তৈমুর লঙের বিরুদ্ধে অভিযোগ -- "দিল্লির সুলতানরা পৌত্তালিকতার উচ্ছেদ সাধন না-করে পৌত্তালিকদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করছে, এই অজুহাতে তিনি ভারত আক্রমণ করেছিলেন। তিনি একদিনে প্রায় এক লক্ষ হিন্দুবন্দিকে হত্যা করে এক নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। তৈমুর দিল্লি পৌঁছোলে তার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হিন্দু নাগরিকরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে এক ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু হয় । তৈমুরের দুর্ধষ বাহিনী অগণিত হিন্দু নরনারীর রক্তে দিল্লি নগরী রঞ্জিত করেছিলেন । দিল্লি হত্যাকাণ্ড এমন পৈশাচিক এবং এত পরিমাণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল যে, এই হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী দু-মাস পর্যন্ত দিল্লির আকাশে কোনো পাখি উড়েনি।"
সত্যতা যাচাই করে দেখা প্রয়োজন মনে করি। অতএব ব্যবচ্ছেদ। তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস চোদ্দোশো শতকের একজন তুর্কি-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ। তিনি পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজ দখলে এনে তৈমুরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৩৭০ থেকে ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল। তিনিই তৈমুরীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি তিমুরে লঙ নামেও পরিচিত, যার অর্থ খোঁড়া তৈমুর। তাঁর আসল নাম তৈমুর বেগ। যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি আহত হন, যার ফলে তাঁর একটি পা অকেজো হয়ে যায় এবং তিনি খোঁড়া হয়ে যান। তিনি তুগরিল বেগ এর সরাসরি বংশধর না-হলেও তুঘরিল বেগ যে অর্ঘুজ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই অর্গুজ গোত্রেই তৈমুর লঙ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ যার মধ্যে আছে কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, বর্তমান পাকিস্তান, বর্তমান ভারতবর্ষ, এমনকি চিনের কাশগর পর্যন্ত।
তুঘলক বংশের শাসনের শেষদিকে ভারতে তৈমুর লঙের আক্রমণ ঘটে গেল। তৈমুরের আক্রমণের প্রাক্কালে তুঘলক সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙে যায়। যেটুকু বাকি ছিল তৈমুরের আক্রমণে সেটুকুও ধ্বংস হয়ে যায়। দিল্লি নগরী লুঠ করে তৈমুর ফিরে যান। তৈমুর ছিলেন মধ্য এশিয়ার সমরখন্দের মানুষ। তিনি তাঁর ক্ষুদ্র পৈত্রিক রাজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তুর্কিস্তানের কিছু অংশ, অক্সাস অঞ্চল, আফগানিস্তান, পারস্য, সিরিয়া, কুর্দিস্তান, বাগদাদ জয় করে নজর পড়ল ভারতে।
তৈমুর যখন তরুণ বয়সি, তখন সমগ্র মধ্য এশিয়া (আমু দরিয়া এবং সির দরিয়া নদীবিধৌত অঞ্চল) জুড়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। বিভিন্ন যাযাবর দল এবং স্থানীয় নেতাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লেগেই থাকত। অপরদিকে স্থানীয় নেতারা অনেকটা পাশ্চাত্য মতাদর্শে শাসন করতেন। তাঁরা চেঙ্গিস খান, কুবলাই খানের শাসনব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। এই কারণে স্থানীয় জনগণ তাঁদের উপর অসন্তুষ্ট ছিল। আমির কাজগান স্থানীয় নেতা চাগতাই খানাতের সর্দার বরলদেকে উৎখাত করে ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু তিনি ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে ঘাতকের হাতে নিহত হন।এবার ক্ষমতায় আসেন তুঘলক তিমুর। তিনি বারলাস অঞ্চলের শাসক হিসেবে তৈমুর লঙকে নিযুক্ত করেন। তৈমুর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তুঘলককে অপসারণ করার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করতে শুরু করে দেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি, তিনি ধরা পড়ে যান। অবশেষে তৈমুরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন তিমুর। তৈমুর লং আমির হুসেইনের (আমির কাজগানের নাতি) সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তৈমুর হুসেইনের বোনকে বিয়ে করেন। তারা দুজন মিলে ১৩৬৪ সালে তুঘলক তিমুরের পুত্র আমির খোজাকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ার সিংহাসনে বসেন। তৈমুর এবং হুসেইন যৌথভাবে শাসন করতে থাকেন। কিন্তু তৈমুর একক শাসনের স্বপ্ন দেখেন, তাই হুসেইনকে হটিয়ে দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ১৩৭০ সালে তৈমুরের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে হুসেইনের সঙ্গে আর কোনো পারিবারিক বন্ধন থাকল না। হুসেইনকে হত্যা করে তৈমুর মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে ঘোষণা করেন। শুধু মধ্য এশিয়া নিয়ে তৈমুর মোটেই খুশি নন, তিনি চান চেঙ্গিসের মতো পৃথিবী শাসন করতে। পৃথিবীর মানচিত্রে চোখ বুলিয়ে তিনি তাঁর বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে নিলেন। পরদিনই তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়েন। তৈমুরের অভিযানের খবর পেয়ে ক্ষমতাচ্যুত মঙ্গোল খান তোকতামিশ তৈমুরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তৈমুর লঙ বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং তোকতামিশ খানকে রাশিয়ার হৃত সিংহাসন ফিরিয়ে দেন। এরপর তৈমুর পারস্যের দিকে সেনাবাহিনী নিয়ে ধাবিত হন। পারস্য অভিযান শুরু হয় হেরাত নগরী দখলের মধ্যে দিয়েই। প্রথমদিকে কার্তিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী হেরাত তৈমুরের নিকট আত্মসমর্পণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। এর ফলে হেরাতের সকল নাগরিককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার আদেশ দেন। হুকুম মুখ থেকে সরতে না-সরতেই তৈমুরবাহিনী হেরাতবাসীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৈমুর বাহিনীর আগ্রাসনে হেরাত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। অবশেষে ১৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে তৈমুরের পায়ে লুটিয়ে পড়ে হেরাত পরাজয় স্বীকার করে।
তৈমুরের নৃশংসতার খবর পারস্যের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। তৈমুর এবার তেহরানের মাটিতে পা দিলেন। তেহরান তৈমুরের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এরপর একে একে এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং ইরাকের কিছু অংশ তৈমুরের করায়ত্ত হয়। এদিকে বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা তো তৈমুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিয়েছে। ক্রুদ্ধ তৈমুর অভিযান ক্ষান্ত দিয়ে কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন। আফগানিস্তানে বিদ্রোহীদের হত্যা করেন। সেখানে একটি মিনার নির্মাণ করেন, আর সেই মিনার ইস্পাহান শহরের ৭০ হাজার বিদ্রোহীর মাথার খুলি একটি অপরটির উপর জুড়ে দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। ১৩৮৭ সালে তৈমুরের মিত্র তোকতামিশ মধ্য এশিয়া আক্রমণ করেন। ১৩৯২ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় পশ্চিমে অভিযান চালান এবং ইরাক দখল করেন। ১৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে মস্কো দখল করেন। রক্তস্নাত মস্কোর সামনে দাঁড়িয়ে তৈমুর লঙ তৃপ্তির হাসি দেন। বিশ্বজয়ের ক্ষুধা তাঁর তখনও মিটেনি। এবার নজর পড়ল ভারত উপমহাদেশের দিকে।
ভারতের শাসক ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভিন্ন নেতারা সেসময় অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে তৈমুর লঙ ঝাঁপিয়ে পড়লেন মাটিতে, ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধুনদের পাড়ে হাজির হয়ে তৈমুর লঙ হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠেন। হত্যা করতে করতে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। প্রায় এক লাখ মানুষ হত্যার পরে তিনি দিল্লি গিয়ে পৌঁছান। সেসময় দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ তুঘলক হস্তিবাহিনী নিয়ে তৈমুরকে আক্রমণ করেন। তৈমুর তখন হাজার হাজার উটের পিঠ খড়ের গাদা দিয়ে বোঝাই করলেন। এরপর খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে উটগুলোকে হস্তিবাহিনীর উল্টোদিকে হটিয়ে দেন। হাতিগুলো ঘুরে সুলতানকেই আক্রমণ করে বসে। নিজেদের বাহিনীর হাতেই পরাজিত হন সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ তুঘলক। দিল্লি দখলের আনন্দে তৈমুর বাহিনী দিল্লী জুড়ে রক্তের হোলি খেলতে শুরু দিল। তবে তৈমুর কিন্তু ভারত শাসন করেননি। তিনি মূলত ভারত থেকে বহু মূল্যবান সম্পদ লুট করে সমরকন্দে ফিরে যান। ১৩৯৯ সালে তৈমুর বাগদাদ আক্রমণ করে বরাবরের মতোই তিনি অনায়াসে হৃত বাগদাদ দখল করে নেন। তাঁর হুকুমে বাগদাদের ২০ হাজার বিদ্রোহীর মুণ্ডু কেটে নেওয়া হয়। তৈমুর লঙ বাহিনী প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করে, যা তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৫%। স্বাধীন সম্রাটরা ভয়ে ভয়ে থাকতেন। এই বুঝি তৈমুর তার বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে বসেন ! প্রায় অর্ধেক পৃথিবী তৈমুর লঙের অধিকারে চলে আসে। তৈমুর লঙ নিজেকে ‘ইসলামের তরবারি’ হিসাবে জাহির করতেন। একজন ইসলামি হিসাবে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নিষ্ঠুর ও নির্দয় সাম্রাজ্যবাদী মানুষ। দ্বিগ্বিজয়ী বীর হিসাবে তৈমুর লঙ যতটা খ্যাতি লাভ করেছিলেন, তা ছাপিয়ে গেছে তাঁর নিষ্ঠুরতার কুখ্যাতি।একজন শিল্পানুরাগী হয়ে কীভাবে যে এত রক্তপিপাসু হতে পারে, সেটা অবশ্যই মনস্তাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় হতে পারে।
ঐতিহাসিক গোলাম আহমেদ মোর্তাজা তৈমুরের এই বীরত্বে বেশ ভক্তিই রেখেছেন। বলেছেন – “পৃথিবীর সকল ঐতিহাসিকই একমত যে, বিজেতা হিসাবে তৈমুর অদ্বিতীয়। আলেকজান্ডার, সিরাজ, হানিবল, শার্লিমেন, চেঙ্গিস, নেপোলিয়ন কেউ তাঁর সমকক্ষ নন। এককথায় তৈমুর নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক দক্ষতা, অপরিসীম সাহস ও অধ্যবসায়ের গুণে ভূমধ্যসাগর থেকে গঙ্গা এবং ভলগা ও ইপটিস নদী থেকে পারস্যোপসাগর পর্যন্ত নিজের সাম্রাজ্যের পরিধিকে বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তৈমুরের দিল্লি অভিযান ভারতের ইতিহাসে এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়।” তবে বিদ্বেষের ঐতিহাসিক মোর্তাজা যে সাফাই দিয়েছেন সেটা কতটা গ্রহনীয় পাঠকরা ভেবে দেখতে পারেন – “অনেকে বলেন, তৈমুর হিন্দুবিদ্বেষী। কিন্তু তা ঠিক নয়। হিন্দুবিদ্বেষের বশে তিনি ভারত আক্রমণ করেননি। তিনি তাঁর উৎকট দিগ্বিজয়ের বাসনাকে চরিতার্থ করতেই শুধু ভারত নয়, বিশ্বগ্রাসে মেতে উঠেছিলেন।” (ইতিহাসের ইতিহাস) আমিও মনে করি, কেবলমাত্র হিন্দুবিদ্বেষী বলে তকমা আটলে সেটা হবে ঐতিহাসিক ভুল। আগেই বলেছি, তৈমুর অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছিলেন চরম নিষ্ঠুরতার মধ্যে দিয়ে। হত্যার করার সময় তিনি হিন্দু-মুসলমান বিচার করেছিলেন বলে মনে করি না। তিনি লক্ষ লক্ষ মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, শিন্টদের নৃশংস হত্যা যেমন করেছেন, তেমনি হিন্দুও হত্যা করেছেন। হিন্দু হত্যা করে তিনি ‘গাজি’ হয়েছেন, এটা বলার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। তিনি মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, শিন্টদের ইসলাম ধর্মে এনেছেন বলেও এমন কোনো নথি পাইনি। তিনি ধর্মনির্বিশেষে নির্বিচারে হত্যা করেছেন সত্য, কিন্তু ধর্মান্তরের কোনো কর্মসূচি তিনি কখনো নেননি। তাঁকে বীভৎস নরপিশাচ সাম্রাজ্যবাদী বলা যেতেই পারে। তাঁর সাম্রাজ্য দখলের পথে হাতের কাছে যাকে পেয়েছেন তাঁকেই হত্যা করেছেন। কিন্তু হিন্দুবিদ্বেষী বা পৌত্তলিকতায় অবিশ্বাসী ভারত আক্রমণ করেছেন একথা বলা যায় না।
১৪০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তৈমুরের কফিনের উপরের ঢাকনায় বড়ো করে লেখা ছিল, “যে আমার কবর খনন করবে, সে আমার চেয়েও ভয়াবহ এক শাসককে জাগিয়ে তুলবে” এবং “আমি যেদিন ফের জেগে উঠব, সেদিন সমগ্র পৃথিবী আমার ভয়ে কাঁপবে!”
0 মন্তব্যসমূহ