বিদেশী অনুপ্রবেশকারী হলে বিতাড়ন আইনি। তাহলে এত রাগারাগির কী আছে? আজ যদি জার্মানি ইচ্ছে করে সিরিয়ার অভিবাসীদের বয়ে বেড়াতে পারছি না, তাহলে কি পথে নেমে আন্দোলন করতে হবে? আমরা একেই গরীব দেশ, কেন বিদেশীদের দিনের পর দিন বয়ে বেড়াব? তবুও বাঙালিরা এত লাফালাফি করছে কেন?
দেশভাগের যন্ত্রণা ভারতের দুই প্রান্তকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল। পূর্বে বাংলা, আর পশ্চিমে পাঞ্জাব। দেশভাগের কারণে প্রায় দেড় কোটি মানুষ ভিটেহারা হয়েছিলেন। পাঞ্জাব প্রান্তে আনুমানিক ৪৭ লক্ষ হিন্দু ও শিখ ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন আর বাংলায় ২৬ লক্ষ মানুষ পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাঙালিদের থেকে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যায় পশ্চিম ভারতে অনুপ্রবেশ হলেও (মূলত পাঞ্জাবি ও সিন্ধি) দেশভাগের যন্ত্রণা, ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষদের এখনো কেন গঞ্জনা শুনতে হয়? এখনো কেন অনেক শরনার্থী এদেশে নাগরিক অধিকার পায়নি? সিন্ধি ও পাঞ্জাবিদের দিল্লীশ্বরেরা আপন করে নিলেও, কেন বাঙালিদের এক বড় অংশ আজও নিজ ভূমে পরবাসী? বাঙালিদের এক অংশ আজও এদেশে বসবাসকারী ওপার বাংলার মানুষদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে, গালিগালাজ দেয়। পাঞ্জাবিদের মধ্যে কখনো 'উদ্বাস্তু পাঞ্জাবি' শব্দ শুনেছেন? যদিও 'উদ্বাস্তু বাঙালি' শব্দ সত্তর বছর পরেও জ্বলজ্বল করছে। কেন বলতে পারেন? আজ যেটা আসামে চলছে, মহারাষ্ট্রেও শিবসেনার দোসর হয়ে এরাই ঠিক একইভাবে বাঙালি খেদাও অভিযান শুরু করেছিল। কখনো ভাবার চেষ্টা করেছেন ইংরেজ আমল থেকেই শাসকদের বাঙালিদের প্রতি এত ক্ষোভ কেন? কখনো কি ভেবে দেখেছেন, পাকিস্তান (PAKISTAN) নাম সৃষ্টি হয়েছিল আট স্থানের আদ্যাক্ষর দিয়ে। এর মধ্যে কোথাও 'B' নেই। বাংলার নাম প্রারম্ভিক পরিকল্পনাতে না থাকলেও তাও কেন বাংলার উপর দিয়ে র্যাডক্লিফ সাহেবের লাইন টানা হয়েছিল? জিন্নাহ কলকাতা ছাড়া পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্গত করতে চাননি, তাও কেন বাংলা ভাগ হয়েছিল?
সবের উত্তর বাংলার মধ্যেই নিহিত আছে। যে জাতির লিখিত লিপি হাজার বছর আগের খুঁজেই পাওয়া যায় না, সেই জাতির চেতনার অগ্রগতি শাসককে বারেবারে ভীতিগ্রস্ত করেছে। হুসেন শাহের ধর্মীয় বিধির ফরমানের বিরুদ্ধে চৈতন্যদেবের নেতৃত্বে বাঙালিরাই পথে নেমেছিল। গান্ধীজির ৫০০ বছর পূর্বে অহিংস পথে আন্দোলনের সূত্রপাত এই বাংলায় চৈতন্যদেবের হাত ধরে। শাসকের বিরুদ্ধে পথে নামার যে অভ্যেস চৈতন্যদেব শিখিয়ে গিয়েছিলেন তা আজও বাঙালিকে বারেবারে পথে নামায়। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও চেতনা জাগ্রত করতে বাঙালিরাই তো অবশিষ্ট ভারতকে পথ দেখিয়েছিল। চট্টগ্রামে সূর্য সেন না থাকলে কে শেখাতো ঠ্যাঙানি দিলে ইংরেজদের মধ্যে পৃথিবী বিজয়ী বীরদেরও পরাস্ত করা যায়। নেতাজি না থাকলে কে ভারতের মধ্যে দেশের পতাকা তোলার সাহস দেখাতো? আজাদ হিন্দ ফৌজের অধিকারে আসার পর নেতাজি এই আন্দামান নিকোবর দ্বীপের অধিকার নিয়ে এর নামকরণ করেছিলেন 'শহীদ ও স্বরাজ্য' দ্বীপ। এরপরেও নেতাজি উপক্ষিত থেকে যান। ইংরেজদের কাছে মুচলেকা দেওয়া বীর সাভারকরের নামে আন্দামানে বিমানবন্দরের নামকরণ হয়। আর যে সেলুলার জেলে সিংহভাগ বাঙালি বীর আপোষহীন ভাবে বন্দীদশায় জীবন কাটান, তেনারা উপেক্ষিত থেকে যান। বাঙালি ছিলেন যে।
এই বাঙালিরাই যে স্বাধীন ভারতেও দিল্লীশ্বরের কাছে মাথা নোয়ায়নি। স্বাধীন ভারতে তেভাগা আন্দোলন তো এই বাঙালিদের হাত ধরে। শাসকের মুখ শুধু পাল্টেছে, শোষণ যন্ত্র যে স্বাধীন দেশেও একই রয়ে গেল - তা তো বাঙালিরাই অনুধাবন করেছিল। যে দামাল বাঙালি বীরেরা ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করেছিল, তাদের অনুজরা আবার বাম ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল। বরানগরের গঙ্গা তো এই অবুঝ দামাল বাঙালিদের রক্তেই রক্তাক্ত হয়েছিল। এই বাংলা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছে, এই বাংলা কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছে, এই বাংলা বিজেপির সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বললে শাসক কি তোমাকে লাড্ডু দেবে? তাই স্বাধীন ভারত দেশেও বাঙালিরা সবথেকে বেশি অবিচারের শিকার।
দেশভাগের পরে বাংলার এক বড় অংশ আসাম রাজ্যের সাথে সংযুক্ত হয়। তাই আসাম রাজ্য যেমন অসমীয়াদের তেমনি বাঙালিদেরও। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় এসেই ঐতিহাসিক ভাবে বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে বাঙালি খেদাও অভিযানে নেমেছে। বাঙালিরা নির্মূল না হলে যে বিজেপির হিংসার রাজনীতি পরাস্ত হবে।
বিজেপির সবথেকে বড় ভয় বাঙালির চেতনাকে। ধর্মের মোহে দেশকে ডুবিয়ে রাখার খেলায় বিজেপির সব থেকে বড় বাধা বাংলা। তাই আজ চল্লিশ লক্ষ বাঙালি ছিন্নমূল হয়েছে। আগামীকাল চারকোটি বাঙালি ছিন্নমূল হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলার মীরজাফর দিলীপ ঘোষ যে তেমনই হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তাই পথে নামতেই হবে। নিজের ভিটেমাটি বাঁচাতেই হবে। নাহলে দিলীপ ঘোষেরা বাংলাকে অবাঙালিদের হাতে তুলে দেবে। অসমের বাঙালিদের মত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকবে।
0 মন্তব্যসমূহ