হুমায়ুন আজাদ: বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়। এই উপাধিটি আমরাই প্রথম দিয়েছিলাম। আমি এবং কাজল রশীদ শাহীন ২০০১ সালের শেষ দিকে একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার করেছিলাম তাঁর। সে বছর ২৫ নভেম্বর দৈনিক আজকের কাগজের ‘তারকা কাগজ‘ এ হুমায়ুন আজাদ এর পুরো প্রচ্ছদবিস্তারি ছবি দিয়ে বেশ গুরুত্বের সাথেই ছাপা হয়েছিলো সেটি। তবে ছাপা হওয়ার আগে শিরোনাম নিয়ে কথা বলি হুমায়ুন আজাদ এর সাথে। তিনি ‘হুমায়ুন আজাদ: বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়‘ এই শিরোনামটি পছন্দ করে বলেন,‘ হুম দিতে পারো উপাধিটি আমার জন্য যথার্থ‘। আমাদের নেয়া স্বাক্ষাতকারটি তিনি ‘ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য‘ গ্রন্থে নির্বাচিত সাক্ষাতকার হিসেব অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
ধীমান এবং জ্ঞানের ধ্যানে থাকা ঋষিতুল্য এই ব্যক্তিত্বের প্রতি আমার আগ্রহ সব সময় কিছুমাত্রাই বেশিই ছিলো। এক সময় তাঁর খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগও হয়েছে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে কেনো তাঁকে ‘বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়‘ বলেছি? কারণ তিনি বাংলাসাহিত্যের অনেকগুলো ক্ষেত্র আলোকিত করেছেন। ভরিয়ে তুলেছেন মৌলিক কাজের জোছনায়। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, প্রাবন্ধিক, কিশোরসাহিত্যিক, অনুবাদক, গবেষক এবং একজন দার্শনিক। তার সাথে নিজের লেখক চরিত্রে যুক্ত ছিলো প্রথা বিরোধিতা। হুমায়ূন আজাদ রাষ্ট্র এবং সমাজের অনেক প্রথা ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি কেন তা চাইতেন, সে ব্যাখাও তাঁর বিভিন্ন লেখা এবং সাক্ষাতকারে উদ্ধৃত হয়েছে। একটি রাষ্ট্র তাঁর কাছে সর্বময় ক্ষমতা বা বিশ্বাসের জায়গা ছিলো না। বরং রাষ্ট্রের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন একজন কবি, বিজ্ঞানী কিংবা দার্শনিক কে। তাঁর মতে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রথম শ্রেণির মানুষের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কবিতা, দর্শন এবং বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের জন্য প্রথম শ্রেণির মানুষ প্রয়োজন হয়। চলুন দেখা যাক এর পেছনে তিনি কি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, ‘মনে করা যাক যদি শেক্সপীয়র মন্ত্রী হতেন, রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রপতি হতেন বা মনে করা যাক আইনস্টাইন বিজ্ঞানচর্চা ছেড়ে রাজনীতি করতেন, তাহলে কি সভ্যতার জন্য তা মঙ্গলজনক হতো? তা নয়। যিনি সৃষ্টিশীল হবেন, স্রষ্টা হবেন, বৈজ্ঞানিক দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী হবেন, তাঁর প্রবণতাই ভিন্ন। তিনি সভ্যতা সৃষ্টি করেন। রাজনীতিবিদরা তা করে না(সাক্ষাতকার-হুমায়ুন আজাদ:বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়)।‘ এভাবে তিনি প্রথ বিরোধী মনোবৃত্তির মধ্য দিয়ে যে চিন্তাচিহ্ন তৈরী করেছেন, তাতেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত প্রথা এবং সত্যতা ও সততা। হুমায়ুন আজাদ কোন অসঙ্গতি লুকাতেন না, অবলীলায় বলে যেতেন সমাজ-রাষ্ট্র এবং মানবজাতির কোন অঙ্গটি বামন থেকে বামনতর হয়ে যাচ্ছে। তার মূলে কোন কলকব্জাগুলো কাজ করছে। তাঁর এই দৃঢ় স্বভাবের কারণেই অনেকের কাছেই অপ্রিয় ছিলেন। রাজনীতিবিদ, ধর্মবিদ এমনকি সিংহভাগ শিল্পী-সাহিত্যিকের কাছেও তিনি অপ্রিয় ছিলেন। আমার কাছেও তিনি প্রথমদিকে একটি বিষয়ে অপ্রিয় ছিলেন। পরিচয়ের প্রথম দিকে যতবারই যেতাম, তিনি আমাকে চিনতে পারতেন না। নতুন করে নিজেকে উপস্থাপন করতে হতো। তারপরও চোখে-মুখে ফুটে থাকতো দাম্ভিকতা-‘কি লিখো, পড়াশুনা করো?‘ ইত্যাদি। এই স্বভাবের কারণেই হুমায়ূন আজাদ আধুনিক এবং রোম্যান্টিক। তিনি প্রাপ্তিতে কোন মতেই বিশ্বাস করতেন না। নির্মোহতা যাঁর সাথে সেঁটে থাকতো। একজন রাষ্টপ্রধানের সাথে সময় ব্যয় না করে একটি কবিতার সাথে বসবাসকে তিনি উত্তম মনে করতেন। এইসব কারণেই তিনি আধুনিক এবং একইসাথে রোম্যান্টিক।
বাংলা কবিতা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ-এর অন্তর্গত অবলোকনের একটি বিস্তৃত এবং মৌলিক ভূমি রয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নির্বাচিত কবিতা(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা) সম্পাদনা করেছেন। শামসুর রাহমান কে নিয়ে (শামসুর রাহমান, নিঃসঙ্গ শেরপা) বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেছেন। আবার এই দুইজনকে নিয়ে তাঁর সমালোচনার তরবারিও চলেছে সমানতালে। রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিকতা মৌলিক নয়-এমন বক্তব্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য রোমান্টিকতাকে বাংলা কবিতায় উপস্থাপন করেছেন কেবল। যে রোম্যান্টিকতা সৃষ্টি করেছিলেন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলি, কীটস বায়রন, ফরাসী এবং জার্মান কবিরা। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কবিতাসহ বেশিরভাগ বাংলা কবিতা অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা বলেও মনে করতেন হুমায়ুন আজাদ। রবি ঠাকুরের যেসব কবিতা পাঠ্যপুস্তকে রয়েছে তার চেয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে‘র রয়েছে বলে বহুবার বলেছেন তিনি। তিনি মনে করেন রবির কবিতা পাঠের জন্য খুব বেশি শিক্ষিত হতে হয় না। ফলে আধুনিক কবিতার যে জটিল চেহারা তা রবীন্দ্রনাথে নেই-‘কিন্তু যখন আমাদের আধুনিক কবিতার ধারা এসেছে, তখন কবিতা জটিল হয়ে উঠেছে। তার কাব্যতত্ত্ব জটিল, তার উপস্থাপনা জটিল, ভাষার ব্যবহার জটিল। যেহেতেু এ-কবিতা বিশ্ব থেকে অনেককিছু গ্রহণ করেছে, ফলে এর মধ্যে জটিলতার সীমাপরিসীমা নেই। তা বোঝার জন্য র দরকার আছে(সাক্ষাতকার -হুমায়ুন আজাদ:বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়)।
‘শামসুর রাহমান, নিঃসঙ্গ শেরপা‘ তাঁর রচিত এই গ্রন্থটিই শামসুর রাহমানের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করতেন। শামসুর রাহমানের কাব্যভাষ্য বিষয়ে দীর্ঘ এই কাব্যগ্রন্থ রচিবার সময় হুমায়ুন আজাদ মনে করতেন, ‘শামসুর রাহমান তিরিশি পাঁচ মহৎ আধুনিক-উত্তর বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ‘। গ্রন্থটির ভূমিকাতে তিনি কবিকে অভিষিক্ত করেন এভাবে-‘এ-দূর্দশাগ্রস্থ গ্রহে যা-কিছু এখনো আমাকে আকর্ষণ করে. তার প্রথম সারিতেই আছে কবিতা; এবং কবিতা সম্পর্কে যখন আমি একটি ব্যাপক গ্রন্থ লেখার আবেগ অনুভব করি, তখন বেছে নিই শামসুর রাহমানকে, যিনি তিরিশি আধুনিকদের পর বাঙলা ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি।‘ শামসুর রাহমানীয় এই গ্রন্থখানি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে। অথচ সেই বিচারের দন্ডে স্থির থাকেন নি হুমায়ুন আজাদ। নব্বইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর সাথে আমার যতবার শামসুর রাহমান প্রসঙ্গে কথা হয়েছে ততবারই তিনি কবিকে আর বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ বলতে চান নি। শামসুর রাহমানের ‘প্রধান কবি‘ উপাধিটা তিনি অস্বীকার করতেন। বলতেন, ‘শামসুর রাহমান প্রধান কবি এরকম উপাধি বিশেষণ ব্যবহার করা ঠিক নয়। আমি তো শামসুর রাহমানকে নিয়ে একটি দীর্ঘ বই লিখেছি। ফলে আমি জানি শামসুর রাহমান কী। আমার লেখা বইটির জন্যেও তিনি অনেকটা বিখ্যাত হয়েছেন।‘ এমনই ছিলো হুমায়ুন আজাদের দাম্ভিক স্বীকারোক্তি। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও ছিলো। তবে শামসুর রাহমান এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিয়েছিলেন কি-না আমার জানা নেই;কিন্তু শেষ পর্যন্তও হুমায়ুন আজাদ নিজের বক্তব্যে স্থির ছিলেন। এটিই তাঁর কবি ও সমালোচক চরিত্রের দৃঢতা এবং আধুনিকতা। তিনি মনে করতেন শামসুর রাহমানের তুলনায় তাঁর নিজের অনেক উত্তম কবিতা রয়েছে। তা পাঠ করে দেখতে বলতেন আমাকে। তাঁর এ-আত্মম্ভিরতা নিয়ে অনেকেরই বিরূপ মন্তব্য রয়েছে। আমার নেই। কেননা তাঁর যে পঠন-পাঠন ও কাব্যসৃষ্টি ও নিজের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস তাতে করে তুলনামূলক প্রবীণ বা সমসাময়িক কাউকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতেই পারেন। এটিই তো একজন কবির স্বাভাবিক চরিত্র হওয়া উচিত। উতরে যাওয়ার প্রবণতা যে মানুষের মধ্যে নেই তার পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব নয় বলে আমিও মনে করি। হুমায়ুন আজাদ নিজের বক্তব্য সরাসরি প্রকাশ করার সাহস রাখতেন। অনেক কবি-লেখক আছেন যারা অড়ালে এই ধরনের বক্তব্য হামেশা প্রসব করে থাকেন।
উপন্যাস ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু‘ এবং ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ‘ নিয়েও হুমায়ুন আজাদের সাথে আমার কথা হয়েছে। ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু‘ উপন্যাসটিকে তিনি বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপন্যাস মনে করতেন। তুলনা করতে গিয়ে এই উপন্যাসকে বিভুতিভূষণের পথের পাঁচালি‘র তুলনায় অনেক উৎকৃষ্ঠ উপন্যাস বলে মনে করেছেন। পথের পাঁচালীর অপু‘র চেয়ে নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু‘র জলকদর অনেক বেশি শিল্পোত্তীর্ণ চরিত্র মন্তব্য করে তিনি বলতেন, ‘ আমাদের বাংলাসাহিত্যে শিশুকিশোর বা বালক নিয়ে যে-সমস্ত উপন্যাস লেখা হয়েছে, সেগুলো একেবারে অনভিজ্ঞতার উপাখ্যান। পথের পাঁচালীর কথা মনে করতে পারো। পথের পাঁচালীর অপু নিতান্তই শিশু। সে অনভিজ্ঞ, এবং সে জীবনের ভিতর দিয়ে যায় নি। কিন্তু জলকদর যদিও কিশোর, সে কিন্তু জীবনের ভিতর দিয়ে এগিয়েছে। সে চারপাশকে দেখেছে, চারপাশের মধ্যে সক্রিয় জীবনযাপন করেছে। ক্রমশ তার বয়স বড়েছে। তার চারপাশে যে-সৌন্দর্য রয়েছে, তা উপভোগ করেছে সক্রিয়ভাবে, অপুর মত নিষ্ক্রিয়ভাবে নয়।‘ হুমায়ুন আজাদ মনে করতেন বিভূতিভূষণ অকেটা অনভিজ্ঞতা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পায়ে চলার পথ‘ নামক একটি ছোট কবিতার ধারণা চুরি করে ‘পথের পাঁচালী‘ রচনা করেছেন। তাঁর এই বক্তব্যে কারো কারো সমর্থন নাও থাকতে পারে। ‘পথের পাঁচালী‘ একটি বহুল পঠিত উপন্যাস। সম্ভবত সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেয়ার পর উপন্যাসটি আরো বেশি পঠিত হয়েছে। হুমায়ুন আজাদ এর ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু‘র পাঠক সে দৌড়ে কোথায় অবস্থান করছে তার হিসেব জানা নেই। তাই বলে হুমায়ুন আজাদের দাবিকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। তার যে যুক্তি, তার যে মার্গীয় চিন্তা তাকে আমলে নিয়ে সমালোচকগণ তাদের চিন্তায় এক সময় তুলনামুলক বিষয়টিকে তুলে আনার একটি নির্দেশনা কিন্তু রয়েছে তাঁর বক্তব্যে। এভাবে নিজের লেখা সম্পর্কে একটি সূত্র তৈরী করে দেয়া একজন লেখককের দায়িত্ব বলেই আমি মনে করি। এই উপন্যাস নিয়ে কথা বলার সময় হুমায়ুন আজাদের মধ্যে জীবন পরম্পরায়, বিভিন্ন সময়ে রেখে আসা চিহ্ন সমুহের জন্য হাহাকার অনুরণিত হতে শুনেছি। তিনি এই পর্যায়ে এসে মনে করতেন, যে জীবন তিনি এতদিন যাপন করেছেন, তা নিরর্থক; বরং কিশোরকালই ভালো ছিলো। দীর্ঘ জীবনে এতসব কাজ কেনো করেছেন, তা নিয়েও তার হতাশার অন্ত ছিলো না। তাই আমি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, তিনি নিজেই জলকদর। একজন বেড়ে ওঠা কিশোর জলকদরের মধ্য দিয়ে তিনি উত্থিত যৌবন-যৌনচিন্তার প্রকাশও করেছেন।
যদিও হুমায়ুন আজাদ নিজেকে জলকদর নন বলে দাবি করেছেন। বলেন, ‘আমি জলকদরের ভিতর দিয়ে নিজের কৈশোরকে দেখেছি। নিজেকে রূপায়ন করি নি। তবে আমার অভিজ্ঞতা এর মধ্যে রয়েছে। জলকদর একজন চাষী-বালক। আমি তো চাষী-বালক ছিলাম না। তবে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।‘ ‘পথের পাঁচালী‘ এবং ‘নিজের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু‘ এই দু‘টি উপন্যাসের মধ্যে আমি তুলনামূলক কোন আলোচনা করতে চাই না। তবে দু‘টি উপন্যাসের পটভূমি গ্রাম। হুমায়ুন আজাদ, জলকদরের দৃষ্টিতে দেখা যে গ্রাম উপস্থাপন করেছেন, তার শিল্পমূল্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বিশ্বগ্রামের(গ্লোবাল ভিলেজ) আধুনিকতা যেভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে তাতে করে জলকদরের গ্রাম একদিন উদাহরণ হয়ে যাবে হয়তো। জলকদরকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদ, যে দম্ভোক্তি করেছেন, তা তিনি করতেই পরেন। নিজের সৃষ্ট একটি চরিত্র যখন পূর্ণাঙ্গ অবয়ব নিয়ে দাঁড়ায় তখন লেখকের আত্মতৃপ্তি থাকায় স্বাভাবিক। আমরা পাঠক হিসেবে তার নির্যাসটুকু নিতে পারি। জলকদর একেবারে প্রাকৃতিক এক গ্রামে বেড়ে ওঠা কিশোর। প্রতিটি পদক্ষেপে যার মনে নানান প্রশ্ন জেগেছে। অশিক্ষিত কিন্তু একধরনের নিরীক্ষণ চিন্তা তার মধ্যে রয়েছে। গ্রামের যে দৃশ্যকল্প তার দৃষ্টিতে, পাঠক হিসেবে আমরা দেখতে পাই, তাতে জীবনাভিজ্ঞতার গভীর রেখাপাত দৃশ্যমান। চাষা পরিবারের সন্তান জলকদরের প্রতিটি কথায় মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা এই কিশোর প্রাকৃতিক দূর্যোগ, গ্রামীন সংস্কার, সামাজিকতাসহ সব রকম জীববোধের মধ্যে ছুটেছে নিরন্তর।
হুমায়ুন আজাদের পরের উপন্যাস ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ‘ আমাদের নেয়া সাক্ষাতকারের বিষয় হিসেবে ছিলো। এই উপন্যাসটি পাঠের পর আমি খুব বেশি যে মুগ্ধ হয়েছি তা নয়. তবে মনে প্রশ্ন তৈরী হয়েছে। ছোটগল্প পাঠের পর যেভাবে প্রবল প্রশ্ন তৈরী হয় ঠিক সেরকম। আবার উপন্যাসটির পটভূমিও প্রচলিত ঘটনাপ্রবাহের বাইরে।
‘এই প্রথম আমি জীবন বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়া চোখের সামনে দেখতে পাই, একটি ঘটনা দিয়ে আমি বদলে দিচ্ছি জীবনকে। ভদ্রলোকটি নিবিড়ভাবে প্রাণপণে, সম্ভবত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ট রীতিতে চেষ্টা ক‘রে যাচ্ছিলেন আমাকে শ্রেষ্ট সুখটি উপহার দেয়ার জন্য, যেনো এটার কথা আমি কোনোদিন না ভুলি, বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন তিনিই পুরুষোত্তম, তাঁর কাছে ধরা দেয় ছাড়া আমার অন্য কোন নিয়তি ছিলো না। আমি নিজের ভেতরে ভেঙে ভেঙে প‘ড়ে, আবার ভেঙে পড়া থেকে নিজেকে টেনে টেনে জড়ো করে ভাবছিলাম বদলে যাচ্ছে আমার জীবন, বদলে দিচ্ছি আমি।‘
এভাবে উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র ড.শিরিন আহমেদ নৃতত্বেও গবেষণা করতে গিয়ে, নিজের জীবন বদলে দেয়ার বর্ণনা উপন্যাসটির শুরুতেই দিয়েছেন। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে এই চরিত্রটি আমার কাছে নতুন মনে হয়েছে। একজন বিবাহিত নারী অন্য একজন পুরুষের সাথে সঙ্গম করে নিজের জীবন বদলে দিচ্ছে। বিষয়টি একেবারেই নতুন এবং একই সাথে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন তৈরী হয়। কেননা সিলেটের কমলগঞ্জে ছাত্রীদের নিয়ে একটি রেস্ট হাউসে উঠে ড.শিরিন এক ঠিকাদারের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে জীবন পাল্টে দেয়। স্বামী দেলোয়ার কে ঢাকায় ফিরে আর গ্রহণ করেন না। দেলোয়ার জোর করে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করতে গেলে শিরিন অন্ডকোষ চেপে ধরে দেলোয়ারকে নিভৃত করে। এই বিষয়গুলো আমাকে ভাবিয়ে তোলে। ঘটনার নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা একই সাথে মূল্যবোধের দিক থেকে আমি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়াই হুমায়ুন আজাদের সম্মুখে। আমার প্রশ্নের উত্তরে হুমায়ুন আজাদের ব্যাখ্যা এরকম, ‘ যারা বহুজনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে, তারা সংখ্যায় কম নয়। এটা নতুন নয়। সেই প্রাচীনকালেও বহু নারী বহু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করেছে। বহু পুরুষের সঙ্গে ঘুমানো কোন আধুনিকতা নয়। এই উপন্যাসের যে-চরিত্র, সে একজন প্রতিষ্ঠিত নারী, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারী। সে মনে করেছে যে মানসিক সম্পর্ক একটা গভীর আস্থার ব্যাপার। সে যেহেতেু এ-আস্থা রাখতে পারে নি কাজেই সে আর স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চায় নি। সে তো স্থূল নয়, সে তো গোপন ক‘রে যেতে পারতো। স্বামীর সঙ্গে চমৎকার জীবনযাপন করতে পারতো। কিন্তু তা সে চায় নি। এটি হচ্ছে নিজের কাছে বিশ্বস্ত থাকা। আর এটিই হচ্ছে আধুনিক রূপ। বহু পুরুষের সঙ্গে ঘুমানো, রোববারদিন একজনের সঙ্গে, সোমবারদিন আরেকজনের সঙ্গে, মঙ্গলবার নিজের স্বামীর সঙ্গে, এটা কোন আধুনিকতা নয়।‘
হুমায়ুন আজাদের এই ব্যাখ্যার পর আমি উপন্যাসটিকে নতুন করে আবিস্কার করি। ড. শিরিন সম্পর্কে আমার পূর্বতন ধারণার কিছুটা পরিবর্তন আসে। প্রতিটি রচনায় লেখককের নিজস্ব কিছু বক্তব্য ছাপ ফেলে। এখানে হুমায়ুন আজাদ নিজের অবিচল সত্যবলার যে দৃঢতা, তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ড. শিরিন‘র ভেতর দিয়ে। তখন আমার মনে হয় বহু বিধৃত অনৈতিক সমাজকে ড.শিরিন সত্য বলার দিশস দিয়েছে। উপন্যাসটি পাঠের পর কাহিনীর বুনন এবং বক্তব্য বিন্যাসে হুমাযুন আজাদের স্বকীয়তা আমি দেখেছি; কিন্তু প্রধান চরিত্র নিয়ে যে প্রশ্ন তৈরী হয়েছিলো তা নিরসনের মধ্য দিয়ে একজন আধুনিক এবং সত্যবাদী নারী মূর্ত হয়ে উঠেছেন। যদিও আমাদের পরিপার্শ্বে এই ধরনের নারীর সন্ধান মিলে না। কেউ নিজের গোপনসূত্র ছিন্ন করতে চায় না। ফলে যে চরিত্র সমাজে বিরাজিত নয়, তাকে নতুন এবং খাপ না খাওয়া মনে হতেই পারে। আমারও তাই মনে হয়েছিলো। উপন্যাসটির শেষের কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই-দেখা যায় স্বামী দেলোয়ার যখন সঙ্গম করতে চায়, তখন ড. শিরিন তাকে নিভৃত করতে অন্ডকোষ ধরে চাপ দেয়। এই বিষয়টিও আমাকে পীড়া দিয়েছে। আমি হুমায়ুন আজাদকে বলি, এটা কিন্তু একজন রুচি সম্পন্ন মহিলার পক্ষে করা সম্ভব নয়। উত্তরে তিনি বেশ বিচলিত হয়েই বলেন, ‘রুচি-অরুচি কী? তুমি পুরুষ হয়ে যদি স্ত্রীকে এতো অত্যাচার করতে পারো, তাহলে আত্মরক্ষারর জন্য সে কি করতে পারে? শিরিন তো মরতে চায় নি। সে বাঁচতে চেয়েছে। ...তার স্বামী তো জানোয়ারে রূপান্তরিত হয়েছে। কাজেই নিজেকে রক্ষা করার জন্য যা করার, তা সে করেছে। আমি মনে করি মেয়েদেরকে একটি জিনিস ভালো করে শেখানো দরকার যে ধর্ষণকারীদের হাত থেকে আত্মরক্ষার একটি ভালো উপায় হচ্ছে, পুরুষের সবচেয়ে দূর্বল স্থান যেটা, সেটাকে ব্যবহার করা। পুরুষের অন্ডকোষ চেপে ধরলে সে আর পুরুষ থাকে না।‘‘হুমায়ুন আজাদ সাহসী লেখক ছিলেন। তিনি এই সত্যকথাগুলো সরাসরি বলেছেন। কোন আড়াল রাখেন নি। ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ‘ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ড.শিরিনকে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরী হতে পারে। আমি মনে করি বাংলা উপন্যাসে প্রধান-অপ্রধান হয়ে এই চরিত্রটি রয়েছে, তবে তা প্রকাশিত হয়েছে সম্পূর্ণ ড. শিরিনের বিপরীত চেহারায়। শিরিনে রাখঢাক নেই;কিন্তু অন্যদের রাখঢাক রয়েছে। ফলে এর মাধ্যমে একজন ঔপন্যাসিকের ব্যক্তি চরিত্রের দৃঢ়তাও প্রকাশিত হয়েছে।
হুমায়ূন আজাদ-এর চিন্তা এবং দর্শনে সবচেয়ে বেশি দেখেছি ‘না‘ বলার প্রবণতা। একজন আধুনিক মানুষ এবং সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর চরিত্রের এই নির্মোহ ভাবটি তাঁকে একজন সুষ্ঠু চিন্তকের অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। জনপ্রিয়তাকেও তিনি এড়িয়ে চলতেন। তিনি মনে করতেন উচ্চমার্গীয় কোন শিল্প জনপ্রিয় হতে পারে না। ‘শিল্পকলার বিমানবিকীরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ‘ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রয়েছে। তার শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘সব রকমের আধুনিক শিল্পকলাই অজনপ্রিয়। আধুনিক কবিতা বা নাটক বা সঙ্গীত বা চিত্রকলা বা শিল্পকলার অন্য যে-কোন শাখার কথাই ধরা যাক না কেনো, দেখা যাবে এরা অজনপ্রিয়(শিল্পকলার বিমানবীকিরণ)।‘ কবি হিসেবেও হুমায়ুন আজাদ আত্মবিধ্বংসী এবং সব সময় ছিলেন অসম সাহসী আত্মহননের দিকে সমর্পিত। এই কাব্যচরিত্রের জন্যই তিনি রোম্যান্টিক।
এই জিজ্ঞাসার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় সমুদয় কবি এবং যে কোন শুভ-অশুভের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার প্রবণতামুখী হুমায়ুন আজাদকে। এটিই তাঁর মৌলিক চরিত্র। এর আভাস আমি তাঁর প্রতিটি উচ্চারনে পেয়েছি। বাংলাসাহিত্যের প্রধান, অপ্রধান অনেক কবি-সাহিত্যিক নিজের জীবনী লিখেছেন। তাঁর সত্যমিথ্যে যাচাই করার প্রবণতাও আমাদের নেই। ফলে অনেক আত্মজীবনী মূলত মিথ্যে গল্পে ভরপুর। সম্ভবত এ কারণেই হুমায়ুন আজাদ নিজের জীবনী লিখতে চান নি। আমি যখন তাঁকে নিজের জীবন নিয়ে কিছু লিখছেন কি‘না জানতে চেয়েছিলাম, প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘ বাঙলা ভাষায় প্রকৃত কোন আত্মজীবনী নেই। এখানে যাঁরা আত্মজীবনী লেখেন, তাঁরা মূলত সমাজকাহিনী লেখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে থেমে গেছেন। প্রতিটি মানুষের বাহ্যজীবন কমবেশি আমরা জানি;কিন্তু তার অন্তর জীবন এবং তার গুপ্ত জীবন, আমরা জানি না। বাঙলার যে-সমাজ, তাতে গোপন জীবন প্রকাশ করা অসম্ভব। এজন্য এখানে প্রকৃত কোন আত্মজীবনী নেই। এখানে বার্টান্ড রাসেলের মতো আত্মজীবনী লেখা সম্ভব নয়। সেজন্যেই আমি অকপটে সবকিছু করতে পারবো না। হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে জীবন নামে আমি আমার আত্মজীবনীর নামও ঠিক করেছিলাম;লিখি নি। তবে হয়তো লিখে যাবো, আমার স্ত্রী, সন্তানদের বলে যাবো তা যেনো আমার মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে প্রকাশ করা হয়।‘
হুমায়ুন আজাদ মনে করতেন, আত্মজীবনী লেখা হলে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র তাঁকে ঠিকভাবে নেবে না। তিনি মিথ্যে কোন জীবনীগ্রন্থ লিখতে চান নি। জীবনের সত্য-মিথ্যে, কলুষতা, আলো-অন্ধকার সব মিলিয়ে কোন একটি অংশ বাদ পড়লেই তাকে পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ মানতে চান নি তিনি। আমি জানি না পরবর্তীতে তিনি জীবনীগ্রন্থ রচনা শুরু করেছিলেন কি‘না। তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম এ জাতীয় কোন রচনা তাদের হাতে আছে কি‘না। কয়েকদিন খোঁজাখুঁজির পর তেমন কোন রচনা পাওয়া যায়নি বলেই জেনেছি। হুমায়ুন আজাদ আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো আমরা সেই গ্রন্থটি পেতে পারতাম। তারপরও তিনি না লেখার মধ্য দিয়ে যাকিছু বলে গেছেই তাকেই আমরা প্রকৃত আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ বলে ধরে নিতে পারি;এবং বলতে পারি আগামী লেখকরা জীবনীগ্রন্থ লেখার সময় তাঁর কথা অনুসরণ করলে বরং প্রকৃত জীবনীগ্রন্থই রচিত হবে। হুমায়ুন আজাদের ব্যক্তিত্বে যে দৃঢ়তা তা আমাদের খুব কম লেখকের মধ্যেই রয়েছে। অনেকে তাঁকে প্রথাবিরোধী লেখক বলে থাকেন। আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখি। আমার মনে হয়েছে তিনি প্রথা নির্মাণের কথা বলতেন। যেসব অপ্রথা প্রথা হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজমান তার অনেকগুলোই সুবিধাভোগী মানুষদের দ্বারা প্রবর্তিত। সেইসব অপ্রথার বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। বলেন, ‘আমি কোন দলের অনুগত নই; এমনকি কোন ভাবাদর্শ বা চিন্তাধারারও অনুগত নই;কোন সুবিধার পিছনে আমি নেই। আমি এখানে একা। আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে তো আমার সঙ্গে অনেকেই জড়িত। ইউরোপ প্রতিটি মানুষকে যে অসীম স্বাধীনতা দেয়, সে-স্বাধীনতা তাদের অসামান্য করে তোলে। বদ্ধ সমাজের মানুষ তো বদ্ধ। আমার সম্ভবত একটি কবিতা আছে-কী করে বড়ো হবো, এতো ক্ষুদ্রের মধ্যে বাস ক‘রে? আমি নানা রকম লেখা লিখছি, বিচ্ছিন্ন থাকছি, আমাকে কেউ বড় লেখক মনে করে, অনেকে ভয় পায়, অনেক আমার সম্পর্কে চুপ থাকে, অনেকে আমার একটু স্তুতি করতে পারলে স্বস্তি পায়। আমি আছি আমার মতো-একা এবং অনেকের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।‘
দেশ নিয়ে হুমায়ুন আজাদ এর বিভিন্ন অন্তর্গত অবলোকনের মধ্যে একটি ছিলো প্রথাবাদিতা নিয়ে। তিনি মনে করতেন আশির দশক থেকে দেশের নানাবিধ প্রথা প্রচলন কিংবা পূণঃপ্রচলনের মধ্য দিয়ে পুরো সমাজ আবার মধ্যযুগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তরুণদের প্রতি তাঁর একধরনের বিরক্তি এবং শঙ্কাবোধ কাজ করতে দেখেছি। তিনি মনে করতেন এখনকার তরুণরা ভবিষ্যতের কথা ভাবেন না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যেসব অধিকার আদায় হয়েছিলো তা নিজেরা গ্রহণ না করে আবারো তা প্রভুদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এখন বেঁচে থাকলে তিনি একই কথা বলতেন কিনা জানি না।
উপন্যাস ‘রাজনীতিবিদগণ‘(১৯৯৯) নিয়ে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়েছে হুমায়ুন আজাদ-এর সাথে। তির্যক ভাব ও ভাষার রচিত এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে দৈনিক আজকের কাগজে ছাপা হওয়ার সময় আমি পাঠ করেছি। রাজনীতিবিদগণের চরিত্র উন্মোচনে তাঁর চরিত্র নির্মাণের হেতু জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন-
-রাজনীতিবিদরা কি এর চেয়ে ভালো? যেভাবে তাদের উপস্থাপন করা হয়েছে, তার থেকে? মানুষের তো বিকল্প নেই এদের গ্রহণ করা ছাড়া। দেশে অনেকগুলো দল আছে, তাদের মধ্যে আবার দু‘টো প্রধান দল আছে। এটিকে গ্রহণ করবে, নতুবা অন্যটিকে গ্রহণ করবে। এছাড়া মানুষের কোনই বিকল্প নেই। আমি তো লেখক; আমি একটিকেও গ্রহণ করতে পারি না। জনগণও যে গ্রহণ করেছে, তা নয়। জনগণের তো বিকল্প কিছু নেই। তারা বিষ খায় কখনো, আবার আফিম খায় কখনো। আর আমি দুটোকেই বাদ দিয়েছি, বিষও নয় আফিমও নয়। জনগণকে বলা হচ্ছে, তোমার ভোটাধিকার আছে, তুমি ভোট দেবে, আর ভোট না দিলে মার খাবে। তুমি যদি ভোট দাও তাহলে তোমার বাড়ি পুড়িয়ে দেবো, তুমি যদি ভোট না দাও তাহলেও তোমার বাড়ি পুড়িয়ে দেবো। জনগণতো খুবই কারারুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
এভাবে রাজনীতিবিদদের নিয়ে বহুবার বিষুদগার তিনি করেছেন। তিনি আমাদের রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করতে পারা একমাত্র লেখক। কোন রকম ভয় তাঁর মধ্যে কাজ করে নি। তিনি উপন্যাসে যে সাহসিকতায় চরিত্র নির্মাণ করেছেন, সে-ভাবে আমার সাথে আলাপকালেও দৃঢ় মন্তব্য করেছেন। এ উপন্যাস প্রকাশের পর বহু হুমকি তাঁকে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। এক পর্যায়ে তিনি রাজনীতিবিদদের নিয়ে আর কথা বলতে চান নি। বলেন, রাজনীতিবিদদের নিয়ে আলোচনা না করে সাহিত্য নিয়ে কথা বলাই ভালো। এই উপন্যাসটি সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের সাথে আলাপের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে অন্য একটি কথাও মনে পড়ে গেলো। সে সময় দৈনিক আজকের কাগজে উপন্যাস ‘শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার‘(১৯৯৮)ও ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিলো। কেবল এই দু‘টি উপন্যাসই নয় আরো বেশকিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয়েছিলো বলে তিনি উল্লেখ করেন। বলেন, এসব লেখা বাবদ দৈনিক আজকের কাগজে তাঁর অনেক টাকা পাওনা দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পত্রিকা কর্তৃপক্ষ দিতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে তিনি বেশ আক্ষেপ করেছিলেন। জানি না পরে তিনি সেই অর্থ পেয়েছিলেন কিনা।
শেষ দিকে এসে হুমায়ুন আজাদ উপন্যাস রচনায় বেশি সময় দিয়েছেন। এক পর্যায়ে এসে ভাষা বিজ্ঞানের দিকেও আরা মনোনিবেশ করেন নি। তাঁকে অনেকে ভাষাবিজ্ঞানী বলে চিহ্নিত করলেও তিনি কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি ভাষাবিজ্ঞানী মনে করতেন না। যদিও তিনি বাক্যতত্ত্ব, তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, বাঙলা ভাষা, অর্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন। তারপরও প্রাসঙ্গিক আলাপে তিনি বলেন ‘আমি তো শতকরা একশ ভাগ ভাষাবিজ্ঞানী নই, যদি তা হতাম তাহলে অনেক কিছুই লিখতাম।‘ একজন লেখক হিসেবে হুমায়ুন আজাদের এই সহজ স্বীকারোক্তি এবং সততা তাঁকে অনন্য উচ্চাতায় আসীন করে। শেষদিকে তিনি কেনো উপন্যাস বেশি রচনা করেছেন তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন-
-আমি এখন উপন্যাস লিখি, তার কারণ উপন্যাস লেখা সবচেয়ে সহজ। একটি প্রবন্ধ লিখতে গেলে যে-পরিমাণ ভাবতে হয়, চিন্তা করতে হয় পড়তে হয় এবং লিখতে হয়-তার থেকে ১৬০ পাতার একটি উপন্যাস লেখা অনেক সহজ। আমার উপন্যাস আকর্ষনীয় চমকপ্রদ কিছু করা জন্য নয়। আমি দেখেছি উপন্যাস লেখা সবচেয়ে সহজ। একটি কবিতা লিখলাম এক পাতার, তাতেও দশ বারো, পনেরো দিন করেই ভাবতে হয়। একমাসে একটির বেশি কবিতা লেখাও কঠিন।
প্রসঙ্গক্রমে হুমায়ুন আজাদ এর কবিতা বিষয়ক বিশেষণ মনে পড়ে গেলো। একটি প্রবন্ধে তিনি বলেছেন-
-ছোটোবড়ো গদ্যপংক্তির মুদ্রিত রূপ কবিতা প্রতিভাস সৃষ্টি করে, কেননা তা মেটায় কবিতার দৈহিক শর্ত; তবে কবিতা হয়ে ওঠে না, যদি-না তার অন্তর্লোকে থাকে সে-দ্যুতি, যা কেনো রচানাকে কবিতায় পরিণত করে। এখন বাংলাদেশে এমন অজস্র রচনা রচিত-প্রকাশিত হচ্ছে, যে-গুলো ছোটোবড়ো গদ্যপংক্তির সমষ্টি, শারীরিকভাবে কবিতার মতো। একটু স্পষ্টভাবে বলা ভালো যে ওই রচনাসমুহের নিরানব্বই ভাগ কবিতা নয়।(কবিতা কি ও কেনো)
হুমায়ুন আজাদ সম্ভবত সন্ত্রস্ত থাকতেন যে, যে-সব কবিতা তিনি রচনা করেছেন, সে-রকম আর পারবেন কিনা? ফলে কবিতার চেয়ে তিনি উপন্যাস রচনায় উপনীত হয়েছিলেন।
সম্ভবত নিজেকে নিজে চ্যালেঞ্জ করার সাহস শেষ দিকে করতে পারেন নি হুমায়ুন আজাদ। তাই সবছেড়ে উপন্যাস যাত্রা। তাই হুমায়ুন আজাদের বিশেষ করে, অলৌকিক ইস্টিমার, নৃত্যগীতবাদ্য, সেই এক বেহালা, জ্বলো চিতাবাঘ, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে এবং কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু এইসব কাব্যগ্রন্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো অন্য কোন এক সময়। এই গ্রন্থসমুহে অন্তর্ভূক্ত কবিতাগুলো হুমায়ুন আজাদকে কবি খ্যাতি এনে দিয়েছিলো।
হুমায়ুন আজাদ এর সাথে অনেক বিষয়েই কথা হয় আমার। নারী, প্রেম, যৌনতা, ধর্ম-অধর্ম, রাজনীতি-বাণিজ্য কোন কিছুই বাদ যায় নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকাকে ঘিরে তাঁর সম্পর্কে যে রটনা তা নিয়েও কথা হয়। এমনও অনেক কথা হয়, যা তিনি প্রকাশ করতে চান না বলে আমাকে কোন সময় না লেখার অনুরোধ জানান। তাই সেসব লিখতে চাই না। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। একুশে বইমেলায় আগামী প্রকাশনীর স্টলের সম্মুখে দীর্ঘ সময় দাঁড়ানোর পর হুমাযুন আজাদের সাথে-
-স্যার কেমন আছেন?
-আমি ব্যস্ত আছি। পাঠকদের অটোগ্রাফ দিচ্ছি। তোমার সাথে কথা বলার সময় নেই।
এই কথার পর আমি সিগারটে ফুঁকতে ফুঁকতে আরো কয়েক বন্ধুসহ মেলা থেকে বেরিয়ে বাসায় রওনা করি। আমি তখন উত্তর শাহজাহানপুরে থাকি। বাসায় প্রবেশ করা মাত্রই চোখ যায় টেলিভিশনের দিকে। পুরো স্ক্রিনে ভাসছেন রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদ। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। নীরবে আবার বাসা থেকে বেরিয়ে শাহবাগ পর্যন্ত যাই। মোচড় দেয়া বুকটাতে দু‘হাত চেপে আবার বাসায় ফিরে আসি। এরপর পত্রপত্রিকার সংবাদই একমাত্র তাঁর সম্পর্কে জানার সুযোগ। হুমায়ুন আজাদকে যখন ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হলো চিকিৎসার জন্য, তখন অনেকটাই আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে তিনি বেঁচে উঠবেন। চিকিৎসা শেষে তিসি সুস্থ হয়ে ফিরেও এসেছিলেন। ব্যাংকক থেকে তিনি ফিরে আসার পর ঠিক করি দেখা করতে যাবো। একদিন সন্ধ্যায় শাহবাগ থেকে বাসার নাম্বারে ফোন করি। সম্ভবত মৌলি আজাদ(হুমায়ুন আজাদের কন্যা) ফোন ধরেছিলেন। আমি চাইতে ফোনটি দেয়া হয়েছিলো তাঁকে।
-স্যার আমি মিলটন। আপনার সাথে দেখা করতে চাই।
-কোন মিলটন।
-স্যার আমি মিলটন রহমান।
-কি চাও।
-স্যার একটু দেখা করতে চাই।
-আসতো পারো, তবে সাথে করে কোন আততায়ীকে নিয়ে আসবে না তো? তোমাদের তরুণদের আমার বিশ্বাস নেই।
-না স্যার আমি একাই আসবো।
-ঠিক আছে আসো। বাসার নিচে দেখবে আমাকে কতগুলো শেয়াল(পুলিশ) পাহারা দিচ্ছে। ওদের বলবে তুমি আমার কাছে এসেছো।
-ঠিক আছে স্যার।
দেরি না করেই রওনা করি। ফুলার রোড়ের বাসার নীচে যেতেই দেখি তিনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশকে বলছেন যেন আমাকে যেতে দেয়া হয়। আমি সিঁড়ি বেয়ে দরজায় যেতেই মৌলি দরজা খুলেন। আমি ড্রইংরুমে বসার একটু পরেই হুমায়ুন আজাদ আসেন। তাঁর বাঁকানো চোঁয়াল দেখেও অভ্যেসবসত মুখ থেকে বেরিয়ে যায়-
-স্যার কেমন আছেন?
-দেখতেইতো পারছো, নষ্ট বাংলাদেশের মত ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেঁচে আছি।
বুঝলাম, হন্তারকরা হুমায়ুন আজাদের শ্রীহানি ঘটিয়েছে কিন্তু সাহসহানি ঘটাতে পারে নি।
-কি খাবে?
-এককাপ চা ।
থেকে থেকে নিরবতা ভেঙ্গে আমি কথা বলছি। বিমর্ষ হুমায়ুন আজাদকে দেখছি, কিন্তু তারপরও কোথাও যেনো তাঁর চোখে মুখে ফুঠে উঠছে সাহসের ঔজ্জল্য। বললেন-
-এই রাষ্ট্র কোন নিরাপত্তা দিতে পারবে না। আজ আমার ছেলে অনন্যকে জামায়াতে ইসলামির সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে। আমি মিউনিখে যাবো একটি গবেষণা বৃত্তির কাজে। ওদের কার কাছে রেখে যাবো?
আমার কোন উত্তর ছিলো না। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি কি করতে পারি। হুমায়ুন আজাদের জন্য আমার যে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা তা তাঁকে নিরাপত্তা দেয়ার মত শক্তিশালী নয়। সেদিন ফিরে আসি। তিনি জার্মানের মিউনিখে চলে যান কয়েকদিন(৭ অগাষ্ট, ২০০৪) পরেই। সেখানে গবেষণা করবেন কবি হাইরিখ হাইন বিষয়ে। তার কয়েকদিন পরেই ১২ অগাষ্ট খবর পাই হুমায়ুন আজাদ ১১ অগাস্ট তাঁর ফ্ল্যাটে মৃত্যুবরণ করেন। আবারো আলো ছিঁড়ে নেমে আসে অন্ধকার। আমরা বাংলাসাহিত্যেও একজন মেধাবি যিশুকে হারিয়ে ফেলি। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো তিনি জার্মান থেকে ফিরে আসার পর তাঁর গবেষণা বিষয়ে জানবো। তাতো আর জানা হলো না।
(কৃতজ্ঞতাঃ অনন্য আজাদ)
0 মন্তব্যসমূহ