আজকের ভাবনাচিন্তা ।। সুমিত্রা পদ্মনাভন


বছর পাঁচেক আগে এক ফরাসী সাংবাদিক যুক্তিবাদ / নাস্তিকতা এসব নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানাবে বলে কলকাতায় এসেছিল। ছোকরার প্রথম প্রশ্ন ছিল "What are the dangers of Atheism in India?" ভারতে নাস্তিকতা (প্রচার বা প্রসার) কতটা বিপজ্জনক?

তাকে চার্বাক টার্বাক বা মুক্তচিন্তা এসব বোঝাতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম ও নিজেই একটু মিস্টিক ধরনের। ব্যাপারটাকে কাব্যিকভাবে প্রেজেন্ট করতে চায়। আলোচনা খুব একটা জমেনি। চা-পাকোড়া, ফিশ ফিঙ্গার দিয়ে শেষ হল গল্প। ওর কাজটা হয়েছিল কিনা জানিনা।

কিন্তু আমার ভাবনাচিন্তা শুরু হল সেখান থেকে। আলোচনা করলাম মুক্তমনা কিছু বন্ধুদের সঙ্গে। ভেবে দেখলাম মুক্ত চিন্তা কি সত্যিই প্রচার করা যায়? নাস্তিকতাও তো ঠিক প্রচারের বস্তু নয়, বরং জীবনচর্যার ব্যাপার। আমাদের পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তো কেউ এসব নিয়ে আলোচনাও করে না। মাথাই ঘামায় না। দিব্যি আছে। কারুর বাড়িতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান-টান হলে নমো নমো করে একটু যোগ দেয় হয়তো। এদের দিনের মধ্যে আশি শতাংশ কাটে বাড়ির বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, বা আড্ডায়। সেখানে ধর্মের বা জাতের বা বাপের পরিচয়ের কোনো সীন নেই। অন্য কিছু নিয়ে থাকে ওরা।

আর 'ডেঞ্জার' বা বিপদের কথা উঠছে কেন? বিপদ যদি থাকে, তা তো মানুষের থেকে। নাস্তিকতার মধ্যে নিহিত তো কোনও  বিপদের সঙ্কেত দেখিনি। এক বন্ধু বললেন, নিরীশ্বরবাদ থেকে বিপদ? এ তো সুস্থ শরীরের বিপদ বলার মতো। অর্থাৎ সুস্থ শরীরটা প্রাথমিক, তারপর অসুখ হলে ডাক্তার, চিকিৎসা এসবের কথা আসে। ভাবলাম সভ্যতার শুরুতে নাস্তিকতাই ছিল স্বাভাবিক। পরে বিভিন্ন কারণে এসেছে ধর্ম। তারমধ্যে প্রধান ভয় আর অজ্ঞতা- এ তো অনেক পুরনো পাঠ আমাদের। অসুখ হলে বিপদ, আর তাতে লাভ হয় ডাক্তার বা হাসপাতালের। তাই, নাস্তিকতা থেকে কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই, বিপদ আসে ধর্মের হাত ধরে। আর লাভও হয় যারা ধর্মের থেকে লাভ করে তাদের। যেমন লাভ করে ডাক্তাররা, হাসপাতাল আমাদের অসুস্থতাকে মূলধন করে। ডাক্তারদের ওপরে অগাধ শ্রদ্ধা রেখেই তুলনাটা করলাম। আর বুঝলাম বন্ধুটি বেশ পোড় খাওয়া কট্টর কিন্তু সহজাতভাবেই লজিকাল। তাই দৃষ্টিটা সুদূরপ্রসারী।

সত্যিই তো! ন্যায়নীতির বোধ তো ধর্মের থেকে আসেনি। ন্যায়বোধ ছিল সভ্যতার শুরু থেকেই, জিনগতভাবে। বাঁচার জন্যেই বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়েছে ন্যায়-অন্যায় বোধ বা মরালিটি, সঙ্ঘবদ্ধভাবে মানুষকে বাঁচতে যে বোধ সাহায্য করেছে। বেসিক সততার মূল্য বা পরিমাপ বোঝার জন্যে ধর্মের প্রাথমিক কোনও ভূমিকা ছিল না। শাস্তির ভয় ছাড়াই বেঁচে ছিল মানবসভ্যতা, সামাজিক ব্যবহার নির্ধারিত হয়েছিল ধর্মের শাসন ছাড়াই। নিজেদের টিকে থাকার তাগিদে। যেভাবে মানুষ রান্না শিখেছে, পরিচ্ছন্নতা শিখেছে।

তবু কিছু লোক আছে, যারা এই পর্যন্ত শুনেই বলে উঠবে, ভারতের প্রেক্ষিতে এসব কথার শুধু মানেই হয়না, তা নয়, রীতিমতো বিপজ্জনক। তারা হয়তো ভারত সম্বন্ধে তেমন কিছু জানেও না। তবু বলবে- 'এই ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য অশিক্ষার দেশে ধর্মই তো পারে মানুষকে সুপথে চালিত করতে।'

ব্যস, এই তো আসল কথা! উত্তরে একটাই উক্তি মনে পড়ে যায়; আরেকজন ফরাসী ভদ্রলোকের কথা। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। যিনি বলেছিলেন- ...'Religion is what keeps the poor from killing the rich!' অর্থাৎ ধর্মই ধনবানদের বাঁচায় গরীবদের হাতে নিহত হওয়া থেকে। শুনতে খুব গোদা, কিন্তু এটাই বলেছিলেন তিনি। ধর্মের ভয় না থাকলে না খেতে পাওয়া মানুষগুলো অন্তত আত্মহত্যা করার আগে কয়েকজনকে মেরে মরত।

তাহলে কী দাঁড়াল? ধর্ম টিকে আছে দারিদ্র্য আর অশিক্ষার কারণে। আর টিকে আছে বলেই দারিদ্র্য, অশিক্ষা স্থায়ী হয়ে আছে। উদ্ধারের চেষ্টা যা হয় সে অনুদান, খুচরো দান-খয়রাত, কিছু পাইয়ে দেওয়া। এগুলো তাৎক্ষণিক পেইন কিলারের মতো কাজ করে, রোগ সারেনা। এগুলো গিমিক হতে বাধ্য। স্থায়ী সুরাহার জন্য চাই পড়াশোনা, শিক্ষার প্রসার। ধর্মের রোগ আপনি সেরে যাবে। তবে এদেশে টাকা খরচ করে ডিগ্রি পাওয়া যায়, শিক্ষিত হওয়া কঠিন। পড়াশোনা করেও উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যায় যারা, তারা বোঝে এখানকার পড়াশোনার পরিসর কত সঙ্কীর্ণ, কত অপরিণত।

তাই শিক্ষা, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা এবং উন্নত গবেষণার কাজে যে দেশ পিছিয়ে থাকে, পিছিয়ে রাখা হয়, পিছিয়ে রাখার জন্যে সেখানে ধর্মকে স্বাভাবিকভাবেই তোল্লাই দিতে হয়। অশিক্ষার পাশাপাশি অস্বাস্থ্য আর ধর্মকে চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করা ছাড়া উপায় থাকে না।

দুঃখের বিষয় এদেশে তেমন সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ ক্রমেই কমে আসছে। আমরা একটা প্রজন্মেই দেখতে পাচ্ছি আগেকার গ্রাজুয়েট আর এযুগের সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের ফারাক। তাহলে পড়ানো শেখানোর ভার কে বা কারা নেবে পরবর্তী যুগে?

প্রাথমিক স্তরে দেশে পড়াশোনা করে অনেকেই বিদেশে গিয়ে বিরাট কাজ করেছেন। এক্ষুনি মনে পড়ছে রসায়নের ভেঙ্কি আর অর্থনীতির অমর্ত্যর কথা। তাঁরা নোবেলজয়ী। সেরকম বহুসংখ্যক ছেলে-মেয়ে প্রতিবছরই বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করে মেজাজে আছেন। যাচ্ছেন যে দেশ থেকে সেখানকার নালন্দায় এক সময়ে সারা পৃথিবীর অগণিত জ্ঞানপিপাসু ছাত্র এসেছেন। এই স্রোত এসেছিল দীর্ঘ সাতশো বছর ধরে। ইতিহাসের কি পরিহাস! কিন্তু প্রাথমিক স্তরে যদি পড়ানোই না হয়, ভুল পড়ানো হয়, ইতিহাস বিকৃত করে পরিবেশন করা হয়, তারা অর্থাৎ সেইসব শিশুরা তো চিরকালের জন্য বামন হয়ে থাকবে।

সেই পিছিয়ে পড়া দেশ ক্রমশ আরও পেছোতে পেছোতে কোথায় নিয়ে যাবে সমাজকে? ধর্মব্যবসা রমরম করবে। যুদ্ধখাতে বাজেট বাড়বে। সেই দেশে, বংশবদ দাস তৈরি হতে হবে বেঁচে থাকার জন্য। চাবুকের বদলে বন্দুক ব্যবহার হবে। উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগবে মানুষকে ভয় দেখাতে, খতম করতে আর মগজ ধোলাইয়ের অস্ত্র তৈরি হবে হাতে হাতে ঘোরা সেলফোনের মধ্যে দিয়ে। মাফিয়া রাজত্বে সৎ দার্শনিক, চিন্তাবিদ গবেষকের কোনও জায়গা থাকবে না। নিজেদের মধ্যে মারামারি, অন্যদেশের কাছে নানাভাবে বিকিয়ে যাওয়া সেই দেশ আমাদের... যাকগে, আর ভাববো না...

ভাবার কোনও শেষ নেই, ভাবার চেষ্টা বৃথা তাই...

শিক্ষা, সঠিক শিক্ষার প্রসার ছাড়া আপাতত ধর্মের হাত থেকে রেহাই নেই। বাকিটা বিবর্তন। বিবর্তনের চাকা সামনে ঘোরাতে শিক্ষা - ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান, সমস্তরকম শিক্ষার দ্রুত প্রসার জরুরি।

নাস্তিকতা নিয়ে এখন মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এই সরল অংকটা বুঝলে শিক্ষা, সঠিক বেসিক শিক্ষার কথা ভাবতে হবে। মানুষ নিজেই ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে যেদিন প্রয়োজন থাকবে না।

ইভোলিউশন - বিবর্তন। এই বিবর্তনের রাস্তা ধরেই সুস্থ নাস্তিকতায় পৌঁছবে মানুষ। একদিন যে বিবর্তিত সুস্থ সমাজ আসবে, সেটা আসবে সঠিক শিক্ষার পথ ধরেই। সেখানে মানুষকে সততা জোর করে চাপিয়ে দিতে হবে না যেমন, তেমনই জোর করে নাস্তিকতার প্রচারও করতে হবে না। নিরীশ্বরবাদী মতবাদ জোর করে চাপালে তার ফল ভয়ঙ্কর হতে পারে। কারণ যে বোধ শিক্ষার হাত ধরে জ্ঞানের হাত ধরে আসেনি, সততারও সে ধার ধারবে না। এটা আমরা নিজের জীবনে দেখেছি।

খুব তাড়াতাড়িই এই বিবর্তন আসতে পারে, আমার আশাবাদী মন বলছে। স্বশিক্ষিত হওয়া এই ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের যুগে খুব কঠিন নয়। যারা যুক্তিনিষ্ঠ মন ও বিজ্ঞানমনস্ক মানসিক / সামাজিক / পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে, তাদেরই হাল ধরতে হবে। হতাশ না হয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে না থেকে লড়ে যেতে হবে।

হাল ছেড়ো না বন্ধু
বরং উজ্জীবিত হও। অনেক কাজ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ