পারস্য বিদ্রোহ -নতুনের আবাহন না ধ্বংসের প্রারম্ভিক সূচনা?।। আজিজুল শাহজী

সংগ্রামের প্রারম্ভিক বর্ণনা 

এই বছর শুরুর সময়ে ইরান মানে পারসিকদের গন বিক্ষোভ নিয়ে কিছু লিখেছিলাম। সেই সূত্র কে মাথায় রেখে বর্তমানের বিদ্রোহের উপর কিছু লিখতে আবার এসেছি।যারা ওটা দেখেন নি তাদের জন্য আগের সূত্র একদম শেষে রেখে গিয়েছি,ইচ্ছা হলে দেখে নেবেন।  
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি,এই অন্তর্জালের বন্ধুদের অনেকের চাপাচাপিতে প্রাচীন পারস্য এবং জরাথ্রুস্ট কে নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে এই দেশ বা এদের সমন্ধে আগ্রহী হয়েছিলাম।গত মাস থেকেই কিছু রাজনৈতিক কারণে বা রাজরোষে দেশের বাইরে থাকা ইরানিদের নিজস্ব সূত্র এবং অন্য সূত্র থেকে খবর পাচ্ছিলাম আবার দেশটি অশান্ত হয়ে উঠেছে।

আমার সীমিত বোধবুদ্ধিতে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি যে অশেষ রবীন্দ্রনাথ মোক্ষম কথা বলেছিলেন , মানুষ অমিত শক্তির একটি প্রাণী যাকে  ছাঁচে ফেলে যন্ত্র তৈরী করতে গেলে ওই ছাঁচই নষ্ট হয়ে যায়। পূর্বতন সেভিয়েত থেকে পূর্ব ইউরোপের অনেক হীরক রাজারা ওটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে তবে দেখে শেখা  যাদের দরকার ছিল তারা শেখেনি তাই হয়তো ঠেকে শেখার রাস্তাই তাদের জন্য নিয়তি!
এই বিদ্রোহের সূচনা দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা এবং ধর্মের ষাঁড়দের এবং তাদের পোষা রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারী এবং গোটা দেশব্যাপী নজরদারির মোরাল পুলিশ বা নীতি পালকদের কীর্তিকলাপ তিতিবিরক্ত ইরানিদের বিদ্রোহের থেকে। ইরানের শাহ বা তার শাসনের অপদার্থতার কারণে যে বিদ্রোহ ১৯৭৯ এ জনতা করেছিল তার পরবর্তীতে আজ এসে তারা উপলব্ধি করছে যে শাসক কে তাড়িয়ে তারা পরিবর্তন এনেছিলেন ওটা তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রক্তক্ষয়,দেশের রক্ষণশীল অর্থনীতি কে আঁকড়ে ধরে থাকা শাসক গোষ্ঠীর অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধি দিতে ব্যর্থতা এবং বহিবিশ্বে শত্রুতা সর্বপরি শ্যাম চাচা মানে আমেরিকার সাথে দ্বৈরথ তাদের জন্য অতীব সমস্যার কারন হয়েছে। ইরানের মানুষ শ্বাস নিতে চাইছে,চাইছে ধর্মের নিগড় থেকে মুক্তি , মোল্লাতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের চোখ রাঙানির থেকে মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক একটি কাঠামোতে  ফিরে যেতে। এই বিদ্রোহ নতুন গতি পেয়েছে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে। আসুন একটু জানি কি হয়ে চলেছে আর হচ্ছে এই প্রাচীন সভ্যতার দেশটিতে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি,এর উপর আপনি আমাদের সংবাদপত্র বা অন্য মিডিয়াতে খবর পাবেন না আর পেলেও একটু ছুঁয়ে যাবে যতক্ষণ না তা চরমে যায়।

নিজের কথা থাক,বিষয়ে আসি , এই বর্ননা দেওয়ার জন্য যথারীতি নির্ভর করেছি সংবাদ মাধ্যমের উপর এবং সে ক্ষেত্রে সার্বিক প্রয়াস রেখেছি কোনো মার্কিন সংবাদ সূত্র বা ইজরায়েল এর খবরের কাগজ কে এর তথ্যসূত্র না করতে কারন পাছে ইরান-অনুভূতি সম্পন্ন কেউ আমাকে ওই দিকের বেতন ভোগী বা অন্য সুবিধা ভোগী ভেবে ফেলেন এই কথা ভেবে। 

গত জানুয়ারির জন জাগরন এবং তারপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পর অনেকেই ভেবেছিল যে এই বিদ্রোহ হয়তো সাময়িক,ওটা ভাবার কারন হলো দেশটি একটি আবরনে ঢাকা অনেকটাই সেই পূর্বতন কমিউনিস্ট/সমাজতান্ত্রিক(আসলে একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরশাসন)দেশগুলোর মতো অবস্থায় আছে যেখানে সংবাদমাধ্যম বা রাষ্ট্রের কাজের বিরুদ্ধে বলা প্রায় অসম্ভব।যাই হোক অনেক বোদ্ধাকে ভুল প্রমান করে পারস্যের জনগন আমাদের জানান দিচ্ছে তারা তাদের রাস্তা থেকে সরে আসেন নি।আরব বা পাকিস্থানি সংবাদ মাধ্যম এবং কিছু জার্মানির আর আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত এসোসিয়েটেড প্রেস,রয়টার ইত্যাদির ভিত্তিতে ঘটনাপ্রবাহ কে সাজিয়ে তুলে ধরছি আপনাদের সামনে।

যা দেখছি তাতে মে মাসের ১৭ তারিখের খবরে জানতে পারছি কাজিরুন শহরে প্রশাসনিক কাজ এবং ওই প্রদেশটিকে বিভাজন নিয়ে এক বিক্ষোভ শুরু হয় যাতে সরকারী সংস্থাকে সূত্র করে বাকি সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে এক জন নিহত এবং ১০ জনের মতো আহত হয়।প্রচুর মানুষকে গ্রেফতার ও করা হয়।পরবর্তিতে ইরান সরকার পিছুহটে এই প্রকল্পকে বাতিল করে। 

মূলত অর্থনৈতিক অব্যবস্থা আর আগের নিষেধের দমবন্ধ করা অবস্থা কে আরো ক্ষুব্ধ করে তোলে সাধারণ নাগরিকদের। বিভিন্ন শহরে ইতস্তত বিক্ষোভ ক্রমশ চলে আসে ইরানের রাজধানী তেহরানের উপরে।  এসোসিয়েটেড প্রেস ওই দেশের সামাজিক মাধ্যম কে সূত্র করে জানাচ্ছে যে জুনের শেষ ভাগে বিক্ষুব্ধ জনতা ইরানের পার্লামেন্ট এবং সবচেয়ে বড় বাজারের কাছে তাদের বিক্ষোভ সংগঠিত করতে থাকে। দোকানদারেরা তাদের দোকান বন্ধ করে ফেলতে থাকে এবং একটা সার্বিক অচলাবস্থা তৈরী হয়।  জনতা সরকার কে ভীরু এবং এই মোল্লাতন্ত্রকে ধিক্কার দিতে থাকে তাদের সোচ্চার বিক্ষোভের মাধ্যমে। পুলিশ এবং প্রশাসন কাঁদানে গ্যাস বা লাঠি ইত্যাদির মাধ্যমে সাময়িক বিক্ষোভ প্রশমন করলেও কোনো পাকাপাকি ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় নি।

জুলাই এর এক এবং দুই তারিখে একই সাথে বিক্ষোভের নতুন ইন্ধন হয়ে ওঠে ইরাকের সীমান্তবর্তী খোরাম শহরে। ওই অঞ্চলে পানিও জলের অভাব এবং সরকারের অপদার্থতা নিয়ে সরব হয় সাধারণ মানুষ। সরকারের সরবরাহ করা জলের নলে কাদা মিশ্রিত আর নোনা জলের কারণে সর্বপরি সামগ্রিক খরা পরিস্থিতিতে সরকারের অপদার্থতা নিয়ে বিক্ষোভ বেড়ে যায়। একের পর এক শহর মানে এই অঞ্চলের অন্য জায়গা মানে আবাদান এবং তেল সম্বৃদ্ধ কুজেস্থান শহরে এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে নাগরিকরা শান্তিপূর্ণ ভাবে এই বিক্ষোভ চালিয়ে গেলেও পরবর্তী পর্যায়ে তা সহিংস হয়ে ওঠে। এটিএম ভাঙচুর থেকে বিভিন্ন জায়গায় গুলি চালানোর এবং পাথর ছোড়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। সরকারি বাহিনী এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং তার বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। মেশিনগানের গুলির আওয়াজ,আহত বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া বা কালাশনিকভ নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো মানুষের ছবি ও দেখা যায়। প্রসঙ্গত বলা যায় এই শহর গুলো আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় প্রবল যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। হাজারে হাজারে মানুষের মৃত্যু আর তেলের পাইপ বা সম্পত্তির প্রভূত ক্ষতি সেই সময়ে হয়েছিল।


এই বিক্ষোভের পরে অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী আব্দুলরেজা রহমানী ফজলি সাংবাদিকদের এই বিক্ষোভ ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দিয়ে কোনো হতাহত হয় নি আর ওটা দমন করা গিয়েছে বলে ভাষণ দেয়। সোজা কথায়,এর থেকে কোনো শিক্ষা ইরানের প্রশাসন নেয় নি।ইরান গত তিরিশ বছর ধরেই খরার কবলে। এরমধ্যে জলের সরবরাহ নিয়ে স্বজন পোষণ এবং দূষিত জলের কারণে অসুস্থতা প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে আরো প্রকট করে তুলেছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো,এই খরা ইত্যাদি কিন্তু এই জনবিক্ষোভের মূল কারন বলছে না বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। মূলত অর্থনৈতিক স্থবিরতা,সরকারের অনমনীয়তা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের অতীব খারাপ দশা আজ ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থা কে এক অবর্ণনীয় জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। আসুন দেখি ঠিক কি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে,এরপর হালের বিক্ষোভ ইত্যাদির কিছু ঘটনা এবং তার পরবর্তী কি ফলাফল হতে পারে তা নিয়ে কথা বলবো। 

আজকের দিনে ইরানের রিয়্যাল এর দাম দাঁড়িয়েছে এক ডলারে ৯০ হাজার রিয়্যাল!সরকারি দাম অবশ্য ৪২ হাজার তবে এই দাম খোলা বাজারের সুতরাং এই একটা খবর থেকেই বুঝতে পারছেন অবস্থা কি শোচনীয় ! আসুন একটু অর্থনৈতিক দুরবস্থা কি জায়গায় গিয়েছে ওটা দেখি 
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুই দেশের বৈঠক থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার পর থেকে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে ওঠে।  মে মাসের আট তারিখে এই প্রত্যাহারের পর ইরান সরকারে বিদেশ দফতর বা নেতৃত্বের প্রজ্ঞা আর কর্মকুশলতার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নি এর মোকাবিলা করার। আমেরিকা তার পুরোনো অপমান ভুলে যায় নি তাই একাধারে বিভিন্ন  বহুজাতিক কোম্পানিদের এই অবস্থাতে শত শত কোটি ডলারের তেল সংক্রান্ত এবং পরিকাঠামোর চুক্তি থেকে সরে আসতে হয়।ইরান তাতে একই ভাবে অনড় থেকে আমেরিকাকে সৌদির কাছে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির কাজ ইত্যাদি কে ভিক্ষাবৃত্তি বলে ব্যঙ্গ করে কিন্তু এর পাল্টা কিছু করার জন্য উদ্যোগ ? উহু কোনো চেষ্টাই তারা করে নি।উল্টে ইরানের প্রথম উপ রাষ্ট্রপতি ইসহাক জাহাঙ্গিরি কোনো নাম না করে এই সৌদি তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে ইরানকে বঞ্চিত করলে পরিনাম সাংঘাতিক হবে বলে হুমকি দেয়। বিপদে বুদ্ধিমান অর্ধেক ত্যাগ করে বা নির্বোধের মতো শক্তিক্ষয় করে নিজেদের অবস্থা আরো খারাপ করা যে সমীচীন না এই কথাগুলো তাদের শাসক গোষ্ঠীর মাথায় এখনো আসে নি।


এই লেখা যখন লিখছি মানে এই মঙ্গলবার থেকে ইরানের উপর নেমে আসছে আমেরিকান ব্যাংক নোট কেনার উপর নিষেধাজ্ঞা সঙ্গে ইরানি রপ্তানীকারকদের উপর রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা। এরপর নভেম্বরের ৪ তারিখ থেকে আসতে চলেছে জ্বালানি ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা।এর ফলে পৃথিবীর কোনো দেশ ইরান থেকে আর ওই তারিখের পর তেল কিনতে পারবে না!আর ইরানের আয়ের ৬০% আমেরিকা মানে ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি বর্তমান ইরানের শাসকের উপর অনাস্থা এবং এর অপসারণের জন্য ইরানের প্রবাসী নাগরিকদের সরকারি ভাবে বলেছে। অর্থাৎ লড়াই একদম সরাসরি হতে চলেছে আর তা হবে অর্থনৈতিক। অন্যদিকে ইরানের রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি হুঙ্কার দিচ্ছে চরম যুদ্ধ কাকে বলে তা দেখিয়ে দেবে। অর্থাৎ ইরানের শাসকের আপৎকালীন কোনো অবস্থান পরিবর্তন করতে রাজি না !

উলখাগড়ার প্রাণ যায়  ....

এই দ্বৈরথে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র থেকে দেখতে পাচ্ছি যে গত ছয়মাসে ইরানের এই বহুদিনের টালমাটাল খাওয়া অর্থনীতি আরো তলানিতে গিয়েছে। ইরানি রিয়্যাল এর মূল্য ৫০ % হ্রাস পেয়েছে এই ছয় মাসেই ! ১৯৭৯ এর জন বিক্ষোভ যার ফলে রেজা শাহীর পতন হয়েছিল তার মতোই দশা হয়েছে বর্তমানে। ঠিক সেই সময়ের মতোই মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ দোকানদার এবং ব্যবসায়ী সবাই বিক্ষুব্ধ। 

শুধু কি আমেরিকার রোষে এই অবস্থা ?
প্রাথমিক ভাবে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছিল তবে তলিয়ে দেখে বুঝেছি এক সার্বিক অব্যবস্থা এবং দুর্নীতি এই অবস্থা তৈরী করেছে। ইরানের চেম্বার অফ কমার্স এর প্রথম উপ প্রধান সোলতানির মতে হাজার হাজার কোটি টাকার তছরুপ হয়েছে সমান্তরাল অর্থনীতি এবং হাওলার মাধ্যমে টাকা পাচারের কারণে।  একই সাথে ইরানের পার্লামেন্টের অর্থনৈতিক বিভাগের প্রধান মহম্মদ রেজা ইব্রাহিমীর কথা অনুযায়ী দেখতে পাচ্ছি ইরান স্রেফ এই বছরে ৩ হাজার কোটি ডলার এর ক্ষতি করেছে পণ্য আমদানির জন্য খরচ দেখিয়ে যার একটি ও পণ্য ইরানে আসে নি। বুঝতেই পারছেন কি হয়েছে ! 
গত আট মাসে এইভাবে টাকা পাচার এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ইরানের সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কে কমিয়েছে ৮০% আর খারাজমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রধান সরকারি প্রচার মাধ্যমে বলেছেন এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই বছরের শেষের মধ্যেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ৩০% এ নিয়ে যাবে। অর্থাৎ অবস্থা অতীব সঙ্গিন!এই অবস্থায় ফরাসী বা ইউরোপীয় বহুজাতিকরা ও পিছিয়ে আসছে আগের চুক্তি ইত্যাদি থেকে।  ইতিমধ্যেই ফ্রান্সের টোটাল এবং প্যাজিও কোম্পানি তাদের বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে।একই সাথে দুই বৃহত্তম বেসামরিক বিমান প্রস্তুতকারক বোয়িং এবং এয়ারবাস তাদের ২০১৫ তে করা চুক্তি থেকে পিছিয়ে এসে নিজেদের শত শত কোটি ডলার এর লোকসান ও দিয়েছে।একই ভাবে পিছিয়ে এসেছে জার্মানির সিমেন্স গোষ্ঠীও। 

ইতিমধ্যেই এমন অবস্থা দাড়িয়েছে যে সরকারী চেষ্টা মানে খোলাবাজারের বা  কালো বাজারের মুদ্রার বিনিময় আর সরকারী বিনিময় কে সমন্বয় করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।সরকার চেষ্টা করেছিল ৪২হাজার রিয়াল এ ওটা বেধে রাখতে যা সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।সরকারী কোনো আশ্বাস মানুষ আর বিশ্বাস করছে না।এমন দশা দাড়িয়েছে যে তেহরানের সবচেয়ে বড় মোবাইল বিক্রেতা দুটি প্রতিষ্ঠান তাদের বিক্রি বন্ধ রেখেছে কারন মুদ্রার মান স্থির নেই বলে।

আমাদের মানে ভারতের সমস্যা 
আমরা ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক সুতরাং এই বিপর্যের ফল আমাদের উপরে আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই তেলের সিংহভাগ কেনে চীন এবং ভারত সুতরাং এই ঝামেলাতে আমাদের জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ইরানের এই তেল কেনার উপর একটি সম্পর্কিত রেখচিত্র সঙ্গে দিলাম দেখলেই বুঝতে পারবেন কেন বিষয়টা আমাদের জন্য খুব উদ্বেগের।আরো ঝামেলা হলো,আমাদের মানে ভারত এবং চিনের ইরানের সাথে বানিজ্যিক যোগাযোগ গোটা পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি,হ্যা তেল বাদে অন্য ক্ষেত্রেও,বিশেষত ভারতের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা চাবাহার বন্দরের কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা বা দেরী হওয়ার কারন হতে পারে ফলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে শত শত কোটি টাকা।

বর্তমান পরিস্থিতি 
তথ্যসূত্র মানে এই বিষয়ে পড়া কাগজগুলো বলছে অবস্থা সেই ১৯৭৯ এর মতোই,সেই সময়ের রাজা শাহ কে উত্খাতের জন্য জনতা আওয়াজ তুলেছিল শাহ মুর্দাবাদ আর আজ বলছে স্বৈরাচারী শাসক মুর্দাবাদ! এই আওয়াজ যেমন সর্বত্র উঠেছিল ঠিক তেমনি এখনো তাই হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট রুহানি কঠোরতা আবার আলোচনা ইত্যাদি করার নানান প্রচেষ্টা করে এই আন্দোলন দমনের চেষ্টা করলেও তার প্রশমন অতীব কঠিন তা মানছেন ইরানের বিদেশে কর্মরত পদস্থ ব্যক্তিরা। একই সাথে সাধারণ মানুষ এমনকি দোকানদাররা পর্যন্ত এক দিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন বলে মনে করছেন না।  রৌহানির বিরোধী পক্ষ বা কট্টর পন্থী গোষ্ঠীরা ও আবার নির্বাচন চাইছে। দেশের প্রধান ধর্মীয় নেতা খোমেইনী আবেদন করলেও তাতে কর্নপাত করছে কেউ বলে দেখা যাচ্ছে। উল্টো তার এবং এই মোল্লাগোষ্ঠীর অপশাসন নিয়ে বিক্ষোভ বেড়েই চলেছে।
জুলাই এর গোড়াতে ক্ষুব্ধ জনতা স্বতস্ফুর্ত ভাবেই রাস্তায় নেমে ইরানের সংসদ মানে পার্লামেন্টের দিকে এগিয়ে গিয়েছে লাঠি এবং টিয়ারগ্যাস বা গুলি উপেক্ষা করে।ফার্সি ভাষাতে স্লোগান উঠেছে খোমেইনি এবং বাকিদের চোর বলে ,প্রশাসন কে কাপুরুষ বলে আখ্যা দিয়ে।আরো উল্লেখযোগ্য হলো,এক মিডিয়ার প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে যে কিছু জায়গায় সরকারের কিছু সহযোগী গোষ্ঠী রুহানিকে চাপে ফেলার জন্য এই বিক্ষোভকে মদদ ও দিয়েছে,বুঝুন অবস্থা!

বিক্ষোভের প্রকাশ হয়েছে ইরানের বিভিন্ন প্রদেশ এবং শহরে।সিরাজ,আহ্ভাজ,মাসাদ,কারাজ শহর হয়ে ইস্পাহানে ও ছড়িয়েছে।বিত্তবানেরা তাদের সহায় সম্বল কে বিদেশী অর্থে পরিবর্তিত করে অথবা সোনা বা মূল্যবান বস্তুতে পরিবর্তিত করে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছে।সাধারন মানুষ বা ছোট ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে কাল কি দর হবে ভেবে আজ মাল কিনতে যাচ্ছে আর বড় ব্যবসায়ী কাল কি হবে ভেবে ওটা বিক্রি করতে চাইছে না।এক অরাজক অবস্থা তৈরী হয়েছে,অন্তত উল্লেখিত কাগজগুলো তাই বলছে।বোঝার উপর শাকের আটি হয়েছে গত তিরিশ বছর ধরে চলা খরা,ইস্পাহানের হাজারে হাজারে চাষী প্রতিদিন বিক্ষোভ দেখাচ্ছে,অনেকেই শাসকের গুলি বা লাঠির ঘায়ে আহত হয়েছে ফলে একটা সার্বিক জন অসন্তোষ সব শ্রেনীর মধ্যে ছড়িয়েছে।

ইতিমধ্যেই বেশ কিছু শহরে মসজিদ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ভাঙচুর হয়েছে।দাবি উঠেছে শাসক গোষ্ঠির ক্ষমতার অধিকারীদের শাস্তির,এদের অনেকের নাকি একাধিক পাসপোর্ট আর বিদেশে আস্তানা আছে।একটা সার্বিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন ক্রমবর্ধমান।একটাই বিষয় উল্লেখ্য,তা হলো এখনো সেই আগের বছরের ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির মতো উত্তাল অবস্থা তৈরী হয় নি।


বজ্র আটুনি ফস্কা গেরো 
অদ্ভুত লাগলেও বলা যায়,কালোবাজারের এই ডলার বা বিদেশী মুদ্রার কারবার কে শেষ করতে গিয়ে এখন ইরানের প্রশাসন সমূহ বিপদে।দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে এই কারবারের এক বহুকোটিপতি ব্যবসায়ী বাবাক জানজানিকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে এই রাস্তাতে সাময়িক স্বস্তি আনার জায়গা ও বন্ধ করেছে এরা।ভাবছেন কি ভাবে?উত্তর সহজ,রুহানি এই ব্যবসা বা হুন্ডি বন্ধ করার যে রাস্তা নিয়েছিল আর এর সূত্র যা ছিল তা আজ মার্কিন ট্রেজারীর কাছে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে ফলে এই রাস্তা এখন ব্যবহার করে আমেরিকাকে ফাকি দেওয়ার রাস্তা আর নেই!আমি বলছিনা,মহম্মদ রেজা,তেহরান চেম্বার অফ কমার্স এর প্রাক্তন প্রধান এই কথা বলছেন।
মূলত যে সময়ে এই চুক্তি হওয়ার কথা চলছিল অর্থাত ২০১৫ পরবর্তী পর্যায়ে কোনো অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তন বা কোনো নতুন কিছুই করে নি ইরান সরকার তাই কোনো প্রস্তুতি ছাড়া আজ স্বখাত সলিলে।

আরো সমস্যা এবং বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে এদের রক্ষনশীল বা বাইরের পৃথিবীর কাছে বিষয় লুকিয়ে রাখার প্রবনতা।বিদেশী সংবাদ মাধ্যমকে ঢুকতে না দিয়ে বিশ্বের কাছে আরো বেশি অনিশ্চয়তার ছবি তুলে ধরছে ইরানের এই ক্ষমতাশীল সরকার।এক দিকে সাধারন মানুষ অন্য দিকে কট্টরপন্থী বিরোধী শিবির একটা অরাজক পরিস্থতি তৈরী করেছে। 

মানুষ কি বলছে ?
শুনলে অবাক হবেন,আমি নিজেও ভেবেছিলাম যে মার্কিন এই নিষেধাজ্ঞা বা দাদাগিরির কারণে  হয়ত ইরানীদের ক্ষেত্রে তাদের স্বভাবসিদ্ধ ভুমিকাতে দেখা যাবে,কার্যত অবাক হচ্ছি এই দেখে যে তাদের ক্ষোভ বা ক্রোধের জায়গা আমেরিকা বা অন্য কোনো শক্তির উপর না,তারা সোজা বলছে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু দরকার আর তা পাশ্চাত্যের কোনো শক্তি বা স্বদেশী কোনো পক্ষের থেকে আসবে তাতে কোনো মাথা ব্যথা নেই।


অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রতিবেদনে বিক্ষুব্ধ মানুষরা তাদের নাম বা বিস্তারিত পরিচয় দিতে ভয় পেয়েছেন দেখতে পাচ্ছি,আরো দেখছি ধনী নির্ধন বা শিক্ষিত কি অশিক্ষিত মানুষ ইরানের ক্ষমতাশীল পক্ষকে অপদার্থতার জন্য দোষ দিচ্ছেন একই ভাবে।

এক সার্বিক হতাশার ছবি দেখতে পাচ্ছি অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংস্কার চাওয়া বা কট্টরপন্থী মানুষ উভয়ের মধ্যেই।কারখানার মালিক তার কারখানা বন্ধ করছে ,দোকানদার তার দোকান বন্ধ করে দিচ্ছে,মানুষ দিশাহারা।বর্তমান রুহানির সরকার বেশ কিছু মন্ত্রী বা পদস্থ কর্মচারীর গ্রেফতার ইত্যাদি করলেও ইউরো কালো বাজারে বিকোচ্ছে এক ইউরো এক লক্ষ ইরানি রিয়ালে!অনাবাসী ইরানিরা যারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছিলেন দেশে বিনিযোগ করতে তারা আবার চলে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছে।সেই ইরাক ইরান যুদ্ধের সময়ের মতো খাওয়ারের জন্য কুপন বা রেশন ব্যবস্থা আবার চালু করে,দামী পণ্য বা অনাবশ্যক বস্তু আমদানি আটকে কোনো সুরাহা হচ্ছে না দেখতে পাচ্ছি।

আগামীর দিনগুলোর ক্ষেত্রে কি হতে পারে ?
একটা পরিবর্তন আসতে পারে তবে তা কতটা ইরানের জন্য মঙ্গলের ওটা বলা শক্ত,অন্তত আমার দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে।যদি স্ব্দর্থ্ক কিছু হয় তবে তা সবার জন্য মঙ্গল নিয়ে আসবে আর যদি না হয়? তবে আরো একটি রক্তক্ষয়ী অধ্যারের সূচনা হবে,সে ক্ষেত্রে আমাদের উপর ও অর্থনৈতিক আচ আসবে,আরো বেশি করে অশান্ত হয়ে উঠবে এইদিকের বেশ কিছু অঞ্চল।
আর তা যদি না হয়?হয়তো সে ক্ষেত্রে আমরা আবার আধুনিক সেই পারস্য কে দেখতে পাবো।আপাতত নজরে পারস্য আর বুক ভরা আশা নিয়ে আছি।এই ভূমি অতীব উন্নত এবং অনেক সভ্যতার আদি পর্বের শিকড় ধারণ করে আজো রয়ে গিয়েছে তাই তার কোনো ক্ষতি হলে অত্যন্ত ব্যথিত হবো।

এই বেসামাল অসমাপ্ত অধ্যায় এর এই পর্বের পরবর্তী ঘটনার প্রতি নজর রেখে আজকের এই লেখাতে ইতি টানলাম।ভালো থাকুন সবাই !

তথ্যসূত্র : (উপরে যেমন বলেছি,ইচ্ছাকৃত ভাবেই পশ্চিমের মানে আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো সূত্র সরাসরি ব্যবহার না করে মূলত পাকিস্থানের এবং মধ্যপ্রাচ্যের সূত্র কে ব্যবহার করেছি তবে মিলিয়ে নিয়েছি অন্য সূত্রের সাথে।একটি সুত্রে বিবিসির খবর কে একটু তুলে ধরা ছাড়া বাকি গুলো স্বযত্নে এড়িয়ে গিয়েছি।আশাকরি তথ্য নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি হলে আগের মতো ধরিয়ে দেবেন!)




৪. উত্তাল ইরানের বিক্ষোভের ভিডিও দেখুন: স্বৈরাচার নিপাত যাক স্লোগানে মুখর ইরান https://www.youtube.com/watch?v=IpaIiDnQjv0

৫. ইরানের তেহরানের প্রধান বাজার গ্র্যান্ড বাজার বন্ধ করার বিক্ষোভ https://www.youtube.com/watch?v=OI6hzOe1_GY

৬. অর্থনৈতিক সংকটের ছবি,পাকিস্থানের কাগজ থেকে https://www.dawn.com/news/1423941

৭. খরা আর কৃষকের ব্যথার ছবি https://www.dawn.com/news/1421311

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ