●ছবিতে: জনতার মাঝে জন-নায়ক: ১৯৩৮ সালে মুম্বাই তে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।
(সূত্র: ন্যাশনাল হেরাল্ড, ২৩শে জানুয়ারি ২০১৮ সালে প্রকাশিত নিবন্ধের বঙ্গানুবাদ)
সুভাষচন্দ্র বসু যিনি ব্রিটিশদেরকে ভারত থেকে বিতাড়িত করার জন্য একটি সশস্ত্র বাহিনী তৈরী করেছিলেন তাঁর প্রতি হিন্দুত্ববাদীরা তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনের অভিনয় চালিয়ে যেতে কসুর করছে না। কিন্তু খুব কম লোকই সুভাষ চন্দ্রের সেই মহান প্রচেষ্টা ব্যার্থ হওয়ার প্রকৃত কারণ বীর সাভারকরের নেতৃত্বে সেসময় হিন্দু মহাসভার যে চরম বিশ্বাসঘাতকতা তা জানেন। যদিও বীর সাভারকরকে আরএসএস হিন্দুত্ববাদের একজন আইকন এর মর্যাদা দিয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজী বৈদেশিক সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে ভারতের আজাদীর লক্ষ্যে যখন উত্তর-পূর্ব ভারতের দিক থেকে আক্রমণের প্রচেষ্টা করছিলেন এবং সে উদ্দেশ্যে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গড়ার মধ্য দিয়ে তিনি চুড়ান্ত প্রস্তুতি নেন সেই সময় এই সাভারকরই তাঁর ইংরেজ প্রভুদেরকে সামরিকভাবে পূর্ণ উদ্যমে সহযোগিতা করে যান। ১৯৪১ সালে, ভাগলপুরে হিন্দু মহাসভার ২৩তম অধিবেশনের ভাষণে তিনি বলেন, “যুদ্ধের যে দামামা ভারতের উপকন্ঠে আছড়ে পড়তে চলেছে তা যেমন বিপদের বার্তা বয়ে আনে তেমনি সেই সঙ্গে নতুন সুযোগের পথ খুলে দেয়। এটা এক ইঙ্গিতবাহী সময়; সশস্ত্র আন্দলনকে তীব্র করে তুলতে হবে। হিন্দু মহাসভার প্রতিটি শাখাপ্রশাখাকে শহরে, গ্রামে গঞ্জে প্রতিটি স্থানে সক্রিয় ভাবে কাজকরতে এবং সকল হিন্দুদেরকে স্থল বাহিনী, নৌবাহিনী ও বায়ুসেনাদলে যোগ দেওয়ার জন্য এবং বিভিন্ন অস্ত্র সরঞ্জাম প্রস্তুতির কাজে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
তিনি যে কি মাত্রায় ব্রিটিশদেরকে সহযোগিতার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তা তার এই বক্তব্যে স্পষ্ট, “ভারতের আত্মরক্ষার প্রশ্ন যেখানে, সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্দ্বিধায় জোটবদ্ধ হয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে এই যুদ্ধতৎপরতায় যতদূর সম্ভব সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, কারণ তা হিন্দু স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বায়ু-সেনাতে যতো অধিক সংখ্যায় সম্ভব যোগ দিতে হবে এবং অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধ সরঞ্জাম, বোমা-বারুদ তৈরীর কারখানাগুলিতে সর্বত্র একটা জায়গা করে নিতে হবে। এটা খুবই উল্লেখযোগ্য যে জাপান এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় আমরা প্রত্যক্ষভাবে অতি শিঘ্রই ব্রিটেনের শত্রুর আক্রমনের মুখোমুখি এসে পড়েছি। ফলে, আমাদের পছন্দ অপছন্দ যাই হোক না কেনো আমাদের নিজের দেশকে এই বাসভূমিকে যুদ্ধের ভয়ঙ্কর ক্ষতি থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে আর এটা সম্ভবপর করতে হলে ভারতকে রক্ষার জন্য সরকারের এই যে যুদ্ধ তৎপরতাকে আরো তীব্রতর করতে হবে। তাই মহাসভার প্রতিটি সদস্যের আবশ্যক কর্তব্য হলো হিন্দুদেরকে বিশেষত বাংলা ও আসাম প্রদেশের হিন্দুদেরকে সজাগ করা, একটা মুহুর্ত নষ্ট না করে অবিলম্বে সমস্ত সশস্ত্র সামরিকবাহিনীতে যতোদূর সম্ভব সক্রিয়ভাবে যোগদান করানোর জন্য সচেষ্ট হওয়া।
সাভারকর হিন্দুদের উদ্দেশ্যে ডাক দেন, “লক্ষ লক্ষ হিন্দু যোদ্ধাদেরকে মনেপ্রাণে সত্যিকারের সঙ্ঘি হয়ে স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বায়ুসেনায় যোগ দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে কানায় কানায় পূর্ণ করতে হবে " এবং তিনি আরো আশ্বাস দেন যদি হিন্দুরা ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দেয় "আমাদের হিন্দু রাষ্ট্র আরো বেশি মজবুত ও শক্তিশালি হতে বাধ্য , যুদ্ধের পরবর্তীকালীন সময়ের পরিস্থিতির মোকাবিলায় – যাইহোক না কেনো যদি তা দেশের অভ্যন্তরে হিন্দু-বিরোধী গৃহযুদ্ধ হয়, অথবা যদি কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয় কিংবা যদি কোনো সশস্ত্র বিপ্লব ঘটে, আমরা তুলনাহীনভাবে অনেকবেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবো।”
ভাগলপুরে ওই সভায় তাঁর বক্তব্যে ইতিটানার সময়ও তিনি জোরের সঙ্গে হিন্দুদেরকে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ তৎপরতায় যোগদান করার কথা বলেন। তিনি খুল্লামখুল্লা আরো বলেন, “যুদ্ধের পরে দেশের পরিস্থিতি ও ভাগ্য যাই হোকনা কেনো, আজকের এই পরিস্থিতিতে সবকিছু বিচার বিবেচনা করে হিন্দু সংগঠনগুলি যে বোধগম্য ও সময় উপযোগি লাভজনক যে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সন্দেহাতীতভাবে, তা হলে দেশের প্রতিরক্ষার জন্য সক্রিয়ভাবে আমাদেরকে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে, এবং আমরা তা অনায়াসে করতে পারি সেক্ষেত্রে হিন্দু-স্বার্থ বিরোধী কোনোরকম পদক্ষেপ নিতে আমরা বাধ্য থাকবো না।” ভাগলপুর সভায় তার দেওয়া বক্তব্যের উপসংহার থেকে স্পষ্ট যে সাভারকরের প্রজ্ঞা অনুযায়ী ব্রিটিশদের পাশে থেকে তাদের যুদ্ধ তৎপরতায় সাহায্য করার ফলে দেশের হিন্দুদের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে আসবে।
“যদি কখনো প্রবাদবাক্য সত্যি হয়ে থাকে যে অন্ধকার রাত যত গাড় হয় সোনালী প্রভাত সম্ভাবনা ততই নিকটবর্তী হয়, তাহলে আজকের দিনের জন্য প্রবাদ বাক্যটি খুবই কার্যকর। যুদ্ধের যে মহড়া আমাদের দেশের পূর্ব উপকন্ঠে দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে এবং যা অচিরেই পশ্চিম উপকূল থেকেও আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে এবং যার ভয়াবহতা নজিরবিহীন হতে পারে; কিন্তু একই সঙ্গে তা বিশ্বের সামনে এক নতুন প্রভাতের আগমনীর বার্তা নিয়ে আসে, এই বিশ্বজোড়া নৈরাজ্যের মধ্যেও শুধু নতুন নয় বরং আরো ভালো একটি শাসন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে পারে। তাই আমাদেরকে সময়ের সদ্বব্যবহার করা দরকার, এবং সর্বতভাবে কাজ করা এবং প্রার্থনা করা প্রয়োজন।”
যখন সুভাষ চন্দ্রের মতো দেশ নেতারা সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় ব্রিটিশ সরকারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য নানান পরিকল্পনা ও রণকৌশল তৈরী করতে ব্যস্ত সে সময় হিন্দুত্ববাদের সুপরিকল্পিত নীলনকশা কে বাস্তবয়িত করতেই সাভারকর ব্রিটিশদেরকে পূর্ণ সমর্থন করেন। মাদুরায় (১৯৪০ সালে হিন্দু মহাসভার ২২তম অধিবেশনে) তিনি তার পছন্দকে স্পষ্টরুপে ঘোষণা করেন । তাঁর ব্রিটিশদেরকে সমর্থন করার পেছনে যুক্তি ছিল, “এটা একরকম অসম্ভব যে ইংল্যান্ড এই যুদ্ধে এমন শোচনীয়ভাবে পর্যদুস্ত হবে যে সে ভারত সাম্রাজ্যেও তার সিন্দুকের চাবী, অর্থভান্ডার, অস্ত্রসম্ভার সবকিছু জার্মানের হাতে সোপর্দ করতে বাধ্য হবে, “এভাবে তিনি বিশ্বাস করতেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। মাদুরায় সভাপতি হিসাবে তাঁর বক্তব্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি নির্লজ্জ সমর্থনের জীবন্ত উদাহরণ। তিনি সরাসরি নেতাজীর দেশ-স্বাধীন করার প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ঘোষণা দেন: “শুধু নৈতিক কারণে নয়, দেশের বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমাদের কে বাধ্য করেছে যে হিন্দু মহা সভা সংগঠনের তরফ থেকে আমরা কোনোরকম সশস্ত্র প্রতিরোধমূলক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করবোনা।”
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তার এই সমর্থনে কোনোরুপ অস্পষ্টতা নেই। ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রতি তাঁর এই নির্লজ্জ সমর্থনের পেছনে তিনি এক অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করেন। তার যুক্তি অনুসারে, “পক্ষে বিপক্ষের সার্বিক পরিস্থিতি বিচার বিবেচনা করে, আমি নির্দ্বিধায় আমার প্রস্তাব কে সামনে রাখতে চাই যে এই যুদ্ধ আমাদের সামনে যে সুযোগ এনে দিয়েছে তাকে কাজে লাগানোর সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি যাদেরকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এবং পরিস্থিতিকে যতদূর সম্ভব কাজে লাগানো যেহেতু তা আমাদের লোকদেরকে সামরিকীকরণ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘোষণা হলে ব্রিটিশ সরকার যখন সশস্ত্র স্থল বাহিনী তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় , সেই সময় হিন্দু মহাসভা সরাসরি সাভারকরের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী বৃহৎ সংখ্যায় হিন্দুদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। মাদুরায় হিন্দু মহাসভার সভায় সাভারকর উপস্থিত সকল প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন তা নিম্ন রুপ: “স্বাভাবিকভাবেই, হিন্দু মহাসভা বাস্তব রাজনীতিতে তাদের অন্ত:দৃষ্টি কে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেহেতু তা সরাসরি ভারতের প্রতিরক্ষার এবং নতুন ভারতীয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।”
যদিও বিষয়টা এমন নয় যে সাভারকর জানতেন না যে সাধারণ থেকে সাধারণতর ভারতবাসীর মধ্যে তার এই ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র বিরক্তি ও ঘৃণার সঞ্চার হচ্ছিল। তারপরেও তিনি হিন্দু মহাসভার ব্রিটিশদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোগীতা করার জন্য যে সমালোচনার সম্মুখীন হন তাকে তিনি এই বলে হেলায় ঠেলে দেন যে, “সাধারণত ভারতীয় জনতা যে ভাবধারায় ভাবতে অভ্যস্ত তা রাজনৈতিকভাবে ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। তারা মনে করে, সাধারণত যেহেতু ভারতীয় স্বার্থ ব্রিটিশ স্বার্থরোধী, তাই ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলানো মানেই তা অপরিহার্যভাবে তাদের বশ্যতা স্বীকার করা, দেশ বিরোধী কাজ, তার মানে ব্রিটিশদের হাতের পুতুল হিসাবে পরিচালিত হওয়া এবং যদি কোন একটি ক্ষেত্রে এবং যে পরিস্থিতিই হোক না কেন, ব্রিটিশদের সহযোগিতা করা মানে তা দেশবিরোধী এবং কঠোরভাবে নিন্দনীয়।” যখন এক দিকে সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতকে স্বাধীন করার জন্য জাপান এবং জার্মানের সহায়তা নিয়ে সামরিক রণকৌশল তৈরী করতে ব্যস্ত , তখন অন্য দিকে সাভারকর তাঁর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের সরাসরিভাবে সাহায্য করে চলেছেন। আর এভাবেই নেতাজীর মহান সেই উদ্যোগ বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়।
সাভারকর এবং হিন্দু মহাসভা প্রকাশ্যে ব্রিটিশদের সমর্থন জানায় এবং পরে তারা ভারতীয় জাতীয় বাহিনী [ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি (INA)] এর হাজার হাজার বীর, সাহসি যোদ্ধাদের হত্যা করে এবং তাদের উপর দৈহিক অত্যাচার চালায় ও অঙ্গচ্ছেদ করে। ব্রিটিশ প্রভুদের প্রশংসায় মুখরিত সাভারকর তাঁর অনুগামীদেরকে বলেন, যেহেতু জাপান তার চির অগ্রগামি বাহিনী নিয়ে এশিয়াকে ইউরোপীয় প্রভাব থেকে মুক্তির ঘোষণা দিয়েছে, ব্রিটিশদের তাদের সশস্ত্র বাহিনীতে বিপুল সংখ্যক ভারতীয়দের যোগদান প্রয়োজন আর তার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করা প্রয়োজন। ব্রিটিশদের রণকৌশলের প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়কত্ব বরাবরের মতো খুবই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। আমি আরো এটা উপলবদ্ধি করেছি যে যদি কখনো জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধে তাহলে যুদ্ধের যাবতীয় মহড়ার জন্য ভারত অবশ্যই আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল হবে…সম্ভাবনা আছে যেহেতু জাপান দ্রুত আমাদের সীমান্তের দিকে সফলভাবে এগিয়ে আসছে, ভারতীয় অফিসারদের অধীনে ভারতীয় লোকদেরকে সৈন্য হিসাবে নিয়োগ করে বিশ লক্ষের একটি সেনা বাহিনী প্রস্তুত করতে হতে পারে।”
সাভারকর পরবর্তী কয়েকটি বছর ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর সৈন্য যোগান দেওয়ার জন্য নিয়োগ ক্যাম্পের আয়োজন করতে থাকেন যারা পরবর্তীতে ভারতের উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর ক্যাডারদেরকে হত্যা করে। মাদুরায় হিন্দু মহাসভার সম্মেলন শেষ হয় একটি “দ্রুত কর্মসূচীর” মধ্য দিয়ে যেখানে জোর দিয়ে বলা হয় “নৌবাহিনী, স্থল বাহিনী ও বায়ু সেনাতে যত বেশি সম্ভব হিন্দু নিয়োগ করা সম্ভব তা করতে হবে।” তিনি তাদের সামনে আরো তথ্য পেশ করেন যে, শুধুমাত্র হিন্দু মহাসভার একক প্রচেষ্টায় এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এক লক্ষ হিন্দুকে তারা নিয়োগ দিতে পেরেছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই সময়ই আরএসএস তাদের সভায় পালাক্রমে সাভারকরকে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ করতে থাকে তরুণ হিন্দু যুবকদেরকে ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য।
সাভারকর ব্রিটিশদের যুদ্ধ তৎপরতায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে জোর দিতে দিয়ে হিন্দু মহাসভার কর্মীদের উদ্দেশ্যে যে নির্দেশনা দেন সেগুলি নিম্নরুপ : “এই অপরিহার্য সময়ে ব্রিটিশদের তোমরা যতোদূর সম্ভব সাহায্য করো, তা তোমাদের দেশের জন্যই লাভজনক। আর এটা বর্তমান পরিস্থিতিতেই সম্ভব। কারণ এটা ভুলে গেলে চলবেনা যে যারা সশস্ত্র আগ্রাসনের সম্মুখে শুধুমাত্র অনৈতিক এই যুক্তিতে তাদের ভন্ডামি পূর্ণ খ্যাপামির অহিংস বা অ-প্রতিরোধ নীতির কথা বলে যারা কল্পনা করে যে তারা দাবী করতে পারে যে তারা সরকারের সঙ্গে কোনোরুপ সহযোগিতা করেনি বা তাদের যুদ্ধতৎপরতায় যোগ দেয়নি, অথবা শুধুমাত্র তাদের সোজা নীতির কারণে যে আমরা যুদ্ধবাজদের সঙ্গে যোগ দিইনা এই যুক্তিতে তারা আত্ম প্রবঞ্চনা ও আত্মতুষ্টিতে ভুগছে।” হিন্দুদের প্রতি তার এই আহ্বানে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না : “অতএব হিন্দুদেরকে এখন এগিয়ে আসতে হবে এবং নৌবাহিনী,স্থলবাহিনী ও বায়ুসেনা দলে হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ সংখ্যায় যোগদান করতে হবে।”
হিন্দু মহাসভা সাভারকরের নেতৃত্বাধীনে একটি উচ্চ লেভেলের বোর্ড গঠন করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেসমস্ত হিন্দুরা ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিতে চান তাদের সহযোগিতার্থে। নিম্নে সাভারকর যে কথাগুলি বলেন তা থেকে আমরা জানতে পারি এই বোর্ড গুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। সাভারকর তার কর্মীদেরকে জানান যে, “সেনাবাহিনীতে হিন্দুদেরকে নিয়োগ করার জন্য সময়ে সময়ে যে সমস্যা ও কষ্টসাধ্য পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় তা সহজ করার জন্য হিন্দু মহাসভা একটি কেন্দ্রীয় উত্তরাঞ্চলীয় সামরিকীকরণ বোর্ড গঠন করেছে যার আহ্বায়ক হচ্ছেন নিউ দিল্লির ৫১,পাঁচকুনি রোডের গণপতি রায় বাবু যিনি পেশায় একজন উকিল (বি.এ, এল.এল.বি)। একটি কেন্দ্রীয় দক্ষিণাঞ্চলীয় বোর্ডও গঠন করা হয়েছে এল.বি ভূপাটকর মহাশয়ের (এম.এ. এল.এল.বি) সভাপতিত্বে যিনি মহারাষ্ট্র প্রদেশের হিন্দুসভা সদাশিব পেট পূণা এর সভাপতিও (Mr. L.B. Bhopatkar, M.A., LL.B., President Maharashtra Provincial Hindusabha, Sadashiv Peth Poona)। উপরোক্ত ঠিকানা গুলিতে কেবলমাত্র সেই সমস্ত হিন্দুরা যারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান, বা যারা আগেই নাম নথিভুক্ত করেছেন তারা আবেদন পত্র, অভাব, অভিযোগ ইত্যাদি পাঠাতে পারেন । ব্যারিস্টার জওলা প্রসাদ শ্রীবাস্তব মহাশয়, বোম্বাই এর বি.বি কালিকর (এম.এল.সি নাগপুর) এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা (ন্যাশ্যানাল ডিফেন্স কাউন্সিল মেম্বারস) অথবা যুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি (আ্যাডভাইসরি ওয়্যার কমিটি) তাদের সাধ্যমত যতোদূর সম্ভব সমস্যাগুলির প্রতিবিধানে সচেষ্ট হবেন; এই সামরিকীকরণ বোর্ডগুলি তাঁদের কাছে চিঠিগুলি প্রেরণ করার পরপরই।
এখানে এটা স্পষ্ট যে ব্রিটিশ সরকার হিন্দু মহাসভার নেতাদেরকে তাদের সরকারি যুদ্ধ বিষয়ক কমিটির সঙ্গে যুক্ত করে রাখেন। যেসমস্ত হিন্দুরা ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগদান করে তাদের উদ্দেশ্যে সাভারকর যে নির্দেশ দেন তা পড়ার পর যারা তাঁকে দেশপ্রেমী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে মনে করেন লজ্জায় তারা মাথা হেঁট না করে পারবেননা : “এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় সবাইকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের নিজেদের স্বার্থে যে সমস্ত হিন্দু ভারতীয় (পড়ুন ব্রিটিশ) বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে তাদের সকলের উচিত যে পরিস্থিতি যাই হোকনা কেনো সামরিক শৃঙ্খলা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলা এবং কর্তব্য পালন করা , যেনো পরবর্তীরা বিবেচনাপূর্বক হিন্দুদের সম্মানকে অপমানিত করতে না পারে।”
কিন্তু অবাক হওয়ার কথা এই যে সাভারকর কখনো বুঝতে পারেননি যে ঔপনিবেশিক প্রভুদের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদান করাটাই যেকোনো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ও দেশপ্রেমী ভারতীয়ের পক্ষে অত্যন্ত অপমানজনক। ভীড়ের বইতেও উল্লেখ আছে যে তিনি “হিন্দু মহাসভা এবং মহাযুদ্ধ” এই শিরোনামে একটি খসড়া লেখেন যেখানে বলা হয়েছে, “ব্রিটিশ সরকারের যেমন এটা সাধারণ কর্তব্য যে ভারতবর্ষের উপর কোনো সামরিক আক্রমণ হলে তারা তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে ঠিক তেমনি সে দায়িত্ব আমাদেরও উপর বর্তায়। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে যেহেতু আমরা কোনরুপ সাহায্য ছাড়া সে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম নই, সে জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে সর্বান্তকরণে সাহায্য সহযোগিতার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং অন্যান্য আরো বিপ্লবী দলগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশগুলির কাছ থেকে সাহায্য লাভের চেষ্টা করছিলো। সাভারকর তার ৫৯তম জন্ম দিনটিকেও হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে হিন্দুদেরকে বিশাল সংখ্যায় ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রচারের কাজে ব্যবহার করেন : “হিন্দুরা যাদের সামর্থ আছে তারা স্থল বাহিনী,নৌবাহিনী এবং বায়ু সেনাদলে যোগদিন , অথবা গোলাবারুদ তৈরীর কারখানায় নাম লেখান বা এই ধরনের যুদ্ধ বিষয়ক অস্ত্রশস্ত্র তৈরীর ওয়ার্কশপে যোগদান করুন।”
ব্রিটিশ সরকার সাভারকরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন যেহেতু তার সংগঠনটি যুদ্ধবিষয়ক সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিকাঠামোগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। সাভারকর যাদের নামকে প্রস্তাব হিসাবে পেশ করতেন তাদেরকে সেসব পদে নিযুক্ত করা হতো। সাভারকর বৃটিশদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যে টেলিগ্রাম পাঠান তা থেকে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে । ভীডের বইতে তা উল্লেখ আছে, “নীচের চিঠিটি পাঠান ব্যারিস্টার ভি.ডি সাভারকর , হিন্দু মহাসভার সভাপতি, (১) কমান্ডর-ইন-চীফ জেনারেল ওয়েভেল কে উদ্দেশ্য করে, (২) এবং ভারতের ভাইসরয়কে মাসের ১৮ তারিখে (১৮ই জুলাই,১৯৪১)। “আপনার এক্সলেন্সির প্রতিরক্ষা কমিটি এবং তার কর্মীবৃন্দের (personnel) ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। মেসার্স কালিকর এবং জামান্দাস মেহতার নিযুক্তিতে হিন্দু মহাসভা খুবই সন্তুষ্ট [মূল পাঠ্য অনুযায়ী]
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মুসলিম লিগের মতো দল যারা বৃটিশ স্বার্থকে আংশিকভাবে মদত যোগাচ্ছিল তারা কিন্তু সাভারকরের মতো কোনোরকম যুদ্ধ-তৎপরতায় অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তারা বৃটিশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রতীরক্ষা কমিটিতেও যোগ দেয়নি । এটা বলা হয় যে যদিও সাভারকরের বৃটিশদের পক্ষে সমস্ত অপরাধমূলক এবং বিভিন্ন দেশবিরোধী চিন্তাধারা এবং কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও ভারতীয় শাসকরা আজও তাঁকে “বীর” মর্যাদা দিয়ে গৌরবান্বীত করে চলেছে। এটা রহস্যজনক যে নেতাজীর বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী এই গ্যাং এর জঘন্য চিন্তাধারা ও কাজকর্মকে আজও দেশবাসীর কাছে গোপন রাখা হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ