হেলানো টাওয়ার আর টেলিস্কোপ।। কে এম হাসান

(ছবি: Palazzo Vecchio,Uffizi Gallery, Exterior,Galileo Sculpture,Florence)

বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে -১৫ ফেব্রুয়ারী গ্যালিলিওর জন্মদিনে –

তাঁর জীবন সম্বন্ধে আমাদের জানা সব তথ্যগুলো এসেছে তিন জনের লেখা থেকে। প্রথম জন ভিনসেনজো ভিভিয়ানি (১৬২২-১৭০৩), গ্যালিলিওর এই সর্বশেষ ছাত্রটি প্রথম যখন তার গুরুর কাছে এসেছিলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬। ভিভিয়ানি প্রথম গ্যালিলিওর জীবনী লিখেছিলেন ( যা প্রকাশিত হয়েছে তার মৃত্যুর পর – ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে) ও তার সব কাগজপত্র সংরক্ষণ করেছিলেন।ভিভিয়ানির ইচ্ছা ছিল তার শিক্ষকের সব বৈজ্ঞানিক রচনার ও নোটের একটি সংকলন প্রকাশ করবেন, সেটি হয়নি। । ভিভিয়ানি মারা যাবার পর বিশাল এক কাঠের আলমারী ভরা গ্যালিলিওর সব কাগজপত্র হাতে আসে তার এক ভাইয়ের ছেলের হাতে, সেখান থেকে আবরো আরেক ভাইপোর কাছে। যদিও তখন গ্যালিলিওকে তখন চার্চের কলঙ্ক হিসাবে চিহ্নিত করা বন্ধ হয়েছে, ফ্লোরেন্সের চার্চে সন্মানজনক কবরে তার জায়গাও হয়েছে। ভিভিয়ানির ভাইপোর কোনো আগ্রহই ছিলনা আলমারী ভর্তি গ্যালিলিওর পাণ্ডুলিপিগেুলোর প্রতি, বরং তারা সব কাগজ সরিয়ে সেটিকে কাপড় রাখার আলমারী হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।

১৭৫০ সালের বসন্তে ফ্লোরেন্সের আরেকজন সুশিক্ষিত মানুষ জিওভানী বাসিস্তা নেলী (১৭২৫-১৭৯৩) পিকনিকে যাবার পথে তার অংশগ্রহন হিসাবে মাংশের টুকরো কিনতে স্থানীয় এক কসাইয়ের দোকানে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে কেনা মাংসের টুকরোটা যখন তিনি পিকনিকে বসে এর কাগজের মোড়ক থেকে বের করেন, সৌভাগ্য বলতে হবে যে তিনি সেই কাগজে হঠাৎ করেই গ্যালিলিওর লেখা দেখতে পান। যতদ্রুত সম্ভব তিনি সেই কসাইখানায় ফিরে এসেছিলেন তাদের মোড়কের কাগজের সরবরাহ কোথা থেকে এসেছে তা অনুসন্ধান করতে। অবশেষে তিনি ভিভিয়ানির পুরোনো বাসায় তার ভাইপোর ভাইপোর কাছে গালিলিওর পাণ্ডুলিপি ও নানা কাগজপত্রের বিশাল সংগ্রহটি আবিষ্কার করেন, যা সেই পরিবার মোড়ক বানানোর কাগজ হিসাবে ধাপে ধাপে বিক্রি করে আসছিলো – খুব সহজেই পুরো সংগ্রহটি কিনে নেন নেলী। এই কাগজগুলো থেকে গ্যালিলিওর দ্বিতীয় জীবনীটি প্রকাশ করেন – এবং গ্যালিলিওর সব লেখাগুলো তিনি ফ্লোরেন্সের সরকারী আর্কাইভে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেন।


১৮৯০ সালে যে কাগজপত্রগুলো ব্যবহার করেছিলেন আন্তোনিও ফাবারো, তিনি পৃথিবীর প্রথম গ্যালিলিও বিশেষজ্ঞ, ১৮৯০ থেকে ১৯০৯ তিনি ২১ খণ্ডে গ্যালিলিওর সব লেখা প্রকাশ করেন। গ্যালিলিও সম্বন্ধে আজ আমরা যা জানি তা সবই ফাবারো জানতেন। তবে ফাবারো গ্যালিলিওর বিজ্ঞানী হিসাবে সুনামটি সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা করেছিলেন সর্বোতভাবেই, একজন ধর্মভীরু ক্যাথলিক ও ভালো মানুষ হিসাবে তাকে প্রতিষ্ঠা করতে যে সব বিষয়গুলো উহ্য রাখার বা প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা যা করার দরকার সব করেছিলেন তিনি, তবে তিনি কোনো কিছুই গোপন করেননি।

১৬৪২ সালে গ্যালিলিও যখন ফ্লোরেন্সে মারা যান, তখন ফ্লোরেন্সে তার তিন দশকের বেশী সময় কেটেছিল। কিন্তু ৪৬ বছর বয়সে পাদুয়া থেকে ফ্লোরেন্সে আসার সময় ধারণা করা হয় গ্যালিলিও বহু কাগজপত্র চিঠি ফেলে দিয়েছিলেন। ফাবারোর Le Opere Di Galileo Galilei এর দশম খণ্ডে গ্যালিলিওর প্রথম ৪৬ বছরের চিঠিপত্রগুলো আছে, কিন্তু পঞ্চদশ খণ্ডেই আমরা দেখতে পাই শুধুমাত্র ১৬৩৩ সালে লেখা চিঠিগুলো – গ্যালিলিওর বিচারের বছরটি। একবছরে তিনি যত চিঠি লিখেছিলেন, সেই অনুপাতে তার জীবনের প্রথম দিকের সেই পরিমান চিঠি হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য। আর বিষয়টি হতাশার কারণ যখন আমরা জানি তার বয়স পঞ্চাশের পর গ্যালিলিও নিজেই কোনো বড় বৈজ্ঞানিক কাজ করেননি, অথচ বেশীভাগ কাগজপত্র তার শেষ জীবনের, তাছাড়া ১৬৩৭ তিনি অন্ধ হয়ে যাবার পর আসলেই লক্ষ্য রাখেননি, কোন কাগজটি রাখবেন আর কোনটি ফেলে দেবেন। সুতরাং ভিভিয়ানি, নেলি, ফাবারো থেকেই আমরা মূলত যে গ্যালিলিওকে পেয়েছি, সেখানে আমাদের জানার কোনো উপায় নেই কত গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পরিত্যক্ত কাগজ হিসাবে মাংসের টুকরো ঢাকার কাগজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ভিভিয়ানির লক্ষ্য ছিল, ক্যাথলিক চার্চের দণ্ড সত্ত্বেও মহান বিজ্ঞানী হিসাবে তার শিক্ষকের মর্যাদা তিনি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা। সুতরাং তিনি সেখানে তার চার্চ বিরোধী কোনো অবস্থান সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। সুতরাং তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদদের অভিযোগ অনেক। যেমন অক্ষাংশ নিয়ে জেনেভার বিজ্ঞানী এলি ডিওডাটিকে লেখা তার শতাধিক চিঠির ( ডিওডাটি প্রোটেষ্টান্ট ছিলেন নামে মাত্র, মূলত অবিশ্বাসী) বহু তথ্য ভিভিয়ানি প্রকাশ করবেন না বলে ডিওবাটিকে জানিয়েছিলেন, সেই চিঠিগুলো আর অবশিষ্ট নেই ১৩ টি ছাড়া, যা ভিভিয়ানি আপত্তিকর না হিসাবে বাছাই করেছিলেন। এছাড়া গ্যালিলিওর নামে নিজেই চিঠি লিখেছিলেন বলে এমন প্রমাণ আছে। কারণ মনে করা হয় ১৬৩৩ এর পরে তিনি কোপার্নিকাসের মডেলের সমর্থনে বহু চিঠিপত্র লিখেছিলেন। যা ভিভিয়ানি তার গুরুকে ক্যাথলিক ফ্লোরেন্সে গ্রহনযোগ্য হিসাবে উপস্থাপন করার জন্য নষ্ট করেছেন। তবে গ্যালিলিওর বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠি যেমন পাওলো সার্পির ( যাকে ক্যাথলিক চার্চ বহু আগেই ত্যাজ্য করেছিল) কাছে গ্যালিলিওর চিঠি প্রমাণ করছে ভিন্ন কিছু। গ্যালিলিও বন্ধুদের সাথে কথোপকথনগুলোই আমাদের সত্যিকারের গ্যালিলিওর পরিচয়ের কাছাকাছি নিয়ে আসে।

ইতালীর পিসা শহরের মূল ক্যাথিড্রালটির প্রায় ৮৫০ বছরের প্রাচীন বেল বা ঘন্টার টাওয়ারটি অবশ্যই পৃথিবীর অদ্ভুত দালানগুলোর একটি। আমাদের অনেকের কাছে এটি লিনিং টাওয়ার অব পিসা (Leaning Tower of Pisa) নামেই পরিচিত। পিসায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের হেলানো এই টাওয়ারটির ছবি তোলা অন্যতম জনপ্রিয় একটি কাজ। এছাড়াও হেলানো টাওয়ারের সাথে একটি গল্প যুক্ত হয়ে আছে, গ্যালিলিও নাকি এই টাওয়ারটি ব্যবহার করেছিলেন তার একটি নিজস্ব পরীক্ষা করার জন্য – দুটি ভিন্ন ওজনের বস্তু উপর থেকে ফেলে দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যে কোনটি মাটিতে আগে পড়ছে। বাস্তব সত্যটি হচ্ছে গ্যালিলিও আসলে টাওয়ারটা ব্যবহার করেননি, কিন্তু তিনি অন্য আরো কিছু পরীক্ষা করেছিলেন, আর সেখান থেকে তিনি তথ্য পেয়েছিলেন, এরকম কোনো পরীক্ষার ফলাফল কি হতে পারে। গল্পটিকে তিনি দেখেছিলেন একটা দশ পাউণ্ডের বল আর এক পাউণ্ডের বল একই সাথে মাটিতে আঘাত করে, আর যেমন পৃথিবীর চারদিকে সূর্য প্রদক্ষিণ করছে না প্রতিদিন, এই পরীক্ষার ফলাফলও আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সাথে মেলেনা। তাছাড়া টাওয়ারের উপর থেকে ফেলা একটা পালক আর একটা বল যদি নিচে ফেলা হয় তারা কখনো একই গতির হারে নীচে পড়ে না। তাহলে কেন দুটো ভিন্ন ওজনের বল পৃথিবীতে একসাথে পড়বে?

যুগান্তকারী সেই পরীক্ষাটি পিসার হেলানো টাওয়ারে আসলে ঘটেনি, এই কাহিনীটির সূচনা করেছিল গ্যালেলিওর ছাত্র সহকারী ভিনসেনজিও ভিভিয়ানি (১৬২২-১৭০৩), ভিভিয়ানী তার শিক্ষকের আত্মজীবনী লিখেছিলেন, এবং গ্যালিলিও শেষ জীবনের গুরুর সাথে থাকতেন, তাকে পড়ে শোনাতেন।এখানে আরেকজনের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য তিনি ইভানজেলিস্টা টরিচেলি।ল (১৬০৮-১৬৪৭), তিনি গ্যালিলিওর ছাত্রের ছাত্র ছিলেন, ১৬৩২ এ তিনি গ্যালিলিওকে লিখেছিলেন তার Dialogue on the Two Chief World Systems, Ptolemaic and Copernican বইটি পড়ে তিনি কোপার্নিকাসে হেলিওসেন্ট্রিক মডেলের উপর তার বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। ১৬৪০ এ টরিচেল্লী একটি বই লেখেন motion of bodies, যেখানে তিনি পড়ন্ত বস্তু সম্বন্ধে গ্যালিলিওর ধারণার কিছু পরীক্ষামূলক প্রমান উল্লেখ করেছিলেন। টরিচেল্লি পরে গ্যালিলিওর সাথে ও তার মৃত্যুর পর ভিভিয়ানির সাথে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন।

১৬৫৪ তে ভিভিয়ানী গ্যালিলিওর জীবনী লিখতে শুরু করেন, বেশ কিছু কাল্পনিক কাহিনীও সেখানে তিনি যুক্ত করেছিলেন বলে মনে করা হয় তার একটি পিসার হেলানো টাওয়ারে কথা কথিত পরীক্ষাটি।গ্যালিলিও নিজে কখনো এমন কোনো পরীক্ষা করেছেন বলেও দাবী করেননি। এমনকি যদি পরীক্ষাটি অ্যারিস্টোটলের ধারণাটি ভ্রান্ত প্রমান করেছিল ( পড়ন্ত বস্তুর গতি এর ওজনের সমানুপাতিক) – গ্যালিলিও এর চেয়ে কম নাটকীয় পরীক্ষা করে সেটি প্রমান করেছিলেন – ; ১৫৮৬ সালে ডাচ প্রকৌশলী সাইমন স্টেভিন এই পরীক্ষাটি করেছিলেন, দুটি ভিন্ন ওজনের একই আকারের সীসার বলকে ৩০ ফুট উপর থেকে নীচে ফেলে দিয়ে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে আদর্শভাবে এই পরীক্ষাটির কাজ করে শূন্যস্থানে যেখানে বাতাসের (কারণ বাতাসের প্রতিরোধ বল আর অভিকর্ষীয় বল পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় প্রান্তিক বেগটি নির্দিষ্ট করে) ১৯৭১ সালে ২ আগষ্ট নভোচারী ডেভিড আর স্কট সাফল্যের সাথে এই পরীক্ষাটি করেছিলেন চাদের পৃষ্ঠে ( পালক আর হাতুড়ী দিয়ে)।

অ্যারিস্টোটলের প্রস্তাবনা ছিল ভারী কোনো বস্তু দ্রুত নীচে পড়বে কোনো হালকা বস্তু অপেক্ষা, কিন্তু গ্যালিলিওর প্রস্তাবনা ছিল একই পদার্থ দিয়ে তৈরী কোন দুটি বস্তু একই মাধ্যমে একই গতিতে নীচে পড়বে। বেশীর ভাগ বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদরা মনে করেন গ্যালিলিও এই ধারণায় পৌছেছিলেন একটি চিন্তার পরীক্ষার মাধ্যমে, তার বই On Motion তিনি কল্পনা করেছেন দুটি ভিন্ন ওজনের বস্তু, একই হালকা ও অন্যটি ভারী, তবে দুটোই পরস্পরের সাথে সুতো দিয়ে বাধা, কোনো একটি টাওয়ারের উপর থেকে যদি এটাকে নীচে ফেলে দেয়া হয়, যদি আমরা ধরে নেই যে ভারী বস্তুটি আগে মাটিতে পড়বে ( এবং হালকাটি পরে ধীরে), তাহলে দুটির মধ্যকার সুতোটি টান টান হয়ে ভারী বস্তুর পতনের গতিকে হ্রাস করবে, কিন্তু পুরো সিস্টেমটাই ভারী বস্তুটির একার চেয়ে ভারী, তাহলে তো তার আরো জোরে নীচে পড়ার কথা। এই স্ববিরোধীতাই প্রমান করে এই ধারণাটি ভুল। বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ James Robert Brown এটি বলেছেন the most beautiful thought experiment ever devise..

তবে Paolo Palmieri আরেক বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ মনে করেন, জীবনের প্রায় শেষের দিকে এসে গ্যালিলিও প্রস্তাব করেছিলেন বায়ু প্রতিরোধ বলের অনুপস্থিতিতে সব পতনশীল একটি গতিতে পতনশীল। তবে গ্যালিলিও চারদশক আগে তার অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি De Motu ও Postils to Rocco (১৬৩৪-১৬৩৫) বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলেন, তিনি কিন্তু সেখানে লেখেননি – কোনো শূন্য বা ভ্যাক্যুমে সব পতনশীল বস্তু একই সময় নেবে একই উচ্চতা থেকে পড়তে, তারা যে পদার্থ দিয়েই তৈরী হোক না কেন – বরং তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, একই ঘনত্বের কোন দুটি বস্তুর উপর এটি প্রয়োজ্য – যেমন মাস্কেটের গুলি আর কামানের গোলা, পরের বইটি Postils to Rocco তে তিনি এটি সম্প্রসারণ করেছিলেন যে কোনো ঘনত্বের বস্তুর উপর, কিন্তু স্বীকার করেছিলেন এটি তার তাত্ত্বিক ধারণা পরীক্ষালদ্ধ সত্য না। ১৫৮৬ সালে সাইমন স্টেভিনের আগেও আরেক ভেনিসবাসী একই পরীক্ষা করেছিলেন জিওভানি বাতিস্তা বেনেদেত্তি, এবং আরো হাজার বছর আগে স্বল্প পরিচিত বাইজানটাইন বিজ্ঞানী জন ফিরোপোনাস ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই কাজটি করেছিলেন।

পারিবারিক নাম যদিও গ্যালিলেই, তবে গ্যালিলিও সেই দূর্লভ মানুষদের একজন যারা তাদের প্রথম নামেই সুপরিচিত। গ্যালিলিও গ্যালিলেই (১৫৬৪-১৬৪২) এর জন্ম পিসাতে। তার বাবা ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ, এবং গ্যালিলিওর শৈশব আসলে কেটেছে নিকটবর্তী ফ্লোরেন্সে। জীবনের শুরুতে যাজক হতে চেয়েছিলেন পরে পিসা আসেন চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে, কিন্তু কথিত আছে একবার দোদ্যুল্যমান ঝাড়বাতি দেখে তিনি খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন, যখন তিনি লক্ষ্য করেন, এটি যতদুরেই দোল খাক না কেন, এই সময় নিয়ে সে আবার আর আগের জায়গায় ফিরে আসে, এটা নিয়ে তিনি পরীক্ষা করেন বাসায় দুটি পেন্ডুলাম নিয়ে, এবং তার পর্যবেক্ষণ প্রমানিত করেন, এই অবধি তাকে গণিত থেকে দুরে রাখা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তার অনিচ্ছুক বাবাকে রাজী করান গণিত আর প্রাকৃতিক দর্শন পড়ার জন্য। তবে ইতিহাস বলছে তরুণ গ্যালিলিও ইউনিভার্সিটি অব পিসায় চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে ফিরে এসেছিলেন। তার পছন্দের বিষয় ছিল গণিত। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসেন তত দিনে তার প্রতিভা কারো দৃষ্টি এড়ায়নি। ১৫৯২ এ তিনি পাদুয়া আসেন গণিত এবং এখন আমরা যাকে পদার্থবিদ্যা বলি সেই বিষয়টি পড়াতে।

নানা কারণে বিতর্কের সাথে জড়িয়ে পড়া অব্যাহত ছিল গ্যালিলিওর সারা জীবনে। তার ধারণাগুলো প্রায় সবসময়ই প্রচলিত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছে, বিশেষ করে অ্যারিস্টোটল এবং গ্রীক -রোমান দার্শনিকদের পদার্থবিদ্যা আর জ্যোতির্বিদ্যা। যদিও অনুগত ক্যাথলিক ছিলেন তিনি, তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস আর নৈতিকতা বিষয়ক, আর বিজ্ঞান হচ্ছে দৃশ্যমান, পর্যবেক্ষণযোগ্য, ভৌত জগত বিষয়ক। যেমনটি তিনি বলেছিলেন বাইবেল শেখায় কিভাবে স্বর্গে যেতে হবে, স্বর্গ কেমন করে চলে সেটা নয়। তার এই ধারণা প্রথমত তাকে ক্যাথলিক চার্চের সাথে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থানে নিয়ে আসে, যখন তীব্র উদ্দীপনা নিয়ে নিজেদের অবস্থান সংহত করছে এর মূল ধারণাগুলো কিংবা কতৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখাচ্ছে এমন যে কারো রই দৃঢ় মোকাবেলা করে। চার্চ ক্রমশ বাড়তে থাকা প্রকাশনাগুলোর উপর তাদের তদারকী শুরু করে। তাদের জন্য অগ্রহনযোগ্য বইয়ের একটি তালিকা দীর্ঘতর হতে থাকে Index Librorum Prohibitorum বা নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা।

গালিলিও উচ্চপর্যায়ের বেশ কিছু বন্ধু ছিল ( তাদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্স, বিশপ, কার্ডিনাল এবং এমনকি পোপও) এবং চার্চের বেশ কিছু মানুষও তাকে সহায়তা করেছেন, তবে কেউ কেউ ছিল যারা খুব দৃঢ়ভাবে চাইতো তার তার শিক্ষা যেন চার্চের কোনো শিক্ষার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা না করে, যা বহু শতাব্দী পুরোনো। গ্যালিলিওর আগে কাজ মূলত ছিল গতিশীল বস্তুদের গতির উপর কাজ করা শক্তি নিয়ে। একেবারে শুরু থেকে তিনি যেখানে ব্যতিক্রম ছিলেন সেটি হচ্ছে তিনি সব কিছু হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখতে চাইতেন, পরিমাপ করে নিশ্চিৎ হতে চাইতেন, এবং সম্ভব হলে গাণিতীকভাবে সেগুলো প্রকাশ করতেন।

তার সবচেয়ে বিখ্যাত একটি পরীক্ষায় তিনি হেলানে একটি পৃষ্ঠদেশের উপর গোলককে রাখেন, এবং এর পর পরিমাপ করেন কোন একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য বলটির ঠিক কতটা সময় লাগছে। আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারবেন যে বলটি ঢাল বেয়ে নামার সময় ধীরে ধীরে আরো দ্রুত গতি অর্জন করে, যতই যে ঢাল বেয়ে নেমে আসতে থাকে ( আমারা হয়তো বললো ত্বরণ বা গতি বৃদ্ধি পায়)। গ্যালিলিও দেখেছিলেন বলটির দ্রুতি আর এটি গতিশীল হবার শুরুর মূহুর্ত থেকে অতিক্রান্ত সময়ের একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে। যতটা সময় লাগছে দ্রুতি হচ্ছে এর বর্গফল (স্কোয়ার); সুতরাং দুই সেকেণ্ড পর, গ্যালিলিও দেখেছিলেন কোন চারগুণ দ্রুত গতিতে চলবে ( যতটা সময় লাগবে তার বর্গফল, (পরবর্তী বহু বিজ্ঞানীর কাজেও আমরা আবির্ভূত হতে দেখেছি), এই সব কিছু এবং আরো বহু পরীক্ষার জন্য তাকে আমরা খুব আধুনিক বিজ্ঞানীর মতই মনে করতে পারি। কারণ তিনি জানতেন যে তার সত্যিকার পরিমাপগুরো সবসময়ই এক নয়, হতে পারে কোন একটা ভুল সময় চোখ বন্ধ করেছি, অথবা সময় রেকর্ড করতে ভুল করেছি অথবা যে যন্ত্র ব্যবহার করছি সেটি হয়তো ঠিক নয়। তবে সত্যিকারভাবে পৃথিবী সম্বন্ধে আমাদের পর্যবেক্ষনগুলো এ ধরনের। আর গ্যালিলিও বাস্তব পৃথিবী সম্বন্ধে সবসময় আগ্রহী ছিলেন, কোনো বিমূর্ত পৃথিবীতে নয় যেখানে সবকিছু সবসময় ক্রটিহীন এবং যথাযথ। গতিশীল পদার্থের উপর গ্যালিলিওর সূচনা পর্বের এই কাজগুলো দেখিয়েছিল ঠিক কতটা ভিন্নভাবে তিনি পৃথিবীটাকে দেখতেন যদি তুলনা করা হয় অ্যারিস্টোটল এবং তারপরে আসা অসংখ্য চিন্তাবিদের সাথে। যদিও সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশুনায় অ্যারিস্টোটলের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য, যেখানে মূলত পরিচালনার দ্বায়িত্বে ছিল ধর্মীয় গ্রুপ গুলো।

৬০৯ এ গ্যালিলেও একটি নতুন যন্ত্রের খবর পেয়েছিলেন, যার ব্যবহার সুযোগ করে দেবে আরো গভীরভাবে প্রাচীন পন্থী ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য। এই যন্ত্রটির খুব শীঘ্রই পরিচিত হয়ে ওঠে টেলিস্কোপ নামে, যে শব্দটির মানে দুরের কিছু দেখা। প্রথম যে টেলিস্কোপটি গ্যালিলিওর হাতে পৌছেছিল তার ক্ষমতা খুব বেশী কিছু ছিলনা, অল্প কিছু বড় করে দেখার ক্ষমতা ছাড়া, তবে তাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল যন্ত্রটি, খুব দ্রুত যন্ত্রটির উন্নতি সাধন করেছিলেন দুটি লেন্সের সংযোগ সাধন করে। সুতরাং তিনি সেই বড় করে দেখার ক্ষমতা অর্জন করেছিল, যা কিনা আমরা অনেকেই এখন সাধারণ বায়নোকুলারে দেখি, প্রায় ১৫ গুণ। খুব বেশী মনে হয়না শুনতে, কিন্তু এটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। এটি ব্যবহার করে কেউ খালি চোখে দেখার আগের বহু আগেই জাহাজের অবস্থান শনাক্ত করতে পারতেন, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার হলো গ্যালিলিও সেটি ব্যবহার করেছিলেন আকাশ দেখার জন্য, এবং তিনি যা দেখেছিলেন তা তাকে বিস্মিত করেছিল।

যখন তিনি চাদের দিকে তাকিয়েছিলেন, তিনি দেখেছিলেন এটি মানুষের ধারণা করা নিখুত, মসৃণ, গোলাকৃতির বল নয়, এর ভিতরে পর্বত আছে , ক্রেটার বা গর্ত আছে। তার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে তিনি গ্রহদের গতিপথ লক্ষ্য করেছিলেন নিবিড় ভাবে, এবং একটি গ্রহ, তিনি দেখেছিলেন জুপিটারের বেশ কিছু উপগ্রহ আছে, ঠিক যেমন পৃথিবীর একটি উপগ্রহ হচ্ছে চাঁদ। আরেকটি গ্রহ শনি, তারও দুটি বড় গোলাকার চাদের মত কিছু আছে, যাদের আমরা এখন এর রিং বলি। ভিনাস ও মার্সের গতিপথ তিনি খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিলেন, এবং দেখেছেন তারা তাদের দিক আর গতি পরিবর্তন করে নিয়মিত এবং পূর্বধারণাক্ষম কোনো উপায়ে। সূর্যের কালো এলাকা বা স্পট আছে। ( তিনি পরোক্ষভাবে এর দিকে তাকানো শিখেছিলেন, চোখ বাচাতে, যা আপনাকে অবশ্যই করতে হবে), তার টেলিস্কোপ দেখিয়েছে যে মিল্কিওয়ে যা দেখতে চমৎকার ঝাপসা আলোর মত দেখায় খালি চোখে কোনো পরিস্কার রাতে, তারা আসলে তৈরী হাজার হাজার নক্ষত্র যারা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে।

টেলিস্কোপ নিয়ে এগুলো ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সবকিছু তিনি লিখেছিলেন তার বই Starry Messenger (১৬১০) এ তিনি এসব কথা লিখেছিলেন, যা বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। প্রতিটি আবিষ্কার মহাবিশ্ব নিয়ে মানুষের প্রচলিত বিশ্বাসগুলোকে প্রশ্ন করেছে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন গ্যালিলিও এই সব ধারণার উৎস তার নতুন টিউব, টেলিস্কোপকে একসময় যে নামে ডাকা হতো, কারণ যা খালি চোখে দেখা যায় না সেটির হয়তো কোনো অস্তিত্বই নেই। গ্যালিলিও চেষ্টা করেছিলেন সবাইকে বোঝাতে তার টেলিস্কোপ দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে সেটা বাস্তবই।

কিন্তু আরো বেশী বিব্রতকর আর আর বিপজ্জনকভাবে গ্যালিলিও পর্যবেক্ষণগুলো ভালো প্রমান দিয়েছিলো যে কোপার্নিকাস ঠিক বলেছেন, যখন তিনি বলেছেন চাদ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে এবং পৃথিবী চাদ এবং অন্যান্য গ্রহগুলো সুর্যের চারপাশে ঘোরে। সেই সময়ে কোপার্নিকাসের প্রকাশিত বইটির বয়স সত্তর। এবং তার কিছু অনুসারীও ছিল, প্রটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক। ক্যাথলিক চার্চের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হচ্ছে কোপার্নিকাসের ধারণা গ্রহের গতিপথ নির্ণয়ে উপযোগি ভূমিকা রাখে ঠিকেই তবে তারা আক্ষরিকভাবে সত্যি না। যদি সত্য হয়, তাহলে বাইবেলের বহু অনুচ্ছেদই জটিলতর হয়ে ওঠে ব্যাখ্যা দেবার জন্য এবং নতুন করে সেগুলো ভাবনার দাবী রাখে। কিন্তু গ্যালিলিও চেয়েছিলেন মানুষকে বলতে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো মানুষকে জানাতে। ১৬১৫ য় তিনি রোমে যান চার্চের অনুমতি নিতে যে তিনি যা আবিষ্কার করেছেন তা যেন তার ছাত্রদের পড়াতে পারেন।

বহু মানুষ – এমনকি পোপ তার প্রতি সমবেদনা জানান ঠিকই – তবে তিনি কোপার্নিকাসের সিস্টেম সম্বন্ধে কিছু লেখা, পড়ানো নিষিদ্ধ এমন একটি ডিক্রি পান। পুরোপুরি হাল ছাড়েননি তিনি, আবারো ১৬২৪ এবং ১৬৩০ দুবার তিনি রোমে একই আবেদন নিয়ে আসেন – তখন তিনি বৃদ্ধ অসুস্থ। তিনি মনে করেছিলেন যদি তিনি কোপার্নিকাসের পদ্ধতিটি শুধু সম্ভাবনা হিসাবে উপস্থাপন করেন তাহলে হয়তো তিনি নিরাপদ থাকবেন। Dialogue on the Two Chief World Systems নামের জ্যোতির্বিজ্ঞানের তার বইটি লেখা হয়েছে মোট তিনজনের কথোপকথন হিসাবে – যেখানে একজন অ্যারিস্টোটলের প্রতিনিধিত্ব করছে, অন্যজন কোপার্নিকানের সিস্টেমকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, এবং তৃতীয় জন হচ্ছেন আপ্যায়নকারী। এই ভাবে গ্যালিলিও পুরোনো ও নতুন ধারণাগুলোর মহাবিশ্ব সম্বন্ধে পক্ষে বিপক্ষে তার যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেন কোনটি সঠিক বা কোনটি ভুল সেটি উল্লেখ না করে। হাস্যরসে পূর্ণ চমৎকার এই বইটি লেখা হয়েছিল গ্যালিলিও বেশীরভাগ বইয়ের মতই, তার মাতৃভাষা – ইতালীয় ( আরো সঠিকভাবে তুসকান) ভাষায়। (তখন ইউরোপ জুড়ে পণ্ডিতরা ল্যাটিন ভাষায় লিখতেন)। শুরু থেকে আসলে স্পষ্ট ছিল তিনি কি বলতে চাইছেন, একটি বিষয় যেমন অ্যারিস্টোটল মতবাদী চরিত্রটির নাম Simplicio বা সিম্পলিসিও, এবং আসলেই একজন প্রাচীন অ্যারিস্টোটল ব্যাখ্যা কারী মানুষ ছিলেন এই নামে, কিন্তু ইংরেজী ভাষার মত ইতালীয় ভাষায় এর অর্থ ছিল সরল বোকা ও বিশ্বাসপ্রবণ কেউ। এবং এই চরিত্রটিও তেমন বুদ্ধিমান ছিলেন না, কোপার্নিকাসকে প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্রটি ( যার নাম সালভিয়াতি, যে নামের অর্থ জ্ঞানী এবং নিরাপদ) যুক্তি ছিল ক্ষুরধার। গ্যালিলিও চার্চের অনুমতি আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন বইটির জন্য। রোমের সেন্সর বোর্ড,ম যারা নিয়ন্ত্রণ করতো কোন বই প্রকাশ হতে পারে, তারা গ্যালিলিওর প্রতি সমব্যাথী ছিলেন, কিন্তু তিনি জানতেন সমস্যা হবে সেজন্য সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করেন। গ্যালিলিও তার কাজ শুরু করেন এবং ফ্লোরেন্স থেকে তিনি সেটি প্রকাশ করেন। যখন চার্চের হর্তা কর্তারা এটি পড়েন, তারা খুব একটা খুশী হলেন না, এবং রোমে বৃদ্ধ গ্যালিলিও কে ডেকে পাঠান। কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন এর আগে তার কোপার্নিকান সিস্টেমটি পড়ানোর নিষেধাজ্ঞাটা আবার হাজির করা হয়।

১৬৩৩ সালে বিচার শুরু হয়, তিন মাস ব্যপী, গ্যালিলিওকে বাধ্য করা হয় বলতে যে তার বইটা ভুল এই সব তার অহঙ্কার। তিনি তার সই করা দোষ স্বীকারোক্তি পত্রে লেখেন, পৃথিবী ঘুরছে না এবং এটি মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। কিংবদন্তী প্রচলিত আছে দণ্ডিত হবার পরপরই গ্যালিলিও নাকি অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন Eppur si muove ( তারপরও এটি নড়ছে), তিনি কথাটি আদৌ বলেছিলেন কিনা তার কোনো প্রমান নেই, তবে তিনি সম্ভবত এটি মনে মনে ভেবেছিলেন। কারণ সত্যিকারভাবে পৃথিবীর প্রকৃতি সম্বন্ধে তার বিশ্বাস চার্চ জোর করে বদলাতে পারেনি।

৬০৯ এর আগষ্ট ২৫, গ্যালিলিও গ্যালিলেই প্রথম তার নতুন করে বানানো টেলিস্কোপ কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটি ভেনিসের সংসদ সদস্যদের দেখিয়েছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও ব্যবসায়ীদের সাগরে এবং বাণিজ্যে কাজে লাগতে পারে ব্যাখা করেছিলেন, তার জন্য এটি বেশ লাভজনক উপরি আয় ছিল। Sidereus Nuncius (Starry Messenger) বইটিতে তিনি প্রথম তার জ্যোতির্বিজ্ঞানের ড্রইংগুলো ব্যবহার করেন যেখানে তিনি টেলিস্কোপ ব্যবহার করেছিলেন।

পাদুয়ায় থাকার সময় গ্যালিলিও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার করেন, মৌলিক বিজ্ঞান ছাড়াও বেশ কিছু প্রায়োগিক ক্ষেত্র যেমন টেলিস্কোপের বেশ উন্নতি করেন নেদারল্যান্ডে হান্স লিপারশে অস্পষ্ট বিবরণ থেকে তিনি ৩০ গুণ বেশী ক্ষমতা সম্পন্ন টেলিস্কোপ বানিয়েছিলেন। গ্যালিলিও যে টেলিস্কোপ বানিয়েছিলেন সেটি দিয়ে কেউ আকারে বড় হওয়া সোজা দৃশ্য দেখতে পেতেন- সাধারণত যা পরিচিত ছিল স্পাইগ্লাস হিসাবে। এর ডিজাইনে গ্যালিলিও একটি কনভার্জেন্ট ( প্লানো-কনভেক্স) লেন্স ব্যবহার করেছিলেন এর অবজেকটিভ লেন্স হিসাবে এবং একটি ডাইভারজেন্ট লেন্স ব্যবহার করেছিলেন ( প্ল্যানো কনকেভ) আইপিস লেন্স হিসাবে। যেহেতু মধ্যবর্তী কোনো জায়গায় ফোকাস বিন্দু ছিলো না, আকারে বড় হওয়া দৃশ্যটি সোজা ইমেজ হিসাবে চোখের উপর পড়তো । অবশ্যই গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের সাথে বর্তমান কোনো টেলিস্কোপের তুলনা হতে পারে না। বহু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বে গ্যালিলিও কিছু বিস্ময়কর আবিষ্কার করেছিলেন এটি ব্যবহার করে।

১৬০৪ এ গ্যালিলিও কেপলারের সুপারনোভা দেখতে পেরেছিলেন, যেহেতু নতুন এই নক্ষত্রের শনাক্ত করা সম্ভব এমন কোনো ডাইরানাল প্যারালাক্স প্রদর্শন করছিল না, সেটা দেখে তিনি উপসংহার টেনেছিলেন, এটি অবশ্যই খুব দূরবর্তী একটি তারা, সুতরাং মহাবিশ্বের অপরিবর্তনশীলতা সংক্রান্ত অ্যারিস্টোটলের তত্ত্বটি ভুল প্রমানিত হয়। এই বিষয়ে অবশ্য তার প্রস্তাবনা বিরোধীতার মুখে পড়ে। ১৬১০ এর ৭ জানুয়ারী তিনি লেখেন three fixed stars, totally invisible by their smallness -যারা সবাই জুপিটারের নিকটবর্তী, এবং তাদের আচরণই বলে দিচ্ছে তারা স্থির কোনো তারা নয়, ১০ তারিখে গ্যালিলিও একটিকে জুপিটারের পেছনে হারিয়ে যেতেও দেখেছিলেন, এবং সেকারণে তিনি প্রস্তাব করেন তারা নিশ্চয়ই জুপিটারকে প্রদক্ষিণ করছে। এই তারাগুলো উপগ্রহ – এখন আমরা জানি এবং Galilean Moons হিসাবে তাদের নামকরণ করা হয়েছে এর আবিষ্কারককে সন্মাণ করে। জুপিটারের এই উপগ্রহগুলো আবিস্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানে একটি বিপ্লবের সূচনা করে। কোনো একটি গ্রহ , যাকে প্রদক্ষিণ করছে আরো ছোট কতগুলো গ্রহ অ্যারিস্টোটালের কসমোলজীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না। যা দাবী করছে সব কিছুই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। একারণে বেশ কিছু বিজ্ঞানী বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে বিশ্বাস করতে। ১৬১২ নাগাদ গ্যালিলিও আরো নিখুতভাবে তাদের কক্ষপথের বিবরণ দেন – এর কিছুদিন আগে তিনি চাঁদের মত ভিনাসের পর্বগুলোর বিবরণ দিয়েছিলেন, যা আসলে নিকোলাউস কোপার্নিকাসের এর পূর্বধারণাগুলো সঠিক প্রমানিত করে তার হেলিওসেন্ট্রিক বা সূর্য কেন্দ্রিক মডেলে।গ্যালিলিও শনি গ্রহও দেখেছিলেন, তিনি সম্ভবত প্রথম ইউরোপিয় যিনি সানস্পট দেখেছিলেনম কেপলারও দেখেছিলেন তবে তিনি সেটিকে মার্কারীর ট্রানজিট হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।

চার্চের ক্ষমতা ছিল গ্যালিলিও কে জেলে ঢোকানোর জন্য এমনকি নির্যাতন করার জন্য, কিন্তু জুরীরা বুঝতে পেরেছিলেন এই বৃদ্ধটি সাধারণ মানুষ নয়, তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হলো এর পরিবর্তে। তার প্রথম গৃহবন্দীত্ব ছিল সিয়েনায় – আদৌ কঠোর ছিল না, তিনি বহু নৈশভোজের দাওয়াতের মধ্যমনি ছিলেন। চার্চ বিষয়টি লক্ষ্য করে তাকে ফ্লোরেন্সের বাইরে তার বাড়ীতে বসবাস করতে বাধ্য করে, যেখানে তার অতিথিদের বিশেষভাবে তদারকী করা হতো। এই সময় তার ( যিনি একজন নান ছিলেন) মেয়েও মারা গিয়েছিলেন, গ্যালিলিও শেষ জীবন একাকী কেটেছে। কিন্তু তিনি তার কাজ করে গিয়েছিলেন, পড়ন্ত বস্তু সংক্রান্ত সমস্যাটি নিয়ে আরো ভেবেছিলেন, সব ধরণের গতি নিয়ে ভেবেছিলেন আমরা যা আমাদের চারপাশে যা দেখি। ১৬৩৮ এ লেখা তার একটি অসাধারণ বই Two New Sciences আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি। তিনি পড়ন্ত বস্তুর ত্বরণ নিয়ে গবেষণা করে আরো, এবং গণিত ব্যবহার করেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন ত্বরণ এমনভাবে মাপা যেতে পারে যা ভবিষ্যতে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে বিখ্যাত গবেষণার আগাম ঘোষণা দিয়েছিল। বাতাসে ছুড়ে মারা কোন বস্তু যেমন কামানো গোলার গতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হয় কিভাবে সেটাও তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, দেখিয়েছিলেন আগে থেকে ধারণা করা সম্ভব এটি কোথায় পড়তে পারে। এই কাজ দিয়ে, শক্তির ধারণা দিয়ে – যা কোনো একটি নির্দিষ্ট উপায়ে কোনো গতির উপর প্রভাব ফেলে , সেটি পদার্থ বিজ্ঞানে তার জায়গা করে নিয়েছিল। গ্যালিলিওর লক্ষ্য ছিল, বিজ্ঞানকে সেই জ্ঞান হিসাবে ব্যবহার করা যা ব্যাখ্যা করতে পারে কিভাবে পৃথিবী কাজ করে তার নিজের ক্ষেত্রে। তার আরো কিছু বিদ্রোহী ধারণা পরে পরিত্যক্ত হয়েছিল কারণ সেগুলো অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করে না পুরোপুরি – আর সেভাবেই বিজ্ঞান সব সময় কাজ করে, বিজ্ঞানের কোনে ক্ষেত্রই সব উত্তর সম্বলিত বন্ধ কোনো বই না, গ্যালিলিও সেটি জানতেন আজকের যুগের সব বিজ্ঞানীদের মতই।


(লেখকের ব্লগপোস্ট থেকে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ