যে ডাকাতের নামে স্মৃতিমন্দির আছে।।পরাশর ভট্টাচার্য


নাম তার মান সিং, মান সিং জমিদারের ছেলে, নতুন বইয়ের গন্ধ তার বড়োই প্রিয়,আঙুল দিয়ে দিয়ে প্রতিটি শব্দ সে পড়ে, নতুন শক্ত শব্দ তার দাদু গুরুজী তাকে বলে দেন, নতুন বইয়ের রঙিন ছবি সে গুলি সারাদিন দেখে। 
দেশে তখন আংরেজ রাজ, মান সিং দের আরেক শরিক অত্যাচারী বাহুবলী। ছোট্ট মান সিং একদিন শুনলো, খুড়তুতো চাচার বেটারা নকলি কাগজ বানাকে তাদের জমিন হড়প লিয়া।

কোর্টে কেস চোললো। তবে যতদিন ফয়সালা না হচ্ছে জমিন শরিকদেরই দখলে রইল।কারণ তারা আংরেজ প্রশাসন ও ভকিল বাবুদের বন্ধু ছিল, পুলিশ মে ভি উন লোগোকো আপনা আদমি থা।
মান সিং দের অবস্থা পড়ে গেল, অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে ফৌজে যাবার বুদ্ধি দিল, কিন্তু মান সিং পড়াশুনো করতে চায়, অনেক লিখাই পড়াই করে সে কালেকটর বোনবে, ক্যানেল বানাবে, গাও মে পানি লাবে।বাউজি ভি ভইস বেচকে তার পড়াশুনা চালিয়ে গেলেন, সংগে মামলার খরচ, কোর্ট জমি তাদের বলে দখলদারিত্ব দিলেও শরিকরা ছাড়লো না, তারা লাঠির জোরে দখল রাখতে চায়,কারণ এদেশের এটাই নিয়ম, “জিসকা লাঠি উসকা ভইস"।
চম্বল নদীর জল চিরকাল কিসান কি খুনসে লাল হয়েছে।মান সিং আর তার পরিবার কে সেই নিয়ম মেনে বন্দুক লাঠি তুলে নিতেই হোল, একটা খন্ডযুদ্ধে দুপক্ষে কিছু লোক আহত হোল। 
প্রশাসনে নিজেদের প্রভাব আর ঘুষ খাইয়ে শরিকরা একতরফা ভাবে মান সিংদের ফৌজদারি  মামলায় ফাঁসালো, অটেম্পট টু মার্ডার কেসে সাজা হোল মান সিং ও তার বাপ কাকাদের।
কৈশোরের প্রান্তে সবে মাত্র ইস্কুল ফাইনাল পাস করে মান সিং ঢুকেছিল ঔপনিবেশিক জেলে, তার বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল,ষোলো সতেরো বছর বয়সেই সে দুটি সন্তানের পিতা।
ইংরেজের জেল, সে বড়ো সুখের জায়গা নয়, তবু মান সিং নজরে পড়েন এক ইংরেজ জেল সুপারের, আসামী পড়তে চায় জেনে তিনি তাকে বই ও সেলে মেট রাইটার দিয়ে পড়াশুনোর ব্যবস্থা করে দিলেন। তাকে জেলের দপ্তরী বিভাগে কাজ দিলেন।মান সিং এই সু্যোগে লেখাপড়া শিখে নিজেকে আরো তৈরী করে নিল।এভাবে সাত বছর কেটে গেল,সাহেব কেসের শুনানির বিরুদ্ধে উকিল দিয়ে আপিল করলেন।
তার ভালো ব্যবহার ও পরিশ্রমী শক্তি, তাই সে রিমিশন ও পেল।
চোদ্দ বছর জেল খেটে মান সিং মুক্তি পেলেন।
জেল খানায় মান সিং নেতাদের দেখেছেন,বড়ো বড়ো চোর ডাকাতদেরও দেখেছেন,ইংরেজ অফিসারদের ও চিনেছেন,ইংরাজি ভাষা শিখেছেন।
বাইরে বেড়িয়ে মান সিং পেলেন তার দুই বালক পুত্রকে,তাদের সাথে পরিবারের আরো অনেক চাচা,ভাতিজা, ভাই ও দাদাকে নিয়ে মোট সতেরো জনের একটা দল তৈরী করলেন।
প্রথমেই তার শরিককে আক্রমণ করলেন, ও হত্যা করলেন। 
তারপর সমস্ত সাউকারোকো সেলাম আদা কিয়া তামাঞ্চেপে। অর্থাৎ তদের গদি আক্রমণ করে, তাদের কাছে বন্ধকী জমির দলিল কৃষকদের ফিরিয়ে দিলেন, সমস্ত বন্ধকী কাগজ পত্র, চাষীদের আঙুলের ছাপ সব আগুনে পুড়িয়ে দিলেন।

"বাগায়ত করনা আগর গুনা হ্যায়,
তো সোচো হাম ভি বাগী হ্যায়।"

তার নাম হয়ে গেল ডাকু মান সিং, তাকে নিয়ে আজও যখন স্থানীয় লোকশিল্পী গান গায়, বলে 

সে পথ চলতি কোনো পথিকের টাকা কেড়ে নেয়নি, 
সে মায়েদের বা বোনেদের গয়না ছিনতাই করে নি, 
কিন্তু তবু সরকার
 ওর নাম দিয়েছে ডাকু মান সিং।

আংরেজ সরকার পল্টন পাঠালো,তারা নিজেরাই চম্বল কা বিহড়মে খো গেয়া। 
মান সিং পঞ্চায়েত গুলিতে নিয়মিত গিয়ে তদারকি করেন, কোথাও কোনো শিশু, নারী দরিদ্র মানুষ,সংকটে পড়লে তাকে রক্ষা করাই ছিল তার কাজ। সাহুকাররা সকলে মিলে তাকে মারার জন্য গুন্ডা বাহিনী তৈরী কোরলো, মান সিং পাকা শিকারির মতো তাদের নিকেশ করলেন।কিছু বদমাস কে হত্যা করলেন,কিছু যারা সাধারণ মানুষ তাদের নাক খত দিইয়ে ছেড়ে দিলেন।

ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হোল। 
ইংরেজ গেলেও চাষির কষ্ট কিছুই কমলো না,সাহুকারি আগের মতোই রয়ে গেল গ্রাম ভারতের বুকে, তাই মান সিং স্বাধীন ভারতেও তার সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন। তাকে হত্যা করার জন্য স্বাধীন ভারতে একটি বাহিনী তৈরী হোল, উত্তরপ্রদেশ আর্মড কন্সটেবুলারি।১৯৫২সালের আশেপাশে তার সম্বন্ধে কাগজে একটি খবর প্রকাশিত হয়, তাতে বলা হয় যাকে ডাকাত বলা হচ্ছে উনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে যে ভাষণ দেন তা শোনার মতন।  উনি সুদখোর মহাজন দের দেশ থেকে দূর করতে চান, গ্রামে গ্রামে শিক্ষার প্রসার চান।মেয়েদের সম্মান রক্ষার কথা বলেন।
সুদখোর ও জোতদারদের টাকা কেড়ে নিয়ে  তিনি তা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা, গরিবের মেয়ে বিয়ে বা ছেলে মেয়েদের পড়াশুনোর জন্য তিনি সাহায্য করতেন।তিনি গ্রামে গ্রামে ইস্কুল ও চিকিৎসা কেন্দ্র বানিয়েছিলেন।
কথার কথা নয়, মান সিং সত্যিই ভারতের রবিনহুড।
১৯৫৫ সালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তার মৃত্যু হয়।মান সিং এর মৃত্যু ও রহস্যজনক যেখানে যেভাবে এনকাউন্টার হয়েছিল বলে বলা হয়, তাতে অনেক ফাঁক আছে, তার একছেলে জীবিত আত্মসমর্পণ করে যে  এনকাউন্টারের আগের শেল্টারের খাবার দুধ খায় নি, খুব সম্ভবত তাদের বিশ্বাসঘাতকতা করে বিষ ও ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। 
তার গ্রামে মানুষ তার স্মৃতিতে একটি স্মৃতি মন্দির বানিয়েছে।আজও লোকোগানে তাকে স্মরণ করে মানুষ।
মান সিং এই মেকি স্বাধীনতার গালে একটা থাপ্পড়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ