যতদূর অনুমান করা যায়, আদিম মানবজাতির ইতিহাসে, সমাজ পরিচালক নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে যখন সুর ও অসুর বিভাজন হয়নি, একই সামাজিক সত্তাকে অসুরও বলা হত, দেবতাও বলা হত, সেই সময় সমাজের নেতৃস্থানীয়দের বলা হত ‘দাশ’। দক্ষযজ্ঞেরও আগে যাঁরা সমাজের সবচেয়ে শক্তসমর্থ পুরুষ ছিলেন, সমাজের জ্ঞানসম্পদ ও শ্রমসম্পদের অধিকারী ছিলেন, সমাজের নেতৃস্থানীয় ছিলেন, সংগৃহীত খাদ্যদ্রব্য সর্ব্বাগ্রে শিশু-বৃদ্ধ-গর্ভবতীদের দিয়ে যেটুকু বাঁচত খেতেন - এভাবে যাঁরা ‘দান করিতে (দা) শক্য’ (শ) ছিলেন, সেকালে তাঁদের দাশ বলা হত। ধনসম্পদের মালিকানা তো অনেক দূরের কথা, তাঁরা এমনকি জ্ঞানসম্পদের ব্যক্তিমালিকানাতেও বিশ্বাস করতেন না বলেই মনে হয়। আহরিত খাদ্যসম্পদ, ধনসম্পদ তো বটেই, অর্জ্জিত জ্ঞা্নসম্পদের ক্ষেত্রেও তাঁরা সাধারণিকরণে (জেনারেলাইজেশনে) বিশ্বাসী ছিলেন। …মোট কথা, মানুষের শারীরিক ও মানসিক খাদ্য আহরণ করে নিয়ে এসে সবাইকে দেওয়ার ক্রিয়াটি যাঁরা একনিষ্ঠভাবে করতেন, আদিতে তাঁদেরকেই ‘দাশ’ বলা হত।
দক্ষযজ্ঞের পরবর্ত্তিকালে এই ‘দাশ’দের সামাজিক মর্য্যাদা হ্রাস পায়। এঁরা নিজেদের স্বভাববশত জ্ঞানের মালিকানা, খাদ্যসম্পদ বা ধনসম্পদের মালিকানার ঘোর বিরোধী রূপে খ্যাত হয়ে যান। কারণ, এঁরা কেবল সমাজের রাঘববোয়াল, রুইকাতলাদেরই বিরোধী ছিলেন না; টাকার কুমীরদেরও পারলে মেরে ফেলতেন। সেই কারণে এঁদের ‘সামাজিক-মৎস্য-হিংসাকারী’ অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানা-হিংসাকারী’ বলা হত [ মনে রাখা ভাল, ‘নরস্য’ যেমন ‘নরের’ বোঝায়, ‘মৎ (=আমি) + স্য’ বা ‘মৎস্য’ কথাটিও তেমনি ‘আমার’ বোঝায় ]। কালে কালে এঁরাই ক্রমান্বয়ে অধঃপতিত হতে হতে fish-হিংসাকারী জেলে-কৈবর্ত্ততে পরিণত হয়ে যান।
অথচ আদিতে এঁরাই ছিলেন বিপ্র, ছিলেন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সবুচেয়ে করিৎকর্ম্মা, জ্ঞানীগুণী; ছিলেন গাছগাছড়া প্রভৃতি বিষয়ে অধিক ওয়াকিফহাল। যে কারণে, বহু পরে, এই দাশ বৈদ্যজাতীর পদবী হয়ে যায়। …যাই হোক, মোটকথা শব্দের ভিতরের ক্রিয়া অনুসারে ‘দান শক্তি যাহার’ কিংবা ‘দানে শক্য যে’, সেই হল 'দাশ'। কিন্তু দান করতে করতে তার যদি সর্ব্বস্ব চলে যায়, হাতে যদি কোনো কিছুই আর না থাকে?
দাস
'দাশ' শব্দের অর্থে আমরা দেখেছি যে, যে-সত্তা ‘দান করিতে শক্য বা পারে’, অর্থাৎ দান করবার মতো শক্তি ধরে যে, তাকে দাশ বলে। কিন্তু এই সত্তা যদি দান করতে করতে তার দানের বিষয় ও বস্তুসমূহ নিঃশেষ করে ফেলে এবং কেবলমাত্র তার শরীরটুকু বা শ্রম ( শ্রমশক্তি ও শ্রমসময় ) ছাড়া দান করার মত তার আর আর কিছুই না থাকে, যখন দান গিয়ে ঠেকেছে তার শেষ অধ্যায়ে, বিসর্গে - দাঃ বা দাস্-এ, তখন তাকে দাস বলে [ এই দাস্-কেই ফারসী পয়েছে তার ‘দাস্ত’ শব্দে, যদর্থ মল, এবং ইংরেজী পেয়েছে ‘dust-এ যার পরে অস্তিত্ব আর থাকে না ]। প্রাচীন ভারতসমাজে ‘দাশ’-এর চেয়েও ‘দাস’ ছিলেন বেশী সম্মানীয়। ‘দাশ’গণ ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানব; সেই দাশগণের মধ্যে যাঁরা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাঁদেরই বলা হত ‘দাস’।
হায় রে কপাল! সেই দাসগণই পরবর্ত্তিকালে একসময় পরিণত হলেন - প্রথমে সাতরকম, পরে পনের রকম ভৃত্যে বা servant-এ। এবং সেই দাসত্ব যুগের পর যুগ ধরে বাহিত হয়ে বর্ত্তমানে পৌঁছে এমন একরকম মনোহারী প্রায় সর্ব্বজনীন ক্রীতদাসত্বে পরিণত হয়েছে যে, তা আগের সর্ব্বপ্রকারের দাসত্বের তুলনায় হাজার গুণ নির্ম্মম-নিষ্ঠুর হওয়া সত্ত্বেও তার দাসত্ব প্রায় দেখাই যায় না। প্রথম যুগের সেই সাতরকম দাসদের নামগুলি পাওয়া যায় মনুসংহিতায়, পনের রকম দাসদের নামগুলি পাওয়া যায় যাজ্ঞবল্ক্য-সংহিতায় ও মিতাক্ষরায়। কীভাব কোন পথ বেয়ে তাঁদের এই দুর্গতি হল, সে এক বিশাল অকথিত কাহিনী। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আমাদের “আসমানদারী করতে দেব কাকে” গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “মানুষ মানুষের ঘাড়ে চাপল কেমন করে অথবা পালকী’র কথা” নিবন্ধে। এখানে আমরা তার কয়েকটি বিন্দুমাত্র ছুঁয়ে যাব।
দক্ষযজ্ঞের পর যৌথ সমাজ ভেঙে বহু গোষ্ঠীতে পরিণত বলে, সমাজপরিচালকদের আত্মকলহে তিতিবিরক্ত সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় আপন আপন জন্মসূত্রে লব্ধ তিনটি মৌলিক অধিকারই [ নিজের উপর অধিকার, সমাজসদস্যরূপে প্রাপ্য অধিকার, জগৎসদস্যরূপে প্রাপ্য অধিকার ] মহর্ষিকে [ = এক বা একাধিক জ্ঞানীকে ] সম্প্রদান করে নিজেরা সেই মহর্ষি-পরিচালিত গোষ্ঠীতে বা সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। এ ছিল তাঁদের স্বেচ্ছায় ‘আত্মনিবেদন’ - আর, ফলস্বরূপ মহর্ষি তাঁদের সার্ব্বিক অস্তিত্বের ‘মালিক’ হয়ে যান। বলতে গেলে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম মানুষের অস্তিত্বের মালিক হয়ে গেল অন্য একজন মানুষ। দাসদের সেই ছিল প্রথম সামাজিক মার্য্যাদার অধঃপতন।
কালে কালে একসময় নানা কারণে মহর্ষি আপন সম্প্রদায়ের কিছু দাসকে অন্য সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন, এবং তাদের গোত্রান্তর হয়ে যায়। [ নারীদের এই গোত্রান্তর আজও প্রচলিত রয়েছে বলেই বিয়ের পর মেয়েদের পদবী স্বামীর পদবীতে বদলে যায় ]। মানুষকে দাসে পরিণত করার বা কৃতদাস প্রথার সেই সূত্রপাত। ঠিক তার পিছু পিছু আসে ‘ক্রীতদাস’ প্রথা। আদিতে গোত্রান্তর করা হত নিতান্ত দায়ে পড়ে। আপন গোষ্ঠীর কোনো মানুষকে অন্য কারও হাতে দিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, প্রয়োজনে আপন গোষ্ঠীর মানুষের জন্য পরিচালক-মহর্ষি আপন জীবন প্রাণ সবই বিসর্জ্জন দিয়ে দিতেন। কিন্তু একসময় বাহ্যিক পরিস্থিতি এই ধরনের গোত্রান্তরের পক্ষে সায় দিতে থাকে। আরও পরে, ক্রমে এই বিষয়টি গা-সওয়া হয়ে যায়। ক্রমে গোত্রান্তরিত দাসদের পরিবর্ত্তে গোষ্ঠী-মহর্ষি কিছু কিছু ‘পরিবর্ত্ত’ নেওয়া উচিত বিবেচনা করলেন। কৃতদাস প্রথা পরিবর্ত্তিত হতে লাগল ক্রীতদাস প্রথায়। এবং ক্রমে এই ক্রীতদাসের নানান রকমফের ঘটতে লাগল।
মোট কথা, সমাজের চোখে এক মানুষ কর্ত্তৃক অন্য মানুষের জীবনদখল লজ্জাকর তো থাকলই না, চোখ-সওয়া গা-সওয়া হয়ে গেল। এমনকি যাদের জীবন দখল করা হতে লাগল, তারাও ব্যাপারটি কমবেশী মেনে নিতে বাধ্য হল। কেননা, দক্ষযজ্ঞের মহাসংগ্রামে বীতশ্রদ্ধ-অভিমানী হয়ে এবং জগতের ভালো চিন্তা করে, নিজের সমস্ত অধিকার মহর্ষির হাতে তুলে দিয়েছিল দাস নিজেই। ধীরে ধীরে সমাজমনের আকাশে এই অসম্ভব সত্য সম্ভব হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে, কোনরকম মমতার বন্ধন ছাড়াই একজন মানুষ অন্য মানুষের হুকুম তামিল করতে পারে; যা কিনা সাবালক পশুপাখীও করে না বরং আত্মহত্যা করা উচিত বিবেচনা করে।
এই বোধ ক্রমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সারা পৃথিবীতেই ক্রীতদাস প্রথা প্রচলিত হয়ে যায়। অন্যথায়, মানুষ মানুষকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে বেচে দিল, আর সে-মানুষটা ওইভাবে ক্রীতদাস হয়ে জীবন কাটাতে রাজী হয়ে গেল - এই অবিশ্বাস্য কাণ্ড কখনও সম্ভব করা যেত না। আপন দাসজীবন মেনে নেওয়ার এই যে মানসিকতা সমাজমনে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারল, সেই মানসিকতা আজ কোথায় এসে পৌঁছেছে, দেখলে অবাক হতে হয়। আজকের মানুষ, রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক, আগ্রহের সঙ্গে ‘চাকরী’ করতে যায়, হুকুমের চাকর হতে যায়। যে ব্যক্তি চাকর রূপে অন্য ব্যক্তিকে ‘নিয়োগ’ করে এবং যে ব্যক্তি সেই নিয়োগ মেনে নিয়ে চাকর হয়, এই ক্রীতদাস প্রথায় তাদের কারও কোনো লজ্জাবোধই হয় না; বরং চাকরী পেয়ে চাকর হয়ে গৌরবের অন্ত থাকে না আজকের সভ্য মানুষের। রাষ্ট্র নিজেই স্কুল-কলেজ নামে চাকর বানানোর কারখানা খুলে বসে আছে। এই যে আধুনিক দাসপ্রথা, এটা এতই চোখ সওয়া হয়ে গেছে যে, এই দাসপ্রথা লোকে দেখতেই পায় না। তার মানে এই নয় যে, কেউ কারও সঙ্গে হাত লাগিয়ে কোনো কাজই করবে না। কিন্তু করবে কীভাবে? এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে “আমাদের “অবিকল্পসন্ধান” গ্রন্থের অন্তর্গত “উত্তর-প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষা ও লালন-পালন” নিবন্ধে।
কৃতদাস
যাকে সামাজিক নিয়ম, নীতি, ধর্ম্ম, আইনের সাহায্যে দাস বা স্লেভ করা হয়েছে, সেই হল কৃতদাস। এই কৃতদাসকে কেউ যখন ক্রয় করে নিয়ে আসে, তখন সেই দাসকে ক্রীতদাস বলে। ভারতের ইতিহাস সুষ্পষ্ট রূপে জানায়, মানুষকে কৃতদাসে পরিণত করতে না পারলে কিছুতেই ক্রীতদাসে পরিণত করা যেত না। ইউরোপ আমাদের যে ক্রীতদাসের গল্প শোনায়, সেটি অতীতহারা ইতিহাস।
ব্যুৎপত্তি [ দাশ, দাস ]
দাশ
দাশ্ + অ (অচ্) - কর্ত্তৃবাচ্যে। দাশ = দশ হইতে জাত; দানে শক্য যে, অর্থাৎ দান করিতে সক্ষম যে; যে মৎস অন্য মৎস্যকে হিংসা করে। / যাহাকে ( মৎস্যের মূল্য ) দেয়। [ বঙ্গীয় শব্দকোষ ]। কৈবর্ত্ত, ধীবর [ অয়োগবীতে নিষাদ হইতে জাত জাতি দাশ বা মার্গব। ইহারা নৌকর্ম্মজীবী। আর্য্যাবর্ত্তে ইহাদের নাম ‘কৈবর্ত্ত’, নাবিক, বিপ্র, ভৃত্য, বৈদ্যজাতির উপাধী। - [বঙ্গীয় শব্দকোষ}। বর্ত্তমানে পদবী রূপে প্রচলিত। দ্রষ্টব্য - কৈবর্ত্ত।
দাস (দাঃ, দাস্, দাস্ত)
দাস = দাস্ + অ (অচ্) - স। দাস = দা-এর (দানকারীর) অন্তিম অস্তিত্ব থাকে যাহাতে। দাঃ, দাস্ = দা-এর ( দানকারীর ) নির্য্যাসত্যাগ যাহাতে। দাস্ত = দাস্ তারিত যাহাতে, মল, মলত্যাগ । / যাহাকে বেতন দেয় বা কার্য্যার্থে প্রেরণ করে; যে আত্মদান করে। = [ বঙ্গীয় শব্দকোষ ]। দাস = ভৃত্য [ মনু মতে দাস সপ্তবিধ - ধ্বজাহত, ভক্তদাস, গৃহজাত (দাসীপুত্র), ক্রীত, দত্রিম, পৈতৃক, ও দণ্ডদাস। মতান্তরে পঞ্চদশবিধ - গৃহজা, ক্রীত, লব্ধ ইত্যাদি ( যাজ্ঞবল্ক্য, মিতাক্ষরা )], শূদ্র [ ঋগ্বেদে ‘দাস’ শব্দে ইন্দ্র কর্ত্তৃক বিজিত ’নমুচিশস্বর’ প্রভৃতি অসুর। ভারতের ‘অসভ্য’ আ্দিবাসীরা আর্য্যদিগের গবাদি বলপূর্ব্বক হরণ করিত বলিয়া, তাহারা ‘দাস বা দস্যু’ শব্দে আখ্যাত হইত। পরে ইহারা আর্য্যদিগের বশীভূত হয় ও ভৃত্যত্ব স্বীকার করে। সুতরাং ‘দাস’ শব্দ মূলতঃ ‘ভৃত্য’-বাচী নহে। দাসেরা বা দস্যুরা ভৃত্যত্ব গ্রহণ করায়, উহার গৌণার্থ ‘ভৃত্য’ এবং ইহারাই শূদ্র নামে অভিহিত। ], ব্রাহ্মণ হইতে শূদ্রকন্যাগর্ভে জাত ও ব্রাহ্মণ কর্ত্তৃক সংস্কৃত ভোজ্যান্ন জাতিবিশেষ, শূদ্রের উপাধীবিশেষ, দস্যু, বৃত্রাসুর, কায়স্থের উপাধী, আত্মনিবেদক, জ্ঞানাত্মা, ধীবর, চর্ম্মকারের উপাধী [ ভক্ত রুইদাস চর্ম্মকার বোধ হয়, এই ‘দাস’ উপাধীর মূল ‘রুইদাস। চর্ম্মকারেরা ‘রুইদাস’ বলিয়াও জাতির পরিচয় দেয়। ], অগ্রজের প্রতি অনুজের হীনতাসূচক বিনয়বাক্য।
কৃতজ্ঞতা- নারায়ণ চন্দ্র দাস...!
0 মন্তব্যসমূহ