সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম সে কখনও করেনা বঞ্চনা
“ইসলামে যদি জঙ্গিবাদ থাকত তাহলে কেন সেটা খালি বর্তমানকালেই দেখা যায়, আগে কেন দেখা যেতো না” প্রশ্নের উত্তর
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কুরআনের জিহাদী টেক্মট তো সেই ১৪০০ বছর ধরে আছে, মুসলমানও আছে তখন থেকে, তাহলে সতের শতক, আঠারো শতক, উনিশ শতকে কেন আমরা কুরআনের ঐ জিহাদী টেক্সটে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানদের জঙ্গি হতে দেখিনি? এর সঠিক উত্তর দিতে না পারলে বাকীরা চেঁচিয়ে মাত করে দিবে যে, ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি মিথ্যে ভীতি শংকা ছড়ানো হয়েছে। সাধাণত বামপন্থিরা এই থিউরী আমদানি করে ‘জিহাদ’ ও ‘খিলাফতকে’ সাম্রাজ্যবাদীদের সমান্তরাল আরেকটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি না ধরে বরং শত্রুর শত্রু বন্ধু থিউরীকে কাজে লাগাতে ব্যগ্র। ইসলামী সন্ত্রাসবাদী শক্তি যেহেতু সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি প্রয়োগ করছে, শত্রুর শত্রু তাদের বন্ধু। বামপন্থি বলতে আজকের পৃথিবীতে কোন শক্তিশালী শিবির নেই বিবদমান শক্তিগুলোর মধ্যে। কিন্তু ইন্টেল্যাকচুয়ালি তাদের একটা উপস্থিতি মিডিয়াতে সরব। বহু বামপন্থি বুদ্ধিজীবীর তত্ত্ব যা পরোক্ষভাবে ইসলামপন্থিদের পক্ষে যায়- সেগুলো ইসলামপন্থিরা নিজের স্বার্থে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। যেমন ইসলামী সন্ত্রাসবাদের জন্য উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে মডারেট ইসলামপন্থিরা আউড়াতে থাকে, কেন শুধু বর্তমানকালেই আমরা দেখছি আইএস, তালেবান, আল কায়দা, বেকো হারামের জন্ম হলো, কেন অন্য শতাব্দীতে মুসলমানরা এরকম ধর্মের নামে উন্মাদ হয়ে যায়নি?… এটা বামপন্থিদের চলতি থিউরী এই শতকে। সাধারণ মানুষ এই কথার সাথে এই তথ্যাগুলোও মিলিয়ে দেখে যে, কিভাবে আমেরিকা সৌদি আরবকে দিয়ে ওহাবী ইসলাম প্রচার করতে অর্থ ঢেলেছিলো। কিভাবে আফগানিস্থানে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে তালেবানদের খাড়া করেছে। আইএসকে অস্ত্র দিয়েছে পশ্চিমারা… ইত্যাদি। এতে করে কি প্রমাণিত হলো? প্রমাণিত হলো আমেরিকাকে শেষ করে দিতে পারলেই এইসব জঙ্গিফঙ্গিও নির্মূল হয়ে যাবে।… আসেন একটু ধৈর্য্য ধরে একদম শুরু থেকে শুরু করি। তা না হলে বুঝতে সহজ হবে না…।
১৪০০ বছর আগে আরবের এক স্বধর্মদ্রোহী মুরতাদকে অস্ত্র অর্থ আশ্রয় দিয়ে সেল্টার দিয়েছিলো মদিনার আকাবার অঞ্চলের লোকজন। এই সেল্টার মক্কার নবী দাবীকৃত মুহাম্মদ তার নবুত্তের ১১তম বছরে এসে লাভ করে। এই সেল্টার লাভ করার পরের বছরই কুরআনে প্রথম রক্তপাতের মাধ্যমে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার আয়াত নাযিল হয় (সূরা হজ্জ ৩৯-৪১)। কুরআনের এই অনুমতির পরই মক্কার বাণিজ্য কাফেলার উপর সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। মক্কার একজন নবী আকাশ থেকে আয়াত নাযিল করে রক্তপাতের অনুমোদন নিচ্ছে এবং তার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে, এসবের সমস্ত দায় কি এখন মদিনবাসীদের নিতে হবে? তারা তো সেল্টার দিয়েছিলো নবী মুহাম্মদকে অর্থ ও আশ্রয় দিয়ে।
শুরু হয় জিহাদের যুগ। অস্ত্রের মাধ্যমে ইসলামের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক এক করে প্রতিটি জনপদ দখল করে সেখানে ইসলামী ফিলোসফি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মুহাম্মদের জমানায় মদীনার আশপাশ পর্যন্ত ইসলামী খিলাফত (শাসন) প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিলো। তার মৃত্যুর পর পরবর্তী খলিফারা (শাসকরা) যেমন আবু বকর, উমার বিন খাত্তাব, উসমান, মুয়াবীয়ার জমানায় ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত এসেছিলো ইসলামী সেনানীরা। এসব আক্রমণ থেকে লুন্ঠিত সম্পদ ও নারীমাংসের চালান ইসলামী খিলাফতের হেডকোয়াটার মক্কায় পৌঁছে যেত। এ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু তারপরই নানা ধাপে যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু আক্রমন চালান সেটিকে আর ‘জিহাদ’ বলতে অনেকেরই আপত্তি! কারণটা এটাই যে জিহাদ বা ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তৃতি, গণিমত লুন্ঠনের অভিযান তখন ইসলামী খিলাফতের বেতনভুক্ত সৈনিকরা করে থাকত। কারণ ইসলাম তখন কোন গেরিলা আন্দোলন নয়। ইসলাম একটি প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য। জিহাদ তখন খলিফার নির্দেশে মুসলিম সৈনিকরা করে থাকে। আবার সুদীর্ঘকাল ব্যাপী এই ইসলামী খিলাফত আরব হতে আফ্রিকা, ইউরোপ হতে এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভকালে খিলাফতের চেহারা এক রকম থাকেনি। কোথাও পরিস্কার ইসলামী শাস্ত্র থেকে খলিফারা সরে যান। যেমন তুরস্কের খিলাফতের বিরুদ্ধে শিরক বিদাতের অভিযোগ তুলে মুহাম্মদ বিন সৌদ ও মুহাম্মদ বিন ওহাব মিলে জিহাদ ঘোষণা করেন। মুহাম্মদ বিন ওহাব ইসলামের পুণর্জাগরণের ডাক দিয়েছিলেন কারণ ইসলামের খিলাফত তখন জিহাদ ভুলে গিয়ে কুফরি মতবাদে ঝুঁকে পড়ছিলো। ঠিক এরকম অভিযোগ করে ইমাম গাজ্জালি ইসলামের পুর্ণজাগরণে ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ বিন সৌদ তার আধ্যাত্বিক নেতা ওহাবের ইসলামের পুনর্জাগরণ আন্দোলনে মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করায় বিরোধীরা ‘ওহাবী মতবাদ’ নামে এটাকে আলাদা একটা মতবাদ হিসেবে প্রচার করে। পরাজিত খিলাফতকারীরা ‘ওহাবী সৌদিদের’ ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী আখ্যা দেয়। প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘকাল ধরে চলা খিলাফত ইসলাম ধর্মের মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়ায় আবদুল ওহাব পূর্ব পুরুষ নবী মুহাম্মদের ইসলামের শাসনে ফেরার ডাক দেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভারতে হামলার সময় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে যার ফয়সালা হয়েছিলো হাদিসের রেফারেন্সে। ভারতের অধিবাসীদের সকলেই যেহেতু পৌত্তলিক এবং তাদের কোন নবী নেই তাই কুরআনের আয়াত অনুসারে তাদের একটাই পথ খোলা ইসলাম গ্রহণ করে নিজের জীবন বাঁচানো। ভারতের জনগণ খ্রিস্টান হলে তারা জিজিয়া কর দিয়ে বসবাসের অনুমতি পেত। এখন সমস্ত হিন্দুদের মেরে ফেললে জিজিয়া কর কে দিবে? হিন্দুদের বরং বাঁচিয়ে রাখলে নিয়ম করে জিজিয়া উশুল করা যাবে। কিন্তু কুরআনের আয়াতকে অগ্রাহ্য করা যাবে কিভাবে? শেষতক খোঁজ করে দেখা গেলো নবী মদিনার ছোট একটা পৌত্তলিক গোষ্ঠিকে জিজিয়ার বিনিময়ে বসবাসের অনুমতি দিয়েছিলেন। এভাবেই সেদিন স্থানীয় হিন্দুদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো। অপর দিকে, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ প্রথম তার শাসনে স্থানীয় হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ দান করেন। খেয়াল করুন, মুহাম্মদ বিন কাসেম যখন কুরআন হাদিস থেকে হিন্দুদের নিয়তি নির্ধারণ করেন তার বহু বছর পর আরেক মুসলিম শাসক হিন্দুদের নিজের দপ্তরে নিয়োগ দান করছেন। এটাকে ইসলামী শাস্ত্রবিদরা বলেন মুসলমানের কুফরির দিকে ঝুঁকে পড়া। যেমন গিয়াসুদ্দীন আজমকে তখনকার সুফি দরবেশ মাওলানা মুজাফর বলখি চিঠি লিখে নিজের আপত্তি জানিয়ে বলেন, সুলতান পরিস্কারভাবে ইসলামকে লঙ্ঘন করছেন। কাফেরদের ছোটখাটো কাজ দেয়া চলে কিন্তু কিছুতে মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার দেয়া চলা না। সুফিদের আপত্তির ফলে সুলতান তখন তার নিয়োগ বাতিল করে দেন। দেখা যাচ্ছে কেমন করে ইসলামী তথা মুসলমানদের শাসকদের শাস্ত্র থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং তার জন্য তাদের দায়ী করে শাস্ত্রবিদদের উদ্বিগ্ন হওয়াটা সমসাময়িককালেই দেখা যায়। আমাদের খালি চোখে বর্তমান বিশ্বে বিচ্ছিন্নভাবে জিহাদীদের হত্যাযজ্ঞ, এককভাবে আত্মঘাতি প্রচেষ্টার সঙ্গে ইসলামী শাসনের জিহাদকে মেলানো সম্ভব নয়। কারণ মুসলমানরা যখন ক্ষমতায় থাকবে তখন জিহাদ করবে রাজ্য দখলের জন্য, গণিমতের জন্য। যখন তারা ক্ষমতাহারা থাকবে তখন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে, সম্ভব হলে এককভাবে ইসলামের ডাক দিয়ে জিহাদ করতে হবে। জিহাদ যেহেতু ইসলামের একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য, তাই যখন মুসলমানরা গভীরভাবে ইসলাম প্রক্টিস করবে তখনই এটা মুসলমানদের মধ্যে বেশি করে দেখা যাবে। ইসলামী খিলাফতকালে সাধারণ জনগণকে জিহাদ করতে হতো না। ইসলামী সেনাদল মুসলমানদের ইমামের নির্দেশে জিহাদে যোগ দিত। কিন্তু খিলাফত বিচ্যুত মুসলমানরা চোরাগুপ্তভাবে, সম্মলিতভাবে, এমনকি নানা রকম ছদ্মবরানে জিহাদ করবে। ইউরোপে হিজাবের অধিকার চেয়ে শোরগোল তোলা হচ্ছে ইসলামের স্পীডকে জানান দেয়া যা একটি জিহাদ হিসেবে গোণ্য। আমরা যদি প্রশ্ন করি কেন আঠারো উনিশ শতকে মুসলমানদের আজকের যুগের মত জিহাদ করতে দেখিনি- তার সূচনা উত্তর হবে, আমরা জিহাদের ছদ্মাবরণকে চিনতে পারিনি। খেয়াল করুন, ইসলামের শেষ খিলাফতের পতন ঘটল তুরস্কে। ব্রিটিশরা তখন সারা পৃথিবীতে তাদের কলোনি তৈরি করেছে। ফরাসী বিপ্লবের পরই পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদ আন্দোলন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পেতে এক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদ তখন পৃথিবীর নতুন দর্শন। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়কালেও মুসলমানরা তাদের খিলাফত পুণরুদ্ধারে ব্যগ্র! অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলন করেছিলো। তুরস্কের খলিফাকে তারা নিজেদের খলিফা বলে সমর্থন করেছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মুসলমানরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিলো এই খিলাফত রক্ষার স্বার্থে। ভারতে যখন ইংরেজ খেদাও আন্দোলন চলছে তখন মুসলমানরা তুরস্কের খিলাফত রক্ষা করতে তাদের নেতাকে (তুরস্কের খলিফাকে) রক্ষা করতে সারা ভারতকে গরম করে ফেলছে। এটা কি ইসলাম নিয়ে উন্মাদনা নয়? এটা কি জিহাদী উত্থান নয়? ভারত ভাগ করে যে ধর্মীয় বিভাজনে বাংলা ভাগ হলো মুসলমানদের শ্লোগান ছিলো ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহো আকবর’। এটাকে কি জিহাদী উত্থান মনে হয় না আপনাদের?
যদি আরেকটু পিছনে যান, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ চালিয়ে শহীদ হয়েছিলো তিতুমীর। এই তিতুমীর মুসলমানদের হারানো খিলাফত ইংরেজদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে সম্পূর্ণ জিহাদী আদলে লড়াই করেন। তিতুমীরের ভারত ইসলামী খিলাফতের ভারত। হাজি শরীয়তুল্লাহ ভারতের মুসলমানদের ঈদের নামাজ পড়তে বারণ করেছিলেন কারণ ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়াতে ভারত দারুল হার্বে পরিণত হয়েছে। কাফেরদের হাতে থাকা কোন দেশে মুসলমানদের জন্য ঈদের নামাজ পড়া হারাম। আমাদের বহু বামপন্থি বন্ধু তিতুমীর-শরীয়তুল্লাহর জিহাদী আন্দোলনকে স্বীকার করতে চান না। যদি না-ই চান তাহলে কেমন করে উনিশ শতকে জিহাদী উত্থানকে তারা স্বীকার করবে? খিলাফত আন্দোলনকে যদি জিহাদী আন্দোলন বলে স্বীকার করতে না চান তাহলে কেমন করে বিশ শতকে জিহাদী আন্দোলন হয়েছিলো আপনি মেনে নিবেন?
ঢাকার রাস্তায় হেফাজতে মিছিলে জিহাদের উত্থান দেখতে পেলেও সেদিন সমগ্র ভারতের মুসলমানদের রাস্তা জুড়ে খিলাফতের দাবীর পক্ষে মিছিলে জিহাদের উত্থান দেখতে না পাওয়া আপনার রাজনৈতিক আদর্শের সীমাবদ্ধতার ফল। পাকিস্তান হবার পর পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা অন্তত কয়েক দশক ইসলামী আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো কারণ তখন তারা পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী পাঠানদের হাতে বাঙালী পরিচয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। অবধারিতভাবেই তাই তখন তাদেরকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ধারণ করে অধিকার চাইতে হচ্ছিল। কিন্তু আদতে তারা পাকিস্তান আন্দোলনে আদর্শ থেকে চুল পরিমাণ বের হয়ে আসেনি। তার প্রামণ সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মুসলমানিত্ব প্রকটভাবে দৃশ্যমাণ হওয়া।
ধর্মের একটা স্পীড আছে যা জনগণের মাঝে জাগিয়ে তুলতে হয়। যেটা ইসলামে ইমাম গাজ্জালি, আবদুল ওহাব থেকে বর্তমানকালের আল কায়দা, তালেবান দলগুলোর প্রধান আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা শায়েখ আবদুল্লাহ আযমরা করেছেন। মানুষের ভাষা যেমন কয়েক মাইল পরে গিয়ে একটু করে পাল্টে গেছে তেমনি ধর্মগুলোও মহাদেশ পরিভ্রমণকালে আঙ্গিকে কিছুটা বদলে গিয়েছে। এই বদলে যাওয়াকে ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশেও আশির দশক থেকে সূচনা ঘটে। যার ফলশ্রুতিতে ‘খোদা হাফেজ’ হয়ে উঠেছিলো ‘আল্লাহ হাফেজ’। মুসলমানদের অমুসলিম প্রীতি, সেক্যুলার মতবাদ গ্রহণ এবং সর্বধর্মীয় রাষ্ট্র তাদেরকে কোনদিন খিলাফত কায়েম করতে দিবে না। আফগানিস্থান ছিলো একটি সেক্যুলার শাসনাধীন আধুনিক সমাজ। কিন্তু সেখানে পার্বত্র অঞ্চলে যে বিশাল মাদ্রাসা ছিলো সেখানে ঠিকই সপ্তম শতাব্দীর মুহাম্মদের খিলাফত জিহাদকে নিষ্ঠার সঙ্গে চর্চা করা হত। সেই দর্শন চর্চাকারী মাদ্রাসার একজন ছাত্র মোল্লা ওমর আফগান মুসলমানদের তেজদীপ্তভাবে জিহাদের মাধ্যমে বাতিল কুফরি বিদাতকে বিদায় করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন। আফগানিস্থানের পার্বত্র অঞ্চলের কঠিন পরিবেশে দরিদ্র আফগানদের সমর্থন আদায় করতে ওমরের অসুবিধা হয়নি কারণ শিক্ষিত ধনীদের হাতে কোন না কোনভাবে দরিদ্ররা বঞ্চিত হয়ে থাকেই। ওমর দরিদ্র মুসলমানদের নবীর আদেশের সঙ্গে তাদের আগামী সুখি জীবনের আশ্বাস দেন যা কেবলমাত্র ইসলামই তাদের দিতে পারে। মার্কিন গোয়েন্দারা এরকম একটা নেতাকেই খুঁজছিলো যে তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে পারবে। মার্কিন ইনভেস্টমেন্ট এভাবেই তালেবানকে গড়ে তুলে। মুহাম্মদকে যেভাবে মদিনাবাসী ১৪০০ বছর আগে গড়ে তুলেছিলো!
শেষকথা, কোনটা জিহাদ সেটা নিয়ে ইসলামী শাস্ত্রবিদরাই বিতর্ক শুরু করেন। যেমন বর্তমান আইএসের জিহাদকে একদল আলেম জিহাদ হিসেবে মানেন না। যেমন আমরা ভারতবর্ষের মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনকে জিহাদী আন্দোলন বলে মানি না! যেমন কেউ কেউ জিহাদকে আমেরিকার সৃষ্টি বলে মানেন। তারা মনে করেন আমেরিকারকে ধ্বংস করতে পারলে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাবে। এই মনে করাতে আর মনে করানোতে ইসলামের কিছু যায় আসে না। তার টেক্সট তার জন্য ততদিন পর্যন্ত একজন জিহাদী তৈরি করে যাবে লড়াই করার জন্য যতদিন পর্যন্ত জঙ্গিবাদকে আমেরিকা, ইহুদী, অর্থনীতি, দারিদ্রতা, প্রেম ভালবাসা, অভিমান, ক্ষোভ, দু:খ ইত্যাদি ফ্যাক্ট দেখিয়ে ইসলামের অনুপ্রেরণাকে আড়াল করা হবে।
“ইসলামে যদি জঙ্গিবাদ থাকত তাহলে কেন সেটা খালি বর্তমানকালেই দেখা যায়, আগে কেন দেখা যেতো না” প্রশ্নের উত্তর
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কুরআনের জিহাদী টেক্মট তো সেই ১৪০০ বছর ধরে আছে, মুসলমানও আছে তখন থেকে, তাহলে সতের শতক, আঠারো শতক, উনিশ শতকে কেন আমরা কুরআনের ঐ জিহাদী টেক্সটে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানদের জঙ্গি হতে দেখিনি? এর সঠিক উত্তর দিতে না পারলে বাকীরা চেঁচিয়ে মাত করে দিবে যে, ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি মিথ্যে ভীতি শংকা ছড়ানো হয়েছে। সাধাণত বামপন্থিরা এই থিউরী আমদানি করে ‘জিহাদ’ ও ‘খিলাফতকে’ সাম্রাজ্যবাদীদের সমান্তরাল আরেকটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি না ধরে বরং শত্রুর শত্রু বন্ধু থিউরীকে কাজে লাগাতে ব্যগ্র। ইসলামী সন্ত্রাসবাদী শক্তি যেহেতু সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি প্রয়োগ করছে, শত্রুর শত্রু তাদের বন্ধু। বামপন্থি বলতে আজকের পৃথিবীতে কোন শক্তিশালী শিবির নেই বিবদমান শক্তিগুলোর মধ্যে। কিন্তু ইন্টেল্যাকচুয়ালি তাদের একটা উপস্থিতি মিডিয়াতে সরব। বহু বামপন্থি বুদ্ধিজীবীর তত্ত্ব যা পরোক্ষভাবে ইসলামপন্থিদের পক্ষে যায়- সেগুলো ইসলামপন্থিরা নিজের স্বার্থে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। যেমন ইসলামী সন্ত্রাসবাদের জন্য উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে মডারেট ইসলামপন্থিরা আউড়াতে থাকে, কেন শুধু বর্তমানকালেই আমরা দেখছি আইএস, তালেবান, আল কায়দা, বেকো হারামের জন্ম হলো, কেন অন্য শতাব্দীতে মুসলমানরা এরকম ধর্মের নামে উন্মাদ হয়ে যায়নি?… এটা বামপন্থিদের চলতি থিউরী এই শতকে। সাধারণ মানুষ এই কথার সাথে এই তথ্যাগুলোও মিলিয়ে দেখে যে, কিভাবে আমেরিকা সৌদি আরবকে দিয়ে ওহাবী ইসলাম প্রচার করতে অর্থ ঢেলেছিলো। কিভাবে আফগানিস্থানে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে তালেবানদের খাড়া করেছে। আইএসকে অস্ত্র দিয়েছে পশ্চিমারা… ইত্যাদি। এতে করে কি প্রমাণিত হলো? প্রমাণিত হলো আমেরিকাকে শেষ করে দিতে পারলেই এইসব জঙ্গিফঙ্গিও নির্মূল হয়ে যাবে।… আসেন একটু ধৈর্য্য ধরে একদম শুরু থেকে শুরু করি। তা না হলে বুঝতে সহজ হবে না…।
১৪০০ বছর আগে আরবের এক স্বধর্মদ্রোহী মুরতাদকে অস্ত্র অর্থ আশ্রয় দিয়ে সেল্টার দিয়েছিলো মদিনার আকাবার অঞ্চলের লোকজন। এই সেল্টার মক্কার নবী দাবীকৃত মুহাম্মদ তার নবুত্তের ১১তম বছরে এসে লাভ করে। এই সেল্টার লাভ করার পরের বছরই কুরআনে প্রথম রক্তপাতের মাধ্যমে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার আয়াত নাযিল হয় (সূরা হজ্জ ৩৯-৪১)। কুরআনের এই অনুমতির পরই মক্কার বাণিজ্য কাফেলার উপর সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। মক্কার একজন নবী আকাশ থেকে আয়াত নাযিল করে রক্তপাতের অনুমোদন নিচ্ছে এবং তার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে, এসবের সমস্ত দায় কি এখন মদিনবাসীদের নিতে হবে? তারা তো সেল্টার দিয়েছিলো নবী মুহাম্মদকে অর্থ ও আশ্রয় দিয়ে।
শুরু হয় জিহাদের যুগ। অস্ত্রের মাধ্যমে ইসলামের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক এক করে প্রতিটি জনপদ দখল করে সেখানে ইসলামী ফিলোসফি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মুহাম্মদের জমানায় মদীনার আশপাশ পর্যন্ত ইসলামী খিলাফত (শাসন) প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিলো। তার মৃত্যুর পর পরবর্তী খলিফারা (শাসকরা) যেমন আবু বকর, উমার বিন খাত্তাব, উসমান, মুয়াবীয়ার জমানায় ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত এসেছিলো ইসলামী সেনানীরা। এসব আক্রমণ থেকে লুন্ঠিত সম্পদ ও নারীমাংসের চালান ইসলামী খিলাফতের হেডকোয়াটার মক্কায় পৌঁছে যেত। এ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু তারপরই নানা ধাপে যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু আক্রমন চালান সেটিকে আর ‘জিহাদ’ বলতে অনেকেরই আপত্তি! কারণটা এটাই যে জিহাদ বা ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তৃতি, গণিমত লুন্ঠনের অভিযান তখন ইসলামী খিলাফতের বেতনভুক্ত সৈনিকরা করে থাকত। কারণ ইসলাম তখন কোন গেরিলা আন্দোলন নয়। ইসলাম একটি প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য। জিহাদ তখন খলিফার নির্দেশে মুসলিম সৈনিকরা করে থাকে। আবার সুদীর্ঘকাল ব্যাপী এই ইসলামী খিলাফত আরব হতে আফ্রিকা, ইউরোপ হতে এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভকালে খিলাফতের চেহারা এক রকম থাকেনি। কোথাও পরিস্কার ইসলামী শাস্ত্র থেকে খলিফারা সরে যান। যেমন তুরস্কের খিলাফতের বিরুদ্ধে শিরক বিদাতের অভিযোগ তুলে মুহাম্মদ বিন সৌদ ও মুহাম্মদ বিন ওহাব মিলে জিহাদ ঘোষণা করেন। মুহাম্মদ বিন ওহাব ইসলামের পুণর্জাগরণের ডাক দিয়েছিলেন কারণ ইসলামের খিলাফত তখন জিহাদ ভুলে গিয়ে কুফরি মতবাদে ঝুঁকে পড়ছিলো। ঠিক এরকম অভিযোগ করে ইমাম গাজ্জালি ইসলামের পুর্ণজাগরণে ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ বিন সৌদ তার আধ্যাত্বিক নেতা ওহাবের ইসলামের পুনর্জাগরণ আন্দোলনে মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করায় বিরোধীরা ‘ওহাবী মতবাদ’ নামে এটাকে আলাদা একটা মতবাদ হিসেবে প্রচার করে। পরাজিত খিলাফতকারীরা ‘ওহাবী সৌদিদের’ ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী আখ্যা দেয়। প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘকাল ধরে চলা খিলাফত ইসলাম ধর্মের মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়ায় আবদুল ওহাব পূর্ব পুরুষ নবী মুহাম্মদের ইসলামের শাসনে ফেরার ডাক দেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভারতে হামলার সময় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে যার ফয়সালা হয়েছিলো হাদিসের রেফারেন্সে। ভারতের অধিবাসীদের সকলেই যেহেতু পৌত্তলিক এবং তাদের কোন নবী নেই তাই কুরআনের আয়াত অনুসারে তাদের একটাই পথ খোলা ইসলাম গ্রহণ করে নিজের জীবন বাঁচানো। ভারতের জনগণ খ্রিস্টান হলে তারা জিজিয়া কর দিয়ে বসবাসের অনুমতি পেত। এখন সমস্ত হিন্দুদের মেরে ফেললে জিজিয়া কর কে দিবে? হিন্দুদের বরং বাঁচিয়ে রাখলে নিয়ম করে জিজিয়া উশুল করা যাবে। কিন্তু কুরআনের আয়াতকে অগ্রাহ্য করা যাবে কিভাবে? শেষতক খোঁজ করে দেখা গেলো নবী মদিনার ছোট একটা পৌত্তলিক গোষ্ঠিকে জিজিয়ার বিনিময়ে বসবাসের অনুমতি দিয়েছিলেন। এভাবেই সেদিন স্থানীয় হিন্দুদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো। অপর দিকে, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ প্রথম তার শাসনে স্থানীয় হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ দান করেন। খেয়াল করুন, মুহাম্মদ বিন কাসেম যখন কুরআন হাদিস থেকে হিন্দুদের নিয়তি নির্ধারণ করেন তার বহু বছর পর আরেক মুসলিম শাসক হিন্দুদের নিজের দপ্তরে নিয়োগ দান করছেন। এটাকে ইসলামী শাস্ত্রবিদরা বলেন মুসলমানের কুফরির দিকে ঝুঁকে পড়া। যেমন গিয়াসুদ্দীন আজমকে তখনকার সুফি দরবেশ মাওলানা মুজাফর বলখি চিঠি লিখে নিজের আপত্তি জানিয়ে বলেন, সুলতান পরিস্কারভাবে ইসলামকে লঙ্ঘন করছেন। কাফেরদের ছোটখাটো কাজ দেয়া চলে কিন্তু কিছুতে মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার দেয়া চলা না। সুফিদের আপত্তির ফলে সুলতান তখন তার নিয়োগ বাতিল করে দেন। দেখা যাচ্ছে কেমন করে ইসলামী তথা মুসলমানদের শাসকদের শাস্ত্র থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং তার জন্য তাদের দায়ী করে শাস্ত্রবিদদের উদ্বিগ্ন হওয়াটা সমসাময়িককালেই দেখা যায়। আমাদের খালি চোখে বর্তমান বিশ্বে বিচ্ছিন্নভাবে জিহাদীদের হত্যাযজ্ঞ, এককভাবে আত্মঘাতি প্রচেষ্টার সঙ্গে ইসলামী শাসনের জিহাদকে মেলানো সম্ভব নয়। কারণ মুসলমানরা যখন ক্ষমতায় থাকবে তখন জিহাদ করবে রাজ্য দখলের জন্য, গণিমতের জন্য। যখন তারা ক্ষমতাহারা থাকবে তখন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে, সম্ভব হলে এককভাবে ইসলামের ডাক দিয়ে জিহাদ করতে হবে। জিহাদ যেহেতু ইসলামের একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য, তাই যখন মুসলমানরা গভীরভাবে ইসলাম প্রক্টিস করবে তখনই এটা মুসলমানদের মধ্যে বেশি করে দেখা যাবে। ইসলামী খিলাফতকালে সাধারণ জনগণকে জিহাদ করতে হতো না। ইসলামী সেনাদল মুসলমানদের ইমামের নির্দেশে জিহাদে যোগ দিত। কিন্তু খিলাফত বিচ্যুত মুসলমানরা চোরাগুপ্তভাবে, সম্মলিতভাবে, এমনকি নানা রকম ছদ্মবরানে জিহাদ করবে। ইউরোপে হিজাবের অধিকার চেয়ে শোরগোল তোলা হচ্ছে ইসলামের স্পীডকে জানান দেয়া যা একটি জিহাদ হিসেবে গোণ্য। আমরা যদি প্রশ্ন করি কেন আঠারো উনিশ শতকে মুসলমানদের আজকের যুগের মত জিহাদ করতে দেখিনি- তার সূচনা উত্তর হবে, আমরা জিহাদের ছদ্মাবরণকে চিনতে পারিনি। খেয়াল করুন, ইসলামের শেষ খিলাফতের পতন ঘটল তুরস্কে। ব্রিটিশরা তখন সারা পৃথিবীতে তাদের কলোনি তৈরি করেছে। ফরাসী বিপ্লবের পরই পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদ আন্দোলন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পেতে এক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদ তখন পৃথিবীর নতুন দর্শন। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়কালেও মুসলমানরা তাদের খিলাফত পুণরুদ্ধারে ব্যগ্র! অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলন করেছিলো। তুরস্কের খলিফাকে তারা নিজেদের খলিফা বলে সমর্থন করেছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মুসলমানরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিলো এই খিলাফত রক্ষার স্বার্থে। ভারতে যখন ইংরেজ খেদাও আন্দোলন চলছে তখন মুসলমানরা তুরস্কের খিলাফত রক্ষা করতে তাদের নেতাকে (তুরস্কের খলিফাকে) রক্ষা করতে সারা ভারতকে গরম করে ফেলছে। এটা কি ইসলাম নিয়ে উন্মাদনা নয়? এটা কি জিহাদী উত্থান নয়? ভারত ভাগ করে যে ধর্মীয় বিভাজনে বাংলা ভাগ হলো মুসলমানদের শ্লোগান ছিলো ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহো আকবর’। এটাকে কি জিহাদী উত্থান মনে হয় না আপনাদের?
যদি আরেকটু পিছনে যান, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ চালিয়ে শহীদ হয়েছিলো তিতুমীর। এই তিতুমীর মুসলমানদের হারানো খিলাফত ইংরেজদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে সম্পূর্ণ জিহাদী আদলে লড়াই করেন। তিতুমীরের ভারত ইসলামী খিলাফতের ভারত। হাজি শরীয়তুল্লাহ ভারতের মুসলমানদের ঈদের নামাজ পড়তে বারণ করেছিলেন কারণ ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়াতে ভারত দারুল হার্বে পরিণত হয়েছে। কাফেরদের হাতে থাকা কোন দেশে মুসলমানদের জন্য ঈদের নামাজ পড়া হারাম। আমাদের বহু বামপন্থি বন্ধু তিতুমীর-শরীয়তুল্লাহর জিহাদী আন্দোলনকে স্বীকার করতে চান না। যদি না-ই চান তাহলে কেমন করে উনিশ শতকে জিহাদী উত্থানকে তারা স্বীকার করবে? খিলাফত আন্দোলনকে যদি জিহাদী আন্দোলন বলে স্বীকার করতে না চান তাহলে কেমন করে বিশ শতকে জিহাদী আন্দোলন হয়েছিলো আপনি মেনে নিবেন?
ঢাকার রাস্তায় হেফাজতে মিছিলে জিহাদের উত্থান দেখতে পেলেও সেদিন সমগ্র ভারতের মুসলমানদের রাস্তা জুড়ে খিলাফতের দাবীর পক্ষে মিছিলে জিহাদের উত্থান দেখতে না পাওয়া আপনার রাজনৈতিক আদর্শের সীমাবদ্ধতার ফল। পাকিস্তান হবার পর পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা অন্তত কয়েক দশক ইসলামী আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো কারণ তখন তারা পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী পাঠানদের হাতে বাঙালী পরিচয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। অবধারিতভাবেই তাই তখন তাদেরকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ধারণ করে অধিকার চাইতে হচ্ছিল। কিন্তু আদতে তারা পাকিস্তান আন্দোলনে আদর্শ থেকে চুল পরিমাণ বের হয়ে আসেনি। তার প্রামণ সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মুসলমানিত্ব প্রকটভাবে দৃশ্যমাণ হওয়া।
ধর্মের একটা স্পীড আছে যা জনগণের মাঝে জাগিয়ে তুলতে হয়। যেটা ইসলামে ইমাম গাজ্জালি, আবদুল ওহাব থেকে বর্তমানকালের আল কায়দা, তালেবান দলগুলোর প্রধান আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা শায়েখ আবদুল্লাহ আযমরা করেছেন। মানুষের ভাষা যেমন কয়েক মাইল পরে গিয়ে একটু করে পাল্টে গেছে তেমনি ধর্মগুলোও মহাদেশ পরিভ্রমণকালে আঙ্গিকে কিছুটা বদলে গিয়েছে। এই বদলে যাওয়াকে ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশেও আশির দশক থেকে সূচনা ঘটে। যার ফলশ্রুতিতে ‘খোদা হাফেজ’ হয়ে উঠেছিলো ‘আল্লাহ হাফেজ’। মুসলমানদের অমুসলিম প্রীতি, সেক্যুলার মতবাদ গ্রহণ এবং সর্বধর্মীয় রাষ্ট্র তাদেরকে কোনদিন খিলাফত কায়েম করতে দিবে না। আফগানিস্থান ছিলো একটি সেক্যুলার শাসনাধীন আধুনিক সমাজ। কিন্তু সেখানে পার্বত্র অঞ্চলে যে বিশাল মাদ্রাসা ছিলো সেখানে ঠিকই সপ্তম শতাব্দীর মুহাম্মদের খিলাফত জিহাদকে নিষ্ঠার সঙ্গে চর্চা করা হত। সেই দর্শন চর্চাকারী মাদ্রাসার একজন ছাত্র মোল্লা ওমর আফগান মুসলমানদের তেজদীপ্তভাবে জিহাদের মাধ্যমে বাতিল কুফরি বিদাতকে বিদায় করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন। আফগানিস্থানের পার্বত্র অঞ্চলের কঠিন পরিবেশে দরিদ্র আফগানদের সমর্থন আদায় করতে ওমরের অসুবিধা হয়নি কারণ শিক্ষিত ধনীদের হাতে কোন না কোনভাবে দরিদ্ররা বঞ্চিত হয়ে থাকেই। ওমর দরিদ্র মুসলমানদের নবীর আদেশের সঙ্গে তাদের আগামী সুখি জীবনের আশ্বাস দেন যা কেবলমাত্র ইসলামই তাদের দিতে পারে। মার্কিন গোয়েন্দারা এরকম একটা নেতাকেই খুঁজছিলো যে তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে পারবে। মার্কিন ইনভেস্টমেন্ট এভাবেই তালেবানকে গড়ে তুলে। মুহাম্মদকে যেভাবে মদিনাবাসী ১৪০০ বছর আগে গড়ে তুলেছিলো!
শেষকথা, কোনটা জিহাদ সেটা নিয়ে ইসলামী শাস্ত্রবিদরাই বিতর্ক শুরু করেন। যেমন বর্তমান আইএসের জিহাদকে একদল আলেম জিহাদ হিসেবে মানেন না। যেমন আমরা ভারতবর্ষের মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনকে জিহাদী আন্দোলন বলে মানি না! যেমন কেউ কেউ জিহাদকে আমেরিকার সৃষ্টি বলে মানেন। তারা মনে করেন আমেরিকারকে ধ্বংস করতে পারলে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাবে। এই মনে করাতে আর মনে করানোতে ইসলামের কিছু যায় আসে না। তার টেক্সট তার জন্য ততদিন পর্যন্ত একজন জিহাদী তৈরি করে যাবে লড়াই করার জন্য যতদিন পর্যন্ত জঙ্গিবাদকে আমেরিকা, ইহুদী, অর্থনীতি, দারিদ্রতা, প্রেম ভালবাসা, অভিমান, ক্ষোভ, দু:খ ইত্যাদি ফ্যাক্ট দেখিয়ে ইসলামের অনুপ্রেরণাকে আড়াল করা হবে।
1 মন্তব্যসমূহ