ঠাকুর বংশের ইতিকথা এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ।। রানা চক্রবর্তী



খ্রিস্টীয় ১৫ শতক। তখন দিল্লীর বাদশাহের সনদ নিয়ে খান জাহান আলী নামে একজন সেনাপতি এসেছেন যশোর শাসন করতে। এই খান জাহান আলীর মৃত্যু হয় ১৪৫৮ খৃষ্টাব্দে, তখনও চৈতন্যদেব জন্মাননি।

তৎকালে বাঙালীদের নামের সঙ্গে কোনো পদবী যুক্ত হওয়ার রেওয়াজ ছিল না। গোত্র এবং গ্রামের পরিচয়েই মানুষের পরিচয়। খান জাহানের এক কর্মচারী ছিলেন। ইতিহাসের পাতায় তাঁর আসল নাম পাওয়া যায় না। তবে তাঁর বংশ পরিচয় ও অন্যান্য তথ্য পাওয়া যায়। সে ছিল ব্ৰাহ্মণের ছেলে। নবদ্বীপের কাছে পিাল্যা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল। একদা সে এক সুন্দরী মুসলমান রমণীর প্রতি প্রণয়াসক্ত হলো। সেই প্ৰণয় এমনই তীব্ৰ যে তার জন্য সে জাত ধর্মবিসর্জন দিতেও প্ৰস্তুত। হিন্দু ধর্ম এমনই কঠোরভাবে গণ্ডীবদ্ধ যে সেখানে অন্য ধর্মের মানুষের কোনোক্রমেই প্রবেশ অধিকার নেই। ব্ৰাহ্মণের ছেলে যবনী বিবাহ করলে তাঁর স্ত্রীকে তো কোনোক্রমেই হিন্দুত্বে বরণ করা যাবে না, বরং সে ছেলেটিরই জাত যাবে। সুতরাং প্রণয় পরিণামে এই ব্ৰাহ্মণ সন্তানটি জাতিভ্ৰষ্ট হল এবং তাঁর নতুন নাম হলো মামুদ তাহির। সে পিারল্যা গ্রাম থেকে এসেছে বলে আগে তাকে পিরালীয়া বলে ডাকা হতো, এই নামটিরও একটি চমৎকার মুসলমানী রূপ পাওয়া গেল, পির আলী।

হিন্দু ধর্ম নতুন কারুকে গ্ৰহণ করে না বরং নিজের লোকদেরই পরধর্মের দিকে ঠেলে দেয়, পৃথিবীর অপর ধর্মগুলি কিন্তু নবাগতদের সাদরে অভ্যর্থনা জানায়। এমনকি অনেক সময় কিছু কিছু পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করে। ধর্মান্তরিত হবার পর পির আলী তাঁর প্রভুর নেকনজরে পড়লো এবং বখশিস হিসেবে পেয়ে গেল একটি পরগণা। সেই পরগণাটির নাম চেঙ্গুটিয়া।

ক্রমে এই পরগণাদার পির আলী বেশ একটি মান্যগণ্য লোক হয়ে উঠলো এবং প্রায়ই ধুমধাম করে নানারকম উৎসবের আয়োজন করতো।

কথায় বলে, নতুন মুসলমান গোরু খাওয়ার যম। পির আলী নিজে তো খেতেনই, উপরন্তু সকলকে গো-মাংস ভক্ষণের উপকারিতা বিষয়ে নানা কথাবার্তা শোনাতেন। কিন্তু চেঙ্গুটিয়া পরগণাটি ছিল হিন্দুপ্রধান এবং সেখানে ছিল বেশ কিছু ব্ৰাহ্মণের বাস। সুতরাং পির আলীর মতামত সহজে জনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা ছিল না।

কামদেব ও জয়দেব নামে দুই ব্ৰাহ্মণ দেওয়ানী করতেন এই পির আলীর অধীনে। একদিন তাঁরা তাঁদের সহৃদয় প্রভুর সঙ্গে একটি অপ্রত্যাশিত রসিকতা করে ফেললো। সেইটিই ছিল তাঁদের জীবনের মহত্তম ভুল। অথবা, ভুলই বা বলছি কেন, এইসব ঘটনাই তো ইতিহাসের কৌতুক।

রোজার মাস, উপবাসী পির আলী তাঁর পাত্ৰমিত্রদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করছেন, তাঁর হাতে একটি গন্ধ লেবু। মাঝে মাঝে সেটি নাকের কাছে এনে শুকছেন তিনি। এমন সময়ে কামদেব ও জয়দেবের মধ্যে একজন কেউ বললো, উজির সাহেব, আপনার আজকের রোজা তো ভঙ্গ হয়ে গেল!

বিস্মিত পির আলীকে সে আরও বুঝিয়ে দিল যে, তাঁদের শাস্ত্ৰমতে ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনম। সুতরাং রোজার মাসের নিয়মরক্ষা হলো না। এই শুনে পির আলী হাসলেন। সেই হাসির মধ্যে গভীর মতলব ছিল।

এরপর একদিন পির আলী তাঁর দরবারে বহু হিন্দুকে নিমন্ত্রণ করে কথাবার্তার মাঝে হঠাৎ ভৃত্যদের কী এক ইঙ্গিত করলেন। অমনি ভৃত্যরা অনেকগুলি জ্বলন্ত উনুন নিয়ে এলো সভাকক্ষে, সেইসব উনুনের ওপর কড়াইতে গো-মাংস রান্না হচ্ছে। লোকশ্রুতি এই, সেদিন নাকি পির আলী এক শত গো বধ করেছিলেন।

গো-মাংসের গন্ধ পেয়ে অনেক হিন্দু নাকে কাপড় দিলেন, অনেকে সভা ছেড়ে পালালেন। কিন্তু পির আলী চেপে ধরলেন কামদেব আর জয়দেবকে। তিনি বললেন, তোমরা পালাচ্ছে কেন? তোমাদেরই শাস্ত্ৰমতে তোমাদের অর্ধেক ভোজন হয়ে গেছে এবং সেই অনুযায়ী তোমাদের জাত গেছে। সুতরাং আর চক্ষুলজ্জা রেখে লাভ কী? আমার পাশে বসে বাকি ভোজনটাও সেরে নাও!

ধর্মান্তরিত হবার পর কামদেব আর জয়দেবের নাম হলো কামালউদ্দিন ও জামালউদ্দিন। এবং তাঁরা উপহার পেলেন জায়গীর। কিন্তু ঘ্রাণে অর্ধ ভোজনের মতন, হিন্দু পরিবারের অর্ধেক মুসলমান হলে বাকি অর্ধেকও নিষ্কৃতি পায় না। কামদেব, জয়দেবের আর দুই ভাই ছিল, তাঁদের নাম ছিল রতিদেব আর শুকদেব। সমাজ খড়গহস্ত হলো এদের প্রতি, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে জল-অচল হলো এবং পির আলীর নামের সুবাদে এদের পরিবারের নামের সঙ্গে পিরালী অপবাদ যুক্ত হয়ে গেল। লোকে তখন এদের পুরোপুরি ব্ৰাহ্মণ বলে না, বলে পিরালীর বামুন।

আত্মীয়স্বজনদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এই দুই ভাইয়ের মধ্যে রতিদেব গৃহত্যাগ করলেন। খুব সম্ভবতঃ তাঁর কোনো পুত্রকন্যা ছিল না, তাই বৈরাগ্য গ্ৰহণ তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল। কিন্তু শুকদেব পড়লো মহা বিপদে। তাঁর নিজের বিবাহযোগ্য কন্যা রয়েছে। এক ভগ্নীরও তখনো পর্যন্ত বিবাহ দেওয়া হয়নি। পরিবারে খুঁত লেগে গেছে বলে এই দুই কন্যার বিবাহের জন্য কোনো পাত্র পাওয়া যায় না। তখন শুকদেব সমাজের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করলেন তাঁর শেষ অস্ত্ৰ, যার চেয়ে অমোঘ অস্ত্র আর হয়। না। টাকা দিয়ে তিনি কিনে ফেললেন দুজন ব্ৰাহ্মণকে। শুকদেবের ভগ্নীর বিবাহ হলো ফুলে গ্রামের মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এবং কন্যার স্বামী হলো পিঠাভোগ গ্রামের জগন্নাথ কুশারী। যৌতুক হিসেবে উভয়েই পেল প্রচুর জমি ও ধন। পরবর্তীকালে শুকদেব, মঙ্গলানন্দ, জগন্নাথদের সন্তানসন্ততিরা সকলেই পিরালীর ব্ৰাহ্মণ বলে চিহ্নিত হয়ে রইলো।

এখন সকলের কথা থাক, আমরা শুধু জগন্নাথ কুশারীকেই অনুসরণ করি।

যেমন গাঙ্গুল গ্রামের ব্ৰাহ্মণের গাঙ্গুলী, সেইরকমই কুশ গ্রামনিবাসীরা কুশারী। এই কুশ গ্রামটি বর্ধমান শহরের কাছে। ক্রমে এই কুশারীরা বাঁকুড়ার সোনামুখী, খুলনার পিঠাভোগ এবং ঢাকার কয়কীর্তন গ্রামেও বসতি নেন। অথবা বলা যায়, সেইসব গ্রামের গ্রামীণ বা গাঞী হয়।

এই কুশারীরা সুদীর্ঘ বংশগৌরব দাবী করতে পারেন। আদিশূর নামে গৌড়ের জনৈক রাজা, যিনি পৌরাণিক না ঐতিহাসিক তা বলা শক্ত, কারণ তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে বিস্তর বিরোধ আছে, কনৌজ থেকে পাঁচজন খাঁটি ব্ৰাহ্মণ এনেছিলেন। ধরে নেওয়া যায়, গৌড় বাংলা তখন ছিল অনার্য অধ্যুষিত। এই পঞ্চ ব্ৰাহ্মণ থেকেই শাণ্ডিল্য, ভরদ্বাজ, কাশ্যপ, বাৎস্য এবং সাবর্ণ গোত্রের উদ্ভব। উত্তরকালে এইসব গোত্র বিভাগ প্রচুর জটিলতার সৃষ্টি এবং অনাসৃষ্টি করেছিল।

শাণ্ডিল্য গোত্রের প্রথম পুরুষ ক্ষিতীশের এক পুত্রের নাম ছিল ভট্টনারায়ণ, যিনি প্রখ্যাত সংস্কৃত নাটক বেণী সংহারের রচয়িতা বলে অনেকের ধারণা। সেই ভট্টনারায়ণের বংশধর হলেন কুশারীরা। মূল শাণ্ডিল্য গোত্রের জন্য এঁদের বন্দ্যঘটী বা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু গাঞী নিরিখে এঁরা কুশারী।

এমত বংশগৌরব থাকলেও যবন সংসৰ্গ হেতু পিঠাভোগের কুশারীদের পিরালী নাম রসাতলে গেল। ধর্ম ও সমাজপতিদের অত্যাচার তাঁদের সইতে হয়েছে বহু প্ৰজন্ম ধরে। অনেক কাল পরে তাঁরা এর শোধ নেন।

এবার কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে আসা যাক।

ঐ কুশারী বংশেরই এক সন্তান পঞ্চানন এবং তাঁর খুল্লতাত শুকদেব আত্মীয়দের সঙ্গে বিবাদ করে স্বগ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ভাগ্যান্বেষণে। ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা এসে পৌঁছেলেন গোবিন্দপুরের খাঁড়ির কাছে। খাটো জাতের ব্ৰাহ্মণ হলেও তাঁদের সাজ-পোশাকের কোনো ত্রুটি ছিল না। পরিধানে পট্টবস্ত্ৰ, মাথায় স্কুল শিখা এবং ললাটে চন্দন, গাত্রবর্ণ অতিশয় গৌর। দেখলেই ব্ৰাহ্মণ বলে চেনা যায়। গোবিন্দপুরের খাঁড়ির পাশে তখন শুধু কয়েক ঘর জেলে, মালো, কৈবর্তের বাস। ব্ৰাহ্মণ দেখে তাঁরা ষষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করলো এবং সেখানেই অধিষ্ঠিত হবার অনুরোধ জানালো। তখন জনমানসে ধারণা ছিল, গ্রামের মধ্যে ব্ৰাহ্মণদের আশ্রয় দেওয়া একটি বড় পুণ্যকর্ম।

সেই গোবিন্দপুরের খাঁড়ির নামই ইদানীং আদি গঙ্গা বা টালির নালা। গোবিন্দপুর, সুতানটি এবং কলকাতা নামে তিনটি গ্রাম জুড়ে ইংরেজরা তখন নতুন একটি শহরের পত্তন করছে। এই খাঁড়ি দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য এটিকে কেটে প্রশস্ত করা হচ্ছে এবং গ্রামের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্য সাহেবরা যখন আসে তখন গ্রামের জেলেরা নিজেরা কথা বলার সাহস না পেয়ে ব্ৰাহ্মণ দুজনকে এগিয়ে দিত। ব্ৰাহ্মণ দেবতুল্য, তাই গ্রামের মানুষ তাঁদের ঠাকুর বলে ডাকতেন। সাহেবরা সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না বলে, তাঁরা বলতো টেগোর। কুশারী ও পিরালী পরিচয় মুছে ফেলে পঞ্চানন ও শুকদেব ঠাকুর হয়ে গেলেন।

এই ঠাকুররাই হলেন কলকাতার আদিযুগের স্টিভেডর এবং কন্ট্রাক্টর। প্রথম প্রথম পঞ্চানন ও শুকদেব, সাহেবদের জাহাজে মালপত্র সরবরাহ করতেন। তারপর সাহেবদের সঙ্গে ভালোমতন পরিচয় হয়ে যাওয়ার ফলে আরও নানারকম কাজের ভার পেতে লাগলেন তাঁরা।

নতুন শহরে তখন অনেক প্রকার কর্মোদ্যম চলছে। বর্গীর হাঙ্গামা থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাটা হলো মারহাট্টা ডিচ। সিরাজউদৌল্লা হঠাৎ এসে কলকাতার কেল্লা গুড়িয়ে দেবার পর ইংরেজরা ময়দানের ফাঁকা জায়গায় মজবুত করে তৈরি করে নতুন কেল্লা বা ফোর্ট উইলিয়াম।

এইসব কাজের ঠিকাদারির ভার পেয়েছিলেন ঐ দুই ঠাকুরের পুত্ৰ ও পৌত্রেরা। ঠাকুরদের তখন এতই ধনসম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, শোনা যায় দুৰ্গম বন জঙ্গল সাফ করে তাঁরা যেখানে একটি বাগানবাটি প্রস্তুত করেন, পরে সেখানেই তৈরি হয়েছিল ঐ নতুন কেল্লা।

পরবর্তীকালে এই বংশের আর দুই উল্লেখযোগ্য ভ্রাতার নাম নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ। দুজনেই যথেষ্ট ধনাঢ্য, তবে নীলমণি ছিলেন অনেক বেশী কর্মবীর।

গোবিন্দপুরের খাঁড়ির কিনারা ছেড়ে ঠাকুরেরা তখন চলে এসেছেন মেছোবাজারের পাথুরিয়াঘাটা নামের অভিজাত পল্লীতে। ছোট ভাইকে সংসার দেখাশুনোর ভার দিয়ে নীলমণি প্রায়ই বাইরে বাইরে কাটান। ইংরেজ কোম্পানীর সঙ্গে তিনি চাকুরিসূত্রে আবদ্ধ। কখনো তিনি যান চট্টগ্রামে, কখনো উড়িষ্যায়। অথোপার্জনের উদ্দেশ্য ছাড়াও তাঁর চরিত্রে দুঃসাহস ছিল যথেষ্ট। দেওয়ানি কাজে সেকালে অর্থাগম হতো বিস্তর। সমস্ত টাকা নীলমণি পাঠিয়ে দিতেন ছোট ভাইয়ের কাছে।

এক সময় চাকরি ত্যাগ করে নীলমণি গৃহে ফিরলেন। তিনি জানতেন না যে সেখানে তাঁর জন্য এক বিরাট অশান্তি অপেক্ষা করেছিল। তাঁদের গৃহে তখন অতুল বৈভব। কিন্তু ছোটভাই দর্পনারায়ণ দাবী করলেন যে এর অধিকাংশই তাঁর নিজের উদ্যোগ ও বিচারবুদ্ধির ফল, এর মধ্যে নীলমণির অংশ সামান্যই। নীলমণি বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়েছেন বটে, কিন্তু দর্পনারায়ণই নিজ কৃতিত্বে সম্পত্তি বহুগুণ করেছেন।

ভ্ৰাতৃবিরোধ এক সময় এমনই চরমে উঠলো যে এক বৃষ্টি মুখর রাতে নীলমণি তাঁর স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যার হাত ধরে এবং গৃহদেবতা নারায়ণশিলা সঙ্গে নিয়ে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। আর কোনোদিন ফিরবেন না। দর্পনারায়ণ তাঁর দাদার হাতে নগদ এক লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছেন এবং তাঁকে দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন যে বসতবাটি এবং ভূসম্পত্তির ওপর নীলমণির আর কোনো অধিকার রইলো না।

বৃষ্টিময় অন্ধকার রাতে নীলমণিকে অবশ্য সপরিবারে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হলো না। ব্ৰাহ্মণকে ভূমিদানের পুণ্য অর্জনের জন্য তাঁদের আশ্রয় দিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত ধনপতি। তাঁর নাম ছিল।শেঠ বৈষ্ণবচরণ। এ বৈষ্ণবচরণ ধনী হয়েছিলেন গঙ্গাজলের ব্যবসায়ে। হিন্দুদের বিবাহ থেকে শ্ৰাদ্ধ পর্যন্ত, এবং প্রতিদিনের পুজোআচ্চায় গঙ্গাজলের প্রয়োজন, এমনকি আদালতেও শপথ নেবার সময় গঙ্গাজল স্পর্শ করতে হয়। মুখবন্ধ মাটির হাঁড়ি ভর্তি গঙ্গাজল চালান যেত গঙ্গাবর্জিত অঞ্চলে। দুধে ভেজাল মিশ্রণের চল না হলেও তখনই নিশ্চিত গঙ্গাজলের ব্যবসায়ে নানারকম কারচুপি ছিল, যে-কারণে অন্যান্য গঙ্গাজল ব্যবসায়ীদের তুলনায় শেঠ বৈষ্ণবচরণের নামাঙ্কিত শিলমোহর করা গঙ্গাজলই ছিল বেশী বিশ্বাসযোগ্য। এমন কি সুদূর তেলেঙ্গানার রাজাও গঙ্গাজল নিতেন এঁর কাছ থেকে।

জোড়াসাঁকো অঞ্চলে শেঠ বৈষ্ণবচরণ প্রদত্ত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হলো ঠাকুর বংশের দ্বিতীয় শাখাটি। নিজে আরও জমি কিনে ক্রমে ক্রমে নীলমণি সেখানে তৈরি করলেন তাঁর নিজস্ব প্ৰাসাদ।

নীলমণির ছিল তিনটি সন্তান। জ্যেষ্ঠের নাম রামলোচন। পিতার মৃত্যুর পর রামলোচনের ওপর পড়লো সংসারের ভার এবং তিনি দক্ষতার সঙ্গেই সে কার্য সম্পন্ন করতে লাগলেন। ছোট দুই ভাইয়ের পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণও করেন তিনি। এবং কিছু কিছু জমিদারি কিনে তিনি আস্তে আস্তে কলকাতার ধনী সমাজে নিজের স্থান করে নেন। রামলোচন ছিলেন শৌখিন এবং বিলাসী পুরুষ। সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলেও অপরাহ্নে তিনি একবার, হাওয়া খেতে বের হবেনই। পরনে লম্বা কোতা দোপাট্টা ও তাজ, অর্থাৎ মুকুটের মতন পাগড়ি। গৃহের সামনে নিজস্ব তাঞ্জাম প্রস্তুত থাকত, সেই তাঞ্জামে চড়ে তিনি ময়দানের দিকে যেতেন বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করার জন্য। পরিচিত আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে খবরাখবর নেওয়াও ছিল তাঁর অভ্যোস। যদিও ততদিনে দুই ঠাকুর পরিবারের বিবাদ মিটে গেছে, রামলোচন প্রায়ই যেতেন পাথুরিয়াঘাটের বাড়িতে, পিতৃপুরুষের ভদ্রাসন দেখে আসতেন। আসা-যাওয়ার পথে যতগুলি দেবালয় পড়ত, সব জায়গাতেই নেমে তিনি ভক্তিভরে প্রণামী দিতেন।

মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে বসত মজলিশ। রামলোচন ঠাকুরের সাংস্কৃতিক রুচি সমসাময়িক ধনীদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। শুধু বাঈ-নাচ দেখে প্ৰমোদ করার বদলে তিনি কালোয়াতি গায়কদেরও ডেকে আনতেন, কোনোদিন আবার দাঁড়া-কবি বা বসা-কবিদের নিয়ে আসার জমাতেন। রাম বসু, হরু ঠাকুরের মতন কবিগণও তাঁর আয়োজিত আসরে এসেছেন।

রামলোচনের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। এক কন্যা জন্মেছিল, সেও অকালমৃত। পত্নী অলকাসুন্দরীর সম্মতি নিয়ে তিনি তাঁর মেজ ভাইয়ের একটি ছেলেকে দত্তক হিসেবে গ্ৰহণ করেন। তাঁর সাধ ছিল ছেলেটিকে তিনি নিজের আদর্শে গড়ে তুলবেন। কিন্তু উপযুক্ত সময় পেলেন না, একদিন হঠাৎ পীড়িত হয়ে পড়ে তিনি বুঝলেন যে তাঁর দিন শেষ হয়ে এসেছে। পুত্রটির যখন তের বছর বয়স, তখন রামলোচন ঠাকুর ইহধাম থেকে প্ৰস্থান করলেন।

রামলোচনের সেই দত্তক পুত্রের নাম দ্বারকানাথ। পালিকা মাতা অলকাসুন্দরী এবং নিজের বড় ভাই রাধানাথের তত্ত্বাবধানে দ্বারকানাথ মানুষ হতে লাগলেন। তখনো হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়নি। জোড়াসাঁকোতেই ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে শেরবোর্ন নামে একজন সাহেব একটা স্কুল খুলে বসেছিলেন। শেরবোর্নও পুরোপুরি সাহেব নন, এঁর মা ছিলেন ব্রাহ্মণী এবং সেকথা তিনি প্রকাশ্যে সগৰ্বে সকলকে জানাতেন। এই শেরবোর্নের ইস্কুলে দ্বারকানাথ পড়তে লাগলেন এনফিল্ডস স্পেলিং, রীডিং বুক, তুতিনামা বা তোতা কাহিনী, ইউনিভাসিলি লেটার রাইটিং, কমপ্লিট লেটার বুক এবং রয়াল ইংলিশ গ্রামার। আঠারো বছর বয়েস পূর্ণ হলেই দ্বারকানাথ স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পথ প্রস্তুত করতে উদ্যত হলেন।

পালক পিতার কাছ থেকে দ্বারকানাথ জমিদারী সম্পত্তি পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার আয় খুব বেশী কিছু নয়। সেই ছোট জমিদারী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মতন মন নিয়ে তিনি জন্মাননি। এ মানুষ ছিলেন অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনি অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই কাছাকাছি অন্য সকলকে ছাড়িয়ে যেতে লাগলেন। সরকারের অধীনে তিনি দেওয়ানের চাকরি করেছেন, জমিদারদের মামলা-মোকদ্দমায় তিনি ল এজেণ্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং বাড়িয়েছেন পরগণার পর পরগণায় নিজস্ব জমিদারী।

জমির মালিকানার প্রতি বঙ্গবাসীদের আকর্ষণ অত্যধিক, কিন্তু দ্বারকানাথ বুঝেছিলেন যে ভূমিরূপ ধন যক্ষে আগলালেও লক্ষ্মীর আনাগোনা চলে বাণিজ্যেই। বহু রকম ব্যবসায় দ্বারকানাথ নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন, ব্যাংকিং, ইন্সিওরেন্স, রেশম, নীল,কয়লা এবং জাহাজ চলাচল। দ্বারকানাথের পূর্বপুরুষ জাহাজে মালপত্র ওঠানো-নামানোর কাজে ভাগ্য ফিরিয়েছিলেন, দ্বারকানাথ স্বয়ং জাহাজ কিনে দেশ বিদেশে মালপত্র আমদানী রপ্তানি করতে লাগলেন। এমনকি স্বাধীনভাবে ইংরেজদের সঙ্গে অংশীদার হয়ে স্থাপন করলেন এক কোম্পানি। নেটিভদের পক্ষে এটা একটা চমকপ্ৰদ ঘটনা। দ্বারকানাথের উদ্যম ও ব্যক্তিত্বে এমনই ঔজ্জ্বল্য, যে 'কার টেগোর কোম্পানি'র প্রতিষ্ঠার পর মহামান্য বড়লাট বাহাদুর লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক এক চিঠি লিখে দ্বারকানাথকে অভিনন্দন জানালেন যে ইংরেজ ও দেশীয় লোকরা মিলে যৌথ কারবার পরিচালনায় আপনিই প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।

অবশ্য একটু ভুল করেছিলেন বেণ্টিঙ্ক। এ ব্যাপারে দ্বারকানাথ প্রথম নন, দ্বিতীয় ছিলেন। তবে বাঙালিদের মধ্যে অবশ্যই প্রথম ছিলেন। বাণিজ্য ক্ষেত্রে তখন তাঁর একজন মাত্র যথার্থ প্ৰতিদ্বন্দ্বী ছিল, তাঁর নাম রুস্তামজী কাওয়াসজী। তাঁরও প্রধানত জাহাজেরই ব্যবসা ছিল। কলকাতা বন্দর জাহাজ নির্মাণের জন্য বিখ্যাত, রুস্তামজী একের পর এক জাহাজ তৈরি করিয়ে জলে নামাচ্ছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে রুস্তামজী 'টানার অ্যাণ্ড কোং' খুলে ফেলেছেন।

বেণ্টিঙ্কের অভিনন্দন বার্তাটিকে তৎকালীন সংবাদপত্রের লেখকরা একটু সংশোধন করে নিল। দ্বারকানাথ হিন্দুদের মধ্যে প্রথম। রুস্তমজী হিন্দু নন। তিনি ইরাণের অগ্নি উপাসক পার্সি জাতীয়। আরবী মুসলমানরা ইরান দখল করে নেবার পর অনেক পার্সি এসে আশ্রয় নেন ভারতের পশ্চিম উপকূলে, তাঁদেরই বংশধর এই রুস্তমজী বোম্বাই থেকে জাহাজযোগে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন এই নতুন শহরে, যে শহর তখন ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ভারতের মধ্যে সবচেয়ে লোভনীয় স্থান। ক্রমে রুস্তমজী ব্যবসায়ীদের মধ্যে শীর্ষস্থানে উঠে গেলেন, একদিকে চীন, অন্য দিকে আফ্রিকা পর্যন্ত যাতায়াত করত তাঁর কোম্পানির জাহাজ। নতুন নতুন জিনিস উৎপাদনের দিকেও তাঁর ঝোঁক ছিল। কলকাতা শহরের জন্য বরফ আনাতে হয় আমেরিকার বোস্টন শহর থেকে, এজন্য বরফ তখন কলকাতায় অগ্নিমূল্য। রুস্তামজী কলকাতায় বরফ প্ৰস্তুত করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।

কোনো ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হয়ে দ্বারকানাথের সুখ ছিল না। তাই দ্বারকানাথ তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন রুস্তমজীর দিকে। এবং যথা সময়ে অবশ্য রুস্তামজীও ধরাশায়ী হয়েছিলেন দ্বারকানাথের হাতে।

ব্যবসাক্ষেত্রে এসে দ্বারকানাথ দু'রকম ইংরেজের সন্ধান পান। তাঁর শ্ৰদ্ধেয় বন্ধু রামমোহনই এদিকে প্ৰথম তাঁর মনোযোগ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এক ইংরেজ এই দেশ শাসন করে, তাঁরা রাজার জাত, তাঁরা প্ৰভু। কিন্তু এঁরা ইংল্যান্ডের একটি ছোট শ্রেণী মাত্র, একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার এবং তাঁদের বেতনভুক কৰ্মচারীগণ। এছাড়াও অন্য ইংরেজ আছে। যারা ভাগ্যান্বেষণে এসেছে ভারতবর্ষে, তাঁদের আছে স্বাধীন পেশা, রাজকর্মচারীদের সঙ্গে তাঁদেরও স্বার্থের সংঘাত হয়, আদর্শগত বিভেদ দেখা দেয়। এদের মধ্যে অনেকে অর্থপিশাচ, অনেকে নারীলোলুপ, অনেকে নীতিহীন নরপশু। আবার কেউ কেউ মুক্তমনা, উদার, একতরফা শোষণের প্রতিবাদকারী। তাঁরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ দেশের ভাষা ও প্রাচীন সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করে, শিক্ষা বিস্তারে আগ্রহ দেখায়, সংবাদপত্রে সরকারী নীতির সমালোচনা করে।

রামমোহন ও দ্বারকানাথ দুজনেই বুঝেছিলেন অরাজক এবং নীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি ভ্ৰষ্ট ভারতের পক্ষে ইংরেজের শাসন আশীর্বাদ স্বরূপ। তবে, ইংরেজ যেন ভারতীয়দের আত্মসম্মানে আঘাত না দেয়। রামমোহনের তুলনায় দ্বারকানাথ আরও বেশী বুঝেছিলেন যে, ইংরেজদের কাছে ভারতীয়রা ক্রীতদাস। ভারতবাসী বহুকাল ধরে যুদ্ধবিদ্যায় অনভ্যস্ত, তাই তাঁদের পক্ষে ইংরেজদের বিরোধিতা করা বাতুলতা। সেইজন্যই ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব ধন মান প্ৰাণের অধিকার আদায় করতে হলে ঐ দ্বিতীয় শ্রেণীর ইংরেজদের সাহায্য নিতেই হবে।

ইউরোপ ভ্ৰমণে গিয়ে দ্বারকানাথ এই সত্য আরো বেশী উপলব্ধি করলেন। ভারতে ইংরেজ-রাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের অন্য শ্রেণীর ইংরেজদের অনেক প্ৰভেদ তাঁর নজরে এল। ভৃত্য বা প্রজার মতন নয়, তাঁরা দ্বারকানাথের সঙ্গে ব্যবহার করেছে সমান সমান মানুষের মতন, কিংবা তারও বেশী সম্রামের সঙ্গে। স্বয়ং ইংলণ্ডেশ্বরী তাঁকে পাশে স্থান দিয়েছেন। বড় বড় ডিউক, লর্ড থেকে শুরু করে ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স পর্যন্ত দেখা করে গেছেন তাঁর বাড়িতে এসে।

ভারত থেকে ইংল্যান্ডবাসীদের জন্য নানান উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। ইংল্যান্ড থেকেও তিনি ভারতীয়দের জন্য বিশেষ একটি উপহার নিয়ে এলেন। সেটা একটি মানুষ। তাঁর নাম ছিল টমসন। এই টমসন পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ লড়াই করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তার আগে তিনি আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে অগ্নিস্রাবী ভাষণ দিয়ে এসেছেন বিভিন্ন জায়গায়। সেজন্য তাঁর প্ৰাণ বিপন্ন হবার সম্ভাবনা ছিল বারবার। এই বিশেষ মানুষটিকে দ্বারকানাথ ভারতে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন এক গূঢ় উদ্দেশ্যে।

এক শীতের ভোরে দ্বারকানাথের জাহাজ এসে ভিড়েছিল কলকাতা বন্দরে। আগে থেকেই খবর পেয়ে শত শত ব্যক্তি সেই সকালেই সেখানে এসে সমবেত হয়েছিলেন তাঁকে সম্বর্ধনা জানাবার জন্য। জেটিতে জাহাজটি স্পর্শ করার পর দ্বারকানাথ তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন পোর্ট সাইড থেকে। তাঁর মুখখানি তখন ছিল এক অদ্ভুত হাস্যে সমুজ্জ্বল। সকল অবিশ্বাসীরা এবার দেখুক! বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে অনেকেই তাঁকে বলেছিল যে ইওরোপীয় জল হাওয়া ভারতবাসীর সহ্য হয় না। সেখান থেকে কেউ বেঁচে ফেরে না, যেমন রামমোহন ফেরেননি।

দ্বারকানাথ হাত তুলে তাঁদের উদ্যেশ্যেই যেন বলেছিলেন, আমি বেঁচে আছি।

এরপরে দ্বারকানাথ আবার বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। স্বদেশে আর তাঁর মন টিকছিল না, জ্যেষ্ঠপুত্রের ব্যবহারে তিনি ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। তাছাড়া এখানে তাঁর প্রাণের দোসর বলতে আর কেউ নেই। তাঁকে সকলে ভয় পায় বা শ্রদ্ধা করে, কেউ ভালোবাসে না। বাণিজ্যে ও জমিদারি পরিচালনায় কৃতিত্বে তিনি সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন। উপার্জন করেছেন প্ৰভূত ধন-সম্পদ, কিন্তু এক সময় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ভাবলেন, কী লাভ এত পরিশ্রমে? তাঁর উত্তরাধিকারীরা যদি এ সব রক্ষা করতে না পারে বা না চায়, তাহলে তিনিই বা আর লক্ষ্মীর পিছনে ছোটাছুটি করে আয়ুক্ষয় করবেন কেন? বরং এবার দু হাতে ব্যয় করে যাবেন। ইওরোপে তাঁর অগাধ খাতির, রূপসী ললনারা তাঁকে ঘিরে থাকবে সেখানে। সেদেশের খাদ্য ও মদ্যও অতি উচ্চশ্রেণীর।

বিলাত যাত্রার সময় দ্বারকানাথ সঙ্গে প্রচুর ধনসম্পদ তো নিয়ে গেলেনই, তাছাড়া তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্ৰকে কঠোর নির্দেশ দিয়ে গেলেন যেন তাঁকে হাতখরচ হিসাবে প্রতিমাসে একলক্ষ টাকা পাঠানো হয়। এবং এবার তিনি কতদিন থাকবেন, তার কোনো ঠিক নেই। একলক্ষ টাকা। অথাৎ যা দিয়ে তৎকালীন সময়ে পাঁচ হাজার ভরি সোনা ক্রয় করা যেত।

দ্বিতীয়বার প্রবাস যাত্রার আগে দ্বারকানাথের মনে সামান্য একটু সংশয় ছিল, এবারেও তিনি পূর্বেকার মতন সমাদর পাবেন তো? প্রথম পরিচয়ের বিস্ময় দ্বিতীয়বার অনেকটা কমে যায়। তাছাড়া, তিনি আগেরবার যখন এসেছিলেন, তখন ইওরোপের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা তাঁকেই প্রথম একজন হিন্দু বা ভারতীয় হিসেবে চাক্ষুষ দেখলেন। এক রূপকথার দেশ হিন্দুস্থান বা ভারতবর্ষ, সেখানকার মানুষকে দেখতে কেমন, এই কৌতূহলই ছিল প্রবল। এবারে ইওরোপে পৌঁছেই দ্বারকানাথ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য একেবারে বিলাসের স্রোত বইয়ে দিলেন।

দ্বারকানাথ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ছোটখাটো একটি দল। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ, তাঁর ভাগিনেয় নবীনচন্দ্র, একজন নিজস্ব ইংরেজ চিকিৎসক, একজন ইংরেজ একান্ত সচিব, কয়েকজন ভৃত্য কর্মচারী। এ ছাড়া মেডিক্যাল কলেজের দুজন ছাত্রকে তিনি উচ্চ শিক্ষালাভের সুযোগ দেবার জন্য তাঁদের পথ-খরচ এবং বিলাতে তাদের আহার, বাসস্থান ও শিক্ষার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁর সাথে গিয়েছিল সেই দুটি ছাত্র এবং সরকারী খরচে আরও দুটি ছাত্র। বিলেতে পৌঁছে তিনি প্রথমেই ঐ ছাত্রদের এবং তাঁর পুত্র ও ভাগিনেয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করে তাঁদের পৃথক পৃথক বাসা ভাড়া করে দিলেন। তারপর দায়িত্বমুক্ত হয়ে তিনি স্বেচ্ছামাগী হলেন।

আগের বার এসে তিনি সাহেব জাতিরা কী কী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছে এবং শিল্পে-বাণিজ্যে কোন কোন অভিনব পন্থা অবলম্বন করে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানিবার চেষ্টা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর স্বদেশেও সে-সব পন্থা প্রয়োগ করবেন। কিন্তু এবারে দ্বারকানাথ স্বদেশের উন্নতি কিংবা নিজ পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধির ব্যাপারে উদাসীন। এখন তিনি নৃত্য, গীত, ভোজের আসর কিংবা থিয়েটার, অপেরা সম্পর্কে বেশী আগ্ৰহী। রানী ও রানীর স্বামীর (বিলাত এমনই দেশ, যেখানে রানীর স্বামী সব সময় রাজা হন না) জন্য তিনি স্বর্ণনির্মিত বহুমূল্য সব উপহার নিয়ে এসেছিলেন, রানী ও যুবরাজ সেগুলি পেয়ে অতিশয় উৎফুল্ল হলেন। রাজপ্রাসাদে দ্বারকানাথের ঘন ঘন ডাক পড়তে লাগলো। তাছাড়াও প্রখ্যাত সব ডিউক ও ডাচেস এবং লর্ড ও লেডিগণ পরিবৃত হয়ে তিনি থাকেন প্রায় সর্বদা। কেউ তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে তিনিও সমান বা তার চেয়ে বেশী জাঁকজমকের সঙ্গে তাঁদের পালটা নিমন্ত্রণ করতেন। মাঝে মাঝে তিনি প্রখ্যাত সব সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের ডেকে আসর জমাতেন নিজের গৃহে। তিনি চাইতেন, ইংলণ্ডের লোক বুঝুক পরাজিত জাতির প্রতিনিধি হয়েও একজন ভারতবাসী তাঁদের সমকক্ষ হতে পারে সব দিক দিয়ে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশন দেখে দ্বারকানাথের মনে একটি নতুন চিন্তা এলো। ব্রিটিশ প্রজাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পালামেন্টের আসন অলস্কৃত করেন। তাহলে ভারতীয়রাই বা কেন সেই নির্বাচনে অংশ গ্ৰহণ করতে পারবে না? আর ভারতীয়দের মধ্যে দ্বারকানাথের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্ৰতিনিধি কে হতে পারে? পার্লামেন্টে আসন পেলে দ্বারকানাথের বিলাতে অবস্থান স্থায়ী হতে পারে।

এক নৈশভোজের নিমন্ত্রণের কথা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য ইংলণ্ডের প্রধানমন্ত্রী একদিন নিজে এলেন দ্বারকানাথের বাসভবনে। তখন কথা প্রসঙ্গে দ্বারকানাথ পালামেন্টে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্বের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেন। অস্বস্তিতে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী। এই মহামান্য অতিথির মনে আঘাত লাগবে এমন কোনো কথা তিনি বলতে পারেন না। প্ৰকারান্তরে তিনি জানালেন যে সেখানে কোনো অ-ব্রিটিশের নির্বাচিত হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। দ্বারকানাথ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, তিনি যে কোনো স্থান থেকেই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়ী হতে পারবেন! প্ৰধানমন্ত্রীকে তখন বলতেই হলো যে, ধরা যাক যদি সেরকমই হয়, তবুও কোনো হিন্দুর পক্ষে পার্লামেন্ট শপথ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। খৃষ্টান ছাড়া আর কারুর সে অধিকার নেই।

দ্বারকানাথ প্রশ্ন করলেন, হিন্দু খৃষ্টানে তফাৎ কী? হিন্দুও একমাত্র এক পরমেশ্বরের ভজনা করে, খৃষ্টানেও কি তা করে না? হিন্দু ও খৃষ্টানে তো ধর্মবিশ্বাসের কোনো সংঘর্ষ নেই, তবে তারা পাশাপাশি কেন বসতে পারবে না পার্লামেণ্টে?

প্রধানমন্ত্রী বললেন, খৃষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যীশুকে কি আপনারা ঈশ্বরের পুত্র বলে মানেন? যারা তা মানে না, তাঁদের আমরা বিপথগামী বলে মনে করি।

আলোচনা অপ্ৰিয় দিকে মোড় নিচ্ছে বলে উভয়েই এক সময়ে থেমে গেলেন। কিন্তু দ্বারকানাথের মনে বিক্ষোভ রয়েই গেল। এই ঘটনার পর থেকে তাঁর মনে খৃষ্টীয় ধর্ম সম্পর্কে একটা বিরূপতার ভাব জমতে লাগলো ধীরে ধীরে। দেশে থাকতে তিনি ব্ৰাহ্মণদের ছুৎমার্গ ও কুসংস্কার দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। এবার তিনি পাদ্রীদের নাম দিলেন, কালো কোট পরা বিলাতী ব্ৰাহ্মণ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে যখনই তিনি পাদ্রীদের কোনো পদস্থলিন বা লজ্জাজনক ব্যবহারের কাহিনী দেখতেন ওমনি সেগুলি কেটে কেটে গদ দিয়ে সেঁটে রাখতেন একটা খাতায়। তাঁর কোনো ইওরোপীয় বন্ধু বা অতিথি খৃষ্টধর্মের প্রশংসায় বাড়াবাড়ি শুরু করলেই তিনি সেই খাতাটি খুলে দেখাতেন।

এর মাঝখানে কিছুদিন দ্বারকানাথ ঘুরে এলেন ফ্রান্সে। তখন ফরাসী দেশের সম্রাট লুই ফিলিপ প্ৰায় তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে পড়েছেন। ভাসাঁইয়ের রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরেও দ্বারকানাথের গতিবিধি, সম্রাটের পত্নী ও ভগিনীর সঙ্গে এর আগে আর কোনো বহিরাগত কথাবার্তা বলার সম্মান অর্জন করেননি, একমাত্র দ্বারকানাথ ছাড়া। দ্বারকানাথের অঙ্গে দেশীয় পোশাক এবং একটি বহুমূল্য কাশ্মিরী শাল, তা দেখে মহিলারা মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ রকম বাহারী জিনিস তাঁরা আগে কখনো দেখেন নি।

ফরাসী দেশে এক সান্ধ্য সম্মিলনীর আয়োজন করে দ্বারকানাথ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী সমেত ফরাসী দেশের শ্রেষ্ঠ অভিজাতদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন সেদিন। তিনি বিশেষ করে অনুরোধ করেছিলেন সকলেই যেন তাঁদের স্ত্রী বা প্ৰেয়সীদের নিয়ে আসেন। একটি বিরাট হলঘরে বসেছিল সেই সান্ধ্যভোজের আসর। সেই হলঘরের সব দেওয়াল ছিল বহুমূল্য সব কাশ্মিরী শালে মোড়া। অতিথিরা, বিশেষত রমণীরা সেই কারুকার্যখচিত শালগুলি থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না। শাল অঙ্গে জড়ানো তখন ফরাসীদেশে একটি দারুণ ফ্যাসান দস্তুর ব্যাপার। কিন্তু এমন চমৎকার কাশ্মীরী শাল এর আগে ফরাসিনীরাও দেখেননি। কোনো নীলনয়না সুন্দরী দেয়ালের কোনো কাশ্মিরী শালের সামনে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেই দ্বারকানাথ এসে বলছিলেন, মহাশয়া, এই শালটি আপনাকে উপহার দিয়া আমি ধন্য হতে পারি কি? তারপরই তিনি দেয়াল থেকে সেই শালটি খুলে নিয়ে বিস্ময়াপ্লুত সেই রমণীর শরীরে নিজের হাতে জড়িয়ে দিচ্ছিলেন। ক্রমে ক্রমে সব কটি শালই এইভাবে বিলি হয়ে গেল। এমন নিমন্ত্রণ উৎসব বহুকাল কেউ প্যারিসে দেখেননি।

প্যারিসে অবস্থানকালেই দ্বারকানাথের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ম্যাক্সমুলারের। দ্বারকানাথের পুত্ৰ দেবেন্দ্রর চেয়েও ম্যাক্সমুলার ছিলেন বছর ছ'য়েকের ছোট। এই যুবকটি তখন জার্মানির লাইপৎসিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ ডি করে ফ্রান্সে এসে অধ্যাপক বুন্টুফের কাছে সংস্কৃত অধ্যয়ন করছিলেন। সেই বুৰ্গফই একদিন ম্যাক্সমুলারকে নিয়ে এলেন দ্বারকানাথের কাছে। দ্বারকানাথ নিজে সংস্কৃত অবশ্য ভালো জানেন না, কিন্তু অধ্যাপক বুর্ণফ এবং ম্যাক্সমুলার সংস্কৃত শিক্ষার সূত্রে ভারতবর্ষ সম্পর্কে এমন সব কথা বলেন, যার সঙ্গে প্রকৃত ভারতবর্ষের সাদৃশ্য খুব কম—এ সব শুনে দ্বারকানাথ কৌতুক বোধ করেন। ম্যাক্সমুলার নামের যুবকটির কৌতূহলের আতিশয্য দেখে দ্বারকানাথ তাঁকে বললেন, যেদিন খুশী সকালবেলা সে তাঁর কাছে আসতে পারে। ম্যাক্সমুলার প্রায় নিয়মিতই আসতে লাগলেন। সংস্কৃত ভাষা ভালোভাবে না জানলেও পারিবারিক সূত্রে দ্বারকানাথ সংস্কৃত সাহিত্য ও ভারতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। তাঁর মুখ থেকে সেই সব কথা ম্যাক্সমুলার গোগ্রাসে গিলতেন। দেখা গেল ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে এই জার্মান যুবকটির আগ্ৰহ অসীম।

দ্বারকানাথ এই সময় গান-বাজনার চর্চায়ও মেতে উঠেছিলেন। ফরাসী ও ইতালীয় অপেরাগীতি তিনি অনুকরণ করতে পারতেন অনবদ্যভাবে। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল জোরালো। মাঝে মাঝে সেই সব গান তিনি গেয়ে উঠলে ম্যাক্সমুলার শুনতেন মুগ্ধভাবে। কখনো কখনো ম্যাক্সমুলার তাঁর গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজাতেন। খুব একটা চর্চা না করলেও দ্বারকানাথের কণ্ঠে বেশ সুর ছিল। একদিন ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথকে অনুরোধ করলেন একটি ভারতবর্ষীয় মার্গ সঙ্গীত শোনাবার জন্য। ভারতীয় প্রিন্স বললেন, ও গান বিদেশীরা বুঝবে না। তবু ম্যাক্সমুলার বারবার অনুরোধ করায় তিনি একটি গান গাইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী, এর মর্ম বুঝিলে কিছু?

ম্যাক্সমুলার অকপটে স্বীকার করলেন যে, ঐ গানে তিনি কোনো রস পাননি, ওটি কোনো গান বলিয়া মনে হয় না। সুর তালি লয় কিছুই নেই।

অমনি চটে উঠলেন দ্বারকানাথ। রুক্ষ স্বরে বললেন, এই তোমাদের এক দোষ। তোমরা সহজে কোনো নতুন জিনিস গ্রহণ করিতে পারো না। কোনো জিনিস। যদি প্রথমবারই তোমাদের মনোরঞ্জন করিতে না পারে, অমনি তোমরা তার প্রতি বিরূপ হও। আমি যখন প্রথম ইতালীয় গীতবাদ্য শুনি, তখন মনে হইয়াছিল উহা বিড়ালের চ্যাঁচামেচি। ধৈর্য ধারণ করিয়া আমি তাহার রস গ্রহণ করিতে শিখিয়াছি। তোমরা মনে করো আমাদের ধর্ম ধর্মই নয়, আমাদের কাব্য কাব্যই নয়, আমাদের দর্শন দর্শনই নয়, যেহেতু তোমরা তা বোঝে না।

ম্যাক্সমুলার চুপসে গেলেন একেবারে। ইদানীং দ্বারকানাথের মেজাজ প্রায়ই ভালো থাকত না। দেশ থেকে টাকা আসতে সামান্য দেরি হলে, তিনি জ্যেষ্ঠপুত্ৰকে তীব্র ভর্ৎসনা করে চিঠি লিখতেন। দেবেন্দ্রকে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ভালোই বুঝতে পেরেছেন যে দেবেন্দ্ৰ যে পথে চলেছে, তাতে বিষয়সম্পত্তি কিছুই রক্ষা করতে পারবে না।

এদিকে দেশে সত্যিই সেইপ্ৰকার ব্যাপার চলছিল। পিতা বিদেশবাসী হবার পর দেবেন্দ্ৰ বিষয়কর্ম থেকে মন একেবারেই সরিয়ে ফেলেছিলেন যেন। সর্বক্ষণ তিনি ধর্ম সাধনায় ও ধর্ম বিস্তারের জন্য উন্মুখ থাকতেন। ইতিমধ্যেই দীক্ষিত ব্ৰাহ্মর সংখ্যা পাঁচশত ছড়িয়ে গেছে, তখন শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলেও এই নব ধর্ম প্রচারের আয়োজন চলছে।

একদিন সকালে দেবেন্দ্র তাঁদের বাহির বাটিতে বসে সংবাদপত্র পাঠ করছেন, এমন সময় তাঁদের হাউসের সরকার রাজেন্দ্ৰনাথ এসে তাঁর কাছে কেঁদে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো, দেশে এত বড় অবিচার সংঘটিত হচ্ছে, অথচ তার প্রতিকার করার কেউ কি নেই?

কাগজ মুড়ে রেখে দেবেন্দ্র বললেন, কান্না থামাও, আগে বৃত্তান্তটি কি তা খুলে বলো!

রাজেন্দ্রনাথ যে কাহিনীটি বলেছিলেন, তা এইরকম:

গত রবিবার রাজেন্দ্রনাথের স্ত্রী এবং তার ছোট ভাই উমেশচন্দ্রের স্ত্রী এক পালকিতে চেপে কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছিলেন এমন সময় তাঁর ছোট ভাই উমেশচন্দ্ৰ পালকি থামিয়ে জোর করে নিজের স্ত্রীকে নামিয়ে নিয়ে যায় এবং উভয়ে খৃষ্টান হবার নিমিত্ত পাদ্রী ডফ সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। উমেশচন্দ্রের বয়স চোদ্দ এবং তাঁর পত্নীর বয়েস এগারো, উভয়েই নাবালক-নাবালিকা। সুতরাং স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হবার অধিকার তাদের নেই। উমেশচন্দ্রের পিতা ডফ সাহেবের কাছে গিয়ে অনুনয় বিনয় করলেন, পুত্র ও পুত্রবধূকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। ডফ সাহেব তা শুনলেন না। তখন সুপ্রিমকোর্টে নালিশ করা হলো, সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়ে দিল যে ছেলে যখন বাপের কাছে ফিরে যেতে চায় না, তখন আদালত সেখানে জবরদস্তি করবে। কেন?

তখন রাজেন্দ্র এবং তাঁর পিতা ডফ সাহেবের কাছে অনুরোধ করে বলেছিলেন, তাঁরা আবার আদালতে নালিশ আনবেন, সেই বিচার সমাপ্ত হবার আগে পর্যন্ত যেন ডফ সাহেব উমেশচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রীকে খৃষ্টান না করেন। ডফ সাহেব সে কথায় কৰ্ণপাত করলেন না। গতকল্য সন্ধ্যাবেলা ডফ সাহেব ওদের দুজনকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দিয়ে ফেলেছেন।

ঘটনাটি শুনে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন দেবেন্দ্র। আদালত এমত প্রকার রায় দিয়েছে? নাবালক-নাবালিকাকেও জোর করে ধর্মান্তরিত করা যাবে। এ তো স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব। এই কি ব্রিটিশ ন্যায়-এর উদাহরণ?

তিনি তাঁর কর্মচারী ও বয়স্য অক্ষয় দত্তকে ডেকে বললেন, আপনি এক্ষণেই এর বিরুদ্ধে কলম ধারণ করুন। অন্তঃপুরের স্ত্রীলোকেরাও এইভাবে ক্ৰমে ক্ৰমে স্বধৰ্ম ছেড়ে পরধর্ম গ্রহণ করবে? এই সাংঘাতিক ঘটনা প্ৰত্যক্ষ করেও কি আমাদের চৈতন্য হবে না!

দেবেন্দ্র নিজে গাড়ি নিয়ে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগলেন। তাঁদের বোঝাতে লাগলেন যে, পাস্ত্রীরা বিনা পয়সায় লেখাপড়া শেখাবার প্রলোভন দেখিয়ে ছোট ছোট বালকদের নিজেদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছে এবং তারপরই প্রথম সুযোগে তাদের খৃষ্টান করে নিচ্ছে। হাজার হাজার ছেলে এইভাবে খৃষ্টান হচ্ছে। এইভাবে চললে যে এদেশের সবাই খৃষ্টান হয়ে যাবে! পাদ্রীদের সংস্পর্শ থেকে এখনি ছেলেদের সরিয়ে আনা দরকার।

সম্ভ্রান্তদের মধ্যে অনেকেই দেবেন্দ্রকে সুনজরে দেখতেন না। ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচার করে তিনি সনাতন হিন্দুধর্মকে আঘাত করার চেষ্টা করছেন বলে মনে করতেন অনেকে। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের শিরোমণি রাধাকান্ত দেব ব্ৰহ্মসভার বিরুদ্ধে একটি ধর্মসভা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তিনিও দেবেন্দ্রর এই ব্যাকুলতা দেখে তাঁর সঙ্গে একমত হলেন। উচ্চ ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যে দু-একজন শুধু প্রশ্ন তুললেন, খৃষ্টান ধর্ম প্রসারে আপত্তি করার নৈতিক ভিত্তি কী? খৃষ্টান ধর্মও তো একটি মহান ধর্ম। ধর্মবিশ্বাসে প্রতিটি মানুষ স্বাধীন, সুতরাং কেউ যদি হিন্দুধর্মের বদলে খৃষ্টধর্ম বরণ করতে চায়, তাহলে তাঁকে বাধা দেওয়া হবে কেন?

দেবেন্দ্র বলেছিলেন, 'খৃষ্টধর্ম যে মহান তা আমি অবশ্য জানি। ধর্মবিশ্বাসে মানুষ স্বাধীন একথাও ঠিক। কিন্তু প্ৰধানত খৃষ্টান হয় কাহাদের সন্তানেরা? খৃষ্টান হয়। গ্রামের দরিদ্র মানুষ অথবা শহরের নব্য শিক্ষিত যুবকেরা। গ্রামের মানুষ খৃষ্টান হয় নানা প্রকার প্রলোভনে। আর শহরের যুবকেরা হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাহাদিগকে খৃষ্টান করা সহজ কাজ বটে, কিন্তু উচিত কাজ কিনা সেটাই প্রশ্নের বিষয়। পাদ্রীরা বেদান্তধর্ম সম্পর্কে নানা রকম গালাগালি করে এবং লোকের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করায়। সেইজন্যই আমি বলি, হিন্দুধর্ম ও খৃষ্টধর্মের মতামতগুলির সম্যক জ্ঞান দেশময় বিস্তারিত হোক। তারপর দুই ধর্মমত তীল করে কেউ যদি একটিকে অন্যটির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বেছে নেয়, তবে তো ভয়ের কোনো কারণ নেই।'

দেবেন্দ্রর ব্যাকুলতা ও জোরালো যুক্তি শুনে সকলেই উপলব্ধি করলেন বিষয়টির গুরুত্ব। এইভাবে ভালো ভালো পরিবারের যুবকেরা, এমনকি নাবালক নাবালিকারাও যদি মোহে পড়ে খৃষ্টান হয়, তাহলে হিন্দুসমাজে ভাঙন রোধ করা যাবে কী প্রকারে? ঠিক হলো, পাদ্রীদের বিদ্যালয়ে যেমন ছেলেরা পড়তে পারে, সেই রকম হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয় নামে একটি পাঠশালা খোলা হবে, সেখানেও বালকরা বিনাবেতনে পড়বে। বালিকাদের জন্যও একটি পাঠশালার কথা অনেকের মনে গুঞ্জরিত হচ্ছে, এর আগে দু-একবার চেষ্টা করেও সুফল পাওয়া যায়নি, কিন্তু আশা ছাড়েননি অনেকে।

শিমুলিয়াতে এক প্রকাশ্য সভায় এই স্কুল খোলার প্রস্তাবে একদিনে চাঁদ উঠে গেল চল্লিশ হাজার টাকা। এমনকি অন্তঃপুরের মহিলারাও এর জন্য তাঁদের দান পাঠিয়ে দিলেন। দেবেন্দ্রর একটি বড় রকমের জয় হলো।

পত্রিকা পরিচালনা ও ধর্মবিস্তার নিয়ে দেবেন্দ্র বেশ কয়েক বৎসর মত্ত হয়েছিলেন। অন্য কোনো দিকে মন দেবার সময় পাননি। নিজ পরিবারের লোকজনের সঙ্গেও প্রায় যোগাযোগ শূন্য। শরীর ক্লান্ত। এইজন্য কিছুদিনের জন্য দেবেন্দ্ৰ গেলেন নদীপথে পরিভ্রমণে। শ্রাবণ মাসের ঘোর বিষয়ে তাঁর পত্নী সারদা দেবী এবং তিন শিশু পুত্ৰ দ্বিজেন্দ্ৰ, সত্যেন্দ্র ও হেমেন্দ্ৰকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে আরও রইলেন রাজনারায়ণ বসু। রাজনারায়ণ তখন সদ্য ব্ৰাহ্ম হয়েছেন এবং দেবেন্দ্রর বিশেষ প্রিয়পাত্র। ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত এই রকম একজন সঙ্গীর প্রয়োজন খুব অনুভব করছিলেন দেবেন্দ্র। অক্ষয়কুমার দত্ত ও রাজনারায়ণ বসু, এই দুজন যথাক্রমে বাংলা ও ইংরেজিতে দেবেন্দ্রর মতামত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্ৰকাশ করতে পারেন।

একটি প্রকাণ্ড পানসি তে পত্নী ও পুত্রদের রেখে আর একটি ছোট বোটে দেবেন্দ্র রয়েছেন রাজনারায়ণের সঙ্গে। সারাদিনে দুইজনে নানা প্রকার বিশ্রাম্ভালাপ হয়, সন্ধ্যার পর রাজনারায়ণ সেই সব কথা ও সারাদিনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখেন। তারপর আহারের সময় দুজন কিঞ্চিৎ সুরা পান করতে করতে সেগুলি নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠেন আবার।

পরপর কয়েকটি দিন কাটলো। তখন নবদ্বীপ ও পাটুলি ছাড়িয়ে চলেছে নৌকাদ্বয়। তখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। দেবেন্দ্র রাজনারায়ণকে বললেন, এবার তোমার দিনলিপি লিখে লও বরং। রাজনারায়ণ বললেন, এখনো বেলা শেষ হয়নি, এর মধ্যে আরও কত কাণ্ড-কারখানা হতে পারে কে জানে!

বলতে বলতেই প্ৰায় দেখা গেল আকাশের পশ্চিম কোণ থেকে একখণ্ড জমাট কালো মেঘ ডানা মেলে হু হু করে এগিয়ে আসছে। এখনি ঝড় উঠতে পারে ভেবে দেবেন্দ্র বললেন, ঝড়ের সময় ছোট বোটে থাকা ভালো নয়, চলো আমরা পানসি তে যাই। মাঝিরা বোটটিকে পিনসির গায়ে লাগাবার চেষ্টা করতে লাগলো, এমন সময় এক ভয়ঙ্কর দমকা হাওয়া উঠে পানসির মাস্তুলের এক অংশ ভেঙে তার পাল ও দড়িদড়া সমেত জড়িয়ে বোটের ছাদের ওপর পড়লো। বাকি পালে তীরের মতন ছুটলো পানসি এবং বোটটাকেও সঙ্গে টেনে নিয়ে দ্রুত চললো। অতবড় পানসি অথাৎ বজরার টানে কাৎ হয়ে গেল ছোট বোটটি, এখুনি দড়িদড়া ছাড়াতে না পারলে ভয়ঙ্কর বিপদ। দড়িদড়া কেটে ফেলবার জন্য দা খোঁজা হতে লাগলো, কিন্তু ঐ হুড়োহুড়ির মধ্যে দা পাওয়া যায় না। একজন মাঝি লাগি দিয়ে গুণ ছাড়াতে যেতেই সে লাগি গিয়ে পড়লো দেবেন্দ্রর নাকের ওপর, দরদর ধারায় রক্ত বেরুতে লাগলো।

এই সময় বার্তাস একটু থেমেই আবার প্রবলতর হলো। ভয়ার্ত মাঝিরা চিৎকার করে উঠলো, ওরে, আবার তাই রে, আবার তাই রে! বোট একদিকে সম্পূর্ণ কাৎ হয়ে গেছে, আর দু-এক মুহূর্তের মধ্যেই ড়ুবে যাবে। দেবেন্দ্ৰ স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। সামনে নিশ্চিত মৃত্যুকে দেখছেন।

কোনোক্রমে একটা দা খুঁজে পেয়ে মাঝিরা কচকচ করে কাটতে লাগলো দড়ি। শেষ দড়িটি কাটা হবার সঙ্গে সঙ্গে বোটটি পিনিসকে ছেড়ে তীরবেগে গিয়ে পাড়ের বালিয়াড়ির ওপর আছড়ে পড়লো। দেবেন্দ্র ও রাজনারায়ণ লাফিয়ে পড়লেন নীচে এবং একটুর জন্য বেঁচে গেলেন।

ইতিমধ্যে ঝড়ে ও অন্ধকারে কোনোদিকে কিছু দেখা যায় না। দেবেন্দ্রর স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে পানসি কোনদিকে ছুটে গেল বোঝার উপায় নেই। এরই মধ্যে ছোট একটি ডিঙি নৌকে এসে ভিড়লো সেখানে। নিশ্চিত বোম্বেটের নৌকো ভেবে সবাই ভয়ার্তভাবে চেঁচিয়ে উঠলো, কে ও? কে ও?

সেই নৌকো থেকে এক ব্যক্তি সত্বর লাফিয়ে পড়ে ছুটে এলো দেবেন্দ্রর দিকে। তার কণ্ঠস্বর শুনেই দেবেন্দ্ৰ চিনতে পারলেন। সে ব্যক্তি তাঁদের বাড়ির স্বরূপ খানসামা। সে একটি জরুরী বার্তাবহ পত্র নিয়ে এসেছে।

অন্ধকারে পড়বার উপায় নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই বিদ্যুতের ঝিকিমিকি আলোয় দেবেন্দ্ৰ কোনোক্রমে খানিকটা পাঠোদ্ধার করলেন।

চিঠিতে আছে, ইংল্যান্ড হইতে দুঃখের সংবাদ। দ্বারকানাথ আর নাই!

দেবেন্দ্ৰ মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন, রাজনারায়ণ তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। অল্পকালের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলেন দেবেন্দ্র। পিতৃশোকের চেয়েও তিনি অন্য বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন বেশী। অবিলম্বে কলকাতায় না। ফিরলে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে দারুণ গোলযোগ উপস্থিত হবে। তিনি অতি সম্প্রতি জেনেছেন যে, গত কয়েক বৎসরে দ্বারকানাথ বাজারে এক কোটি টাকা দেনা করেছেন, এবার পাওনাদারগণ তাঁদের পরিবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

পরদিনই সেই ঝড়-জলের মধ্যেই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে দেবেন্দ্র রওনা হলেন কলকাতার দিকে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোনোক্রমে পলতায় পৌঁছে, সেখানে ডাঙায় নেমে পেয়ে গেলেন অশ্বশকিট। সেই দুযোগের মধ্যেই গাড়ি হাঁকিয়ে রাত দুপুরে পৌঁছোলেন কলকাতায়। সেদিনের সেই ঝড় যেন তাঁদের পারিবারিক বিপর্যয়ের রূপক।

পাওনাদারেরা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতন শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত আশেপাশে ঘুরতে লাগলো। দেবেন্দ্ৰ সকলকে জানিয়ে দিয়েছেন যে অশৌচদশায় তিনি টাকা পয়সা সংক্রান্ত কোনো আলোচনাই করবেন।

কিন্তু এর আগেই দারুণ মতান্তর দেখা গেল শ্ৰাদ্ধপ্রণালী নিয়ে। দেবেন্দ্রর ছোটকাকা রমানাথ ঠাকুর বললেন, দেখো, ব্ৰহ্ম ব্ৰহ্ম করে এ সময় কোনো গোলমাল তুলো না। দাদার বড় নাম।

দেবেন্দ্ৰ বললেন, তা কি করে হয়! আমার ধর্মব্ৰতের বিরুদ্ধে তো কোনো কাজ আমি করতে পারি না। আমি শ্ৰাদ্ধ করবো উপনিষদের মতে। শালগ্রাম শিলা আমি মানি না। পাথরের নুড়িকে আমি নারায়ণ বলে পূজা করতে পারবো না। রাজা রাধাকান্ত দেব বললেন, সে হবে না, সে হবে না। তুমি অমন করলে শ্ৰাদ্ধ বিধিপূর্বক হবে না। তোমার পিতার পরলৌকিক কার্য অসম্পূর্ণ থাকবে। দেবেন্দ্র তখন তাঁর মেজ ভাই গিরীন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর মত। গিরীন্দ্ৰ দাদার অনুবতী। দাদার সঙ্গে তিনিও ব্ৰাহ্মধর্ম গ্ৰহণ করেছেন। কিন্তু এখন তিনিও বললেন, আমরা যদি এমন করি, তাহলে সকলে আমাদিগকে ত্যাগ করবে, সকলে বিপক্ষে যাবে।

দেবেন্দ্র বিস্মিত, বিমূঢ় বোধ করলেন। সকলেই তাঁর মতের বিরোধী। এ দেশে ধর্ম আর সামাজিক প্রথা যেন পৃথক ব্যাপার। যারা ব্ৰহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছে, তাঁরাও সামাজিক প্রথা অমান্য করতে ভয় পায়।

দেবেন্দ্র তখন নির্জনে বসে প্রশ্ন করতে লাগলেন নিজের বিবেককে। বারবার একই উত্তর পেলেন। লোকভয়, সামাজিক শিষ্টাচারের চেয়েও নিজের ধর্মবিশ্বাস অনেক বড়। এর মধ্যে তিনি একদিন স্বপ্নে দেখলেন তাঁর পরলোকগত জননীকে। তিনি যেন জীবন্ত হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, তোকে বড় দেখবার ইচ্ছা হয়েছিল। তুই নাকি ব্ৰহ্মজ্ঞানী হয়েছিস? এর দ্বারা আমাদের কুল পবিত্র হয়েছে, তোর জননী কৃতাৰ্থ হয়েছে। সারা শরীরে আনন্দ প্রবাহ নিয়ে জেগে উঠলেন দেবেন্দ্ৰ।

শ্রাদ্ধের দিন বাড়ির পশ্চিম প্রাঙ্গণে মস্ত এক চালা তৈরি হয়েছিল। দানসাগরের সোনা রূপার ষোড়শোপচারে ভরে গিয়েছিল সেই চালা। মাঝখানে পুরোহিত, আত্মীয়-পরিজন সকলে শালগ্রাম শিলা স্থাপন করে বসে ছিলেন দেবেন্দ্রর অপেক্ষায়।

দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ দেবেন্দ্ৰ পট্টবস্ত্ৰ পরিধান করে গম্ভীরভাবে প্ৰবেশ করলেন সেখানে। উপনিষদের একটি শ্লোক উচ্চারণ করে সমগ্ৰ দানসামগ্ৰী উৎসর্গ করে তিনি আবার পেছন ফিরলেন। আত্মীয়বন্ধুরা তাঁকে ডাকতে লাগলো যজ্ঞের আসনে এসে বসবার জন্য। দ্বারকানাথের তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র, তাঁকে বাদ দিয়ে যজ্ঞ শুরু হতে পারে না। কিন্তু তিনি ভ্রূক্ষেপ করলেন না, সোজা উঠে গেলেন তিনতলায়।

একটু পরে তিনি শুনতে পেলেন তাঁর ভাই গিরীন্দ্রনাথ তাঁর হয়ে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পাঠ করে চলেছেন।

দেবেন্দ্ৰ মনে মনে বললেন, জ্ঞাতি বন্ধুরা আমায় ত্যাগ করে করুক, কিন্তু ঈশ্বর আমাকে আরও গ্ৰহণ করলেন।

 


(তথ্যসূত্র:
১- সেই সময় (অখণ্ড) (পটভুমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীললোহিত), আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
২- Memoir of Dwarkanath Tagore, Kissory chend mittra, Parul Prakashani Pvt. Ltd.।
৩- ডারলিং ডোয়ার্কি (প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে হত্যার কাহিনি), রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন (২০১৮)।
৪- আত্মজীবনী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্য বিহার (২০১৪)।
৫- মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী।
৬- ঠাকুরবাড়ি সংক্রান্ত, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, পুনশ্চ (২০১২)।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ