-- বাবা, তুমি বাঙালি নও।
-- সেকি মাসিমা, দেখলেন না ইংরেজি কাগজে বাংলায় সই করলাম।
-- না বাবা, মানে, আমার সমস্যা নেই, কিন্তু পাড়ায় লোকে জানতে পারলে সমস্যা হবে। ওইটা খাও না তো বাবা।
ওইটা মানে গোরুর মাংস। কী আর বলি, আমি তো সর্বভূক।
বললাম, মাসিমা চিন্তা করবেন না। শিক্ষিত লোকে ওসব খায় না।
একটু অনৃতভাষণ হল। কিন্তু নাচার। বাড়ি ভাড়া পাচ্ছি না। বহু জায়গায় ঘুরেছি। গেরুয়া পাঞ্জাবি আর কথা শুনে তার ওপর সাংবাদিক জেনে সব বাড়িওয়ালাই খুব খুশি। শুধু এগ্রিমেন্ট বা চুক্তির সময় নাম লিখতে গিয়েই সমস্যা।
-- আমার মেজদার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।
কারো আবার বড়দা , কারো বাবা, কারো ছোড়দা তখন অভিভাবক।
এখানে দালাল, আমাকে বলেছেন, কোনও কিছু বলবেন না, পুরো ১৫ হাজার দিয়ে দিন। একেবারে এক তারিখের ভোরে মাল নিয়ে হাজির হয়ে যাবেন।
--- নাম? আমি মিনমিন করি।
--- ও আমি বলে দেব কিছু একটা।
এক তারিখের ভোরে মালপত্র মানে ম্যাটাডোর ভর্তি বই নিয়ে হাজির । সৌমেনের বন্ধুরাও হাজির।
মাসিমা বলতে গেলেন, এগরিমেন্ট।
দালাল ছেলেটি বলল, আরে হবে হবে । মাল পেয়ে গেছেন তো।
মাল মানে পয়সা।
এইবার মাসিমা প্রতিদিন একবার মনে করান, বাবা এগরিমেন্ট?
মাসখানেক পর আর ঠেকানো গেল না। যেতেই হল। মাসিমার উকিলের বাড়ি। উকিল নয় মুহুরি। বুঝলাম। বাম জমানা। ভদ্রলোকও বামপন্থী। আমার নাম লিখে দিলাম। সঙ্গে মাতৃ পদবি। ভদ্রলোক সব বুঝলেন। কিন্তু সরাসরি বলতে পারছেন না। ইংরেজিতে কথা শুরু করলেন।
-- পূজায় কী করেন?
-- অষ্টমীতে লুচি, নবমীতে মাংস।
--- আচ্ছা মহরমে?
-- কিছুই না।
--- ইদে?
-- সিমুই লাচ্চা খাই।
ভদ্রলোক, আমি যে মুসলিম পরিবারে জন্মেছি তা সরাসরি বলতে পারছেন না; কিন্তু চেষ্টার অন্ত নেই মাসিমাকে বোঝানোর। মাসিমা শেষে বুঝলেন। ইদ-বিফ ইত্যাদি শুনে।
বেরিয়েই মোক্ষম প্রশ্নটি করলেন।
--- বাবা , তুমি বাঙালি নও।
এরপর মাসিমাকে বহু ঝড় পোহাতে হয়েছে কার্গিল যুদ্ধের বিরোধিতা করে মিছিল করায়। সরকারি লোক গেছে বোঝাতে কাকে ভাড়া দিয়েছেন। পাকিস্তানের লোক। আই এস আই। কত বিশেষণ! কিন্তু মাসিমা অনড়। এক কথা।
-- ও বড় ভালো ছেলে। আমার আপদে-বিপদে দেখে।
আট বছর ছিলাম। অনেক কষ্ট করে পনেরো হাজার অ্যাডভ্যান্স দিয়েছিলাম ধার করে। মাসে শোধ দিতাম অশোক দাশগুপ্ত আর দেবাশিস ভট্টাচার্যকে। একজন ছয় আর একজন তিন হাজার ধার দিয়েছিলেন।
আসার সময় মাসিমা বললেন, থেকে যাও বাবা।
মাসিমা অ্যাডভান্সের টাকা ফেরৎ দিতে পারেননি। ছ হাজার দিয়েছিলেন মেসোমশাই। বড় ভালোমানুষ। সোনার বরণ গায়ের রঙ। কলকাতার এক বিখ্যাত রাজ পরিবারের সন্তান। এখন আর্থিক সঙ্গতি কম।
আজ মাসিমার কথা মনে পড়ছে। বিশ্বকর্মা পূজা এলেই ২৫ রকম সব্জি রান্না করে দিয়ে যেতেন। বলতেন, সকালেই, আজ আর রান্না করো না। আজ আমার রান্না পুজো।
মাঝে মাঝেই যেতাম। প্রথম দিকে টাকার কথা মনে থাকতো। পরে এমনিই যেতাম। গেলেই মাসিমা বলতেন, বাবা এখানেই তো ভাড়া থাকতে পারতে। পুরানো দিনের বাড়ি। ২০০২-এ সম্প্রীতি যাত্রার সময় ১৫ দিন ছিলাম না। উইয়ে বহু বই, অষ্টম শ্রেণি থেকে লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি খেয়ে দেয়। খাবার জল তুলতে হতো রাস্তার কল থেকে।
মাসিমার মৃত্যুর কিছুদিন আগে গেলাম। কঙ্কালসার দেহ। বিছানায় মিশে গেছেন। ব্রাহ্মণকন্যা। কাছে ডাকলেন, পাশে বসালেন। গায়ে মাথায় হাত বোলালেন।
বললেন, বাবা ভালো থেকো। তুমি এলে খুব আনন্দ পাই।
এই মাসিমারা যতদিন আছেন , আমার বাংলা সাম্প্রদায়িক হবে না।
এই মাসিমারা যতদিন আছেন , আমার বাংলা সাম্প্রদায়িক হবে না।
0 মন্তব্যসমূহ