নোম চমস্কি, গণসম্মতি উৎপাদন (Manufacturing Consent), আই পি এল, এবং লোকসভা নির্বাচন
চতুর্থ ও শেষ অংশ -- উন্নয়ন নামক বিশালতম ধাপ্পাবাজি
অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আচ্ছে দিন, আর কালো টাকার উদ্ধার -- এই তিনটে জিনিস হলো এই ভৌতিক প্ল্যানচেটের তেপায়া টেবিলের তিনটে পা। ভূত নামানোর মতোই ধাপ্পাবাজি।
তিনটে ধাপ্পাবাজিই ব্যর্থ হয়েছে। তাই এবারে বিজেপির ২০১৯ নির্বাচনী ইস্তাহারে কালো টাকা সম্পর্কে একটা কথাও নেই। তাছাড়া, ভৌতিক অস্তিত্বের হাজার ব্যক্তি, বড় বড় কর্পোরেশন, সেলিব্রিটি, বলিউড, টলিউড, মলিউড এবং ক্রিকেট লবি থেকে এতো লক্ষ কোটি নির্বাচনী তহবিলে জমা পড়েছে যে কালো টাকা উদ্ধার একটা হাস্যকর তামাশায় পরিণত হয়েছে।
এছাড়া, ইউরো, পাউন্ড আর ডলারের আমদানি তো আছেই। ওই জায়গাটায় দেশপ্রেমিকরা দাতাদের দেশদ্রোহী বলেনা।
এই যে আই পি এল চলছে, এটাও একটা বিশাল কালো টাকার খেলা। সবাই জানে। বল বাই বল জুয়া হচ্ছে। লক্ষ কোটি টাকা হাতবদল হচ্ছে ক্রিকেট খেলার নাম করে মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়ে। ইয়ং জেনারেশন লাফাচ্ছে উল্লাসে -- আন্দ্রে রাসেলের ছক্কায়। একদল দুটো গেম জিতলে তার পরেরটায় হারবে। মুম্বাই প্রথম দিকে হারতে থাকবে, এবং তারপর বিশালতম বাজি জিতবে শেষের দিকে। বিরাট কোহলি হিরো থেকে এখন হেরো। কিন্তু জিরো থেকে হিরো হতেই পারে -- যদি পর্দার পিছনে সেরকম খেলার ব্যবস্থা করা থাকে। আপনি আমি কিছুই জানতে পারবো না। পর্দানসীনরা জানে।
গণসম্মতি উৎপাদন। এই তো ক্রিকেট। এতদিন আমরা যা খেলে এসেছি, ওসব ফালতু।
আর এস এস -- স্বঘোষিত নীতিপুলিশ এবং রামচন্দ্রের মন্ত্রশিষ্যরা -- এই দেশব্যাপী এবং এখন আন্তর্জাতিক বৃহত্তম জুয়ার বাজি নিয়ে একটা কথাও বলছে না, বলবে না। শুধু তাই নয়, অমিত শা গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। আর এস এসের শাখায় ক্রিকেট খেলা চিরকাল নিষিদ্ধ -- বিদেশী খেলা বলে। হিপোক্রিসি এখন এক্স এবং ওয়াই জেনারেশনে পৌঁছেছে। একেবারে রাম রহিম আর রামদেবের ইয়োগা।
সবকিছুই মিডিয়া দ্বারা ধোলাইকৃত মগজের খেলা। "তুমি বলবে, আমি শুনবো। সন্ধ্যাবেলাআআয় ... তুমি আমি বসে আছি দুজনে।" ঝিরিঝিরি বাতাসে গণসম্মতি প্রোডাকশন। খাপ খুললেই লাশ পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা।
কোন সাংবাদিক সন্ধ্যাবেলায় মুণ্ডহীন হয়ে ঘরে ফিরতে চায়? কোন সাংবাদিকা ধর্ষিতা হয়ে?
কিন্তু তার ওপরেও আছে আরো বড় ধরণের গণসম্মতি উৎপাদন। যার কথা গুরু চমস্কি বারবার বলেছেন। এই সেদিনও আমাকে সামনে বসিয়ে বললেন এ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির অফিসে। গণসম্মতি উৎপাদন হলো, এই অর্থনীতি আমাদের জন্যে ভালো। ভীষণ ভালো। কমিউনিজম ব্যর্থ হয়েছে, সুতরাং এই ক্যাপিটালিজম তোমরা খাও। মহৌষধ। মার্কিনি সাধুর সালসা। কাল সকালেই যুবতী রাণী গর্ভবতী হবে, বাগানে সবুজ পালং শাক আর লাল গোলাপ ফুটবে, মরুভূমিতে কুলুকুলু মিষ্টি জলের নদী বয়ে যাবে।
তোমরা খাও। সালসা। আমাদের লালসার কথা বোলো না।
আমেরিকা ও ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্য পৃথিবীর সব দেশের থেকে নিকৃষ্ট ও ভয়াবহ চেহারায়। আমেরিকায় ০.০১ পার্সেন্ট লোকের হাতে সেদেশের ৯০ শতাংশ অর্থ ও সম্পদ এখন। ভারতে দশ থেকে পনেরো জন আম্বানি, আদানি, মোদী, ডালমিয়া, টাটার হাতে আমাদের সমগ্র সম্পদের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ। আমরা বাকিরা ওদের মহাভোজ খাওয়া হয়ে যাবার পর মাটিতে যে গুঁড়ো পড়ে থাকে, তাই চাটছি।
তাই নিয়ে মারামারি করছি। আর ভাবছি, "একদিন আসবে, একদিন আসবে, ফুটপাথ থেকে আসা ভিখিরির ছেলেটা মখমল মোড়া এক সিংহাসনে বসবে। সেই অদ্ভুত দিন, গল্পের দিন, স্বপ্নের দিন আসবে।"
ভারতেও তাই। আমেরিকাতেও তাই। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ভারতের বৈষম্য সবচেয়ে খারাপ। আর ধনী দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার। কিন্তু গণসম্মতি উৎপাদন করা হয়েছে কর্পোরেট মিডিয়ার মাধ্যমে যে আমরা এই মার্কিনি মডেল অনুসরণ করে নাকি অনেক এগিয়ে গেছি। আমরা ফ্রান্সকে টপকে যাবো। ... আরো সব কী কী যেন আমরা করবো। ভারত সুপারপাওয়ার হয়ে যাচ্ছে সাড়ে পরশু দিন। শুধু পদ্দফুলে আপনার ভোটটা দিয়ে দিন। বাকি সব আমরা দেখছি।
গঙ্গা -- বারাণসীর মোদীঘাট -- পৃথিবীর দূষিততম নদী। কোনো আলোচনা নেই মিডিয়াতে। দীর্ঘদিন অনশন করে এক আগরওয়াল জীবন দিয়ে দিলেন মা গঙ্গার দূষণ রোধের দাবিতে। মোদী উত্তর দেয়নি।
নারীদের ওপর অত্যাচারে ভারত এখন পৃথিবীর লাস্ট বয়। সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণ ও দলিতদের ওপর হিংসাতেও তাই। আমেরিকায় আমাদের বন্ধুরা -- যারা যথেষ্ট শিক্ষিত ও উদারমনা মার্কিন ভ্যারাইটি -- নির্ভয়া, আসিফা, দাদরি এখলাক এসবের পরে আমরা তাদের সঙ্গে দেখা হলে লজ্জায় চোখ নামিয়ে রাখি। যেমন গোধরার পরে নামিয়ে রাখতাম।
তারপরে নর্মদা, সবরমতি আর তাপ্তির জল অনেক বয়ে গেছে। মোদীর কেড়ে নেওয়া পাসপোর্ট আর ভিসা আমেরিকা আবার ফিরিয়ে দিয়েছে। ওই যে বললাম, অমিত শা এখন গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। আর এস এস নেতারা আই পি এল দেখছেন নাগপুরে কেশব কুঞ্জে বসে।
যেসব দেশ কমিউনিজম আর ক্যাপিটালিজমের মধ্যবর্তী একটা বিউটিফুল সিস্টেম তৈরী করেছে, এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীস্বাধীনতা, পরিবেশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, খেলাধুলা, এবং আরো সর্বক্ষেত্রে ভারত আর আমেরিকার চেয়ে একশো মাইল এগিয়ে গেছে, তাদের কথা আমরা জানতেও পারিনা। এমনকি, ব্রেজিল, বোলিভিয়া, কিউবার কথাও না। আমেরিকার ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীরা কিউবাতে পড়তে যায়। খরচ নেই। বেস্ট মেডিকেল এডুকেশন। কেউ জানেনা।
আমাদের বলা হয়েছে, "জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।"
বলা হয়েছে, আমরাই শ্রেষ্ঠ। বলা হয়েছে, দশ দেশের মধ্যে আমরা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন। বাকিরা অলিম্পিকে যাক। ওসব আমরা খেলিনা। আমরা আই পি এল জুয়ো খেলি। আমরা মেসি আর রোনাল্ডোর মূর্তি বসাই তালতলার মোড়ে প্যাণ্ডেল খাটিয়ে। পুজো দিই।
আমাদের বলা হয়েছে মার্কিনি কায়দায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে, "ডোন্ট ওয়রি, বি হ্যাপপি।" আমরা তাতেই খুশি।
ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক
১০ই এপ্রিল, ২০১৯
0 মন্তব্যসমূহ