শীর্ষ ছবি: লিদিৎসে’র শিশুদের স্মরণে চেক ভাস্কর মারী উচাইতিলোভার  The Memorial to the Children Victims of the War এর একাংশ (ছবিসুত্র)
Each man’s death diminishes me, For I am involved in mankind. Therefore, send not to know, For whom the bell tolls, It tolls for thee. (John Donne (1572–1631) O peace! how many wars were waged in thy name. Alexander Pope (1688 – 1744)
যুদ্ধের নামে মানুষের বর্বরতার উদহারনের কোন অভাব নেই। তবে বর্বরতার এই ইতিহাসটি চেকোস্লোভাকিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম লিদিৎসে (Lidice) র। ১৯৪২ সালের ১০ জুন নাৎসী জার্মানীর এসএস সেনাদের নৃশংস হত্যাকান্ড এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছিল  এই গ্রামটির নিরীহ বেসামরিক অধিবাসীরা, শিশু, নারী এবং পুরুষ। ১০ জুন ছিল সেই গনহত্যার ৭২ তম বার্ষিকী। এই ৭২ বছরে আরো অসংখ্য গনহত্যা হয়েছে। ভু-রাজনৈতিক আধিপাত্য,ধর্ম আর সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়েছে নীরিহ শিশু, নারী ও পুরুষ। আমরা কিছুই বদলাতে পারিনি এবং পারবো বলেও অনেকের মত আমি আশাবাদী না। তাই হয়তো এই লেখা : সব গনহত্যার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিস্মৃতির প্রতি,  ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির প্রতি অসহায় কিছু শব্দমালা। বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাহা ( Prague) থেকে প্রায় ২০ কিমি দুরে উত্তর পশ্চিমেই অবস্থিত লিদিৎসে; ১৯৪২ সালে যেখানে মুল গ্রামটি ছিল, তার কাছেই আবার নতুন করে তৈরী করা হয়েছে লিডিৎসে, পুরো গ্রামটাই এখন এক ভয়াবহ ইতিহাসের স্মৃতি সৌধ। ৭২ বছর আগে নাৎসী জার্মানীর নিয়ন্ত্রনাধীন বোহেমিয়া ও মোরাভিয়ার একটি গ্রাম ছিল লিদিৎসে।১০ জুন, ১৯৪২ সালে হিটলারের জার্মান সরকার ঘোষনা দেয়, তারা চেকোস্লোভাকিয়ার একটি গ্রাম লিদিৎসে সম্পুর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, এর সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং প্রায় ৫২ জন নারীকে হত্যা করে এবং বাকী জীবিত নারী এবং শিশুদের (জার্মানীকরন করা সম্ভব এমন কয়েকটি শিশু ছাড়া, যাদের জার্মানীতে পাঠানো হয়েছিল) কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। নাৎসীরা এরপর দম্ভ করে ঘোষনা দেয়, লিদিৎসে, এর অধিবাসীদের, এই গ্রামের নাম পর্যন্ত স্মৃতি থেকে সম্পুর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। কিন্তু লিদিৎসে’র নাম নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি হিটলার। লিদিৎসে এখন শান্ত একটা শহর, যার পাশেই এখন আছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পুরোনো গ্রামের কিছু পাথূরে অবশেষ, নৃশংস হ্ত্যকান্ডের স্মরনে গড়া স্মৃতি সৌধ, লিদিৎসের হারিয়ে যাওয়া শিশুদের স্মরনে একটি হৃদয়স্পর্শী একগুচ্ছ ব্রোন্জ মুর্তি, একটি গোলাপ বাগান, মিউজিয়াম, লিদিৎসে মেমোরিয়াল। 











কি হয়েছিল সেদিন লিদিৎসে?  তার আগে কিছুটা ইতিহাস বলতে হবে। ১৯৩৮, মিউনিখ চুক্তির পর হিটলারের সেনাবাহিনী জাতিগতভাবে জার্মান প্রধান বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়ার বেশ কিছু এলাকার দখল নেয়, এরপর এর কিছু দিন পর অন্যদিকে হাঙ্গেরী দক্ষিন স্লোভাকিয়া এবং রুথেনিয়া এলাকার দ্বায়িত্ব গ্রহন করে।১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে হিটলার আরো কিছু চেক অংশ দখল করে নিলে, চেকোস্লোভাকিয়ার আর কোন অস্তিত্ব থাকেনা, আর বাকী স্লোভাকিয়া তখন একটি নাৎসীদের পুতুল রাষ্ট্রে পরিনত হয়। নাৎসী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এরপর দ্রুত বাড়তে থাকে চেকদের প্রতিরোধ আন্দোলন। আর সেই আন্দোলন দমন করতে, সিকিউরিটি পুলিশ প্রধান, এসএস (SS বা Schutzstaffel, যার আক্ষরিক অর্থ প্রতিরক্ষা বাহিনী, যা নাৎসী পার্টির অধীনে একটি প্যারামিলিটারী বাহিনী ছিল) এর একজন উর্ধতন কর্মকর্তা রাইনহার্ড হেইড্রিশ কে ১৯৪১ এর সেপ্টেম্বরে জার্মান দখলকৃত এলাকায় উপপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয় জার্মান হাই কম্যান্ড। রাইনহার্ড  এর সংক্ষিপ্ত এাসের রাজত্বে প্রায় ৫০০০ ফ্যাসীবাদ বিরোধী যোদ্ধা এবং তাদের সাহায্যকারীদের বন্দী করা হয়।মার্শাল কোর্টের দ্রুত বিচারে বা কখনো বিনা বিচারে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, রাইনহার্ড এই সময় খেতাব পান ’প্রাহার কসাই’ হিসাবে।

ছবি: জার্মান অধিকৃত এলাকার উপ প্রধান প্রাহার জল্লাদ রাইনহার্ড হেইড্রিশ এবং নিষ্ঠুর গেষ্টাপো প্রধান লিদিৎসে গনহত্যার প্রধান কার্ল হেরমান ফ্রাঙ্ক। কার্ল হেরমান ফ্র্যাঙ্ক মার্কিন বাহিনীর কাছে পরে আত্মসমর্পন করেন, ১৯৪৬ সালে তার বিচার হয় প্রাহাতে। প্রায় ৫০০০ মানুষের সামনে ফাসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তখন লন্ডনে নির্বাসিত চেকোস্লোভাক সরকারের প্রধান এডভার্ড বেনেস, চেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান ফ্রান্টিসেক মোরাভেক এর সাথে নাৎসীদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। জার্মান নাৎসীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ প্রতিরোধটি ছিল জল্লাদ রাইনহার্ডকে হত্যা করার অপারেশনটি (  যার কোড নাম ছিল অপারেশন অ্যানথ্রোপয়েড); দুজন সাহসী চেক মুক্তিযোদ্ধা জান কুবিস এবং জোসেফ গাবসিক ( তখন ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনীর পোলিশ ফোর্সের সদস্য) এই অপারেশনটির দ্বায়িত্ব নেন এবং  প্রাহার কাছাকাছি  প্যারাসুটের সাহায্যে তারা অবতরন করেন। ১৯৪২ এর ২৭ শে মে তারা রাইনহার্ডকে হত্যার দু:সাহসী অ্যামবুশটি করেন, যখন রাইনহার্ড তার অফিসে যাচ্ছিল। গুরুতর আহত রাইনহার্ড এর ৮ দিন পর ৪ জুন মারা যান। 

বি: জান কুবিস (চেক) এবং জোসেফ গাবসিক (জাতিগত ভাবে স্লোভাক), অপারেশন অ্যানথ্রোপয়েড এর দুই মুক্তিযোদ্ধা রাইনহার্ডের আহত হবার সাথেই সাথেই ন্যাৎসীরা তাদের পাল্টা আক্রমন শুরু করে আততায়ীদের ধরার জন্য। গুরুতর আহত রাইনহার্ড এর ৮ দিন পর মারা যান। রাইনহার্ডের আহত হবার সাথেই সাথেই নাৎসীরা আততায়ীদের ধরার জন্য সাড়াশী অভিযান শুরু করে।জার্মান গোয়েন্দারা বুঝে ফেলে ব্রিটিশ সহায়তা ছিল এই আক্রমনের পিছনে।এই দুজনকে ধরতে মোট  বহু চেককে (প্রায় ১৩০০০) গ্রেফতার এবং নীপিড়ন এবং হত্যা করা হয়।অবশেষে এক চেক মুক্তিযোদ্ধার বিশ্বাসঘাতকতায় ১৮ জুন জার্মান সেনারা কুবিস এবং গাবসিক ও অন্য প্যারাট্রুপারদের আশ্রয়স্থল প্রাহার Cyril and Methodius Cathedral ঘিরে ফেলে।অনেকক্ষন যুদ্ধের পর গুরুতর আহত কুবিস ছাড়া বাকীরা আত্মহত্যা করে, কুবিস শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়, পরে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে মারা যায় ((এই পুরো ঘটনাটির কাহিনী নিয়ে ১৯৭৫ সালে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র আছে, যার নাম অপারেশন ডে ব্রেক))। http://youtu.be/LkwVGqqqSGE ভিডিও : অপারেশন ডেব্রেক ক্ষুদ্ধ হিটলার রাইনহার্ডের এর সেকেন্ড ইন কমান্ড কার্ল হেরমান ফ্র্যাঙ্ককে নির্দেশ দেন পুরো চেক জাতিকে ( কোন সুত্রে কমপক্ষে ১০০০০ জন) নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রক্রিয়া শুরু করতে।কিন্তু কার্ল হিটলারকে বোঝাতে সক্ষম হন, আগে আততায়ীদের খুজে বের করার জন্য কিছু সময় দেবার জন্য, এছাড়া জার্মান যুদ্ধের কাচামাল যোগানোর জন্য চেকদের প্রয়োজনও আছে, বড় আকারের কোন গনহত্যা উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে । কয়েকদিনের মধ্যে জার্মানরা ৫০০০ গ্রাম এবং শহর তল্লাশী করে আরো প্রায় ৩১৮০ জনকে আটক করে, যাদের ১৩৪৪ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় দ্রুত, উদ্দেশ্য, চেকদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে ধ্বংস করে দেয়া। কিন্তু হিটলারে নির্দেশ মোতাবেক বড় সংখ্যার চেকদের হত্যা করার তুলনায় এই সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য। যদিও সব বেসামরিক চেকদের উপর হিটলারের নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি তবে, কার্লকে বার্লিন থেকে জানানো হয়, হিটলার স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছেন যদি কোন চেক গ্রামের রাইনহার্ড হত্যার সাথে কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তবে সেই গ্রামের সব প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে হত্যা করতে হবে, সকল মহিলা ও শিশুদের (যে সমস্ত শিশুদের জার্মানীকরন করা যাবে তাদের বিভিন্ন এস এস পরিবারে প্রেরণ করে) কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাতে হবে এবং পুরো গ্রাম ধ্বংশ করে, পর থেকে বোমা মেরে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে, পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে । ১৯৪২ সালের ৯ জুন খুব ভোরেই, ক্লান্ডো জেলার ছোট শহর লিদিৎসে এ ১০ ট্রাক সিকিউরিটি পুলিশ সদস্য এসে নামে। এর কারন ছিল, এস এস গোয়েন্দা সংস্থা গেষ্টাপোর গোয়েন্দারা লিদিৎসের স্থানীয়, হোরাক নামে একটি পরিবারের কাছে তাদের ছেলের পাঠানো একটি চিঠি আটক করে, যে লন্ডনে নির্বাসিত চেক আর্মির সদস্য ছিল। গেষ্টাপো সেই  চিঠিটাকে সন্দেহজনক আখ্যা দেয়, যার ফলশ্রুতিতে লিদিৎসে চিহ্নিত হয় হিটলার এর সেই ভয়াবহ আদেশ পালনের শিকার হিসাবে। http://youtu.be/O1PTzlxWBpc গ্রামের সমস্ত ১৬ বছর এর বেশী বয়সী সকল পুরুষদের একসাথে জড়ো করে গ্রামের এক প্রান্তে হোরাক পরিবারের খামারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাতটা থেকে প্রথমে একসাথে পাচ জন, পরে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য দশজন করে গুলি করে হত্যা করা হয়  এস এস অফিসার ম্যাক্স রোস্টক এর নির্দেশে ( যুদ্ধ শেষে বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়াবার পর ম্যাক্স রোস্টক ধরা পড়ে, বিচারে তার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিষ্ট শাসন শেষ হলে, কিছু গোপন কাগজ পত্রে জানা যায় ম্যাক্স রোস্টককে কমিউনিষ্ট সরকার গোপনে ক্ষমা করে দিয়েছিল। এবং তাদের পক্ষে গোয়েন্দা হিসাবে পশ্চিম জার্মানীতে ৮০ দশকের শেষে তার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত ভালোভাবেই জীবনযাপন করেছিল) রাত দশটায় সিকিউরিটি পুলিশের সাথে যোগ দেয় প্রাহা থেকে আসা গেষ্টাপো এজেন্টরা; একদল যখন ডেথ স্কোয়াড, হত্যা করে যাচ্ছিল, আরেকদল পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে প্রেট্রোল ঢেলে জ্বালাতে শুরু করে সব ঘর বাড়ী।দিন শেষে ১৭৩ জন পুরুষের গুলির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত লাশ পড়ে থাকে গ্রামের প্রান্তে ফলের বাগানে। এরপর আসে সেনাবাহিনীর ইন্জিনিয়ারদের দল, তখনও দাড়িয়ে থাকা বাড়ীর দেয়ালগুলো উড়িয়ে দেয়া হয় বোমা মেরে, এর পর আসে বুলডোজার শিকড় সহ গাছ উপড়ে ফেলে সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়, এমনকি পুরাতন কবরস্থান।১১ জুন সকালে স্থানীয় গেটো থেকে ধরে নিয়ে আসা ট্রাক ভর্তি ইহুদিদের দিয়ে গর্ত খোড়ানো হয়  এবং মাটি চাপা দেয়া হয়  ‍মৃতদেহগুলো। গ্রামে এই ধ্বংশলীলা চালানোর সময়, সমস্য মুল্যবান সম্পত্তি, গবাদী পশু, চাষাবাদের সামগ্রী নিয়ে যায় সিকিউরিটি পুলিশ। প্রায় ৪০০ র মত কবরও ধ্বংশ করা হয়। মাটির সাথে মিশিয়ে দেবার পর লিদিৎসের উপর দিয়ে তৈরী করা হয় রাস্তা, রুপান্তরিত করা হয় ভেড়ার চারন ক্ষেত্রে । লিদিৎসে র কোন চিহ্ন খুজে যাতে না পাওয়া যায়, এমন ভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল গ্রামটিকে। চার দিকে কাটাতারের বেড়া দিয়ে জার্মানরা সাবধান বানী লিখে রেখেছিল, কেউ  এখানে ঢোকার চেষ্টা করলে, দেখা মাত্রই গুলি করা হবে। 




লিদিৎসে র নারী ও শিশুদের ছাড় দেয়া হয়নি। আরো ১১ জন যারা গ্রামে সেদিন ছিলনা তাদেরকেও ধরে আনা হয়, এবং এর আগে গ্রেফতার হওয়া ৮ জন পুরুষ আর ৭ জন নারী (যাদের আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল, কারন তাদের একজন আত্মীয় ছিল যুক্তরাজ্যে চেক আর্মির সদস্য), এই ১৯ জনকে একই সাথে হত্যা করা হয় প্রাহাতে। গ্রামের মোট ১৯২ জন পুরুষ সবাইকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল নির্বিচারে। পুরুষদের হত্যা করার সময়, জার্মান সেনারা ২০৩ জন নারী এবং ১০৫ জন শিশুকে জড়ো করে প্রথমে লিদিৎসের স্কুলে।এবং এর তিন দিন পর তাদের নিকটবর্তী শহর ক্ল্যানদোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নারীদের থেকে শিশুদের আলাদা করার পর, ১৯৬ জন নারীকে নিয়ে যাওয়া হয় রাভেনসব্রুকের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, চারজন গর্ভবতী মাকে সন্তান জোর করে প্রসব করানো হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর আগে।ক্যাম্পের নির্যাতনে এবং গ্যাস চেম্বারে মারা যায় ৫৩ জন। লিদিৎসের মোট ২০৩ জন নারীর মধ্যে ৬০ জনকে হত্যা করা হয়। বাকী ১৪৩ জন ফিরে এসেছিল গ্রামে, যাদের মধ্যে অনেকেই দ্রুত মারা যান। 

ছবি: লিদিৎসে শিশুদের একাংশ, ছবিটি স্কুলের। এদের কেউ আর ফিরে আসেনি ৮৮ জন শিশুকে বাসে করে জুনের ১৩ তারিখ লোভোসিস এ নিয়ে আসা হয়। প্রাহার জার্মান প্রধানের অফিস থেকে পাঠানো টেলিগ্রামে লেখা ছিল, এই শিশুদের যা পরনে আছে তারা তাই নিয়ে এসেছে, কোন বিশেষ ব্যবস্থা যেন নেয়া না হয়। শিশুদের উপর নির্যাতন ছিল ভয়াবহ: তাদের অনাহারে রাখা, তীব্র শীতে ঠান্ডা মেঝেতে শুতে বাধ্য করা, কোন কম্বল বা শীত বস্ত্র ছাড়া, ক্যাম্পের ম্যানেজমেন্টের প্রতি বিশেষ নির্দেশ ছিল তাদের যেন কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হয়। এখানে আসার পর জার্মানীকরনের উদ্দেশে সাত জনকে বাছাই করা হয়, এবং জুলাই ১ তারিখে, আইখম্যান নির্দেশ পাঠান বাকীদের যেন দ্রুত হত্যা করা হয়। জুলাই ২, ১৯৪২, বাকী ৮১ জন শিশুকে গেষ্টাপো অফিসে হস্তান্তর করা হয়, তাদের পোল্যান্ডে চেলনো (Chelmno) নামে এটি স্থানে এক্সটারমিনেশন বা ডেথ ক্যাম্পে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। ধারনা করা হয়, তাদের সবাইকে একই দিনে হত্যা করা হয়েছিল। লিদিৎসের ১০৫ জন শিশুর (অনুর্ধ ১৬ বছর) ৮২ জন মারা যায় চেলমোয়, ৬ জন এতিমখানায়। মাত্র ১৭ জন জীবিত ফিরে এসেছিল সেই শিশুদের ।এর কিছু দিন পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে লেজাকি (Ležáky) বলে আরেকটি গ্রামে। ১৯৪৫ সালে মে মাসে চেকোস্লোভাকিয়া মুক্ত হলে নতুন করে গ্রামটির স্থাপনা শুরু হয়। জুন ৩, ১৯৪৫ সালে রেড আর্মির সেনারা প্রথম একটি স্মৃতি সৌধ তৈরী করে গন কবরের স্থানে। পরে বর্ধিতাকারে একটি মেমোরিয়াল ও মিউজিয়াম এবং ভাস্কর্য নির্মান করা হয়। লিদিৎসের শিশুর নামের ৮২ টি ব্রোন্জের মুর্তি ছাড়াও গ্রামের স্কুলের ভিত্তির উপর এবং কবরের কাছে দাড়ানো আছে দুটি শোকার্ত নারীর মুর্তি। ৫০ এর দশকে বিশ্বব্যাপী মানুষের সাহায্যে গড়ে তোলা হয় ১০০ টি বাড়ী, মুল এলাকার কাছেই , তৈরী করা হয় ৩২ টি দেশ থেকে পাঠানো একটি ২৯০০০ গোলাপ গাছের একটি বাগান জীবনের নিরন্তর প্রবাহর চিহ্ন হিসাবে। মারী উচাইতিলোভা কুসোভা ও তার The Memorial to the Children Victims of the War, একজন শিল্পীর দায়:  লিদিৎসের ভয়াবহ এই ঘটনার সবচেয়ে নির্মম শিকার ছিল শিশুরা। আর এই ভয়াবহতাকে  বিস্মৃতির অভিশাপ থেকে বাচানোv দায় থেকে মারি উচাইতিলোভা কুসোভা (Marie-Uchytilova Kucova: 17 January 1924 – 16 November 1989 Prague ) নামের একজন চেক অ্যাকাডেমিক ভাস্কর কোন কমিশন ছাড়াই নিজের তাগিদে ৬০ দশকের প্রথম ভাগ থেকেই  লিদিৎসে শিশু এবং সেই সাথে সকল যুদ্ধে নিহত শিশুদের স্মরনে, চেলনো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিহত প্রতিটি শিশুকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন মোট ৮২ টি ভাস্কর্য তৈরী করার কাজ শুরু করেন। প্রথমে তৈরী হয় তার প্লাষ্টার মডেল, মডেল তৈরী করে তিনি চেয়েছিলেন লিদিৎসে গ্রামেই এই স্বতন্ত্রটি ৮২টি শিশুর ভাষ্কর্যটি ব্রোন্জ দিয়ে কাষ্ট করবেন। http://youtu.be/V7AnxHJM_YU কিন্তু তার সেই আর্থিক ক্ষমতা ছিল না একার পক্ষে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, বেচে থাকতে মাত্র ৩ টি ব্রোন্জ কাষ্ট করেছিলেন, তার কাজে সাহায্য করেছিলেন তার স্বামী জর্জ ভি হাম্পল।তৎকালীন চেক কমিউনিষ্ট সরকারও কোন উৎসাহ দেখায়নি মারিকে সাহায্য করার জন্য। যেটুকু সহায়তা তিনি পেয়েছিলেন তা এসেছিল দেশের বাইরে থেকে। তারপরও তা যথেষ্ট ছিল না। হঠাৎ করেই মেরী উচাইটিলোভা মারা যান ১৯৮৯ সালে তার সেই স্বপ্ন অপুর্ণ রেখেই।  স্বামী জর্জ  মারীর মৃত্যুর পর তার স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেন আরো জোরে সোরে। তার প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ ধীরে ধীরে সম্ভব হতে থাকে। তবে প্রথমে তা যথেষ্ট ছিলনা। কিন্তু হঠাৎ করেই মধ্য নব্বই এর দশকে বড় অংকের একটি সাহায্য আসে ডেনমার্কের Albertslund শহরের অধিবাসীদের কাছ থেকে। সম্ভব হয় প্রয়োজনীয় ৮২ টি ব্রোন্জ ঢালাই এর কাজটি শেষ এবং লিদিৎসে এ এই হৃদয়স্পর্শী ভাস্কর্য টি স্থাপনা করার জন্য। 

চেক ভাস্কর মারি উচাইতিলোভা কুসোভা, মারি কবিতাও লিখতেন। 

প্লাষ্টার কাষ্টের সামনে মারী উচাইতিলোভা 


মারীর সৃষ্টির সামনে দাড়ানো তার স্বামী জর্জ হাম্পল ১৯৯৫ সালে প্রথমে ৩০টি শিশুর মুর্তি নিয়ে স্থাপন করা হয়। ২০০০ সালে ১০ই জুন লিদিৎসে গণহত্যার ৫৮ তম বার্ষিকীতে উন্মোচন করা হয় পুরো ভাষ্কর্যটিকে; শিল্পী র কাজ শুরু করার ৩০ বছর আর তার মৃত্যুর ১১ বছর পর মারীর অপুর্ব সৃষ্টি লিদিৎসের শিশুরা তাকিয়ে আছে তাদের পুর্বপুরুষের সমাধির দিকে এবং সমস্ত মানবতার দিকে। 














মারী উচাইতিলোভার আরো একটি ভাস্কর্য হলো Mother of Lidice; এটি স্থাপনা করা হয়েছে, ক্লান্দো গ্রামার স্কুলের প্রাঙ্গনে। যেখান থেকেই জুন ১১, ১৯৪২ সালে জার্মানরা লিদিৎসের মাদের কোল খালি করে শিশুদের নিয়ে গিয়েছিল। অনুপস্থিত অথচ চিরস্থায়ী স্মৃতির গভীরে প্রোথিত শিশুর চিহ্ন মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়াবহ বেদনার দিনটিকে



লিদিৎসে মেমোরিয়ালে উন্মুক্ত খোলা প্রান্তরে দাড়ানো শিশুরা আজ সারা পৃথিবীর শিশু কন্ঠ, তারা জানতে চায়, তাদের অপরাধটা কি ছিল। আর সেই প্রশ্নর উত্তর দেবার মত আমরাই বা কবে সভ্য হতে পারবো ? (পরিশিষ্ট:  প্রতি বছর বিশ্ব ব্যাপী শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয় লিদিৎসে মেমোরিয়াল এর উদ্যোগে, উৎসাহীরা এই লিঙ্ক এ তা দেখতে পাবেন। এছাড়া লিদিৎসের মিউজিয়ামটির  সাথে আছে আর্ট গ্যালারী, যেখানে অনেক শিল্পী তাদের চিত্রকর্ম দান করেছেন)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ