● ছবিতে- ১৮৬০ এর দশকে তোলা এক বালক নাথ ব্রাহ্মণ যোগী বা রুদ্রজ ব্রাহ্মণ যোগীর স্টুডিও পোট্রেট। সম্ভবত তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কতৃক এদের চিহ্নিত করে রাখার জন্য ছবিটি তোলা হয়েছিল।
(ছবি সৌজন্যে: Harvard University, Cambridge, Massachusetts, United Kingdom.)
'নাথ কি জাত' এই প্রশ্নটা আজও অনেকের মনে উকি ঝুকি মারে, কারণ নাথ জাতির আচার ব্যবহার অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে সামাজিক প্রথায় বেশ কিছু স্বাতন্ত্র্য রয়ে গেছে। যেমন: শব-সমাধি রীতি, অন্নের পিন্ডদান, সমগোত্রীয়দের মধ্যে বিবাহ, শালগ্রাম শিলা স্পর্শপূর্বক তার পূজা, দেব-দেবীকে অন্নভোগ প্রদান, চন্ডীপাঠ, শিবপূজা ইত্যাদি। অধিকন্তু এইসব ব্যাপারে নারী পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে। অন্যান্য সামাজিক ব্যাপারে অবশ্য সামবেদ অনুসরণ করা হয়। প্রবর পাঁচটি- শিব, শম্ভু, সরোজ, ভূধর ও আপ্লুব। এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃতিগুলো পাঠ করলে কোন সংশয় বা দ্বিধা থাকার কথা নয়। 'নাম যোগী পঞ্চ বিপ্র, যোগ যোগী সহস্রশঃ' অর্থাৎ যিনি শুধু নামে যোগী তিনি পাঁচজন বিপ্রের (ব্রাহ্মণ) এর সমান, এবং যিনি যোগ সাধনার বলে যোগী তিনি সহস্র বিপ্রের (ব্রাহ্মণদের) সমান। গোপাল ভট্ট লিখিত ও শশীভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় কর্তৃক অনূদিত 'বল্লাল চরিত্র' নামক গ্রন্থে যোগ জাতির উৎপত্তি অতীব উত্তম বলে বর্নিত হয়েছে। মহান রুদ্রের (শিব) ঔরসে সূর্যবতীর গর্ভে যোগনাথ জম্মগ্রহণ করেছিলেন। এই যোগনাথ হতে নাথ বংশের বিস্তার হয়েছে। বেদশাস্ত্র এবং পুরাণাদীতে মহাদেবকে মহান এবং মহারুদ্র রুপে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই নাথ সম্প্রদায় রুদ্রজ ব্রাম্মণ, আর যোগ সাধনাই তাদের প্রধান ধর্ম বলে তাঁরা "যোগী"। নাথ সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতা শিব, তাই তাঁরা শৈব এবং শিব গোত্রীয়।
আমরা বর্তমানে যাদের 'নাথ' বা 'দেবনাথ' পদবি দেখতে পাই, তাঁরা সকলেই নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত।
নাথ ধর্মের প্রবর্তন করেন যোগী মীননাথ। তিনিই ছিলেন নাথ ধর্মের প্রথম গুরু। তিনি আদতে বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বরিশাল জেলার লোক ছিলেন। তবে তাঁর নাম অনেক রূপে লিখিত হয়েছে: মৎস্যেন্দ্রনাথ, মচ্ছেন্দ্রনাথ ইত্যাদি। তাঁর ধর্মের নামও অনেক: নাথপন্থা, নাথধর্ম, সহজিয়া ইত্যাদি। মীননাথের জন্মস্থান চন্দ্রদ্বীপ এবং জীবনের অনেকটা সময় চন্দ্রদ্বীপেই তিনি অতিবাহিত করেছেন। এ মর্মে রায় পাওয়া যায় ‘কৌলজ্ঞান নির্ণয়’ গ্রন্থে এবং জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও ওয়াকিল আহমদ এর বিশ্লেষণে।
মীননাথের প্রবর্তিত ধর্মটি বেশ মজার। এ ধর্মে ঈশ্বর নেই। বাঙালির ধর্মের ইতিহাসে রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য। এক বা একাধিক অলৌকিক শক্তি বা সত্তা ও তাদের আরাধনা এই অনেক বৈচিত্র্যের মাঝে এক মোটামুটি সাধারণ রূপ। কিন্তু অলৌকিক শক্তি বা ঈশ্বরের ধারণার উল্টোরূপ কিছু মতও এখানে ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। মীননাথের নাথধর্ম তার অনুরূপ। নাথধর্ম নিরীশ্বর অর্থাৎ এখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। এ ধর্মের সাধনায় কেন্দ্রে থাকে একজন গুরু বা সিদ্ধা। তাই এ ধর্ম গুরুবাদী। গুরুবাদী এই ধর্মের আদি ও প্রধান গুরু বা সিদ্ধা মীননাথ নিজেই। তার যোগ্য শিষ্য গোরক্ষনাথের প্রচেষ্টায় এই ধর্মমত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ নেপাল, সিকিম পর্যন্ত এ ধর্ম প্রচার লাভ করে।
নাথ পন্থের উৎপত্তি নিয়ে বিশ্লেষকগণ বিভিন্ন মত প্রদান করেন। নিম্নে কিছু মত উল্লেখ করা গেল-
“নাথপন্থা যে বৌদ্ধ মন্ত্রযান হইতে উদ্ভূত বা প্রভাবিত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। এই নাথ পন্থা বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখার শূন্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত”।- ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙলা সাহিত্য কথা(১ম খন্ড), পৃ: ১৭,২১,২৮
“নবম,দশম এবং একাদশ খ্রিষ্ট শতাব্দে বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের শাখা বিশেষের সহিত শৈব ধর্মের যোগ ও তন্ত্রাচার মিলিত হইয়া নাথ পন্থের সৃষ্টি করিয়াছিল”। - শ্রী নলিনী কান্ত ভট্টশালী, ‘মীনচেতন’ ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
“যাহারা নিরঞ্জনপন্থী, কনফট, মচ্ছেন্দ্রী, সারঙ্গীহার, কানিপা ইত্যাদি নামে আছেন তাহারা (সন্ন্যাসীরা) নাথপন্থেরই পথিক, ...নাথপন্থের উৎপত্তি ও বিকাশ যে বাঙ্গলা কেন্দ্রিক পূর্ব ভারতে ঘটিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ করিবার কিছুই নাই”। - ড. সুকুমার সেন।
“ব্রাহ্মণ্য-শৈব ও বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত, এর আধুনিক নাম নাথপন্থ”। - ড. আহমদ শরীফ, বাঙলার সূফী সাধনা ও সূফী সাহিত্য, ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
“নাথপন্থা মূলত আদিম মৈথুন তত্ত্ব ও টোটেম বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত এবং মূলত এটি অনার্য দর্শন। সাংখ্য ও যোগ এই দুই শাস্ত্র ও পদ্ধতি যে আদিম অনার্য দর্শন ও ধর্ম তা আজকাল আর কেউ অস্বীকার করেনা। এই শাস্ত্র অস্টিক কিংবা বাঙলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিরাত জাতির মনন উদ্ভূত। ... বাঙালির শিব ও ধর্মঠাকুর অনার্য মানস প্রসূত। তেমনই অনাদি এবং আদিনাথও কিরাত জাতির দান। ভোট-চীনার (মঙ্গোলীয়) নত> নথ> নাত> নাথ থেকেই যে “নাথ” গৃহীত তা আজ গবেষণার অপেক্ষা রাখে না”। - ড. আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য; বাঙালীর মৌল ধর্ম, পৃষ্ঠা: ৭৯।
নাথপন্থা নিরীশ্বর, ধর্মমঙ্গল, শূন্যপুরানের ধর্মঠাকুর আর নাথ ঐতিহ্যের নিরঞ্জন আদিনাথ অভিন্ন। ধর্মঠাকুরের পুরানকথা আর নিরঞ্জনের সৃষ্টি বর্ণনা একই। নাথদের আদিনাথ শিব। জৈন ধর্মের আদিনাথও সম্ভবত শিব, জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর নির্গ্রন্থ নাথ। নিগন্থ>নিগ্রন্থ>বেদবিরোধী।
মীননাথের জন্মস্থান চন্দ্রদ্বীপ, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বরিশাল। কেউ কেউ মীননাথের জন্ম সন্দীপ বলে প্রায়ই ভুল করে থাকেন, কারন দূর অতীতে সন্দীপ চন্দ্রদ্বীপের ভেতরেই ছিল। মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথের জন্ম পূর্ব বঙ্গ বলে পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে নাথপন্থার অনুসারীরা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মে ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁতি শ্রেণীর বৌদ্ধরাই প্রধানত নাথপন্থী। ইসলাম ধর্মে যারা জোলা ‘জুলহা’ নামে পরিচিত তারা আদিতে নাথপন্থী ছিল।
বঙ্গদেশে পেশা ও জীবিকার ধরণ হিসেবে নাথপন্থীদের তিনটি শ্রেণী আছে:
ক) সাধারণ যোগী,
খ) জাত যোগী, ও
গ) সন্ন্যাসী যোগী।
প্রথম শ্রেণী গৃহ যোগী। তাঁরা কৃষি ও তন্তুবায়ের কাজ করত।
জাত যোগীরা ভবঘুরে ও সাপুড়ে।
সন্ন্যাসী যোগীরা প্রধানত ভিক্ষা করতেন। অলাবু বা নারিকেলের মালা তাঁদের ভিক্ষার পাত্র। যোগীরা ‘অচল’ নামক এক যষ্ঠি ব্যবহার করতেন।
বাংলাদেশের ঢাকা ও ভারতের ত্রিপুরার যোগীরা প্রধানত বস্ত্র উৎপাদন করতেন।
বাংলাদেশের রংপুরের চুনতি যোগীরা চুন উৎপাদন করতেন।
পানাতি যোগীরা পান উৎপাদন করতেন।
পূর্ববঙ্গে ‘মৎস্য’ ও ‘একাদশী’ নামে দুটি যোগী সম্প্রদায় আছে তাঁরা পরস্পরের অন্ন গ্রহণ করে না অন্তর্বিবাহ করে না।
ভারতের ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের নোয়াখালী ও বিক্রমপুরে মৎস্য যোগী ও বাংলাদেশের ঢাকায় একাদশী যোগী বসবাস করতেন। বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতি পাহাড় সংলগ্ন ঘোষনগর গ্রামে যোগীদের বসবাস এখনো আছে। ১৮৮১ সালে বঙ্গদেশে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ যোগীর বসবাস ছিল। ১৯১০ সালে একমাত্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রায় ৬৮,০০০ যোগী ছিল। শ্রীমতি কল্যানী মল্লিক “নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও সাধন প্রণালী” গ্রন্থে বলেছেন, পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশে সাড়ে চার লক্ষ যোগী আছে। এদের এক তৃতীয়াংশ পশ্চিমবঙ্গ এবং দুই তৃতীয়াংশ পূর্ববঙ্গে বসবাস করে।
দশম শতকের শেষভাগ থেকে কোন কোন গুরু বা সিদ্ধা এমন ছিলেন যিনি শৈব ও বৌদ্ধ এই দুই পদ্ধতিরই আচার্য ছিলেন। অর্থাৎ তিনি আচার্য হিসেবে যেমন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কর্তৃক মান্য হতেন তেমনি শৈব সম্প্রদায় কর্তৃক মান্য হতেন। আমরা তিনজন প্রধান সিদ্ধার কথা জানি যারা উভয় সম্প্রদায় কর্তৃক সম্মানিত হয়েছেন। এঁরা তিনজন হলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, জালন্দর ও কানহ। মোটসিদ্ধার সংখ্যা বলা হয় চৌরাশি। Albert Grunwedel তিব্বতী সূত্রে প্রাপ্ত চৌরাশি জন মহাসিদ্ধার নাম পরিচয় সংকলন করেছেন।
চৌরাশি সংখ্যাটি বিভিন্ন কারণে নাথপন্থায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চৌরাশি আঙুল পরিমিত কায়ার সাধনে সিদ্ধ হলে নাথপন্থায় তাকে সিদ্ধা বলে। বৌদ্ধপূর্ব যুগের আজীবিকদের বিশ্বাস ছিল যে চৌরাশি লক্ষ স্তর বা অবস্থা (জন্মান্তর) অতিক্রম করে আত্মা মনুষ্য দেহে স্থিতি পায়। মৈত্রায়নী উপনিষদে চৌরাশি হাজার বার জন্মের বা জন্মান্তরের উল্লেখ আছে। কোন কোন তন্ত্রে ও পুরাণে বিভিন্ন অবস্থায় চৌরাশি লক্ষ যোগী ও জন্মের কথা আছে। বৌদ্ধদের “ধর্মখন্ধ” (ধর্মস্কন্ধ) এর সংখ্যা চৌরাশী হাজার। যোগ ও তন্ত্রের গ্রন্থে যোগাসনের ব্যায়াম চর্যাপদ্ধতি চৌরাশি প্রকার। কানফাটা যোগীদের জপমালায় রয়েছে চৌরাশি বিটি বা দানা। স্কন্ধপুরাণে রয়েছে চৌরাশি প্রকার শিবলিঙ্গের বর্ণনা।
নাথপন্থ দুই ভাগে বিভক্ত।
মীননাথ-গোরক্ষনাথ কাহিনতত্ত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশুদ্ধ নাথপন্থা। আর হাড়িফা- কানুফার তত্ত্ব ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কামাচারী তান্ত্রিক সাধনা যার ফলে গড়ে উঠেছে সহজিয়া মতবাদী গৃহযোগী সম্প্রদায়। এরা বিশুদ্ধ নাথপন্থী নয়। এদেরকে বলা হয় ‘ফা’পন্থী।
মীননাথের নাথ ধর্মে একটি সৃষ্টিতত্ত্বও রয়েছে। এতে বলা হয়েছে জলময় অন্ধকার অবস্থা থেকেই অনাদিশক্তি গড়ে ওঠে এবং তার ইচ্ছা থেকে কায়াধারী আদিনাথ ও নিরঞ্জনের উদ্ভব। আদি শক্তির ঘর্ম থেকে জল, জল থেকে কূর্ম (কুমির) তারপর হংস, উল্লুক এবং তারপর হলো বাসুকির (সাপ) জন্ম। আদিনাথের মন থেকে আদি শক্তির উদ্ভব। এই আদ্যাশক্তিই জন্ম দিলেন শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মার। আবার শৈব শক্তি থেকে দেব ও মানবের সৃষ্টি।
নাথ সাধনা প্রণালীতে বলা হয় দেহের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নাড়ী। তার মধ্যে তিনটি প্রধান ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না এদেরকে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী এই তিনটি মহানদী কল্পনা করা হলে অন্যগুলো উপনদী। এগুলো দিয়ে শুক্র, রজঃ, নীর, ক্ষীর ও রক্ত প্রবাহমান। এ প্রবাহ বায়ুচালিত। অতএব নাথ সাধনা প্রণালীতে বলা হয় বায়ু নিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জন করলেই দেহের উপর কর্তৃত্ব জন্মায়।
এ সাধনায় মজার প্রসঙ্গ হলো রমণ বা রতি বিষয়ক। এ সাধনা প্রণালীতে বলা হয় প্রশ্বাস হচ্ছে রেচক, শ্বাস হচ্ছে পূরক এবং দম অবরুদ্ধ করে রাখার নাম কুম্ভক। ইড়া নাড়ীতে পূরক ও পিঙ্গলায় রেচক করতে হয়। কুম্ভক বা দম ধরে রাখার সময়ের দৈর্ঘ্যই সাধকের শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ। এর নাম প্রাণায়াম। এমন অবস্থায় দেহ হয় ইচ্ছাধীন তখন যে-শুক্রের স্খলনে নতুন জীবন সৃষ্টি হয় সেই শুক্রকে নাড়ীর মাধ্যমে উর্ধ্বে সঞ্চালিত করা হয়। তার পতন ও স্খলন রোধ করলেই শক্তি হয় সংরক্ষিত। সেই সঞ্চিত শুক্র শরীরে জোয়ারের জলের মতো ইচ্ছানুরূপ প্রবাহমান রেখে স্থায়ী রমন সুখ অনুভব করাও সম্ভব। মূলাধার (গুহ্য ও জনন ইন্দ্রিয়ের মধ্যস্থ) থেকে শুক্রকে নাড়ীর মাধ্যমে উর্ধ্বে উত্তোলন করে ললাট দেশে সঞ্চিত করে রাখলেই ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব। এটাই সিদ্ধি সাধনার তিনটি স্তর - প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধি।
প্রবর্তাবস্থায় যোগী সুষুম্না-মুখে সঞ্চিত শুক্ররাশি ইড়া মার্গে মস্তিষ্কে চালিত করার প্রয়াস পায়। এতে সাফল্য ঘটলে যোগী প্রেমের কল্পনারূপ অমৃতধারায় স্নাত হয়। শৃঙ্গারের রতি স্থির করলে তথা বিন্দু ধারণে সমর্থ হলে যোগী সঠিক নামে অভিহিত হয়। তখন মস্তিষ্ক সঞ্চিত শুক্ররাশিকে পিঙ্গলা পথে চালিত করে সুষুম্নামুখে আনা হয়। ফলে বিন্দু আজ্ঞাচক্র থেকে মূলাধার অবাধ স্নায়ুপথে জোয়ারের জলের মতো উচ্ছসিত প্রবাহ পায়। এতে প্রেমানন্দে দেহ প্লাবিত হয়। এর নাম তারুণ্যামৃত ধারার স্নান। এর ফলে সাধক ইচ্ছাশক্তি দ্বারা দেহ-মন নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায় এবং ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী পথে শুক্র ইচ্ছামত চালু রেখে অজরামরের মতো বোধগত সামরস্যজাত পরামনন্দ বা সহজানন্দ উপভোগ করতে থাকে। এরই নাম লাবণ্যামৃত পারাবারের স্নান। ইহা কায়াসাধন বা দেহসাধনের অতি প্রাচীন শাস্ত্র, তত্ত্ব ও পদ্ধতি। নেপাল তিব্বত ছাড়া সমতলভূমির মধ্যে বৌদ্ধযুগে কেবল বাংলাদেশে এর বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই এ অঞ্চলে সহজিয়া ও নাথপন্থার উদ্ভব।
নাথপন্থায় মহাজ্ঞানতত্ত্ব নামে একটি তত্ত্ব রয়েছে। মহাজ্ঞান হল “কায়া” বা যোগ সাধনার দ্বারা মরণশীল মানবদেহের পরিবর্তন এনে দীর্ঘজীবন তথা অজরত্ব ও অমরত্ব লাভ করা। নিরীশ্বরবাদী এই ধর্ম কোন প্রকার অলৌকিক ঐশী শক্তিতে বিশ্বাস করে না। যোগলদ্ধ জ্ঞান দ্বারা সমাধিস্থ হওয়ার মধ্যে ঈশ্বরের স্থান নেই। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মে নিরীশ্বরবাদের চেতনার সাথে এর মিল আছে। এই মহাজ্ঞানতত্ত্বের সাধনার দ্বারা সাধক কিছু অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়; যেমন:
ক) নিজ দেহের আকার পরিবর্তন,
খ) শূন্যপথে বিচরণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ মুহূর্তে অতিক্রম,
গ) ভক্তকে সন্তানলাভের বর প্রদান,
ঘ) মন্ত্রবলে মৃত ব্যক্তিকে জীবিতকরণ এবং এমনকি কাটা মুন্ডু জোড়াদান,
ঙ) মন্ত্রবলে ভূত-ভবিষ্যতের জ্ঞানলাভ ইত্যাদি।
নাথপন্থায় সাধন বিষয়ে কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। এই সাধনপন্থায় একজন শিষ্য ছয়মাস সংযমাদি পালন করার পর গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে যোগী হয়। দীক্ষিত যোগী গেরুয়া বস্ত্র পরিধান করে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ও উপবীত ধারণ করে। দুই কানে কুন্ডুল পরে। ডান বাহুতে যোনিলিঙ্গের চিহ্ন এবং হাতে পিতল, রূপা, লোহা বা গন্ডারের চর্মের বলয় পারে। দীক্ষা গ্রহণ কালে মস্তক মুন্ডন করলেও পরে জটা ধারণ করতে পারে। কানের উপাস্থি পর্যন্ত দীর্ঘ ছিদ্র করে বলে নাথপন্থীরা ‘কানফাটা যোগী’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
দীক্ষাগ্রহণের পর যোগী আজীবন ব্রহ্মচর্যা অথবা গার্হস্থ্যধর্ম পালন করতে পারে। মৃত্যুর পর যোগীর মৃত দেহ ধ্যানাবস্থায় আসন বদ্ধ করে সমাধিস্থ করা হয়। তবে ‘গোপীচন্দ্রের গানে’ মাণিকচন্দ্রের মৃত্যু হলে তাকে হিন্দু রীতিতে দাহ করা হয়। ময়নামতী সহমরণে চিতায় আরোহণ করলেও অগ্নি তাকে দাহ করতে পারেনি কারণ মহাজ্ঞানের প্রভাবে তিনি অমরত্বের অধিকারিনী ছিলেন।
মোহসেন ফানী’র বর্ননায় অমৃতকুন্ডকে গোরক্ষ শিষ্যদের শাস্ত্র বলে উল্লেখ করে। সেই হিসেবে নাথশাস্ত্র হিসেবে অর্মতকুন্ডকে ধরা যায়। এই গ্রন্থটি সম্ভবত প্রাকৃতে কিংবা অবহট্টে রচিত ছিল। চৌদ্দ শতকে মিশরের সূফী মুহম্মদ আল মিশরী অমৃতকুন্ডের উল্লেখ করেছেন। মুসলিম জগতের সর্বত্র জনপ্রিয় হয়েছিল এই গ্রন্থ। অমৃত কুন্ড কামরূপের গ্রন্থ কামরূপ বাসী ভোজবর্মন ও অম্ভরানাথের সাহায্যে প্রাপ্ত ও অনুদিত, এতে অনুমান করা চলে যোগী ব্রাহ্মন নন বৌদ্ধ। অমৃতকুন্ডের দশটি অধ্যায় এবং পঞ্চাশটি শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে বিষয়বস্তু। এই গ্রন্থটির সূচি দেখলে নাথপন্থদের সাধনা প্রনালীর সাথে পরিচিত হওয়া যাবে।
১। জীবসৃষ্টি
২। জীবসৃষ্টি রহস্য
৩। মন ও তার তাৎর্পয
৪। অনুশীলন ও তার পদ্ধতি
৫। শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
৬। বিন্দু ধারন
৭। চিত্ত চাঞ্চল্য
৮। মৃত্যুলক্ষণ
৯। ইন্দ্রিয় ও মনজাত জগতের বর্ণনা।
আর্যধর্মের সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদিতায় আমাদের মীননাথের এই সাধন-ধর্মের অবসান হয়। বিলুপ্তিলগ্নে নিম্নবিত্তের নাথপন্থীরা স্বধর্ম রক্ষার প্রয়াসে বাহ্যত ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র ও সমাজ অঙ্গীকার করে ব্রাহ্মণ্য সমাজে আশ্রিত হয়ে আত্মরক্ষা করে। এ সময়েই প্রজ্ঞা- উপায়ে, বজ্র- তারায়, করুণা- শূন্যতায়, নাথ- নিরঞ্জনে ও আদিনাথ-আদ্যশক্তির (প্রকৃতি) বদলে হরগৌরী নাম বরণ করে। ক্রমে আদিনাথ- চন্দ্রনাথে, বৈদ্যনাথ- শিবে, তারা -চন্ডীতে, লোকনাথ- অবলোকিতেশ্বর বিষ্ণুতে, জাঙ্গুলী- মনসায়, বৎসলা- বাসুলীতে রূপান্তরিত হয়ে নিচুজাত হিন্দুর দেবতা রূপে গৃহীত হয়। ষোড়শ শতকের অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে এসব দেবতা অধিকাংশই অশ্রদ্ধায় অপসৃত হয়।
বঙ্গদেশে নাথ যোগীদের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় বহু সমস্যা। কোনও মতামতেই ঐক্যমত্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন, কেউ যখন জানাচ্ছেন নাথ গুরু আদিনাথ হচ্ছেন স্বয়ং শিব; তখন কেউ বলছেন পাঁচজন আদিনাথ পাওয়া যায়। আবার যখন কেউ বলছেন মীননাথ ও মৎসেন্দ্রনাথ একই ব্যক্তি ছিলেন; তখন ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ তার আদি পর্বে জানাচ্ছে, “ত্যাঙ্গুর-গ্রন্থ অনুযায়ী মীননাথ ছিলেন মৎসেন্দ্রনাথের পিতা। তাঁহার নাম বজ্রপাদ ও অচিন্ত্য।”
গোরক্ষনাথের কথা বলতে গিয়ে কেউ কেউ জানাচ্ছেন, তিনি পূর্ব-বঙ্গের মানুষ ছিলেন; আবার কেউ কেউ বলেছেন, উত্তর ভারত অথবা উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে আগত।
শুধু এই নয়, নাথ গুরুদের সময়-কাল নিয়েও বহু সমস্যা। মীননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথকে কেউ কেউ দেখিয়েছেন খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মানুষ হিসেবে আবার কেউ কেউ বলেছেন নবম অথবা দশম শতাব্দী।
এই ধর্মের গুরুদের যে তালিকা পাওয়া যায় যেমন — আদিনাথ, মৎসেন্দ্রনাথ, সারদানন্দ, ভৈরবনাথ, চৌরঙ্গীনাথ, মীননাথ, গোরক্ষনাথ, বিরূপাক্ষ, বিলেশয় প্রমুখ — এঁদের কার পরে যে কে এবং কোন সময়ের — তারও কোন ঐক্যমত্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন, অনেকেই বললেন মৎসেন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন গোরক্ষনাথ; আবার অনেকেই জানাচ্ছেন, মৎসেন্দ্রনাথ এবং গোরক্ষনাথের মধ্যে অন্তত ছয়জন শিক্ষাগুরু ছিলেন।
এধরণের বিভিন্নতা ছাড়াও, নাথধর্মের উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে বহু মতামত। যেমন : কেউ লিখেছেন, “নাথপন্থা যে বৌদ্ধ মন্ত্রযান হইতে উদ্ভূত বা প্রভাবিত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই।”
আবার কেউ জানালেন, “নবম,দশম এবং একাদশ খ্রিষ্ট শতাব্দে বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের শাখা বিশেষের সহিত শৈব ধর্মের যোগ ও তন্ত্রাচার মিলিত হইয়া নাথপন্থের সৃষ্টি করিয়া ছিল।”
আর অনেকে বলেন যে, “ব্রাহ্মণ্য-শৈব ও বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত, এর আধুনিক নাম নাথপন্থ।”
একটি গবেষণায় জেনেছিলাম, “নাথপন্থা মূলত আদিম মৈথুন তত্ত্ব ও টোটেম বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত এবং মূলত এটি অনার্য দর্শন।” ইত্যাদি ইত্যাদি।
বঙ্গদেশে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ইতিহাস লিখতে গিয়ে সকল ঐতিহাসিকগণই আক্ষেপ করেছেন প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণের অপ্রতুলতা নিয়ে। আর হবেই বা না কেন? এমন যে নদী-মাতৃক দেশ যার ছোট বড় সব নদ-নদীই ছিল কীর্তিনাশা, যুগ যুগ ধরে এই নদ-নদীগুলোই একদিকে যেমন ধ্বংস ক’রে চলেছিল বঙ্গদেশে গড়ে ওঠা অমূল্য সব কীর্তি-সম্পদ, তেমনি আর একদিকে মধ্যযুগে পর পর আক্রমণ হেনেছিল দু-দুটো শক্তিশালী কট্টর ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ। যারা পুরানো সব সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চিহ্ন ধ্বংস করতে ছিল সচেষ্ট।
বাঙ্গালী সাধক-পণ্ডিতরা তাদের আদি ধর্মীয় পুঁথি-পুস্তক নিয়ে নেপাল, ভূটান, তিব্বত ইত্যাদি এলাকায় পালিয়ে গেলেও, পরবর্তীকালে সে সব ঠিকমত খুঁজে পাওয়া বা মিলিয়ে নেওয়াটা হয়ে গেল প্রায় অসম্ভব। ফলে বিভিন্ন গবেষণায় বিচ্ছিন্নভাবে যে বিভিন্ন সব মতামত উঠে আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
তবুও আমরা এই নাথধর্মের ব্যাপারে বস্তুবাদী মানসিকতায় যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট পথে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। সেই ব্যাপারে আমাদের হাতে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম এবং সেটি হ’ল —- আদিনাথ।
এই আদিনাথ হচ্ছেন নাথধর্মের মতো ভারতবর্ষে যত নিরীশ্বর দেহাত্মবাদী এবং গুরুকেন্দ্রিক ধর্মমত রয়েছে এবং যাঁদের সাধনা নির্ভর করে মূলত হঠযোগ ও কায়সাধনার উপর, দেখা গেছে, তাঁদের প্রত্যেক সম্প্রদায়েরই প্রথম গুরু হচ্ছেন ওই আদিনাথ। এ ব্যাপারে জৈনধর্ম, পাশুপতধর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রণদীপম বসু নাথযোগীদের সাধন-পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের একটি ভাষ্য তুলে ধরেছেন। আমরাও সেটির অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরলাম।
১) হঠযোগ :- “নাথপন্থা অনুযায়ী চরম সত্তার দুটি দিক, যাদের প্রতীক সূর্য ও চন্দ্র। সূর্য হচ্ছেন কালাগ্নি যিনি বিনাশের আদর্শ, যিনি মৃত্যু ও ধ্বংসের পদ্ধতি ধারক। পক্ষান্তরে চন্দ্র হচ্ছেন অপরিবর্তনীয়তার আদর্শ। নাথপন্থার চরম আদর্শ হচ্ছে নিজের মধ্যে অদ্বয়ের উপলব্ধি — যা সম্ভব অমরত্ব অর্জন ও দিব্যদেহের দ্বারা। এই অদ্বয় অবস্থার প্রতীক সাধারণতঃ শিব, যা চন্দ্র ও সূর্যের সংযোগের দ্বারা সম্ভব। দিব্য এবং অপরিবর্তনীয় দেহ অর্জন হঠযোগের এবং রসায়নের দ্বারা সম্ভব। যেখানে চন্দ্র ও সূর্যের মিলন ঘটবে। এই মিলনটা যে প্রতীকী তা বলাই বাহুল্য।”
২) কায়সাধনা :- “কায়সাধনার দ্বারা দিব্যদেহ লাভ করা যায়। চন্দ্র হচ্ছেন সোম বা অমৃতের উৎস — যিনি মানব দেহে অবস্থিত সহস্রার অঞ্চলের (মস্তিষ্ক প্রদেশ) নীচে থাকেন। যে নির্যাস পরিদৃশ্যমান মানব দেহকে টিকিয়ে রাখে তা উৎপন্ন হয় এই সোম বা অমৃত থেকে। একে ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলেই অমরত্ব অর্জন করা যায়। কিন্তু এখানে একটি বিরাট অসুবিধা আছে। দেহের মধ্যে অবস্থিত চন্দ্র বা সোম থেকে ক্ষরিত অমৃত বিন্দু সূর্য শুষে নেন, যে সূর্য বাস করেন মানবদেহের নাভিমূলে। কাজেই এই অমৃতকে সূর্যের হাত থেকে রক্ষা করা দরকার। সেটি একটি উপায়ে করা সম্ভব। দেহের মধ্যে যে আঁকাবাঁকা সর্পাকার নালী আছে, যার দুটি মুখ এবং যা শঙ্খিনী নামেও পরিচিত। এই নালীর মুখটি — যা দিয়ে সোম ক্ষরিত হয়, দশম দ্বার নামেও পরিচিত — এই মুখটি বন্ধ করতে পারলেই কাল বা মৃত্যুরূপী সূর্যের গ্রাস থেকে সোম বা অমৃতকে রক্ষা করা সম্ভব। এর জন্য কায়সাধন দরকার। কোন কোন গ্রন্থে তান্ত্রিক কুলকুন্ডলিনীকে জাগানোর কথাও বলা হয়েছে।” (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)।
ইতিহাস বলে যে, একদা বাংলার নৃপতি বল্লাল সেনের শাসনকালে নাথ ব্রাহ্মণ বা রুদ্রজ ব্রাহ্মণরা, ব্রাহ্মণদের মধ্যে উচ্চ স্থানের অধিকারী ছিলেন। তাঁরা রাজপুরোহিত হিসাবে কাজ করতেন। গোল বাঁধলো বল্লাল সেনের পিতা লক্ষণ সেনের মৃত্যর পরে। তখন রাজপুরোহিত ছিলেন নাথ ব্রাহ্মণ পীতাম্বর নাথ। তিনি বল্লাল সেনের গুরুদেবও ছিলেন। পিতৃ শ্রাদ্ধে রাজা বল্লাল সেন চাইলেন যে তাঁর গুরু ও রাজপুরোহিত পীতাম্বর নাথ তাঁর মৃত পিতার পিন্ড গ্রহণ করুন, রাজার দান হিসাবে। পীতাম্বর নাথ কোনও মৃত ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত কোনও দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। ব্যাস! প্রচন্ড ক্রোধে ও আত্মভিমানে বল্লাল সেন তাঁর উপবিত (পৈতা) টেনে ছিঁড়ে দিলেন ও সমগ্র বঙ্গদেশে প্রচার করলেন যে নাথ ব্রাহ্মণ বা রুদ্রজ ব্রাহ্মণদের রাজার নির্দেশে শুদ্র বলে গণ্য করা হবে। অথচ বঙ্গের বাইরে কিন্তু নাথেরা ব্রাহ্মণ হিসাবেই গণ্য হতেন ও আজও হন।
পরিশেষে নাথ গুরু গোরক্ষনাথ সম্বন্ধে কিছু জানিয়ে রাখা যাক। তবে এই তথ্যগুলো নিয়েও একাধিক মত রয়েছে।
গোরক্ষনাথ ছিলেন নাথ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান গুরু। ঐতিহাসিক ব্যক্তি হয়েও তিনি ভক্তের চোখে প্রথমে ‘কিংবদন্তি পুরুষে’ এবং পরে সাধারণের চোখে একজন ‘দেব পুরুষে’ পরিণত হন। গুরুবাদী নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। তিনি সাত শতকে, মতান্তরে নয় শতকে জন্মগ্রহণ করেন; তাঁর জন্মস্থান ছিল চন্দ্রদ্বীপ। গোরক্ষনাথ তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন; তাঁরই চেষ্টায় নাথ ধর্মমত দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে এবং বঙ্গদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের নানা প্রদেশে, এমনকি নেপাল ও সিকিমে প্রচার লাভ করে। এজন্য গোরক্ষপন্থীরা তাঁকেই নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করে।
অনেকে মনে করেন, গোরক্ষনাথের জন্মভূমি ছিল পূর্ববঙ্গে। তাঁর শিষ্য ছিলেন হাড়িপা ও ময়নামতী; ময়নামতীর পুত্র গোপীচন্দ্র ছিলেন হাড়িপার শিষ্য। মৎস্যেন্দ্রনাথ ও গোরক্ষনাথকে কেন্দ্র করে ‘গোরক্ষ-বিজয়’ এবং হাড়িপা-ময়নামতী-গোপীচন্দ্রকে কেন্দ্র করে ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’ বা ‘গোপীচন্দ্রের গান’ নামে লিখিত ও মৌখিক ধারার একাধিক বাংলা কাব্য পাওয়া যায়। ষোল শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ ‘গোরক্ষ-বিজয়’ নামে প্রথম একখানি কাব্য রচনা করেন। এতে নাথগুরুর মাহাত্ম্য ও নাথ ধর্মমতের মহত্ত্ব প্রকাশ বিধৃত হয়েছে। আদি গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ শিব কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে কদলীর ‘স্ত্রী-রাজ্যে’ নারী সংসর্গে এসে ধর্মকর্ম বিসর্জন দেন। শিষ্য গোরক্ষনাথ যোগ-সাধনাবলে বহু কষ্টে গুরুকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন।
নাথধর্ম ছিল নিষ্কাম কায়া-সাধনার ধর্ম।। গোরক্ষ-বিজয় কাব্যে তাঁর বিজয় অর্থাৎ চারিত্র্যিক মাহাত্ম্যের কথা প্রচার করা হয়েছে। বাংলা কাব্য ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় গোরক্ষ-সংহিতা ও গোরক্ষ-সিদ্ধান্ত নামে দুখানি গ্রন্থ আছে। প্রাচীন ও মধ্য যুগে গোরক্ষনাথ যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, বাংলাদেশের ও ভারতের নানা স্থানে অসংখ্য মঠ ও মন্দিরের অস্তিত্ব থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোরক্ষনাথের মঠ-মন্দির ও পূজারী মোহন্ত-যোগীর অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজশাহীর ‘যোগীর ঘোপা’, বগুড়ার ‘যোগীর ভবন’, রংপুরের ‘গোরক্ষ মন্ডপ’, দিনাজপুরের ‘গোরকুই’ (গোরক্ষকূপ), দমদমের ‘গোরক্ষ বাসুলী’ প্রভৃতি স্থানে গোরক্ষনাথের পূজার প্রচলন ছিল। বাংলাদেশের রাজশাহীর যোগীর ঘোপা (গোফা)-র একটি কক্ষে শিবলিঙ্গ ও ত্রিশূল আছে। শিবের অঙ্গ থেকে গোরক্ষনাথের জন্ম বলে শিবলিঙ্গের মাধ্যমে গোরক্ষপূজা হয়ে থাকে।
যোগীর ধ্যানের স্থানকে ‘গোফা’ বলে। বাংলাদেশের বগুড়ার যোগীর ভবনের চারটি মন্দিরের মধ্যে একটি গোরক্ষনাথের বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের দিনাজপুরের গোরক্ষকূপে এক চূড়াবিশিষ্ট তিনটি মন্দিরের একটি গোরক্ষনাথের মন্দির; এর অন্ধকার কক্ষে শিবলিঙ্গ ও কালীমূর্তি সংরক্ষিত আছে। দমদমের গোরক্ষ বাসুলীর তিনটি মন্দিরের মধ্যে গোরক্ষনাথের মন্দিরে গোরক্ষ কর্তৃক প্রজ্বলিত ধুনি আজও সংরক্ষিত আছে। ধর্মভীরু ভক্তের চোখে ঐতিহাসিক গোরক্ষনাথ এভাবে পৌরাণিক গোরক্ষনাথে পরিণত হয়েছেন।
লোকচেতনায় গোরক্ষনাথের আরও রূপান্তর ঘটেছে। দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের রাজবংশী ও পলিয়া কৃষককুল তাঁকে গো-রক্ষক দেবতারূপে পূজা করে। তিনি গৃহপালিত গবাদিপশুকে সব রকমের রোগ থেকে রক্ষা করে থাকেন। গোরক্ষনাথের প্রতীক একটি কাঠের মূর্তি তেল-সিঁদুর মাখিয়ে গোয়ালঘরে রেখে নানা উপকরণ দিয়ে পূজা করা হয়। এ পূজায় এক কূলা ধান নিবেদন করতে হয়। সাধারণ কৃষক সমাজেও গোরক্ষনাথের পূজার প্রচলন ছিল। পাবনা জেলায় ‘গোরক্ষনাথের ব্রত’ এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে ‘ গোরক্ষনাথের শিরনি’ নামে লোকাচার পালন করা হতো। এ আচার পালনের পদ্ধতি হচ্ছে বাছুর জন্মের ৩০ দিন পর গাভীর দুধ দোহন করে সবটাই গাঢ় করে জ্বাল দেওয়া হয়। তারপর চিনি মিশিয়ে সেই দুধ দিয়ে গরু ও বাছুরের মূর্তি, নাড়ু, স্বস্তিকা প্রভৃতি তৈরি করা হয়। সন্ধ্যার সময় একটি রাখাল বালক কলাপাতায় করে ওই ভোগ গোয়ালঘরের এক কোণে রেখে আসে। বিশ্বাস করা হয় যে, রাতের বেলা গোরক্ষনাথ এসে ওই ভোগ গ্রহণ করেন। গাভীর অধিক দুধ পাওয়ার উদ্দেশ্যেই গোরক্ষনাথের শিরনি আচারটি পালিত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে উঠানের একটি স্থান লেপে পরিষ্কার করে পাড়ার রাখাল ছেলেদের ডেকে এনে পায়েস খাওয়ানো হয়। খাওয়ার পর তারা এঁটো হাতে গাভীর পিঠে কিল দেয়। লোকবিশ্বাস, এতে গাভীর দুধ বৃদ্ধি পায়। এ উপলক্ষে পাঁচালি পরিবেশিত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে গাভীর বাছুর জন্ম নেয়ার একুশ দিন পর এ আচারটি পালিত হয়। এ উপলক্ষে বয়াতী গোয়ালঘরের মাঝ দুয়ারে বসে পাঁচালি বলে। এটি ‘গুক্খের ধারের পাঁচালী’ নামে পরিচিত। বয়াতী গান করে এবং রাখালেরা তার চারদিকে বসে ‘হেচ্ছ’ বলে দোহার ধরে। পাঁচালিতে গাভীর বেশি দুধ পাওয়ার কামনা ব্যক্ত করা হয়। পন্ডিতদের মতে গোরক্ষক হিসেবে গোরক্ষনাথের নাম এলেও তিনি নাথ সম্প্রদায়ের আদি গুরু গোরক্ষনাথ নন, লৌকিক দেবতা। প্রচ্ছন্ন ‘বৌদ্ধ দেবতা’ বলেও তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়। গোবৎসের রক্ষক হিসেবে বৌদ্ধরা তাঁর পূজা করে থাকে।
(তথ্যসূত্র: নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও সাধনপ্রণালী: শ্রীমতী কল্যাণী মল্লিক।)
21 মন্তব্যসমূহ
যেখানে পুরানে নাথদের কথা উল্লেখ আছে, সেখানে বৌদ্ধদেরসাথে কিভাবে তুলনা করেছেন??
আর এই লেখাটিতে নাথদের হিন্দু হিসেবে কোথাও উল্লেখ করেননি। তাহলে উনি নাথদের নিয়ে কি চিন্তা করেন তার কোন সুস্পষ্ট মত নেই। কেন??
আর নাথ পন্থা বৌদ্ধ ধর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হতেই পরে।কারণ তৎকালীন ভারতের বহু পন্থা যেমন আদি শঙ্করাচার্যের পন্থা ও বৌদ্ধ ধর্ম থেকে অনুপ্রাণিত ছিল।
গবেষণা হয়নি মনে করা গেল। গবেষণা করার জন্য তথ্য
ভিত্তিক পর্যাপ্ত সমল খোঁজে না পেতেও পারেন।যাটুকু পেয়েছেন
তাকে নিয়ে লিখেছেন। উৎকৃষ্ট সামাজিক ইতিহাস
থাকলে বিস্তারিত ভাবে প্রচার করলে কাহারো আপত্তি
থাকবে না নিশ্চয়।
আমি আপনার উৎপত্তি আগামী তে তুলে ধরবো তখন বুঝবেন আপনার জন্ম কিভাবে।।
মা বা তার চরিত্র ঠিক রাখা যায়, সে বিষয়ে লিখলে আরো ভালো হবে আর কি। প্রয়োজনে উনি আমাদের সাহায্যও নিতে পারেন। বিষয়টা আসলে রান্নাবান্না না, অত সস্তা না!
কল্যাণী মল্লিকের কাছে আমার কিছু জিজ্ঞেসা
শিব কে উনি কি হিন্দুদের দেবতা নাকি নাথ সম্প্রদায়ের এটা পরিষ্কার করার প্রয়োজন ছিলো।
রৌদ্রর্য ব্রাম্মনরা যদি পুরোহিত কর্ম করে নিরীশ্বর কিভাবে হলো?উনার লেখায় অসংলগ্ন এবং স্ববিরোধীতা পাওয়া যায়।এই পন্ডিতদের জন্যই আজ সনাতনীরা বিভক্ত।
আর এখানে ঐতিহাসিক যে নাথ সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে তারা আসলে নাথ বংশ বা দেবনাথ নয় মানে শিব গোত্রের কেউ নয়। বা কেউ কেউ হয়তোবা থাকতে পারে। যেমন যেসব দশক আর শতকের কথা বলা হয়েছে তখন কিছু সম্প্রদায়ের মানুষের নামের সাথে নাথ যুক্ত থাকতো। এরা নিজেদের মতোকরে ধরম পালন করতো। এরা বেশিরভাগই অন্য গোত্র থেকে আসা লোকজন ছিলো। বিশেষ করে কাপালিক বা তান্ত্রিক ব্যক্তিরা যারা কিনা বিভিন্ন গোত্র বা সম্প্রদায় থেকে এসে নামের শেষে নাথ শব্দটি ব্যবহার করতো। তো তাদের সাথে আর শৈব বা শিব গোত্রের দেবনাথ, নাথ, দেবশর্মা এরা এক না। সম্প্রদায় আর গোত্র এক না। লেখক বা লেখিকা এখানে যাদের কথা বলেছেন তারা ছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নামের শেষে নাথ বা পা যেমন হাড়িপা যুক্তকারী লেখক সাধক বা জ্ঞানীব্যক্তিগন। চরযাপদ এর লেখক গন বা তার আগের নাথগন সাধারনত সনাতনী ব্যক্তিবর্গ। যারা নিজেদের অঞ্চল কর্ম সম্প্রদায়কে অন্যদের থেকে আলাদা করতে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে নিজেদের সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখতো। কিন্তু ভগবান শিবের বংশধর বা গোত্ররা কখনোই ব্রহ্মা বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণ কালি বা স্রষ্টা নেই এরকম চিন্তা ধারা লালন ধারন পোষন করেনি করেনা করবেও না। হতে পারে কেউ একটু বেশিই মহাদেবের ভক্ত যেমন চাঁদ সদাগর এমন কোন রাজা বা যোগী একমাত্র মহাদেবকেই ভগবান বা স্রষ্টা মনে করে থাকেন। আসলে দেবনাথ বংশীয় মানুষরা একটু বেশিই উচিৎ বক্তা এবং স্বেচ্ছাচারী বা কিছুটা বৈরাগ্য ভাবধারার হয়ে থাকে। এজন্য এদেরকে অনেকেই বেশি পছন্দ বা বেশি অপছন্দ করে থাকে।
পরিশেষে বলতে চাই মহাদেব ভোলানাথ পরমেশ্বরের পরমাত্মা থেকে যাদের গোত্রধারার সূচনা তাদের সম্বন্ধে লোকগাথার কাহিনীর সাথে জুড়ে দেয়া আর চর্যাযাপদের সমসাময়িক কিছু ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে বানানো রূপকথা কখোনও সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি যুগের আদিনাথ মহাদেবের শিবগোত্রের শৈব বা দেবনাথরা নয়।