(সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা দেখে মনে হল এটা নিয়ে কিছু লিখি তাই শুরু করছি। তবে ইতিমধ্যেই এই কিছু অসমাপ্ত সিরিজ ঝুলে আছে, সেগুলো আস্তে আস্তে শেষ করব, কিন্তু আপাতত এটাই চলুক...)
সংখ্যালঘুদের নিয়ে কী নীতি গ্রহণ করা যায়- এই বিষয়ে বিতর্ক অনেক পুরনো। এদেরকে সমাজের মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের অংশের সমতুল্য ভেবে একই মানদণ্ডে বিচার করা উচিৎ হবে, নাকি তাদের সংস্কৃতিকে অদৃশ্য করে দিয়ে মূলধারার সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণভাবে আত্তীকৃত করা উচিৎ হবে, নাকি সংখ্যালঘু সংস্কৃতিকে সমাজের প্রান্তিক সংস্কৃতি হিসেবে একপাশে রেখে তাদের নিজেদের মত অধিকার পালন করতে দেয়াই সঠিক হবে- এসব নিয়ে তাত্ত্বিক মহলের বিতর্ক অতি প্রাচীন। আর এই বিতর্কের প্রতিফলন ঘটে তাদের অধিকার রক্ষার বিভিন্ন প্রায়োগিক প্রেক্ষিতেও। এই সিরিজে তাত্ত্বিক পরিসরে সংখ্যালঘুত্ব আর সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
সংখ্যালঘু বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি মূলত ৫ রকমেরই – রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি (conservative approach), উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি (liberal approach), আত্তীকরণ দৃষ্টিভঙ্গি (assimilation approach), সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি (cultural pluralism approach) ও আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি (legal approach)। প্রথমেই রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু বলা যাক।
*রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি
রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মনে করা হয়, সমাজের সংখ্যালঘু অংশের অবস্থান ও অংশগ্রহণ যদি অর্থনৈতিক, আইনগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মূলধারার সংখ্যাগুরু অংশের মতই হয়, তাহলে তা সমাজকে ভঙ্গুর করে দিয়ে এর সার্বিক ভারসাম্য অবস্থাকে বিপন্ন করে তোলে। একে অনেকসময় বর্ণভিত্তিক বা রেশিয়াল দৃষ্টিভঙ্গিও বলা হয়। ইউরোপে রেনেসাঁর আগমনের পর, বিশেষ করে সপ্তদশ শতকে গোটা ইউরোপ জুড়েই উদার দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়, যা ঐতিহ্যবাহী অসম প্রতিষ্ঠানকে ভেঙ্গে ফেলতে থাকে। আর এরই প্রতিক্রিয়ায় প্রাচীনপন্থী পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্ভব হয় রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির।
বিংশ শতকের শেষভাগ থেকে একবিংশ শতকের শুরুতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সমস্যা, সংখ্যালঘু সমস্যা, মূলধারার সংখ্যাগুরু সমাজে সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভূক্তি ইত্যাদি বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মত অভিবাসিত জনগোষ্ঠী নির্ভর দেশে পুরনো প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ ও রীতিনীতিকে টিকিয়ে রাখার প্রবল দাবীতে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নতুন করে মাথাচাড়া দেয়।
সংখ্যালঘু বিষয়ক আলোচনার এসব বর্ণবাদী তত্ত্ব যথেষ্ট সমালোচিত হলেও দেখা যায় এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা রাজনৈতিক তোষণে উত্থিত হন। অনেক সময়ই রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে এসব রক্ষণশীল ধ্যান-ধারণার উদ্ভব হয় বলে এরকম মতবাদগুলো অনেক সমালোচনার পরও হারিয়ে যায় না। সময়ের সাথে সাথে রক্ষণশীলতার প্রকাশ কমলেও প্রভাবশালী রাজনৈতিক মদদে তা আবার ফিরে আসে। দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডার মত যেসব দেশে বহু জাতীয়তা, বহু অভিবাসনের সম্মেলন ঘটেছে সেখানেও উদারনৈতিক ধারার পাশাপাশি রক্ষণশীল ধারার সহাবস্থান বিরাজ করে। কিন্তু দেখা যায় এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীতা নিজেদেরকে সচেতনভাবে বর্ণবাদী বা রেসিস্ট বলতে নারাজ।
সংখ্যালঘু নিয়ে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এগুলো নিয়ে এবার একটু আলোচনা করা যাক:
১। রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করা হয় মানুষ মাত্রই অযৌক্তিক। যদি মানুষ সব কিছু যুক্তি দিয়েই বিচার করত তাহলে তারা টিকেই থাকতে পারত না। আর তাই টিকে থাকতে হলে মানুষকে অযৌক্তিক হতে হবে। এদের মতে “সৃষ্টির” পর থেকে মানুষকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। যুক্তিবোধ দিয়ে মানুষের পক্ষে প্রতিযোগিতায় জেতা সম্ভব না, অযৌক্তিক আচরণ দ্বারাই মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে জিতেছে। তাদের মতে তাই বিভিন্ন ধরণের সংখ্যালঘুত্বের উদ্ভব, শরণার্থী স্থানান্তর বা অভিবাসনের বাস্তবতায় পুরনো সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলেও অযৌক্তিক হতে হবে। আর তাই সংখ্যালঘুদের বাদ দিতে হবে।
২। রক্ষণশীলরা মনে করেন, মানব সমাজে স্তরায়ন বা হায়ারার্কি থাকা উচিৎ। তাদের মতে, সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতেই স্তরায়নকে টিকিয়ে রাখা দরকার। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষেরা নিচু স্তরের মানুষদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে- এটাই স্বাভাবিক, তা না হলে সবাই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনৈতিক অবস্থান, গোত্রবর্ণ, উচ্চ বংশ মর্যাদা ইত্যাদির ভিত্তিতে সমাজে উচ্চক্রম ও নিম্নক্রম নির্ধারিত হয়। কোনভাবেই এই দুটো ক্রমের মধ্যে আন্তযোগাযোগ বা সংমিশ্রণ ঘটানো উচিৎ নয়, আর তাই সমাজে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বিভাজন টিকিয়ে রাখা দরকার।
৩। রক্ষণশীলরা মনে করেন, প্রশাসনিক ও আইনগতভাবে সকলের সম-প্রবেশাধিকার কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। তাদের মতে, প্রশাসন, আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলো সমাজে অনেক বেশি বিশ্বস্ততার সাথে সংরক্ষণ করা উচিৎ। এইসব ক্ষেত্রে যদি সমাজের সকল অংশের প্রবেশ থাকে তাহলে এইসব প্রতিষ্ঠানের বিশ্বস্ততা নষ্ট হবে। দরিদ্র ও সংখ্যালঘুরা তাদের নিজেদের যোগ্যতায় এসব অংশে প্রবেশ করলেও তা সংরক্ষণের দায়িত্ব সুচারু ও বিশ্বস্তভাবে পালন করতে তারা অক্ষম। বরং সমাজের উঁচু শ্রেণীর অর্থবান ও মূলধারার অংশ এখানে থাকলে তারা এসব দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে পারবেন। যেহেতু মূলধারার লোকজনের মাঝে সংখ্যালঘুদের মত বিভিন্ন সংকট থাকেনা, তাই তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোন অবকাশ নেই। তাই এসব ক্ষেত্রে অসমতা থাকাই ভাল।
৪। রক্ষণশীলরা মনে করেন, সমাজের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোই শ্রেয়। তাদের মতে পুরাতন মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে ধারণ করা সমাজের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত সংস্কৃতির বিশুদ্ধ রূপকেই ধারণ করে। অভিবাসন, স্থানান্তরগমন ইত্যাদি হবার আগে সেই বিশুদ্ধ রূপই সংস্কৃতির একমাত্র প্রতিভূ ছিল। অভিবাসন, শরণার্থীর আগমন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সমাজে এসব প্রতিষ্ঠানের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায় আর এরফলে সংস্কৃতির আদিরূপটিও নষ্ট হয়। এইসবের ফলে সংস্কৃতি হিসেবে যা সামনে আসে তাকে দেখে রক্ষণশীলরা মনে করেন, এটা সংস্কৃতির মূল রূপ নয়, এর চেয়ে সংস্কৃতির আদিরূপে ফিরে যাওয়া এবং বর্তমানে সেই আদিরূপের যেসব অংশ সমাজে প্রচলিত রয়েছে সেগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
৫। রক্ষণশীলরা মনে করেন, কোন অদৃশ্য শক্তি দ্বারা সমগ্র সমাজ পরিচালিত হয়। এই সমাজে একটি অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব আছে, যেই শক্তির ক্ষমতার বাইরে মানুষ চাইলেও যেতে পারবে না, সেই ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। যদি এই ক্ষমতা মানুষের হাতে থাকত, তাহলে মানুষ সমাজের বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মত করে ভেঙ্গে ফেলত, নষ্ট করে ফেলত। আর এর ফলে সমাজ টিকে থাকতে পারত না। সেরকম হলে সমাজের দুর্বল, সংখ্যালঘু ও দরিদ্র অংশ এসব প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে ফেলত, নষ্ট করে ফেলত, সমাজের দরিদ্ররা তাদের সংখ্যাধিক্যের সুযোগ নিয়ে এই কাজ করত। এদের আক্রমণ থেকে এক অদৃশ্য শক্তিই সমাজকে রক্ষা করে চলেছে।
৬। রক্ষণশীলরা মনে করেন, সংখ্যালঘু ও শরণার্থীদের হাত থেকে সমাজকে টিকিয়ে রাখতে সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষকে একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। তারা সংখ্যালঘু বা শরণার্থীদেরকে সমাজের জন্য একরকম হুমকি মনে করেন, এবং এদের হাত থেকে সমাজকে বাঁচানোর জন্য উঁচু শ্রেণীর ও উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষদেরকে একতাবদ্ধ থাকতে হবে।
গত পর্বে আমি সংখ্যালঘুদের নিয়ে কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীলদের দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। এবার রক্ষণশীলদের দৃষ্টিভঙ্গিকে কয়েকটি মডেল দ্বারা প্রকাশ করব। মোট সাতটি মডেল নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। একটার পর একটা নিয়ে আসছি...
১। নৈতিকতার মডেল বা Principled Conservatist Model: সমাজে সুযোগ সুবিধা, রাষ্ট্রীয় অধিকার এবং আইনি বিভিন্ন অধিকার সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে বণ্টন সম্পর্কে এই তত্ত্বে আলোচনা করা হয়। প্রিন্সিপলড কনজারভেটিভ বললে তাদেরকেই বোঝানো হয় যারা কনজারভেটিভ নীতির সাথে কখনই কম্প্রোমাইজ করেন না, এমনকি অধিক ভোট বা জনপ্রিয়তা পাবার জন্যেও যদি কনজারভেটিভ নীতিগুলোর কোন কিছু কম্প্রোমাইজ করলে এদের সুবিধা হয় তবুও এরা তাদের নীতিতে অটল থাকবেন। এডমান্ড বার্ক সহ বিভিন্ন পলিটিকাল ফিলোসফারদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এদের নীতি তৈরি হয়। আর এরা সেইসব নীতিতে অটল থাকেন। অনেক সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের কনজারভেটিভদের মধ্যে একধরণের প্রবণতা দেখা যায়, তারা ন্যাশনাল সিকিউরিটি, পাওয়ারফুল মিলিটারি, শক্তিশালী পুলিস ফোর্স এই তিনটা সহ কম বেশি আরও কিছু পুরণ হয়ে গেলে অন্যান্য খাতগুলোতে কনজারভেটিজম ছেড়ে লিবারাল এপ্রোচও নিয়ে নেয়। এরা যদি দেখে কোন কোন ক্ষেত্রে লিবারাল এপ্রোচ নিলে জনপ্রিয়তা বাড়বে, ভোট বেশি পাবার সম্ভাবনা বাড়বে, তাহলে তারা অনেক সময় সেই পথেই হাঁটেন।
কিন্তু এই ব্যাপারগুলোতে প্রিন্সিপলড কনজারভেটিভরা খুব কঠোর থাকেন। যেসব কনজারভেটিভরা এরকম নীতির সাথে কমপ্রোমাইজ করেন তাদেরকে এরা ফ্লেক্সিবল বা ম্যালিয়েবল কনজারভেটিভ বলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেকেই এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ম্যালিয়েবল কনজারভেটিভ বলছেন, অন্যদিকে সেনেটর টেড ক্রুজ এখন অব্দি প্রিন্সিপলড কনজারভেটিভ এর মর্যাদায় আসীন। সমাজ-নৈতিকতার ক্ষেত্রে প্রিন্সিপলড কনজারভেটিভদের সোজাসাপ্টা হিসাব। সমাজে এরা কোনরকম এক্সপেরিমেন্টে যাবেন না, কোনরকম ফ্রি সুবিধা মানবেন না, হেলথকেয়ার কি মানুষের অধিকার? না! শিক্ষা কি মানুষের অধিকার? না! পিছিয়ে পড়া, সংখ্যালঘুদের জন্য কি রিজার্ভেশন রাখা উচিৎ? একেবারেই না! আপনি ততটুকুই পাবেন যতটা আপনার সামর্থে কুলোয়, মারকেটে আপনার কাজের যে মূল্য আপনাকে তাই দেয়া হবে, এর বেশি একটুকুও আপনাকে দেয়া হবে না। আমি কনজারভেটিভ, আমি সম্পূর্ণভাবে নিজের দেশের স্বার্থ সবার আগে দেখব, এবং সম্পূর্ণভাবে আমি ক্যাপিটালিজম সাপোর্ট করব। এটাই আমার নীতি, আর তাই আমি নৈতিক দিক দিয়ে রক্ষণশীল বা প্রিন্সিপলড কনজারভেটিভ... যাই হোক, এই প্রিন্সিপলড কনজারভেটিভরা মনে করেন, সুষম বণ্টনের বিপরীতে অবস্থান নেবার জন্য যথার্থ দার্শনিক, মতাদর্শিক ও নৈতিক ভিত্তি তাদের রয়েছে, আর এটার জন্য তাদেরকে বর্ণবাদী বা রেসিস্ট হতে হয় না, বা তাদেরকে রেসিস্ট বলার কিছু নেই কারণ তাদের মতে এটা তারা তাদের আদর্শ থেকেই করছে, কৃষ্ণাঙ্গ বা অন্যান্য মাইনোরিটিদের দেখলেই তাদের মনে যে ঘৃণা উদ্রেক করে, তেমনটা নয়। নিজেদের মধ্যকার আদর্শ, মতাদর্শ এবং নৈতিক দার্শনিকতার ভিত্তিতেই এই ধারার তাত্ত্বিকরা সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু অংশের মধ্যে সম্পদ ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার সুষম বণ্টনের বিপক্ষে অবস্থান নেন।
২। অবস্থার মডেল বা Status Model: এই মডেলটির ধারণা তৈরি হয় ম্যাক্স ভেবার সহ আরও বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিকের সোশ্যাল স্ট্যাটাস থিওরির আলোকে। এখানে মনে করা হয়, সমাজে ধনী, দরিদ্র, সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, সাদা-কালো এই সব বিভাজনগুলো একটি অপরিবর্তনশীল কাঠামোর মত। সুতরাং সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই বিষয়গুলোকে বিভাজিত বৈপরিত্যের মধ্যে রাখলেই ভালো। কালো না থাকলে সাদা ফুটবে না, দরিদ্র না থাকলে ধনীর গরিমা প্রখর হবে না, সুতরাং এই বিষয়গুলো মেনে নিতেই হবে। যে মানুষটি দরিদ্র তার উচিৎ সমাজের স্বার্থে নিজের অবস্থা মেনে নেয়া, নাহলে সমাজ টিকবে না এবং সমাজ না টিকলে মানব প্রজাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এই মডেল অনুসারে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতি যা সমাজে বৈষম্য দূর করার জন্য প্রণীত হয়েছে, বা হবে তা আসলে সমাজকে নষ্ট করছে।
৩। আকাঙ্ক্ষার মডেল বা Expectation State Model: এই মডেলটি আসে সমাজতাত্ত্বিক জোসেফ বার্জারের এক্সপেক্টেশন স্টেট থিওরি থেকে, যেখানে এক্সপেক্টেশন বা প্রত্যাশাকেই সমাজের স্ট্যাটাস হায়ারার্কি বা মর্যাদার ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। এই মডেল অনুসারে, সমাজে মানুষ যে স্তরে, যেভাবে অবস্থান করছে তার ভিত্তিতে তাদের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হওয়া দরকার। সমাজে দরিদ্রদের আকাঙ্ক্ষা হওয়া দরকার তাদের ক্ষুন্নীবৃত্তি নির্ধারণ নিয়েই, আর ধনী বা অবস্থাপন্ন অংশের উচিৎ নিজেদের বিত্তের পরিমাণ বৃদ্ধি করে সমাজের উচ্চ অবস্থানটিকে টিকিয়ে রাখা। সংখ্যালঘুরা মূলত সমাজে বঞ্চিত এবং দরিদ্র বংশের প্রতিনিধিত্ব করে ("মডেল মাইনোরিটি" টার্মটার সাথে যারা পরিচিত তাদের কেউ কেউ এই কথার প্রতিবাদ করতে পারেন, তবে আপাতত এগুলোকে ব্যতিক্রব হিসেবে ধরা যাক)। এই সংখ্যালঘুদের জন্য ন্যূনতম চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এর সংস্থান অনেক বেশি কষ্টসাধ্য। এই অবস্থার দৈনন্দিন চাহিদা নিবারণ ঠিক মত করাই হওয়া উচিৎ এদের চাহিদার ও আকাঙ্ক্ষার পরিসীমা। এরা যদি এই পরিসীমার বেশি আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে ও অস্মাজের সংখ্যাগুরু অংশের মত জীবনযাপন করতে চায় তাহলে তা অবশ্যই সমাজের মধ্যে ভারসাম্য সমস্যা তৈরি করবে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর চাপ বাড়বে। ফলে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সবার জন্য সুষম সম্পদ বণ্টনের মত যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ পাওয়া যাবে না।
সংখ্যালঘু নিয়ে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন মডেল নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সাতটি মডেল নিয়ে লিখছি, গত পর্বে ৩টি মডেল নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, এই পর্বে বাকি চারটি মডেল নিয়ে লিখছি।
৪। বাস্তবতাভিত্তিক দ্বন্দ্বের মডেল বা Realistic Conflict Model: এই মডেলটি আসে সমাজতাত্ত্বিক ডোনাল্ড ক্যাম্পবেলের রিয়ালিস্টিক কনফ্লিক্ট থিওরি থেকে। এটা ইন্টারগ্রুপ কনফ্লিক্ট নিয়ে একটি সোশ্যাল সাইকোলজিকাল থিওরি, যা অনুসারে সমাজের সীমিত সম্পদ নিয়ে মানুষের প্রতিযোগিতা এবং দ্বান্দ্বিক লক্ষ্যের কারণে মানুষের মধ্যে একধরণের আন্তঃদলীয় শত্রুতা বা ইন্টারগ্রুপ হস্টাইলিটি তৈরি হয়। এই তত্ত্বটি একটি দলের মধ্যে থাকা অন্য দলগুলোর প্রতি কুসংস্কার ও বৈষম্যের একটি ব্যাখ্যাও প্রদান করে। এই দলগুলো অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামরিক সুরক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদার জন্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, আর এই দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো বাস্তবও হতে পারে, আবার কেবল পারসিভড বা অনুভূতও হতে পারে। এই তত্ত্ব নিয়ে আপাতত আলোচনা করছি না। এই আলোচনায় যেসব তত্ত্ব নিয়ে আসছি এগুলো সবই কেবল মাত্র ডেসক্রিপ্টিভ বা বর্ণনামূলক, এগুলো শুধু সমাজকে ব্যাখ্যাই করতে চায়, কিন্তু এগুলো থেকে কনজারভেটিভদের যে মডেলগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলো কিন্তু নরমেটিভ। এই মডেলগুলো কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা উচিৎ, কোনটা অনুচিৎ এসমস্ত বিষয়ও ঠিক করে দিতে চায়, এবং সমাজে এগুলোর প্রয়োগ ঘটাতে চায়। তাই পাঠকদেরকে আলাদাভাবে সাবধান করা হচ্ছে, তারা যাতে ডেসক্রিপটিভ থিওরি আর নরমেটিভ মডেলগুলোকে গুলিয়ে না ফেলেন। যাই হোক, এই মডেল অনুসারে, সমাজে সংখ্যালঘুরা বর্তমান প্রজন্মে বা এক বা একাধিক প্রজন্ম আগে অন্য কোন রাষ্ট্রের বা অন্যকোন সঙ্ঘের সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল, যার ফলে তারা আত্মিকভাবে সমাজের সংখ্যাগুরু অংশের রীতিনীতি, প্রতিষ্ঠান, আইন ইত্যাদির প্রতি আত্মিক টান অনুভব করেন না। ফলে তারা যখন নিজেরা সংখ্যাগুরু অংশের মত অধিকার দাবী করেন তখন তাদেরকে সেই অধিকার প্রদান করা উচিৎ নয়। তাদেরকে যদি একই প্রকার অধিকার দেয়া হয় তবে সেক্ষেত্রে তারা হয়তো সব প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে ব্যর্থ হবে এবং সহজে বিশ্বাস ভঙ্গ হবে। হয়ও সামান্য ব্যক্তিস্বার্থে এইসব প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত কঠোর নীতিগুলো তারা ভেঙ্গে ফেলবে, ফলে সমাজে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ব্যকজতির সংখ্যা বেড়ে যাবে, সমাজে শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। সমাজ একটি দ্বান্দ্বিক পরিসরে পরিণত হবে, সেখানে ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়বে। এই দ্বন্দ্বমুখর বাস্তবতা সমাজকে দূষিত করবে। তাই সংখ্যালঘুদের এই বাস্তবতা অনুধাবন করে বিদ্যমান অবস্থাকে মেনে সংখ্যাগুরুর মত অধিকার চাওয়ার আন্দোলন থেকে সরে আসতে হবে।
৫। বর্ণবাদী নির্যাতন মডেল বা Racial Oppression Model: এই মডেল অনুসারে বলা হয়, ইতিহাসের সুদীর্ঘ অংশ ধরে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ বিভেদ খুব প্রবল ছিল। শুধুমাত্র গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে সাদা, কালো, বাদামি মানুষের ভেদাভেদ হয়েছে আর সাদারা কালো ও অন্যদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে শোষণ করেছে। ফলে এদের মধ্যে এক ধরণের শেতাঙ্গ বিদ্বেষ এবং হীনমন্যতা ক্রিয়াশীল থাকা খুব স্বাভাবিক। যদি সমাজে সুষম বণ্টন হয় এবং সর্বত্র সব চাকরি এবং সমস্ত অর্থনৈতিক অ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের প্রবেশাধিকার আইনগতভাবে স্বীকৃত হয়, তাহলে শ্বেতাঙ্গ প্রতিষ্ঠানেও অশ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামি বর্ণের সংখ্যালঘু শ্রেণী প্রবেশ করতে থাকবে এবং বিভিন্নভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পদে এরা সংখ্যাগুরুদের অধিকর্তা বা বস হয়ে যাবে। এই অবস্থায় তারা মূলত শত বছর ধরে চলে আসা নিষ্পেষণ ও নির্যাতনের প্রতিশোধ তুলতে থাকবে। ফলে শ্বেতাঙ্গরা নিজদের দেশে নিজেদের তৈরি করা সব প্রতিষ্ঠানে নিগৃহীত এবং বঞ্চিত হতে থাকবে, যা কখনই কাম্য হতে পারে না। এজন্যই সংখ্যালঘুদেরকে সম অধিকার প্রাপ্তি ও সকল প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভূক্তি ও অনুপ্রবেশ ঠেকানো দরকার শ্বেতাঙ্গদের স্বার্থেই। (এই মডেলটি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক তাই শেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের কথা এসেছে, অন্যান্য সমাজেও এটা প্রযোজ্য, কেবল এদের পরিচয় পরিবর্তিত হয়ে যায়।)
৬। কর্তৃত্বের মডেল বা Neoclassical Hegemony Model: এটা এসেছে এন্টোনিও গ্রামসির কালচারাল হেজিমনি বা সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বের কনসেপ্ট থেকে। বর্তমানে সমস্ত পৃথিবীব্যাপী সবধরণের সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনার একটি সর্বস্বীকৃত ধারা হল লিবারাল বা উদারনৈতিক ধারা, যেখানে একই ছাতার নিচে সাদা-কালো, সমকামী-বিষমকামী, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সকলকে আনা এবং সবার সমান অধিকার ও সকল প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে সকলের অন্তর্ভূক্তির কথা বলা হয়। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে সম অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক আন্দোলনের কথাও বলা হয়। এই মডেল অনুসারে, এই সার্বিক উদারনৈতিক আলোচনার একটি প্রভাব দেখা যায় রাষ্ট্রীয় নীতি তৈরির পর্যায়ও। তাই দেখা যায়, রাষ্ট্র সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুকে একইভাবে দেখছে। এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি হেজিমনির মত মানুষের মনোজগৎ এবং ক্রিয়াজগৎকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে এবং তা মানুষের সমাজকে নিয়ন্ত্রণও করছে। তারই প্রতিফলন হচ্ছে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণী কর্মকাণ্ডে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুকে একইভাবে মূল্যায়ন করা। হেজিমনি কখনও ভালো জিনিস নয়, হেজিমনি হলো একটি প্রক্রিয়া যা মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং যার ফলে মানুষ ভালো-মন্দের বিভেদ গুলিয়ে ফেলে। এই মডেল অনুসারে, এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে, যারা এই হেজিমনির বিরোধিতা করছে তাদেরকে বর্ণবাদী আখ্যা দেয়া হচ্ছে, আর তাদের কথা কেউ শুনতে চাইছে না। রাষ্ট্র ও সমাজের বিশুদ্ধতা টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষকে অবশ্যই এই আচ্ছন্নতা বা হেজিমনি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, নাহলে সমাজ অরাজকতায় ভরে যাবে।
৭। সামাজিক আধিপত্যের মডেল বা Social Domination Model: এই মডেলটি এসেছে জিম সিডেনিয়াস ও ফেলিসিয়া প্রাটোর সোশ্যাল ডমিনেন্স থিওরি থেকে। এটি একটি ইন্টারগ্রুপ রিলেশন বা আন্তদলীয় সম্পর্ক নিয়ে সমাজমনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব যা গ্রুপ ভিত্তিক সোশ্যাল হায়ারার্কি এর স্থিতিশীলতায় ফোকাস করে। এই থিওরি অনুসারে গ্রুপ ভিত্তিক অসমতা বা বৈষম্যগুলো তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে রক্ষিত হয়। এরা হচ্ছে, স্পেসিফিকালি ইনস্টিটিউশনাল ডিসক্রিমিনেশন, এগ্রিগেটেড ইনডিভিজুয়াল ডিসক্রিমিনেশন ও বিহ্যাভিওরাল এসিমেট্রি। এই থিওরি বলে, আমাদের মধ্যে যে সার্বজনীন সাংস্কৃতিক আদর্শগুলো থাকে (যেমন বিভিন্ন "লেজিটিমাইজিং মিথ) সেগুলোই আন্তদলীয় আচরণগুলোকে নৈতিক ও বৌদ্ধিক জাস্টিফিকেশন দিয়ে থাকে। যাই হোক, এই তত্ত্ব নিয়ে অন্য কোন দিন আলোচনা করা যাবে। আপাতত মডেলটাতে যাই। এই মডেল অনুসারে, সমাজ সবসময় বিভিন্ন অধিকর্তার নিয়ন্ত্রণে চলে তাই আধিপত্যের বিষয়টি প্রাচীন এবং প্রায় অবিচ্ছিন্ন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজে টিকে আছে। বিভিন্ন কারণে মানুষ এই আধিপত্যের দাবী করে, যেমন পেশির জোড়, গলার জোড়, রাজনৈতিক জোড়, অর্থনৈতিক জোড়, সংখ্যায় বেশি হবার জোড় ইত্যাদি। এই আধিপত্যের অধীনে থাকে শাসিত অংশ। কেন আধিপত্য এবং আদৌ এই আধিপত্য সকলের দ্বারা স্বীকৃত কিনা এবং আদৌ এই আধিপত্য সঠিক কিনা এই প্রশ্ন এই মডেল অনুসারে অবান্তর এবং অযৌক্তিক। আধিপত্য না থাকলে সমাজ বিশৃঙ্খল এবং অরাজকদের স্বর্গ হয়ে উঠবে, তাই সংখ্যালঘু শ্রেণীকে সংখ্যাগুরুদের আধিপত্য মেনে নিতে হবে এবং আধিপত্যকারী সংখ্যাগুরু যদি প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোন ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদেরকে বঞ্চিত করে বা তার প্রবেশাধিকার ও অন্তর্ভূক্তিকে ব্যাহত করে, তাহলে তাদেরকে তা মানতে হবে। কারণ না মানলে অধিপতি, শ্রেণী তাকে আরও বেশি বঞ্চিত করতে পারে। অথবা বর্তমানে যে ন্যুনতম সংস্থানে সংখ্যালঘুরা বাঁচতে পারছে, সেটাও থাকবে না এবং তার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই নিজের জীবন রক্ষার্থেই সমাজের সংখ্যাগুরু অংশের আধিপত্যকে মেনে নিতে হবে এবং সমাজে ও রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরুদের সমান অধিকার চাওয়া থেকে পিছিয়ে আসতে হবে।
পূর্বের পর্বগুলোতে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে রক্ষণশীলদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে লিখেছি। এরপর অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলো নিয়ে লেখার কথা ছিল। কিন্তু লিখতে গিয়ে পরে মনে হল, আগে সংখ্যালঘু কারা, এদের প্রকৃতি কী সেব্যাপারেই আলোচনা করা দরকার। তাই এই উদ্দেশ্য নিয়েই আপাতত লেখা শুরু করছি।
সংখ্যালঘুদেরকে আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রেই দেখা যায়। সংখ্যালঘু দ্বারা সংখ্যায় ছোট বা অল্পকে বোঝায়। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে সংখ্যালঘু বা মাইনোরিটি বলতে বোঝানো হয়েছে, "Small group of people different from others in race, religion, language etc." অর্থাৎ এরা একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী যারা জাতি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদির থেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা। তবে মাইনোরিটি বা সংখ্যালঘু টার্মটিকে আরও একটু বিশেষভাবে ফোকাস করা করা হয়। "The Problem of Minority Groups" নামক নিবন্ধে লুইস ওয়ার্থ ১৯৪৫ সালে প্রথম মাইনোরিটি গ্রুপ শব্দটা ব্যবহার করেন। তিনি সেখানে যা লিখেছিলেন, তাকে বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা অনেকটা এরকম, "সংখ্যালঘু বলতে এমন একদল মানুষকে বোঝায়, যার সদস্যদেরকে তাদের দৈহিক বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হয় এবং যারা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এবং যারা যৌথভাবে নিজেদেরকে বিভেদমূলক আচরণের বস্তু বলে মনে করে। কোন সমাজে সংখ্যালঘু অস্তিত্ব অর্থ ঐ সমাজে প্রভাবশালী গোষ্ঠীও রয়েছে যারা উচ্চসামাজিক মর্যাদা ও অধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণ থেকে এরা বঞ্চিত থাকে।"
ওয়েবস্টারের সেভেন্থ নিউ কলেজিয়েট ডিকশনারিতে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুরা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি অংশ, যারা প্রায়শ ভিন্ন আচরণ করে। ফিলিপ কোটাক তার এনথ্রোপলজি গ্রন্থে বলেছেন, সংখ্যালঘু হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রমমানের একটি অধীনস্ত গোষ্ঠী যাদের ক্ষমতা ও সম্পদের অধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর চেয়ে কম থাকে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে, এরা সাংস্কৃতিক, জাতিগত ও বর্ণগতভাবে আলাদা গোষ্ঠী যারা এদের চেয়ে অধিক কোন কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠীর সাথে সহাবস্থানে থাকে। যাই হোক, পরের দিকের সংজ্ঞাগুলোতে আমরা দেখি সংখ্যালঘুর সংজ্ঞায় তাদের সংখ্যায় কম হওয়াটাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছ এনা, বরং এদের ভিন্ন সংস্কৃতি, বৈষম্য, বিভেদমূলক আচরণ- এগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।
যাইহোক, পরবর্তীকালের সমাজবিজ্ঞানীরা এই "সংখ্যালঘু" প্রত্যয়টিকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করেন। তারা সংখ্যালঘুদেরকে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের আলোকে ব্যাখ্যা করেন যেগুলো পূর্বে আলোচিত হয় নি। সমাজবিজ্ঞানী রবার্টসন ১৯৮০ সালে লেখা তার "Sociology" গ্রন্থে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কিছু বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেন। সেগুলোকে সংক্ষেপে নিচে উল্লেখ করছি:
১। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যরা অন্যান্য গোষ্ঠীর দ্বারা নানাভাবে শোষিত ও লাঞ্ছিত হয়। ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদাবোধের দিক থেকে সংখ্যালঘুরা সমাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সংখ্যালঘুরদের দুর্বলতা ও অসুবিধাজনক অবস্থাগুলোই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সুবিধাজনক সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সমাজে নিম্ন মর্যাদা প্রদান করার মাধ্যমে প্রভাবশালীরা সংখ্যালঘুদের শোষণ করে, শোষণ করে সংখ্যালঘুদের শ্রম ও সম্পদকে। সংখ্যালঘুদের সদস্যরা যে কেবল প্রভাবশালীদের দ্বারাই বঞ্চিত হয় তাই নয়- সংখ্যালঘুরা প্রায়ই প্রভাবশালীদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ও বিভেদমূলক আচরণের শিকার হয়। তাদেরকে অপব্যবহার করা হয়, গালিগালাজ করা হয় এবং নানাভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে লজ্জা দেয়া হয়।
২। সামাজিকভাবে সহজেই দৃশ্যমান এবং গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংখ্যালঘুদেরকে চিহ্নিত করা যায়। গায়ের রঙ, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি বিচারে সংখ্যালঘুদের এমন একটি সমন্বিত সামাজিক একক মনে করা হয় যা সামাজিক দিক দিয়ে একটা তাৎপর্য বহন করে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি যে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পায় তা গোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্যের জন্যই প্রযোজ্য মনে করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি হিসেবে কেউ যতই ভালো হোক না কেন তাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব কমই দেয়া হয়।
৩। সংখ্যালঘু গোষ্ঠী খুবই আত্ম-সচেতন এবং গোষ্ঠীর সবার মধ্যে একটি শক্তিশালী ঐক্যের ধারণা বিদ্যমান থাকে। ইহুদি, আমেরিকান নিগ্রো বা অন্য যেকোন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের ধারণা প্রবল এবং তারা একে অপরের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্কে আবদ্ধ। সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর সদস্য সাধারণ পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়, গোষ্ঠী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে যদিও পার্থক্য থাকে, সেটা তারা ভুলে স্বার্থ বড় করে দেখে। সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণভাবে যে দুঃখ-কষ্ট, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হন, সেটার কারণে নিজেদের পার্থক্য ভুলে গোষ্ঠীর চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়। তারা যতই প্রভাবশালীগোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকে, ততই তাদের মধ্যকার সংহতিবোধ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।
৪। সাধারণত কোন মানুষ স্বেচ্ছায় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্য হয় না, সংখ্যালঘুগোষ্ঠীতে জন্মলাভ করে তারা সদস্য হয়ে থাকে। সদস্যরা জন্মগত সূত্রে বা ঐতিহ্যগতভাবে একই বা সাধারণ পরিচয় বহন করে। সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর কোন সদস্যের পক্ষে নিজের গোষ্ঠী ত্যাগ করা খুব কঠিন কাজ। কারণ, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে কোন সংখ্যালঘু জন্মগতভাবে তার সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর স্থায়ী সদস্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে কারও বাবা মার একজন কৃষ্ণাঙ্গ, আরেকজন শ্বেতাঙ্গ হলেও সেই ব্যক্তিকে কৃষ্ণাঙ্গই ধরা হয়, এবং তাকে সংখ্যালঘু বলেই বিবেচনা করা হয়।
৫। ইচ্ছা করেই হোক বা প্রয়োজনের তাগিদেই হোক, সংখ্যালঘুগোষ্ঠী সাধারণত এন্ডোগ্যামি বা অন্তঃগোষ্ঠী বিবাহরীতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ, সংখ্যালঘুরা নিজ গোষ্ঠীর মধ্যেই পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করে। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কোন সদস্য সাধারণত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে বিয়ে করতে চাইবে না বা বিয়েতে অনীহা দেখাবে কেননা, তার দৃষ্টিতে সংখ্যালঘুরা সামাজিকভাবে নিচু মর্যাদার অধিকারী, এবং তারা নানানভাবে অবহেলিত, নির্যাতিত এবং বঞ্চিত। অন্যদিকে সংখ্যালঘুরা নানান দিক বিবেচনায় নিজ গোষ্ঠীতেই পাত্রপাত্রী অনুসন্ধান করেন। এক্ষেত্রে তাদের কনশাসনেস অফ কাইন্ড বা গোষ্ঠীচেতনাই বেশি কাজ করে। এর ফলে যা দাঁড়ায় তা হল সংখ্যালঘু সমাজে বংশ পরম্পরায় সংখ্যালঘু মর্যাদা বা মাইনোরিটি স্ট্যাটাস বর্তাতেই থাকে।
সুতরাং সমাজতাত্ত্বিকদের চিন্তায় সংখ্যালঘুদের বৈশিষ্ট্য এই পাঁচরকমই: অসম আচরণ, শারীরিক বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, আরোপিত মর্যাদা, গোষ্ঠী সংহতি ও আন্তঃগোষ্ঠী বিবাহ। সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষনে এও বলা হয় যে সংখ্যালঘুগোষ্ঠী কখনও কখনও সমাজে জনসংখ্যার হিসেবে সংখ্যাগুরু বা নিউমারিকাল মেজরিটি হতে পারে। অর্থাৎ সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর মর্যাদা ও সমাজে তাদের অবস্থান তাদের সদস্য সংখ্যার মাপকাঠিতে বিবেচ্য হচ্ছে না, বরং উপরে যে কয়টি পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে সেগুলো দ্বারাই বিবেচ্য হচ্ছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, সমাজে জনসংখ্যা হিসেবে সংখ্যাগুরুরা খুব কমই সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করে। তবে এরকম বিরল ঘটনার উদাহরণ যে নেই তা নয়। যেমন, আফ্রিকার একটি দেশ বুরুন্ডিতে তুৎসি উপজাতির মানুষের সংখ্যা কম হলেও তারা হুতু নামের উপজাতির উপর প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়েছে। কিছু সমাজবিজ্ঞানীদের মতে আমেরিকান সমাজে নারীরা সংখ্যার দিক থেকে পুরুষের তুলনায় সামান্য বেশি হওয়া সত্ত্বেও তারা সংখ্যালঘুর পর্যায়ে পড়ে। অর্থাৎ বলা যায়, যদিও সংখ্যালঘুরা প্রায় সমাজেই জনসংখ্যা হিসেবেও সংখ্যালঘু, তবুও জনসংখ্যা হিসেবে বৃহৎ আকারের কোন মানবগোষ্ঠীও সংখ্যালঘু হতে পারে যদি তারা তাদের সমাজে অন্যান্য গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত, নিয়ন্ত্রিত, শাসিত, শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত এবং ঘৃণিত হতে থাকে। তাই কোন সংখ্যালঘুগোষ্ঠী বেশি বা কম যাই হোক না কেন, তারা মূলত অধীন ও উপেক্ষিত।
যাই হোক, উপরের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য ছাড়াও সংখ্যালঘুদের আরও বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন, সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু উভয় গোষ্ঠী একে অপরের থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে। এতে এরা একে অপরের প্রতি অনেক সময় ভিত্তিহীন বদ্ধমূল এবং বিরোধপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে; সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংখ্যাগুরুদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়; অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী প্রভাবশালী সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর ন্যায় সমান সুযোগ পেয়েও তারা নিজেদেরকে নিকৃষ্ট মনে করে; সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর অনেকেই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর তুলনায় নিজেদেরকে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিজেদেরকে উৎকৃষ্ট মনে করতে পারে, আবার এর বিপরীত অবস্থাও দেখা যেতে পারে; সংখ্যাগুরুদের অনেকেই সংখ্যালঘুদের গোষ্ঠীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে পারে... ইত্যাদি।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্ভব কিভাবে হয় তা গবেষণার বিষয়। তবে বর্তমান বিশ্বে সংখ্যালঘুর উদ্ভবের কারণ খুঁজতে গেলে বেশ কিছু জিনিস পাওয়া যাবে, যেমন:
১। যুদ্ধে পরাজিত বা যুদ্ধবন্দীরা সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিতি পায়।
২। উন্নত জীবিকার উদ্দেশ্যে কিংবা অভিবাসিত হয়ে কোন উন্নত রাষ্ট্রে গমন করলে তারা সংখ্যালঘু বলে বিবেচিত হয়।
৩। নব্য প্রতিষ্ঠিত কোন জাতির সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের কোন বিশেষ জনগোষ্ঠী দুই দেশের রাজনৈতিক ভূখণ্ডের আওতায় পড়ে উভয় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
৪। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে পড়লে স্থানীয় অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও মানুষ সংখ্যালঘু হতে পারে।
৫। কোন ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠীর কনভার্শন বা ধর্মান্তরন হলে সেটাও সংখ্যালঘুর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।
৬। মানুষ পেশা, ধর্ম, জাতি বা বর্ণভিত্তিক সংখ্যালঘু হতে পারে।
৭। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে হঠাৎ একটি গোষ্ঠীর উত্থান হলে তা প্রথমত সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে সংখ্যালঘুরা কখনও কখনও তাদের কর্মকাণ্ডে জনপ্রিয়তা অর্জন বা অন্যান্য কারণে সংখ্যা ও শক্তিতে পরিণত হলে তারাও পরবর্তীতে সংখ্যাগুরুতে পরিণত হয়। অন্যদিকে পূর্বের সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। এর উদাহরণ হিসেবে ইসলামের আবির্ভাবের সময়কার মুসলমানদের কথা বলা যেতে পারে... ইত্যাদি...
সংখ্যালঘুদেরকে কয়েকটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরণের সংখ্যালঘু নিয়ে কিছু বলা যাক:
জেন্ডার ও সেক্সভিত্তিক সংখ্যালঘু: বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান হলেও নারীরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে অধঃস্তন মর্যাদা লাভ করে, যাকে নারীবাদীগণ সংখ্যালঘুর মর্যাদা বলে আখ্যায়িত করেন। এছাড়া পাশ্চাত্য সমাজে উনিশ শতক থেকে এলজিবিটি-গোষ্ঠী (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার) সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। এই সম্প্রদায়গুলো লৈঙ্গিক বহুমাত্রিকতার প্রতীক।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু: কোন সমাজের বেশিরভাগ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে ভিন্ন কোন ধর্মমতে বিশ্বাসীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু। পৃথিবীর সকল দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু আছে। আধুনিক বিশ্বে এটা মনে করা হয় যে, প্রত্যেক ব্যক্তিরই ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। এমনকি কোন ধর্মে বিশ্বাস না করার অধিকারও আছে।
বয়সভেদে সংখ্যালঘু: বয়োঃবৃদ্ধগণ অর্থনৈতিকভাবে অনুৎপাদনশীল বলে বর্তমানে ক্ষমতার অভাবে সংখ্যালঘু, যদিও পূর্বের সমাজে তারাই নেতৃত্ব দিত। শিশুরাও সমাজে প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা নির্যাতিত হয় বলে তারাও সংখ্যালঘু। বয়সভেদে এই বৈষম্যকে এজিজম বলে।
প্রতিবন্ধী সংখ্যালঘু: প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলন বা ডিজ্যাবিলিটি রাইটস মুভমেন্ট অক্ষম জনসমাজকে ক্ষমতার দৃষ্টিকোন থেকে সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করে। তাদের মতে মূলত সুযোগের অভাবে তারা বঞ্চিত অবস্থায় আছে।
রাজনৈতিক সংখ্যালঘু: রাজনৈতিক সংখ্যালঘু বলতে কোন সমাজের বিদ্যমান রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের আলোকে তুলনামূলকভাবে কম জনসমর্থন প্রাপ্ত রাজনৈতিক দলকে বোঝায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টি।
এথনিক গ্রুপ: এথনিক গ্রুপ বলতে এমন একটি সামাজিক গোষ্ঠী বোঝায় যাদের নিজস্ব একটি ভাষা ও সংস্কৃতি আছে যা অন্যদের থেকে ভিন্নতর। সাধারণত বৃহত্তর সামাজিক কিংবা জাতীয় ব্যবস্থার আওতায় ভিন্ন কোন ভিন্ন কোন নৃগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত এথনিক গ্রুপ ঐ এলাকায় সংখ্যালঘু।
রেস: রেস বলতে মানব জাতির একেকটি উপবিভাগ বোঝায় যা অন্য উপবিভাগগুলো থেকে ভিন্ন। এদের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো জৈবিক আর জৈবিক সূত্রেই পরবর্তী প্রজন্মে বৈশিষ্ট্যগুলো বাহিত হয়। মূলত চার ধরণের রেস আছে: ককেশয়েড বা শ্বেতাঙ্গ, মঙ্গোলয়েড, নিগ্রয়েড বা কৃষ্ণাঙ্গ এবং অস্ট্রালয়েড। একটি এলাকায় এরকম কোন রেস সংখ্যালঘু হতে পারে, যেখানে অন্য আরেকটি রেস সংখ্যাগুরু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন কৃষ্ণাঙ্গরা সংখ্যালঘু।
সংখ্যালঘু বিভিন্ন মতভেদ আলোচনা করতে গিয়ে মনে করি যে সংখ্যালঘু বলতে কাদেরকে বোঝায়, সংখ্যালঘুর প্রকৃতি কী এসব নিয়ে আলোচনা করা দরকার। এই উদ্দেশ্য গত পর্বে সংখ্যালঘু কারা, তাদের প্রকৃতি এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ সেখান থেকেই কন্টিনিউ করছি...
গত পর্বে সংখ্যালঘুদের নিয়ে শ্রেণীবিভাগ করার চেষ্টা করেছিলাম, সেখানে সেক্স এন্ড জেন্ডার ভিত্তিক সংখ্যালঘু, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সহ বিভিন্ন ধরণের সংখ্যালঘু সম্পর্কে বলেছিলাম। আজকে সংখ্যালঘুদের নিয়ে আরেকটি শ্রেণীবিভাগে যাব। এই বিশেষ শ্রেণীবিভাগে সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ধরণ নিয়ে আলোচনা করা হবে...
১। এসিমিলেশনিস্ট মাইনোরিটি বা আত্তীকরণ সংখ্যালঘু: আত্তীকরণ দ্বারা বোঝানো হয় যখন কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৃহত্তর সমাজে অভিবাসন গড়ে তোলে তখন তারা মূল সাংস্কৃতিক ধারাকে নিজেদের মধ্যে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করে। এ ধরণের আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার কল্যাজে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যগণ স্থানীয় সংস্কৃতির কৃষ্টি ও ঐতিহ্যগুলোকে মেনে নেয়। তাদের প্রচেষ্টার ফলে তারা একসময় এমনভাবে আধিপত্যপূর্ণ সংস্কৃতিতে মিশে যায় যে, তাদেরকে আর ভিন্ন কোন সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংখ্যালঘুগোষ্ঠী ধীরে ধীরে (বা দ্রুত) প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এমনভাবে মিশে যায় যে প্রভাবশালীরা সংখ্যালঘুদেরকে চেতনে বা অবচেতনে নিজেদের করে নেয়। এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে বজায় থাকে না- এই প্রক্রিয়ায় সংখ্যালঘুগোষ্ঠী সচেতনভাবে তাদের আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায় না। একেই আত্তীকরণ বলে। এই আত্তীকরণের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদেরকে পূর্ণ ও সমান মর্যাদায় দেখতে পারে। এটা আত্তীকরণের একটি ইতিবাচক দিক।
আত্তীকরণ প্রক্রিয়া দুভাবে কাজ করতে পারে - কালচারাল এসিমিলেশন (সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ) এবং রেশিয়াল এসিমিলেশন (নৃগোষ্ঠী আত্তীকরণ)। এই দুটি একইসাথে বা আলাদাভাবে সংঘটিত হতে পারে। কালচারাল এসিমিলেশন ঘটে যখন সংখ্যালঘুগোষ্ঠী নিজেদের প্রধান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধগুলো পরিত্যাগ করে প্রভাবশালীদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে। অন্যদিকে রেশিয়াল এসিমিলেশন ঘটে যখন সংখ্যালঘু ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মধ্যকার দৈহিক পার্থক্যগুলো প্রজনন (inbreeding) প্রক্রিয়ায় (যেমন বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে) বিলুপ্ত হয়ে যায়। রেশিয়াল এসিমিলেশনকে কোন কোন সমাজতাত্ত্বিক এমালগামেশন বা মিশ্রণ বলেও অভিহিত করেন। কালচারাল এসিমিলেশনের চেয়ে এটা তুলনামূলকভাবে কঠিক প্রক্রিয়া, যেমন বলা যায়, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের দৃষ্ঠান্ত থাকলেও তা ব্যাপকভাবে সমাজে অনুমোদিত নয়। আর তাই এদের মধ্যে দৈহিক পার্থক্য এখনও সুস্পষ্ট। তবে হাওয়াই বা পলিনেশিয়াতে তিনটি প্রধান রেসের মধ্যে ব্যাপকভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এবং এর ফলে সেখানে দৈহিক পার্থক্য কিছুটা কমে এসেছে। এসিমিলেশনের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ব্রাজিলের সমাজ। বিক্ষিপ্তভাবে বসবাসকারী কিছু ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী বাদে অন্যান্য সব রেস ও এথনিক গোষ্ঠী সেখানে আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় একাত্ম হয়ে গেছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্তুগাল তাদের অধীনস্ত আফ্রিকান কলোনিগুলোতে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। এমনকি পর্তুগীজরা আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় আফ্রিকানদেরকে নিজেদের অরে নিতে একটি বিশেষ উদ্যোগও নেয়। যেসব আফ্রিকান পর্তুগীজদের সংস্কৃতি গ্রহণ করবে তাদের জন্য "এসিমিলাডো" নামে একটি বিশেষ মর্যাদা ঘোষিত হয় এবং পর্তুগীজরা এদেরকে সমমর্যাদায় গ্রহণ করতে রাজি হয়। ব্রাজিলের ২০১০ সালের ডেমোগ্রাফি দেখলে পাওয়া যায়, সেখানে ব্রাঙ্কোস বা শ্বেতাঙ্গের পরিমাণ ৪৭.৭৩ শতাংশ, অন্যদিকে পারডোস বা মাল্টিরেশিয়াল বা মিশ্রিতদের পরিমাণ ৪৩.১৩ শতাংশ। সেখানে প্রেটোস বা কৃষ্ণাঙ্গদের পরিমাণ ৭.৬১ শতাংশ এবং বাকিরা এশিয়ান এবং ইন্ডিজেনাস।
আত্তীকরণের আরও দুটো দিক রয়েছে। এর প্রথমটিতে দেখা যায়, ভিন্ন সমাজ থেকে আগত ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো পরিহার করে প্রভাবশালীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে লীন হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গোষ্ঠী হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ এংলো স্যাক্সন প্রোটেস্ত্যান্ট (White Anglo-Saxan Protestant)। ইংলিশ জার্মান, স্কানডিনেভিয়ান এবং নর্থ ইউরোপিয়ান অঞ্চল থেকে আগত কিছু জনগোষ্ঠী এধরণের আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় চমৎকারভাবে প্রভাবশালীদের সাথে মিশে গেছে এবং প্রভাবশালীদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় ধরণের আত্তীকরণের ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের সংস্কৃতি বহিরাগত উপসংস্কৃতি বা সাবকালচার এমনভাবে ইনটারেক্ট করে যে তার ফলে একরকম নতুন বৈশিষ্ট্যের নতুন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সাধারণত যেকোন নগর জীবনে এটা ঘটে। এজন্য নগর বা সিটিকে আত্তীকরণের ধারক-পাত্র বলা হয়। আবার এও ঠিক যে, অনেক এথনিক গোষ্ঠী প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসেও নিজেদের সংস্কৃতির ধারা বজায় রেখেছে, অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত বা কল্পিত আত্তীকরণ সেখানে যথাযথ হয়নি।
আত্তীকরণ তখনই সম্ভব হয় যখন কয়েকটি শর্ত পূরণ হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সংস্কৃতি এবং দৈহিক বৈশিষ্ঠ্য যদি অনেক প্রভাবশালীর মতই হয় তবে সহজেই দ্রুততার সঙ্গে আত্তীকরণ প্রক্রিয়া ঘটে। যেমন শ্বেতাঙ্গ ইংরেজি ভাষার প্রোট্যাস্ট্যান্ট (ইংলিশ, স্কট, ক্যানাডিয়ান) আমেরিকান সহজেই এসিমিলেটেড হয়ে যায়। অন্যদিকে অখ্রিস্টান কালো বা বাদামী ত্বকের মানুষেরা, যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয় তারা আমেরিকান সমাজে সহজে এসিমিলেটেড হতে পারে না, এদেরকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। সহজে আত্তীকরণ সম্ভাবনা তখনই বেড়ে যেতে পারে তখন যখন বিভিন্ন এথনিক গোষ্ঠীর উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ঘটে। এধরণের ক্ষেত্রে আত্তীকরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কম দেখা যায়।
যদিও সংখ্যালঘুদের জন্য আত্তীকরণ হচ্ছে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণভাবে খাপ খাইয়ে চলার এবং ক্রমে প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে লীন হবার উৎকৃষ্টকর পন্থা, তবুও আত্তীকরণ সবসময়ই সবার জন্য লাভজনক হয় না। কেননা অনেক সমাজে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী থাকলে সমাজ দ্রুত অগ্রসর হতে পারে, কখনও বা সমাজের সংখ্যালঘুদের উপসংস্কৃতি একরকম প্রাকৃতিক সম্পদের মত কাজ করে, যেখান থেকে অনেক বিকল্প চিন্তা, ধ্যান ধারণা ও আচার আচরণের থেকে প্রভাবশালীরা নতুন ধারণা ও অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারে, অনেক সময় সংখ্যালঘুদের আচরণের প্রভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অনেকের কুসংস্কার, গোড়ামি, স্টেরিওটাইপ, বায়াজ দূর হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষ নিজেরাও পুরোপুরি আত্তীকরণ চায় না। তারা আত্তীকরণ রুখে দাঁড়ায়, স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজেদের জীবনযাত্রা, তথা সংস্কৃতিকে অনেক মূল্যবান মনে করে। আর তাই তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে পরিহার করে বা বিপন্ন করে প্রভাবশালী সমাজে মিশে যেতে অনীহা দেখায়।
সমাজে বসবাসকারী প্রভাবশালী ও বিভিন্ন এথনিক গোষ্ঠীর মধ্যে আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার সহায়ক ও সহায়ক নয় এমন অনেক উপাদান কাজ করে। সমাজবিজ্ঞানী গিলিন আত্তীকরণের জন্য সহায়ক কয়েকটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, অর্থনৈতিক সুযোগে সম-অধিকার, বাইরে থেকে আগত সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দান এবং তাদের প্রতি সমবেদনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রভাবশালীদের সামনে সংখ্যালঘু সংস্কৃতির ব্যাপক পরিচিতি প্রদান, সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য বা নৈকট্য এবং আন্তগোষ্ঠীর (প্রভাবশালী-সংখ্যালঘু) মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। আবার আত্তীকরণের পথে সহায়ক না এরকম উপাদানের কথাও গিলিন বলেছেন। এগুলো হল - বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন (বা যোগাযোগ কম রাখা), নিজেদেরকে উৎকৃষ্ট মনে করা বা উৎকৃষ্ট মনোভাব পোষণ করা, গোষ্ঠীসমূহের গায়ের রং এর পার্থক্য বেশি হওয়া, এবং নির্যাতন।
আত্তীকরণেরও যে দুটি বিশেষ ধরণ দেখা যায়, সেগুলো নিয়ে সামান্য আলোচনা করেই এই পর্ব শেষ করছি...
(ক) ইন্টিগ্রেশন (Integration): এর দ্বারা প্রভাবশালী সমাজের সংস্কৃতি ও সমাজ কাঠামোকে অন্যদের সাথে মিশ্রিত করাকে বোঝায়। ইন্টেগ্রেশন বোঝানোর আরেকটি সহজ প্রত্যয় হচ্ছে মেল্টিং পট (melting pot)। এখানে দেখা যায় এথনিক গ্রুপগুলো নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রথাগুলো বর্জন করে অভিন্ন জাতীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়। অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্রাজিলে আমরা আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার সফলতা অধিক মাত্রায় দেখতে পাই। স্বাভাবিকভাবেই যদি প্রভাবশালী দল সমাজের বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে সংখ্যালঘুদেরকে অবশ্যই তাদের সংস্কৃতির গুণগুলোকে গ্রহণ করতে হবে। এর কিছু প্রভাব আছে, আর এটি ইতিবাচকও হতে পারে। এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পালন করে সংখ্যাগরিষ্ঠরা। এরা যদি সংস্কৃতির বিষয়গুলকে সংখ্যালঘুদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয় তাহলে তার মাধ্যমেই ইন্টিগ্রেশন সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী ও সংখ্যালঘু উভয়েরই থাকতে হবে। এটি একই সাথে সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত সমন্বয়। এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে বিভিন্ন এলাকার লোক বাস করে। এখানে যে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি সংখ্যালঘুরা গ্রহণ করে তা নয়, বরং এর বিপরীতও হতে পারে।
(খ) এমালগামেশন (Amalgamation): এর মাধ্যমে বোঝায় স্থানীয় জনগণের সাথে এথনিক দলের জৈবিক মিশ্রণ। এক্ষেত্রে দুটি দলের মাঝে রক্তের মিশ্রণ ঘটে। কিন্তু এটা খুব কমই ঘটে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাদা ও কালোদের মধ্যকার সম্পর্ক এর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বিয়ে ও সন্তান উৎপাদন সেভাবে সমাজ স্বীকৃত নয় (যদিও আইনগতভাবে নিষিদ্ধ নয়)। এদের মধ্যে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা রয়েছে। সত্যিকারের সংমিশ্রণ দেখা যায় হাওয়াই এবং পলিনেশিয়ানদের মধ্যে যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ও মঙ্গোলীয়দের (মঙ্গোলয়েড) মধ্যে বিয়ে হয়। শ্বেতাঙ্গরা যেহেতু প্রভাবশালী তাই তাদের সংস্কৃতিকেই যুক্তরাষ্ট্রে সবাইকে গ্রহণ করতে দেখা যায়। এথনিক সম্প্রদায়ের আন্তঃসম্পর্কীয় সমস্যা সমাধানে মিশ্রণ কোন কার্যকরী সমাধান নয়। মধ্যপ্রাচ্যের আরবীয়দের এবং ইহুদিদের সমস্যা এভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়, কারণ এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য এক, এদের পার্থক্য সামাজিক দিক দিয়ে, জৈবিক দিক দিয়ে নয়।
(সংখ্যালঘু সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা দিয়ে এই সিরিজ শুরু করেছিলাম। এক্ষেত্রে রক্ষণশীলদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলা হয়েছে প্রথম তিন পর্বে। সেদিক থেকে আত্তীকরণ নিয়েও বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে যা সংখ্যালঘু সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আত্তীকরণের প্রশ্নে সেই আলোচনাও প্রাসঙ্গিক হবে, তবে আপাতত সেই আলোচনায় যাচ্ছি না।)
২। প্লুরালিস্টিক মাইনোরিটি বা বহুত্ববাদী সংখ্যালঘু:
যখন কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৃহত্তর সমাজে অভিবাসন গড়ে তোলে তখন যদি তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক ধারাকে রক্ষা করে নতুন সাংস্কৃতিক পরিবেশে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করে তখন তাকে বহুত্ববাদী বা প্লুরালিস্টিক বলা হয়। যখন কোন বৃহত্তর সমাজের মধ্যে বসবাসরত ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বা দল নিজেদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করার পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজের আইন ও মূল্যবোধকে গ্রহণ করার প্রয়াস করে থাকে তখন তাকে বহুত্ববাদী বা প্লুরালিস্টিক বলে। বহুত্ববাদী (pluralistic) ধারণাটি বহুসংস্কৃতিকতাবাদ বা মাল্টিকালচারালিজম থেকে ভিন্ন। কারণ বহুসংস্কৃতিকতাবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠের সাংস্কৃতিক ধারণাটি অনুপস্থিত থাকে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়লে বহুত্ববাদ খুব সহজেই বহুসংস্কৃতিকতাবাদে রূপান্তরিত হতে পারে। সম্প্রদায় যদি পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে পরিচালিত হয় বা পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে তাহলে সেই সমাজকে বহুত্ববাদী বলা যায় না।
কোন ব্যক্তি বা দল বিভিন্ন মাত্রায় বহুত্ববাদের চর্চা করতে পারে। আধুনিক যুগের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বহুত্ববাদ চর্চার একটি বিশাল ক্ষেত্র যেখানে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব ধর্ম, এথনিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস পালন করতে পারে। বহুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো কেবল পাশাপাশিই বসবাস করে না, এক্ষেত্রে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক গুণাবলির চর্চাও করে। এমন অনেক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রয়েছে যারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বেশ গর্ব অনুভব করে, নিজের গোষ্ঠীর প্রতি অনুগত থাকে এবং তারা গোষ্ঠীর মধ্যে দৃঢ় সংহতি বজায় রাখে। এরা নিজেদের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগুলোর বিলুপ্তি কামনা করে না, বরং নিজেদের আপন বৈশিষ্ট্যে ও পরিচয়ে বিকশিত হতে চায়। এমন অবস্থায় প্রভাবশালী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনুমোদন, সমর্থন ও সহযোগিতা দান করতে পারে, এমনকি বৃহৎ জাতীয় পরিমণ্ডলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্ব স্ব জীবনধারা বজায় রাখার অনুকূলে উৎসাহ প্রদানমূলক কর্মসূচীও নিতে পারে। এক্ষেত্রে বলা যায়, তানজানিয়া একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে আফ্রিকান, এশিয়ান, ইউরোপিয়ান ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখে সৌহার্দপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
কখনও কখনও বহুত্ববাদকে আংশিক আত্তীকরণ হিসেবেও বর্ণনা করা হয় যেখানে প্রভাবশালী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদেরকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরোপুরি অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়, এবং একই সাথে বিশেষ মাত্রার সামাজিক সাংস্কৃতিক পার্থক্যও বজায় রাখে। আমেরিকান সমাজে দেখা যায় যে, সেখানে যদিও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে প্রাধান্য দেয়া হয়, তবুও সেটা পুরোপুরি সফলতায় পর্যবসিত হয় নি। কেননা, সেখানে সংখ্যালঘু অনেকেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতে পারছে না। তবে সেখানে বহিরাগত বিভিন্ন গোষ্ঠীকে তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে মোটামুটিভাবে সামাজিক অনুমোদন রয়েছে।
সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ বজায় রাখা সহজ নয়, কোন সমাজে তা বজায় রাখতে হলে একটি বিশেষ মাত্রার সাংস্কৃতিক ঐক্য চাই। যেমন একটা দেশে সীমিত অর্থে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করতে পারে, তবে তাদের সবার মধ্যে কিছু অভিন্ন মৌলিক মূল্যবোধ ও সামাজিক প্রতিশ্রুতি থাকবে। আমেরিকানর মত সমাজে যদি বিভিন্ন আষাভাষী গোষ্ঠীগুলো ইংরেজি বাদ দিয়ে নিজেদের ভাষা সবজায়গায় ব্যবহার করতে চায় তাহলে আমেরিকান সমাজ যোগাযোগের সমস্যার কারণে নিশ্চল হয়ে পড়বে। আবার প্রতিটি গোষ্ঠী যদি ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধ দ্বারা চালিত হয় তবে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাবে (ধরুন কোন গোষ্ঠী নারীদেরকে যেভাবে দেখে, বা যেভাবে ট্রিট করতে চায়, রাষ্ট্র সেভাবে করতে চায় না, বা অনেক ক্ষেত্রে করতে দিতে পারে না।)
0 মন্তব্যসমূহ