চুপি চুপি মুম্বই থেকে পালিয়ে আসছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ,,,,
কোলকাতা ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল।
একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁকে প্রায় ধরেবেঁধে আটকান প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়। —‘‘আমি তোমাকে এখানে এনেছি। তুমি চলে গেলে, তুমি তো হারবে না, আমি হেরে যাব। একটা হিট ছবি দিয়ে তুমি যেখানে খুশি চলে যাও। আমি বাধা দেব না।’’
‘ফিল্মিস্তান’ স্টুডিয়োর তখন সর্বেসর্বা শশধর মুখোপাধ্যায়। পরিচালক হেমেন গুপ্তকে দিয়ে ‘আনন্দমঠ’ ছবির জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে মুম্বইতে নিয়ে যান তিনি।
ফিল্মিস্তান-এর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক তখন অতি খারাপ বললেও কম বলা হয়। তবু তাঁকে দিয়ে ছবির জন্য ‘বন্দেমাতরম’ গাইয়ে প্রায় অসাধ্যসাধন করেছিলেন হেমন্তকুমার। নিজে গেয়েছিলেন ‘জয় জগদীশ হরে’। গীতা দত্তের সঙ্গে ডুয়েট।
গান তো জনপ্রিয় হল, কিন্তু ছবি? সুপার ফ্লপ। তার পরেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চলে আসতে চান কলকাতা। ভিটি স্টেশন থেকে লুকিয়ে ফোন করে সে-খবর শশধর মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছে দেন হেমন্ত-পত্নী বেলা।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ফেরা হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি! এর পরই যে ‘নাগিন’! যে ছবির গানের রেকর্ড কুড়ি বছর বাদে ভেঙেছিল ‘ববি’।
অথচ এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই কি’না এক সময় রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। জলসায় গাইতে দেবার আশ্বাস পেয়েও ঠায় চার ঘণ্টা বসে থেকে শুনেছেন, ‘‘দূর মশাই, আপনার গান কে শুনবে? দেখছেন না, পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন! ওঁর গান শুনে বাড়ি চলে যান।’’
ভেবে বসেছিলেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাহিত্যিক হবেন। গল্প লিখতেন। তার কয়েকটি প্রকাশও পেয়েছিল। যার একটি তো একেবারে ‘দেশ’ পত্রিকায়— ‘একটি দিন’। তখন সাহিত্যিক হবার স্বপ্নে তিনি মশগুল।
গায়ক-বন্ধুর ব্যাপারে স্কুলবেলার সহপাঠী সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রমাকৃষ্ণ মৈত্ররা শুধু হাল ছাড়েনি। তাই রক্ষে।
•••••
প্রথম রেকর্ড বেরনোর পর সেটাকে কাগজে মুড়ে হাতে নিয়ে চেনাজানা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যাতে কারও কৌতূহল হয়, জানতে চান, ওটা কী! ধীরে ধীরে গান গাওয়া তখন অস্থিমজ্জায় ঢুকে পড়েছে।
শচীনকর্তার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যদি কর্তার দু’কলি ভেসে আসে, অঞ্জলি পেতে নেবেন!
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শুনছেন কোনও বাড়িতে পঙ্কজ মল্লিকের গান বাজছে, স্তব্ধ হয়ে ভেবেছেন, ‘‘আমারও গান কি কোনও দিন এমন ঘরে ঘরে বাজবে?’’
তখন ওই যুবক যদি জানতেন, ঘরে-ঘরে কেন, তাঁর শ্রোতার দলে এক দিন নাম লেখাবেন উস্তাদ আমির খান, মেহদি হাসান!
দিল্লির এক জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে মুগ্ধ উস্তাদজি বলেছিলেন, ‘‘তোমার গান শুনছিলাম এতক্ষণ।’’
আর গজল-শাহেনশা মেহদি হাসান বলতেন, ‘‘দেখা হলে লতাজির কণ্ঠে একটা চুমু দিতে চাই।’’ আর পুরুষ-কণ্ঠ হলে?— ‘‘হেমন্তকুমারের। এই উপমহাদেশের সেরা কণ্ঠস্বর হেমন্তকুমারের।’’
এই সেদিন আরতি মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘হেমন্তদা’-কে নিয়ে বলতে গিয়ে মেহদি-প্রসঙ্গ তুললেন।
বলছিলেন, ‘‘মধ্য কলকাতার এক নামী হোটেলে মেহদি হাসানকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সংবর্ধনার দিন মেহদি হাসানের সঙ্গে বসে আছি। হেমন্তদা হাঁকডাক করে তদারকিতে ব্যস্ত। হাসানসাহেব এক দৃষ্টিতে হেমন্তদাকে লক্ষ্য করছিলেন। এক সময় নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘ক্যায়া আওয়াজ পায়া হ্যায়! ইয়ে খুদা কি দেন্ হ্যায়।’
অনেক কষ্টে সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি কোনও দিন কেউ হেমন্তদার আওয়াজ আর আপনার গায়কি নিয়ে জন্মায়?’
সঙ্গে সঙ্গে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ইন্শাল্লা! খুদা কি মর্জি। তব্ হী ইয়ে চমৎকার হো সকতে’—।’’ কেবল মাত্র খোদার ইচ্ছেতেই এমন জাদু ঘটা সম্ভব।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক হওয়া হয়নি। কিন্তু ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিকে পাশ করার পর বাবার ইচ্ছেয় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে হয়েছিল। যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
আসলে চার ছেলে, এক মেয়ের দ্বিতীয় হেমন্তকে নিয়ে ছোট থেকেই বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের অনেক আশা। চোদ্দো পুরুষের ভিটে বড়ুগ্রাম ছেড়ে কালিদাস পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন ভবানীপুরের ২৬/২এ রূপনারায়ণ নন্দন লেনে। দু’ঘরের বাড়ি।
ম্যাকনিন ম্যাকেনজির সাধারণ কেরানি কালিদাস। টানাটানির সংসার। মিত্র ইনস্টিটিউশনের মতো বেশি মাইনের স্কুলে ছেলেদের পড়ানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কিন্তু মেজ ছেলের পড়াশুনোয় আগ্রহ দেখে হেডমাস্টারমশাইকে ধরেটরে হাফ-ফি-তে কোনওক্রমে ভর্তি করেছিলেন।
ছেলে পড়াশুনোয় তো ভালই, কিন্তু গোলটা বাধল ঠিক ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার তিন মাস আগে। স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে!
তার মূলেও কিন্তু ওই গান! টিফিন টাইমে অন্যরা সব খায়-দায়। কালিদাসবাবুর মেজছেলের না আছে বাড়ির দেওয়া টিফিন, না পকেটে কানাকড়ি। বন্ধুদের নিয়ে সে টেবিল বাজিয়ে গান গায়। পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেববর্মনের রেকর্ডের গান। তাতে এমন হইচই, হট্টগোল রেজিস্টার থেকে নাম কেটে দিয়ে বলা হল— ‘‘যাও, এ বার গান গেয়ে বেড়াও গে যাও।’
ফাইনাল পরীক্ষার বাকি তখন সবে তিন মাস! কালিদাসবাবু স্কুলে গিয়ে প্রায় হাতে-পায়ে ধরে সে-যাত্রায় ছেলেকে রক্ষা করেন। এর পরও যখন ফার্স্ট ডিভিশন পেল ছেলে, খুব চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু তত দিনে গান যে তাকে পেয়ে বসেছে!
বন্ধু সুভাষ অসিতবরণকে ধরে রেডিয়োয় অডিশনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। অভিনেতা অসিতবরণ তখন রেডিয়োয় তবলা বাজান।
অডিশনে পাশ করার তিন মাস বাদে প্রোগ্রামের চিঠি এল। গান শুনে পাহাড়ী সান্যাল বললেন, ‘‘বাহ্, চর্চা করলে ভাল গাইয়ে হবে।’’ পঙ্কজ মল্লিক এক দিন আকাশবাণীতে অনুজ হেমন্তকে দেখে বললেন, ‘‘তুমি তো দেখছি আমাদের ভাত মারবে!’’
ই়ঞ্জিনিয়ারিংটা হল না। বাবা দুঃখ পেয়েছিলেন, তবু ’৩৮ সালে কলেজে ইস্তফা দিয়ে বসল ছেলে।
এই সময়কাল, তার অল্প আগে পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের জীবনে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকল। বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বেরল। রেডিয়ো থেকেও ঘন ঘন ডাক। ‘মহালয়া’। আইপিটিএ। সলিল চৌধুরী। প্রথম প্লে-ব্যাক।
কিন্তু তার পরেও যে খুব সুদিন চলছিল সংসারে, তেমন হয়তো নয়। অর্থের কারণেই বহু দিন পর্যন্ত গানের টিউশানি ছাড়তে পারেননি। বাঁধা রোজগারের জন্য গ্রামাফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে গানের ক্লাস নিতেন। বলতেন, ‘‘টিউশনি না করলে খাব কী?’’
’৪৫ সালে বিয়ে করলেন বেলা মুখোপাধ্যায়কে। স্ত্রী, পাঁচ-পাঁচটি নাবালক শ্যালক-শ্যালিকা নিয়ে নতুন সংসার পাতলেন ইন্দ্র রায় রোডের ভাড়া বাড়িতে। ’৪৭-এ প্রথম সন্তান, জয়ন্ত। ’৫৪-তে রাণু।
দিন কতক আগে কলকাতায় এসে জয়ন্ত বলছিলেন, ‘‘রাণু ঠিক মতো গানটা গাইল না বলে বাবার খুব দুঃখ ছিল। বিশেষ করে শ্রাবন্তী মজুমদারের সঙ্গে ডুয়েট ‘আয় খুকু আয়’ গানটা রাণুরই করার কথা ছিল। বালসারাজি রাণুর কথা ভেবেই গানটা কম্পোজ করেছিলেন। মনে আছে, ‘মাসুম’ ছবির গান ‘নানী তেরি’-র শেষ অন্তরাটা গাড়িতে বাবা কী যত্নে রাণুকে শেখাতে শেখাতে নিয়ে যাচ্ছে রেকর্ড করাতে। রাণুকে না পেয়ে ফিমেল ভয়েস-এর জন্য কবিতা কৃষ্ণমূর্তিকে নেয়। কবিতার আসল নাম ছিল সারদা। বাবাই ওকে কবিতা নাম দেয়। বাবার সঙ্গে ও নানা জায়গায় গাইতে যেত। পরে মান্না দে’ও বাবার কাছ থেকে ওকে প্রোগ্রাম করতে নিয়ে যেত।’’
জয়ন্তর কাছে শোনা গেল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম হিন্দি ছবি ‘বিশ সাল বাদ’-এর নেপথ্য-গল্প। ছবিটি নাকি তৈরি হয়েছিল ‘ডালডা’র সবচেয়ে বড় বড় ডাব্বায় জমানো টাকা দিয়ে! ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা! সেই ’৬০-’৬১ সালে টাকাটা নেহাত কম নয়।
এই সময়ের ঠিক আগে ছ’মাস গান গাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। গলায় কী একটা অসুবিধের জন্য গাইতে পারছিলেন না। ভেবে বসেছিলেন, আর বোধ হয় কোনও দিন গানই গাওয়া হবে না।
ঠিক এমন সময়ই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে প্রস্তাব দেন, ‘‘আমি ছবি করছি, তিন দিন বাদে ‘ফিল্ম সেন্টার’ স্টুডিয়োতে রেকর্ডিং। আমি তোমাকে জোর করব না। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি এসো।’’
এসেছিলেন লতাজি। গেয়েওছিলেন। আর সম্মানদক্ষিণা দিতে গেলে ফুঁসে উঠে বলেছিলেন, ‘‘দাদা, আপ মুঝে প্যয়সা দে রহেঁ হ্যায়?’’ ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন খাম।
লতা মঙ্গেশকর-আশা ভোঁসলে দুজনেই কোনও দিন গানের জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অর্থ নেননি। জয়ন্ত বলছিলেন, ‘‘মাত্র দু’মিনিটে গানের মুখড়াটা করেছিল বাবা। আমি তখন বছর চোদ্দোর ছেলে। এক দিন দেখি, বাবা ‘কত দিন গেল কত রাত’ গানটা গুন গুন করে গাইছে। তার পরই আমায় ডেকে বলল, ‘চল তো বাবু সুরটা করি। আমি ঠেকা দিয়ে গেলাম তবলায়। বাবা মুহূর্তে সুর করে ফেলল— ‘কঁহি দীপ জ্বলে…’।’’
•••••
১৯৮৯-এর ২৭ সেপ্টেম্বর। সকাল। ভোরবেলা কেমন একটা হাহাকার ভেতর থেকে ঠেলে তুলে দিল। রেডিয়ো, টিভি, ক্যাসেটে ঘরে ঘরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা বড় ভীষণ জোরে বাজছে— ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’।
সারা রাত বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে থেকে ভোরের অপেক্ষা করছিলাম। যে ভোরে শরতেই হেমন্ত নেই। গত রাত, ২৬ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার সওয়া এগারোটায় চলে গিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
চলতে না চাওয়া শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পৌঁছলাম মেনকা সিনেমার উল্টো দিকে, তাঁর ফ্ল্যাট বাড়িতে। কাতারে কাতারে মানুষ।
যে বাড়িতে কারণে-অকারণে আবারিত দ্বার পেয়েছি, এ দিন তা-ই অবরুদ্ধ জনস্রোতে। তারই মাঝে এক জন চিনতে পেরে ডেকে নিলেন। চার তলার হল ঘর। সেখানেও মানুষ আর মানুষ শুধু। কিন্তু কারও দিকে চোখ যাচ্ছে না। শুধু দেখছি ছোটবেলা থেকে দেখা সাড়ে ছ’ফুট লম্বা সেই মানুষটিকে। বরফের বিছানায় ধবধবে সাদা চাদরে গলা অবধি ঢেকে ঘুমিয়ে আছেন।
চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সাড়ে চার মাস আগের, ৪ মে ১৯৮৯-এর বিকেল। সাহিত্যিক-বন্ধু আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে শেষ রওনা করিয়ে দিতে আসা, তার হিমঠান্ডা কপালে হাত রেখে ফুঁপিয়ে ওঠা, ওই মানুষটিকে। পিতৃহারা আমার পাশে দাঁড়িয়ে কান্নাভেজা ভাঙা গলায় যিনি বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আমার বেলা কে সি-অফ করতে আসবে?’’…
বাইরে তখন থিকথিকে মানুষের ঢল। তাঁকে সি-অফ করতে এসেছেন। চোখের জলে রয়্যাল-স্যালুট দিচ্ছেন তাঁরা…!
0 মন্তব্যসমূহ