বাবুয়ানির তিন পুরুষ হল কেনারাম, রাজারাম, বেচারাম। ১৮৫৭-র আশপাশ হল রাজারামদের যুগ। তাঁরা বাপ পিতামহের দুই পয়সা পেলেন, হিন্দু কলেজে গিয়ে বাবু হলেন। এরই মধ্যে যাঁরা আলালের ঘরের দুলাল হয়ে উঠতে পারলেন না, তাঁরা নাট্যশালায় further এনলাইটেনমেন্ট-এর উপায় খুঁজে পেলেন। ১৮৫৭ সালে দেখা গেল তিন বাবু নাট্যশালায় মজলেন। ১৮৫৭-তে লখনৌয়ের বাদশাহ যখন তাড়া খাচ্ছেন তখন একই সঙ্গে তিন তিনটে নাট্যশালা একসঙ্গে শুরু হতে দেখা গেল, ছাতু বাবুর (আশুতোষ দেব) সিমলার বাড়িতে বাবু নন্দকুমার রায়ের অভিজ্ঞান শকুন্তলের অভিনয় ৩০শে জানুয়ারী। মার্চ মাসে বাবু রামজয় বসাকের বাড়ি রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’, এবং বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী সভার উদ্বোধনে ওই একই ‘নাটুকে রামনারায়ণ’-এর ‘বেণী সংহার’ নামানো হয় ১১ই এপ্রিলে। তার আট বছরের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে মেট্রোপলিটন থিয়েটার (১৮৫৯), শোভাবাজার রাজাদের প্রাইভেট থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি (১৮ই জুলাই ১৮৬৫), বাবু যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয় (৩০শে ডিসেম্বর ১৮৬৫) এবং যারে কয় last but not least, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাবুদের নাট্যশালা (জানুয়ারী ১৮৬৭) এবং বাবু বলদেব ধর ও চুনিলাল বসুর বহুবাজার বঙ্গ নাট্যালয় (১৮৬৮)।
শুরুরও শুরু থাকে। সর্বনাশের গোড়াপত্তন যে Hindoo এনলাইটেনমেন্ট-এ সে ব্যাপারটি পরিষ্কার। একটি পোকায় কাটা বইয়ের পাতা উল্টে দেখা যায়, ১৮৩৭-এর ২৯শে মার্চ গভর্নমেন্ট হাউসে হিন্দু কলেজের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ছাত্র-বাবুরা শেক্সপিয়রের খানিক খানিক অভিনয় করেন। এরপরই দেখা যায় ১৮৫১-র ৭ই অগাস্ট বটতলায় ডেভিড হেয়ার একাডেমী শুরু হয় হাটখোলার বাবু গুরুচরণ দত্তের উদ্যোগে। ১৮৫৩-তে সে একাডেমীর হিন্দু ছাত্রেরা শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অফ ভেনিসের Act IV Scene One-এর আবৃত্তি করেন। সমাচার দর্পণ তার actor-দের তালিকা ছেপে বেশ ফলাও করে খবরটি ছাপিয়েছিল। অভিনেতার তালিকায় দেখা যায় Portiar ভূমিকায় Obhoychurn Bose, Nerissa-র ভূমিকায় Rajendranarain Mitter আর Nelly Gray-র ভূমিকায় Gobinchunder Dutt।
আলোকপ্রাপ্ত রাজারামরা যে ঐ সময় থেকেই নাট্যরঙ্গে মজেছেন তা জানা গেল। তবে কি না নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে যে ব্যাটাছেলে ছাড়া গতি নেই তা জলবৎ তরলম্। নব্য বাবুরা তাতেই খুশি। মেয়েমানুষ যে পাড়ায় গেলে পাওয়া যায় সে পাড়ায় যায়ই বা কে, তাদের স্কুলের বাবুদের সঙ্গে অভিনয় করতে দেওয়ার মতো নিঘিন্নে কাজই বা করে কে। অতএব, Obhoychurn বিনে গতি নেই।
সায়েবদের থেকে মদ ছাড়াও বাবুরা পেয়েছিলেন শেক্সপীয়ার। সে বেশ সকাল-সকালই পেয়েছিলেন দেখা যাচ্ছে। তাঁরা ইংরিজি নাটক দেখতে বেশ যেতেন, এমনকি অভিনয়ও যে করতেন এক-আধটু সে-ও শুনলাম। দুই চার পত্রিকাতে সে সবের রিভিউও বেরোত। কিন্তু আমার ওসব উচ্চ বিষয়ে মন নেই। আমি খালি বাজে জিনিস খুঁজে বেড়াই। ১৮৪৮ সালে Sans Souci থিয়েটারে ‘ওথেলো’-র অভিনয় হয়। ২১শে অগাস্ট ‘সংবাদ প্রভাকর’ লেখে–
“গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর সানশশি (Sans Souci) নামক থিয়েটারে বেশ সমারোহ হইয়াছিল, বহুদিবস হইল ঐরূপ সমারোহ হয় নাই, কলিকাতা ও অন্যান্য স্থানের সাহেব ও বিবি এবং এতদ্দেশীয় বাবু ও রাজাদিগের সমাগম দ্বারা নৃত্যাগারের শোভা অতি মনোরম হইয়াছিল (…) এতদ্দেশীয় নর্তক বাবু বৈষ্ণবচাঁদ আঢ্য ওথেলোর ভঙ্গি ও বক্তৃতার দ্বারা সকলকে সন্তুষ্ট করিয়াছেন, তিনি কোনো রূপে ভীত অথবা কোনো ভঙ্গির অবহেলন করেন নাই, তিনি চতুর্দিগ হইতে ধন্য ২ শব্দ শ্রবণ করিয়াছেন এবং তাঁহার উৎসাহ ও সাহস বদ্ধমূল হইয়াছে, যে বিবি ডেসডিমোনা হইয়াছিলেন তিনিও বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠিতা হইয়াছেন..”।
এর পরে আরও খানিক নাট্য সমালোচনা আছে বৈষ্ণবচাঁদ আঢ্যর অভিনয় নিয়ে, কিন্তু ওই যে বললাম নিন্দুকের নজর খালি বাজে খবর খোঁজে, নজর পড়ল ‘বিবি’ ডেসডিমোনার ওপর। প্রশ্ন হল, এই বিবি কোনও ইহুদি বিবি কিনা, কারণ তাঁদের সৌন্দর্য বিষয়ে দু-চার কথা ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদের মুখে শোনা যায় বটে। কারণ সেইসময় কিছু ইংরেজ বিবির কলকাতায় যাতায়াত হয়েছিল। বামাবোধিনী বিবি শিক্ষয়িত্রী রেকমেন্ড করছে। নাট্যজগতেও দুই বিবির খোঁজ পাওয়া যায়; মিস এলিস আর মিসেস গ্রেগ। মিস এলিস-এর খবরটি বেশ চমকপ্রদ । ১৮৫৩, ৬ই অগাস্ট ‘সংবাদ প্রভাকর’ বলছে–
“অবগতি হইল ওরিয়েন্টালি ছাত্ররা এক প্রকাণ্ড ভাণ্ড কাণ্ড ফাঁদিয়াছেন, এতদিন মেন্ Clinger সাহেব একাকী অধিকারী হইয়া বিলিতি যাত্রার উপদেশ দিতেছিলেন। এইক্ষণে এক শ্বেতাঙ্গী শ্ৰীমতী তাহার অধিকারিণী হইয়াছেন, ইহার নাম ইলিস, যিনি আসিয়া ভাব ভঙ্গির শিক্ষা প্রদান করিলে নাটকের আরও চটক পড়িবেক্।”
এই বিবি এলিসের গড়ের মাঠে ‘নৃত্যাগার’ ছিল এবং ১৮৫১-র ২৬শে এপ্রিল সংবাদ প্রভাকর জানাচ্ছে যে সেই নৃত্যাগার ‘পবন ঠাকুরের কৃপায় পতিত হইয়াছে’।
যাই হোক, চটক কতটা পড়িয়াছিল বলা যায় না তবে বিলিতি বিবিদের যে প্রথম যুগের নাট্যশালায় যাতায়াত ছিল তা দেখাই যাচ্ছে। ১৮৫৪-র ১৭ই মার্চ ওরিয়েন্টাল থিয়েটার, ২৬৮ গরানহাটা, চিৎপুরে রোডে মার্চেন্ট অফ ভেনিস আবার পেশ করা হয়। এবার Portia-র ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে মিসেস গ্রেগ-কে। The Bengal Harkaru জানাচ্ছে “that will be her last performance and indeed the close of her last day’s sojourn in Bengal.” এই সব বিবিদের সুখ-দুঃখের কথা লিখব কোনও একসময়। এনারা ছিলেন মহারানীর আমলের ‘Cargo’…। জাহাজ ভর্তি হয়ে এঁরা এদেশে আসতেন ভাগ্য খুঁজতে। কেউ বা গরিব বাপের মেয়ে, বর জোটেনি, তাই চলেছেন বিদেশে বরের খোঁজে। কারও স্বামী ছেড়ে গেছে অথবা কোনও লম্পট বদমাইশের হাত থেকে পালিয়ে তাঁরা নতুন দেশে নতুন জীবন খুঁজছেন। যাঁদের ভাগ্যদেবী নতুন দেশেও মুখ ফিরিয়ে নিতেন, তাঁরা আবার ‘Returned Cargo’ হয়ে ফিরে যেতেন নিজেদের দেশে। মিসেস গ্রেগ তেমনি কেউ ছিলেন কিনা কে জানে…
বাবুদের নাট্যশালায় ফিরি। ১৮৫৭-র জুলাই মাসে ছাতুবাবুর প্রাসাদে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তল’-এর অভিনয়ে নারীচরিত্রে তখনও বাবুদের রমরমা। Cast list-টি নিম্নরূপ–
শকুন্তলার ভূমিকায় ছাতুবাবুর পৌত্র বাবু শরৎ চন্দ্র দেব।
অনসূয়া: অবিনাশ চন্দ্র ঘোষ।
প্রিয়ম্বদা: ভুবনমোহন ঘোষ।
অভিনয়ের পরে এক বাবু জানালেন: “যখন বিশ হাজার টাকার অলংকারে মণ্ডিত হইয়া শরৎবাবু দীপ্তিময়ী শকুন্তলার রানিবেশ দেখাইয়াছিলেন তখন দর্শকবৃন্দ চমৎকৃত হইয়াছিলেন।”
মনে মনে ভাবলাম, হইবেনই। আশ্রমবাসিনী শকুন্তলার বিশহাজারী ঠমক দেখে দর্শককুল ভিরমি যে খাননি সেটা শরৎবাবুর কপালগুণ।
বাবু যতীন্দ্র মোহন ঠাকুরের পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গ নাট্যালয়ে ১৮৬৬-তে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের অভিনয় হয়। তার কাস্ট লিস্টটি নিম্নরূপ:
বিদ্যা: মদনমোহন বর্মন (খোট্টা)
হিরে মালিনী: শ্রী কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়
সুলোচনা চপলা (রাজকন্যার দাসী): শ্রী ষষ্ঠীদাস মুখোপাধ্যায়, শ্রী যদুনাথ ঘোষ, শ্রী হরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়
বিমলা: শ্রী নারায়ণ চন্দ্র বসাক।
পিছিয়ে আসা যাক ১৮৫৯-এ। তার একটি বিশেষ কারণ আছে। ১৮৫৯ সালে বঙ্গরঙ্গমঞ্চ জমজমাট। জনৈক রামদাস সেন ১০ই মে সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়ে ছড়া কাটলেন:
"নিত্য নিত্য শুনতে পাই অভিনয় নাম।
অভিনয়ে পূর্ণ হলো কলিকাতা ধাম।।
হায় কি সুখের দিন হইলো প্রকাশ।
দুঃখের হইলো অন্ত সুখ বারোমাস।।
দিন দিন বৃদ্ধি হয় সভ্যতা সোপান।
দিন দিন বৃদ্ধি হইলো বাংলার মান।।
হায় কি সুখের দিন হইলো উদয়।
এদেশে প্রচার হলো নাট্য অভিনয়।।"
এবার পাইকপাড়ার রাজাদের কথা পৃথকভাবে না লিখলে অপরাধ হবে। তাঁদের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির নাট্যশালায় বড় বড় মানুষের পায়ের ধুলো পড়ত। রাজা গজারা ছাড়াও তাঁদের বেলগাছিয়া নাট্যশালায় যাঁরা যেতেন তাদের মধ্যে ছিলেন বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র, শ্রীযুক্ত পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন। বাংলাদেশের ছোট গবের্নের শ্রীযুক্ত মান্যবর হেলিডে সায়েবেরও নাম পাওয়া গেল। কিন্তু আর একটি গুরুতর কারণে এই নাট্যশালা বিশিষ্ট। এই মঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নর ‘রত্নাবলী’ নামে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়, তা দেখে মোহিত হয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামধারী একজন বিলেত ফেরত বয়ে যাওয়া বাবু। তিনি তখন সদ্য সদ্য মাদ্রাজ থেকে কলকাতা এসেছেন এবং কলকাতা পুলিশ আদালতে কেরানির চাকরি নিয়েছেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা যে কী ছিল সে বাংলাদেশের তাবৎ মানুষ জানেন, ও নিয়ে বেশি বলার প্রয়োজন নেই। তা সেই অবস্থা থেকে তাঁর উদ্ধার পরিকল্পে তাঁর বন্ধু বাবু গৌরমোহন বসাক তাঁর সঙ্গে এইসব বড়মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেন। রত্নাবলী নাটক দেখতে যে সব সায়েব সুবো আসতেন, তাঁদের জন্যে একখানি ইংরিজি অনুবাদ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, পাইকপাড়ার রাজা শ্রীযুত প্রতাপ চন্দ্র সিংহ বাহাদুর সেই অনুবাদটির বরাত তাঁকেই দেন। পাওনা ধার্য্য হয়েছিল ৫০০ টাকা।
এই রত্নাবলী নাটক দেখেই পুলিশ কোর্টের কেরানির নাটক লিখতে সাধ গিয়েছিল। ফলশ্রুতি স্বরূপ ‘শর্মিষ্ঠা’ এবং বঙ্গসাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ’র তোলপাড়।
কিন্তু আমরা এখানে মাইকেল গাথা রচনা করতে বসিনি। পাঠক যদি এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ চান তবে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ বইটি পড়বেন। আরাম পাবেন। যাইহোক, শর্মিষ্ঠার অভিনয় হল এবং কশ্চিৎ রাজা ঈশ্বর চন্দ্র সিংহ বন্ধু গৌরদাস বসাককে যে Dramatis Personae-খানি পাঠালেন তাতে দেখা গেল:
Debjani: Hemchunder Mookerjee
Sharmista: Krishtodhon Banerjea (a new comer)
Purnika: Kally Das Sandel (formerly our dancing girl)
Dabika: Aghor Chunder Dhagria
Notee: Chunilal Bose (as before)
Maid Servant: Kally Prasanna Mookerjee
Dancing Girls: Same as before plus Bankim chunder Mookerjee.
বড় বিষ্ময়ের বিষয়, ১৮৫৯-১৮৬৬ নাক উঁচু উচ্চবর্ণের বাবুরা ‘মেড়ো’ আর ‘খোট্টা’দের সঙ্গে অবলীলায় নাট্য কর্ম করেছেন, কোথাও বাধেনি। বোধ করি এই সব মেড়ো ও খোট্টা পথ ভুলে হিন্দু কলেজ বা সমগোত্রীয় কোনও কলেজে মনোভুলে ঢুকে পড়েছিলেন, তাতেই ভাগ্যক্রমে এঁদের কুলীন সংসর্গ হয়েছিল…।
থিয়েটার-এ ১৮৫৫-৫৭-র আগে স্ত্রীলোকের আমদানি হয়েছিল কিন্তু তাঁরা ধোপে টেকেননি। দাড়ি-চাঁছাদের দিয়েই নাট্যমোদীদের সন্তুষ্ট রাখা হচ্ছিল তার কারণ সুশীলারা দুষ্প্রাপ্য এবং দুঃশীলাদের ছোঁয়াচ বঙ্গ সমাজের ন্যায়বাগীশরা তেমন ভালো চোখে দেখেননি।
বাবু নবীন চন্দ্র বসুর এমনি বুকের পাটা যে ১৮৩৫-এ তাঁর নাট্যশালার বিদ্যাসুন্দর অভিনয়ে চার চারটি মন্দ স্ত্রীলোককে তিনি মঞ্চে ঠেলে তুললেন। তাঁদের প্রমোশন হল। তাঁদের তিনজনের খবরের কাগজ পঞ্চমুখে প্রশংসা করল। আমরা অভিনেত্রীদের নাম জানলাম– রাধারাণী, জয়দুর্গা, রাজকুমারী ও বৌহরো ম্যাথরাণী। আরও জানলাম যে, এঁদের সবাইকে পতিতালয় থেকেই অভিনয়ের জন্য আনা হয়েছিল। গুণীজন রাধারাণী, জয়দুর্গা, রাজকুমারীর গুণগান গাইলেন কিন্তু বৌহরো ম্যাথরাণীর প্রসঙ্গ উঠতে দেখলাম না কোথাও। বোধ করি নামখানি তাঁদের জিভে বেঁধেছিল। ম্যাথরাণী তলিয়ে গেলেন। রক্ষণশীল সমাজ চুপ করে রইল না। সুলভ সমাচার পত্রিকায় লেখা হল–
"সিমলার কতগুলি ভদ্রসন্তান বেঙ্গল থিয়েটার নাম দিয়া আর একটি থিয়েটার খুলিতেছে। ….যে যে স্থানে পুরুষদের মেয়ে সাজাইয়া অভিনয় করতে হয়, সেই স্থানে আসল একেবারে সত্যিকারের মেয়েমানুষ আনিয়া নাটক করিলে অনেক টাকা হইবে-– এই লোভে পড়িয়া তাঁহারা কতগুলি নটীর অনুসন্ধানে আছেন।… মেয়ে নটী আনিতে গেলে মন্দ স্ত্রীলোক আনিতেই হইবে, সুতরাং তাহা হইলে শ্রাদ্ধ অনেক দূর গড়াইবে। কিন্তু দেশের পক্ষে তাহা নিতান্ত অনিষ্টের হেতু হইবে।"
বাবু নবীন চন্দ্র বসুর নাট্যশালা বেঙ্গল থিয়েটরের দরজা বন্ধ হলে কিছুদিন বঙ্গসমাজ ভরাডুবির হাত হতে রক্ষে পেলেন। এর পরবর্তী সময়ে Kally Prasanna Mookerjee, Chunilal Bose আদিরা দাড়ি কামিয়ে রং মেখে শাড়িটি পরে স্টেজ আলো করতে থাকলেন।
১৮৭৩ সালে ছাতুবাবুর নাতি তাঁর দালানের সামনে মাঠে ন্যাশনাল থিয়েটার দিলেন। এই হল প্রথম পেশাদারি থিয়েটার। বাবুদের দালান থেকে নাট্যকলা পথে নামলে। আর ছাতুবাবুকে মাইকেলবাবু উজোতে লাগলেন: “তোমরা স্ত্রীলোক লইয়া থিয়েটার খোলো, স্ত্রীলোক না লইলে কিছুতেই ভালো হইবে না” …so on and so forth। কথায় আছেই ‘সঙ্গদোষে শিলা ভাসে’। তাঁর সঙ্গে তাল দিয়ে নাচতে লাগলেন শরৎবাবুর (ছাতুবাবুর নাতি) ভগ্নিপতি Mr. O.C Dutt., বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায় (এঁর কথা পূর্বে বলা হয়েছে), ন্যাদাড়ু গিরিশ, অর্থাৎ বাবু শ্রীযুত গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, বটুবাবু, বাবু প্রিয়নাথ বসু, ছাতুবাবু স্বয়ং এবং আরও তিন চার immoral ভদ্রসন্তান। এইবার ষোলো কলা পূর্ণ হল। মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক স্টেজে উঠল, বাবুরা আবারও জাতে তুললেন চার বেশ্যাকে। তাঁরা হলেন: গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী, জগত্তারিণী, শ্যামাসুন্দরী।
খবরের পাতায় ইংরিজি বাংলায় সোরগোল পড়ে গল। মহা হাঙ্গামা। ১৮৭৩-এর ১৮ই অগাস্ট, হিন্দু প্যাট্রিয়ট বললেন–
"…Mr Michael Modhusudan Datta’s classic drama of Sarmistha was selected for the first performance. The actors performed their parts very creditably, the two actresses, who are professional women, we are informed, were most successful. We wish this dramatic corps had done without the actresses. It is true that professional women join the jattras and natches, but we had hoped that the managers of the Bengali Theatres would not bring themselves down to the level of Jattrawallas."
১২৮০-র ১৪ই ভাদ্র ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকায় মনমোহন বসু ব্যঙ্গ করে লিখলেন–
"…বিলাতে রঙ্গভূমিতে স্ত্রীর প্রকৃতি স্ত্রীর দ্বারাই প্রদর্শিত হয়। বঙ্গদেশে দাড়ি গোঁপ ধারী (হাজার কামাক) জ্যেঠা ছেলেরা মেয়ে সাজিয়া কর্কশ স্বরে সুমধুর বামা স্বরের কার্য করিতেছে। ইহা কি তাঁহাদের ন্যায় সমাজ সংস্কারক সম্প্রদায়ের সহ্য হয়? (…) অতএব ‘আন্ স্ত্রী!’ (…) বাঁচিয়া থাকিলে আরও কত কি দেখিতে পাইবো। কিন্তু এত সভ্যতার তেজ সহ্য করিয়া বাঁচিয়া থাকা দায়।"
১৫ই জানুয়ারী ১৮৭৪ দেখলাম অমৃতবাজার সমাজ পরিত্যক্ত ধর্ম বহির্ভূত স্ত্রীলোকদের নিয়ে নাটক করানোয় আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে এই করতে গিয়ে যদি সমাজের একজন লোককেও পরিহার করতে হয় তবে সে বড় দুঃখের বিষয় হইবেক। অমৃতবাজারের আশঙ্কা একেবারে যে ননসেন্স তা বলতে পারা গেল না। শ্রীযুত পণ্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর শর্মা প্রতিবাদে পাপ থিয়েটার সংসর্গ ত্যাগ করলেন। ১৮৭৩-এর ২৯শে জুন দত্তোকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন দেহ রাখলেন। Dear Vid-এর কার্যকলাপ তাঁকে দেখে যেতে হল না।
পাঠক, এইবার কামসূত্রের ৫৮ নম্বর সূত্র, যেটি এই অংশের মাথায় লটকেছি, সেটি দেখুন। নটী এবং শিল্পকারিকা যে আদতে বেশ্যা যেহেতু তাঁরা নিজেদের expose করে থাকেন (প্রকাশ বিনষ্টা) সে তো বাৎস্যায়ন কোন মান্ধাতার আমলে বলেই গেছেন। এঁদের দিয়ে কাম প্রশমন হয়। উচ্চ সংস্কৃতি হয় কি? তার ওপর যখন তারা আসে খোদ বেশ্যাপাড়া থেকে তখন সোনায় সোহাগা। আদর্শ হিন্দু বংশোদ্ভূতরা করেন কী? ১৮৭৪-এর জানুয়ারী মাসে যখন মাইকেল-এর হতভাগ্য ছেলেপুলেদের সাহায্যার্থে আবার ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক মঞ্চস্থ হয়, দুটি অসমসাহসিনী ব্রাহ্মিকা সেই বেশ্যাদোষ দুষ্ট নাটক দেখতে গেছিলেন। প্রকারান্তরে তাঁদের সাবধান করে দেওয়া হয়।
১৮৭৩ থেকে শুরু হল আমোদের ছড়াছড়ি। বাবু গিরীশ চন্দ্র ঘোষ ‘নোটো গিরীশ’ হতে প্রমোশন পেলেন। ‘মেঘনাদ বধে’ তাঁর অভিনয় দেখে ‘সাধারণী’র সম্পাদক শ্রীযুত অক্ষয় চন্দ্র সরকার তাঁকে ‘Garrick of Bengal’ শিরোপা দিলেন। সতীর true definition নিয়ে তিন তিনটে নাটক লেখা হল আর ওরই মাঝে দু’ দশটি বেশ্যা জাতে উঠলেন।
বেশ্যাকে জাতে উঠতে হলে কি করতে হয়? না, নাচতে হয়, গাইতে হয়, সর্বোপরি ভদ্রলোকের ভাষায় কথা কইতে হয়। যাঁরা সেসব পারলেন তাঁরা নোটো বাবুদের নেকনজরে পড়ে তরে গেলেন। যাঁরা সরস্বতীর আশীর্বাদ পেলেন না তাঁরা শুধু বাবুদের সঙ্গ করে মরলেন। ‘সধবার একাদশী’র নাটকের বেশ্যার নাম কাঞ্চন। তাঁর মনোবেদনাটি নিম্নরূপ–
"কাঞ্চন: অটলবাবু আমার ওপর বড় নির্দয়। উনি সাতদিন ভাঁড়য়ে একদিন যান। উনি কত বড় মানুষ, আমরা গরিব, আমাদের বাড়িতে উনি গেলে ওনার মানের খর্ব হয়– আমরা নাচতে জানিনে, গাইতে জানিনে, কথা কইতে জানিনে, কিসে ওর মনোরঞ্জন করবো?
অটল: আমি তো কাল গিচলেম।
কাঞ্চন: চকিতের ন্যায়।
নিম: শালী আমার সঙ্গে কথা কইলে যেন হাঁড়িচাঁচা ডাকতে লাগলো, এখন কথা কচ্ছে যেন সেতার বাজছে।
—প্রথম অঙ্ক প্রথম গর্ভাঙ্ক"
কাঞ্চনের অভিমানের ফাঁক দিয়ে “চকিতের ন্যায়” মনোরঞ্জনের যে বাসনা দেখা গেল, তা নাটুকে বুলি, সে ভাষা কাঞ্চনের নয়, কোনও মাতাল বাবুর কপচানো এস্টেজের কথা তোতা পাখির মতো আউড়ে যাওয়া। এই সময়ে শহরের রাস্তায়, থিয়েটারে, বেশ্যার বাড়িতে মাতাল বাবুদের অভাব নেই। তাঁরা বোতল খালি করে শেক্সপীয়ার, মিল্টন, মধুসূদন, বিদ্যাসুন্দর একই দক্ষতায় কপচান এবং বেশ্যা পল্লীতে বা গঙ্গার ধারে বেশ্যা প্রতি ধাবিত হন। ‘সধবার একাদশী’র নিমচাঁদই হল সেই গ্যালেরির এক যোগ্য উদাহরণ। তা এই মাতালবাবু যা বললেন তাও অনুধাবনযোগ্য। যিনি শুধু ‘সঙ্গ’ করার বাবু, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়ার কালে বেশ্যার ভাষার রাখঢাক নেই; সেখানে তার আসল গলা, বুলি বেরোয়, কিন্তু যে বাবু তাকে প্রমোশন-এর স্বপ্ন দেখান willy nilly, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়ার সময় বেশ্যার গলায় সেতার বাজে, সে যে কত চেষ্টায় রপ্ত তা বিলক্ষণ বোঝা যায় যখন রাগের মাথায় “চকিতের ন্যায়” তার আসল ভাব ও ভাষা বেরিয়ে পড়ে– “অটল তুই কি পাগল হোলি নাকি! আমি তো আর তোর ঘরের মাগ নই যে বাগানে গিইচি বলে তোর মুখ হেঁট হবে।”
ফলকথা হল এই যে নাচতে গাইতে এবং সর্বোপরি কথা কইতে জানলে ভদ্র বাবুদের পাশে চকিতের ন্যায় হলেও বসা যায়, এইটেই হল সার সত্য। এই স্বপ্ন খোলার ঘরে বসে কত বেশ্যা দেখেছিল কে জানে! পাঠক জিগেস করতে পারেন, ঘণ্টা দুইয়ের জন্যে পাশে বসল, দুচার কথা কইল, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হল? নাট্যশালার খোলামেলায় এই সকল মন্দ স্ত্রীলোক সরল সচ্চরিত্র ভদ্রসন্তানদের কতটাই বা বিপদ ঘটাতে পারেন?
এইবার আবার বাবু মনমোহন বসুর কথায় ফিরি কারণ এই বিষয়টি তিনি বিশদ বুঝিয়েছিলেন ন্যাশনাল থিয়েটার-এর প্রথম বাৎসরিক অনুষ্ঠানে–
“কি আকৃতি, কি প্রকৃতি, কি স্বর, কিছুতেই কর্কশ ও রুক্ষ স্বভাবের পুরুষেরা কোমলাঙ্গী, কোমলহৃদয়া মধুরভাষিণী কামিনীগণের ন্যায় হইতে পারে না। সত্যিকার রমণীকে রমণী সাজাইলে দেখিতে শুনিতে সর্বপ্রকারের ভালো হয়। কিন্তু এ বিষয়ে যেমন উত্তম হইল, অন্যান্য বিষয় যে আছে তাহাতেও উপেক্ষা করা উচিত নয়। দৃশ্য-মনোহারিত্ব, ও আমোদ সুখ প্রার্থনীয় বটে কিন্তু সমাজের ধর্মনীতি অধিক প্রার্থনীয় কিনা তাহা কি আর বহু বাক্যে বুঝাইয়া দিতে হইবে? এ দেশে কুলজা কামিনীকে অভিনেত্রী রূপে প্রাপ্ত হওয়া এক কালেই অসম্ভব, স্ত্রী অভিনেত্রী সংগ্রহ করিতে হইলে কুলটা বেশ্যা পল্লী হইতেই আনিতে হইবে। ভদ্রযুবকগণ আপনাদের মধ্যে বেশ্যাকে লইয়া আমোদ করিবেন, বেশ্যার সঙ্গে একত্র সাজিয়া রঙ্গভূমিতে রঙ্গ করিবেন, বেশ্যার সঙ্গে নৃত্য করিবেন, ইহাও কি কর্ণে শুনা যায়? ইহাও কি সহ্য হয়? ইহাও যে রাজধানীতে— এত সুশিক্ষা সদুপদেশ, ও সভ্যতার মধ্যে কোনো সম্প্রদায় কর্ত্তৃক অনায়াসে অনুষ্ঠিত হইতেছে, ইহার অপেক্ষা বিস্ময় ও আক্ষেপের বিষয় আর কি আছে?”
Contamination-এর ভয় বড় ভয়। এবং সে রোধ করার কোনও উপায়ই নেই, ভদ্রসন্তানদের নাটকের এমনই ছিরি। যতই কেননা পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক নাটক লেখা হউক, তার মূল সুরটি ‘রঙ্গ’ আর ‘আমোদে’র। তাতে নট নটী এ ও’র গায়ে প্রায়শই ঢলে পড়ে, আদিরসাত্মক রসিকতা করে। এ সকল entertaining গলাগলি ঢলাঢলি ব্যাপার যদি একটি বেশ্যার সহিত অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সে মহামারী contamination হতে বাবুদের রক্ষা করেন কোন শ্রী হরি? দর্শক বাবুদের দেখন সুখের লজ্জাই বা রক্ষা করেন কোন মধুসূদন? ‘প্রকাশ বিনষ্টা’দের না হয় বাৎস্যায়ন অনুমোদন করেছেন, প্রকাশ বিনষ্টদের তো কোনও বিধান নেই! তাঁরা অটলবাবু বা নিমচাঁদ বাবুর অনুসরণে আদাড়ে পাঁদাড়ে ঘুরুন, সে আমরা দেখতে যাচ্ছিনে, কিন্তু এক হলঘর বাবুর সামনে…? প্রাণ থাকতে নয়।
গোড়ার দিকে তিন সতী-গন্ধী নাটকের কথা বলেছিলাম। তার মধ্যে একটি থেকে দুই একটি দৃশ্য পেশ করছি। পাঠক প্রথমে এইটি দেখুন–
"(কুটীলার প্রবেশ)
কুটীলা— দাদা, দাদা, দাদা,—
আয়ান— আরে কেন, কি হয়েচে–-
কুটীলা– যা হয়েচে একবার দেখ্বে এসো— এই গে তোমার রাধা-সতী কালার সঙ্গে নিকুঞ্জবনে আমোদ প্রমোদ করচে– আর কিচু নয়—
আয়ান— (যষ্টি হস্তে দণ্ডায়মান) সত্য বলচিস্ রাধাকৃষ্ণ নিকুঞ্জ বনে একত্র রয়েচে ।
কুটীলা— আমি বুঝি কেবল তোমার কাছে মিথ্য কথাই বলে ব্যাড়াচ্চি– স্বচক্ষে দেখে এসেচি— এখন ইচ্ছে হয়, তো চল তোমারে দেখুয়ে দি,— তার পর তোমার মনে যা থাকে তাই করো– বাবা বোয়ের এমন বুকের পাটা কখন দেখিনি— এই দুই প্রহর বেলা, পর পুরুষের সঙ্গে আমোদ– ওমা ছি, ছি, ছি, কুল বধূর কি এই কাম, কালা মিন্সের জ্বালায় লোকের কাছে মুক দেখানো ভার– রাত দিন কৃষ্ণের সঙ্গে বনে বনে ফিরুবে, ঘরে এক দণ্ড থাকতে মন যায় না— ভাল কথা বলতে গেলে তেড়ে মারুতে আসে– কলঙ্কিনীর জন্যে যমুনায় ঝাপ দিয়ে মরতে ইচ্ছে হয়— এই তোমার আস্কারা পেয়েই তো এত দূর হয়েচে— তুমি দাবালে কি কখন এমন হতো–- মা সাধ করে বলেন তুমি মেয়ে মানুষ, কাচা দিয়ে কাপড় পর না—
—সতী কি কলঙ্কিনী, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭৯"
এ হল রাধা সতীর বৃত্তান্ত। এই নাটকে কৃষ্ণর কালী সেজে কুটীলা আর আয়ান ঘোষকে ফাঁকি দেওয়ার প্লট। এতে রাধা যমুনা থেকে জল এনে কৃষ্ণের প্রাণ বাঁচালেন এবং বৃন্দাবনের শ্রেষ্ঠা সতী সাব্যস্ত হলেন।
কিন্তু রাধা কৃষ্ণর লীলা যে ‘আমোদ’-এ পরিণত হল, সেই কথাটি আমাদের ভাবায়। দিব্য প্রেম হোক আর যাই হোক, নাট্যশালার bawdry না হলে টিকিট বিকোবে কিসে? এ বস্তুটি বাবুদের শিখিয়েছিলেন মহাত্মা শেক্সপীয়ার।
পাঠক এইবার একই নাটকে এই দৃশ্যটি অবলোকন করুন। রাধা সতী জল আনতে চলেছেন আর বিলাপ করছেন–
"প্রথম গর্ভাঙ্ক। যমুনা তট। (রাধিকা সখিগণ সমভিব্যাহারে উপস্থিত)
রাধিকা– সখি! পা যে আর চলে না— আমার মনের ভিতর যে কি হচ্চে তা অন্তর্যামী পরমেশ্বরই জানেন— প্ৰাণেশ্বর এ হতভাগিনীর অদৃষ্ট কি শেষে এই ছিল— কুল, মান, প্রাণ মন সকল সমর্পণ করে অবশেষে তোমার বিরহ যাতনা ভোগ কত্তে হলো— ওহ! সখি, আমি কি জল এনে প্রাণনাথের জীবন রক্ষা কত্তে পাবো? ব্রজের সাধ্বী রমণীগণ যা পারেন না, আমা হতে সে কাৰ্য্য কি সম্ভব। নাথ! তুমিই তো বলেছিলে যে আমার কালাকলঙ্কিনী নাম খণ্ডন করবে— দীননাথ! আমি অনন্তকাল এ কলঙ্ক রাশি ভোগ কর্ত্তে পারি, কিন্তু তোমার বিরহ যে এক মুহুৰ্ত্তও সহ্য করতে পারিনে– দয়াময়! দাসীকে এ ঘোর বিপদ সাগর হতে পরিত্রাণ কর নতুবা এ যমুনার জলে ছার প্রাণ পরিত্যাগ করবো।
—সতী কি কলঙ্কিনী, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭৯"
এইবার আপনারা বিবেচনা করুন, এই whining pining রাধাটি যদি কোনও বেশ্যা হ’ন, এবং নাটকের কোনও এক ব্রাহ্ম মুহূর্তে তিনি যদি গিয়ে কৃষ্ণ-রূপী young বাবুটির ঘাড়ে গিয়ে পড়েন, তা হইতে যা বিপত্তি হবে সে সামলাতে বাবুর চোদ্দ পুরুষ হদ্দ হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়, বিশেষ করে সে বেটির গলায় যদি সেতার বাজে। সুতরাং মনমোহন বাবুর কথাটি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বাঁচতে চাও তো হুতোমের ভাষায় ‘খ্যাংরা গুঁপো’ মিনসেদের কামিয়ে জুমিয়ে রাধা ললিতা বিশাখা রোহিনী যা খুশি সাজাও। ধর্ম সংকটের ভয় নেই।
মনমোহন বসু হলেন সনাতনপন্থীদের ধ্বজাধারী এবং নাট্যরঙ্গ এবং পুরুষের সতীত্ব রক্ষার যৌথ প্রকল্পে নিবেদিত প্রাণ। নাটকে নটী চরিত্রে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু সেই দুশ্চরিত্রা নটীর চরিত্র কোনও সুললিত বাবু করুন; তাতে রঙ্গ কিছু কম পড়িবেক বটে, তবে জাত ধর্ম বিনাশের সম্ভাবনা কিছুমাত্র নাই।
এইবার তাঁরই রচিত ‘সতী’ নাটক (১৮৭৩) থেকে খানিকটা পাঠ করি। এটি হল সে যুগের আর এক ‘সতী’ নাটক। এই অংশটিতে নট-নটীর কথোপকথনে আমরা যথার্থ সতীত্বের একটি সঠিক ব্যাখ্যা পাই।
এই লিস্টিতে চন্দ্রাকুলবধূ দ্রৌপদী নাকচ হয়ে যান এক আম্রবনের আম্রফলের কথাটি বলার সময়। পঞ্চপতির উপরেও তাঁর যে আর একটি পতির (কর্ণ) ইচ্ছা জেগেছিল, এই অপরাধে। “সতীকুলের ঈশ্বরী” ইন্দ্রানী পরীক্ষায় ফেল হলেন নিম্নোক্ত কারণে–
“বলপূর্বক যে এসে ইন্দ্রকে তাড়িয়ে দে স্বর্গের সিংহাসনখানি অধিকার করে (নহুষ), শচী ঠাকরুন অমনি হুট্ করে তারই বামে বসেন! এমন ঐশ্বর্য্যপ্রাণা ভোগবিলাসিনীকে পতিপ্রাণা না বলতে পারলে তোমার মন উঠবে কেন?”
যাঁকে এই অংশে তিরস্কার করা হচ্ছে তিনি হলেন এক নটী, অর্থাৎ আর এক ভোগবিলাসিনী, যাঁর সতীপনার কোনও কারেক্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং নেই। তারপর নট চরিত্রটি এই সাব্যস্ত করলে যে, “যে কন্যারত্ন দক্ষ প্রজাপতির কুল উজ্জ্বল করে, কৈলাশনাথের হৃদয়মণি হয়ে, সতীত্বের প্রভায় ত্রিভুবন আলো করেছেন (…) সেই সতীকূলের ঈশ্বরীর নিখুঁত চরিত্র কীর্তন করে জীবন সার্থক করি।”
সামাজিক অনুশাসন নাটকের পাতায় ঢুকে পড়ে তাবৎ নষ্ট মেয়েমানুষকে চোখ রাঙাতে থাকল। তারই মধ্যে কে এক ‘শান্তে পাগলা’ কোত্থেকে এসে তিড়িং বিড়িং করে নেচে কুঁদে মোটা দাগের গান গেয়ে ইনফেরিওর দর্শকদের আমোদ বর্ধন করলে। অর্থাৎ কিনা, যে নাট্যকার বাবু “কৈলাসনাথের হৃদয়মণি”কে সতীত্বের সার্টিফিকেট দিয়ে নিজের noble সাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিটি নাটকে জাহির করলেন, আদর্শ নারীত্বের একটি বার্নিং এক্সাম্পল সেট করলেন এবং ব্যাড উওম্যানকে chastise করলেন, তিনিই আবার স্থুল রসিকতা করে মঞ্চের ধারাটি এবং ‘পিট্’-এর চাহিদাটিতে ইন্ধন যোগালেন। মোটা দাগের আমোদটি বজায় থাকুক, তার খাতিরে দুই একটি বেশ্যা/নটী গোছের চরিত্র-ও থাকুক, কিন্তু তাতে যেন কার্যকাল সমুৎপন্নে বাবু কুলের শরীর এবং মন কন্টামিনেটেড না হয়ে পড়ে। তাঁরই ঢঙে বলি, “অতএব নারীচরিত্রে আন্ মিন্সেদের।” বেশ্যাসক্তি বিষম বিপত্তি। স্টেজ এবং জীবন মিলে গেলে মহা বিপদ। ওই যে বলেছি আগেই, ‘সাধু সাবধান’!
একটি মুখের মতো জবাব দেখলাম দিলেন জনৈক বাবু মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, এইসকল ড্যামসেলরা স্টেজ-এ ওঠেন বলেই যত নিম্নবর্গের লোক পয়সা দিয়ে টিকেট কাটে, ড্যামসেলদের সাঙ্গপাঙ্গরা চুপি চুপি নাটক দেখতে আসে; দাড়ি-চাঁছা নায়িকাদের দেখতে তাঁদের কি তদ্রূপ উৎসাহ হত? এছাড়া তিনি এও বললেন যে যাঁরা সমালোচক, তাঁরা উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু নারীদের মঞ্চে উপস্থিত করুন, immoral বাবুরা সব কয়টি বেশ্যাকে তাড়া দিয়ে একেবারে গঙ্গা পার করে ছাড়বেন।
সে হবার নয়। তালেগোলে বেশ্যারা স্টেজ আলো করে থেকে গেলেন। সনাতনপন্থী বাবুরা ঢাল তলোয়ার নিয়ে নাচতে থাকলেন। ১৯১২-র ৮ই ফেব্রুয়ারি, গিরীশচন্দ্র যখন দেহ রাখলেন, তাঁর মৃতদেহে মালা দেওয়ার অধিকারটুকুও সনাতন বাবুরা তাদের দিলে না।
"আমি সখের নারী সুকুমারী
স্ত্রী পুরুষে এ্যাক্টো করি
দুনিয়ার লোক দেখে যারে —!"
যাদুমণি, আন্দি, এইসব নাম যাদের হয় তাদের ঠিকুজি কুলুজির খোঁজ থাকে না। গোলাপসুন্দরীরও নেই। মাহেশ থেকে কি অবস্থায় তিনি কলকাতায় এসে খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন সে কথা কেউ বলে যাননি। তবে হ্যাঁ, কপাল করে এসেছিলেন এই বেশ্যাটি। প্রথম চোটেই মধুসূদন দত্তর নাটকে শর্মিষ্ঠা; ১৮৭৪ বেঙ্গল থিয়েটারে খোদ জ্যোতি ঠাকুরের পুরু বিক্রম নাটকে রাণী ঐলাবেলা। এরপর একটি মহা কাণ্ড ঘটল তাঁর জীবনে। এক আলোকপ্রাপ্ত বাবুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। বাবুটি সমাজসেবী radical, নাম উপেন্দ্রনাথ দাস। তিনি আবার নাট্যপ্রেমীও বটে। ১৮৭৫ সালে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সাঙ্গ করে তিনি তাঁর বন্ধু বাবু শিশিরকুমার ঘোষের সাহায্যে দি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার-এর ম্যানেজার হলেন। এরপর ১৮৭৫-এ লিখলেন শরৎ সরোজিনী নাটক। সেই নাটকে অত্যাচারী সাহেবদের খুব একহাত নিলেন, এবং যা হবার তা হল– সরকার সে নাটক বন্ধ করলে। কিন্তু সেই নাটকে ‘সুকুমারী’র ভূমিকায় অভিনয় করে গোলাপসুন্দরী রাতারাতি নাটকের হ্যান্ডবিলে হয়ে উঠলেন সুকুমারী। রীতিমত যারে কয়, a star is born। গল্পটি এখানে শেষ হলে বলা যেত happy ending। কিন্তু সে হবার নয়। উপেন্দ্রনাথ দাস একে বাবু তায় radical, তাঁর মাথায় খেয়াল এল যে এক্ট্রেসদের ভদ্রসমাজের পাতে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন, এবং সে হতে পারে একমাত্র বিবাহ সূত্রে।
যেমন কথা তেমন কাজ। ঘটনাক্রমে উপেন্দ্রনাথ পেয়ে গেলেন আর এক নাটুকে বাবুরে। তিনি গোষ্ঠবেহারী দত্ত। তাঁর সঙ্গে তাঁর ‘সুকুমারী’র বিয়ে দিয়ে তিনি তাকে জাতে তুলবেন এইরকমই সাব্যস্ত করেছিলেন তিনি। ধন্য radical বুদ্ধি। বেশ্যা জাতে তোলা কি সোজা? ১৮৭৫-এর ১২ই ফেব্রুয়ারির ‘এডুকেশন গেজেট’-এ লেখা হলো–
"সাপ্তাহিক সংবাদ : প্রতিধ্বনি বলেন, গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার-এর অভিনেত্রী শ্রীমতি গোলাপ(মোহিনী)র সহিত উক্ত নাট্যশালার অন্যতম অভিনেতা শ্রীযুক্ত বাবু গোষ্ঠবেহারী দত্তর বিবাহ ১৮৭২ অব্দের তিন আইন অনুসারে আগামী মঙ্গলবার নির্বাহ হইবে, এমত কথা আছে।”
কতিপয় রগুড়ে বাঙালি যে বেশ্যার বিয়ে রঙ্গ দেখে আটখানা হলেন তা বোঝা যায় তাদের ছড়াকাটা শুনে।
বিবাহ গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তদপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ‘তিন আইনে বিয়ে’। কারণ এ হল উনিশ শতকের নবতম বিবাহ প্রথা। এই বিড়ম্বনার শুরু আদি ব্রাহ্মসমাজের নতুন বিবাহ প্রথা প্রবর্তন (১৮৬১) এবং তারপরে, বাবু কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্ম বিবাহ রিফর্ম মনোবাঞ্ছায় এবং দুই ব্রাহ্ম নেতার লাঠালাঠির ব্যাপারে। এই ‘তুই থুলি না মুই থুলি’ দেখে ইংরেজ সরকার যে নেটিভ ম্যারেজ এ্যাক্টের পরিকল্পনা করছিলেন তা শিকেয় তুলে রাখেন এবং নামকরণ না করেই ১৮৭২-এ যে আইনটি বলবৎ হয় সেই হল তিন আইন। এই আইনের নানা প্যাঁচ পয়জার, সে সবে আমাদের দরকার নেই। এই বিবাহ আইনের মূল কথা তিনখানি হল : বিবাহ হয় একনিষ্ঠ, অর্থাৎ বিবাহিতেরা খামখেয়ালিতে একে অন্যকে ছাড়িয়া নূতন বিবাহ করিতে পারেন না। চতুর্দশ বর্ষ বালিকাদিগের সর্বনিন্ম বিবাহোপযুক্ত বয়স বলিয়া নির্দিষ্ট হইল। এই নূতন আইন তাহাদেরই জন্য বিধিবদ্ধ ব্যবহৃত হইয়াছে যাহারা প্রচলিত হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, য়িহদী প্রভৃতি, কোনও ধৰ্ম্মে বিশ্বাস করে না, এবং ঐ সকল ধৰ্ম্মের, নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে বিবাহ করিতে অনিচ্ছুক।
এখন কথা হল এইসব আইনি মারপ্যাঁচের সঙ্গে গোলাপের বাবু গোষ্ঠবেহারীর সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক কী?
সম্পর্ক একটু আছে বৈকি। একটি হিন্দু মেয়ে আর একটি হিন্দু বাবুর কেন তিন আইনে বিয়ে হওয়া প্রয়োজন তা একটু ভাবলেই বেরিয়ে পড়বে। বেজাত বেশ্যার সঙ্গে হিন্দু কুলোদ্ভবের বিবাহ দিতে কোনও টিকিধারী-ই সম্মত হতেন কি? তাই এই তিন আইনের খুঁট ধরে গোলাপ, তিনি মোহিনী বা সুন্দরী যাই হন, তার সঙ্গে দত্তবাবুর বিয়েটি শাস্ত্রসম্মত না হোক, আইনসম্মত করা গেল এবং যেহেতু এই বিয়ে রেজিস্টারি বিয়ে, দত্তবাবুর কাঁছা কোঁচা তুলে পালানোর পথটিও বন্ধ করা হল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। একে বেশ্যা, তায় তিন আইনে অ-হিন্দু বিয়ে। দত্তবাবুর পরিবার তাঁরে ত্যাগ দিলেন। খানিক অর্থকষ্ট সহ্য করে দত্তবাবু তাঁর মুরুব্বি উপেন্দ্রনাথ দাসের পথ ধরে বিলেত রওনা দিলেন এবং শোনা যায় একটি হোটেলে চাকরি নিলেন। তার কিছু পরেই তাঁর দেহান্তর হয়। ‘মিসেস সুকুমারী দত্ত’ একটি সদ্যোজাত কন্যাসন্তান নিয়ে মোচার খোলার মতো সংসার সমুদ্রে ভাসতে লাগলেন। Radicalism-এর জয়গানের এখানেই অন্ত হল। গোলাপ কিছুদিন একটি নাচ গানের স্কুল খুলে জীবনধারণের চেষ্টা করলেন, এমনকি নাটক লিখতে শুরু করলেন। ১৮৭৫ সালের ২৩শে অগাস্ট, নাটকটি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল কিন্তু তেমন দাগ কাটতে পারল না।
নাটকটির নাম অপূর্ব সতী। একটি বেশ্যার ভদ্রকুলবধূ হওয়ার ইচ্ছার কাহিনী এবং বিয়োগান্ত।
নাটকটির কভার পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে এটি হল–
"TRAGEDY!
TRAGEDY!
TRAGEDY!"
এই হল আমাদের গোড়ায় বলা তিন ‘সতী’ নাটকের তিন নম্বর এবং সর্বশেষ উল্লেখ।
কোথায় জীবনের শেষ কোথায় নাটকের শুরু বোঝা শক্ত। নাচতে গাইতে, কথা কইতে জানা এই বেশ্যাটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা নাট্যকার। সমাজ এক রঙ্গশালা বটে। তাঁর পরবর্তী জীবনের কথা প্রায় কিছুই লেখা নেই। মেয়েটিকে যথাসাধ্য শিক্ষিত করেছিলেন, প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করে একটি সম্ভ্রান্ত ‘ব্রাহ্মণ’ পরিবারে বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পা দেওয়ার অধিকার তাঁকে দেওয়া হয়নি।
অপূর্ব সতীর নায়িকা নলিনীর একটি গান–
"যদি নাহি পাই প্রাণের কানাই প্রাণ না ভাসে
নাথের উদ্দেশে, এদেশে সেদেশে, সন্ন্যাসিনী বেশে,
ভ্রমিব গহনে
নীরবে কাঁদিব, সবে সুধাইব, জীবন ত্যাজি ঝাঁপিয়ে জীবনে।।"
শেষ পংক্তিতে একটি paradox বা কূটাভাস আছে। “জীবন ত্যাজি ঝাঁপিয়ে জীবনে” কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ বা অনর্থ নিয়ে একটু চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ওটিই হল গোলাপ ওরফে সুকুমারীর মনের কথা।
“রঙ্গভূমি ভালবাসি
হৃদে সাধ রাশি রাশি
আশার নেশায় করি
জীবন যাপন।।”
–গিরীশ চন্দ্র ঘোষ।
সুকুমারী দত্তর অপূর্ব সতী কোনও কালজয়ী নাটক নয়। হরমণি নাম্নী এক বেশ্যা তার লেখাপড়া জানা মেয়ের জন্যে জাল ফেললে। তাতে ধরা পড়ল চন্দ্রকেতু ঘোষ নামক এক জমিদার তনয়। হরমণির মেয়ে নলিনী যখন সেই কচি বাবুটির প্রেমে ভীষণ পড়লে, তখন হরমণি লোভে পড়ে তাকে তরুবাবু নামক এক মক্কেলের কাছেই বেঁচে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কৃতকার্য হয় না। নলিনী চন্দ্রকেতুর সঙ্গে কাশীধাম যায় এবং গন্ধে গন্ধে চন্দ্রকেতুর পিতৃদেব তথায় পৌঁছিয়ে ছেলেকে বলপূর্বক কলকাতা আনয়ন করেন। নলিনী আত্মঘাতী হয়… ইত্যাদি। এই নাটকটি স্মরণীয় একটি বিশেষ কারণে। কুসুমকুমারী এই নাটকে তাঁর নিজের সত্তাকে দুই টুকরো করে মা মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। সূত্র হল সেই হাড়ি চাঁচা আর সেতার বাদন। নলিনী যে ভাষায় কথা বলে সে হল নাটকের ভাষা, তাতে শব্দের ঝংকার আছে, আবেগের ঘনঘটা আছে, যা নেই তা হল বাস্তবের ছোঁয়া। শুনলে মনে হয় যেন একটি নাটুকে মেয়েমানুষ ঘুরে ঘুরে রাধা সতীর অভিনয় করছে। হরমণি যে ভাষায় কথা কয়, সে হল কথ্য ভাষা; সে ভাষায় পালিশ কিছু নেই, কিন্তু সে ভাষা যে অভিজ্ঞতার ভাষা তা বোঝাটা শক্ত কিছু না।
"নলিনী: তুমি আমার সতীত্ব নাশের জন্য নানাপ্রকার চেষ্টা কচ্ছ। তুমি তোমার নিজের সতীত্ব নষ্ট করেছ বলে কি আমাকেও সেই পথগামিনী করতে চাও?
হর: আ মর বেটি! বেটি আমার কি সতীরে!– সতীপনা দেখছেন– আরে বেটি! সতীত্ব নিয়ে করবি কি?– সতীত্ব নিয়ে কি ধুয়ে খাবি?– না সতীত্বে পেট ভরবে? সেই জোগাড় কর, তারপর তখন আর চেষ্টা দেখিস। বেটির অরগণ নেই ছাড়গুন আছে।"
আরও একটি মজার ব্যাপার, ভাষা যে দুই জিভে কথা কইছে সে সুকুমারী দত্ত ভালোই জানেন, কারণ, হরমণি শুধু যে মেয়ের সতীপনাকে গাল পাড়ছে তা নয়। মেয়ের নাটুকে ভাষাকেও ভ্যাঙ্গাচ্ছে–
মেয়ে মায়ের কাছে চন্দ্রকেতুর প্রতি তার প্রেমের গভীরতা নিয়ে কাব্যপ্রবণ আক্ষেপ আর হরমণির প্রতিক্রিয়া—
"নলিনী: সেইদিন তাঁকে প্রাণনাথ বলে হৃদয়রাজ্যের রাজা করেছি— সেই অবধি তাঁর অধিনী বলে তাঁর চরণ সেবা করেছি। মা! আর অধিক কি বলব, সেই অবধি তাঁকে হর্তা কর্তা বিধাতা, আশ্রয় অবলম্বন বলে তাঁরই আশ্রিত হয়েছি।
হর: আহা! বেটি আমার ভিক্ষা চেয়ে প্রাণটা শীতল কল্লে রে! বেটি আমার কবিতা আওড়াতে লাগলেন (বিকৃত স্বরে) হত্তা কত্তা বিধাতা করেছি-– কটাক্ষপাত করেছি— মুণ্ডুপাত করেছি, বেটি আমার রাজরাজেশ্বরী হয়েছেন। (চতুর্থ অঙ্ক, প্রথম গর্ভাঙ্ক)"
Verisimilitude, authenticity ইত্যাদি বড় বড় তত্ত্ব আমরা ব্যবহার করতে চাইনে, তবে হরমণির মধ্যে গোলাপের গল্প আর তার মাহেশের জীবনটি যেন কেউ তুলে বসিয়ে দিল নাটকের পাতায়। আর নলিনীর প্রেমাবেগে একটি রংচং মাখা কথা বলা পুতুল বৈ আর কিছু পাওয়া গেল না। যে চরিত্র কলের পুতুলের মতো সাজানো গোজানো ভাষায় কথা বলে, সে থেটারে বসে একপ্রকার সহ্য করা যায়, কিন্তু জীবনে সে মানানসই হয় না। ঐটিই হল “জীবন ত্যাজিয়া ঝাঁপিয়ে জীবনে”র মূল ধরতাই। যে জীবন ঘেন্নার, সে জীবন ত্যাগ করলাম, কিন্তু যে সাজানো গোজানো জীবনে ঢোকার লোভ হল, তাতে ঠিক প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল না, সে রংচং-এ মাটির কাঠামো হয়ে রইল এবং ভেঙেও গেল। নলিনী সুকুমারী কিনা সেটা আজ বলা সম্ভব নয়, কিন্তু নলিনীর ভাবভঙ্গি, কথার ধরণে কোথায় যেন এক aspiring মিসেস সুকুমারী দত্তকে দেখতে পাওয়া যায়। নাটকের কভার পৃষ্ঠায় যে ট্র্যাজেডি কথাটি তিন তিনবার লেখা হয়েছে, তার আসল ব্যঞ্জনা নাটক ছাপিয়ে সংলাপ ছাপিয়ে, এক বেশ্যার ‘ভদ্রমহিলা’ হয়ে ওঠার মর্মান্তিক চেষ্টার রূপক বর্ণনা অর্থাৎ কিনা allegory হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
"যাহারা বিনোদিনীর ন্যায় অভাগিনী, কুৎসিত পন্থা ভিন্ন যাহাদের জীবনোপায় নাই, মধুর বাক্যে যাহাদিগকে ব্যাভিচারীরা প্রলোভিত করিতেছে, তাহারাও মনে মনে আশান্বিত হইবে যে, যদি বিনোদিনীর মতো কায়মনে রঙ্গালয়কে আশ্রয় করি, তাহা হইলে এই ঘৃণিত জন্ম জনসমাজের কার্যে অতিবাহিত করিতে পারিব। যাহারা অভিনেত্রী তাহারা বুঝিবে—কিরূপ মনোনিবেশের সহিত নিজ ভূমিকার প্রতি যত্ন করিলে জনসমাজে প্রশংসাভাজন হইতে পারে।" – শ্রী গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
বিনোদিনী দাসী, যাঁরে তাবৎ বাঙালি ‘নটি বিনোদিনী’ বলে থাকেন, আমার কথা আর আমার অভিনেত্রী জীবনে–র দৌলতে তিনি বাংলা সাহিত্যে একেবারে জাজ্বল্য হয়ে আছেন। যদি খুব ভুল না করি, তাহলে ইনিই এখনও পর্যন্ত একমাত্র মন্দ স্ত্রীলোক যাঁর জীবনী ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। এই যে ইনি বাঙালির সংস্কৃতিতে ফাইভ স্টার পেলেন, সে যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দৌলতে সে বোঝা কঠিন নয়। মহাপুরুষের আশীর্বাদধন্যা হলে বেশ্যা জাতে না উঠে যায় কোথায়। আমাদের বাসি খবরে প্রয়োজন নেই। কথার মধ্যেও যেমন কথা থাকে, সে রূপকই হোক বা আভাসই হোক, তা আমরা খুব জানি। তাই মন দিয়ে লেখাটি পড়ি। ভারী সুন্দর করে তিনি তাঁর রামকৃষ্ণ দর্শনের কথা বললেন–
“যখন তিনি অসুস্থ হইয়া শ্যামপুকুরের বাটিতে বসবাস করিতেছিলেন, আমি শ্রীচরণ দর্শন করিতে যাই তখন সেই রোগক্লান্ত প্রসন্নবদনে আমায় বললেন : “আয় মা বোস”, আহা কি স্নেহপূর্ণ ভাব! এ নরকের কীটকে যেন ক্ষমার জন্য সতত আগুয়ান! কতদিন তাঁহার প্রধান শিষ্য নরেন্দ্রনাথের (পরে যিনি বিবেকানন্দ স্বামী বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন) “সত্যম শিবম” মঙ্গলগীতি মধুর কণ্ঠে থিয়েটারে বসিয়া শ্রবণ করিয়াছি। আমার থিয়েটার কার্যকরী দেহকে এই জন্য ধন্য মনে করিয়াছি।”
কিন্তু ওই অংশে আর একটি কথা উঁকি দিচ্ছে। তিনি বলছেন, “নরেন্দ্রনাথের “সত্যম শিবম” মঙ্গলগীতি মধুর কণ্ঠে থিয়েটারে বসিয়া শ্রবণ করিয়াছি।” এইখানে একটু খটকা লাগার বিষয় … নরেন দত্তর গান থেটারে, এ কিরকম! তারপর বোঝা গেল, ওই গানটি তাঁর মনের ভেতর রয়ে গেছিল, সেই গান তিনি মনে মনে শুনতেন। এইবার গিরিশবাবু আর বিনোদিনীর কথাগুলো আবার বিবেচনা করে দেখা যায়– “কুৎসিত পন্থা” “ঘৃণিত জন্ম” আর “থিয়েটার কার্যকরী দেহ”। এই হল নাটুকে বেশ্যার ত্র্যহস্পর্শ। এই স্পর্শদোষ থেকে বাঁচার মন্ত্র হল ওই সত্যম শিবম জপমন্ত্র। ওই একরকম বেঁচে থাকার উপায়। পাঠক, বেশ্যার মন আর দেহ কি আলাদা? নিশ্চই তাই। থিয়েটার কার্যকরী দেহ রইল বাবুদের আর দর্শকের জিম্মা; মন শুনে গেল সত্যম শিবম। সেই মন্ত্র ধরে রাখার উপায়টি বাতলে দিলেন গিরিশবাবু–
“আমার অন্য কথা ভালো লাগিত না। গিরিশবাবু মহাশয় যে সকল বিলাতের বড় বড় অভিনেতা বা অভিনেত্রীর গল্প করিতেন, যে সকল বই পড়িয়া শুনাইতেন, আমার তাহাই ভালো লাগিত। মিসেস সিডনিস যখন থিয়েটারের কার্য ত্যাগ করিয়া দশ বৎসর বিবাহিতা অবস্থায় অতিবাহিত করিবার পর পুনরায় যখন রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন, তখন তাঁহার অভিনয়ে কোনও সমালোচক কোনও স্থানে কিরূপ দোষ ধরিয়াছিল, কোনও অংশে তাঁহার উৎকর্ষ বা ত্রুটি ইত্যাদি পুস্তক হইতে পড়িয়া বুঝাইয়া দিতেন। […] বঙ্কিমবাবুর “দুর্গেশনন্দিনী” কোন পুস্তকের ছায়াবলম্বনে লিখিত, “রজনী” কোন পুস্তকের ভাব সংগ্রহে রচিত, এইরকম কত বলিব। গিরিশবাবু মহাশয়ের ও অন্যান্য স্নেহশীল বন্ধুগণের যত্নে ইংরাজি, গ্রীক, ফ্রেঞ্চ, জার্মানি প্রভৃতি বড় বড় অথরের কত গল্প যে আমি শুনিয়াছি তাহা বলিতে পারি না। শুধু শুনিতাম না, তাহা হইতে ভাব সংগ্রহ করিয়া সতত সেই সকল চিন্তা করিতাম।”
এই গিরিশবাবু মহাশয়ের কারণেই বিনোদিনীর মুখের ভাষা নাটুকে পালা হয়ে পড়ল না। সেই সদাশয় ব্যক্তি বিনোদিনীর কার্যকরী দেহের থেকে মনটিকে টেনে বার করে নিলেন; ধুলো ঝাড়লেন, ঘষলেন, মাজলেন, তারপর সেই মন যখন কথা কইল, তখন সে থিয়েটার কার্যকরী দেহর ছায়া চকিতের ন্যায়ও ভাষায় ছাপ ফেলল না।
মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন বড় বিচিত্র। বিনোদিনী বলছেন–
“গিরিশবাবুর সঙ্গে আমার জোর জবরদস্তি মান অভিমান রাগ প্রায়ই চলত। তিনি আমায় অত্যধিক আদর দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন। আমি তাই বড্ড বেড়ে উঠেছিলুম, মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করতুম, কিন্তু তার জন্য তিনি আমায় একটি দিনের জন্যও তিরস্কার করেননি, অনাদর অযত্ন তো করেনইনি। তবে আমি একটি দিনের জন্য এমন কোনও কাজ করিনি, যাতে তাঁর এতটুকু ক্ষতি হয়।”
বেড়ে ওঠার কারণ একটুখানি ছিল বৈকি। যে সময়ের কথা তিনি বলছেন তখন গিরিশবাবুর হাতে গড়া এই বেশ্যাটি Prima Dona of Bengali Theatre; Flower of Native Theatre. বাঙালি বাবুরা কোন ছার, সায়েবরাও তখন তাঁর কদর করছেন। বিনোদিনী মনে কী ভেবেছিলেন কে জানে। নাটুকে মেয়েছেলে যে আসলে নাটুকে বাবুদের সম্পত্তি, হাতের পুতুল, তা বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল তাঁর। যে কথাটি তিনি তেমনভাবে পষ্টাপষ্টি বলে উঠতে পারলেন না তা হল তাঁর বিনিময়ে গিরিশবাবুর স্টার থিয়েটার লাভ। আমার কথা–য় শুধু লেখা হল–
“নানা কারণের প্রধান কারণ যে আমায় অনেক রূপে প্রলোভিত করিয়া কার্য উদ্ধার করিয়া লইয়া আমার সহিত যে সকল ছলনা করিয়াছিলেন তাহা আমার হৃদয়ে বড় লাগিয়াছিল। থিয়েটার বড় ভালোবাসিতাম তাই কার্য করিতাম। কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই। তাই অবসর বুঝিয়া অবসর লইলাম।”
১৮৮৭-র পয়লা জানুয়ারী তাঁর জীবনের শেষ অভিনয়। সেই স্টার থিয়েটারেই। নল দময়ন্তী-র দময়ন্তী, বেল্লিক বাজার–এর রঙ্গিনী। দুটিই গিরীশবাবুর লেখা। একই রাতে একটি চরিত্রে সতীর সতী, তস্য সতী, যারে কয়, sublime character; দময়ন্তী নলকে বলছেন–
"প্রভু, কি দিয়ে করিব দেব-পূজা?
দেহ, প্রাণ,–- কিছু আর নহে মোর;
দেবগণে সাক্ষী করি’ কহি—
সকলই হে দিয়েছি তোমায়,
জানি, নাথ, তুমি হে আমার
দানে তবে নাহি অধিকার।
ধর্মপত্নী আমি তব;
দেহ মোরে পতি-পূজা উপদেশ;
কহ, নাথ, স্বয়ম্বরে দিবে দেখা?"
পরবর্তীটিতে এক মেথরানী, যে অশ্লীল নাচ গানে স্টেজ মাতায়। রঙ্গিনী গাইছে–
"মায় বাপ জিসিকে রোয়ে,
জরু ছোড়ে কে কসবি ঘরমে শোয়ে,
হাম ওস্কে দেওয়ে; গঙ্গা কিরা ময় সাচি কহি॥
যো না মানে দেওতা ভি না মানে পীর,
বে পয়জারসে যিসিকে না নোয়ে শির,
সরাব মে রহে যো মস্তাগীর,— যো
ছোড়া হ্যায় জাত,
ডেম (damn) ডেম বলে ছোড়হে লাথ,
উসিকে দেনে ময় খাড়া রহি॥"
দময়ন্তীর ভোল পাল্টে রঙ্গিনীর নাচটি নাচতে নাচতে ফ্লাওয়ার অফ নেটিভ থিয়েটার কি ভাবছিলেন কে জানে। এ নাটকও গিরিশবাবুর লেখা। এবং প্রহসন। নল দময়ন্তীতে বিনোদিনী দময়ন্তী, নল নাট্যকার গিরিশবাবু স্বয়ং। তার আগে ১৮৮৩ সালেও এই স্টার থিয়েটারেই গিরিশবাবুর সঙ্গে তাঁরই লেখা দক্ষ যজ্ঞ। সে নাটকেও বিনোদিনী সতী, গিরিশবাবু মহাদেব। সেটিই স্টার থিয়েটরে তাঁর প্রথম অভিনয়।
বিনোদিনীর জীবনে গুর্মুখ রায়কে বাদ দিয়েও, পাঁচ পাঁচটি বাবু। রাধারমণবাবু, ছোটবাবু, গিরিশবাবু। গিরিশবাবু ঈশ্বর। তিনি কাদার তাল আর পাঁকের ময়লা তুলে প্রতিমা তৈয়ের করলেন। তারপর সে প্রতিমা সোনার দরে বেচলেন। আর এক বাবু রীতিমতো তলোয়ার নাচানো ‘সম্ভ্রান্ত যুবক বাবু’। তিনি নিজে বিয়ে শাদি করে থিতু হয়ে, বিনোদিনীর নতুন বাবুর খবর পেয়ে তলোয়ার বাগিয়ে তাঁর একদা বাঁধা মেয়েমানুষকে কাটতে গেলেন। আর একজন ‘রাঙা’ বাবু তাঁকে ছায়া দিলেন ১৮৮৭ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত। একটি মেয়েও হয়েছিল তাঁদের। মেয়েটির নাম ছিল শকুন্তলা। ১৯০২-এ সে মারা যায়। ১৯১২তে মারা যান দুই বাবু : গিরিশ বাবু আর ‘রাঙা’ বাবু। তলোয়ার বাবুটি আগেই গিয়েছিলেন। বিনোদিনী সম্পর্কে পড়তে গিয়ে দেখা যায় এই ‘রাঙা’বাবুটিকে কেউ বলেছেন ‘স্বামী’, কেউ বলেছেন ‘বেনেফ্যাক্টর’। ‘স্বামী’ কথাটি কিন্তু বিনোদিনী একবারও উচ্চারণ করলেন না, কারণ মিথ্যা বলা তাঁর ধাতে ছিল না। গিরিশবাবুর লেখা ভূমিকা তিনি প্রথম সংস্করণে ছাপাননি কারণ, "তাহাতে অনেক সত্য ঘটনার উল্লেখ ছিল না”। সুতরাং তাঁর একটি ‘প্রাণের দেবতা’ (রাঙা বাবু) থাকলেও, তাঁর ‘মাথা মুণ্ড’ জীবনীতে তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তিনি বেশ্যাই ছিলেন, এবং বেশ্যার ব্যবহারই পেয়ে গেছেন, যতই সতী আর দময়ন্তী সাজুন না কেন–
"পতিপ্রেম সাধ আমাদের আছে, কিন্তু কোথায় পাইব? কে আমাদের হৃদয়ের পরিবর্তে হৃদয় দান করিবে? লালসায় আসিয়া প্রেমকথা কহিয়া মনোমুগ্ধ করিবার অভাব নাই, কিন্তু কে হৃদয় দিয়া পরীক্ষা করিতে চান যে আমাদের হৃদয় আছে? আমরা প্রথমে প্রতারণা করিয়াছি, কি প্রতারিত হইয়া প্রতারণা শিখিয়াছি, কেহ কি অনুসন্ধান করিয়াছেন? (…) অনেক প্রদেশে জল জমিয়ে পাষাণ হয়। আমাদের তাহাই (…) যাহা হউক, এখন ও কথা থাকুক।"
গৌরবে বহুবচনের এমন সার্থক প্রয়োগ খুব কম দেখা যায়।
১৯১২-র ৯ই ফেব্রুয়ারি গিরিশচন্দ্রের প্রয়াণ। কলকাতার টাউন হলে সর্বশ্রী সারদাচরণ মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহতাবের সভাপতিত্বে যে বিরাট শোকসভার ডাক দিলেন সেখানে নাট্যাচার্যের প্রতি সম্মান আর শুদ্ধতার অজুহাতে অভিনেত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। প্রতিবাদে স্টার থিয়েটারের “সুধাকন্ঠী” সুশীলাবালার (১৮৮৪-১৯১৫) নেতৃত্বে অভিনেত্রীরা গিরিশচন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের অধিকার দাবি করেছিলেন। দাবি মঞ্জুর হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৮ই সেপ্টেম্বর অভিনেত্রীদের তরফে একটি শোকসভা হয় স্টার রঙ্গমঞ্চে। সুশীলাবালার জিজ্ঞাস্য ছিল— ‘নারীকে বেশ্যা বানায় যাঁরা তাঁরা বেশ্যাকে ঘৃণা করে কোন মুখে?’ শোকসভায় সুশীলাবালা বলেছিলেন, ‘…পতিতা আমরা, সমাজ বর্জিতা বটে— কিন্তু আমরা মানুষ। …প্রিয়জন বিরহে যদি ক্রন্দনের অধিকার থাকে,… বুকফাটা হাহাকারে যদি দোষ না থাকে তবে আমাদের শোক দূষণীয় হইবে কেন?’
এই প্রশ্নটির সদুত্তর কোনও Reformist অবলাবান্ধব দিতে পারেননি বলেই জানি। নাট্য ইতিহাসের রেজিস্টারি তাই বলে।
বিনোদিনীর পর ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’ তারাসুন্দরী, ‘নটকুলমণি’ কুসুমকুমারী, ‘সুধাকন্ঠী’ সুশীলাবালা, ‘সংগীতনিপুণা’ নরীসুন্দরী, সারদামণির স্নেহ ধন্যা নীরদাসুন্দরী… এমন আরও কত পাপিষ্ঠার কথা অ-বলা রয়ে গেল। তাঁদের সম্ভবত কোনও গিরিশবাবু জোটেনি… তাঁরা তাই চকিতের ন্যায় মিলিয়ে গেলেন… কতগুলো পোকায় কাটা আবছা ছবি শুধু রয়ে গেল, আর কোনও কোনও সুভাগিনীর ক্ষেত্রে, গুটি কতক নেহাতই কাঁচা, অপটু কবিতা।
শুরুরও শুরু থাকে। সর্বনাশের গোড়াপত্তন যে Hindoo এনলাইটেনমেন্ট-এ সে ব্যাপারটি পরিষ্কার। একটি পোকায় কাটা বইয়ের পাতা উল্টে দেখা যায়, ১৮৩৭-এর ২৯শে মার্চ গভর্নমেন্ট হাউসে হিন্দু কলেজের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ছাত্র-বাবুরা শেক্সপিয়রের খানিক খানিক অভিনয় করেন। এরপরই দেখা যায় ১৮৫১-র ৭ই অগাস্ট বটতলায় ডেভিড হেয়ার একাডেমী শুরু হয় হাটখোলার বাবু গুরুচরণ দত্তের উদ্যোগে। ১৮৫৩-তে সে একাডেমীর হিন্দু ছাত্রেরা শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অফ ভেনিসের Act IV Scene One-এর আবৃত্তি করেন। সমাচার দর্পণ তার actor-দের তালিকা ছেপে বেশ ফলাও করে খবরটি ছাপিয়েছিল। অভিনেতার তালিকায় দেখা যায় Portiar ভূমিকায় Obhoychurn Bose, Nerissa-র ভূমিকায় Rajendranarain Mitter আর Nelly Gray-র ভূমিকায় Gobinchunder Dutt।
আলোকপ্রাপ্ত রাজারামরা যে ঐ সময় থেকেই নাট্যরঙ্গে মজেছেন তা জানা গেল। তবে কি না নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে যে ব্যাটাছেলে ছাড়া গতি নেই তা জলবৎ তরলম্। নব্য বাবুরা তাতেই খুশি। মেয়েমানুষ যে পাড়ায় গেলে পাওয়া যায় সে পাড়ায় যায়ই বা কে, তাদের স্কুলের বাবুদের সঙ্গে অভিনয় করতে দেওয়ার মতো নিঘিন্নে কাজই বা করে কে। অতএব, Obhoychurn বিনে গতি নেই।
সায়েবদের থেকে মদ ছাড়াও বাবুরা পেয়েছিলেন শেক্সপীয়ার। সে বেশ সকাল-সকালই পেয়েছিলেন দেখা যাচ্ছে। তাঁরা ইংরিজি নাটক দেখতে বেশ যেতেন, এমনকি অভিনয়ও যে করতেন এক-আধটু সে-ও শুনলাম। দুই চার পত্রিকাতে সে সবের রিভিউও বেরোত। কিন্তু আমার ওসব উচ্চ বিষয়ে মন নেই। আমি খালি বাজে জিনিস খুঁজে বেড়াই। ১৮৪৮ সালে Sans Souci থিয়েটারে ‘ওথেলো’-র অভিনয় হয়। ২১শে অগাস্ট ‘সংবাদ প্রভাকর’ লেখে–
“গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর সানশশি (Sans Souci) নামক থিয়েটারে বেশ সমারোহ হইয়াছিল, বহুদিবস হইল ঐরূপ সমারোহ হয় নাই, কলিকাতা ও অন্যান্য স্থানের সাহেব ও বিবি এবং এতদ্দেশীয় বাবু ও রাজাদিগের সমাগম দ্বারা নৃত্যাগারের শোভা অতি মনোরম হইয়াছিল (…) এতদ্দেশীয় নর্তক বাবু বৈষ্ণবচাঁদ আঢ্য ওথেলোর ভঙ্গি ও বক্তৃতার দ্বারা সকলকে সন্তুষ্ট করিয়াছেন, তিনি কোনো রূপে ভীত অথবা কোনো ভঙ্গির অবহেলন করেন নাই, তিনি চতুর্দিগ হইতে ধন্য ২ শব্দ শ্রবণ করিয়াছেন এবং তাঁহার উৎসাহ ও সাহস বদ্ধমূল হইয়াছে, যে বিবি ডেসডিমোনা হইয়াছিলেন তিনিও বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠিতা হইয়াছেন..”।
এর পরে আরও খানিক নাট্য সমালোচনা আছে বৈষ্ণবচাঁদ আঢ্যর অভিনয় নিয়ে, কিন্তু ওই যে বললাম নিন্দুকের নজর খালি বাজে খবর খোঁজে, নজর পড়ল ‘বিবি’ ডেসডিমোনার ওপর। প্রশ্ন হল, এই বিবি কোনও ইহুদি বিবি কিনা, কারণ তাঁদের সৌন্দর্য বিষয়ে দু-চার কথা ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদের মুখে শোনা যায় বটে। কারণ সেইসময় কিছু ইংরেজ বিবির কলকাতায় যাতায়াত হয়েছিল। বামাবোধিনী বিবি শিক্ষয়িত্রী রেকমেন্ড করছে। নাট্যজগতেও দুই বিবির খোঁজ পাওয়া যায়; মিস এলিস আর মিসেস গ্রেগ। মিস এলিস-এর খবরটি বেশ চমকপ্রদ । ১৮৫৩, ৬ই অগাস্ট ‘সংবাদ প্রভাকর’ বলছে–
“অবগতি হইল ওরিয়েন্টালি ছাত্ররা এক প্রকাণ্ড ভাণ্ড কাণ্ড ফাঁদিয়াছেন, এতদিন মেন্ Clinger সাহেব একাকী অধিকারী হইয়া বিলিতি যাত্রার উপদেশ দিতেছিলেন। এইক্ষণে এক শ্বেতাঙ্গী শ্ৰীমতী তাহার অধিকারিণী হইয়াছেন, ইহার নাম ইলিস, যিনি আসিয়া ভাব ভঙ্গির শিক্ষা প্রদান করিলে নাটকের আরও চটক পড়িবেক্।”
এই বিবি এলিসের গড়ের মাঠে ‘নৃত্যাগার’ ছিল এবং ১৮৫১-র ২৬শে এপ্রিল সংবাদ প্রভাকর জানাচ্ছে যে সেই নৃত্যাগার ‘পবন ঠাকুরের কৃপায় পতিত হইয়াছে’।
যাই হোক, চটক কতটা পড়িয়াছিল বলা যায় না তবে বিলিতি বিবিদের যে প্রথম যুগের নাট্যশালায় যাতায়াত ছিল তা দেখাই যাচ্ছে। ১৮৫৪-র ১৭ই মার্চ ওরিয়েন্টাল থিয়েটার, ২৬৮ গরানহাটা, চিৎপুরে রোডে মার্চেন্ট অফ ভেনিস আবার পেশ করা হয়। এবার Portia-র ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে মিসেস গ্রেগ-কে। The Bengal Harkaru জানাচ্ছে “that will be her last performance and indeed the close of her last day’s sojourn in Bengal.” এই সব বিবিদের সুখ-দুঃখের কথা লিখব কোনও একসময়। এনারা ছিলেন মহারানীর আমলের ‘Cargo’…। জাহাজ ভর্তি হয়ে এঁরা এদেশে আসতেন ভাগ্য খুঁজতে। কেউ বা গরিব বাপের মেয়ে, বর জোটেনি, তাই চলেছেন বিদেশে বরের খোঁজে। কারও স্বামী ছেড়ে গেছে অথবা কোনও লম্পট বদমাইশের হাত থেকে পালিয়ে তাঁরা নতুন দেশে নতুন জীবন খুঁজছেন। যাঁদের ভাগ্যদেবী নতুন দেশেও মুখ ফিরিয়ে নিতেন, তাঁরা আবার ‘Returned Cargo’ হয়ে ফিরে যেতেন নিজেদের দেশে। মিসেস গ্রেগ তেমনি কেউ ছিলেন কিনা কে জানে…
বাবুদের নাট্যশালায় ফিরি। ১৮৫৭-র জুলাই মাসে ছাতুবাবুর প্রাসাদে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তল’-এর অভিনয়ে নারীচরিত্রে তখনও বাবুদের রমরমা। Cast list-টি নিম্নরূপ–
শকুন্তলার ভূমিকায় ছাতুবাবুর পৌত্র বাবু শরৎ চন্দ্র দেব।
অনসূয়া: অবিনাশ চন্দ্র ঘোষ।
প্রিয়ম্বদা: ভুবনমোহন ঘোষ।
অভিনয়ের পরে এক বাবু জানালেন: “যখন বিশ হাজার টাকার অলংকারে মণ্ডিত হইয়া শরৎবাবু দীপ্তিময়ী শকুন্তলার রানিবেশ দেখাইয়াছিলেন তখন দর্শকবৃন্দ চমৎকৃত হইয়াছিলেন।”
মনে মনে ভাবলাম, হইবেনই। আশ্রমবাসিনী শকুন্তলার বিশহাজারী ঠমক দেখে দর্শককুল ভিরমি যে খাননি সেটা শরৎবাবুর কপালগুণ।
বাবু যতীন্দ্র মোহন ঠাকুরের পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গ নাট্যালয়ে ১৮৬৬-তে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের অভিনয় হয়। তার কাস্ট লিস্টটি নিম্নরূপ:
বিদ্যা: মদনমোহন বর্মন (খোট্টা)
হিরে মালিনী: শ্রী কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়
সুলোচনা চপলা (রাজকন্যার দাসী): শ্রী ষষ্ঠীদাস মুখোপাধ্যায়, শ্রী যদুনাথ ঘোষ, শ্রী হরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়
বিমলা: শ্রী নারায়ণ চন্দ্র বসাক।
পিছিয়ে আসা যাক ১৮৫৯-এ। তার একটি বিশেষ কারণ আছে। ১৮৫৯ সালে বঙ্গরঙ্গমঞ্চ জমজমাট। জনৈক রামদাস সেন ১০ই মে সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়ে ছড়া কাটলেন:
"নিত্য নিত্য শুনতে পাই অভিনয় নাম।
অভিনয়ে পূর্ণ হলো কলিকাতা ধাম।।
হায় কি সুখের দিন হইলো প্রকাশ।
দুঃখের হইলো অন্ত সুখ বারোমাস।।
দিন দিন বৃদ্ধি হয় সভ্যতা সোপান।
দিন দিন বৃদ্ধি হইলো বাংলার মান।।
হায় কি সুখের দিন হইলো উদয়।
এদেশে প্রচার হলো নাট্য অভিনয়।।"
এবার পাইকপাড়ার রাজাদের কথা পৃথকভাবে না লিখলে অপরাধ হবে। তাঁদের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির নাট্যশালায় বড় বড় মানুষের পায়ের ধুলো পড়ত। রাজা গজারা ছাড়াও তাঁদের বেলগাছিয়া নাট্যশালায় যাঁরা যেতেন তাদের মধ্যে ছিলেন বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র, শ্রীযুক্ত পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন। বাংলাদেশের ছোট গবের্নের শ্রীযুক্ত মান্যবর হেলিডে সায়েবেরও নাম পাওয়া গেল। কিন্তু আর একটি গুরুতর কারণে এই নাট্যশালা বিশিষ্ট। এই মঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নর ‘রত্নাবলী’ নামে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়, তা দেখে মোহিত হয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামধারী একজন বিলেত ফেরত বয়ে যাওয়া বাবু। তিনি তখন সদ্য সদ্য মাদ্রাজ থেকে কলকাতা এসেছেন এবং কলকাতা পুলিশ আদালতে কেরানির চাকরি নিয়েছেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা যে কী ছিল সে বাংলাদেশের তাবৎ মানুষ জানেন, ও নিয়ে বেশি বলার প্রয়োজন নেই। তা সেই অবস্থা থেকে তাঁর উদ্ধার পরিকল্পে তাঁর বন্ধু বাবু গৌরমোহন বসাক তাঁর সঙ্গে এইসব বড়মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেন। রত্নাবলী নাটক দেখতে যে সব সায়েব সুবো আসতেন, তাঁদের জন্যে একখানি ইংরিজি অনুবাদ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, পাইকপাড়ার রাজা শ্রীযুত প্রতাপ চন্দ্র সিংহ বাহাদুর সেই অনুবাদটির বরাত তাঁকেই দেন। পাওনা ধার্য্য হয়েছিল ৫০০ টাকা।
এই রত্নাবলী নাটক দেখেই পুলিশ কোর্টের কেরানির নাটক লিখতে সাধ গিয়েছিল। ফলশ্রুতি স্বরূপ ‘শর্মিষ্ঠা’ এবং বঙ্গসাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ’র তোলপাড়।
কিন্তু আমরা এখানে মাইকেল গাথা রচনা করতে বসিনি। পাঠক যদি এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ চান তবে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ বইটি পড়বেন। আরাম পাবেন। যাইহোক, শর্মিষ্ঠার অভিনয় হল এবং কশ্চিৎ রাজা ঈশ্বর চন্দ্র সিংহ বন্ধু গৌরদাস বসাককে যে Dramatis Personae-খানি পাঠালেন তাতে দেখা গেল:
Debjani: Hemchunder Mookerjee
Sharmista: Krishtodhon Banerjea (a new comer)
Purnika: Kally Das Sandel (formerly our dancing girl)
Dabika: Aghor Chunder Dhagria
Notee: Chunilal Bose (as before)
Maid Servant: Kally Prasanna Mookerjee
Dancing Girls: Same as before plus Bankim chunder Mookerjee.
বড় বিষ্ময়ের বিষয়, ১৮৫৯-১৮৬৬ নাক উঁচু উচ্চবর্ণের বাবুরা ‘মেড়ো’ আর ‘খোট্টা’দের সঙ্গে অবলীলায় নাট্য কর্ম করেছেন, কোথাও বাধেনি। বোধ করি এই সব মেড়ো ও খোট্টা পথ ভুলে হিন্দু কলেজ বা সমগোত্রীয় কোনও কলেজে মনোভুলে ঢুকে পড়েছিলেন, তাতেই ভাগ্যক্রমে এঁদের কুলীন সংসর্গ হয়েছিল…।
থিয়েটার-এ ১৮৫৫-৫৭-র আগে স্ত্রীলোকের আমদানি হয়েছিল কিন্তু তাঁরা ধোপে টেকেননি। দাড়ি-চাঁছাদের দিয়েই নাট্যমোদীদের সন্তুষ্ট রাখা হচ্ছিল তার কারণ সুশীলারা দুষ্প্রাপ্য এবং দুঃশীলাদের ছোঁয়াচ বঙ্গ সমাজের ন্যায়বাগীশরা তেমন ভালো চোখে দেখেননি।
বাবু নবীন চন্দ্র বসুর এমনি বুকের পাটা যে ১৮৩৫-এ তাঁর নাট্যশালার বিদ্যাসুন্দর অভিনয়ে চার চারটি মন্দ স্ত্রীলোককে তিনি মঞ্চে ঠেলে তুললেন। তাঁদের প্রমোশন হল। তাঁদের তিনজনের খবরের কাগজ পঞ্চমুখে প্রশংসা করল। আমরা অভিনেত্রীদের নাম জানলাম– রাধারাণী, জয়দুর্গা, রাজকুমারী ও বৌহরো ম্যাথরাণী। আরও জানলাম যে, এঁদের সবাইকে পতিতালয় থেকেই অভিনয়ের জন্য আনা হয়েছিল। গুণীজন রাধারাণী, জয়দুর্গা, রাজকুমারীর গুণগান গাইলেন কিন্তু বৌহরো ম্যাথরাণীর প্রসঙ্গ উঠতে দেখলাম না কোথাও। বোধ করি নামখানি তাঁদের জিভে বেঁধেছিল। ম্যাথরাণী তলিয়ে গেলেন। রক্ষণশীল সমাজ চুপ করে রইল না। সুলভ সমাচার পত্রিকায় লেখা হল–
"সিমলার কতগুলি ভদ্রসন্তান বেঙ্গল থিয়েটার নাম দিয়া আর একটি থিয়েটার খুলিতেছে। ….যে যে স্থানে পুরুষদের মেয়ে সাজাইয়া অভিনয় করতে হয়, সেই স্থানে আসল একেবারে সত্যিকারের মেয়েমানুষ আনিয়া নাটক করিলে অনেক টাকা হইবে-– এই লোভে পড়িয়া তাঁহারা কতগুলি নটীর অনুসন্ধানে আছেন।… মেয়ে নটী আনিতে গেলে মন্দ স্ত্রীলোক আনিতেই হইবে, সুতরাং তাহা হইলে শ্রাদ্ধ অনেক দূর গড়াইবে। কিন্তু দেশের পক্ষে তাহা নিতান্ত অনিষ্টের হেতু হইবে।"
বাবু নবীন চন্দ্র বসুর নাট্যশালা বেঙ্গল থিয়েটরের দরজা বন্ধ হলে কিছুদিন বঙ্গসমাজ ভরাডুবির হাত হতে রক্ষে পেলেন। এর পরবর্তী সময়ে Kally Prasanna Mookerjee, Chunilal Bose আদিরা দাড়ি কামিয়ে রং মেখে শাড়িটি পরে স্টেজ আলো করতে থাকলেন।
১৮৭৩ সালে ছাতুবাবুর নাতি তাঁর দালানের সামনে মাঠে ন্যাশনাল থিয়েটার দিলেন। এই হল প্রথম পেশাদারি থিয়েটার। বাবুদের দালান থেকে নাট্যকলা পথে নামলে। আর ছাতুবাবুকে মাইকেলবাবু উজোতে লাগলেন: “তোমরা স্ত্রীলোক লইয়া থিয়েটার খোলো, স্ত্রীলোক না লইলে কিছুতেই ভালো হইবে না” …so on and so forth। কথায় আছেই ‘সঙ্গদোষে শিলা ভাসে’। তাঁর সঙ্গে তাল দিয়ে নাচতে লাগলেন শরৎবাবুর (ছাতুবাবুর নাতি) ভগ্নিপতি Mr. O.C Dutt., বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায় (এঁর কথা পূর্বে বলা হয়েছে), ন্যাদাড়ু গিরিশ, অর্থাৎ বাবু শ্রীযুত গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, বটুবাবু, বাবু প্রিয়নাথ বসু, ছাতুবাবু স্বয়ং এবং আরও তিন চার immoral ভদ্রসন্তান। এইবার ষোলো কলা পূর্ণ হল। মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক স্টেজে উঠল, বাবুরা আবারও জাতে তুললেন চার বেশ্যাকে। তাঁরা হলেন: গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী, জগত্তারিণী, শ্যামাসুন্দরী।
খবরের পাতায় ইংরিজি বাংলায় সোরগোল পড়ে গল। মহা হাঙ্গামা। ১৮৭৩-এর ১৮ই অগাস্ট, হিন্দু প্যাট্রিয়ট বললেন–
"…Mr Michael Modhusudan Datta’s classic drama of Sarmistha was selected for the first performance. The actors performed their parts very creditably, the two actresses, who are professional women, we are informed, were most successful. We wish this dramatic corps had done without the actresses. It is true that professional women join the jattras and natches, but we had hoped that the managers of the Bengali Theatres would not bring themselves down to the level of Jattrawallas."
১২৮০-র ১৪ই ভাদ্র ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকায় মনমোহন বসু ব্যঙ্গ করে লিখলেন–
"…বিলাতে রঙ্গভূমিতে স্ত্রীর প্রকৃতি স্ত্রীর দ্বারাই প্রদর্শিত হয়। বঙ্গদেশে দাড়ি গোঁপ ধারী (হাজার কামাক) জ্যেঠা ছেলেরা মেয়ে সাজিয়া কর্কশ স্বরে সুমধুর বামা স্বরের কার্য করিতেছে। ইহা কি তাঁহাদের ন্যায় সমাজ সংস্কারক সম্প্রদায়ের সহ্য হয়? (…) অতএব ‘আন্ স্ত্রী!’ (…) বাঁচিয়া থাকিলে আরও কত কি দেখিতে পাইবো। কিন্তু এত সভ্যতার তেজ সহ্য করিয়া বাঁচিয়া থাকা দায়।"
১৫ই জানুয়ারী ১৮৭৪ দেখলাম অমৃতবাজার সমাজ পরিত্যক্ত ধর্ম বহির্ভূত স্ত্রীলোকদের নিয়ে নাটক করানোয় আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে এই করতে গিয়ে যদি সমাজের একজন লোককেও পরিহার করতে হয় তবে সে বড় দুঃখের বিষয় হইবেক। অমৃতবাজারের আশঙ্কা একেবারে যে ননসেন্স তা বলতে পারা গেল না। শ্রীযুত পণ্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর শর্মা প্রতিবাদে পাপ থিয়েটার সংসর্গ ত্যাগ করলেন। ১৮৭৩-এর ২৯শে জুন দত্তোকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন দেহ রাখলেন। Dear Vid-এর কার্যকলাপ তাঁকে দেখে যেতে হল না।
পাঠক, এইবার কামসূত্রের ৫৮ নম্বর সূত্র, যেটি এই অংশের মাথায় লটকেছি, সেটি দেখুন। নটী এবং শিল্পকারিকা যে আদতে বেশ্যা যেহেতু তাঁরা নিজেদের expose করে থাকেন (প্রকাশ বিনষ্টা) সে তো বাৎস্যায়ন কোন মান্ধাতার আমলে বলেই গেছেন। এঁদের দিয়ে কাম প্রশমন হয়। উচ্চ সংস্কৃতি হয় কি? তার ওপর যখন তারা আসে খোদ বেশ্যাপাড়া থেকে তখন সোনায় সোহাগা। আদর্শ হিন্দু বংশোদ্ভূতরা করেন কী? ১৮৭৪-এর জানুয়ারী মাসে যখন মাইকেল-এর হতভাগ্য ছেলেপুলেদের সাহায্যার্থে আবার ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক মঞ্চস্থ হয়, দুটি অসমসাহসিনী ব্রাহ্মিকা সেই বেশ্যাদোষ দুষ্ট নাটক দেখতে গেছিলেন। প্রকারান্তরে তাঁদের সাবধান করে দেওয়া হয়।
১৮৭৩ থেকে শুরু হল আমোদের ছড়াছড়ি। বাবু গিরীশ চন্দ্র ঘোষ ‘নোটো গিরীশ’ হতে প্রমোশন পেলেন। ‘মেঘনাদ বধে’ তাঁর অভিনয় দেখে ‘সাধারণী’র সম্পাদক শ্রীযুত অক্ষয় চন্দ্র সরকার তাঁকে ‘Garrick of Bengal’ শিরোপা দিলেন। সতীর true definition নিয়ে তিন তিনটে নাটক লেখা হল আর ওরই মাঝে দু’ দশটি বেশ্যা জাতে উঠলেন।
বেশ্যাকে জাতে উঠতে হলে কি করতে হয়? না, নাচতে হয়, গাইতে হয়, সর্বোপরি ভদ্রলোকের ভাষায় কথা কইতে হয়। যাঁরা সেসব পারলেন তাঁরা নোটো বাবুদের নেকনজরে পড়ে তরে গেলেন। যাঁরা সরস্বতীর আশীর্বাদ পেলেন না তাঁরা শুধু বাবুদের সঙ্গ করে মরলেন। ‘সধবার একাদশী’র নাটকের বেশ্যার নাম কাঞ্চন। তাঁর মনোবেদনাটি নিম্নরূপ–
"কাঞ্চন: অটলবাবু আমার ওপর বড় নির্দয়। উনি সাতদিন ভাঁড়য়ে একদিন যান। উনি কত বড় মানুষ, আমরা গরিব, আমাদের বাড়িতে উনি গেলে ওনার মানের খর্ব হয়– আমরা নাচতে জানিনে, গাইতে জানিনে, কথা কইতে জানিনে, কিসে ওর মনোরঞ্জন করবো?
অটল: আমি তো কাল গিচলেম।
কাঞ্চন: চকিতের ন্যায়।
নিম: শালী আমার সঙ্গে কথা কইলে যেন হাঁড়িচাঁচা ডাকতে লাগলো, এখন কথা কচ্ছে যেন সেতার বাজছে।
—প্রথম অঙ্ক প্রথম গর্ভাঙ্ক"
কাঞ্চনের অভিমানের ফাঁক দিয়ে “চকিতের ন্যায়” মনোরঞ্জনের যে বাসনা দেখা গেল, তা নাটুকে বুলি, সে ভাষা কাঞ্চনের নয়, কোনও মাতাল বাবুর কপচানো এস্টেজের কথা তোতা পাখির মতো আউড়ে যাওয়া। এই সময়ে শহরের রাস্তায়, থিয়েটারে, বেশ্যার বাড়িতে মাতাল বাবুদের অভাব নেই। তাঁরা বোতল খালি করে শেক্সপীয়ার, মিল্টন, মধুসূদন, বিদ্যাসুন্দর একই দক্ষতায় কপচান এবং বেশ্যা পল্লীতে বা গঙ্গার ধারে বেশ্যা প্রতি ধাবিত হন। ‘সধবার একাদশী’র নিমচাঁদই হল সেই গ্যালেরির এক যোগ্য উদাহরণ। তা এই মাতালবাবু যা বললেন তাও অনুধাবনযোগ্য। যিনি শুধু ‘সঙ্গ’ করার বাবু, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়ার কালে বেশ্যার ভাষার রাখঢাক নেই; সেখানে তার আসল গলা, বুলি বেরোয়, কিন্তু যে বাবু তাকে প্রমোশন-এর স্বপ্ন দেখান willy nilly, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়ার সময় বেশ্যার গলায় সেতার বাজে, সে যে কত চেষ্টায় রপ্ত তা বিলক্ষণ বোঝা যায় যখন রাগের মাথায় “চকিতের ন্যায়” তার আসল ভাব ও ভাষা বেরিয়ে পড়ে– “অটল তুই কি পাগল হোলি নাকি! আমি তো আর তোর ঘরের মাগ নই যে বাগানে গিইচি বলে তোর মুখ হেঁট হবে।”
ফলকথা হল এই যে নাচতে গাইতে এবং সর্বোপরি কথা কইতে জানলে ভদ্র বাবুদের পাশে চকিতের ন্যায় হলেও বসা যায়, এইটেই হল সার সত্য। এই স্বপ্ন খোলার ঘরে বসে কত বেশ্যা দেখেছিল কে জানে! পাঠক জিগেস করতে পারেন, ঘণ্টা দুইয়ের জন্যে পাশে বসল, দুচার কথা কইল, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হল? নাট্যশালার খোলামেলায় এই সকল মন্দ স্ত্রীলোক সরল সচ্চরিত্র ভদ্রসন্তানদের কতটাই বা বিপদ ঘটাতে পারেন?
এইবার আবার বাবু মনমোহন বসুর কথায় ফিরি কারণ এই বিষয়টি তিনি বিশদ বুঝিয়েছিলেন ন্যাশনাল থিয়েটার-এর প্রথম বাৎসরিক অনুষ্ঠানে–
“কি আকৃতি, কি প্রকৃতি, কি স্বর, কিছুতেই কর্কশ ও রুক্ষ স্বভাবের পুরুষেরা কোমলাঙ্গী, কোমলহৃদয়া মধুরভাষিণী কামিনীগণের ন্যায় হইতে পারে না। সত্যিকার রমণীকে রমণী সাজাইলে দেখিতে শুনিতে সর্বপ্রকারের ভালো হয়। কিন্তু এ বিষয়ে যেমন উত্তম হইল, অন্যান্য বিষয় যে আছে তাহাতেও উপেক্ষা করা উচিত নয়। দৃশ্য-মনোহারিত্ব, ও আমোদ সুখ প্রার্থনীয় বটে কিন্তু সমাজের ধর্মনীতি অধিক প্রার্থনীয় কিনা তাহা কি আর বহু বাক্যে বুঝাইয়া দিতে হইবে? এ দেশে কুলজা কামিনীকে অভিনেত্রী রূপে প্রাপ্ত হওয়া এক কালেই অসম্ভব, স্ত্রী অভিনেত্রী সংগ্রহ করিতে হইলে কুলটা বেশ্যা পল্লী হইতেই আনিতে হইবে। ভদ্রযুবকগণ আপনাদের মধ্যে বেশ্যাকে লইয়া আমোদ করিবেন, বেশ্যার সঙ্গে একত্র সাজিয়া রঙ্গভূমিতে রঙ্গ করিবেন, বেশ্যার সঙ্গে নৃত্য করিবেন, ইহাও কি কর্ণে শুনা যায়? ইহাও কি সহ্য হয়? ইহাও যে রাজধানীতে— এত সুশিক্ষা সদুপদেশ, ও সভ্যতার মধ্যে কোনো সম্প্রদায় কর্ত্তৃক অনায়াসে অনুষ্ঠিত হইতেছে, ইহার অপেক্ষা বিস্ময় ও আক্ষেপের বিষয় আর কি আছে?”
Contamination-এর ভয় বড় ভয়। এবং সে রোধ করার কোনও উপায়ই নেই, ভদ্রসন্তানদের নাটকের এমনই ছিরি। যতই কেননা পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক নাটক লেখা হউক, তার মূল সুরটি ‘রঙ্গ’ আর ‘আমোদে’র। তাতে নট নটী এ ও’র গায়ে প্রায়শই ঢলে পড়ে, আদিরসাত্মক রসিকতা করে। এ সকল entertaining গলাগলি ঢলাঢলি ব্যাপার যদি একটি বেশ্যার সহিত অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সে মহামারী contamination হতে বাবুদের রক্ষা করেন কোন শ্রী হরি? দর্শক বাবুদের দেখন সুখের লজ্জাই বা রক্ষা করেন কোন মধুসূদন? ‘প্রকাশ বিনষ্টা’দের না হয় বাৎস্যায়ন অনুমোদন করেছেন, প্রকাশ বিনষ্টদের তো কোনও বিধান নেই! তাঁরা অটলবাবু বা নিমচাঁদ বাবুর অনুসরণে আদাড়ে পাঁদাড়ে ঘুরুন, সে আমরা দেখতে যাচ্ছিনে, কিন্তু এক হলঘর বাবুর সামনে…? প্রাণ থাকতে নয়।
গোড়ার দিকে তিন সতী-গন্ধী নাটকের কথা বলেছিলাম। তার মধ্যে একটি থেকে দুই একটি দৃশ্য পেশ করছি। পাঠক প্রথমে এইটি দেখুন–
"(কুটীলার প্রবেশ)
কুটীলা— দাদা, দাদা, দাদা,—
আয়ান— আরে কেন, কি হয়েচে–-
কুটীলা– যা হয়েচে একবার দেখ্বে এসো— এই গে তোমার রাধা-সতী কালার সঙ্গে নিকুঞ্জবনে আমোদ প্রমোদ করচে– আর কিচু নয়—
আয়ান— (যষ্টি হস্তে দণ্ডায়মান) সত্য বলচিস্ রাধাকৃষ্ণ নিকুঞ্জ বনে একত্র রয়েচে ।
কুটীলা— আমি বুঝি কেবল তোমার কাছে মিথ্য কথাই বলে ব্যাড়াচ্চি– স্বচক্ষে দেখে এসেচি— এখন ইচ্ছে হয়, তো চল তোমারে দেখুয়ে দি,— তার পর তোমার মনে যা থাকে তাই করো– বাবা বোয়ের এমন বুকের পাটা কখন দেখিনি— এই দুই প্রহর বেলা, পর পুরুষের সঙ্গে আমোদ– ওমা ছি, ছি, ছি, কুল বধূর কি এই কাম, কালা মিন্সের জ্বালায় লোকের কাছে মুক দেখানো ভার– রাত দিন কৃষ্ণের সঙ্গে বনে বনে ফিরুবে, ঘরে এক দণ্ড থাকতে মন যায় না— ভাল কথা বলতে গেলে তেড়ে মারুতে আসে– কলঙ্কিনীর জন্যে যমুনায় ঝাপ দিয়ে মরতে ইচ্ছে হয়— এই তোমার আস্কারা পেয়েই তো এত দূর হয়েচে— তুমি দাবালে কি কখন এমন হতো–- মা সাধ করে বলেন তুমি মেয়ে মানুষ, কাচা দিয়ে কাপড় পর না—
—সতী কি কলঙ্কিনী, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭৯"
এ হল রাধা সতীর বৃত্তান্ত। এই নাটকে কৃষ্ণর কালী সেজে কুটীলা আর আয়ান ঘোষকে ফাঁকি দেওয়ার প্লট। এতে রাধা যমুনা থেকে জল এনে কৃষ্ণের প্রাণ বাঁচালেন এবং বৃন্দাবনের শ্রেষ্ঠা সতী সাব্যস্ত হলেন।
কিন্তু রাধা কৃষ্ণর লীলা যে ‘আমোদ’-এ পরিণত হল, সেই কথাটি আমাদের ভাবায়। দিব্য প্রেম হোক আর যাই হোক, নাট্যশালার bawdry না হলে টিকিট বিকোবে কিসে? এ বস্তুটি বাবুদের শিখিয়েছিলেন মহাত্মা শেক্সপীয়ার।
পাঠক এইবার একই নাটকে এই দৃশ্যটি অবলোকন করুন। রাধা সতী জল আনতে চলেছেন আর বিলাপ করছেন–
"প্রথম গর্ভাঙ্ক। যমুনা তট। (রাধিকা সখিগণ সমভিব্যাহারে উপস্থিত)
রাধিকা– সখি! পা যে আর চলে না— আমার মনের ভিতর যে কি হচ্চে তা অন্তর্যামী পরমেশ্বরই জানেন— প্ৰাণেশ্বর এ হতভাগিনীর অদৃষ্ট কি শেষে এই ছিল— কুল, মান, প্রাণ মন সকল সমর্পণ করে অবশেষে তোমার বিরহ যাতনা ভোগ কত্তে হলো— ওহ! সখি, আমি কি জল এনে প্রাণনাথের জীবন রক্ষা কত্তে পাবো? ব্রজের সাধ্বী রমণীগণ যা পারেন না, আমা হতে সে কাৰ্য্য কি সম্ভব। নাথ! তুমিই তো বলেছিলে যে আমার কালাকলঙ্কিনী নাম খণ্ডন করবে— দীননাথ! আমি অনন্তকাল এ কলঙ্ক রাশি ভোগ কর্ত্তে পারি, কিন্তু তোমার বিরহ যে এক মুহুৰ্ত্তও সহ্য করতে পারিনে– দয়াময়! দাসীকে এ ঘোর বিপদ সাগর হতে পরিত্রাণ কর নতুবা এ যমুনার জলে ছার প্রাণ পরিত্যাগ করবো।
—সতী কি কলঙ্কিনী, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭৯"
এইবার আপনারা বিবেচনা করুন, এই whining pining রাধাটি যদি কোনও বেশ্যা হ’ন, এবং নাটকের কোনও এক ব্রাহ্ম মুহূর্তে তিনি যদি গিয়ে কৃষ্ণ-রূপী young বাবুটির ঘাড়ে গিয়ে পড়েন, তা হইতে যা বিপত্তি হবে সে সামলাতে বাবুর চোদ্দ পুরুষ হদ্দ হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়, বিশেষ করে সে বেটির গলায় যদি সেতার বাজে। সুতরাং মনমোহন বাবুর কথাটি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বাঁচতে চাও তো হুতোমের ভাষায় ‘খ্যাংরা গুঁপো’ মিনসেদের কামিয়ে জুমিয়ে রাধা ললিতা বিশাখা রোহিনী যা খুশি সাজাও। ধর্ম সংকটের ভয় নেই।
মনমোহন বসু হলেন সনাতনপন্থীদের ধ্বজাধারী এবং নাট্যরঙ্গ এবং পুরুষের সতীত্ব রক্ষার যৌথ প্রকল্পে নিবেদিত প্রাণ। নাটকে নটী চরিত্রে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু সেই দুশ্চরিত্রা নটীর চরিত্র কোনও সুললিত বাবু করুন; তাতে রঙ্গ কিছু কম পড়িবেক বটে, তবে জাত ধর্ম বিনাশের সম্ভাবনা কিছুমাত্র নাই।
এইবার তাঁরই রচিত ‘সতী’ নাটক (১৮৭৩) থেকে খানিকটা পাঠ করি। এটি হল সে যুগের আর এক ‘সতী’ নাটক। এই অংশটিতে নট-নটীর কথোপকথনে আমরা যথার্থ সতীত্বের একটি সঠিক ব্যাখ্যা পাই।
এই লিস্টিতে চন্দ্রাকুলবধূ দ্রৌপদী নাকচ হয়ে যান এক আম্রবনের আম্রফলের কথাটি বলার সময়। পঞ্চপতির উপরেও তাঁর যে আর একটি পতির (কর্ণ) ইচ্ছা জেগেছিল, এই অপরাধে। “সতীকুলের ঈশ্বরী” ইন্দ্রানী পরীক্ষায় ফেল হলেন নিম্নোক্ত কারণে–
“বলপূর্বক যে এসে ইন্দ্রকে তাড়িয়ে দে স্বর্গের সিংহাসনখানি অধিকার করে (নহুষ), শচী ঠাকরুন অমনি হুট্ করে তারই বামে বসেন! এমন ঐশ্বর্য্যপ্রাণা ভোগবিলাসিনীকে পতিপ্রাণা না বলতে পারলে তোমার মন উঠবে কেন?”
যাঁকে এই অংশে তিরস্কার করা হচ্ছে তিনি হলেন এক নটী, অর্থাৎ আর এক ভোগবিলাসিনী, যাঁর সতীপনার কোনও কারেক্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং নেই। তারপর নট চরিত্রটি এই সাব্যস্ত করলে যে, “যে কন্যারত্ন দক্ষ প্রজাপতির কুল উজ্জ্বল করে, কৈলাশনাথের হৃদয়মণি হয়ে, সতীত্বের প্রভায় ত্রিভুবন আলো করেছেন (…) সেই সতীকূলের ঈশ্বরীর নিখুঁত চরিত্র কীর্তন করে জীবন সার্থক করি।”
সামাজিক অনুশাসন নাটকের পাতায় ঢুকে পড়ে তাবৎ নষ্ট মেয়েমানুষকে চোখ রাঙাতে থাকল। তারই মধ্যে কে এক ‘শান্তে পাগলা’ কোত্থেকে এসে তিড়িং বিড়িং করে নেচে কুঁদে মোটা দাগের গান গেয়ে ইনফেরিওর দর্শকদের আমোদ বর্ধন করলে। অর্থাৎ কিনা, যে নাট্যকার বাবু “কৈলাসনাথের হৃদয়মণি”কে সতীত্বের সার্টিফিকেট দিয়ে নিজের noble সাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিটি নাটকে জাহির করলেন, আদর্শ নারীত্বের একটি বার্নিং এক্সাম্পল সেট করলেন এবং ব্যাড উওম্যানকে chastise করলেন, তিনিই আবার স্থুল রসিকতা করে মঞ্চের ধারাটি এবং ‘পিট্’-এর চাহিদাটিতে ইন্ধন যোগালেন। মোটা দাগের আমোদটি বজায় থাকুক, তার খাতিরে দুই একটি বেশ্যা/নটী গোছের চরিত্র-ও থাকুক, কিন্তু তাতে যেন কার্যকাল সমুৎপন্নে বাবু কুলের শরীর এবং মন কন্টামিনেটেড না হয়ে পড়ে। তাঁরই ঢঙে বলি, “অতএব নারীচরিত্রে আন্ মিন্সেদের।” বেশ্যাসক্তি বিষম বিপত্তি। স্টেজ এবং জীবন মিলে গেলে মহা বিপদ। ওই যে বলেছি আগেই, ‘সাধু সাবধান’!
একটি মুখের মতো জবাব দেখলাম দিলেন জনৈক বাবু মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, এইসকল ড্যামসেলরা স্টেজ-এ ওঠেন বলেই যত নিম্নবর্গের লোক পয়সা দিয়ে টিকেট কাটে, ড্যামসেলদের সাঙ্গপাঙ্গরা চুপি চুপি নাটক দেখতে আসে; দাড়ি-চাঁছা নায়িকাদের দেখতে তাঁদের কি তদ্রূপ উৎসাহ হত? এছাড়া তিনি এও বললেন যে যাঁরা সমালোচক, তাঁরা উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু নারীদের মঞ্চে উপস্থিত করুন, immoral বাবুরা সব কয়টি বেশ্যাকে তাড়া দিয়ে একেবারে গঙ্গা পার করে ছাড়বেন।
সে হবার নয়। তালেগোলে বেশ্যারা স্টেজ আলো করে থেকে গেলেন। সনাতনপন্থী বাবুরা ঢাল তলোয়ার নিয়ে নাচতে থাকলেন। ১৯১২-র ৮ই ফেব্রুয়ারি, গিরীশচন্দ্র যখন দেহ রাখলেন, তাঁর মৃতদেহে মালা দেওয়ার অধিকারটুকুও সনাতন বাবুরা তাদের দিলে না।
"আমি সখের নারী সুকুমারী
স্ত্রী পুরুষে এ্যাক্টো করি
দুনিয়ার লোক দেখে যারে —!"
যাদুমণি, আন্দি, এইসব নাম যাদের হয় তাদের ঠিকুজি কুলুজির খোঁজ থাকে না। গোলাপসুন্দরীরও নেই। মাহেশ থেকে কি অবস্থায় তিনি কলকাতায় এসে খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন সে কথা কেউ বলে যাননি। তবে হ্যাঁ, কপাল করে এসেছিলেন এই বেশ্যাটি। প্রথম চোটেই মধুসূদন দত্তর নাটকে শর্মিষ্ঠা; ১৮৭৪ বেঙ্গল থিয়েটারে খোদ জ্যোতি ঠাকুরের পুরু বিক্রম নাটকে রাণী ঐলাবেলা। এরপর একটি মহা কাণ্ড ঘটল তাঁর জীবনে। এক আলোকপ্রাপ্ত বাবুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। বাবুটি সমাজসেবী radical, নাম উপেন্দ্রনাথ দাস। তিনি আবার নাট্যপ্রেমীও বটে। ১৮৭৫ সালে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সাঙ্গ করে তিনি তাঁর বন্ধু বাবু শিশিরকুমার ঘোষের সাহায্যে দি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার-এর ম্যানেজার হলেন। এরপর ১৮৭৫-এ লিখলেন শরৎ সরোজিনী নাটক। সেই নাটকে অত্যাচারী সাহেবদের খুব একহাত নিলেন, এবং যা হবার তা হল– সরকার সে নাটক বন্ধ করলে। কিন্তু সেই নাটকে ‘সুকুমারী’র ভূমিকায় অভিনয় করে গোলাপসুন্দরী রাতারাতি নাটকের হ্যান্ডবিলে হয়ে উঠলেন সুকুমারী। রীতিমত যারে কয়, a star is born। গল্পটি এখানে শেষ হলে বলা যেত happy ending। কিন্তু সে হবার নয়। উপেন্দ্রনাথ দাস একে বাবু তায় radical, তাঁর মাথায় খেয়াল এল যে এক্ট্রেসদের ভদ্রসমাজের পাতে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন, এবং সে হতে পারে একমাত্র বিবাহ সূত্রে।
যেমন কথা তেমন কাজ। ঘটনাক্রমে উপেন্দ্রনাথ পেয়ে গেলেন আর এক নাটুকে বাবুরে। তিনি গোষ্ঠবেহারী দত্ত। তাঁর সঙ্গে তাঁর ‘সুকুমারী’র বিয়ে দিয়ে তিনি তাকে জাতে তুলবেন এইরকমই সাব্যস্ত করেছিলেন তিনি। ধন্য radical বুদ্ধি। বেশ্যা জাতে তোলা কি সোজা? ১৮৭৫-এর ১২ই ফেব্রুয়ারির ‘এডুকেশন গেজেট’-এ লেখা হলো–
"সাপ্তাহিক সংবাদ : প্রতিধ্বনি বলেন, গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার-এর অভিনেত্রী শ্রীমতি গোলাপ(মোহিনী)র সহিত উক্ত নাট্যশালার অন্যতম অভিনেতা শ্রীযুক্ত বাবু গোষ্ঠবেহারী দত্তর বিবাহ ১৮৭২ অব্দের তিন আইন অনুসারে আগামী মঙ্গলবার নির্বাহ হইবে, এমত কথা আছে।”
কতিপয় রগুড়ে বাঙালি যে বেশ্যার বিয়ে রঙ্গ দেখে আটখানা হলেন তা বোঝা যায় তাদের ছড়াকাটা শুনে।
বিবাহ গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তদপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ‘তিন আইনে বিয়ে’। কারণ এ হল উনিশ শতকের নবতম বিবাহ প্রথা। এই বিড়ম্বনার শুরু আদি ব্রাহ্মসমাজের নতুন বিবাহ প্রথা প্রবর্তন (১৮৬১) এবং তারপরে, বাবু কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্ম বিবাহ রিফর্ম মনোবাঞ্ছায় এবং দুই ব্রাহ্ম নেতার লাঠালাঠির ব্যাপারে। এই ‘তুই থুলি না মুই থুলি’ দেখে ইংরেজ সরকার যে নেটিভ ম্যারেজ এ্যাক্টের পরিকল্পনা করছিলেন তা শিকেয় তুলে রাখেন এবং নামকরণ না করেই ১৮৭২-এ যে আইনটি বলবৎ হয় সেই হল তিন আইন। এই আইনের নানা প্যাঁচ পয়জার, সে সবে আমাদের দরকার নেই। এই বিবাহ আইনের মূল কথা তিনখানি হল : বিবাহ হয় একনিষ্ঠ, অর্থাৎ বিবাহিতেরা খামখেয়ালিতে একে অন্যকে ছাড়িয়া নূতন বিবাহ করিতে পারেন না। চতুর্দশ বর্ষ বালিকাদিগের সর্বনিন্ম বিবাহোপযুক্ত বয়স বলিয়া নির্দিষ্ট হইল। এই নূতন আইন তাহাদেরই জন্য বিধিবদ্ধ ব্যবহৃত হইয়াছে যাহারা প্রচলিত হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, য়িহদী প্রভৃতি, কোনও ধৰ্ম্মে বিশ্বাস করে না, এবং ঐ সকল ধৰ্ম্মের, নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে বিবাহ করিতে অনিচ্ছুক।
এখন কথা হল এইসব আইনি মারপ্যাঁচের সঙ্গে গোলাপের বাবু গোষ্ঠবেহারীর সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক কী?
সম্পর্ক একটু আছে বৈকি। একটি হিন্দু মেয়ে আর একটি হিন্দু বাবুর কেন তিন আইনে বিয়ে হওয়া প্রয়োজন তা একটু ভাবলেই বেরিয়ে পড়বে। বেজাত বেশ্যার সঙ্গে হিন্দু কুলোদ্ভবের বিবাহ দিতে কোনও টিকিধারী-ই সম্মত হতেন কি? তাই এই তিন আইনের খুঁট ধরে গোলাপ, তিনি মোহিনী বা সুন্দরী যাই হন, তার সঙ্গে দত্তবাবুর বিয়েটি শাস্ত্রসম্মত না হোক, আইনসম্মত করা গেল এবং যেহেতু এই বিয়ে রেজিস্টারি বিয়ে, দত্তবাবুর কাঁছা কোঁচা তুলে পালানোর পথটিও বন্ধ করা হল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। একে বেশ্যা, তায় তিন আইনে অ-হিন্দু বিয়ে। দত্তবাবুর পরিবার তাঁরে ত্যাগ দিলেন। খানিক অর্থকষ্ট সহ্য করে দত্তবাবু তাঁর মুরুব্বি উপেন্দ্রনাথ দাসের পথ ধরে বিলেত রওনা দিলেন এবং শোনা যায় একটি হোটেলে চাকরি নিলেন। তার কিছু পরেই তাঁর দেহান্তর হয়। ‘মিসেস সুকুমারী দত্ত’ একটি সদ্যোজাত কন্যাসন্তান নিয়ে মোচার খোলার মতো সংসার সমুদ্রে ভাসতে লাগলেন। Radicalism-এর জয়গানের এখানেই অন্ত হল। গোলাপ কিছুদিন একটি নাচ গানের স্কুল খুলে জীবনধারণের চেষ্টা করলেন, এমনকি নাটক লিখতে শুরু করলেন। ১৮৭৫ সালের ২৩শে অগাস্ট, নাটকটি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল কিন্তু তেমন দাগ কাটতে পারল না।
নাটকটির নাম অপূর্ব সতী। একটি বেশ্যার ভদ্রকুলবধূ হওয়ার ইচ্ছার কাহিনী এবং বিয়োগান্ত।
নাটকটির কভার পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে এটি হল–
"TRAGEDY!
TRAGEDY!
TRAGEDY!"
এই হল আমাদের গোড়ায় বলা তিন ‘সতী’ নাটকের তিন নম্বর এবং সর্বশেষ উল্লেখ।
কোথায় জীবনের শেষ কোথায় নাটকের শুরু বোঝা শক্ত। নাচতে গাইতে, কথা কইতে জানা এই বেশ্যাটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা নাট্যকার। সমাজ এক রঙ্গশালা বটে। তাঁর পরবর্তী জীবনের কথা প্রায় কিছুই লেখা নেই। মেয়েটিকে যথাসাধ্য শিক্ষিত করেছিলেন, প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করে একটি সম্ভ্রান্ত ‘ব্রাহ্মণ’ পরিবারে বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পা দেওয়ার অধিকার তাঁকে দেওয়া হয়নি।
অপূর্ব সতীর নায়িকা নলিনীর একটি গান–
"যদি নাহি পাই প্রাণের কানাই প্রাণ না ভাসে
নাথের উদ্দেশে, এদেশে সেদেশে, সন্ন্যাসিনী বেশে,
ভ্রমিব গহনে
নীরবে কাঁদিব, সবে সুধাইব, জীবন ত্যাজি ঝাঁপিয়ে জীবনে।।"
শেষ পংক্তিতে একটি paradox বা কূটাভাস আছে। “জীবন ত্যাজি ঝাঁপিয়ে জীবনে” কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ বা অনর্থ নিয়ে একটু চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ওটিই হল গোলাপ ওরফে সুকুমারীর মনের কথা।
“রঙ্গভূমি ভালবাসি
হৃদে সাধ রাশি রাশি
আশার নেশায় করি
জীবন যাপন।।”
–গিরীশ চন্দ্র ঘোষ।
সুকুমারী দত্তর অপূর্ব সতী কোনও কালজয়ী নাটক নয়। হরমণি নাম্নী এক বেশ্যা তার লেখাপড়া জানা মেয়ের জন্যে জাল ফেললে। তাতে ধরা পড়ল চন্দ্রকেতু ঘোষ নামক এক জমিদার তনয়। হরমণির মেয়ে নলিনী যখন সেই কচি বাবুটির প্রেমে ভীষণ পড়লে, তখন হরমণি লোভে পড়ে তাকে তরুবাবু নামক এক মক্কেলের কাছেই বেঁচে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কৃতকার্য হয় না। নলিনী চন্দ্রকেতুর সঙ্গে কাশীধাম যায় এবং গন্ধে গন্ধে চন্দ্রকেতুর পিতৃদেব তথায় পৌঁছিয়ে ছেলেকে বলপূর্বক কলকাতা আনয়ন করেন। নলিনী আত্মঘাতী হয়… ইত্যাদি। এই নাটকটি স্মরণীয় একটি বিশেষ কারণে। কুসুমকুমারী এই নাটকে তাঁর নিজের সত্তাকে দুই টুকরো করে মা মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। সূত্র হল সেই হাড়ি চাঁচা আর সেতার বাদন। নলিনী যে ভাষায় কথা বলে সে হল নাটকের ভাষা, তাতে শব্দের ঝংকার আছে, আবেগের ঘনঘটা আছে, যা নেই তা হল বাস্তবের ছোঁয়া। শুনলে মনে হয় যেন একটি নাটুকে মেয়েমানুষ ঘুরে ঘুরে রাধা সতীর অভিনয় করছে। হরমণি যে ভাষায় কথা কয়, সে হল কথ্য ভাষা; সে ভাষায় পালিশ কিছু নেই, কিন্তু সে ভাষা যে অভিজ্ঞতার ভাষা তা বোঝাটা শক্ত কিছু না।
"নলিনী: তুমি আমার সতীত্ব নাশের জন্য নানাপ্রকার চেষ্টা কচ্ছ। তুমি তোমার নিজের সতীত্ব নষ্ট করেছ বলে কি আমাকেও সেই পথগামিনী করতে চাও?
হর: আ মর বেটি! বেটি আমার কি সতীরে!– সতীপনা দেখছেন– আরে বেটি! সতীত্ব নিয়ে করবি কি?– সতীত্ব নিয়ে কি ধুয়ে খাবি?– না সতীত্বে পেট ভরবে? সেই জোগাড় কর, তারপর তখন আর চেষ্টা দেখিস। বেটির অরগণ নেই ছাড়গুন আছে।"
আরও একটি মজার ব্যাপার, ভাষা যে দুই জিভে কথা কইছে সে সুকুমারী দত্ত ভালোই জানেন, কারণ, হরমণি শুধু যে মেয়ের সতীপনাকে গাল পাড়ছে তা নয়। মেয়ের নাটুকে ভাষাকেও ভ্যাঙ্গাচ্ছে–
মেয়ে মায়ের কাছে চন্দ্রকেতুর প্রতি তার প্রেমের গভীরতা নিয়ে কাব্যপ্রবণ আক্ষেপ আর হরমণির প্রতিক্রিয়া—
"নলিনী: সেইদিন তাঁকে প্রাণনাথ বলে হৃদয়রাজ্যের রাজা করেছি— সেই অবধি তাঁর অধিনী বলে তাঁর চরণ সেবা করেছি। মা! আর অধিক কি বলব, সেই অবধি তাঁকে হর্তা কর্তা বিধাতা, আশ্রয় অবলম্বন বলে তাঁরই আশ্রিত হয়েছি।
হর: আহা! বেটি আমার ভিক্ষা চেয়ে প্রাণটা শীতল কল্লে রে! বেটি আমার কবিতা আওড়াতে লাগলেন (বিকৃত স্বরে) হত্তা কত্তা বিধাতা করেছি-– কটাক্ষপাত করেছি— মুণ্ডুপাত করেছি, বেটি আমার রাজরাজেশ্বরী হয়েছেন। (চতুর্থ অঙ্ক, প্রথম গর্ভাঙ্ক)"
Verisimilitude, authenticity ইত্যাদি বড় বড় তত্ত্ব আমরা ব্যবহার করতে চাইনে, তবে হরমণির মধ্যে গোলাপের গল্প আর তার মাহেশের জীবনটি যেন কেউ তুলে বসিয়ে দিল নাটকের পাতায়। আর নলিনীর প্রেমাবেগে একটি রংচং মাখা কথা বলা পুতুল বৈ আর কিছু পাওয়া গেল না। যে চরিত্র কলের পুতুলের মতো সাজানো গোজানো ভাষায় কথা বলে, সে থেটারে বসে একপ্রকার সহ্য করা যায়, কিন্তু জীবনে সে মানানসই হয় না। ঐটিই হল “জীবন ত্যাজিয়া ঝাঁপিয়ে জীবনে”র মূল ধরতাই। যে জীবন ঘেন্নার, সে জীবন ত্যাগ করলাম, কিন্তু যে সাজানো গোজানো জীবনে ঢোকার লোভ হল, তাতে ঠিক প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল না, সে রংচং-এ মাটির কাঠামো হয়ে রইল এবং ভেঙেও গেল। নলিনী সুকুমারী কিনা সেটা আজ বলা সম্ভব নয়, কিন্তু নলিনীর ভাবভঙ্গি, কথার ধরণে কোথায় যেন এক aspiring মিসেস সুকুমারী দত্তকে দেখতে পাওয়া যায়। নাটকের কভার পৃষ্ঠায় যে ট্র্যাজেডি কথাটি তিন তিনবার লেখা হয়েছে, তার আসল ব্যঞ্জনা নাটক ছাপিয়ে সংলাপ ছাপিয়ে, এক বেশ্যার ‘ভদ্রমহিলা’ হয়ে ওঠার মর্মান্তিক চেষ্টার রূপক বর্ণনা অর্থাৎ কিনা allegory হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
"যাহারা বিনোদিনীর ন্যায় অভাগিনী, কুৎসিত পন্থা ভিন্ন যাহাদের জীবনোপায় নাই, মধুর বাক্যে যাহাদিগকে ব্যাভিচারীরা প্রলোভিত করিতেছে, তাহারাও মনে মনে আশান্বিত হইবে যে, যদি বিনোদিনীর মতো কায়মনে রঙ্গালয়কে আশ্রয় করি, তাহা হইলে এই ঘৃণিত জন্ম জনসমাজের কার্যে অতিবাহিত করিতে পারিব। যাহারা অভিনেত্রী তাহারা বুঝিবে—কিরূপ মনোনিবেশের সহিত নিজ ভূমিকার প্রতি যত্ন করিলে জনসমাজে প্রশংসাভাজন হইতে পারে।" – শ্রী গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
বিনোদিনী দাসী, যাঁরে তাবৎ বাঙালি ‘নটি বিনোদিনী’ বলে থাকেন, আমার কথা আর আমার অভিনেত্রী জীবনে–র দৌলতে তিনি বাংলা সাহিত্যে একেবারে জাজ্বল্য হয়ে আছেন। যদি খুব ভুল না করি, তাহলে ইনিই এখনও পর্যন্ত একমাত্র মন্দ স্ত্রীলোক যাঁর জীবনী ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। এই যে ইনি বাঙালির সংস্কৃতিতে ফাইভ স্টার পেলেন, সে যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দৌলতে সে বোঝা কঠিন নয়। মহাপুরুষের আশীর্বাদধন্যা হলে বেশ্যা জাতে না উঠে যায় কোথায়। আমাদের বাসি খবরে প্রয়োজন নেই। কথার মধ্যেও যেমন কথা থাকে, সে রূপকই হোক বা আভাসই হোক, তা আমরা খুব জানি। তাই মন দিয়ে লেখাটি পড়ি। ভারী সুন্দর করে তিনি তাঁর রামকৃষ্ণ দর্শনের কথা বললেন–
“যখন তিনি অসুস্থ হইয়া শ্যামপুকুরের বাটিতে বসবাস করিতেছিলেন, আমি শ্রীচরণ দর্শন করিতে যাই তখন সেই রোগক্লান্ত প্রসন্নবদনে আমায় বললেন : “আয় মা বোস”, আহা কি স্নেহপূর্ণ ভাব! এ নরকের কীটকে যেন ক্ষমার জন্য সতত আগুয়ান! কতদিন তাঁহার প্রধান শিষ্য নরেন্দ্রনাথের (পরে যিনি বিবেকানন্দ স্বামী বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন) “সত্যম শিবম” মঙ্গলগীতি মধুর কণ্ঠে থিয়েটারে বসিয়া শ্রবণ করিয়াছি। আমার থিয়েটার কার্যকরী দেহকে এই জন্য ধন্য মনে করিয়াছি।”
কিন্তু ওই অংশে আর একটি কথা উঁকি দিচ্ছে। তিনি বলছেন, “নরেন্দ্রনাথের “সত্যম শিবম” মঙ্গলগীতি মধুর কণ্ঠে থিয়েটারে বসিয়া শ্রবণ করিয়াছি।” এইখানে একটু খটকা লাগার বিষয় … নরেন দত্তর গান থেটারে, এ কিরকম! তারপর বোঝা গেল, ওই গানটি তাঁর মনের ভেতর রয়ে গেছিল, সেই গান তিনি মনে মনে শুনতেন। এইবার গিরিশবাবু আর বিনোদিনীর কথাগুলো আবার বিবেচনা করে দেখা যায়– “কুৎসিত পন্থা” “ঘৃণিত জন্ম” আর “থিয়েটার কার্যকরী দেহ”। এই হল নাটুকে বেশ্যার ত্র্যহস্পর্শ। এই স্পর্শদোষ থেকে বাঁচার মন্ত্র হল ওই সত্যম শিবম জপমন্ত্র। ওই একরকম বেঁচে থাকার উপায়। পাঠক, বেশ্যার মন আর দেহ কি আলাদা? নিশ্চই তাই। থিয়েটার কার্যকরী দেহ রইল বাবুদের আর দর্শকের জিম্মা; মন শুনে গেল সত্যম শিবম। সেই মন্ত্র ধরে রাখার উপায়টি বাতলে দিলেন গিরিশবাবু–
“আমার অন্য কথা ভালো লাগিত না। গিরিশবাবু মহাশয় যে সকল বিলাতের বড় বড় অভিনেতা বা অভিনেত্রীর গল্প করিতেন, যে সকল বই পড়িয়া শুনাইতেন, আমার তাহাই ভালো লাগিত। মিসেস সিডনিস যখন থিয়েটারের কার্য ত্যাগ করিয়া দশ বৎসর বিবাহিতা অবস্থায় অতিবাহিত করিবার পর পুনরায় যখন রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন, তখন তাঁহার অভিনয়ে কোনও সমালোচক কোনও স্থানে কিরূপ দোষ ধরিয়াছিল, কোনও অংশে তাঁহার উৎকর্ষ বা ত্রুটি ইত্যাদি পুস্তক হইতে পড়িয়া বুঝাইয়া দিতেন। […] বঙ্কিমবাবুর “দুর্গেশনন্দিনী” কোন পুস্তকের ছায়াবলম্বনে লিখিত, “রজনী” কোন পুস্তকের ভাব সংগ্রহে রচিত, এইরকম কত বলিব। গিরিশবাবু মহাশয়ের ও অন্যান্য স্নেহশীল বন্ধুগণের যত্নে ইংরাজি, গ্রীক, ফ্রেঞ্চ, জার্মানি প্রভৃতি বড় বড় অথরের কত গল্প যে আমি শুনিয়াছি তাহা বলিতে পারি না। শুধু শুনিতাম না, তাহা হইতে ভাব সংগ্রহ করিয়া সতত সেই সকল চিন্তা করিতাম।”
এই গিরিশবাবু মহাশয়ের কারণেই বিনোদিনীর মুখের ভাষা নাটুকে পালা হয়ে পড়ল না। সেই সদাশয় ব্যক্তি বিনোদিনীর কার্যকরী দেহের থেকে মনটিকে টেনে বার করে নিলেন; ধুলো ঝাড়লেন, ঘষলেন, মাজলেন, তারপর সেই মন যখন কথা কইল, তখন সে থিয়েটার কার্যকরী দেহর ছায়া চকিতের ন্যায়ও ভাষায় ছাপ ফেলল না।
মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন বড় বিচিত্র। বিনোদিনী বলছেন–
“গিরিশবাবুর সঙ্গে আমার জোর জবরদস্তি মান অভিমান রাগ প্রায়ই চলত। তিনি আমায় অত্যধিক আদর দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন। আমি তাই বড্ড বেড়ে উঠেছিলুম, মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করতুম, কিন্তু তার জন্য তিনি আমায় একটি দিনের জন্যও তিরস্কার করেননি, অনাদর অযত্ন তো করেনইনি। তবে আমি একটি দিনের জন্য এমন কোনও কাজ করিনি, যাতে তাঁর এতটুকু ক্ষতি হয়।”
বেড়ে ওঠার কারণ একটুখানি ছিল বৈকি। যে সময়ের কথা তিনি বলছেন তখন গিরিশবাবুর হাতে গড়া এই বেশ্যাটি Prima Dona of Bengali Theatre; Flower of Native Theatre. বাঙালি বাবুরা কোন ছার, সায়েবরাও তখন তাঁর কদর করছেন। বিনোদিনী মনে কী ভেবেছিলেন কে জানে। নাটুকে মেয়েছেলে যে আসলে নাটুকে বাবুদের সম্পত্তি, হাতের পুতুল, তা বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল তাঁর। যে কথাটি তিনি তেমনভাবে পষ্টাপষ্টি বলে উঠতে পারলেন না তা হল তাঁর বিনিময়ে গিরিশবাবুর স্টার থিয়েটার লাভ। আমার কথা–য় শুধু লেখা হল–
“নানা কারণের প্রধান কারণ যে আমায় অনেক রূপে প্রলোভিত করিয়া কার্য উদ্ধার করিয়া লইয়া আমার সহিত যে সকল ছলনা করিয়াছিলেন তাহা আমার হৃদয়ে বড় লাগিয়াছিল। থিয়েটার বড় ভালোবাসিতাম তাই কার্য করিতাম। কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই। তাই অবসর বুঝিয়া অবসর লইলাম।”
১৮৮৭-র পয়লা জানুয়ারী তাঁর জীবনের শেষ অভিনয়। সেই স্টার থিয়েটারেই। নল দময়ন্তী-র দময়ন্তী, বেল্লিক বাজার–এর রঙ্গিনী। দুটিই গিরীশবাবুর লেখা। একই রাতে একটি চরিত্রে সতীর সতী, তস্য সতী, যারে কয়, sublime character; দময়ন্তী নলকে বলছেন–
"প্রভু, কি দিয়ে করিব দেব-পূজা?
দেহ, প্রাণ,–- কিছু আর নহে মোর;
দেবগণে সাক্ষী করি’ কহি—
সকলই হে দিয়েছি তোমায়,
জানি, নাথ, তুমি হে আমার
দানে তবে নাহি অধিকার।
ধর্মপত্নী আমি তব;
দেহ মোরে পতি-পূজা উপদেশ;
কহ, নাথ, স্বয়ম্বরে দিবে দেখা?"
পরবর্তীটিতে এক মেথরানী, যে অশ্লীল নাচ গানে স্টেজ মাতায়। রঙ্গিনী গাইছে–
"মায় বাপ জিসিকে রোয়ে,
জরু ছোড়ে কে কসবি ঘরমে শোয়ে,
হাম ওস্কে দেওয়ে; গঙ্গা কিরা ময় সাচি কহি॥
যো না মানে দেওতা ভি না মানে পীর,
বে পয়জারসে যিসিকে না নোয়ে শির,
সরাব মে রহে যো মস্তাগীর,— যো
ছোড়া হ্যায় জাত,
ডেম (damn) ডেম বলে ছোড়হে লাথ,
উসিকে দেনে ময় খাড়া রহি॥"
দময়ন্তীর ভোল পাল্টে রঙ্গিনীর নাচটি নাচতে নাচতে ফ্লাওয়ার অফ নেটিভ থিয়েটার কি ভাবছিলেন কে জানে। এ নাটকও গিরিশবাবুর লেখা। এবং প্রহসন। নল দময়ন্তীতে বিনোদিনী দময়ন্তী, নল নাট্যকার গিরিশবাবু স্বয়ং। তার আগে ১৮৮৩ সালেও এই স্টার থিয়েটারেই গিরিশবাবুর সঙ্গে তাঁরই লেখা দক্ষ যজ্ঞ। সে নাটকেও বিনোদিনী সতী, গিরিশবাবু মহাদেব। সেটিই স্টার থিয়েটরে তাঁর প্রথম অভিনয়।
বিনোদিনীর জীবনে গুর্মুখ রায়কে বাদ দিয়েও, পাঁচ পাঁচটি বাবু। রাধারমণবাবু, ছোটবাবু, গিরিশবাবু। গিরিশবাবু ঈশ্বর। তিনি কাদার তাল আর পাঁকের ময়লা তুলে প্রতিমা তৈয়ের করলেন। তারপর সে প্রতিমা সোনার দরে বেচলেন। আর এক বাবু রীতিমতো তলোয়ার নাচানো ‘সম্ভ্রান্ত যুবক বাবু’। তিনি নিজে বিয়ে শাদি করে থিতু হয়ে, বিনোদিনীর নতুন বাবুর খবর পেয়ে তলোয়ার বাগিয়ে তাঁর একদা বাঁধা মেয়েমানুষকে কাটতে গেলেন। আর একজন ‘রাঙা’ বাবু তাঁকে ছায়া দিলেন ১৮৮৭ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত। একটি মেয়েও হয়েছিল তাঁদের। মেয়েটির নাম ছিল শকুন্তলা। ১৯০২-এ সে মারা যায়। ১৯১২তে মারা যান দুই বাবু : গিরিশ বাবু আর ‘রাঙা’ বাবু। তলোয়ার বাবুটি আগেই গিয়েছিলেন। বিনোদিনী সম্পর্কে পড়তে গিয়ে দেখা যায় এই ‘রাঙা’বাবুটিকে কেউ বলেছেন ‘স্বামী’, কেউ বলেছেন ‘বেনেফ্যাক্টর’। ‘স্বামী’ কথাটি কিন্তু বিনোদিনী একবারও উচ্চারণ করলেন না, কারণ মিথ্যা বলা তাঁর ধাতে ছিল না। গিরিশবাবুর লেখা ভূমিকা তিনি প্রথম সংস্করণে ছাপাননি কারণ, "তাহাতে অনেক সত্য ঘটনার উল্লেখ ছিল না”। সুতরাং তাঁর একটি ‘প্রাণের দেবতা’ (রাঙা বাবু) থাকলেও, তাঁর ‘মাথা মুণ্ড’ জীবনীতে তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তিনি বেশ্যাই ছিলেন, এবং বেশ্যার ব্যবহারই পেয়ে গেছেন, যতই সতী আর দময়ন্তী সাজুন না কেন–
"পতিপ্রেম সাধ আমাদের আছে, কিন্তু কোথায় পাইব? কে আমাদের হৃদয়ের পরিবর্তে হৃদয় দান করিবে? লালসায় আসিয়া প্রেমকথা কহিয়া মনোমুগ্ধ করিবার অভাব নাই, কিন্তু কে হৃদয় দিয়া পরীক্ষা করিতে চান যে আমাদের হৃদয় আছে? আমরা প্রথমে প্রতারণা করিয়াছি, কি প্রতারিত হইয়া প্রতারণা শিখিয়াছি, কেহ কি অনুসন্ধান করিয়াছেন? (…) অনেক প্রদেশে জল জমিয়ে পাষাণ হয়। আমাদের তাহাই (…) যাহা হউক, এখন ও কথা থাকুক।"
গৌরবে বহুবচনের এমন সার্থক প্রয়োগ খুব কম দেখা যায়।
১৯১২-র ৯ই ফেব্রুয়ারি গিরিশচন্দ্রের প্রয়াণ। কলকাতার টাউন হলে সর্বশ্রী সারদাচরণ মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহতাবের সভাপতিত্বে যে বিরাট শোকসভার ডাক দিলেন সেখানে নাট্যাচার্যের প্রতি সম্মান আর শুদ্ধতার অজুহাতে অভিনেত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। প্রতিবাদে স্টার থিয়েটারের “সুধাকন্ঠী” সুশীলাবালার (১৮৮৪-১৯১৫) নেতৃত্বে অভিনেত্রীরা গিরিশচন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের অধিকার দাবি করেছিলেন। দাবি মঞ্জুর হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৮ই সেপ্টেম্বর অভিনেত্রীদের তরফে একটি শোকসভা হয় স্টার রঙ্গমঞ্চে। সুশীলাবালার জিজ্ঞাস্য ছিল— ‘নারীকে বেশ্যা বানায় যাঁরা তাঁরা বেশ্যাকে ঘৃণা করে কোন মুখে?’ শোকসভায় সুশীলাবালা বলেছিলেন, ‘…পতিতা আমরা, সমাজ বর্জিতা বটে— কিন্তু আমরা মানুষ। …প্রিয়জন বিরহে যদি ক্রন্দনের অধিকার থাকে,… বুকফাটা হাহাকারে যদি দোষ না থাকে তবে আমাদের শোক দূষণীয় হইবে কেন?’
এই প্রশ্নটির সদুত্তর কোনও Reformist অবলাবান্ধব দিতে পারেননি বলেই জানি। নাট্য ইতিহাসের রেজিস্টারি তাই বলে।
বিনোদিনীর পর ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’ তারাসুন্দরী, ‘নটকুলমণি’ কুসুমকুমারী, ‘সুধাকন্ঠী’ সুশীলাবালা, ‘সংগীতনিপুণা’ নরীসুন্দরী, সারদামণির স্নেহ ধন্যা নীরদাসুন্দরী… এমন আরও কত পাপিষ্ঠার কথা অ-বলা রয়ে গেল। তাঁদের সম্ভবত কোনও গিরিশবাবু জোটেনি… তাঁরা তাই চকিতের ন্যায় মিলিয়ে গেলেন… কতগুলো পোকায় কাটা আবছা ছবি শুধু রয়ে গেল, আর কোনও কোনও সুভাগিনীর ক্ষেত্রে, গুটি কতক নেহাতই কাঁচা, অপটু কবিতা।
(তথ্যসূত্র:
১- মূল প্রবন্ধের লেখিকা শ্রীমতী পূর্ণা চৌধুরী। মূল লেখাগুলির লিংক:
ক) https://4numberplatform.com/?p=929
খ) https://4numberplatform.com/?p=934&
গ) https://4numberplatform.com/?p=1012&
২- কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত (১৬৮০-১৮৮০), অনীশ দাস অপু এবং লোকনাথ ঘোষ, আকাশ প্রকাশনী।
৩- কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত, লোকনাথ ঘোষ, প্রতিভাস প্রকাশনী।)
১- মূল প্রবন্ধের লেখিকা শ্রীমতী পূর্ণা চৌধুরী। মূল লেখাগুলির লিংক:
ক) https://4numberplatform.com/?p=929
খ) https://4numberplatform.com/?p=934&
গ) https://4numberplatform.com/?p=1012&
২- কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত (১৬৮০-১৮৮০), অনীশ দাস অপু এবং লোকনাথ ঘোষ, আকাশ প্রকাশনী।
৩- কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত, লোকনাথ ঘোষ, প্রতিভাস প্রকাশনী।)
0 মন্তব্যসমূহ