সম্প্রতি পাঞ্জাব ও কেন্দ্রীয় সরকার মিলিতভাবে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করতে চলেছে। ছাগলের রক্ত পায়ুপথে ঢুকিয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধক কর্মসূচি। এই কর্মসূচীর সাথে যুক্ত এক আধিকারিকের কথায় ইহা এক প্রাচীন আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি। এতে নাকি রক্তে লোহিত কণিকার সংখ্যা বাড়বে এবং থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনীতা কমবে। (তথ্যসূত্রঃ জি নিউজ)
এই নিয়ে বিভিন্ন স্যোশাল মাধ্যমে বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। মানুষের দেহ কি সত্যিই প্রাণীর রক্ত গ্রহণে সক্ষম? মানুষের দেহে প্রাণীর রক্ত প্রবেশ করিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলছে। ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইসের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ব্যাপ্টিস্ট ডেনিস এই পদ্ধতি প্রয়োগের চেষ্টা করেন। জানা যায় যে প্রথম দুইবার সফল হলেও তৃতীয়বারে রোগী মারা যান। এই অসফলতার কারণে তিনি যে শুধু রাজার চিকিৎসক হিসেবে বরখাস্ত হন তাই নন, সারাজীবন চিকিৎসা করার সুযোগ হারান। ঠিক এক সময়ে ইংল্যান্ডে রিচার্ড নামক জনৈক ব্যক্তি সেই এক চেষ্টা করেন ও অসফল হন। অতএব বলা যায় ১৯০১ সাল অব্দি মানুষের দেহে বিভিন্নভাবে রক্ত প্রবেশ করানোর চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। কারণ আমাদের শরীর এমনভাবেই তৈরি যে কোন বাহ্যিক বস্তু শরীরে ঢুকলে তা শরীর যদি বুঝে যাই যে 'ইহা আমার নয়', শরীর প্রবল প্রতিরোধ শুরু করবে।
রক্তের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনই। আমাদের রক্তকণিকার বাইরের আবরণ বিভিন্ন প্রোটিন দিয়ে ঢাকা। এই প্রোটিনের বিভিন্ন চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি আছে। যাকে আমরা রক্তের গ্রুপ বলি। 'A', 'B', 'AB' 'O' গ্রুপ। এরা যদি নিজেদের রক্তের গ্রুপকে পায় তা চিহ্নিত করতে পারবে না। ফলে শরীর সহজেই বাইরের রক্ত গ্রহণ করে নেবে। যেমন ধরুন আপনি রোগীর শরীরে 'A' গ্রুপের রক্ত ঢোকালেন, এবার রোগীর রক্তের প্রোটিনের বাহ্যিক আবরণ যদি 'A' হয়, বাইরের রক্তকে নিজেদের আত্মীয় ভেবে ঝামেলা করবে না। কিন্তু যদি বুঝে যায় যিনি এসেছেন তিনি আমার পরিবারের নয়, তাহলে ঢাল তরোয়াল নিয়ে ঝামেলা জুড়ে দেবে। রক্তের পরিমাণ যত বেশি হবে, শরীরে যুদ্ধক্ষেত্রের স্থান তত বাড়বে। ফলে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি বেশি পরিমাণ হলে গোটা শারীরিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু অন্য গ্রুপের রক্ত যদি কম পরিমাণে প্রবেশ করানো হয় তবে শরীর সাময়িক কিছুটা অসুস্থ হলেও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে। ১০ মিলি বাইরের অন্য বৈশিষ্ট্যযুক্ত রক্ত খুব বেশি ক্ষতিসাধন করে না, তা মানুষের হোক বা পশুর। যেমন সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা পদ্ধতি ঘোড়ার রক্ত ব্যবহার করেই এবং রোগীর ক্ষেত্রে পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করেই।
এটা জানলেই বোঝা যায় যে ফ্রান্সে চিকিৎসক ডেনিসের চিকিৎসা পদ্ধতিতে কেন প্রথম দুজন রোগী মারা যায়নি। কারণ রক্তের পরিমাণ এতটাই কম ছিল যে তা রোগীদ্বয়কে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়নি। কিন্তু তৃতীয় রোগীর ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী চিকিৎসক বেশি রক্ত প্রবেশ করিয়েছিলেন, যা রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়। 'O' গ্রুপের রক্তের যে বাহ্যিক প্রোটিন আবরণ আছে তাতে কোন চিহ্নিতকরণ বৈশিষ্ট্য নেই, ফলে সব গ্রুপের রক্তই তাকে নিজের পরিবারের মনে করে নিজেদের পরিসরে জায়গা করে দেয়। তাই 'O' গ্রুপকে সর্বজনীন দাতা বলা হয়। আবার 'AB' গ্রুপের রক্তে 'A' ও 'B' দুই বৈশিষ্ট্য থাকার জন্য এই রক্ত সব পরিবারের রক্তকেই বিনা বাক্যব্যয়ে জায়গা করে দেয়, তাই 'AB' সর্বজনীন গ্রহীতা।
১৯০১ সালে পৃথিবীতে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে মানুষের রক্ত অন্য মানুষের দেহে প্রবেশের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কারণ ততদিনে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। এখনো যেমন পরীক্ষা চলছে শূয়োর বা অন্য প্রাণির রক্ত মানুষ গ্রহণ করতে পারে কি না!
অতএব পাঞ্জাবে যে প্রয়োগপদ্ধতি শুরুর চেষ্টা চলছে তা কি আদৌ বিজ্ঞানসম্মত? এই নিয়ে কি আদৌ কোন গবেষণা হয়েছে? তা কি কোন মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে? ছাগলের রক্ত ঠিক কতটা পরিমাণ মানুষ গ্রহণে সক্ষম? ছাগলের রক্তে কি আদৌ থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধজনিত বৈশিষ্ট্য আছে? এই সংক্রান্ত কোন পরীক্ষা কি পশুর দেহে পরীক্ষাগারে প্রয়োগ হয়েছে? আমাদের দেশের প্রাচীন আয়ুর্বেদিকরা আদৌ কি থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন? তারা কি ছাগলের রক্ত প্রয়োগের বিষয় কোথাও লিপিবদ্ধ করেছিলেন? এমন বিভিন্ন প্রশ্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তুলছেন।
না কি এমন প্রয়োগ অবলম্বন করে দেশের কিছু মানুষকে গিনিপিগ করা হবে? 'সব বেদে আছে' এমন ভ্রান্ত ধারণার বশীভূত হয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে?
0 মন্তব্যসমূহ