প্রাচীন গ্রীসের বৈজ্ঞানিক চর্চা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার বলেছেন যে, "গ্রীস সম্বন্ধে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এই বলিয়া গর্ব করিয়া থাকেন যে যে যুক্তিমুলক মনোবৃত্তি (rational attitude of mind) হইতে বিজ্ঞানের উৎপত্তি তাহা গ্রীসই জগতকে দান করিয়াছে এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের আবিষ্কার অপেক্ষা ইহার মুল্য অনেক অধিক। ইহার সহিত ভারতে প্রচলিত সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের উপর নির্ভরতা, অলৌকিক কাহিনী ও যুক্তিহীন ধর্মমতের প্রভাব, উদ্ভট কল্পনা দ্বারা প্রাকৃতিক স্বরূপ নির্ণয় প্রভৃতির তুলনা করিয়া ইউরোপীয়ানগণ বৈজ্ঞানিক জগতে গ্রীসের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্ব সহজেই প্রতিপন্ন করেন।" (পৃষ্ঠা ২, প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চা, রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়)
প্রাচীন গ্রীসের বিজ্ঞানদর্শন সম্বন্ধে প্রায় একই ধারণা পোষণ করেন আইরিশ বিজ্ঞান-ঐতিহাসিক বার্নাল সাহেব। তাঁর মতে "গ্রিক চিন্তা ও সক্রিয়তার অনন্য চরিত্রটি গ্রীক জীবনধারার একটি বিশেষ দিকের সঙ্গে সংস্লিষ্ট। এটি হল আমাদের পুর্বকথিত সেই বৈজ্ঞানিক মার্গ। (পৃষ্ঠা ১১৮, ইতিহাসে বিজ্ঞান, জে ডি বার্নাল, নবপত্র প্রকাশন) তিনি আরও বলেন, "গ্রীক দর্শন আর গ্রীক বিজ্ঞানের (এ দুটিকে সেকালে আলাদা করে দেখা হত না) ইতিহাস সেই যুক্তিধারারই আনুপুর্বিক ইতিহাস। পূর্বপক্ষ আর উত্তরপক্ষের মধ্যে চাপানউতোরের ভিতর দিয়ে তাদের বিতর্ক অগ্রসর হত। এই বিশেষ বিতর্ক পদ্ধতিকে গ্রীকরা বলত ডায়লেকটিক।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২০)
গ্রীসের বিজ্ঞান দর্শনের উৎকর্ষতা সম্পর্কে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মত প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞান ঐতিহাসিক সমরেন্দ্রনাথ সেন। "গ্রীক বিজ্ঞানের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রকৃতির রহস্যপূর্ণ ব্যবহার ও তাহার নিয়মের স্বরূপ বুঝিবার একটি সুস্পষ্ট ও সচেতন প্রয়াস আমরা ইহার মধ্যে দেখিতে পাই। প্রকৃতির ব্যবহার সম্বন্ধে কতকগুলি বিক্ষিপ্ত ও অসংলগ্ন তথ্য আবিষ্কারই যে যথেষ্ট নহে, এই ব্যবহারের পশ্চাতে যে নিয়ম ও শৃংখলা নেপথ্যে ক্রিয়াশীল এবং তাহার রহস্যভেদই যে বৈজ্ঞানিক সাধনার চরম লক্ষ্য - বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই আদর্শ গ্রীকরাই প্রথম প্রচার করে।" (পৃষ্ঠা ১৩১, বিজ্ঞানের ইতিহাস প্রথম খণ্ড, সমরেন্দ্রনাথ সেন, ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স)
ভারতবর্ষ ও গ্রীস দুই প্রাচীন সভ্যতার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্রের পার্থক্য থাকলেও সাধারণ জনগণের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের ক্ষেত্রে কিন্তু দুই সভ্যতাই একে অপরের পরিপূরক। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেদিন থেকে বস্তুবাদী দর্শন ও জ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে তখন থেকেই ধর্মীয় সম্প্রদায় পরিচালিত শাসকশ্রেণী শুরু করেছে বিজ্ঞানীদের উপর নিপীড়ন। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ভারতবর্ষে লোকায়ত দর্শনের প্রচারক চার্বাকদের পুড়িয়ে মারার কথা পুরাণ ও ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য মেলে। তাঁদের সম্বন্ধে অাতঙ্কজনক গল্প প্রচার করে, কুৎসা রটিয়ে, সমাজে একঘরে করে, পুঁথিপত্র পুড়িয়ে ধর্মোম্মাদরা চার্বাকদের বিনাশ করেছিল। একইভাবে খ্রীষ্ট জন্মের পাঁচশো বছর পূর্বে যে সমস্ত গ্রীক দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বস্তুনির্ভর মতবাদের প্রসার লাভে অগ্রণী ভুমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদেরও নির্যাতিত হতে হয়েছিল। এইরকমই একজন হলেন অ্যানাক্সাগোরাস।
প্রাচীন গ্রীসের আয়োনীয় দার্শনিকদের মধ্যে শেষতম অ্যানাক্সাগোরাস সম্বন্ধে বলা হয়, "একজন বিদ্রোহী মানবদরদী প্রমিথিউসের অনুগামী।" (পৃষ্ঠা ১৫, প্রমিথিউসের পথে, উৎস মানুষ সংকলন) এই গ্রন্থে অ্যানাক্সাগোরাস সম্পর্কে তরুণ বসুর একটি প্রবন্ধ আছে। তা থেকে জানতে পারি যে, আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ সনে আনাক্সাগোরাস জন্মেছিলেন এশিয়ার মাইনরের স্মার্ণার কাছাকাছি ক্লাজমেনে। তার শৈশব বা কৈশোর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ৪৬২-তে গ্রিক দেশের শাসনকর্তা পেরিক্লিস আনাস্কাগোরাসকে এথেন্স নিয়ে আসেন। সে-কালে উপদেষ্টা হিসাবে একজন বিখ্যাত দার্শনিককে নিয়োগ করতে পারলে সরকারের মর্যাদা ও স্থিতিশীলতা বাড়ত। যেমন পেরিক্লিস দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাসের সাহচর্যের সুবিধা লাভ করেছিলেন। পেরিক্লিস ছিলেন প্রকৃতই জ্ঞানপিপাসু এবং আনাক্সাগোরাসের বন্ধু ও শিষ্য।
এই সময় গ্রিসের এথেন্স নগরী ছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এথেন্সে এসে আনাক্সাগোরাস কাজ শুরু করেন অধ্যাপনা দিয়ে এবং প্রায় ৩০ বছর (৪৬২-৪৩৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) তিনি এখানে অধ্যাপনা করেন। জ্যোতির্বিদ্যা ও অঙ্ক-শাস্ত্রে আনাক্সাগোরাসের ছিল গভীর জ্ঞান এবং অধ্যাপনার সাথে তিনি গাণিতিক জ্যোতিষ সম্পর্কেও গবেষণাও শুরু করেন। "কেহ তাঁহাকে একবার প্রশ্ন করিয়াছিল, মানুষ্য জন্মের উদ্দেশ্য কি? তিনি উত্তর দেন, চন্দ্র, সূর্য ও আকাশ সম্বন্ধে গবেষণা করাই ইহার উদ্দেশ্য।" (পৃষ্ঠা ১৫১, বিজ্ঞানের ইতিহাস ১ম)
খালি চোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত গবেষণায় আনাক্সাগোরাস বেশ কয়েকটি মূল্যবান, বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন। মুলত চন্দ্রগ্রহণের কারন আবিস্কার করবার জন্যেই তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। চন্দ্র সম্পর্কিত গবেষণায় তিনি বলেছিলেন, চন্দ্র বা সূর্য কোন স্বর্গীয় বস্তু নয়। চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলো নেই। শুধু চন্দ্র সম্পর্কিত সিদ্ধান্তই নয়, আনাক্সাগোরাস ছায়াপথ এবং ব্রহ্মণ্ড সম্পর্কে কতগুলি সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন। ছায়াপথ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, রাত্রিকালে সূর্য পৃথিবীর অপরদিকে আত্মগোপন করলে নক্ষত্রখচিত আকাশে পৃথিবীর যে-ছায়া পড়ে তাই-ই ছায়াপথ। পৃথিবী সম্পর্কে তিনি বললেন, এই পৃথিবী কোন স্বর্গীয় দেবতার সৃষ্টি নয়। আদি অবস্থায় পৃথিবী ছিল এক জড় পদার্থ। অ্যানাক্সাগোরাসের এই গবেষণা ছিল মুলত অগ্নিকেন্দ্রীক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় অগ্নিকে কেন্দ্র করে সূর্য চন্দ্র নক্ষত্রাদি ঘোরে। এখন অ্যানাক্সাগোরাসের তত্ত্বগুলি অসম্পূর্ণ ও কিছুটা ভুলও মনে হয় বটে, কিন্তু আড়াই হাজার বছর আগে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ছিল বিশাল বৈপ্লবিক কাজ।
সে-সময়ে এথেন্সের জনসাধারণ ছিল গোঁড়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন। পুরনো বিশ্বাসকে তারা আঁকড়ে ধরে থাকতো প্রাণপণে। নতুন যুক্তিবাদী ভাবনাকে সহজে গ্রহণ করা তাদের সম্ভব ছিল না প্রচলিত ধর্মের অলীক ভয়ে। এইসব সিদ্ধান্তে এবং পরীক্ষালব্ধ মতামতগুলি এথেন্সের তথাকথিত গোঁড়া ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তীব্রভাবে ক্ষেপীয়ে তুলেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, তিনি ঈশ্বরের মহিমাকে সরাসরি অস্বীকার করে পৃথিবীর ব্যাখ্যা করেছেন। বার্নাল বলেছেন, "দার্শনিকপ্রবর একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে তিনি এতদুর অগ্রাহ্য করেন যে শেষ পর্যন্ত তাঁকে সরিয়ে দিতে হয়।" (পৃষ্ঠা ১২৬, ইতিহাসে বিজ্ঞান) কুসংস্কারাপন্ন এথেন্সবাসী ও ধর্মীয় সম্প্রদায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিল যে, অ্যানাক্সাগোরাস ঈশ্বর বিদ্বেষী তথা মানুষের শক্র এবং তাঁর মতবাদ সম্পূর্ণ ভুল। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসে আনাক্সাগোরাসের এই মতবাদ ছিল এক যুগান্তকারী মতবাদ। "জ্ঞানের সীমাকে, মানব সভ্যতাকে, উন্নত করতে চাওয়ার অপরাধে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।" (পৃষ্ঠা ১৭, প্রমিথিউসের পথে) এথেন্সের গণপরিষদে এই মর্মে এক প্রস্তাব উপস্থিত করা হল যে যারা প্রচলিত ধর্মমত ও সংস্কার না মানবে অথবা আকাশের গ্রহ উপগ্রহ সম্বন্ধে কোনো মত প্রচার করবে তাদের বিরুদ্ধে গণপরিষদে অভিযোগ করা হবে। "প্রাচীন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ গণতন্ত্র শাসিত নগরী এথেন্সের গণপরিষদ বিচার করে অ্যানাক্সাগোরাসের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন। (পৃষ্ঠা ৪, প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চা) শেষ পর্যন্ত পেরিক্লিসের প্রভাবের জন্যে সে-যাত্রা তিনি বেঁচে যান। কিন্তু পরবর্তীকালে পোলেনেশীয় যুদ্ধের ফলে পেরিক্লিসের প্রভাব কমে যায় এবং সুযোগে আনাক্সাগোরাসকে নিষ্ঠুরভাবে বিতাড়িত করা হয় এথেন্স থেকে। এই নির্যাতন সহ্য করা তাঁর পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না, বাধ্য হয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল এশিয়া মাইনরে এবং সেখানকার ল্যাম্নাকাস নামে এক জায়গা তার মৃত্যু হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৪২৮ সনে।
শেষ করবো তরুণবাবুর একটি অনবদ্য মন্তব্য দিয়ে, "প্রমিথিউস যদি পূরাণ কথার নায়ক হন তবে পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিরুদ্ধ মতবাদ পোষণ এবং প্রচারের অপরাধে নির্যাতিত প্রথম প্রমিথিউসের পথগামী হলেন অ্যানাক্সাগোরাস।"
0 মন্তব্যসমূহ