১৫২২ সালে স্প্যানিশরা ভেনিজুয়েলার আদি বাসিন্দাদের সরিয়ে ধীরে ধীরে ভেনিজুয়েলার দখল নিতে শুরু করে। ভেনিজুয়েলা নামও স্প্যানিশদের দেওয়া। এখানে পা দিয়ে তাদের মনে হয় যেন ইতালির ভেনিস শহরে এসে পড়েছি। তাই স্প্যানিশ ভাষায় এর নামকরণ হয় ভেনিজুয়েলা বা ছোট্ট ভেনিস।
লাতিন আমেরিকান দেশগুলির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হল প্রেসিডেন্সিয়াল ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা ও ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ। সমাজতান্ত্রিক তকমা নেওয়া দেশগুলিও এই শাসন ব্যবস্থার বাইরে নয়। ভেনিজুয়েলাও এই শাসন ব্যবস্থাকে অনুসরণ করে। ভেনিজুয়েলা মূল্যবান খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ হলেও কখনো বিশ্ব মানচিত্রে সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। আমেরিকান নিয়ন্ত্রণাধীন এই দেশের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করত আমেরিকান সরকার ও কর্পোরেট কোম্পানিরা। তেল, স্টিল, টেলিকম, পরিকাঠামো সবেতেই সিংহভাগ শেয়ার ভোগ করত আমেরিকান নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলি।
১৯৯৮ সালে হুগো শাভেজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই ব্যবস্থা পরিবর্তিত হতে শুরু করে। সমস্ত আমেরিকান ও অন্য বেসরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হতে শুরু করে। আইনের মাধ্যমে ভেনিজুয়েলায় বিভিন্ন তেল কোম্পানিতে সরাসরিভাবে ৫১% সরকারি নিয়ন্ত্রণের কথা ঘোষণা করা হয়। এই প্রাক্তন মিলিটারি অফিসার এর পূর্বেও ১৯৯২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভেনিজুয়েলার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন ও ব্যর্থ হন। ক্ষমতায় এসে তিনি বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন ও জনগণকে বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এক্ষেত্রে তিনি কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে অনুসরণ করেন। শুধু তাই নয় দীর্ঘযুগ ধরে আমেরিকান অবরোধের সম্মুখীন হওয়া এই দেশকে তিনি তেল ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে সাহায্য দেওয়া শুরু করেন। বিনিময়ে কিউবাও ভেনিজুয়েলাকে তাদের উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় সমৃদ্ধ করা শুরু করে। কিউবার সুপ্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের মাধ্যমে ভেনিজুয়েলায় প্রায় ১১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষকে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় শাভেজ লাতিন আমেরিকান অন্যান্য দেশগুলিকে নিয়ে আমেরিকান বিরোধী ব্লক করা শুরু করেন ও নিজেদের মত করে সংযুক্ত ব্যবস্থার গঠনে উদ্যোগী হন। ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, কিউবা, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া সহ কয়েকটি দেশকে নিয়ে তিনি ALBA চুক্তির প্রবর্তন করেন। এর মূল উদ্দেশ্য লাতিন আমেরিকান দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক বৃদ্ধি। এছাড়াও এই অঞ্চলে ইউরো ব্যবস্থার মত SUCRE নামে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা প্রণয়নে তিনি উদ্যোগী হন।
শুধু তাই নয়। শাভেজ দেশের জনগণের জন্য বিভিন্ন কল্যাণকামী ব্যবস্থার প্রবর্তন শুরু করেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি ভূমি সংস্কার ও আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণে উদ্যোগী হন। বিনামূল্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিভিন্ন উৎসাহমূলক ভাতা, সস্তায় খাদ্য - এইরকম বিভিন্ন পরিষেবা শাভেজ সরকার শুরু করেন। এছাড়াও তিনি জনগণকে বিভিন্ন কোঅপারেটিভ সংস্থা গঠনে উৎসাহ দিতে শুরু করেন। এরজন্য সরকার বিভিন্ন উৎসাহ ভাতা ও কর মুকুব করা শুরু করে। ২০০৫-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ১৬% ভেনিজুয়েলার নাগরিক এই স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর অন্তর্ভূত হন। যদিও ২০০৬ সালে এসে দেখা যায় প্রায় ৫০% স্বনির্ভর গোষ্ঠীরর হয় অস্তিত্ব নেই অথবা এগুলির মধ্যে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে। বেশিরভাগ সংস্থা ভুঁয়োভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সহজে সরকারি অর্থ নয়ছয় করতে পারে ও আয়করে ফাঁকি দিতে পারে। এর পরেও শাভেজ এই ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করতে ব্যর্থ হন। ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি প্রায় পুরোপুরি তেলের উপর নির্ভরশীল। বিশ্ববাজারে তেলের দামের কমা-বাড়ার উপরে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতিও উর্দ্ধ বা নিম্নমুখী হয়।
যদিও শাভেজ শেষদিন অব্দি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন কল্যানমূলক পরিষবা জারি রাখেন। তার সময়েই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মোট জিডিপির ৭.৭% ব্যয় করা শুরু করেন। যেখানে ভারতে এই হার ১.৪% ও বাংলাদেশে ০.৮%। শাভেজের সময়ে দারিদ্রের হার ৪৮.৭% শতাংশ থেকে ৩২.১% এ নেমে আসে।
কিন্তু তারপরেও অন্ধকার দিকগুলিকে অস্বীকার করা যায় না। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমেনি। তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পালনে ব্যর্থ হন। যেমন আমাদের দেশের মোদীর মত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বছরে দেড় লক্ষ বাড়ি তৈরি করে দেবেন। তার সরকার বছরে ৩৫০০০ বাড়ি তৈরিতেও ব্যর্থ হন। সবকিছু রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণাধীন করতে গিয়ে উৎপাদন হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। যেমন সিমেন্ট উৎপাদন ৬০% কমে যায়। নতুন রেললাইন তৈরিতে হাত দিয়েও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। চীনা রেল কোম্পানি দাবি করেন যে ভেনিজুয়েলার সরকার প্রতিশ্রুত অর্থ পরিশোধ করেনি, তাই তারা কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। শাভেজ সরকার রাশিয়া ও চীন থেকে ঋণ নিতেও শুরু করেন।
আমাদের দেশের গুটিকয় যেমন দাবি করেন ভেনিজুয়েলায় শাভেজের নেতৃত্বে নয়া সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে অসত্যবচন। এক প্রাক্তন মিলিটারি নেতা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করবেন তা শুধুমাত্র স্বপ্ন হতে পারে। তাই দেখা যায় বিভিন্ন সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে শাভেজ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে আরো কুক্ষিগত করেছেন। জনগণের হাতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ ভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠন হতে পারে না। সেখানে তিনি উল্টোপথে হেঁটে রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ আরো দৃঢ় করেছেন। বিনিময়ে তিনি বিভিন্ন কল্যানমূলক পদক্ষেপ অনুসরণ করেছেন। যেখানে তিনি পুরোপুরিভাবে ফিদেল কাস্ত্রোকে অনুসরণ করেছেন। রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সামাজিক কল্যাণমুখী পদক্ষেপ। যাতে স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থার বিনিময়ে জনগণকে কিছু সুবিধা দেওয়া। এই ব্যবস্থা অনুসরণ করে কাস্ত্রো আমৃত্যু কিউবা শাসন করে গেছেন। শাভেজও এই ব্যবস্থার সফল প্রয়োগকর্তা। ভারতেও জয়ললিতা বা মমতা কিছুটা এই ব্যবস্থা অনুসরণ করেন। বিনামূল্যে শিক্ষা, সাইকেল, ল্যাপটপ, বিভিন্ন ভাতার মাধ্যমে জনগণের থেকে প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবি করেন। তাই বিভিন্ন দুর্নীতির পরেও এদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সমস্যা হয়না। শাভেজ কখনোই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করেননি। তিনি উদারবাদী ক্যাথলিক খ্রিস্টান ছিলেন। যদিও ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্দ্ধে ছিলেন। তিনি কখনোই স্বয়ম্ভর গ্রাম্য ব্যবস্থা তৈরিতে উদ্যোগী হননি।
তিনি চেয়েছিলেন লাতিন আমেরিকান আইকন হতে। আমরা এই আইকনকে অবশ্যই সম্মান জানাচ্ছি।
0 মন্তব্যসমূহ