আজ যখন বিশ্বের সর্ব্বত্র মৌলবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে, অহরহ মৌলবাদের পদধ্বনিতে বর্ত্তমান সমাজ শিহরিত ও রক্তাক্ত হচ্ছে, তখন বঙ্গযানের পাঠককুলের জন্য অতীতের পৃষ্ঠা থেকে প্রাসঙ্গিক একটি অংশ তুলে ধরা হল।
হিন্দু ও ইসলাম এই দুটি ধর্ম্মের সৃষ্টিই হয়েছিল মৌলবাদের বিরোধিতা থেকে। অথচ আজ উভয় ধর্ম্মই মৌলবাদের শিকার। দুই ধর্ম্মাবলম্ববী মানুষের মুক্তির কি কোন পথ নেই?
বারো পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা কলিম খান রচিত মূল নিবন্ধটি ২০০১ সালে একটি সাময়িক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এতে দেখানো হয়েছিল যে, হিন্দুধর্ম্ম ও ইসলাম ধর্ম্ম - দুটি ধর্ম্মই মূলত এক, একই অচলায়তনের বা মৌলবাদের বিরোধিতার থেকে ধর্ম্ম দুটি উদ্ভূত হয়েছিল। দেখানো হয়েছিল, পচে যাওয়া অতীতের বিরোধিতা করা [ প্রাণবন্ত অতীতের নয় ] আর মৌলবাদ বিরোধিতা করা একই কথা। আমরা নিবন্ধটি থেকে মাত্র দুটি প্রাসঙ্গিক প্যারাগ্রাফ লেখকের সম্মতি সাপেক্ষে তুলে ধরলাম।
সম্পাদক, বঙ্গযান ]।
কোরান ও গীতা : পুনঃপাঠ
[ সংক্ষেপিত ] - কলিম খান
মহম্মদ কহিলেন : -
হে আবুবক্কর! মদিনা হইতে এই বিশাল সৈন্যবাহিনী লইয়া যে উদ্দেশ্যে হেথায় আসিয়াছি, তাহা বুঝি আর সফল হইল না| দেখো, সম্মুখসমরে আজ আমারই কোরেস বংশের বংশজগণ। আর দেখো, উভয় সেনার মধ্যে আমারই পিতৃব্যগণ পিতামহগণ আচার্য্যগণ মাতুলগণ ভ্রাতৃগণ পুত্রগণ পৌত্রগণ মিত্রগণ শ্বশুরগণ সুহৃদগণ অবস্থান করিতেছেন।আমি কাহাকে হত্যা করিব? হে আবুবক্কর! যুদ্ধেচ্ছু এই সকল স্বজনদিগকে সম্মুখে অবস্থিত দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইতেছে এবং মুখ শুষ্ক হইতেছে। ইহা সত্য যে, ৩৬০টি প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়া ইহারা যুগযুগান্ত ধরিয়া আরববাসীগণকে প্রতারিত করিতেছে, আর ওই প্রতীকগুলির সাহায্যে পুরাতন জীবনব্যবস্থায় তাহাদিগকে মোহগ্রস্ত করিয়া রাখিয়াছে, তাহাদের ধনসম্পদ ভোগ করিতেছে। ইহাও সত্য যে, আমি ওই বংশেরই এক কনিষ্ঠতম ও অবহেলিত অবক্ষিপ্ত উত্তরাধিকারী, এক দুয়ো-রাজকুমার। তথাপি এক্ষণে ইহাদিগকে সমরাঙ্গনে সম্মুখস্থ দেখিয়া আমার হস্তপদ অবসন্ন হইয়া আসিতেছে।
আবুবক্কর কহিলেন : -
অয় মুহম্মদ! এই সঙ্কট সময়ে স্বর্গহানিকর অকীর্ত্তিকর তোমার এই মোহ কোথা হইতে উপস্থিত হইল? এ যুদ্ধ স্বার্থপ্রণোদিত নহে, ইহা জেহাদ, ধর্ম্মযুদ্ধ| হে পরন্তপ! তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করিয়া যুদ্ধার্থে উত্থিত হও! জেহাদ অপেক্ষা ইমানদার মোমিনের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছুই নাই। হে ধনঞ্জয়! এই যুদ্ধ জগৎ-পিতার নিয়মে স্বয়ং উপস্থিত হইয়াছে। ইহা আমাদের নিমিত্ত জন্নাতের দ্বার উন্মুক্ত করিবে। অতএব যুদ্ধার্থে উত্থিত হও। অন্যথায় মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়বশত যুদ্ধে বিরত হইতেছ, দয়াবশত নহে। সুতরাং যাহারা তোমাকে বহু সম্মান করেন, তাহাদিগের নিকট তুমি লঘুতা প্রাপ্ত হইবে। তোমার শত্রুরাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া অনেক অবাচ্য কথা বলিবে। তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখকর আর কী আছে? এক হস্তে অধর্ম্মের বিনাশ ও অপর হস্তে ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ধর্ম্মভ্রষ্টদিগকে হত্যা করিতে দ্বিধা কিসের? সুতরাং হে সব্যসাচী, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান করো।
সব্যসাচী কহিলেন : -
ইহা সত্য যে, ইহারা ধর্ম্মভ্রষ্ট। এই কৌরবগণ আমাদিগের ন্যায় একই ইক্ষ্বাকু বংশজ হইলেও ইহারা ধর্ম্মের অমর্য্যাদা করিয়াছে। প্রজাপালন বিষয়ে ইহাদিগের দুঃশাসনের কোনো সীমা নাই। ইহাও সত্য যে, আমরা এই বংশেরই অবহেলিত অবক্ষিপ্ত উত্তরাধিকারী, এই রাজবংশের দুয়ো-রাজকুমার এবং ইহারা আমাদিগকে আশৈশব প্রবঞ্চনা করিয়া আসিতেছে, সাধারণ প্রজাদিগের তো কথাই নাই। সেই হেতু ধর্ম্মপ্রতিষ্ঠার স্বার্থেই ইহাদিগকে ক্ষমতাচ্যুত করা প্রয়োজন। কিন্তু এতত্সত্ত্বেও, স্বজন ও গুরুজনদিগকে বধ করিয়া কীরূপে প্রাণ ধারণ করিব, এইরূপ চিন্তাপ্রযুক্ত হইয়া চিত্তের দীনতায় আমি অভিভূত হইতেছি। প্রকৃত ধর্ম্ম কী, এ বিষয়ে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইতেছে। ধর্ম্মপ্রতিষ্ঠার নিমিত্ত এ আমি কাহার হত্যাকারী হইতে চলিয়াছি? অতএব, হে কৃষ্ণ, যাহাতে শুভ হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া তাহা বলো!
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন : -
প্রকৃতপক্ষে তুমি কাহারও হত্যাকারী নহ। স্বজন ও গুরুজন যাহাই হউক, যাহারা অন্যায়কারী, প্রজাবৃন্দের প্রতি নির্দয়, অচলায়তন রূপে সমাজের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাঁহারা ধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়াছেন। কাল সমুপস্থিত হইলে স্বয়ং শিব ধর্ম্মভ্রষ্টদিগের মহিমাহরণ করিয়া তাহাদিগকে হনন করিয়া রাখেন। এক্ষেত্রেও তাহাই হইয়াছে, তুমি নিমিত্তমাত্র। সত্যের জন্য, ধর্ম্মের জন্য, স্বজন ও গুরুজনদিগের উপর বাণনিক্ষেপ করিলে কদাচ অধর্ম্ম হয় না। সুতরাং, তুমি নিঃসংশয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। যাহারা সত্যের নিমিত্ত ধর্ম্মের নিমিত্ত পিতৃব্য ও পিতামহ প্রভৃতি স্বজনগণকে নিকেশ করিতে দ্বিধা করে না, তাহারাই প্রকৃত ধার্ম্মিক। ইতিহাস তাহার সাক্ষী। অতএব, হে পাশুপতধারী মোমিন! হে দুয়ো-রাজকুমার! হে বংশদ্রোহী! তুমি যুদ্ধ করো।
কৃতজ্ঞতা: বঙ্গযান
0 মন্তব্যসমূহ