মানবেদেহের ও সমাজদেহের রোগোৎপত্তি ও তার কারণ

                     
[ কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তীর রচনাবলী থেকে সঙ্কলিত ]

[ সাম্প্রতিককালেই শুধু নয়, মাঝে মাঝেই হোমিওপ্যাথি বনাম আধুনিক চিকিৎ্সা পদ্ধতি নিয়ে বাক-বিতণ্ডা ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমেও দেখা যায়। তারই প্রেক্ষাপটে বঙ্গযান-এর এই নিবেদন। উপসংহারে বঙ্গযান-এর নিজস্ব মতামত রয়েছে - বঙ্গযান ]

‘‘... … … হ্যাঁ।  এই মৌলবাদী জীবননীতি [ একই  কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির নীতি ] গ্রহণ করবার ফলে সমাজশরীর ও মানব শরীর যুগপৎ রোগগ্রস্ত হয়ে যায়। চরকসংহিতার বর্ণনানুসারে দক্ষযজ্ঞের ওই প্রলয়ঙ্কর কাণ্ডের সময়ই মানুষের সামাজিক ও শারীরিক রোগসমূহের উৎপত্তি হয়েছিল। সেখানে ‘রোগোৎপত্তি’র বর্ণনায় বলা হয়েছে – 

“সত্যযুগ গত হইবার সময়ে কোনো কোনো ব্যক্তি ধনাদির অতিগ্রহণ জন্য সাম্পন্নিক হওয়ায় তাহাদের শরীরের গুরুত্ব হইয়াছিল। শরীরে গুরুত্ববশত শ্রান্তি, শ্রান্তিবোধ হইতে আলস্য, আলস্য হইতে ধনসঞ্চয়ে আকাঙ্ক্ষা, সঞ্চয়েচ্ছা হইতে প্রতিগ্রহ এবং প্রতিগ্রহ হইতে লোভ প্রাদুর্ভূত হইয়াছিল। তৎপরে ত্রেতা যুগ আরম্ভ হইলে লোভ হইতে জিঘাংসা, জিঘাংসা হইতে মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা হইতে কাম ক্রোধ অভিমান দ্বেষ পরুষতা অভিঘাত ভয় তাপ শোক চিন্তা ও উদ্বেগাদির প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল …এবং জ্বরাদি ব্যাধি কর্ত্তৃৃৃক শরীর আক্রান্ত হইয়াছিল, তজ্জন্য তাহাদের আয়ু ক্রমশ হ্রাস পাইতে লাগিল... রোগসমূহের প্রথমোৎপত্তির বিবরণ কথিত হইল।’ মানব সমাজে জ্বরোৎপত্তি ও রোগোৎপত্তি বিষয়ে প্রায় এই ধরণের বর্ণনা মহাভারতে এবং কোনো কোনো পুরাণেও দেখতে পাওয়া যায়। … ...

ভারতের এই সকল ইতিহাস ইউরোপের জানা ছিল না। ...তা সত্ত্বেও মানবশরীরে রোগের উৎসসন্ধান করতে গিয়ে হ্যানিম্যান ও তাঁর ভাবশিষ্য কেণ্টস্‌ প্রায় একই উৎসে পৌঁছে যান, খানিকটা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো, যিনি আবিষ্কারের কালে জানতে পারেন নি যে, তিনি আমেরিকা আবিষ্কার করে বসে আছেন। হ্যানিম্যানও জগৎসৃষ্টিতে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ইতিহাসটা না জেনেই রোগসৃষ্টিকে ওই তিনটি ভিত্তিভূমির উপরই খাড়া করেছেন, শুধু ভাষাটা একটু আলাদা – সাইকোটিক, সিফিলিটিক, ও সোরিক। তবে জগৎসৃষ্টিতে মহেশ্বরের মতো রোগসৃষ্টিতে সোরাই নাকি মূল ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে (৯)। 

তাঁদের মতে - ‘প্রাচীন ব্যাধিসমূহের সাধারণ জন্মদাতা হচ্ছে সোরা। আজকাল যে সকল ব্যাধি দেখা যায়, তার প্রায় আট ভাগের সাত ভাগই ওই সোরার জন্য সৃষ্টি হয়েছে।’ আবার কেণ্টস্‌ বলেন - “যদি কথাটা অন্য ভাবে প্রকাশ করা হয়, তবে বলা যায় – এখন সব লোকই সোরাদুষ্ট। ...সোরা হচ্ছে অন্তর্নিহিত কারণ, মানবজাতির বিশৃঙ্খলার মুখ্য কারণ। সোরা মানবজাতির আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার একটা অবস্থাগত মূর্ত্তি। বিভিন্ন রকমের ব্যাধি এবং প্রাচীন রোগের দ্বারা ইহা ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করে। মানবজাতির অবস্থা যদি স্বাভাবিকভাবে সুস্থ থাকত, তবে সোরার কোনো অস্তিত্বই থাকত না। মানবজাতির সোরা গ্রহণাসক্তি এমন একটি প্রশ্নের সৃষ্টি করে, যা গুরুত্বের দিক থেকে তুলনা করলে চিকিৎসা বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পাঠের চেয়ে অনেক বড় ও তাৎপর্য্যপূর্ণ। সোরা নামক বিষয়টি অতি ব্যাপক, ইহা মানবজাতির আদিম পাপকার্য্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত”। 

সেই পাপকার্য্যটিকে আবার হ্যানিম্যান তাঁর অর্গ্যাননে সরাসরি শনাক্ত করেন - ‘মানুষের সুস্থাবস্থায় দেহকে যে (অদৃশ্য) শক্তি বাঁচাইয়া রাখে, তাহাকেই জীবনীশক্তি বলে। এই অদৃশ্য সত্তা হইতেই মানবজীবনের সর্ব্বপ্রকার অনুভূতি ও কার্য্যকলাপ উদ্ভূত হয়। ... এই অদৃশ্য শক্তি কোনো জীবনবিরোধী প্রভাবকের গতিশীল প্রভাবে মৌলিকভাবে বিশৃঙ্খলাগ্রস্ত হইলেই কেবল কোনো ব্যক্তি রোগগ্রস্ত হইতে পারে।’ তবে এই জীবনবিরোধী প্রভাবকের গতিশীল প্রভাবই যে মানবসমাজে একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তিকারী দক্ষদের গতিশীল প্রভাব, তা তাঁরা জেনে যেতে পারেননি। কারণ তাঁরা জানতেন - ‘প্রাচীনতম জাতির ইতিহাস এই ব্যাধির মূলগত কারণ অনুসন্ধান করতে পারেনি।’ (-কেণ্টস্)।

এখন আমরা বলতে পারি, হেথা হোথা অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। আদিম পাপের ওই ইতিহাস আমাদের বেদপুরাণ রামায়ণ মহাভারতাদির ভিতর সুলিখিতই আছে। তবে কিনা, যে [ ক্রিয়াভিত্তিক ] পদ্ধতিতে সেগুলি লিখিত আছে, কেবল সেই পদ্ধতিতেই সেগুলি পাঠ করতে হয়, যা আমরা এতদিন ভুলে গিয়েছিলাম। এখন প্রয়োজন কেবল সেই পদ্ধতিতে সেগুলিকে ভাষান্তর করে নেওয়া তাহলেই সমাজশরীরে ও মানবশরীরে রোগোৎপত্তির সমস্ত কারণই জানতে পারা যায়। জানা যায় আদিম পাপকার্য্যটি ঠিক কেমন। বাইবেলের আদিম পাপের বিবরণ ওই পাপকার্য্যের কোন্ অংশকে ব্যাখ্যা করে থাকে।

মার্ক্স সাহেবও পুঁজির উদ্ভবের উৎস অনুসন্ধান করতে করতে ওই আদিম পাপকার্য্যের নিকট পৌঁছে যান - ‘Primitive accumulation plays in Political Economy about the same part as original sin in theology. Adam bit the apple, and there upon sin fell on the human race.’ 

…কিন্তু তাঁর নিকট ‘ভারতের ইতিহাস অজ্ঞাত’ থাকায় তাঁর জানা হয়ে উঠল না, ওই আদিম-পাপটি ঠিক কী? যদি জানা যেত, তাহলে যে মার্ক্সবাদ অন্যভাবে লেখা হত, সেকথা আজ হলফ করে বলে দেওয়া যায়। ... ... …

তা সে যাই হোক, সভ্যতার আদিকল্পে ভারতে যে ওই ‘আদিম পাপকার্য্য’ সম্পন্ন হয়েছিল, হোমিওপ্যাথি দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা কেণ্টস্‌ সেকথা আদৌ জানতেন না। অন্তত সেরকম কোনো কোনো সাক্ষ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও তিনি সেই আদি পাপকে সফলভাবে শনাক্ত করে দিয়ে যান। তাঁর মতে –

‘মানুষের প্রথম ব্যাধি হচ্ছে আধ্যাত্মিক ব্যাধি এবং সেই আধ্যাত্মিক বিকৃতি থেকে মানুষ ক্রমান্বয়ে অধঃপতিত হয়ে সোরা গ্রহণাসক্তি লাভ করেছে। মানুষ এই অবস্থা লাভ করে অন্যান্য রোগের ভিত্তিস্থাপন করেছে। …চিন্তা এবং কামনা- বাসনা মানুষের প্রকৃতি গঠন করে, যা তার প্রকৃতিস্বরূপের নির্দ্দেশ বহন করে। যতদিন মানুষ সৎ-চিন্তা করত ... ততদিন সে ...রোগপ্রবণতা থেকে মুক্ত ছিল, কারণ সেইরূপ অবস্থায় তার সৃষ্টি হয়েছিল। [স্মর্ত্তব্য – ‘তখন সকল মানুষ নিরাময় ছিল’ -মনুসংহিতা। ] যতদিন পর্যন্ত সে সেই অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তার মনের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ ছিল, ততদিন সে রোগপ্রবণ হইয়া পড়ে নাই এবং রোগ সংক্রমণের অদৃশ্য রশ্মিও বিকীর্ণ করে নাই। [ এই সেই রশ্মি, যা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার আলো বিচ্ছুরণের সঙ্গেই পৃথিবীতে ছড়ায়। ]।

কিন্তু যখন সে তার অসৎ চিন্তা-সঞ্জাত বস্তুসমূহের আকাঙ্ক্ষা করতে আরম্ভ করল, তখন তার প্রকৃতি এ’রূপ অবস্থায় উপস্থিত হল, যা তার অন্তরের অনুরূপ। ...এইরূপ খারাপ বাসনা, অপবিত্র চিন্তাধারা অবিরামভাবে পুরুষানুক্রমে সাধিত আপত্তিকর জীবনধারা মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থাকে রোগপ্রবণ অবস্থায় পরিণত করেছে।’

এই বিকৃতি নেই বলেই বনের পশুপাখিদের রোগপ্রবণতা নেই। আর নেহাত যদি কোনো রকম রোগ-সম্ভাবনা দেখাও দেয়, পশুপাখরা প্রত্যেকেই জানে, কী হলে কী করতে হবে, কোন গাছের পাতা বা শিকড় খেতে হবে। …

পাদটীকা থেকে -

৯. ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর’-এর সমান্তরালে কেবল ‘সাইকোটিক- সিফিলিটিক-সোরিক’ নেই; রয়েছে ‘তামা-রূপা-সোনা’ও।  সোনার গহনা সোরাগ্রস্ততার প্রতিষেধক ভেবেই প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে সোনার এত ব্যবহার। বিষয়টির খানিকটা আঁচ পাওয়া গেল Gold : As A Remedy In Disease / by James Compton Burnett MD FRGS (publisher : B. Jain Publishers Pvt Ltd) গ্রন্থে। এখানে হোমিওপ্যাথি বিষয়ক যে সকল উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলি নেওয়া হয়েছে প্রধানত এই দুটি গ্রন্থ থেকে –

(১) কেণ্টস্‌ ফিলসফি / (হোমিও দর্শন) - অনুবাদক ডা. আর পাল; এবং 
(২) অর্গ্যানন অফ মেডিসিন / হ্যানিম্যান – ডা. ত্রিগুণানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

- [ কলিম খান-এর “মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে” গ্রন্থের ৫৮-৬৪ পৃষ্ঠাসমূহ থেকে সঙ্কলিত ]

[ এছাড়াও দ্রষ্টব্য – রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খান-এর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থে ‘মৎস্যগন্ধ’ শব্দটি। পৃষ্ঠা ৪৭৪-৪৭৫)। তবে তার আগে মৎস্য শব্দের অদৃশ্য অর্থ ব্যক্তিমালিক (ব্যক্তিমালিকানা) এবং সাদৃশ্য অর্থ মাছ – একথা ভালভাবে বুঝে নিতে হবে। উক্ত শব্দার্থকোষে ‘মৎস্য’ শব্দটি দেখে নিন। ]  

‘‘মৎস্যগন্ধ :- … এখানে আমরা মৎস্যগন্ধ শব্দটির চারটি রূপ নিয়ে কথা বলব – (১) মৎস্যগন্ধ-মাত্রের বাহ্যিকভাবে আঘ্রাত রূপ, (২) মৎস্যগন্ধ-মাত্রের মানসিকভাবে আঘ্রাত রূপ, (৩)  মৎস্যগন্ধ তন্মাত্রের বাহ্যিকভাবে আঘ্রাত রূপ, ও (৪) মৎস্যগন্ধ -তন্মাত্রের মানসিকভাবে আঘ্রাত রূপ। … ...

মৎস্যগন্ধ-তন্মাত্রের বাহ্যিকভাবে আঘ্রাত রূপ – 

কোনো নিরামিষাশী হিন্দু ব্রাহ্মণ আমিষাশী হিন্দু বা মুসলমান বাড়ীতে জলগ্রহণ করতে না চাইলে আমরা বিরক্ত হই। ভাবি, এসব শুধুই গোঁড়ামী। কিন্তু কলিম খান-এর অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য এই রকম - ‘বছর দুই স্বপাকে শুধুমাত্র জগাখিচুড়ি [ চাল-ডাল-আলু-কলা ইত্যাদি একত্রে সিদ্ধ করা অন্ন ] খেয়ে দিনাতিপাত করার কালে দেখেছি যে, নিরামিষ ভোজনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর কোনো আমিষাশী মানুষের বাড়ীতে গেলে খুবই অসুবিধায় পড়তে হত। তাঁদের গেলাসে ও গেলাসের জলে মাছের গন্ধ বা আমিষগন্ধ পাওয়া যেত এবং সে জল পান করতে গিয়ে খুবই অস্বস্তিতে পড়তে হত; যেন সেই জলে কাঁচা মাছ ধোয়া হয়েছে, এত তীব্র লাগত সেই গন্ধ। ঐ দু’বছরের আগে এবং কিছুদিন পরে ঐ সমস্যায় আর পড়তে হয়নি।’ আমরা দেখেছি, বাসনকোশন যত ভাল করে ধোয়াধুয়ি করা হোক না কেন, নিরামিষাশী মানুষ জল পান করতে গেলেই টের পেয়ে যাবেন পরিবারটি আমিষাশী কি না। বাসনকোশন থেকে মাছের গন্ধ সম্পূর্ণ দূর করতে পারে, এমন বাসন-ধোয়ার সাবান সম্ভবত পাওয়াই যায় না। কেউ সেরকম দাবি করলে, তাঁর সাবানটি দিয়ে আমিষাশী পরিবারের বাসনকোশন ধুয়ে তাদের গেলাসে কোনো নিরামিষাশী মানুষকে জল খেতে দিলেই তিনি বলে দেবেন, সাবানটি সত্যি করিৎকর্ম্মা কি না।

মৎস্যগন্ধের এই রূপটিকে তার বাহ্যিক তন্মাত্ররূপ বলে। গেলাসে পাওয়া মৎস্যগন্ধে কার্য্যত মৎস্য-এর কণামাত্রও থাকে না, থাকে মৎস্য-এর তন্মাত্র, থাকে মৎস্য-এর অস্তিত্বের স্মৃতি। এই স্মৃতি তুলকালাম ঘটানোর যোগ্যতা ধরে। হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিদ্যায় এই তন্মাত্র বা স্মৃতিই ঔষধরূপে ক্রিয়া করে থাকে। যেহেতু সেই স্মৃতিকে চিহ্নিত করার জন্য যে সূক্ষ্মতম যন্ত্রের প্রয়োজন, সেই যন্ত্র আবিষ্কার করা যায়নি, সেকারণে আধুনিক বিজ্ঞান এখনও হোমিওপ্যাথি ঔষধের কার্য্যকারিতার কারণ নির্ণয় করতে পারেনি।

মৎস্যগন্ধ-তন্মাত্রের মানসিকভাবে আঘ্রাত রূপ – 

‘‘টাটাকে (সিঙ্গুর থেকে) তাড়িয়ে মমতা কিন্তু কাজটা ভাল করেনি’ – হঠাৎ বলে বসলেন রামবাবু। এতক্ষণ সভা চলছিল নিরামিষ আড্ডার মতো, আর সেটা নিরামিষ থাকল না। সবাই হৈ হৈ করে উঠল।’’

তার মানে, বাগবিষয়েরও আমিষ-নিরামিষ হয়। অথচ ঐ আলোচনাকে আমিষ-আলোচনা পর্য্যন্ত বলা হয়নি; শুধু আলোচনা-সভাটি ‘নিরামিষ থাকল না’ বলে পরোক্ষে উল্লেখ করে দেওয়া হল যে, ‘আলোচনা-সভাটি তারপর আমিষ- আলোচনা-সভায় পরিণত হয়ে গেল’।

এই কথাবার্ত্তায় মালিকানার বা মৎস্য-এর লেশমাত্রও নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই যে নিরামিষ শব্দ প্রয়োগ করে পরোক্ষে আমিষের উল্লেখ করা হল, একেই বলে মৎস্যগন্ধের মানসিক তন্মাত্র রূপ। এই রূপটিকে আমরা আরও অজস্র ক্ষেত্রে দেখতে পাই। যথা - ‘অধ্যাপক রামবাবুর বাড়ীতে যুবকটির যাতায়াতকে একেবারেই নিরামিষ ভাববেন না যেন; রামবাবুর একটি সুন্দরী কন্যা আছে!’ কিংবা, ‘শ্যামবাবু যে বন্যাত্রাণে দিনরাত খাটতে থাকেন, সেটি তাঁর নিরামিষ জনসেবা মাত্র নয়। একাত্তরের বন্যার পরই তো তিনি তাঁর বাড়ীটা পাকা করলেন!’ ...এসবই মৎস্যগন্ধের মানসিক তন্মাত্র রূপ। এই তন্মাত্র রূপ থেকেই দুইখানি বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে। প্রায় সমস্ত পুরাণাদি গ্রন্থ সুস্পষ্টভাবে জানায় যে, এই গন্ধ-তন্মাত্রাত্মক সংঘাত থেকেই মানবসভ্যতার বর্ত্তমান রূপটির জন্ম হয়েছিল।"

বঙ্গযান" - এর অভিমত

মহাত্মা হ্যানিম্যান, কেণ্টস্‌ ও মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন তত্তদ কালের যথাক্রমে জার্ম্মানী, আমেরিকা ও বাংলার শ্রেষ্ঠ অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার। তুলনায় অনেক মেধাসম্পন্ন এই তিন ব্যক্তিত্বের প্রত্যেকেই তাঁদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতায় অ্যালোপ্যাথি তথা আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার অসম্পূর্ণতা লক্ষ্য করেছিলেন এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিদ্যাকে মানুষের রোগ নিরাময়ের শ্রেষ্ঠ উপায় বুঝে এবং সেরূপ অনুভব করে সেই বিদ্যার প্রয়োগ করে মানুষের রোগ নিরাময়ের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

কার্য্যত অ্যালোপ্যাথি বা আধুনিক চিকিৎসা হল দৃশ্য স্পষ্ট সত্যের কারবারী। এ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রেও ধরা দেয় না এমন 'রোগ-বালাই'য়ের সামনে সে বড়ই অসহায় হয়ে পড়ে| বিপরীতে হোমিওপ্যাথি একটি অতি সূক্ষ্ম বিজ্ঞান। এত সূক্ষ্ম যে অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন মানুষ বা অত্যন্ত অনুভূতিসম্পন্ন স্পর্শকাতর বড় মানুষ ছাড়া সেই বিজ্ঞানকে ঠিকঠাক ধারণ করতেই পারেন না। [ অথচ দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে, তথাকথিত ভাল ছাত্ররা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে আসেন না ]।

রবীন্দ্রনাথ যাঁদের ‘বড়-ইংরেজ’ বলতেন, তাঁরাই পলাতক হ্যানিম্যানকে আশ্রয় ও সমর্থন দিয়েছিলেন। সারা পৃথিবীর বড়-মানুষেরা – বড়-ইংরেজ, বড়-জার্ম্মান, বড়-আমেরিকান, বড়-ভারতবর্ষীয় মানুষেরা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকেন। বড়-ইংরেজ আজ প্রায় বিলুপ্ত। ইংলণ্ডে হোমিওপ্যাথির বিলুপ্তি বড-ইংরেজের বিলুপ্তিতে সিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছে। এখন তো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রচলন কোন দেশে কী পরিমাণ রয়েছে তাই দিয়েই বলে দেওয়া যায়, কোন দেশে কত বড় মানুষ এখনও বেঁচে আছেন।

ডা. শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র গত দু’বছর ধরে তাঁর বিভিন্ন লেখায় এবং প্রকাশিত গ্রন্থসমূহে তার ক্রমবর্দ্ধমান সাধনা ও মেধার পরিচয় পাঠকসমাজে্র সামনে মেলে ধরেছেন। সম্প্রতি হোমিওপ্যাথি নিয়ে একাধিক প্রতিবেদনে তিনি তার বক্তব্য তুলে ধরে বিতর্কের অবতারণা করেছেন। এতে পাঠকসমাজের মনে নানা মত নিয়ে বাক-বিতণ্ডা চলছে। আমাদের মনে হয়েছে আপাত বিরোধিতার ছদ্মবেশে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত দেখতে আগ্রহী। এটা অনেকটা শত্রুরূপে ভজনার মত করে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ভক্ত হয়ে ওঠার প্রবণতাই আমরা লক্ষ করেছি। স্বয়ং আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সাধক হিসাবে সেই বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক দায়দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা থেকেই হোমিওপ্যাথি নিয়ে বিরোধিতার আড়ালে হোমিওপ্যাথির প্রতি তিনি আগ্রহী বা উৎসাহী হতে চান। এবং কে বলতে পারে আগামী দিনে, যিনি এই মুহূর্ত্তে ভাষাশাস্ত্রের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের একনিষ্ঠ অনুসারী ও প্রবক্তা এবং যে তত্ত্বে শব্দের সাদৃশ্য অর্থকে অতিক্রম করে তার অভিধার্থ ছাড়াও তার অদৃশ্য ব্যাপ্ত অর্থের ব্যঞ্জনাকে অনুধাবন করে ‘বর্ণসঙ্গীত’ রচনা করতে পারেন, সেই তিনি অচিরেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকে রূপান্তরিত হয়ে মানবসমাজের অনুকূলে বৃহত্তর জনস্বাস্থ্য রক্ষার মত কাজে আরও বিপুলভাবে আত্মনিয়োগ করবেন না?

খণ্ডবাদী দেহভিত্তিক আধুনিক চিকিৎসা সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন অবস্থায় আরও উন্নততর হয়ে উঠুক। একই সঙ্গে আত্মাভিত্তিক ও লক্ষণভিত্তিক সুলভ ও জনপ্রিয় হোমিওপ্যাথির চিকিৎসাও উন্নততর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও তার মূল্যায়ণের উপযুক্ত মাপকাঠি আবিষ্কারের কাজ এগিয়ে আসুক। তবে একথা সকলেই স্বীকার করেন যে, মনের জগতের হদিশ পাবার মাপকাঠি নির্ব্বাচনের কাজটি অত্যন্ত কঠিন। বিজ্ঞান পদার্থের মৌলকে ভেঙে ভেঙে অতি সূক্ষ্ম স্থানে পৌঁছেও সেই পরমাণুর আচরণের রহস্যভেদে ব্যর্থ হয়ে আরও অধিকতর রহস্যময় গোলকধাঁধাঁর সম্মুখীন হয়ে পড়ছেন! [ তবে হ্যাঁ, রহস্যভেদের উদ্যোগ অবশ্যই জারী আছে ]।

এই অবস্থায় কোন এক পক্ষ থেকেই, ধরা যাক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সমর্থকদের পক্ষ থেকে, তাদের অর্জ্জিত জ্ঞানের হাতুড়ী দিয়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মস্তকে আঘাত করা থেকে যেমন বিরত থাকা উচিত, ঠিক তেমনি অপর পক্ষ অর্থাৎ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনুসারীদের পক্ষ থেকেও এটা অনুচিত হবে তাদের জ্ঞানের হাতুড়ী দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাশাস্ত্রের মাথায় আঘাত করা। আমাদের আশা, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা্সহ অপরাপর চিরায়ত চিকিৎসা শাস্ত্রসমূহ একত্রে হাতে হাত মিলিয়ে চলবে, তাদের মেলবন্ধন ঘটবে এবং একে অপরের পরিপূরক ভূমিকা পালন করে মানুষের দেহমনের এক অখণ্ড/পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা-ব্যবস্থা উপহার দিয়ে সমগ্র মানবসমাজের কল্যাণকারী ও মঙ্গলদায়কের ভূমিকা পালন করবে।  

- [ সম্পাদক-প্রশাসক, বঙ্গযান ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ