ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মানুষটি আজ ভারত এবং জাপানে এক কিংবদন্তী পুরুষ। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় ১৮৮৬ সালে তাঁর জন্ম। মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই স্বাধীনতামন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। ১৯০৮ সালে তিনি ‘আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ’ মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে ছিলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে দেরাদুনে যান। সেখানে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে হেডক্লার্ক হিসাবে কাজ করেন। দেরাদুনে থাকার সময়ে তাঁর সঙ্গে বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের দেখা-সাক্ষাৎ ঘটে। তরুণ বয়সে এই বাঙালি বীর ভারতে বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে (Lord Hardinge, Viceroy of India, ১৯১০-১৯১৬) হত্যা এবং আর একটি সিপাহী বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে মহাষড়যন্ত্র করেছিলেন, যা ইতিহাসে দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্র (Delhi-Lahore Conspiracy, ১৯১২) নামে খ্যাত। দুর্ভাগ্যক্রমে দুটো পরিকল্পনাই বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। রাসবিহারী বসু জাপানে পালিয়ে আসেন ১৯১৫ সালের ৫ই জুন। তখন তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্য তাঁর মাথার উপর তৎকালীন বৃটিশ সরকারের ১২,০০০ রুপী তথা ৫ হাজার বৃটিশ পাউন্ডের মহাপুরস্কার ঝুলছিল।
জাপানে এসে তিনি প্রথমে পাঞ্জাবের দুর্দান্ত বিপ্লবী ভগবান সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর জাপানে পলাতক চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সান-ইয়াৎ সেনের (১৮৬৬-১৯২৫) কথা জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান সহযোগিতা পাবার আশায়। সান-ইয়াৎ তাঁকে গুরু তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। এর কয়েক মাস পরেই জাপানে আসেন আর এক দুর্দান্ত বিপ্লবী হেরাম্বলাল গুপ্ত (১৮৮৯-১৯৬৫) একই পুরস্কারের অঙ্ক মাথায় নিয়ে। তাঁদের দুজনকে জাপানি পুলিশের হাত থেকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রভাবশালী গণমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা রাজনীতিক এবং ‘গেনয়োশা’ নামক গুপ্ত সমিতির পরিচালক গুরু তোয়ামা মিৎসুরু (১৮৫৫-১৯৪৪)। তাঁকে আরও যাঁরা সহযোগিতা করেন এবং পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন তাঁরা হলেন: কুজো ইয়োশিহিসা, উচিদা রিয়োহেই, ওওকাওয়া শুমেই, সুগিয়ামা শিগেমারু, ইয়াসুওকা মাসাহিরো, শিমোনাকা ইয়াসাবুরো, ওজাকি য়ুউকিও, গোতো শিনপেই, মিৎসুকাওয়া কামেতারো, নাকানো সেইগো, সাসাকি ইয়াসুগোরো, কিমুরা নিক্কি, ড.ওওকুরা কুনিহিকো, ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, য়োশিদা শিগেরু প্রমুখ প্রভাবশালী আদর্শবান এশিয়াবাদী (প্যান-এশিয়ানিস্ট) রাজনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। তাঁদের আগমনের কয়েক মাস পর নভেম্বর মাসে জাপান সফরে আসেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী নেতা, ভয়ঙ্কর বিপ্লবী বলে পরিচিত লালা লাজপৎ রায় (১৮৬৫-১৯২৮)। রাসবিহারী বসু তাঁর আগমনকে উপলক্ষ করে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করতে মনস্থির করেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি চাইছিলেন জাপানি সমাজে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচার করতে যাতে করে জাপানি নাগরিকরা প্রবাসী বিপ্লবীদেরকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে, পাশাপাশি ভারতে বৃটিশের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যদিও জাপান তখন সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ।
ইতিমধ্যে হেরাম্বলাল গুপ্তের সঙ্গে তখনকার প্রখ্যাত প্যান-এশিয়ানিস্ট এবং ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের গবেষক তুখোড় তরুণ বুদ্ধিজীবী ওওকাওয়া শুমেই (১৮৮৬-১৯৫৭)-এর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি গভীরভাবে সহানুভূতিশীল ছিলেন। সম্ভবত তাঁরই পরামর্শে টোকিওর উয়েনো শহরের বিখ্যাত সেইয়োকেন্ মিলনায়তনে তাইশো সম্রাট ইয়োশিহিতো’র (১৯১২-২৬) সিংহাসন আরোহণকে কেন্দ্র করে একটি অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে মূল লক্ষ্য অনুসারে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন লালা লাজপৎ রায়, রাসবিহারী বসু, হেরাম্বলাল গুপ্ত। তোয়ামা মিৎসুরুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন।
ওই সভায় কতিপয় গুপ্তচর উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা যথা সময়ে বিবরণ উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রদূতের কাছে। পরের দিন বৃটিশ দূতাবাস জাপান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে বিপ্লবীদেরকে ধরিয়ে দেবার জন্য। সরকার বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে জাপান ত্যাগের নির্দেশ জারি করেন। লালা রাজপৎ রায় আমেরিকা চলে যান। রাসবিহারী এবং হেরাম্বলালকে গুরু তোয়ামা আশ্রয় প্রদান করেন। তাঁদেরকে তাঁর বাড়ির কাছেই শিনজুকু শহরে অবস্থিত সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘নাকামুরায়া’র কর্ণধার সোমা আইজোর সঙ্গে আলাপ করে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে একটি পরিত্যক্ত ছবি আঁকার স্টুডিও ভবনে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু কিছুদিন পর পুলিশ ঠিকই তাঁদের গুপ্ত অবস্থান জানতে পারে। এর মধ্যে হেরাম্বলাল গৃহবন্দী অবস্থায় অস্থির হয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং ওওকাওয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। মাস চারেক সেখানে থাকার পর আমেরিকায় চলে যান।
এদিকে যখন রাসবিহারী বসুকে আর কিছুতেই পুলিশের নজর থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না তখন তোয়ামা মিৎসুরু সোমা আইজোকে তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা তখন কলেজ ছাত্রী তোশিকো সোমার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাবে সোমা দম্পতি মহাবিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। কিন্তু তাঁদেরকে রক্ষা করেন তোশিকো নিজেই এগিয়ে এসে। প্রস্তাবিত বিয়েতে তিনি রাজি হন। বলেন, ‘মিঃ বোস স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জাপানে থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সহযোগিতা করতে চাই, আমাকে তাঁর কাছেই যেতে দাও।’ তাঁদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৮ সালের ৯ই জুলাই তোয়ামা মিৎসুরুর বাড়িতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে।
কিন্তু বিয়ের পরও কয়েক মাস বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে জীবনযাপন করতে হয় তাঁদেরকে। শাশুড়ি সোমা কোক্কো’র ডায়েরি থেকে ১৭ বার বাসা বদলের তথ্য পাওয়া যায়। এই সময় বিহারী বসু তাঁদের বিয়ে নিয়েও মানসিক অশান্তিতে ভোগেন কিছুদিন। নববিবাহিতা স্ত্রী তোশিকো আসলেই তাঁকে ভালোবাসে কিনা এই সন্দেহে দগ্ধ হচ্ছিলেন। তোশিকো কি পারিবারিক শুভাকাঙ্খী গুরুস্থানীয় তোয়ামা মিৎসুরুর প্রস্তাব উপেক্ষা করতে না পেরে অনিচ্ছাসত্ত্বে তাঁকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে? এই প্রশ্নটি তাঁকে সর্বক্ষণ তাড়া করছিল। একদিন দুজনে বেড়াতে গিয়ে নিভৃতে বিহারী বসু তোশিকোকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, তোশিকো যদি সত্যিই তাঁকে ভালোবাসে তাঁর সামনে প্রমাণ করতে পারবে কিনা? তোশিকো এই কথা শুনে অশ্রুসিক্ত হন। বিহারী বসু বলেন, যদি ভালোবাসো তাহলে এই বারান্দা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরে প্রমাণ করতে পারবে? সঙ্গে সঙ্গে তোশিকো দৌড়ে ঝাঁপ দিতে গেলে বিহারী বসু তাঁকে নিরস্ত করেন। এরপর আর কোনোদিন তাঁদের মধ্যে এ প্রসঙ্গ ওঠেনি। এই ঘটনার পেছনে মূল কারণ ছিল তোশিকোর সঙ্গে নাকামুরায়ার অভ্যন্তরে আশ্রিত নাকামুরা ৎসুনে নাম্নী জনৈক তরুণ চিত্রশিল্পীর সঙ্গে তোশিকোর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা বিহারী বসু জানতেন। ৎসুনে কর্তৃক গোপনে তোশিকোর কয়েকটি ছবি আঁকার ফলে সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঐ চিত্রশিল্পীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিহারী বসু বিয়ের পরও সেই প্রেম তোশিকো ভুলতে পারেনি বলে মনে মনে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তা যে নয় তোশিকো তা প্রমাণ করে দেয়ার পরে বিহারী বসু আশ্বস্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে পালিয়ে থাকলেও দুজনে খুব সুখী ছিলেন। তোশিকো ছিলেন মেধাবী ছাত্রী এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। তিনি বিহারী বসুর একান্ত সচিবের মতো সকল দাপ্তরিক কাজকর্ম করতেন।
১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপে যুদ্ধবিরতি এবং পরের বছর প্যারিস শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়। ফলে বিহারী বসুর উপর থেকে জাপান সরকার সকল বাধানিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বন্ধের সূত্র ধরে ভারতে বৃটিশ প্রশাসন ১৯২১ সালে ‘রয়্যাল ক্লেমেন্সি’ বা ‘রাজকীয় ক্ষমা’ ঘোষণা করে বৃটিশবিরোধী বিদ্রোহী, বিপ্লবী-সন্ত্রাসীদের জন্য একটি শর্তে যে, ক্ষমা চেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে হবে। এই সুযোগ গ্রহণ করেন অনেক জেলবন্দী বিপ্লবী; এমনকি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত আসামিরা পর্যন্ত ছাড়া পান। কিন্তু তাঁরা মুক্ত হয়েই গা ঢাকা দেন। এই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য রাসবিহারী বসুও চন্দননগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে বাংলার ইংরেজ গভর্নমেন্টের কাছে লিখিত পত্রে আবেদন জানান ১৮ এপ্রিল ১৯২১ তারিখে। কিন্তু বৃটিশ সরকারের বিবেচনায় বিহারী বসু তখনও এক নম্বর শত্রু বলে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর কী হয়েছিল জানা যায় না, তবে তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রকৃত কারণ আজও রহস্যজনক। যাই হোক, পলাতক জীবনের ইতি ঘটিয়ে এবার মুক্ত আলোয় স্বাধীনভাবে বসবাস শুরু করেন নবদম্পতি। দুবছর পর ১৯২০ সালে পুত্র মাসাহিদে ১৯২২ সালে এবং কন্যা তেৎসুকো জন্মগ্রহণ করে। নিজের বংশ পরিচয়ে পরিচিত করার জন্য তিনি জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন ১৯২৩ সালে। কিন্তু দাম্পত্য-সুখ বেশি দিন তাঁর ভাগ্যে সয় না। পলাতক জীবনে স্ত্রী তোশিকোকে অমানবিক কষ্ট সহ্য করতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গায়, সেখানে না ছিল পর্যাপ্ত আলো-বায়ু, না ছিল সুস্থ পরিবেশ। ফলে লাগাতার জ্বরজারি থেকে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ভুগে ১৯২৫ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে পরলোকে যাত্রা করেন। ধরায় রেখে যান প্রাণপ্রিয় স্বামী ও দুটি শিশুসন্তানকে। পরলোকগত স্ত্রীর ভালোবাসার সম্মানার্থে রাসবিহারী বসু আর বিয়ে করেননি বাকি জীবনে শাশুড়ির আবেদন-নিবেদন সত্ত্বেও। পত্নীবিয়োগের এক বছর পর ১৯২৭ সালে নাকামুরায়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ্বিতলে ভারতীয় কারি রেস্টুরেন্ট ‘ইন্দো নো মোন’ তথা ‘ভারতীয় তোরণ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ৮০ বছর পেরিয়ে এই কারি রেস্টুরেন্ট এখনও ‘নাকামুরায়া নো কারেএ’ নামে জাপানে কিংবদন্তীসম জনপ্রিয়। রাসবিহারী বসুই প্রথম জাপানে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মশলায় রাঁধা মুরগি-মাংসের কারি প্রচলন করেন। একই ধরনের সুস্বাদু কারি আজও জাপানি পাচক উপহার দিচ্ছেন প্রতিদিন। ভারত বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা তাঁর সম্পর্কে জানেন, এই রেস্টুরেন্টে এসে এই কারির স্বাদ গ্রহণ এবং রাসবিহারী বসুকে স্মরণ করেন। তবে তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই আঙুলে গোনার মতো।
এই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এখানে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনকারী জাপানি রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ আলাপ-আলোচনায় বসতেন। অবশ্য অন্যান্য প্রবাসী ভারতীয়রাও আসতেন নিয়মিত। রাসবিহারী বসু ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের (IIL: Indian Independence League) প্রেসিডেন্ট। অসাধারণ কূটনৈতিক মেধাশক্তি ও বিচক্ষণতা দিয়ে প্রভাবশালী জাপানি নেতৃবৃন্দের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার যেমন করতে পেরেছিলেন তেমনি জাপানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশ্বাস ও রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা ছিল ভিন্ন দুটি জাতি ও সংস্কৃতির সমন্বয় রক্ষার্থে অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। কিন্তু এই কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন বলা যায়।
ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনে জাপান-প্রবাসী রাসবিহারী বসুর অবদানের কথা বলতে গেলে এটাই শুধু বলতে হয় যে, তিনি জাপানে না এলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কোন পথে যেত এবং কবে স্বাধীনতা আসত বলা মুশকিল। মূলত তাঁর প্রচেষ্টার জোরেই জার্মানি প্রবাসী সুভাষচন্দ্র বসু জাপানে আহুত হয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA: Indian National Army) মূলত বিহারী বসুর পরিকল্পনা ও উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ১৯৪২ সালেই এবং পরে সুভাষচন্দ্র বসু যার অধিনায়ক হন। এবং এই উপলক্ষে সিঙ্গাপুরে আয়োজিত এক মহাসভায় রাসবিহারী বসুই সুভাষ বসুকে ‘নেতাজি’ অভিধা প্রদান করেন বলে কথিত আছে। তিনি গোঁড়া থেকেই গান্ধীকে ভক্তি করলেও তাঁর অহিংস নীতির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি গান্ধীর বিকল্প একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধিনায়কের প্রত্যাশায় ছিলেন। সেই অধিনায়কই হচ্ছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁকে ‘দেশনায়ক’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মৃত্যুর আগে। তাঁর সঙ্গে ১৯৩৮ সাল থেকেই রাসবিহারী চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিস্থিতি বুঝে ১৯৪০ সালে গান্ধীকে ‘গতকালের লোক’ বলে অভিহিত করে ‘আজকের অবিসংবাদিত নেতা’ হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ঘোষণা করেন। বিভিন্ন জাপানি পত্রিকা ও সাময়িকীতে সুভাষ বসুর নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তাঁর চৌকস তারুণ্য, যোগ্যতা, অনস্বীকার্যতা এবং বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব তুলে ধরে একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন মূলত এশিয়াবাদী ভারতদরদী জাপানি রাজনীতিক, প্রভাবশালী সরকারি কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সহানুভূতি লাভের জন্য। যাতে করে জাপানিদের সামনে বর্তমান ও আগামী ভারতবর্ষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর একটি সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে—যেহেতু জাপান ছাড়া আর কোনো দেশ ছিল না তখন যে দেশটি ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত জাপানের সশস্ত্র ভূমিকাই ভারতবাসীর আরাধ্য স্বাধীনতা দ্রুত অর্জনে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু এর জন্য রাসবিহারী বসুসহ অসংখ্য প্রবাসী বিপ্লবী ও নেতাজির বহু বছরের সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষাকে স্বীকার না করলে নয়। কিন্তু তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন আজও হয়েছে বলে মনে হয় না।
চরমপন্থী রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ত্যাগ করে রাশিয়া হয়ে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ জার্মানির বার্লিন শহরে পৌঁছেছিলেন। সেখানে থেকেই তিনি স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে থাকেন। একমাত্র বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৪৩ সালের ১৬ মে জাপানে আগমন করেন। এই সালেই নেতাজি গঠিত স্বাধীন ভারত সরকারের (Free India Government/Provisional Government) প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন রাসবিহারী বসু। তখন তিনি মরণব্যাধি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত, অসুস্থ। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি টোকিওর নিজগৃহে। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে মাসাহিদে বোস জাপানি সৈন্য হিসেবে ওকিনাওয়া যুদ্ধে মিত্রশক্তি মার্কিনী সেনাদের হাতে প্রাণ হারান। মেয়ে তেৎসুকো বোস হিগুচি পদবিধারী জনৈক জাপানি প্রকৌশলীকে বিয়ে করে বর্তমানে বার্ধক্য জীবন অতিবাহিত করছেন। একবারও যেতে পারেননি স্বাধীন পিতৃভূমিতে। কেন যেতে পারেননি সেও এক রহস্য। স্বাধীন ভারতের কোনো রাজনীতিক তাঁকে তাঁর পিতৃভূমিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিনা জানি না, জানালে নিশ্চয়ই তিনি যেতেন। তবে মেয়ে তথা রাসবিহারীর পৌত্রী মাতামহের জন্মস্থান একবার ঘুরে এসেছেন ব্যক্তিগতভাবে। সম্প্রতি বিশিষ্ট ভারত-বিষয়ক গবেষক এবং হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাকাজিমা তাকেশি তেৎসুকো হিগুচির মুখে শোনা তাঁর পিতার কাহিনী একটি চমৎকার গ্রন্থ চিচি বোওসু বা পিতা বোস-এ লিপিবদ্ধ করেছেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন যেমন শিক্ষামূলক তেমনি বৈচিত্র্যময় একটি উপন্যাস বললে অত্যুক্তি হয় না, যা চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হলে পরে তরুণ প্রজন্মকেই শুধু স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ করবে না, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’দের জন্যও শিক্ষণীয় হবে নিঃসন্দেহে। ন্যাশনালিস্টরা যে চোর হয় না, জনগণের সম্পদ লুন্ঠনকারী নয়, একমাত্র নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন কৈশোর থেকেই তার আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন। তাঁর নীতিজ্ঞান ছিল অত্যন্ত খাঁটি। তিনি যেমন ছিলেন একনিষ্ঠ হিন্দুধর্মাবলম্বী তেমনি নিঃস্বার্থ স্বদেশপ্রেমে তেজস্বী। নিয়ম ও সময়জ্ঞান ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রখর। তাঁর প্রবল আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ তাঁকে আজীবন সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছিল। ১৯৩৫ সালে তিনি টোকিওতে বিশ্ব আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, নিজেও গবেষণা করেছিলেন মূলত বিশ্বসংস্কৃতিকে আরও অনুধাবন করার জন্য। শুধু এশিয়ার পরাধীন মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণার্থে তাঁর উদ্যোগের ইতিহাস অপ্রচারিতই থেকে গেছে।
রাসবিহারী বসুর মৃত্যুর পর এত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু আজও তিনি প্রবীণ জাপানিদের মনে বিখ্যাত ‘ইনদো শিশি’ বা ‘ভারতীয় বীরপুরুষ’ ভাবমূর্তিতে অধিষ্ঠিত। টোকিওর প্রাণকেন্দ্র শিনজুকু শহরস্থ ‘নাকামুরায়া’ মানেই রাসবিহারী বসু। প্রতিষ্ঠানের দোতলায় রেস্টুরেন্টের প্রবেশপথেই স্থাপিত শোকেসে তাঁর ও পরিবারের আলোকচিত্র রক্ষিত আছে। কিন্তু বাঙালি জানে না তাঁর ইতিহাস একেবারেই। আজকে এই যে দুই বাংলা থেকে হাজার হাজার বাঙালি জাপানে এসে কাজ করছে, ব্যবসা করছে এবং স্বদেশী সংস্কৃতির সংগঠন-সমিতি প্রতিষ্ঠা করছে, এই ধারার সূচনাই করেছিলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে শিনজুকু শহরে ‘এশিয়া হাউস’ নামে একটি ৮ কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল রেস্টহাউস স্থাপন করেছিলেন। সেখানে ৫৮ জন এশিয়ান অভিবাসী বসবাস করতেন। এখানে এশিয়ার মুক্তি, জাপানের সঙ্গে এশিয়ার ভাতৃবন্ধন, সাংস্কৃতিক বিনিময় ইত্যাদি বিষয়ক সভা, আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পান-ভোজনাদি অনুষ্ঠিত হত। তখনকার খ্যাত-অখ্যাত একাধিক জাতীয় পত্রিকা, সাময়িকীর সম্পাদক, সাংবাদিক পর্যন্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে আসতেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। রাসবিহারী বসু জাপানস্থ ভারতীয়সহ এশিয়ানদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য ‘কারিভোজ’ দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন। অবশ্য জাপানি খাবার-দাবার যে ছিল না তা নয়। তবে ‘নাকামুরায়া’ প্রতিষ্ঠানের দোতলায় নিজস্ব ভারতীয় রেস্টুরেন্টে তাঁর নিজের হাতে তৈরি ‘ইন্ডিয়ান কারি-রাইস’ খাবারের সুনাম ইতিমধ্যে টোকিওসহ বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে ‘এশিয়া হাউসে’ সভা-সমাবেশ মানেই ভারতীয় কারি আর সেটা তৈরি করবেন ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু—এই ঘটনা শহরব্যাপী মুখরোচক সংবাদে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ছিল।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবাসী ভারতীয়দেরকে একত্রিত করার জন্য তিনি ‘ভারত মৈত্রী সমিতি’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে শুধু যে ভারতীয়রা আসতেন তা নয়, ভারত, এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহী জাপানিরাও আসতেন। আলাপ-আলোচনা এবং পান-ভোজনাদি হত বেশ ঘটা করে। প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালের ৩০ শে জুন তারিখে তাঁর রেস্টুরেন্টের ভিতরেই। তাতে ৩১ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন জাপানের স্বনামখ্যাত আন্তর্জাতিক কবি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু নোগুচি ইয়োনেজিরো (১৮৭৫-১৯৪৭) বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সমিতির সর্বমোট ১০টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমিতি থেকে ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সম্মেলনে জাপান থেকে একজন প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। আবার ভারত থেকে বিশেষ অতিথি কেউ এলে তাঁর স্মরণে বিশেষ সভা-সম্মিলনেরও আয়োজন করেছেন তিনি। যেমন জাপানস্থ প্রাচ্য গবেষণা সংস্থায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিনয়কুমার সরকার; জাপান সফরে এসেছিলেন স্বনামখ্যাত বৌদ্ধভিক্ষু রাষ্ট্রপাল সান্ধিরিয়া; বিশ্বভারতীর জনৈক শিল্পী-অধ্যাপকও এসেছিলেন বলে জানা যায়, তাঁরা বিশেষ সভায় আলোচনা ও বক্তৃতা করেছিলেন।
নানাবিধ কাজের পাশাপাশি রাসবিহারী বসু নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকসাহিত্য এবং ভারতে বৃটিশের শাসন-শোষণ নিয়ে অনেক লেখা জাপানি জাতীয় দৈনিক, সাময়িকী ও সংকলনে প্রকাশ করেছেন। তবে অধিকাংশই জাপানি ভাষায়। সারা জাপান ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অবরুদ্ধ, শোষিত মাতৃভূমির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দুরবস্থার ইতিহাস তুলে ধরেছেন জাপানিদের সামনে। জাপানে এশিয়ানদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এশিয়ানদের মুখপত্র হিসেবে নিজব্যয়ে মাসিক নিউ এশিয়া নামে একটি তথ্যভিত্তিক কাগজ প্রকাশ করেছিলেন কিছুদিন। স্বনামে ও যৌথভাবে প্রায় ১৫/১৬টি গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন। যার মধ্যে গ্রন্থিত আছে মূল্যবান বিস্তর তথ্য ও ঘটনা। গ্রন্থগুলোর মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন। চরমপন্থী বিপ্লবী হলেও তিনি যে রোমান্টিক ছিলেন তাতেই প্রমাণিত হয়। যুদ্ধপূর্ব টোকিওর সবচেয়ে ব্যয়বহুল কেতাদুরস্ত আধুনিক শহর ‘গিনজা’তে প্রায়শ সন্ধ্যেবেলা ‘সুশি বার’ পানশালায় বন্ধুদের সঙ্গে দিলখোলা আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর জাপানে একাধিকবার সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাঁকে ঘটা করে সংবর্ধনা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। কবিগুরু ১৯২৪ সালের জুন মাসের একদিন তাঁর বাড়িতে এসে পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাসবিহারী বিশ্বভারতীর জন্য চাঁদা তুলে কবির হাতে তুলে দেন। স্ত্রীর মাসতুতো বোন মাকি হোশিকে শান্তিনিকেতনে পাঠান ফুলসজ্জাবিদ্যা ‘ইকেবানা’ ও ঐত্যিবাহী চা-অনুষ্ঠান ‘চাদোও’র প্রশিক্ষক হিসেবে। ১৯২৯ সালে কবিগুরু কানাডা থেকে ফেরার পথে জাপানে কিছুদিন বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে টোকিওতে তাঁর তিন সপ্তাহকাল বসবাসের ব্যবস্থা করেন তাঁর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বন্ধু ড. ওওকুরা কুনিহিকোর প্রাসাদোপম বাড়িতে। এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ জাপান সফর। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের অশেষ আশীর্বাদ পেলেও একটি বিষয়ে তাঁর সহানুভূতিলাভে ব্যর্থ হন রাসবিহারী বসু। ১৯৩১ সালে চীনের মাঞ্চুরিয়া রাজ্য জাপান আক্রমণ করলে রবীন্দ্রনাথ মনঃক্ষুণ্ন হন; অপ্রত্যাশিত হিসেবে এই সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচনা করেন। ১৯৩৭ সালে যখন চীন-জাপান দ্বিতীয় যুদ্ধ বাঁধে তাতে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীসহ ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় তোলেন জাপানের বিরুদ্ধে। প্রকৃতপক্ষে, মাঞ্চুরিয়ার আসল ইতিহাস ও ঘটনা এবং দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের পটভূমি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছুই জানতেন না বলে অনেক গবেষকই মনে করেন। তাঁর কানে ভুল তথ্য দিয়ে থাকবেন তখন শান্তিনিকেতনে অবস্থানরত চীনা ভবনের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীরা বলে কোনো কোনো গবেষকের ধারণা। যাহোক, চীন আক্রমণ নিয়ে ভারতে যখন জাপান-বিরোধী প্রতিবাদ তুঙ্গে তখন জাপানিরাও মনঃক্ষুণ্ন হন। বিশ বছরের পুরনো বন্ধু কবি নোগুচি ইয়োনেজিরো এই সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক পত্রযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সবচেয়ে বেশি নিরাশ হন রাসবিহারীকে সুদীর্ঘ ২১ বছর ধরে যে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে তাঁরা। রাসবিহারী বসু এই মহাসংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত ঘটনা বুঝিয়ে বলার জন্য তাঁকে ১৯৩৮ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে জাপানে আসার আমন্ত্রণপত্র পাঠান জাহাজ ভাড়া ৫০,০০০ ইয়েন বাজেটের কথা উল্লেখ করে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রস্তাবে রাজি হননি, উত্তরে তিনি লিখেন, ‘দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে আমার শরীর উত্তম পর্যায়ে নেই। কিন্তু জাপানের প্রতি আমার যে মিশন তা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত আয়োজন করে থাকলে তোমার প্রস্তাব বিবেচনা না করলে নয়। আমার মিশন হচ্ছে, এখন এশিয়ার যে মহা দুটি জাতি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাদের মধ্যে সংস্কৃতি ও মৈত্রী সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু জাপানি কর্তৃপক্ষ আমাকে মুক্তচিত্তে চলার ও বলার সুযোগ দেবে কিনা এই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কাজেই জাপান ভ্রমণ করে ছলচাতুরির মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে চাই না। তথাপি জাপানের প্রতি আমার সত্যিকার ভালোবাসা বহন করছি।’ এই কারণে অনেক ভারতীয় ও বাংলাদেশী রাসবিহারী বসুকে জাপানের দালাল বলে কটাক্ষ করেন যা কিনা অজ্ঞতার পরিচায়ক ছাড়া আর কিছু নয়। যাঁরা ইতিহাস সচেতন তাঁরাই তাঁকে বীর দেশপ্রেমিক হিসেবে সম্মান করেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। রাসবিহারী বসুর জাপানে জীবিতকালের সুদীর্ঘ ৩০ বছরের ঘটনাবহুল ইতিহাস সত্যিই আকর্ষণীয়। তিনি যেমন বিদেশী হিসেবে তৎকালীন রক্ষণশীল জাপানি সমাজের কঠোর সমালোচনা করেছেন তেমনি উদারপন্থী প্রভাবশালী জাপানিদের প্রিয়ভাজনও হয়ে উঠেছিলেন। জাপানের সামরিক শক্তির সাহায্যে মাতৃভূমি ভারতের মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে জাপান ও ভারতবর্ষের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি-বন্ধনের প্রথম সেতুই হচ্ছেন রাসবিহারী বসু।
মৃত্যুর পূর্বে মহাপূর্ব-এশিয়া যুদ্ধ তথা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার মূল্যায়নস্বরূপ শোওয়া সম্রাট হিরোহিতো (১৯০১-৮৯) সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মাননা-পদক প্রদান করেন রাসবিহারী বসুকে। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হননি বলে কন্যা তেৎসুকোর ভাষ্য থেকে জানা যায়। মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সেটা পাঠানো হয় রাসবিহারীর বাড়ির ঠিকানায়। এই রকম রাজকীয় সম্মান পেয়েছেন আর একজন বাঙালি দূরপ্রাচ্য টোকিও আন্তর্জাতিক সামরিক বিচার তথা টোকিও ট্রাইব্যুনালের (১৯৪৬-১৯৪৮) অন্যতম বিচারপতি বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় জন্ম ড.রাধাবিনোদ পাল ১৯৬৬ সালে। ১৯৪৫ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকেও জাপান সরকার অনুরূপ পদক প্রদানের পরিকল্পনা করেছিলেন। নেতাজি বিনীতভাবে তা প্রত্যাখান করেন।
১৯৫৭ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতসহ জাপান সফরে আসেন। কথিত আছে, তিনি রাসবিহারী বসু সম্পর্কে কোনো খোঁজ-খবর নেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অপরিসীম অবদানকে স্মরণ করে নেহেরু ইচ্ছে করলে শিনজুকু শহরে অবস্থিত নাকামুরায়া তথা একদা বসুর শ্বশুরালয়ে পদধুলি রাখতেই পারতেন। কিংবা টোকিওর অদূরে অকুতামা শহরে অবস্থিত তাঁর সমাধিতে অর্পণ করতেই পারতেন সামান্য কিছু ফুল। তিনি কিছুই করেননি। ঐ সময়ে নেহেরু টোকিওর রেনকোজি বৌদ্ধমন্দিরে (এখানে নেতাজির তথাকথিত চিতাভস্ম (!) সংরক্ষিত আছে) যে বাণী লিখেছেন সেখানে নেতাজির কোনো প্রসঙ্গই নেই, আছে গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম প্রসঙ্গে ইংরেজিতে লিখিত দুছত্র মন্তব্য। নেতাজিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করা হয়েছে এই সেদিন ১৯৯২ সালে। নেতাজি তবুও সম্মানিত হয়েছেন; কিন্তু রাসবিহারী বসুর ভাগ্যে কোনো পুরস্কারই জোটেনি—এক কলকাতার এক রাস্তার পাশে নির্মিত একটি বিসদৃশ প্রস্তরমূর্তি ছাড়া।
জাপানে এসে তিনি প্রথমে পাঞ্জাবের দুর্দান্ত বিপ্লবী ভগবান সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর জাপানে পলাতক চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সান-ইয়াৎ সেনের (১৮৬৬-১৯২৫) কথা জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান সহযোগিতা পাবার আশায়। সান-ইয়াৎ তাঁকে গুরু তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। এর কয়েক মাস পরেই জাপানে আসেন আর এক দুর্দান্ত বিপ্লবী হেরাম্বলাল গুপ্ত (১৮৮৯-১৯৬৫) একই পুরস্কারের অঙ্ক মাথায় নিয়ে। তাঁদের দুজনকে জাপানি পুলিশের হাত থেকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রভাবশালী গণমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা রাজনীতিক এবং ‘গেনয়োশা’ নামক গুপ্ত সমিতির পরিচালক গুরু তোয়ামা মিৎসুরু (১৮৫৫-১৯৪৪)। তাঁকে আরও যাঁরা সহযোগিতা করেন এবং পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন তাঁরা হলেন: কুজো ইয়োশিহিসা, উচিদা রিয়োহেই, ওওকাওয়া শুমেই, সুগিয়ামা শিগেমারু, ইয়াসুওকা মাসাহিরো, শিমোনাকা ইয়াসাবুরো, ওজাকি য়ুউকিও, গোতো শিনপেই, মিৎসুকাওয়া কামেতারো, নাকানো সেইগো, সাসাকি ইয়াসুগোরো, কিমুরা নিক্কি, ড.ওওকুরা কুনিহিকো, ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, য়োশিদা শিগেরু প্রমুখ প্রভাবশালী আদর্শবান এশিয়াবাদী (প্যান-এশিয়ানিস্ট) রাজনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। তাঁদের আগমনের কয়েক মাস পর নভেম্বর মাসে জাপান সফরে আসেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী নেতা, ভয়ঙ্কর বিপ্লবী বলে পরিচিত লালা লাজপৎ রায় (১৮৬৫-১৯২৮)। রাসবিহারী বসু তাঁর আগমনকে উপলক্ষ করে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করতে মনস্থির করেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি চাইছিলেন জাপানি সমাজে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচার করতে যাতে করে জাপানি নাগরিকরা প্রবাসী বিপ্লবীদেরকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে, পাশাপাশি ভারতে বৃটিশের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যদিও জাপান তখন সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ।
ইতিমধ্যে হেরাম্বলাল গুপ্তের সঙ্গে তখনকার প্রখ্যাত প্যান-এশিয়ানিস্ট এবং ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের গবেষক তুখোড় তরুণ বুদ্ধিজীবী ওওকাওয়া শুমেই (১৮৮৬-১৯৫৭)-এর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি গভীরভাবে সহানুভূতিশীল ছিলেন। সম্ভবত তাঁরই পরামর্শে টোকিওর উয়েনো শহরের বিখ্যাত সেইয়োকেন্ মিলনায়তনে তাইশো সম্রাট ইয়োশিহিতো’র (১৯১২-২৬) সিংহাসন আরোহণকে কেন্দ্র করে একটি অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে মূল লক্ষ্য অনুসারে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন লালা লাজপৎ রায়, রাসবিহারী বসু, হেরাম্বলাল গুপ্ত। তোয়ামা মিৎসুরুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন।
ওই সভায় কতিপয় গুপ্তচর উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা যথা সময়ে বিবরণ উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রদূতের কাছে। পরের দিন বৃটিশ দূতাবাস জাপান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে বিপ্লবীদেরকে ধরিয়ে দেবার জন্য। সরকার বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে জাপান ত্যাগের নির্দেশ জারি করেন। লালা রাজপৎ রায় আমেরিকা চলে যান। রাসবিহারী এবং হেরাম্বলালকে গুরু তোয়ামা আশ্রয় প্রদান করেন। তাঁদেরকে তাঁর বাড়ির কাছেই শিনজুকু শহরে অবস্থিত সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘নাকামুরায়া’র কর্ণধার সোমা আইজোর সঙ্গে আলাপ করে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে একটি পরিত্যক্ত ছবি আঁকার স্টুডিও ভবনে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু কিছুদিন পর পুলিশ ঠিকই তাঁদের গুপ্ত অবস্থান জানতে পারে। এর মধ্যে হেরাম্বলাল গৃহবন্দী অবস্থায় অস্থির হয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং ওওকাওয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। মাস চারেক সেখানে থাকার পর আমেরিকায় চলে যান।
এদিকে যখন রাসবিহারী বসুকে আর কিছুতেই পুলিশের নজর থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না তখন তোয়ামা মিৎসুরু সোমা আইজোকে তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা তখন কলেজ ছাত্রী তোশিকো সোমার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাবে সোমা দম্পতি মহাবিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। কিন্তু তাঁদেরকে রক্ষা করেন তোশিকো নিজেই এগিয়ে এসে। প্রস্তাবিত বিয়েতে তিনি রাজি হন। বলেন, ‘মিঃ বোস স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জাপানে থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সহযোগিতা করতে চাই, আমাকে তাঁর কাছেই যেতে দাও।’ তাঁদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৮ সালের ৯ই জুলাই তোয়ামা মিৎসুরুর বাড়িতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে।
কিন্তু বিয়ের পরও কয়েক মাস বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে জীবনযাপন করতে হয় তাঁদেরকে। শাশুড়ি সোমা কোক্কো’র ডায়েরি থেকে ১৭ বার বাসা বদলের তথ্য পাওয়া যায়। এই সময় বিহারী বসু তাঁদের বিয়ে নিয়েও মানসিক অশান্তিতে ভোগেন কিছুদিন। নববিবাহিতা স্ত্রী তোশিকো আসলেই তাঁকে ভালোবাসে কিনা এই সন্দেহে দগ্ধ হচ্ছিলেন। তোশিকো কি পারিবারিক শুভাকাঙ্খী গুরুস্থানীয় তোয়ামা মিৎসুরুর প্রস্তাব উপেক্ষা করতে না পেরে অনিচ্ছাসত্ত্বে তাঁকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে? এই প্রশ্নটি তাঁকে সর্বক্ষণ তাড়া করছিল। একদিন দুজনে বেড়াতে গিয়ে নিভৃতে বিহারী বসু তোশিকোকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, তোশিকো যদি সত্যিই তাঁকে ভালোবাসে তাঁর সামনে প্রমাণ করতে পারবে কিনা? তোশিকো এই কথা শুনে অশ্রুসিক্ত হন। বিহারী বসু বলেন, যদি ভালোবাসো তাহলে এই বারান্দা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরে প্রমাণ করতে পারবে? সঙ্গে সঙ্গে তোশিকো দৌড়ে ঝাঁপ দিতে গেলে বিহারী বসু তাঁকে নিরস্ত করেন। এরপর আর কোনোদিন তাঁদের মধ্যে এ প্রসঙ্গ ওঠেনি। এই ঘটনার পেছনে মূল কারণ ছিল তোশিকোর সঙ্গে নাকামুরায়ার অভ্যন্তরে আশ্রিত নাকামুরা ৎসুনে নাম্নী জনৈক তরুণ চিত্রশিল্পীর সঙ্গে তোশিকোর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা বিহারী বসু জানতেন। ৎসুনে কর্তৃক গোপনে তোশিকোর কয়েকটি ছবি আঁকার ফলে সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঐ চিত্রশিল্পীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিহারী বসু বিয়ের পরও সেই প্রেম তোশিকো ভুলতে পারেনি বলে মনে মনে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তা যে নয় তোশিকো তা প্রমাণ করে দেয়ার পরে বিহারী বসু আশ্বস্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে পালিয়ে থাকলেও দুজনে খুব সুখী ছিলেন। তোশিকো ছিলেন মেধাবী ছাত্রী এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। তিনি বিহারী বসুর একান্ত সচিবের মতো সকল দাপ্তরিক কাজকর্ম করতেন।
১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপে যুদ্ধবিরতি এবং পরের বছর প্যারিস শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়। ফলে বিহারী বসুর উপর থেকে জাপান সরকার সকল বাধানিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বন্ধের সূত্র ধরে ভারতে বৃটিশ প্রশাসন ১৯২১ সালে ‘রয়্যাল ক্লেমেন্সি’ বা ‘রাজকীয় ক্ষমা’ ঘোষণা করে বৃটিশবিরোধী বিদ্রোহী, বিপ্লবী-সন্ত্রাসীদের জন্য একটি শর্তে যে, ক্ষমা চেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে হবে। এই সুযোগ গ্রহণ করেন অনেক জেলবন্দী বিপ্লবী; এমনকি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত আসামিরা পর্যন্ত ছাড়া পান। কিন্তু তাঁরা মুক্ত হয়েই গা ঢাকা দেন। এই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য রাসবিহারী বসুও চন্দননগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে বাংলার ইংরেজ গভর্নমেন্টের কাছে লিখিত পত্রে আবেদন জানান ১৮ এপ্রিল ১৯২১ তারিখে। কিন্তু বৃটিশ সরকারের বিবেচনায় বিহারী বসু তখনও এক নম্বর শত্রু বলে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর কী হয়েছিল জানা যায় না, তবে তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রকৃত কারণ আজও রহস্যজনক। যাই হোক, পলাতক জীবনের ইতি ঘটিয়ে এবার মুক্ত আলোয় স্বাধীনভাবে বসবাস শুরু করেন নবদম্পতি। দুবছর পর ১৯২০ সালে পুত্র মাসাহিদে ১৯২২ সালে এবং কন্যা তেৎসুকো জন্মগ্রহণ করে। নিজের বংশ পরিচয়ে পরিচিত করার জন্য তিনি জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন ১৯২৩ সালে। কিন্তু দাম্পত্য-সুখ বেশি দিন তাঁর ভাগ্যে সয় না। পলাতক জীবনে স্ত্রী তোশিকোকে অমানবিক কষ্ট সহ্য করতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গায়, সেখানে না ছিল পর্যাপ্ত আলো-বায়ু, না ছিল সুস্থ পরিবেশ। ফলে লাগাতার জ্বরজারি থেকে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ভুগে ১৯২৫ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে পরলোকে যাত্রা করেন। ধরায় রেখে যান প্রাণপ্রিয় স্বামী ও দুটি শিশুসন্তানকে। পরলোকগত স্ত্রীর ভালোবাসার সম্মানার্থে রাসবিহারী বসু আর বিয়ে করেননি বাকি জীবনে শাশুড়ির আবেদন-নিবেদন সত্ত্বেও। পত্নীবিয়োগের এক বছর পর ১৯২৭ সালে নাকামুরায়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ্বিতলে ভারতীয় কারি রেস্টুরেন্ট ‘ইন্দো নো মোন’ তথা ‘ভারতীয় তোরণ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ৮০ বছর পেরিয়ে এই কারি রেস্টুরেন্ট এখনও ‘নাকামুরায়া নো কারেএ’ নামে জাপানে কিংবদন্তীসম জনপ্রিয়। রাসবিহারী বসুই প্রথম জাপানে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মশলায় রাঁধা মুরগি-মাংসের কারি প্রচলন করেন। একই ধরনের সুস্বাদু কারি আজও জাপানি পাচক উপহার দিচ্ছেন প্রতিদিন। ভারত বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা তাঁর সম্পর্কে জানেন, এই রেস্টুরেন্টে এসে এই কারির স্বাদ গ্রহণ এবং রাসবিহারী বসুকে স্মরণ করেন। তবে তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই আঙুলে গোনার মতো।
এই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এখানে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনকারী জাপানি রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ আলাপ-আলোচনায় বসতেন। অবশ্য অন্যান্য প্রবাসী ভারতীয়রাও আসতেন নিয়মিত। রাসবিহারী বসু ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের (IIL: Indian Independence League) প্রেসিডেন্ট। অসাধারণ কূটনৈতিক মেধাশক্তি ও বিচক্ষণতা দিয়ে প্রভাবশালী জাপানি নেতৃবৃন্দের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার যেমন করতে পেরেছিলেন তেমনি জাপানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশ্বাস ও রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা ছিল ভিন্ন দুটি জাতি ও সংস্কৃতির সমন্বয় রক্ষার্থে অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। কিন্তু এই কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন বলা যায়।
ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনে জাপান-প্রবাসী রাসবিহারী বসুর অবদানের কথা বলতে গেলে এটাই শুধু বলতে হয় যে, তিনি জাপানে না এলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কোন পথে যেত এবং কবে স্বাধীনতা আসত বলা মুশকিল। মূলত তাঁর প্রচেষ্টার জোরেই জার্মানি প্রবাসী সুভাষচন্দ্র বসু জাপানে আহুত হয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA: Indian National Army) মূলত বিহারী বসুর পরিকল্পনা ও উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ১৯৪২ সালেই এবং পরে সুভাষচন্দ্র বসু যার অধিনায়ক হন। এবং এই উপলক্ষে সিঙ্গাপুরে আয়োজিত এক মহাসভায় রাসবিহারী বসুই সুভাষ বসুকে ‘নেতাজি’ অভিধা প্রদান করেন বলে কথিত আছে। তিনি গোঁড়া থেকেই গান্ধীকে ভক্তি করলেও তাঁর অহিংস নীতির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি গান্ধীর বিকল্প একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধিনায়কের প্রত্যাশায় ছিলেন। সেই অধিনায়কই হচ্ছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁকে ‘দেশনায়ক’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মৃত্যুর আগে। তাঁর সঙ্গে ১৯৩৮ সাল থেকেই রাসবিহারী চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিস্থিতি বুঝে ১৯৪০ সালে গান্ধীকে ‘গতকালের লোক’ বলে অভিহিত করে ‘আজকের অবিসংবাদিত নেতা’ হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ঘোষণা করেন। বিভিন্ন জাপানি পত্রিকা ও সাময়িকীতে সুভাষ বসুর নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তাঁর চৌকস তারুণ্য, যোগ্যতা, অনস্বীকার্যতা এবং বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব তুলে ধরে একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন মূলত এশিয়াবাদী ভারতদরদী জাপানি রাজনীতিক, প্রভাবশালী সরকারি কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সহানুভূতি লাভের জন্য। যাতে করে জাপানিদের সামনে বর্তমান ও আগামী ভারতবর্ষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর একটি সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে—যেহেতু জাপান ছাড়া আর কোনো দেশ ছিল না তখন যে দেশটি ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত জাপানের সশস্ত্র ভূমিকাই ভারতবাসীর আরাধ্য স্বাধীনতা দ্রুত অর্জনে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু এর জন্য রাসবিহারী বসুসহ অসংখ্য প্রবাসী বিপ্লবী ও নেতাজির বহু বছরের সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষাকে স্বীকার না করলে নয়। কিন্তু তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন আজও হয়েছে বলে মনে হয় না।
চরমপন্থী রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ত্যাগ করে রাশিয়া হয়ে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ জার্মানির বার্লিন শহরে পৌঁছেছিলেন। সেখানে থেকেই তিনি স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে থাকেন। একমাত্র বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৪৩ সালের ১৬ মে জাপানে আগমন করেন। এই সালেই নেতাজি গঠিত স্বাধীন ভারত সরকারের (Free India Government/Provisional Government) প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন রাসবিহারী বসু। তখন তিনি মরণব্যাধি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত, অসুস্থ। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি টোকিওর নিজগৃহে। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে মাসাহিদে বোস জাপানি সৈন্য হিসেবে ওকিনাওয়া যুদ্ধে মিত্রশক্তি মার্কিনী সেনাদের হাতে প্রাণ হারান। মেয়ে তেৎসুকো বোস হিগুচি পদবিধারী জনৈক জাপানি প্রকৌশলীকে বিয়ে করে বর্তমানে বার্ধক্য জীবন অতিবাহিত করছেন। একবারও যেতে পারেননি স্বাধীন পিতৃভূমিতে। কেন যেতে পারেননি সেও এক রহস্য। স্বাধীন ভারতের কোনো রাজনীতিক তাঁকে তাঁর পিতৃভূমিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিনা জানি না, জানালে নিশ্চয়ই তিনি যেতেন। তবে মেয়ে তথা রাসবিহারীর পৌত্রী মাতামহের জন্মস্থান একবার ঘুরে এসেছেন ব্যক্তিগতভাবে। সম্প্রতি বিশিষ্ট ভারত-বিষয়ক গবেষক এবং হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাকাজিমা তাকেশি তেৎসুকো হিগুচির মুখে শোনা তাঁর পিতার কাহিনী একটি চমৎকার গ্রন্থ চিচি বোওসু বা পিতা বোস-এ লিপিবদ্ধ করেছেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন যেমন শিক্ষামূলক তেমনি বৈচিত্র্যময় একটি উপন্যাস বললে অত্যুক্তি হয় না, যা চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হলে পরে তরুণ প্রজন্মকেই শুধু স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ করবে না, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’দের জন্যও শিক্ষণীয় হবে নিঃসন্দেহে। ন্যাশনালিস্টরা যে চোর হয় না, জনগণের সম্পদ লুন্ঠনকারী নয়, একমাত্র নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন কৈশোর থেকেই তার আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন। তাঁর নীতিজ্ঞান ছিল অত্যন্ত খাঁটি। তিনি যেমন ছিলেন একনিষ্ঠ হিন্দুধর্মাবলম্বী তেমনি নিঃস্বার্থ স্বদেশপ্রেমে তেজস্বী। নিয়ম ও সময়জ্ঞান ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রখর। তাঁর প্রবল আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ তাঁকে আজীবন সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছিল। ১৯৩৫ সালে তিনি টোকিওতে বিশ্ব আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, নিজেও গবেষণা করেছিলেন মূলত বিশ্বসংস্কৃতিকে আরও অনুধাবন করার জন্য। শুধু এশিয়ার পরাধীন মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণার্থে তাঁর উদ্যোগের ইতিহাস অপ্রচারিতই থেকে গেছে।
রাসবিহারী বসুর মৃত্যুর পর এত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু আজও তিনি প্রবীণ জাপানিদের মনে বিখ্যাত ‘ইনদো শিশি’ বা ‘ভারতীয় বীরপুরুষ’ ভাবমূর্তিতে অধিষ্ঠিত। টোকিওর প্রাণকেন্দ্র শিনজুকু শহরস্থ ‘নাকামুরায়া’ মানেই রাসবিহারী বসু। প্রতিষ্ঠানের দোতলায় রেস্টুরেন্টের প্রবেশপথেই স্থাপিত শোকেসে তাঁর ও পরিবারের আলোকচিত্র রক্ষিত আছে। কিন্তু বাঙালি জানে না তাঁর ইতিহাস একেবারেই। আজকে এই যে দুই বাংলা থেকে হাজার হাজার বাঙালি জাপানে এসে কাজ করছে, ব্যবসা করছে এবং স্বদেশী সংস্কৃতির সংগঠন-সমিতি প্রতিষ্ঠা করছে, এই ধারার সূচনাই করেছিলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে শিনজুকু শহরে ‘এশিয়া হাউস’ নামে একটি ৮ কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল রেস্টহাউস স্থাপন করেছিলেন। সেখানে ৫৮ জন এশিয়ান অভিবাসী বসবাস করতেন। এখানে এশিয়ার মুক্তি, জাপানের সঙ্গে এশিয়ার ভাতৃবন্ধন, সাংস্কৃতিক বিনিময় ইত্যাদি বিষয়ক সভা, আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পান-ভোজনাদি অনুষ্ঠিত হত। তখনকার খ্যাত-অখ্যাত একাধিক জাতীয় পত্রিকা, সাময়িকীর সম্পাদক, সাংবাদিক পর্যন্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে আসতেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। রাসবিহারী বসু জাপানস্থ ভারতীয়সহ এশিয়ানদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য ‘কারিভোজ’ দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন। অবশ্য জাপানি খাবার-দাবার যে ছিল না তা নয়। তবে ‘নাকামুরায়া’ প্রতিষ্ঠানের দোতলায় নিজস্ব ভারতীয় রেস্টুরেন্টে তাঁর নিজের হাতে তৈরি ‘ইন্ডিয়ান কারি-রাইস’ খাবারের সুনাম ইতিমধ্যে টোকিওসহ বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে ‘এশিয়া হাউসে’ সভা-সমাবেশ মানেই ভারতীয় কারি আর সেটা তৈরি করবেন ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু—এই ঘটনা শহরব্যাপী মুখরোচক সংবাদে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ছিল।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবাসী ভারতীয়দেরকে একত্রিত করার জন্য তিনি ‘ভারত মৈত্রী সমিতি’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে শুধু যে ভারতীয়রা আসতেন তা নয়, ভারত, এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহী জাপানিরাও আসতেন। আলাপ-আলোচনা এবং পান-ভোজনাদি হত বেশ ঘটা করে। প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালের ৩০ শে জুন তারিখে তাঁর রেস্টুরেন্টের ভিতরেই। তাতে ৩১ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন জাপানের স্বনামখ্যাত আন্তর্জাতিক কবি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু নোগুচি ইয়োনেজিরো (১৮৭৫-১৯৪৭) বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সমিতির সর্বমোট ১০টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমিতি থেকে ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সম্মেলনে জাপান থেকে একজন প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। আবার ভারত থেকে বিশেষ অতিথি কেউ এলে তাঁর স্মরণে বিশেষ সভা-সম্মিলনেরও আয়োজন করেছেন তিনি। যেমন জাপানস্থ প্রাচ্য গবেষণা সংস্থায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিনয়কুমার সরকার; জাপান সফরে এসেছিলেন স্বনামখ্যাত বৌদ্ধভিক্ষু রাষ্ট্রপাল সান্ধিরিয়া; বিশ্বভারতীর জনৈক শিল্পী-অধ্যাপকও এসেছিলেন বলে জানা যায়, তাঁরা বিশেষ সভায় আলোচনা ও বক্তৃতা করেছিলেন।
নানাবিধ কাজের পাশাপাশি রাসবিহারী বসু নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকসাহিত্য এবং ভারতে বৃটিশের শাসন-শোষণ নিয়ে অনেক লেখা জাপানি জাতীয় দৈনিক, সাময়িকী ও সংকলনে প্রকাশ করেছেন। তবে অধিকাংশই জাপানি ভাষায়। সারা জাপান ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অবরুদ্ধ, শোষিত মাতৃভূমির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দুরবস্থার ইতিহাস তুলে ধরেছেন জাপানিদের সামনে। জাপানে এশিয়ানদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এশিয়ানদের মুখপত্র হিসেবে নিজব্যয়ে মাসিক নিউ এশিয়া নামে একটি তথ্যভিত্তিক কাগজ প্রকাশ করেছিলেন কিছুদিন। স্বনামে ও যৌথভাবে প্রায় ১৫/১৬টি গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন। যার মধ্যে গ্রন্থিত আছে মূল্যবান বিস্তর তথ্য ও ঘটনা। গ্রন্থগুলোর মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন। চরমপন্থী বিপ্লবী হলেও তিনি যে রোমান্টিক ছিলেন তাতেই প্রমাণিত হয়। যুদ্ধপূর্ব টোকিওর সবচেয়ে ব্যয়বহুল কেতাদুরস্ত আধুনিক শহর ‘গিনজা’তে প্রায়শ সন্ধ্যেবেলা ‘সুশি বার’ পানশালায় বন্ধুদের সঙ্গে দিলখোলা আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর জাপানে একাধিকবার সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাঁকে ঘটা করে সংবর্ধনা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। কবিগুরু ১৯২৪ সালের জুন মাসের একদিন তাঁর বাড়িতে এসে পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাসবিহারী বিশ্বভারতীর জন্য চাঁদা তুলে কবির হাতে তুলে দেন। স্ত্রীর মাসতুতো বোন মাকি হোশিকে শান্তিনিকেতনে পাঠান ফুলসজ্জাবিদ্যা ‘ইকেবানা’ ও ঐত্যিবাহী চা-অনুষ্ঠান ‘চাদোও’র প্রশিক্ষক হিসেবে। ১৯২৯ সালে কবিগুরু কানাডা থেকে ফেরার পথে জাপানে কিছুদিন বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে টোকিওতে তাঁর তিন সপ্তাহকাল বসবাসের ব্যবস্থা করেন তাঁর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বন্ধু ড. ওওকুরা কুনিহিকোর প্রাসাদোপম বাড়িতে। এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ জাপান সফর। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের অশেষ আশীর্বাদ পেলেও একটি বিষয়ে তাঁর সহানুভূতিলাভে ব্যর্থ হন রাসবিহারী বসু। ১৯৩১ সালে চীনের মাঞ্চুরিয়া রাজ্য জাপান আক্রমণ করলে রবীন্দ্রনাথ মনঃক্ষুণ্ন হন; অপ্রত্যাশিত হিসেবে এই সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচনা করেন। ১৯৩৭ সালে যখন চীন-জাপান দ্বিতীয় যুদ্ধ বাঁধে তাতে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীসহ ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় তোলেন জাপানের বিরুদ্ধে। প্রকৃতপক্ষে, মাঞ্চুরিয়ার আসল ইতিহাস ও ঘটনা এবং দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের পটভূমি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছুই জানতেন না বলে অনেক গবেষকই মনে করেন। তাঁর কানে ভুল তথ্য দিয়ে থাকবেন তখন শান্তিনিকেতনে অবস্থানরত চীনা ভবনের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীরা বলে কোনো কোনো গবেষকের ধারণা। যাহোক, চীন আক্রমণ নিয়ে ভারতে যখন জাপান-বিরোধী প্রতিবাদ তুঙ্গে তখন জাপানিরাও মনঃক্ষুণ্ন হন। বিশ বছরের পুরনো বন্ধু কবি নোগুচি ইয়োনেজিরো এই সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক পত্রযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সবচেয়ে বেশি নিরাশ হন রাসবিহারীকে সুদীর্ঘ ২১ বছর ধরে যে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে তাঁরা। রাসবিহারী বসু এই মহাসংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত ঘটনা বুঝিয়ে বলার জন্য তাঁকে ১৯৩৮ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে জাপানে আসার আমন্ত্রণপত্র পাঠান জাহাজ ভাড়া ৫০,০০০ ইয়েন বাজেটের কথা উল্লেখ করে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রস্তাবে রাজি হননি, উত্তরে তিনি লিখেন, ‘দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে আমার শরীর উত্তম পর্যায়ে নেই। কিন্তু জাপানের প্রতি আমার যে মিশন তা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত আয়োজন করে থাকলে তোমার প্রস্তাব বিবেচনা না করলে নয়। আমার মিশন হচ্ছে, এখন এশিয়ার যে মহা দুটি জাতি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাদের মধ্যে সংস্কৃতি ও মৈত্রী সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু জাপানি কর্তৃপক্ষ আমাকে মুক্তচিত্তে চলার ও বলার সুযোগ দেবে কিনা এই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কাজেই জাপান ভ্রমণ করে ছলচাতুরির মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে চাই না। তথাপি জাপানের প্রতি আমার সত্যিকার ভালোবাসা বহন করছি।’ এই কারণে অনেক ভারতীয় ও বাংলাদেশী রাসবিহারী বসুকে জাপানের দালাল বলে কটাক্ষ করেন যা কিনা অজ্ঞতার পরিচায়ক ছাড়া আর কিছু নয়। যাঁরা ইতিহাস সচেতন তাঁরাই তাঁকে বীর দেশপ্রেমিক হিসেবে সম্মান করেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। রাসবিহারী বসুর জাপানে জীবিতকালের সুদীর্ঘ ৩০ বছরের ঘটনাবহুল ইতিহাস সত্যিই আকর্ষণীয়। তিনি যেমন বিদেশী হিসেবে তৎকালীন রক্ষণশীল জাপানি সমাজের কঠোর সমালোচনা করেছেন তেমনি উদারপন্থী প্রভাবশালী জাপানিদের প্রিয়ভাজনও হয়ে উঠেছিলেন। জাপানের সামরিক শক্তির সাহায্যে মাতৃভূমি ভারতের মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে জাপান ও ভারতবর্ষের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি-বন্ধনের প্রথম সেতুই হচ্ছেন রাসবিহারী বসু।
মৃত্যুর পূর্বে মহাপূর্ব-এশিয়া যুদ্ধ তথা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার মূল্যায়নস্বরূপ শোওয়া সম্রাট হিরোহিতো (১৯০১-৮৯) সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মাননা-পদক প্রদান করেন রাসবিহারী বসুকে। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হননি বলে কন্যা তেৎসুকোর ভাষ্য থেকে জানা যায়। মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সেটা পাঠানো হয় রাসবিহারীর বাড়ির ঠিকানায়। এই রকম রাজকীয় সম্মান পেয়েছেন আর একজন বাঙালি দূরপ্রাচ্য টোকিও আন্তর্জাতিক সামরিক বিচার তথা টোকিও ট্রাইব্যুনালের (১৯৪৬-১৯৪৮) অন্যতম বিচারপতি বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় জন্ম ড.রাধাবিনোদ পাল ১৯৬৬ সালে। ১৯৪৫ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকেও জাপান সরকার অনুরূপ পদক প্রদানের পরিকল্পনা করেছিলেন। নেতাজি বিনীতভাবে তা প্রত্যাখান করেন।
১৯৫৭ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতসহ জাপান সফরে আসেন। কথিত আছে, তিনি রাসবিহারী বসু সম্পর্কে কোনো খোঁজ-খবর নেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অপরিসীম অবদানকে স্মরণ করে নেহেরু ইচ্ছে করলে শিনজুকু শহরে অবস্থিত নাকামুরায়া তথা একদা বসুর শ্বশুরালয়ে পদধুলি রাখতেই পারতেন। কিংবা টোকিওর অদূরে অকুতামা শহরে অবস্থিত তাঁর সমাধিতে অর্পণ করতেই পারতেন সামান্য কিছু ফুল। তিনি কিছুই করেননি। ঐ সময়ে নেহেরু টোকিওর রেনকোজি বৌদ্ধমন্দিরে (এখানে নেতাজির তথাকথিত চিতাভস্ম (!) সংরক্ষিত আছে) যে বাণী লিখেছেন সেখানে নেতাজির কোনো প্রসঙ্গই নেই, আছে গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম প্রসঙ্গে ইংরেজিতে লিখিত দুছত্র মন্তব্য। নেতাজিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করা হয়েছে এই সেদিন ১৯৯২ সালে। নেতাজি তবুও সম্মানিত হয়েছেন; কিন্তু রাসবিহারী বসুর ভাগ্যে কোনো পুরস্কারই জোটেনি—এক কলকাতার এক রাস্তার পাশে নির্মিত একটি বিসদৃশ প্রস্তরমূর্তি ছাড়া।
(তথ্যসূত্র:
১- Rash Behari Bose: The Father of the Indian National Army by Elizabeth Eston.
২- বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, মণি বাগচী, শিক্ষা-ভারতী।
৩- Bose of Nakamuraya: An Indian Revolutionary in Japan by Takeshi Nakajima.
৪- https://arts.bdnews24.com/?p=2843)
১- Rash Behari Bose: The Father of the Indian National Army by Elizabeth Eston.
২- বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, মণি বাগচী, শিক্ষা-ভারতী।
৩- Bose of Nakamuraya: An Indian Revolutionary in Japan by Takeshi Nakajima.
৪- https://arts.bdnews24.com/?p=2843)
0 মন্তব্যসমূহ