অনেকে অভিযোগ করেন, নাস্তিকেরা নাকি আসলে খুব গোঁড়া, কারণ তাঁরা মনে করেন --- “ধর্ম না থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে”, এবং, “ধার্মিক মাত্রই মানবতার শত্রু”।
চলুন, ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা প্র্যাকটিস করি।
আচ্ছা, এমনটা কি কোনও চিন্তাশীল নাস্তিককে কেউ বলতে শুনেছেন কখনও? বগলে ফোঁড়া হলে কোন নাস্তিক ধর্মকে দোষারোপ করে, কে-ই বা তার পাশের বাড়ির আস্তিকটিকে এর পেছনে ষড়যন্ত্রকারী বলে ঠাওরায়? আস্তিকরাই তো সমাজে সংখ্যাগুরু, এবং আমাদের মত দেশে ভীষণভাবে সংখ্যাগুরু, কাজেই নাস্তিকেরা সব সময়েই তাদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে চলতে বাধ্য, এবং চলেনও ঠিক তাইই। যদি কোনও নাস্তিক চান যে তিনি অসুস্থ হলে শুধু নাস্তিকেরাই তাঁর সেবা করবে, সে এক অবাস্তব ব্যাপার, তাঁকে তো পরিবার-প্রতিবেশ-কর্মক্ষেত্র ও হাসপাতালে তাঁকে ঘিরে থাকা লোকেদের সাহায্যই নিতে হবে, অত নাস্তিকের সরবরাহ পাবেন কোথায় তিনি?
আর, ‘এই রে, স্বধর্মী নেই, অতএব ঘেন্নাপিত্তি চেপে রেখে ব্যাটা বিধর্মীদের সাথেই কারবার করতে হবে’ --- এ মানসিকতা বোধহয় শুধু ধার্মিকদের জন্যই সংরক্ষিত, এভাবে মনের মধ্যে গোষ্ঠী-ঘৃণা পুষে রাখার ক্ষমতা নাস্তিকের করায়ত্ত নয়।
বরং, আমি উল্টোদিক থেকে প্রশ্নটাকে আক্রমণ করতে চাইব। আচ্ছা, ‘ধর্ম না থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে’ কিনা, এমন প্রশ্ন নাস্তিককে আপনি আদৌ করবেন কেন বলুন তো? এ প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, এটা হাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে বৌদ্ধিক অনুশীলন মাত্র নয়, বাস্তবে নাস্তিককে এ প্রশ্নের সম্মুখীন প্রায়শই হতে হয়। অথচ, প্রশ্নটি কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক নয়। একটু খুঁটিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যাবে, এ প্রশ্নটি করা হয় যুক্তিশাস্ত্রের বিধি সূক্ষ্মভাবে ভঙ্গ করে, এমন কি, হয়ত বা, তা ভঙ্গ করবার জন্যই। যে চাষী খরা নিয়ে চিন্তিত, তাকে কি কেউ জিজ্ঞেস করেন, খরা না থাকলে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কিনা? যে লোকটি বাজারে চাল-ডাল কিনতে গিয়ে দামের কারণে চিন্তাগ্রস্ত, তাকে এই প্রশ্ন করলে কেমন হয় যে, মূল্যবৃদ্ধি না থাকলে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কিনা? যে লোকটি দেশের শিক্ষাদীক্ষা, কবিতাচর্চা বা ফুটবল খেলার মানের অবনতি নিয়ে উত্তেজিত, তাকে এইটা জিজ্ঞাসা করাটা কি এক অবাক কাণ্ড হবে না যে, মানের অবনতি না থাকলে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কিনা? দুর্নীতি, গুণ্ডাবাজি বা পরমাণু বোমার বিরুদ্ধে যে প্রচার করছে, তাকে যদি কেউ গিয়ে আজ শুধোয়, এগুলো না থাকলেই পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কিনা, সে কি প্রশ্নকর্তাকে উন্মাদ ভাববে না?
কাজেই, বোঝা যায়, এ প্রশ্ন স্বাভাবিক নয়। এ প্রশ্নটি অনেকটা, ‘মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব (কিম্বা জীবনানন্দের কবিতা) দিয়ে কী হবে, ও দিয়ে কি আর বগলের ফোঁড়া সারে’ গোছের।
কিন্তু তাহলে, এ রকম প্রশ্ন করা হয় কেন, আর, এখানে যুক্তিশাস্ত্রের নিয়মটাই বা ঠিক কোথায় ভাঙা হচ্ছে? দ্বিতীয় কৌতূহলটা আগে মেটানো যাক। কেউ যদি দাবি করে থাকেন যে তিনি নাস্তিক, তো তার মানে তিনি আসলে দাবি করছেন যে, তিনি একটি গূঢ় সত্যি উপলব্ধি করেছেন --- এ দুনিয়াটা কোনও অলৌকিক শক্তিমান ব্যক্তি ওপর থেকে ভেবে ভেবে চালায় না, এ বস্তুটি চলে তার নিজস্ব কতকগুলো অন্ধ অচেতন স্বয়ংক্রিয় নিয়মে। উপলব্ধির সত্য-মিথ্যা নিয়ে আস্তিক তাঁর সাথে তর্ক করতেই পারেন, কিন্তু, 'এ দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হবে কিনা', এ প্রশ্নের যৌক্তিক কাঠামোটা ‘মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব দিয়ে আমার বগলের ফোঁড়া সারবে কিনা’ আকারের। প্রশ্নটি অযৌক্তিক, কারণ, এখানে কোনও তত্ত্বকে খণ্ডন করা হচ্ছে সে তত্ত্বের কোনও এক অপ্রাসঙ্গিক অক্ষমতার দিকে আঙুল তুলে। যুক্তিশাস্ত্রে এ ধরনের তর্ককে বলে ‘ফ্যালাসি’ বা কুযুক্তি, এবং এই বিশেষ ধরনের কুযুক্তির ল্যাটিন নাম হল ‘ignoratio elenchi'।
এ রকম যুক্তিবিরোধী প্রশ্ন করা হয় কেন? খুব সোজা। বুঝে বা না বুঝে সত্যকে চাপা দেবার জন্য।
এর পরও অবশ্য কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। আচ্ছা, নাস্তিক হয়ে জগতের কোন উপকারটা হয় মশায়, তা না হলেই বা কী আসে যায়? আমার ধারণা, আসে যায় অনেক কিছুই, এমন কি, হয়ত প্রায় সব কিছুই। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ অকারণ প্রাণবলি থেকে বাঁচে, জ্ঞান মুক্ত হয়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণার ঘাড় থেকে জোয়ালটা নেমে যায়, মানুষ সংকীর্ণ গণ্ডী ভেঙে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আর কী চাই বলুন তো?
কিন্তু, আমি আজ এইসব অজুহাত দিতে চাই না, শুধু একটা পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই। নাস্তিকতার একটা ‘উপযোগিতা’ আদৌ থাকতে হবে কেন মশায়, নাস্তিকতা একটা স্ক্রু-ড্রাইভার না মুরগির ডিম?
জগত সম্পর্কে একটা গুরুতর সত্যের উপলব্ধিই কি একটা মস্ত পাওয়া নয়? আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, সত্য কি তার নিজের গুণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়?
সত্যকে, নিছক সত্য হিসেবেই, আমরা কবে মর্যাদা দিতে শিখব?
0 মন্তব্যসমূহ