বন্ধুবর শ্রী গৌরমোহন দাস 'মান্ধাতার আমল' এই শব্দ-বন্ধ নিয়ে 'শুবাচ'-তে আলোচনা করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন । বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে 'বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ'-এ এর তাৎপর্য যেভাবে ব্যাখ্যাত আছে তা উদ্ধৃত করার লোভ সম্বরন করতে পারলাম না ।
"ক্ষুধাতুরের পক্ষে সামনে খাদ্য দেখতে পাওয়া অথচ তা গ্রহণ করতে না-পারার মতো শাস্তি আর হয় না । তার খাদ্য দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্যই দুর্ভাগ্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে । 'মান্ধাতার আমল' কথাটি সবচেয়ে মূর্খ বাংলাভাষীও কখনো-সখনো বলে ফেলেন, এবং মান্ধাতার মানে সবচেয়ে জ্ঞানী বাংলাভাষীও জানেন না । কথাটি বাংলাভাষী যে ভোলেননি, মান্ধাতা নামের স্মৃতি যে তার এখনও আছে, সমগ্র বাংলাভাষী-সমাজেই আছ, এবং তার ভিতরে যে মানসিক-খাদ্যস্বরূপ মানে রয়েছে সেটি ঠিক; কিন্থ সে খাদ্য গ্রহণ করা যাচ্ছে না । পোড়া কপাল আর কাকে বলে !
মান্ধাতা = ‘মাং ধাতা -- অর্থাৎ আমাকে পান করিবে’; সূর্য্যবংশীয় রাজাবিশেষ (...অপুত্রক যুবনাশ্ব নির্ব্বেদ হেতু মুনিমন্ডলে আশ্রয় গ্রহণ করিলে, মুনিগণ যুবনাশ্বের পুত্রার্থ যজ্ঞ করিয়া মন্ত্রপূত জলকলস বেদিমধ্যে রাখিয়া নিদ্রিত হন । যুবনাশ্ব তৃষ্ণার্ত হইয়া সেই জল পান করিয়া গর্ভ ধারণ করেন । পরে যথাকালে কুক্ষি ভেদ করিয়া শিশু নির্গত এবং রাজা পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলে, মুনিরা কহিলেন -- ‘এই শিশু কাহার স্তন পান করিবে ?’ ‘ইন্দ্র বলিলেন -- ‘এই শিশু আমাকেই পান করিবে (মাময়ং ধাস্যতি) ।
এই বলিয়া ইন্দ্র শিশুমুখে অমৃতস্রাবিণী প্রদেশিনী অর্পণ করিলে, শিশু অঙ্গুলি পান করিয়া বর্দ্ধিত হইল । ‘মাময়ং ধাস্যতি’ হইতে ‘মান্ধাতা’ (মাম্+ধাতা) নামের উৎপত্তি । ইনি চক্রবর্ত্তী হইয়া সদ্বীপা পৃথিবী ভোগ করেন ।) মান্ধাতার-আমল = মান্ধাতার শাসনকাল; (গৌণার্থে) অতিপ্রাচীন কাল ।” - (ব.শ. ও পৌ.অ.) ।
"ব্যক্তির মাং-কে (মাম্কে) বা 'আমিত্ব'কে ধারণপূর্ব্বক তারণ করে যে (দ্র. মাংস); অথবা, ব্যক্তির 'আমিত্ব' বা স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করিয়া তারণ করে যে; কিংবা, যে সত্তা 'আমিত্ব'কে (ইন্দ্রকে) পান করিয়া (সব বিষয়ে 'আমি' 'আমি' করিয়া) বড় হইতে থাকে; অথবা, ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে কাল হইতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও সমাজে রাজত্ব করিতে শুরু করিয়াছিল; কিংবা, পুরাণ অনুসারে যে শিশু সম্পর্কে ইন্দ্র বলিয়াছিলেন, 'এই শিশু আমাকে পান করিয়া বড় হইবে' " - (সরল শব্দার্থকোষ - কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ।
“...বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পণ্ডিতই কিন্তু এই মুহূর্তে জানেন না, মানুষের সভ্যতায় ও মানবমনে সর্বপ্রথম ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে’র জন্ম হয়েছিল কীভাবে এবং কোথায় ? আজ আমরা কিন্তু সেই উদ্ভবের ইতিহাসটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি । সেই ইতিহাসই মান্ধাতার জন্মের ইতিহাস । একালের ইংরেজি-কলুষিত বাংলায় আমরা যাকে ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ বলি, সেকালের শুদ্ধ পৌরাণিক বাংলায় তাকেই বলা হত মান্ধাতা । মানুষের সমাজে, মানুষের মনে কীভাবে তার জন্ম হয়েছিল, সেকথাই উপরের দেওয়া বয়ানে বলা হয়েছে; বলা হয়েছে ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় । সেই কাহিণীর খোসা একটু একটু করে ছাড়িয়ে নিতে পারলেই পাওয়া যাবে পুরো ইতিহাসটাই ।
কার্যত, এখনও আমাকের দুজন ধাতা - ‘বিধাতা’ আর ‘মান্ধাতা’, ‘যৌথতাবাদ’ (সমাজতন্ত্রবাদ) ও ‘আমিত্ববাদ’ (ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ) ।
সনাতন যুগ পেরিয়ে বৈদিক যুগে পা রাখার পর থেকে বিধাতা নামক যৌথতাবাদের বা অধঃপতিত সমাজতন্ত্রবাদের (বৈদিক বিধিসমূহের) রীতিনীতির অধীনে মানুষের বাঁচা-মরার সূচনা হয় এবং নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সেই যৌথতাবাদ শত শত রূপ বদল করে আজো চলছে । তার কিছুকাল পরেই জন্ম হয় মান্ধাতার বা ‘মাম্-ধাতা’র -- আমিত্ববাদের, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের, পুঁজিবাদের । যৌথতার গর্ভে সে জন্মায় না, স্বভাবতই যৌথতার মাতৃদুগ্ধ পান করে সে বড় হয় না, আমিত্বের (ইন্দ্রের) আঙ্গুল চুষেই সে বড় হয় । তার পর থেকে যখনই স্বাতন্ত্র্যবাদী কোনো ব্যাপারের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলত, তাকে উত্তর দেওয়া হত -- ‘এ ব্যাপার তো মান্ধাতার-আমল থেকে চলে আসছে । এখন তাতে আপত্তি কেন ? কালে কালে স্বাতন্ত্র্যবাদের পক্ষে এইভাবে বলবার রীতিটি যে কোনো আদি ব্যাপারের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হতে শুরু করে এবং মান্ধাতার আমল কথাটির তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে । এখনও তাৎপর্যহীনভাবে মান্ধাতার আমল ও ‘আঙ্গুল চোষা’র ব্যাপারটি যথারীতি প্রচলিত আছে, তাৎপর্য হারিয়েই । …
তবে আজ এখানে আমরা মান্ধাতার ও ‘আঙ্গুল-চোষার’র উত্তরাধিকারের সব কথা বলতে বসব না । শুধু রবীন্দ্রনাথের একটি কথা বলতে চাই । কথাটি হল - প্রকৃতপক্ষে মানুষের ‘মাং-ধাতা’র (বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ব্যবস্থার) ও ‘বি-ধাতা’র (সামাজিক-ধাতার বা যৌথতাবাদী ব্যবস্থার) কোনো একটিকে নিয়ে মানুষের স্বাভাবিকভাবে বাঁচার উপায় নেই । সে চেষ্টা সবসময়ই মানবসভ্যতার ক্ষতি করে, করেছে । দুটি ব্যবস্থার সামঞ্জস্যেই মানুষের বঁচা-মরা স্বাভাবিক হতে পারে । ‘ততঃ কিম’ জাতীয় কয়েকটি নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বিষয়টিকে অনেক সহজ করেই উপস্থাপিত করেছেন । আমাদের ‘দিশা থেকে বিদিশা’-গ্রন্থের একেবারে শুরুতেই আমরা সেই সামঞ্জস্যকে পৃথিবীর আহ্ণিক গতির পর্যায়ে ব্যাখ্যা করেছিলাম । তাতে বলা হয়েছিল, ‘পৃথিবীটা এমন এক নিখুঁত আত্মকেন্দ্রিকতায় ঘুরে চলেছে যে তাতেই তার সূর্যের চারদিকেও ঘোরা হয়ে যায় । এমন আত্মকেন্দ্রিকতাও অতএব সম্ভব, যাতে সার্ব্বজনীনতার সাফল্যও নিশ্চিত হতে পারে ।” - (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী রচিত ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ থেকে) ।
0 মন্তব্যসমূহ