১৮২৫ থেকে ১৮৫০। মাত্র ২৫ বছরের একটা উল্লম্ব লাফ।
খুব সহজে এর একটা সূচনাবিন্দু ধরা যেতে পারে। ১৮১৫। যে বছরে রামমোহন রায় স্থায়িভাবে কলকাতায় বাস করতে শুরু করেন এবং তাঁর জীবনের আসল কাজগুলি গুরুত্ব সহকারে হাত দেন। বলা যেতে পারে তিনিই এই লাফের অবিসংবাদী ‘রান-আপ’।
এক অভারতীয় বাঙালীদের মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন তর্কশাস্ত্রে তোমরা পণ্ডিত ছিলে কখনো। তিনি তরুণ হওয়ার আগেই লিখে ফেলেছিলেন ‘ফকির ওফ ঝুঙ্গিরা’। তাঁর ক্লাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক চলত। তাঁকে নিয়ে ভবিষ্যতের বাঙালি যতই বিতর্ক করুক না কেন তিনি যদি হিন্দু কলেজের চুম্বক না হতেন হয়ত আমরা আজ অনেক কিছুই দেখতে পেতাম না, আর্যাবর্ত বা মুঘলাই ঘুর্ণি তে পাক খেতাম। তিনি হেনরি ভিভিয়ান লুইস ডিরোজিও। ভুল, হয়ত ইয়ং বেঙ্গল অনেক ভুল করেছিল। কিন্তু ভুল যে অনেক সময় ঠিকের চেয়েও মূল্যবান। প্রমান গত শতকের সাতের দশক।
ভাবা যায়, টোল পণ্ডিতির যুগে দুটো পত্রিকা বেরোচ্ছে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ এবং ‘এনক্যোয়ারার’।
১৮৩৩ এ নতুন চাটার্ড অ্যাক্টে ভারতীয়দের জন্য উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরির বাজার খুলে গেলে ডিরোজিয়ানরা আরও মারাত্মক ভাবে মিশে গেলেন সমাজে, সমাজের ভালোমন্দে। হয় মুভমেণ্টে, নয় রিফর্মে। যার ফলে ১৮৪২ থেকে বেরোতে শুরু হল ‘বেঙ্গলি স্পেক্টেটর’। হ্যাঁ, বাঙালি যা ভাবত, ঘোমটা আর পাগড়িতে আটকে থাকা ভারত তখনো সেসব ভাবেনি।
বাঙালি ডিমস্থিনিস রামগোপাল ঘোষ। ব্রিটিশদেরও স্থানীয় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার সমর্থনে লিখে ফেললেন ‘রিমার্কস অন দ্য ব্ল্যাক অ্যাক্টস’। তিনি বেচু চাটুজ্জ্যে স্ট্রিটে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিলে চেতলা বাজার থেকে লোক ছুটে আসত তাকে দেখতে।
প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার- ডিরোজিওর দুই প্রিয় শিষ্য অনেকগুলি বুদুবুদকে এক করে গড়ে তুললেন ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। তাদেরই ‘মাসিক পত্রিকা’য় বাংলা গদ্য সংস্কৃত-মুক্ত হল। তারা মাপছিলেন। বাঙ্গালির নেওয়ার ক্ষমতা মাপছিলেন। বাঙ্গালিও নিতে নিতে পরপর নক্ষত্র প্রসব করতে লাগল। প্রথম দিকে সাংস্কৃতিক, পরে পরে রাজনৈতিক নক্ষত্র। সশব্দে বা নিঃশব্দে তারা জ্বলতেন।
তারাচাঁদ চক্রবর্তী। যাকে আমরা প্রায় কেউ চিনব না। বইএর পাতার কোনো এক লাইনে যিনি দুটো কমার মধ্যে রয়ে যাবেন, তিনি ইয়ংবেঙ্গলের নিঃশব্দ নেতা।
দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়? সবাই তো কুৎসা নিতে পারেন না। তিনিও পারেননি। ঐ বাংলা তাঁকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছিল উত্তরপ্রদেশে। কিম্বা সেই অনামী ডিরোজিয়ান, যিনি সন্নাসী হয়ে কাথিয়াওয়াড় চলে গেলেন, স্থানীয় রাজবিদ্রোহে অংশ নিলেন। তাকেও ঐ বাংলা মেনে নেয়নি।
অনেকেই পালিয়ে যাননি, শুধু লড়ে গেছেন, সমালোচিত হতে হতে। আর এঁরা সবাই, এঁদের সাথে রামতনু লাহিড়ি, হরচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা অক্ষয়কুমার দত্তরা যে অভাবনয়ীয় র্যাডিকেল রাজনীতির বীজ বুনে ফেলেছিলেন আজ তাকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করে দিতে পারি বটে কিন্তু তার অনুভব অস্বীকার করতে পারিনা।
এদের নিয়েই বহু বছর আগে, ১৯০৩ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখে গেছেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’।
বাঙালিকে জানতে যা পড়তেই হবে।
0 মন্তব্যসমূহ