কিষানজী বলেছিলেন,‘‘মমতা নৈঃশব্দ ভাঙুন।’’ ‘নৈঃশব্দ’ ভেঙেছিল। জঙ্গলমহলে ২০০৯-র মধ্য জুনের যৌথ অভিযানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী।
এখন, এই অকাল গ্রীষ্মে দেশ, রাজ্য, সমাজ বলছে —‘‘আপনি চুপ কেন? কথা বলুন।’’ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি চুপ। চুপ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আরএসএস-র আগ্রাসন নিয়ে। চুপ রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির তৎপরতা নিয়ে।
প্রায় সাত বছর আগে মাওবাদী নেতার আহ্বানের পর যৌথবাহিনীর অভিযানের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মুখ খোলার পিছনে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক ছিল। এখন, ২০১৬-র ফেব্রুয়ারিতে হিন্দুত্ববাদীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নৈশঃব্দ বজায় রাখার পিছনেও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর নির্দিষ্ট অঙ্ক আছে। মাওবাদীদের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের বহুজাতিকদের সুবিধার্থে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করা। অতিবামপন্থীরা বরাবরই দেশের রাজনীতিতে বামপন্থার বিরুদ্ধে ‘পঞ্চমবাহিনী’-র ভূমিকা পালন করে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল সময়ে অবিবেচক, হঠকারী স্লোগান তুলে বিরুদ্ধ শক্তির হাত শক্ত করার একটি আদর্শগত অভ্যাস আছে এদের। সাম্প্রতিক সময়েও রাজ্যেও তা দেখা গেছে। যা শেষপর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াইকে দুর্বল করে। মাওবাদীদের লক্ষ্য ছিল — সিপিআই(এম)-কে মেরেধরে, খুন করে দুর্বল করা। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কিংবা বিজেপি-রও একটিই লক্ষ্য ‘কমিউনিস্টদের’ ধ্বংস করা। আজ থেকে নয়, তাদের এই কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ জন্মগত বৈশিষ্ট্য।
২০১১-তে তথাকথিত ‘পরিবর্তন’-এ এরা সবাই মমতা ব্যানার্জির সহযোগী ছিল। মাওবাদীদের সহযোগিতার কথা এখন স্পষ্ট। এ’ নিয়ে আলোচনার প্রায় কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু আরএসএস? তারাও ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ২০১১-র আগে থেকেই।
‘পরিবর্তন’-এ হিন্দুত্ববাদীরাঃ
একটি উদ্ধৃতির দিকে নজর দেওয়া যাক। রাজ্যে আরএসএস-র মুখপত্র স্বস্তিকা। ২০১১-র ২৩শে মে প্রকাশিত স্বস্তিকার সম্পাদকীয়কতে কী লেখা হচ্ছে? সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল — ‘দুঃশাসনের অবসান’। সেখানে প্রবল হিন্দুত্ববাদীরা লিখেছিলেন — ‘‘অবশেষে দুঃশাসনের অবসান। গত ৩৪ বৎসর ধরিয়া বাংলার বুকের উপর ফ্যাসিবাদী দলতন্ত্রের যে জগদ্দল পাথর চাপিয়া বসিয়াছিল, রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেই পাথরকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছে। আলিমুদ্দিনওয়ালাদের যে ধরাশায়ী করা সম্ভব ইহা লইয়া অনেকেরই সন্দেহ ছিল।...যদিও কমিউনিস্টরা বিজেপিকেই শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, পয়লা নম্বর শত্রু বলিয়াই মনে করে। ইহা স্বীকার করিতেই হইবে, পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী সরকার ও ক্যাডারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁহারই নেতৃত্বে তৃণমূল জোটের এই বিরাট জয়।’’ শুধু তাই নয়। উল্লাস প্রকাশ করে মার্কসবাদী দর্শনে আক্রমণ করে আরও বলা হলো —‘‘মানুষের মুক্তির নামে মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করিবার ‘কমিউনিজম’ নামক এমন মিথ্যা দর্শন ও বিজ্ঞান বিশ্বে ইহার পূর্বে কখনও দেখা যায় নাই। সোভিয়েত রাশিয়া হইতে মাও-এর চীন পর্যন্ত ইহার সেই একই বিকৃত চেহারা। মার্কসবাদীরা তত্ত্বগতভাবে যে জাতীয়তাবিরোধী এবং ব্যবহারিক দিক হইতে অসামাজিক — বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসেই তাহা প্রমাণিত।’’
অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জির প্রতি স্নেহশীল এই সংগঠনটি কমিউনিস্ট, বামপন্থীদের বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে খড়্গহস্ত। বামফ্রন্ট সরকারকে অপসারিত করতে এরা ২০১১-র আগে থেকেই যাবতীয় সহযোগিতা করে এসেছে মমতা ব্যানার্জিকে। উল্লেখ্য, প্রায় একযুগ আগে ২০০৪-র ১১ই এপ্রিল সিপিআই(এম) তৎকালীন রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড অনিল বিশ্বাস মমতা ব্যানার্জি-আরএসএস-র বোঝাপড়া সম্পর্কে বলেছিলেন,‘‘আরএসএস-র পরগাছা হয়ে রাজ্যে কাজ করছে তৃণমূল কংগ্রেস।’’ এখনও রাজ্যে বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদীদের শক্তিবৃদ্ধিতেই পরোক্ষে সহযোগিতা করছেন মমতা ব্যানার্জি।
ফলে মমতা ব্যানার্জি এদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পছন্দ করবেন না মোটেও — সেটিই স্বাভাবিক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যাচ্ছেতাই উত্তেজনা তৈরি করলেও না। রাজ্যে গত পৌনে পাঁচ বছরে আরএসএস তাদের সাংগঠনিক শক্তি আশঙ্কাজনক, নজিরবিহীনভাবে বাড়ালেও না।
তার চেয়েও বড় কথা রয়েছে মননের স্তরে। প্রবল সিপিআই(এম) বিরোধী মমতা ব্যানার্জি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে একটি দেশপ্রেমিক শক্তি বলেই মনে করেন। এই ক্ষেত্রেও প্রমাণ আছে। এবং তা বারবার বলতে হবে। তুলে ধরতে হবে।
মমতা ব্যানার্জির দেশপ্রেমিকরাঃ
২০০৩-এ আরএসএস সম্পর্কে নিজের অন্তরের গভীরতম অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। দিনটি ছিল ১৫ই সেপেম্বর। স্থান ছিল সেই নয়াদিল্লিই। আরএসএস-র জাতীয় পর্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে কী বলেছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী? বলেছিলেন — ‘‘আপনারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আমি জানি আপনারা দেশকে ভালোবাসেন...’’। তাঁর আবেদন ছিল, ‘‘যদি আপনারা(আর এস এস) ১ শতাংশ সাহায্য করেন, আমরা কমিউনিস্টদের সরাতে পারবো।’’ মমতা ব্যানার্জি সেদিন আর এস এস-র নেতাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন,‘‘কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আপনাদের লড়াইয়ে আমরা সঙ্গে আছি।’’ সেদিন কমিউনিস্ট বিরোধী একটি বই প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত আর এস এস-র ওই সভায় হাজির ছিলেন এইচ ভি শেষাদ্রি, মোহন ভাগবতের মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। তৃণমূল নেত্রীর সেদিনের বক্তব্যে আর এস এস সেদিন খুবই উৎসাহিত হয়েছিল। তাই বি জে পি-র রাজ্যসভার সাংসদ বলবীর পুনী ওই সভাতেই বলেছিলেন,‘‘আমাদের প্রিয় মমতাদিদি সাক্ষাৎ দুর্গা।’’
তিনি আরএসএস-র ‘দুর্গা’। আমরা? কমিউনিস্টরা? বরাবর আমরাই ভারতীয় সমাজের অগ্রগতির পদাতিক, নিঃশর্ত সেনাবাহিনী। তারও বিস্তর উদাহরণ ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে। অবিভক্ত ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার দুই পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ এবং কমরেড আবদুল হালিম। কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়েছে, তাঁদের ধর্মের পরিচয়ে নয়। শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ে তাঁদের উজ্বল ভূমিকার জন্য। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘পূর্ণ স্বরাজের’ দাবি উত্থাপনকারী প্রথম কণ্ঠ ছিল কমিউনিস্টদের। ঐতিহাসিক নৌবিদ্রোহসহ একাধিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী তীব্র আন্দোলনে কমিউনিস্টরা অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। গণেশ ঘোষ, কল্পনা দত্ত, সুবোধ রায়, সতীশ পাকড়াশি, সরোজ মুখার্জি, বিনয় চৌধুরি, সুধাংশু দাশগুপ্ত, সুকুমার সেনগুপ্তর মতো অনেক ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের বীর সেনানীরা কমিউনিস্ট পার্টিকে বেছে নিয়েছিলেন জীবনের পথচলা, সংগ্রামের জন্য। সেলুলার জেলেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘কমিউনিস্ট কনসলিডেশন’। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যের ঊত্তরাধিকারী কমিউনিস্টরা।
আরএসএস তৈরি হয়েছে ১৯২৫-এ। তারা অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তাড়ানোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেনি। তারা গুরুত্ব দিয়েছিল মুসলিম বিতাড়নে। এই নিয়ে গোলওয়ালকারের উক্তি নিজগুণে কুখ্যাত হয়ে আছে। দেশে হিন্দুত্বের দর্শনের প্রধান প্রবক্তা বিনায়ক দামোদর সাভারকার আন্দামান সেলুলার জেলে ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন। কী লিখেছিলেন ‘বীর সাভারকার’, আন্দামানের জেল থেকে? ১৯১৩-র চিঠিটি মনে আছে? ব্রিটিশ সরকারকে বিনায়ক দামোদর সাভারকার লিখেছিলেন ‘‘...অন্যভাবে যা পাওয়া যেতে পারে সে তুলনায় আমাকে জেলে আটকে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না। শক্তিশালীর পক্ষেই একমাত্র ক্ষমাশীল হওয়া সম্ভব। কাজেই অনুতপ্ত সন্তান পিতৃতুল্য সরকারের দরজায় ছাড়া আর কোথায় ফিরে যাবে? মহামান্য হুজুর অনুগ্রহ করে বিষয়গুলি বিবেচনা করবেন এই আশা রইল।’’
স্বাধীনতা সংগ্রামীর অনুতাপ। তাও আবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে। তাঁর অনুগতরা শেখাবেন দেশপ্রেম? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
ধর্মের ভিত্তিতে মাথা তুলতে চাওয়া রাষ্ট্র কোনও ভূখণ্ডের উন্নতির সহায়ক হয়নি। বরং ফল উল্টো হয়েছে। এমন দেশ কোথাও গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ধর্মান্ধ শক্তির রাজনীতি গণতন্ত্রকে মানে না। পারলে তাকে ধুলিস্যাৎ করে। আরএসএস-র প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম গোলওয়ালকার হিটলারের ফ্যাসিবাদের পূজারী ছিলেন। আরএসএস-র দর্শন ইস্রায়েলের জায়নবাদী রাষ্ট্রর প্রবল সমর্থক। তারা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। আরএসএস-র রাজনীতিতে অনেক ভাষা, ভাষা ভিত্তিক রাজ্য, সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদ, রাজ্যগুলির হাতে অধিক ক্ষমতার কোনও অস্তিত্ব নেই। সরকার গঠনের পরেই মোদীর সারা দেশে হিন্দিভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সেই দর্শনেরই অংশ। আবার ইদানীং চেষ্টা হয়েছে সংস্কৃতভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার। এমনই এদের দর্শন যে, কত ফুট লম্বা লাঠির উপরে জাতীয় পতাকা টাঙাতে হবে, তাও তারা বলে দেবে।
আর কমিউনিস্টরা? অবিভক্ত বাংলার তেভাগা আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য আন্দোলন, জমির লড়াই, পরবর্তীকালে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে। সংগ্রামের ময়দানে সব পরিচয় ধুয়েমুছে বড় হয়ে উঠেছিল দুই পরিচয় — অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত — এই দুই পক্ষ। কৃষক, খেতমজুর, শ্রমিক, মধ্যবিত্তর লড়াইয়ের ঐক্যের সামনে পিছু হটেছিল সামন্ততন্ত্র-পুঁজিবাদীদের শক্তি। তারই নির্যাস বামফ্রন্ট।
বোঝাপড়া অনেকদিনের
তবু কমিউনিস্টরা মমতা ব্যানার্জির কাছে শত্রু। গোলওয়ালকারের সংগঠন হলো নিখাদ ‘দেশপ্রেমিক’। বন্ধু। কমিউনিস্ট-নিধনে সহায়ক শক্তি। তাই হিন্দুত্ববাদীদের রাজনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে মমতা ব্যানার্জি তাদের সহায়ক শক্তি হিসাবেই আবির্ভূত হয়েছেন।
বাবরি মসজিদ ভাঙতে দলে দলে করসেবকরা অযোধ্যায় জড়ো হচ্ছেন, ততক্ষণে সে’ আশঙ্কার খবর সারা দেশেই ছড়িয়েছিল। সি পি আই(এম) বি জে পি-র সেই মারাত্মক কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছিল। ৪ঠা ডিসেম্বরই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনসভা হয়েছিল বামফ্রন্টের — শহীদ মিনার ময়দানে। সেদিন মমতা ব্যানার্জিও একটি সভা করেছিলেন কলকাতায় — সিধো কানহু ডহরে। তখন তিনি কংগ্রেসে। সেদিন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের প্রচার সম্পর্কে তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন,‘‘সি পি এম ষড়যন্ত্র করছে।’’ আরো বলেছিলেন,‘‘বি জে পি অযোধ্যায় কিছু করতে পারবে না। ওসব আটকাতে কংগ্রেসই যথেষ্ট। আসলে সি পি এম যে মিটিং মিছিল করছে, তা ক্যাডারদের জড়ো করার জন্য। আমাদের মহাকরণ অভিযানকে আটকাবার জন্য। ওদের সম্পর্কে তাই সাবধান থাকুন।’’
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরের দু’দিন আগেও মমতা ব্যানার্জি দেশের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে এতখানিই লঘু মনোভাব দেখিয়েছিলেন। সেদিনও ওই বিপদের বিরুদ্ধে সি পি আই (এম)-র প্রচারকে তিনি ‘ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। মমতা ব্যানার্জি সেই সময় বি জে পি-কে আড়াল করার চেষ্টা কেন করেছিলেন, তা তখন হয়তো বিচার্য ছিলো না। এখন তারও বিচার জরুরি। তার কিছুদিন পরেই, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসেই মমতা ব্যানার্জি বললেন, ‘বি জে পি অচ্ছুৎ নয়।’ ১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটে জোট বাঁধলেন বি জে পি-রই সঙ্গে। তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মের পরেই তারা বিজেপি-র সরকারে অংশ নিয়েছিল। ১৯৯৮-’৯৯-এ অটলবিহারী বাজপেয়ীর তেরো মাসের সরকারে, পরে ১৯৯৯-এর বিজেপি সরকারেও শরিক ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ২০০৪-এও লোকসভা নির্বাচনে তিনি বিজেপি-র সঙ্গে ছিলেন। ২০০৬-র বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি বিজেপি-র সঙ্গেই জোট বেঁধেছিলেন। ওই বছরের ২৫শে ডিসেম্বর ধর্মতলায় অনশন মঞ্চে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে যান আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। তারপর ২০০৮-এও মমতা ব্যানার্জি বিজেপি-র সঙ্গেই ছিলেন। রাজ্যে তথাকথিত ‘পরিবর্তন’-র পরে মমতা ব্যানার্জিকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শটি দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত স্বয়ং সেবক নরেন্দ্র মোদী — ‘‘প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে দিন।’’
সংসদে ‘অনুপ্রবেশ’ ইস্যুতে সংঘ পরিবারের বক্তব্য তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ হিসাবে তুলে ধরেছেন যিনি, তাঁর নাম মমতা ব্যানার্জিই। দিনটি ছিল ২০০৫-র ৪ঠা আগস্ট। লোকসভায় অধ্যক্ষের মুখের উপরে কাগজের তাড়া ছুঁড়ে দিয়ে অভব্যতার এক নজির সৃষ্টি করেছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী। সারা দেশ হতবাক হয়েগেছিল তাঁর এই কাণ্ডে। সেদিন তিনি এমন করেছিলেন কেন? কারণ, সেদিন তিনি সংসদে ‘অনুপ্রবেশ সমস্যা’ নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। অনুমতি মেলেনি। তাই ওই অভব্যতা। অর্থাৎ, রাজ্যে যখন শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলনের অবস্থানের কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তি পা রাখার সামান্য জায়গা পাচ্ছে না, তখন ‘পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রবেশ’ নিয়ে সংসদে বলে সংঘ পরিবারের কাছে বার্তা দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি — ‘আমি তোমাদেরই লোক।’
উল্লেখ্য, ২০০২-এ গুজরাটে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সময়ে মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রীয় সরকারের পাশেই ছিলেন। তৎকালীন বাজপেয়ী সরকার মোদীর প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। তৃণমূল নেত্রী তখন ছিলেন দপ্তরহীন মন্ত্রী। এই সমর্থনের পুরস্কার হিসাবে ২০০৩-এ তিনি বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় জায়গা পান। আর ওই ২০০৩-র আগস্টের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তখন গুজরাটের গণহত্যার ক্ষত দগদগে হয়ে রয়েছে। মোদীর গুজরাট সরকার যখন ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা করছে, তখন বণিকসভা ফিকির তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল অমিত মিত্রই দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমেরিকা, ইউরোপে গুজরাটের হয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করতে। এখানেই শেষ নয়। নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটের প্রচারের জন্য ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট, রিসার্জেন্ট গুজরাট’-র আয়োজক ছিলেন তৃণমূল সরকারের আজকের অর্থমন্ত্রীই।
0 মন্তব্যসমূহ