প্রথম অংশ
ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট -- অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সম্মতি উৎপাদন। বিষয়টা সম্পর্কে প্রথম
জানতে পারি আমার গুরু নোম চমস্কির কাছে। বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে তখন আমি চল্লিশ
বছর বয়েসে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও রাইটিং নিয়ে পড়াশোনা
করতে ঢুকেছি। যে বইগুলো আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিলো, তার মধ্যে ছিল জর্জ
অরওয়েলের "১৯৮৪," আর Manufacturing Consent: The Political Economy of the
Mass Media (1988) by Edward S. Herman and Noam Chomsky. এই বইতে তাঁরা
বলেছিলেন যে মার্কিন মাস কমিউনিকেশন মিডিয়া একটি শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ এস্টাব্লিশমেন্ট , যারা দুটো
কাজ করে। (১) তারা স্থিতাবস্থার পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালায়, যাতে মুক্ত
বাজার অর্থনীতিকেই একমাত্র অর্থনীতি বলে স্থাপিত করা হয়, এবং (২) তারা
কোনোরকম জোরজবরদস্তি (কমিউনিস্ট স্টাইল) না করে নিজেদেরকে নিজেরাই সেন্সর
করে। আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম চমস্কির দেওয়া বিভিন্ন উদারহণ দেখে।
তারপর উদাহরণ দেখলাম নিজের জীবনেই। নিউ ইয়র্ক টাইমস, CNN এরা সবাই ইরাক
যুদ্ধের জনসমর্থন আদায় করার জন্যে সাদ্দাম হুসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র
(Weapons of Mass Destruction বা WMD) আছে -- এই তত্ত্ব খাড়া করলো, মিথ্যা
রিপোর্টিং'এর ভিত্তিতে। এবং বোমাবর্ষণ করে ইরাককে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো।
সাদ্দাম হুসেনকে ধরে ফেলে জনসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হলো। অথচ, সাদ্দাম হুসেনের
সঙ্গে ১১ই সেপ্টেম্বরের নিউ ইয়র্ক সন্ত্রাসী হামলার কোনো সম্পর্কই ছিলো না।
সম্পর্ক ছিল সৌদি আরবের। কিন্তু সৌদি আরবের সম্পর্কে কোনো আলোচনা মার্কিন
মিডিয়াতে হলো না। তাদের রাজপরিবারের সদস্যদের নিরাপদে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া
হলো। কোটি কোটি আমেরিকানকে ভুল বুঝিয়ে তাদের সম্মতি উৎপাদন করা হলো এই
বর্বর যুদ্ধ ও লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ মারার ষড়যন্ত্রে।
এরকম উদাহরণ
আরো অনেক আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বর
পরাশক্তি (superpower) হয়ে দাঁড়িয়েছে কেবলমাত্র তাদের যুদ্ধব্যবসার জোরে।
অস্ত্র, বোমা, বিষাক্ত গ্যাস, নাপাম যা ভিয়েতনামে ব্যবহার করা হয়েছিল,
হিরোশিমা নাগাসাকির বীভৎস পরমাণু বোমা -- এসব তো আছেই। তার সঙ্গে হাজার
রকমের কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ড্রোন, ওষুধপত্র থেকে শুরু করে
খাবারদাবার, ইউনিফর্ম, গাড়ি, বিমান, হেলিকপ্টার -- সবকিছুই যুদ্ধের
প্রয়োজনে উৎপাদন ও রপ্তানি হচ্ছে। এই ব্যবসা আমেরিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী
করে তুলেছে। সুতরাং, ১৯৪৮ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরেই আমেরিকা
পৃথিবীর এক বা একাধিক যুদ্ধ বাধিয়েছে, এবং যুদ্ধের ব্যবসা রমরম করে
চালিয়েছে। বস্তুতঃ, যুদ্ধ না হলে আমেরিকার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে।
সুতরাং, যুদ্ধের পক্ষে জনসম্মতি উৎপাদন করা মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়ার একটি
বিশেষ কাজ। এই কাজে তারা দুই প্রধান দলের কাছে সমর্থন পেয়ে এসেছে।
দ্বিতীয় অংশ
সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর থেকে কোনো সমান্তরাল শক্তি পৃথিবীতে প্রায় না
থাকায় আমেরিকার শাসকশ্রেণীর পক্ষে এই কাজ আরো সহজ হয়ে গেছে। এবং তাদের
মিডিয়ার মডেল বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় চাপিয়ে দেওয়া
হয়েছে। এর মধ্যে ভারত হলো সবচেয়ে সুযোগ্য ছাত্র। শিক্ষানবীশ। ভারতের
শাসকেরা এই manufacturing consent পদ্ধতির সবচেয়ে দ্রুত শিখে নেওয়া ছাত্রের
দল। আজকের মোদী, শাহ এবং বিজেপি-আর এস এস এই মডেল সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে
অনুকরণ করেছে। কিন্তু শুধু তারা করেনি। ১৯৯০ থেকে বিশ্বায়িত এক চরম
বৈষম্যের যে আর্থ-রাজনীতি ভারত অতি দ্রুত গ্রহণ করেছে, তার প্রথম দলের
ছাত্র ছিল কংগ্রেস সরকার। এখন বিজেপি যা করছে, তার গোড়াপত্তন করে গেছে
কংগ্রেস। রাজীব গান্ধী, মনমোহন সিং -- উন্নয়ন নামক এক ওয়ান পার্সেন্ট-মুখী
অর্থনীতি দেশের ওপর কায়েম করে গেছেন, এবং তার পক্ষে জনসমর্থন আদায় করেছেন
মাস মিডিয়ার সাহায্যে।
অনেক, অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু এখন নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার যেভাবে হাজার ছোটবড় মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে (১) ডি-মানিটাইজেশন, (২) জি এস টি, (৩) আধার কার্ড, (৪) পুলওয়ামা-বালাকো ট, এবং আরো বহু বিষয়ে consent ম্যানুফ্যাকচারিং করেছে, তা একেবারেই অভূতপূর্ব। তার সঙ্গে এখন ঠিক ভোটের আগে যুক্ত হয়েছে
মোদী বায়োপিক, হাজার চ্যানেলে ফেক ইলেকশন ফোরকাস্ট, এবং বিজেপি-আর এস এস
ক্যাডারদের তৈরী করা আই টি সেল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেক আই ডি-অবলম্বনে নানা
গুজব, ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানো।
নোম চমস্কি যখন তাঁর বিখ্যাত বইটি
লিখেছিলেন, তখন ইন্টারনেট ছিলো না, সোশ্যাল মিডিয়াও ছিলো না। আজ তাই আমার মতো
শিষ্য যারা রয়েছি, তাদের কাজ হলো, আরো কত রকম ভাবে কত রকম মিডিয়া ও
ব্যক্তি জনসম্মতি উৎপাদন করে চলেছে, তার মুখোশ সকলের সামনে খুলে দেওয়া।
এই কাজে বহু উদাহরণ আমিও দিতে পারি। আপনারাও পারেন। তার সঙ্গে সঙ্গে, ওই
সব ব্যক্তি ও হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নানা মিডিয়ার রাজনৈতিক কানেকশন ও অর্থের যোগান
কোথা থেকে আসছে -- সেগুলো সম্পূর্ণ নগ্ন করে তুলে ধরা। কারণ, বেশির ভাগ
মানুষ এই বিষয়গুলো ভালো বুঝতে পারেন না, এবং খুব সহজেই প্রোপাগান্ডার শিকার
হয়ে পড়েন।
অধিকার, গণতন্ত্র এবং মানবসভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই শিক্ষা দেওয়া ছাড়া আর পথ নেই। এবং যা করার এখনই করতে হবে।
তৃতীয় অংশ : "হাল্লা চলেছে যুদ্ধে।"
বহু উদাহরণ দেওয়া যায় চমস্কির এই বিশ্ববিখ্যাত তত্ত্ব প্রমাণ করার
জন্যে। এই তত্ত্বের ওপর লেখা প্রথম বইতে ১৯৮৮ সালে তিনি দিয়েছিলেন দুটো
প্রধান থিসিস: (১) বিশাল মিডিয়ার সাহায্যে শাসকশক্তি মানুষের মনে প্রতিষ্ঠা
করে যে মুক্তবাজার অর্থনীতিই একমাত্র মডেল, এবং এর কোনো বিকল্প নেই, এবং
(২) বিশাল মিডিয়া এখন কমিউনিস্ট বা ফ্যাসিস্টদের মতো বলপ্রয়োগ করে,
খুনজখমের রাস্তায় গিয়ে সেন্সরশিপ করে না, তারা নিজেরাই নিজেদের সেন্সর করে।
আমি আর একধাপ এগিয়ে গিয়ে এই স্বেচ্ছা-সেন্সর শিপকে নাম দিয়েছি "জার্নালিজম অফ এক্সক্লুশন," বা বর্জনমূলক সাংবাদিকতা। অর্থাৎ, কী কী তথ্য খবরে থাকা উচিৎ ছিল, কিন্তু থাকেনি।
যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা যাক।
অবশ্যই আমি চমস্কির দ্বিতীয় থিসিস সম্পর্কে কথা বলছি। প্রথম থিসিস সম্পর্কে
(মুক্তবাজার অর্থনীতি) চতুর্থ অংশে লিখবো।
আজকে সকালেই ফেসবুকে দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা আমার বিজেপির যুদ্ধজিগির-বিরো ধী
কথাবার্তায় খুব চটেছেন, এবং ভদ্রভাষায় উপহাস করেছেন। উনি যে ভাষায়
লিখেছেন, সাধারণতঃ আমি যেসব ভাষায় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কমেন্ট পাই, সে
তুলনায় নেহাৎই ভদ্র। সুতরাং, উত্তর দেওয়াটাও আমার উচিৎ -- ভদ্র ভাষায়।
ব্যাপারটা হলো এই। একটা consent -- জনসম্মতি উৎপাদন করা হয়েছে আমাদের দেশে
আর এদেশে এই আমেরিকায় যে যুদ্ধ খুব দরকার। "আজ বাদে কাল যুদ্ধ হবে" -- এটা
অসংখ্য ভারতীয় ও আমেরিকান মানুষের কাছে একটা বেশ চিত্তাকর্ষক ব্যাপার।
যুদ্ধ বেশ একটা ফান। হাত পা ছেঁড়ে না, কান চোখ উড়ে যায় না, ভয়ে মলত্যাগ হয় না,
পাকস্থলী পেট থেকে বেরিয়ে পড়ে না। বাকি জীবনটা ডিপ্রেসন বা আতঙ্কে কাটে না।
অনেকটা ভিডিও গেমসের মতো। বা কার্টুনের মতো। মৃতরা আবার ফিরে আসে।
বিশেষ করে যারা পারিবারিক কারণে যুদ্ধের সঙ্গে, মিলিটারির সঙ্গে যুক্ত,
তাদের মধ্যে প্রবলভাবে এই সমর্থন লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল
ইসলাম, বিভূতিভূষণ, অথবা বব ডিলান কিংবা স্যাম হ্যামিল, রিটা ডাভ এসব কবি ও
সাহিত্যিকের কবিতা, গল্প ও গান সেখানে ব্যর্থ। কিন্তু এই সমর্থকদের
মধ্যেই কিন্তু অনেক রবীন্দ্রনাথ ভক্ত আছেন। যুক্তি ও তর্ক আবেগ ও অন্ধ
দেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে চলে যায়। এবং শাসকশ্রেণী তা খুব ভালো করেই জানে।
তারা সে সুযোগ কাজে লাগায় ভোটে জেতার প্রয়োজনে।
পুলওয়ামা ও
বালাকোটের আগে মোদী সরকারের সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। বিধানসভা
নির্বাচনগুলোতে একের পর এক হার। ডি-মানিটাইজেশন নামক কেচ্ছা ফাঁস হয়ে
গিয়েছিলো, আদানি-আম্বানি ও বিল গেটস যে এই ষড়যন্ত্রের কথা আগেই জানতো, তা
বেরিয়ে পড়েছিল। জি এস টি লক্ষ মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সর্বনাশ করেছিল।
আধার কার্ড নামক গুপ্তচরবৃত্তির বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ দানা বেঁধে উঠেছিল,
এবং জিনিসপত্রের দাম, প্রাইভেটাইজড শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের আকাশচুম্বী মূল্য
মানুষকে দিশাহারা করে তুলেছিল। গঙ্গার তীব্র দূষণ, অথবা মহিলাদের ওপর,
মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
বিজয় মাল্য ও নীরব মোদীর বিজেপি সংযোগ আর নীরব থাকছিলো না।
মোদী, শা, আর এস এস এবং বিজেপির দরকার ছিল একটা মারাত্মক ধরণের
গ্যাম্বলিং। তুরুপের তাস। পুলওয়ামার সন্ত্রাস এবং ৪৫ জন নিরীহ সেনার শহীদ
হওয়ার ঘটনা তাদের হাতে সে সুবর্ণ সুযোগ তুলে দিলো। বিশাল মিডিয়ার গণসম্মতি
উৎপাদনের (manufacturing consent) কাজ শুরু হলো -- মানুষকে রাতারাতি তাদের
বাস্তব জীবনের সমস্ত সমস্যা এবং মোদী সরকারের সমস্ত ব্যর্থতা ভুলিয়ে দেওয়া
হলো। পাকিস্তান-বিরোধী ঘৃণা
নতুন করে উৎপাদন করা হলো, এবং সমস্ত মুসলমান সম্প্রদায়কে ও তার সাথে সাথে
আমাদের মতো যারা বিশ্লেষণ করতে পারি, মানুষকে বোঝাতে পারি, তাদের দেশদ্রোহী
তকমা দেওয়া হলো। এমনকি, শহীদ সৈনিকের স্ত্রী যাঁরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে
বক্তব্য রেখেছেন, তাঁদের অপমান করা শুরু হলো। আই টি সেল এবং ফেক সোশ্যাল
মিডিয়ার আই ডি ধারকরা ঘৃণা ও হিংসার বিষ ছড়িয়ে দিলো অতি দ্রুত।
গণ হিস্টিরিয়া তৈরী হলো দেশজুড়ে। ভোটের হাওয়া ঘুরে গেলো। "আচ্ছে দিন" জাতীয় ধোঁকাবাজির আর দরকার থাকলো না।
আমার Journalism of Exclusion? কী কী খবর আপনারা পেলেন না, যা অবশ্যই
পাওয়া উচিৎ ছিল? (১) যেখানে মাছি গলতে পারেনা, সেই ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি
এলাকায় এতো বড় মাপের সন্ত্রাসী হামলা হতে পারলো কীভাবে? (২) এই অবিশ্বাস্য
সিকিউরিটি ব্যর্থতার জন্যে দায়ী কারা? (৩) তাদের গ্রেফতার ও শাস্তি হয়েছে
কি? (৪) কী স্টেপ নেওয়া হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে, এবং (৫)
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সেখানকার সরকার বিপদে পড়ে এই ধরণের জালিয়াতি করেছে
কি? অর্থাৎ, এরকম তুরুপের তাস ব্যবহার করা কি একেবারেই অসম্ভব?
তারপর বালাকোট। যদিও ইমরান খান উইং কম্যান্ডার অভিনন্দনকে বহাল তবিয়তে
ফেরত পাঠিয়েছেন, এবং শান্তির স্বপক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন, কিন্তু
মিডিয়া ততক্ষণে তাদের মিথ্যা ও অর্ধসত্য দিয়ে শহুরে, ফেসবুক-টুইটার-শিক্ষিত মানুষের মগজধোলাই করে ফেলেছে।
0 মন্তব্যসমূহ