তিতুমীর (ছবি সৌজন্যেঃ উইকিপিডিয়া ) |
তিতুমীর পরিচালিত 'ওয়াহাবী বিদ্রোহ' বঙ্গদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে
একটি বিশিষ্ট ঘটনা। প্রাচীনপন্থী ঐতিহাসিকদের অনেকেই এই বিদ্রোহকে 'হিন্দু
বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা' বলে আখ্যা দেন। "উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম
ভাগে নদীয়ার রাজনৈতিক গগনে একটি অশুভকর জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব হয়; সেটি
তিতুমীর নামে খ্যাত জনৈক ধর্ম্মোন্মত্ত বলদৃপ্ত মুসলনান। বলদৃপ্ত তিতু
তাহার মূর্খ অনুচরগণের সাহায্য কেবল যে নদীয়া, যশোহর, ২৪ পরগণার জমিদারগণ ও
নিঃসহায় প্রজাকুলের উপর অত্যাচার করিয়াছিল, তাহা নহে, সে তার প্রায়
নিরস্ত্র, নিরক্ষর সঙ্গীদের সাহসের ও আপনার অদ্ভুত শক্তির উপর অন্ধ বিশ্বাস
স্থাপন করিয়া পরাক্রান্ত ব্রিটিশ রাজের বিপক্ষেও দন্ডায়মান হইতে পশ্চাদপদ
হয় নাই।" (পৃষ্ঠা ৭১, নদীয়া কাহিনী, কুমুদনাথ মল্লিক, সাহিত্য সভা)
এমনকি বিখ্যাত প্রথমযুগের কম্যুনিস্ট নেতা ভুপেন দত্তও তিতুমীরের আন্দোলন
নিয়ে যথেষ্ট কনফিউজড বক্তব্য রেখেছেন। "আজকাল কেহ কেহ তিতুমিঞার ওয়াহাবী
আন্দোলনকে একটি বৈপ্লবিক আন্দোলন বলিয়া গণ্য করেন। চব্বিশ পরগণার বারাসত
নামক স্থানে ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে সৈয়দ আহম্মদ এবং তাহার শিষ্য মীর নিসের বা
তিতুমিঞার অধীনে ফারাজীদের এই উত্থান হয়। (Thornton-এর ইতিহাস দ্রষ্টব্য)
১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ফরিদপুরের দীদু মীরের অধিনায়কত্বে ফারাজীরা আন্দোলন
করেন। ইহা ইংরেজদের বিপক্ষে আন্দোলন বটে। কিন্তু জাতীয় স্বাধীনতাকল্পে এই
আন্দোলন সৃষ্ট হয় নাই। ইহা স্থানীয় হিন্দুদের বিপক্ষে গিয়াছিল। অনুমান ১৮৯৮
খ্রীষ্টাব্দে পুরাতন 'বঙ্গবাসী' পত্রিকাতে এই বিষয়ে ধারাবাহিক প্রবন্ধ
বাহির হইয়াছিল। তাহাতে স্থানীয় মুসলমানদের কবিতাদি এবং ঘটনা দ্বারা ইহা
প্রমাণিত হয় যে, এই আন্দোলন ইংরেজদের বিপক্ষে গিয়াছিল বটে, কিন্তু প্রধানতঃ
direct action এর চোট পড়িয়াছিল হিন্দুর উপরে।" (পৃষ্ঠা ৮৯, ভারতের
দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত, নবভারত পাবলিশার্স)
কিন্তু পরবর্তীকালের তথ্যানুসন্ধানী ঐতিহাসিকরা তিতুমীর তথা ওয়াহাবী
বিদ্রোহ প্রসঙ্গে সম্পুর্ণ ভিন্নমত পোষন করেন। ইংরেজ ঐতিহাসিক থর্নটন তাঁর
'হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া' গ্রন্থে বলেছেন, তিতুমীরের শান্তিপূর্ণ ধর্মসংস্কার
আন্দোলনকে অহেতুক ভীতির চোখে দেখে এবং একে কর আদায়ের অজুহাতরূপে ব্যবহার
করে জমিদারগণ মুসলমান কৃষকদের উপর যে উৎপীড়ন আরম্ভ করেন তাই হল বিদ্রোহের
মুল কারণ। এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় প্রাচীনপন্থী ঐতিহাসিক
বিহারীলালের বইতেও। "কৃষ্ণদেব (জমিদার কৃষ্ণদেব রায়) হুকুম দিলেন, তাঁহার
জমিদারীর মধ্যে যাহারা ওয়াহাবী মতাবলম্বী তাহাদিগের প্রত্যেককে দাড়ির উপর
আড়াই টাকা করিয়া খাজনা দিতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ১৯, তিতুমীর বা নারকেলবেড়িয়ার
লড়াই, বিহারীলাল সরকার, পুস্তক বিপণি)
পরম ইংরেজভক্ত বিহারীলাল হলেন
তিতুমীরের একমাত্র বাঙালী জীবনীকার। তাঁর ইংরেজভক্তির একটি নমুনা এইরূপ, "এ
ভারতে ইংরেজের রাজত্বে ইংরেজের করুণার মর্ম্ম, ইংরেজের বাৎসল্যের ভাব, কে
না বুঝে? ইংরেজের রাজত্বে সুখাামৃতের নিত্য সুখাস্বাদ কে না করে?"
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৯) বিহারীলাল তাই স্বভাবতই বুঝতে সক্ষম হন নি যে "এই
বারাসত বিদ্রোহের বহিরাকৃতি ধর্মীয় হইলেও জমিদারগোষ্ঠী ও নীলকুঠির শোষণ
উৎপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষক সংগ্রামই ইহার প্রধান বিষয়বস্তু।" (পৃষ্ঠা ২৬২,
ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সুপ্রকাশ রায়, ডিএনবিএ
ব্রাদার্স) তাই তিনিও জমিদারগোষ্ঠীর শোষণ উৎপীড়নের কথা স্বীকার করেও এই
বিদ্রোহের মুল প্রকৃতি হিন্দু বিরোধী বলে রায় দিয়েছেন।
একথা
অনস্বীকার্য যে এই বিদ্রোহ ইংরেজ, জমিদার, নীলকর, মহাজন ইত্যাদি সাধারণ
শত্রুর বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও বিদ্রোহের নায়কগণ সমসাময়িক কালের বৈশিষ্ট্য
অনুযায়ী তা ধর্মের ধ্বনি তুলে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি
করেছিল। এর মূল কারণ বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক চেতনার অভাব। "কিন্তু ইহাও পূর্ণ
সত্য যে পরাধীন ভারতে তিতুমীর প্রভৃতি ওয়াহাবী বিদ্রোহের নায়কগণ সর্বপ্রথম
সচেতনভাবে ইংরেজশক্তির উচ্ছেদ করিয়া ভারতের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ধ্বনি
তুলিয়াছিলেন এবং সেই ধ্বনিকে কার্যকরী রূপ প্রদানের জন্য নির্ভয়ে জীবন
আহুতি দিয়াছিলেন।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮২) ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে বিদ্রোহী
নায়কদের বিচারকালে বিদ্রোহী পক্ষের ব্যারিস্টার এনেস্টি সাহেবের বক্তৃতায় চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছিল যে, "ওয়াহাবী বিদ্রোহ কৃষকদের স্বাধীনতা
সংগ্রাম ব্যতীত অন্য কিছু নহে।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২২০)
উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালী মুসলিম সমাজে নবজাগরণের ধারা সম্বন্ধে আলোচনা করতে
গিয়ে ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে বলেছেন, "ফরাজী-ওয়াহাবী আন্দোলন গ্রাম বাংলার
মুসলমানদের এক নুতন চিন্তায় উদ্দীপিত করে। ফরাজী-ওয়াহাবী তত্ত্বেই জমির উপর
কৃষকের মালিকানা স্বত্বের প্রশ্নটি মূর্ত হয়ে ওঠে।" (পৃষ্ঠা ১৫, সমাজ ও
সংস্কৃতি, অমলেন্দু দে, রত্না প্রকাশনী) পরবর্তীকালে বিপ্লবী নায়কদের
১৮৩০-৭০ খ্রীষ্টাব্দের 'ওয়াহাবী বিদ্রোহ' যে প্রেরণা যুগিয়েছিল এবং
জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল তা স্বীকার করেছিলেন বিপিনচন্দ্র পালের
মতো নেতা। "ওয়াহাবী নেতা আমীর খাঁকে সরকার ১৮১৮, তিন আইন অনুসারে ১৮৭১ সালে
যাবজ্জীবন নির্ব্বাসিত করলেন। তাঁর প্রকাশ্যে বিচারের জন্য কলকাতা
হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জন পেন্টন নরম্যানের এজলাসে আবেদন করা হল। এ
উদ্দেশ্যে ওয়াহাবীরা বোম্বাই হাইকোর্ট থেকে প্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার মিঃ
এনেস্টিকে এনেছিলেন। তিনি ছলজবাবে লর্ড মেয়োর শাসনকালের (১৭৬৮-৭২)
অনাচার-অবিচারের কথা বিশদভাবে
উল্লেখ করেন। এনেস্টির এই বক্তৃতা সমেত মোকদ্দমার বিবরণ ওয়াহাবীরা
পুস্তকাকারে ছেপে চারিদিকে বিলি করলে। বিপিনচন্দ্র পাল বলেন, যৌবনে এই
পুস্তিকাখানি পাঠ করে তাঁরা যেন একেবারে মেতে উঠেছিলেন।" (পৃষ্ঠা ৯৯,
মুক্তির সন্ধানে ভারত, যোগেশচন্দ্র বাগল, অশোক পুস্তকালয়)
এর কিছু
পরে, ১৮৭১ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর, টাউন হলের সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়ে প্রধান
বিচারপতি নরম্যান আবদুল্লা নামে এক আততায়ীর ছোরার আঘাতে নিহত হন। ইউরোপীয়
সমাজ এজন্যে এতদুর ক্ষিপ্ত হয়েছিল যে তারা আবদুল্লার ফাঁসি হওয়ার পর তার
মৃতদেহ কবর না দিয়ে সৎকার করে ফেলে। এর অব্যবহিত পরেই ১৮৭২ সালের ৮ই
ফেব্রুয়ারী আন্দামান ভ্রমণকালে শের আলী নামক এক কয়েদীর হাতে বড়লাট লর্ড
মেয়োকেও প্রাণ দিতে হয়। এই দুটি হত্যাকান্ডের দ্বারা ওয়াহাবীরা তাঁদের
প্রতিশোধ নিয়েছিলেন বলেই ঐতিহাসিকদের ধারণা।
0 মন্তব্যসমূহ