ঠাকুরবাড়ির ছেলে, সমাজ বদলানোর ঝোঁকটাও তো থাকবেই। সময়ের থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিল তাঁর শিল্পী-মন। সব সময়ে নতুন রকম কিছু করার ভাবনায় মেতে থাকতেন। একটা গল্প বললেই তার আন্দাজ পাওয়া যাবে। নিজের মেয়ে সুজাতার বিয়ে নিয়ে গগনেন্দ্র বড় মাপের বাজি ধরেছিলেন। সে সময় হিন্দু বিয়ে এবং শ্রাদ্ধে সেলাই করা বস্ত্র পরিধানের রেওয়াজ ছিল না। পুরোহিতরা চাদর পরতেন, জামা বা পাঞ্জাবি পরতেন না। শ্রাদ্ধ এবং বিয়ের সময় মেয়েরা শাড়ি ও চাদরে নিজেদের আবৃত রাখতেন। ব্লাউজ বা সেমিজ পরতেনই না। কারণ, ওই যে! শাস্ত্রীয় কাজে ছুঁচ-সুতোয় বোনা কাপড় পরা বারণ ছিল। কারণ ছুঁচে সুতো পরাতে হলে জিভের লালায় ভিজিয়ে নিয়ে সুতোকে ছুঁচের ফুটোয় পরাতে হয়। এই অশুচি ব্যাপারটা হিন্দু শাস্ত্র মানতে পারেনি। তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে এক সময় এ ধরনের জামা পরা ঘোর নিষিদ্ধ বলে গণ্য হত।
চোখ ধাঁধানো সোনার ব্লাউজ় ছিল না সে দিন সুনন্দিনীর অঙ্গে। সত্যি বলতে, আদপে ছিল না কোনও ব্লাউজ়। শাড়ি এবং গয়নায় এমন সাজানো হয়েছিল তাঁকে যে, মনে হচ্ছিল অঙ্গে মহার্ঘ এক ব্লাউজ়।
সুনন্দিনীর বাবা সে দিন এমন ভাবেই সাজিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েকে। বাবা মানে, স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বড় মেয়ে সুনন্দিনীকে তিনি অল্প বয়সেই বিয়ে, মানে গৌরীদান করেছিলেন। সুনন্দিনী যখন বিয়ের আসরে বাবার শৈল্পিক আবরণে, আভরণে ভূষিত হয়ে এলেন, তাঁর হবু শ্বশুরবাড়ির ঘোলা জলে ঢিল পড়ল। প্রভাতনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁর বর। বিয়েতে সেই বরের জ্যাঠামশাই অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বেঁকে বসলেন। বললেন, ‘‘সেলাই করা কাপড় পরে তো মেয়ে সম্প্রদান হয় না।’’ মেয়ের বাবা উত্তেজিত না হয়ে স্বভাবসুলভ শান্ত গলায় বললেন, ‘‘সেলাই-করা কাপড়? মেয়ের গায়ে তো নেই!’’
গগনেন্দ্রনাথ পালটা দাবি করলেন মেয়েকে সেলাই করা কাপড় পরানো হয়নি। যদি বেয়াইমশাই প্রমাণ করতে পারেন যে কন্যার পরিধানে ওই বস্ত্র আছে, তা হলে নগদ এক লাখ টাকা বাজি ধরবেন।
ঘটনাটা রয়েছে চিত্রা দেবের ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ বইয়ে। সে দিন শুধু বরের জ্যাঠামশাই নয়, বিয়েবাড়িতে উপস্থিত সকলেই অবাক হয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথের কথা শুনে। দেখা গেল, সুনন্দিনীর পরনে সত্যি কোনও সেলাই করা বস্ত্র নেই। বরং শাড়ি এবং অলঙ্কারে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, মেয়ের গায়ে যে ব্লাউজ় নেই তা বোঝা যাচ্ছে না। শুভ কাজে তখন সেলাই-বস্ত্র বারণ মেয়েদের।
এই শৈল্পিক পরিকল্পনা তাঁরই—গগন ঠাকুরের! নিমন্ত্রিত সকলেই তখন চমকিত, রোমাঞ্চিত। এ জিনিস কোনও দিন তাঁরা ভাবতেই পারেননি। সেখানেই শেষ নয়। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে গগনেন্দ্রনাথ বিয়ের সাজে সুনন্দিনীর একটা ছবি আঁকিয়ে রেখেছিলেন এক চিত্রশিল্পীকে দিয়ে। আজকের বিয়েবাড়ির বহুমূল্য ব্লাউজ়ের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না সে দিনের সেই ব্লাউজ়হীনতা। ‘ভোঁদড় বাহাদুর’-এর স্রষ্টা মেয়েকে শুধু ছদ্ম বক্ষ-আবরণীতে সাজিয়ে থেমে থাকেননি। বড় ছেলের বিয়েতে সাহেব বাজনদারদের ব্যান্ড পার্টিকে বাজাতে বলেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত।
১৯০৪ সালে বড় ছেলে গেহেন্দ্রনাথের বিয়ে দেন গগনেন্দ্রনাথ। আগে এই বিয়েবাড়িতেই একটা ট্রাজেডি ঘটেছিল। গগন ঠাকুরের বাবা গুণেন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিলেন তাঁর মেয়ে বিনয়িনী দেবীর বিয়ের পার্টিতে। মৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত মদ্যপান। পরে অর্থাভাবে গগন ও বাকি সন্তানদের বিয়ে নমো নমো করেই দিয়েছিলেন তাঁর মা। সেই ক্ষোভ মেটাতেই এত ধুমধাম।
ধুমধাম মানে? খাস পরিচারককে উপহার দেওয়া হল দামি শাল। রুপোর থালায় তত্ত্ব পাঠানো হল মেয়ের বাড়ি। প্রতিটি থালার নকশা করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ নিজে। বিয়েতে লোবো সাহেবের ব্যান্ডপার্টি বাজিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের দুটি গান— ‘শান্ত হ রে মম চিত্ত নিরাকুল’ এবং ‘শান্তি করো বরিষন’। দুটি গান সাহেবদের বাজানোর জন্য হারমোনাইজ় করে দিয়েছিলেন স্বয়ং ইন্দিরা দেবী। সম্ভবত সেই প্রথম কোনও সাহেবি বাজনদার বিয়েবাড়ির ব্যান্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর তুলল।
বিয়েটা অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। এক বছর পরেই গেহেন্দ্রনাথ মারা যান। শোক সামলাতে সময় লেগেছিল গগন ঠাকুরের। তারপরই শোকগ্রস্ত শিল্পী আরও গভীর ভাবে ডুবে যান রং-তুলির জগতে।
বড় তেজি ছিলেন শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ। এতটাই যে, তাঁর বড় দাদা গগনেন্দ্রনাথও তাঁর সামনে দাঁড়ানোর সাহস পেতেন না। একদিন চৌরঙ্গী আর্ট স্কুলের বাড়িতে ছবি আঁকছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সকলে বিস্মিত হয়ে দেখছেন। অবনীন্দ্রনাথ কে সেই ছবি দেখানোর জন্য অনেক সাধ্য সাধনা করে নিয়ে এসেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দাদার ছবি দেখে ভাই হুঙ্কার দিলেন, "এটা কি এঁকেছ? এটা ছবি হয়েছে?" অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনও কখনও তাঁর হাতে ধরা লাঠি দিয়ে খোঁচা দিতেন ছবিতে। এক্ষেত্রেও তাই করলেন। গগনেন্দ্রনাথও কম রাগী ছিলেন না, তবে তখন তিনিও কাঁচুমাচু।
জোড়াসাঁকোর দুই ঠাকুরবাড়ি থেকে যে সব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ভারতের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির জগৎকে আলোকিত ও আলোড়িত করেছিলেন, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের অন্যতম। পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ ও অনুজ অবনীন্দ্রনাথ যতটা সুপরিচিত, মেধায় সৃষ্টিশীলতায় ব্যক্তিত্বে কোনও অংশে কম না হয়েও গগনেন্দ্রনাথ কিন্তু কিছুটা অপরিচিত রয়ে গিয়েছেন। স্মৃতিচারণায়, সমসাময়িক লেখায় ব্যক্তি গগনেন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানা কথা জানা গেলেও শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার ভগ্নাংশও জানা যায় না। অবন ঠাকুরের নাম আজও লোকের মুখে মুখে, কিন্তু তাঁর দাদা গগন ঠাকুরের নাম ততটা প্রচার পায়নি। শুধু রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ বইটার টুকরো-টাকরা ছবি আঁকার জন্য তাঁকে মনে রেখেছেন কেউ কেউ। অথচ, এই মানুষটার মধ্যে ঠাকুরবাড়ির শিল্পী-রক্ত কম ছিল না কিছু। তাঁর তুলি-কলমের জীবনের গল্পগুলিও ভারী চমৎকার।
গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র। তিনি গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ সন্তান। সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাইপো। গগন ঠাকুর জন্মেছিলেন ১৮৬৭ সালে। প্রথাগত বিদ্যায় তাঁরও ছিল ভয়ানক অরুচি। সে সময়ের বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জলরঙের ছবি আঁকতে তাঁর জুড়ি ছিল না। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাছেই নাড়া বেঁধেছিলেন।
পরিণত বয়সে, ছোট ভাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে, গগন ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আটর্’। গগন ঠাকুরের নিজের আঁকাতে, তাঁর তৈরি ব্যঙ্গচিত্রে বাঙালিয়ানার প্রভাব ছিল খুব স্পষ্ট। তাঁর আঁকায় দেখা যেত জাপানি চিত্রকলার কেরামতিও। হবে না? ১৯০৬ থেকে ’১০-এর মধ্যে শিল্পী কত কষ্ট করে জাপানি ব্রাশ টেকনিক শিখেছিলেন। চিনে-জাপানি অঙ্কনরীতির সঙ্গে নিজস্বতার রং মিশিয়ে কত ছবি উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের। তার কতগুলো যে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, ভাবলেও মন খারাপ হয়ে যায়।
খুব থিয়েটার ভালবাসতেন গগন ঠাকুর। লেখালেখিও করেছেন কখনও কখনও। ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ বলে একটা ছোটদের বই লিখে ফেলেছেন এই আঁকা নিয়ে মেতে থাকার ফাঁকেই। সেই লেখায় লুইস ক্যারলের ঘরানার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।
যাঁরা গগন ঠাকুরের আঁকা ক্যারিকেচার-সিরিজ দেখেছেন, তাঁরা সব্বাই জানেন, ভারী অন্য ধাঁচের রসবোধ ছিল তাঁর। ১৯১১ সালে মোহনবাগান ক্লাব আইএফএ শিল্ড জয় করে ভারতীয় ফুটবলে ইতিহাস করল। আগুনে যেন ঘি পড়ল, বাঙালির রক্তে ফুটবলপ্রীতি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছল যে, পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করল এবং বাঙালি চরিত্রের প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়াল যে, সে ফুটবলের সমর্থক এবং সমঝদার। মোহনবাগান ক্লাবের খেলা যে দেখেনি, সে বাঙালিই নয়। ঠাকুরবাড়িতেও সেই হুজুগের ঢেউ পৌঁছল।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সেই হুজুগে মেতে কোনও কবিতা লেখেননি। কিন্তু গগনেন্দ্র নিজের জুড়িগাড়ি নিয়ে মোহনবাগান মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁর দুর্ভাগ্য, খেলার দিন, ঠিক খেলার সময়েই শুরু হল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এবং মোহনবাগানের ছেলেরা তাদের স্বভাবমত খালি পায়ে সেই কাদা-মাঠে খুব ভালই খেলল। গগনেন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত জীবনে খেলাধুলোর তেমন ভক্ত কোনও দিনই ছিলেন না। জুড়িগাড়ি থেকে খেলা দেখতে আদৌ নামলেন না। সঙ্গে ছাতাও ছিল না। যারা বারো মাস মাঠে খেলা দেখতে যায়, তাঁরা ছাতা সঙ্গে নিয়েই যায়। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে অতি যত্নে প্রতিপালিত গগনেন্দ্রনাথ কি আর মাঠ-ঘাটের খবর রাখা হাটুরে মানুষ? তিনি তো ছাতা নিয়ে যাননি। তবে দেখেছিলেন অনেক কিছু। বাড়ি ফিরেই স্বভাব-কার্টুনিস্ট গগনেন্দ্র একটি মজার কার্টুন এঁকে ফেললেন, তাতে যে দিকেই তাকানো যাক, ছবি জুড়ে ছাতা আর ছাতা। বল কই! গোলপোস্ট কই!
পরিপূর্ণ ভাবে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন অনেক দেরিতে। মোটামুটি ভাবে ১৯০৫ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর সৃজনময় জীবন। ১৯৩০ সালে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে আর কাজ করতে পারেননি। এই ২৫ বছরে তিনি অবশ্য অনেক ছবি এঁকেছিলেন। তার সামান্য অংশই এখন অবশিষ্ট আছে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার আগুনে তাঁর মেয়ের বাড়িতে নষ্ট হয়েছে অজস্র ছবি। জাহাজডুবিতেও হারিয়ে গেছে অনেক। এই তথ্য চণ্ডী লাহিড়ি জানিয়েছেন গগনেন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তাঁর বইতে। এখন যা অবশিষ্ট আছে, উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তাও খুব ভাল অবস্থায় নেই।
১৯০৫ সাল থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে চাইনিজ ইঙ্কে তিনি কিছু কাকের ছবি আঁকেন। জাপানি কালি-তুলির ছাপ ছিল এতে। ১৯০২ সালে জাপানি মনীষী ওকাকুরা এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন তিন জন শিল্পী তাইকান, কাৎসুতা ও হিশিদা শুনসো। তাঁদের সংস্পর্শে এসে গগনেন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হন জাপানি আঙ্গিকের প্রতি। তাঁর জাপানি আঙ্গিকের আঁকার অনবদ্য প্রকাশ দেখা যায় ১৯১১ সালে আঁকা বাঁশপাতার ছবিতে।
১৯১১-১২ সালে আঁকা ‘জীবনস্মৃতি’-র সচিত্রকরণের ছবি গগনেন্দ্রনাথের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। গ্রন্থচিত্রণের একটি আদর্শ যেমন তৈরি হয়েছে এই ছবিতে তেমন বর্ণের বিরলতায় অন্তর্দীপ্ত গভীর অনুভবের উৎসারণও ঘটেছে এর মধ্যে। পুরাণকল্পকে গগনেন্দ্রনাথ কেমন করে ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ করেছেন, তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন ১৯১২-১৩ সালের ‘চৈতন্য-র স্বর্গীয় প্রেমের প্রথম অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক ছবিটি। পাশ্চাত্য প্রতিচ্ছায়াবাদী রীতি, জাপানি কালি-তুলির পদ্ধতি ও দেশীয় প্রথাগত চিত্ররীতির অসামান্য সংশ্লেষ ঘটেছে এই ছবিতে। এই সংশ্লেষ পদ্ধতির ভিতর দিয়েই গগনেন্দ্রনাথ আমাদের আধুনিকতায় নতুন উত্তরণ এনেছেন, যার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমরা দেখি তাঁর তথাকথিত ঘনকবাদী ছবিতে।
এখানে কিউবিজমের সরাসরি প্রভাব কতটা, সে বিষয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু এই জ্যামিতিক বিন্যাসে যে অন্তর্লীন রহস্যময়তা, সেখানেই গগনেন্দ্রনাথ তাঁর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনন্য। এরই বিপরীত প্রান্তে রয়েছে কার্টুনের মধ্যে তাঁর প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত শিল্পসম্ভার নিয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ হল, আর শিবকুমার রচিত পেইন্টিংস অব গগনেন্দ্রনাথ টেগোর বইটি।
শিল্পীর শিল্পসম্ভার নিয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রামাণিক গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে শিবকুমার প্রথমেই তাঁর সমস্যার কথা জানিয়েছেন। অধিকাংশ ছবিতে তারিখ নেই, কোথায় আঁকা হয়েছিল তা ঠিক করে জানবার উপায় নেই, অনেক ছবির হদিশ পাওয়া যায় না, অনেক ছবি কলকাতার দাঙ্গায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তিনটি ‘সিরিজ়’ ছাড়া অন্য ছবিগুলি কোনও ধরাবাঁধা রীতিতে আঁকা নয় ও একই সময়ে বিভিন্ন ধরনের ছবি আঁকতেন বলে তাঁর শিল্পরীতি বা শিল্পীসত্তার ক্রমবিবর্তনের কোনও বিবরণ দেওয়া কঠিন। অগত্যা শিবকুমারও তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসরণে নিজের মতো করে গগনেন্দ্রনাথের শিল্পকৃতিকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করেছেন।
প্রথমে ‘দ্য ওয়ার্লড অ্যারাউন্ড’। শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশের ঢের আগে থেকেই গগনেন্দ্রনাথের শিল্পজীবনের সূচনা। ছোটবেলায় বাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী পাশ্চাত্য রীতিতে ছবি আঁকার পাঠ নিয়েছেন। তাঁর কন্যা লিখেছেন, তেলরঙের কিছু ছবিও এঁকেছিলেন এই পর্বে— যদিও তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। অমৃতসর, লখনউ, পটনা থেকে ছবির ব্যবসায়ীদের আনা পাহাড়ি, মুঘল ও রাজস্থানি ছবির পসরা থেকে বেছে বেছে ছবি সংগ্রহ করেছেন, দক্ষিণের বারান্দায় আগন্তুক দেশি ও নামী জাপানি শিল্পীদের ছবি আঁকার বিশেষ ধরন মন দিয়ে লক্ষ করেছেন, বিদেশি শিল্পের অজস্র বই কিনেছেন, আবার পাশের আরামকেদারায় বসে কনিষ্ঠ ভ্রাতা অবনীন্দ্রনাথের শিল্পী হিসাবে পরিণত হয়ে ওঠা প্রত্যক্ষ করেছেন। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে পিতৃহারা হয়ে অগ্রজের দায়দায়িত্বও ধীরে ধীরে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাই বলে পারিবারিক রেওয়াজ অনুযায়ী পাশ্চাত্য ও রাগসঙ্গীত, নাট্যাভিনয় বা সাহিত্যের তালিমে ছেদ পড়েনি। দামি ক্যামেরা কিনে ফটো তুলেছেন বিপুল উৎসাহে, এমনকি ডার্করুম তৈরি করে ফিল্ম ডেভেলপ ও প্রিন্ট করার কায়দাও রপ্ত করেছেন। নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে মঞ্চসজ্জা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। দক্ষিণের বারান্দায় দেশি-বিদেশি জ্ঞানীগুণীদের নক্ষত্রসমাগমে সিস্টার নিবেদিতা, আনন্দ কুমারস্বামী, ওকাকুরা, রোদেনস্টাইন, ভিক্টর গোলব্যু, কাউন্ট কাইজ়ারলিং, স্টেলা ক্রামরিশের মতো মানুষকে আতিথ্য দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় ঋদ্ধ হয়েছেন। তবু ইউরোপীয়, দূরপ্রাচ্য ও ভারতের প্রাচীন যুগ থেকে সমসাময়িক শিল্পকলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত হলেও নিজে তুলি ধরতে অনেক সময় নিয়েছেন।
তবে ছবি যে আঁকতেন না তা নয়, খাতা পেন্সিল পাশে রাখা থাকত, যাঁরাই দক্ষিণের বারান্দায় কাজে-অকাজে আসতেন তাঁদের কৌতুককর ভাবসাব দেখে চুপচাপ স্কেচ করে নিতেন। জুরি হয়ে আদালতে উপস্থিত লোকজনের নানা মজাদার অভিব্যক্তি টুক করে এঁকে রাখতেন। আরও অনেকের মতো শিবকুমারেরও মনে হয়েছে যে ১৯০৫-এ জ্যেষ্ঠপুত্র গেহেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুর গভীর শোকাঘাত যখন তাঁকে অন্তর্মুখী করে দেয়, তখন ক্ষেত্রনাথ শ্রীমানির কথকতা ও শিবু কীর্তনিয়ার কীর্তনগান তাঁর চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনে। কালি কলম ও রংতুলির মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ থেকে তাঁর শিল্পীজীবনের প্রকৃত সূত্রপাত হয়। ১৯১০ সালে যখন রথীন্দ্রনাথ আমেরিকা থেকে পাঠ নিয়ে জোড়াসাঁকোয় ফিরেছেন তখনও গগনদাদাকে ‘মাঝে মাঝে ছবি আঁকতে’ দেখেছেন, নিয়মিত অনুশীলন করতে দেখেননি। পুরীর সমুদ্রতীরে নিজের ডিজ়াইন করা বাড়ি ‘পাথারপুরী’তে বসবাস করার সময় অনেক ছবি এঁকেছেন। তার অধিকাংশই মন্দিরে যাতায়াতের পথে দেখা পান্ডা, পুণ্যার্থীর সঙ্গে পুরীর মন্দির ও কোণারকের নানা খণ্ডচিত্র। ১৯১১ সালের ঘটনাবহুল দিনগুলির মাঝে এক দিকে তাঁর প্রধান অবলম্বন মায়ের মৃত্যু, অন্য দিকে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। ওই বছরে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’র কিস্তিগুলি প্রকাশিত হয়। পরে যখন তা বইয়ের আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা হয় তখন কবি গগনকে তার জন্য কিছু ছবি আঁকার ভার দেন। ১৯১২ সালে যখন গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ছবি-সহ ‘জীবনস্মৃতি’র প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হল তা বিদ্বজ্জন মহলে সাড়া জাগায়।
দ্বিতীয় অধ্যায় ‘সিন অ্যান্ড ইমাজিনড ল্যান্ডস্কেপস’ ও তৃতীয় অধ্যায়, ‘পুরী অ্যান্ড নকচার্নাল্স’ সময়, বিষয়বস্তু ও শিল্পরীতির বিচারে প্রথম অধ্যায়ের সঙ্গেই আলোচিত হতে পারে। তৃতীয় অধ্যায়ে রাঁচি, বেনারস, শান্তিনিকেতন, দার্জিলিং ও জোড়াসাঁকোর ছবিও আছে, আর সব দৃশ্যগুলি যে নৈশ দৃশ্য তাও নয়। কিছু ছবির উল্লেখ সমসাময়িক লেখা বা চিঠিতে পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্ধকারে হাতড়াতে হয়।
চতুর্থ অধ্যায়, ‘চৈতন্য অ্যান্ড আদার ন্যারেটিভস’-এর মুখ্য বিষয় চৈতন্যজীবনের নানা পর্যায়ের ছবি। ১৯১২-১৩ সালে আঁকা ছবিগুলি তাঁর শিল্পী-জীবনে ধর্মীয় বিষয়ের একমাত্র সিরিজ়। ১৯১৪ সালে প্যারিস ও লন্ডনে ‘দ্য নিউ ক্যালকাটা স্কুল’ প্রদর্শনীতে এই সিরিজ়ের সব ছবি ছিল। ছবিগুলি ওরিয়েন্টাল সোসাইটির প্রদর্শনীতে দেখানো হলে দর্শকমহলে সাড়া পড়ে যায়।
পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক গগনেন্দ্রনাথের শিল্পপ্রতিভার এক ভিন্নধর্মী অভিমুখ নিয়ে আলোচনা করেছেন, নাম দিয়েছেন ‘বিজ়ার ট্রুথ’, বিচিত্র সত্য। গগনেন্দ্রনাথের স্বল্প ও মৃদুভাষী, শান্ত ও আপাতগম্ভীর অভিব্যক্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকত একজন অন্য মানুষ, যাঁর সমাজের বৈষম্য, অনাচার নিয়ে অসন্তোষ, বিদেশি শাসকশ্রেণির পদলেহনকারী অভিজাত সমাজের প্রতি ঘৃণা, স্বাধীনতাকামীদের প্রতি সহানুভূতি, আর ছিল গভীর রসবোধ। কিন্তু উচ্চকণ্ঠে রোষ প্রকট করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ, তাই আশ্রয় নিয়েছিলেন কার্টুনের। রঙে, রেখায়, তুলির আঁচড়ে কষাঘাতের এই উপায় অবলম্বন করে তিনি রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিলেন। ১৯১৭ সালে পর পর দু’টি বড় পোর্টফোলিয়ো প্রকাশ করেন: ‘বিরূপ বজ্র’ ও ‘অদ্ভুতলোক’। তৃতীয় ‘নবহুল্লোড়’ প্রকাশিত হয় ১৯২১-এ। এগুলি কৌতুকচিত্র নয়, কিছু সমসাময়িক ঘটনাবলির উপর তির্যক কষাঘাত, আবার জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের যুগান্তকারী আবিষ্কারের উপর কৌতুক-মেশানো মন্তব্য। শিবকুমার তাঁর সংক্ষিপ্ত লেখায় জানিয়েছেন, শিল্পী কত অনায়াসে বিদেশি স্যাটায়ার বা নামী জাপানি ও ইউরোপীয় চিত্রকরদের ভাবধারায় নিজস্ব ভাষায় ও শৈলীতে এগুলি নির্মাণ করেন। একশো বছর পরেও এর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যায়নি।
১৯১৫ সাল থেকে প্রায় নিয়মিত গরমের মাসগুলি গগনেন্দ্রনাথ সপরিবার দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কিংবা মুসৌরি ভ্রমণে যেতেন। ষষ্ঠ অধ্যায়ে লেখক এই সময়কার ছবিগুলি নিয়ে লিখেছেন: ‘অ্যান এনগেজ়মেন্ট উইথ দ্য মাউন্টেনস’। কয়েকটি তারিখযুক্ত ছবি দেখে জানা যায়, শেষ বার ১৯২৮ সালে অর্থাৎ আকস্মিক অসুস্থতার জন্য ছবি আঁকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মাত্র দু’বছর আগেও তিনি পাহাড় ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এই পর্বের অধিকাংশ ছবির বিষয়বস্তু হল পাহাড়। দিগন্তবিস্তারী হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গের বিশালত্ব, নৈঃশব্দ্য, ব্যাপ্তি আর রোদ, মেঘ, কুয়াশা, রাতের মায়াবী অন্ধকার, সূর্য ওঠার বা পাটে যাওয়ার আগের মুহূর্তগুলির বর্ণালী সমাবেশ তাঁকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
সপ্তম অধ্যায় ‘কিউবিস্ট ভিশনস’-এ লেখক শিল্পীর কিউবিজ়ম নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে আঁকা ছবির আলোচনা করেছেন। আধুনিক শিল্পী হিসাবে গগনেন্দ্রনাথের পরিচিতি মূলত এই পর্বের ছবির জন্য। ১৯২১ সালের কোনও সময় তিনি এই ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২২-এর এক প্রদর্শনীতে কয়েকটি ছবি দেখানো হয় ও ওই বছরেই ‘রূপম’ পত্রিকায় স্টেলা ক্রামরিশের নিবন্ধ ‘অ্যান ইন্ডিয়ান কিউবিস্ট’ প্রকাশিত হয়। আলো ও রঙের ব্যবহারে ছবির বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তোলা, ছবির মুখ্য বিষয়বস্তু বা পাত্রপাত্রীর দিকে দর্শকের দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিউবিস্ট শিল্পীদের কাজ দেখে তিনি অনুভব করেছিলেন তাঁর চিন্তাভাবনাকে কী ভাবে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত করা যায়। শিবকুমার মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, গগনেন্দ্রনাথ এই সময় ক্যালাইডোস্কোপের মতো একটা খেলনা কিনে এনে তাতে চোখ লাগিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাচের টুকরো থেকে বিচ্ছুরিত রামধনুর মতো নানা রঙের ছটা দেখার পর ছবিতে সেই রকম বর্ণচ্ছটা ফুটিয়ে তুলতেন। স্থাপত্যবিদ্যা, ফটোগ্রাফি ও মঞ্চসজ্জায় তাঁর গভীর জ্ঞান থাকায় রঙের সমাহারে ছবিগুলি নতুন মাত্রা পেত। তবে শিবকুমার যেমন বলেছেন, দেল্যনের মতো পাশ্চাত্য শিল্পীদের কাজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল, তাঁদের রঙের ব্যবহার তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারণার উপর ছায়া ফেলতেই পারে।
বইয়ের শেষ অধ্যায়, ‘টুওয়ার্ডস আ সায়লেন্ট ডার্কনেস’। সারা জীবন সংসারের সব রকম সমস্যা, শোক, দায়দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করতেন, মনের গভীরের ব্যথাবেদনার বহিঃপ্রকাশ দেখা যেত না, কখনও কথক ঠাকুরের পাঠ, কীর্তনিয়াদের ভক্তিগান, কখনও পুরীর মন্দির, অন্তহীন সমুদ্র, কখনও হিমালয়ের বিশালতার মধ্যে নিজেকে ভুলিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে এঁকে চলেছেন নানা ধরনের প্রতিকৃতি, নিসর্গদৃশ্য, ব্যঙ্গচিত্র আর ছবি, কখনও কালো-সাদায় আর কখনও বা রঙের মালা গেঁথে। শিল্পীজীবনের শেষ ক’টি বছরে নেমেছিলেন নতুন পরীক্ষায়। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন স্ত্রী প্রমোদকুমারীর অসুস্থতা তাঁকে বেশ অসহায় করে দেয়। কিউবিস্ট পর্বের বেশ কিছু ছবিতে শোক, শূন্যতা কিংবা মৃত্যুর ছায়া সুস্পষ্ট। এই পর্বে আর যাদের দেখা মেলে তারা হল নারী— তাদের হাতে কখনও প্রদীপ, কখনও শিশুদের নিয়ে আহ্লাদিত, কিংবা কথাবার্তায় মগ্ন, কখনও আকাশের তারায় নিমগ্ন দৃষ্টি— নীরবে, নিভৃতে, নিঃশব্দে। এর পরেই আকস্মিক ভাবে তাঁর জীবনে অন্ধকার নেমে আসে, পক্ষাঘাতে বাক রুদ্ধ হয়ে যায়, ছবি আঁকার হাতও অকেজো হয়ে যায়।
এতো গেল তাঁর শিল্পী জীবন, তাঁর সৃষ্টির আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু তাঁর নিজের জীবন! এগিয়ে যাওয়া যাক আরও আগে।
১৯০৫ সাল।
মুখ নিচু করে বসে আছেন গগনেন্দ্র। দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁর আদরের গুপু আর নেই। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। কিন্তু সে-ই আবার পরবর্তী সময়ের কক্ষপথের নিয়ন্ত্রা। দুঃসহ শোকের মধ্যে কক্ষপথ লেখা হয়ে গেল গগনেরও।
প্রতি বছর গরম পড়তেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার চল ছিল। থাকা হত তিন-চার মাস। প্লেগ থেকে বাঁচতে খোলামোলা জায়গায় যাওয়া।
সে বারও ব্যতিক্রম হয়নি।
গগন ঠাকুর সপরিবার উঠে এলেন সার্কুলার রোডের এক বাড়িতে। ওই ক’টা দিন ঠাকুরবাড়ি ঝেড়ে-মুছে, ভাঙাচোরা সারাই করে, দরজা-জানালার বাইরে রঙের পোঁচ পড়বে। কিন্তু নতুন বাড়িতে এক তালাবন্ধ ঘর নিয়ে ছিল রহস্য।
অত বড় বাড়িতে জায়গার অভাব নেই। কিন্তু একটা ঘর তালাবন্ধ। বাড়িওয়ালা বাইরে থাকেন, ভাড়া দেওয়ার আগে পইপই করে বললেন ও ঘর না খুলতে। কারণ জানালেন না। পরে লোকমুখে শোনা গেল, সেই ঘরে নাকি বাড়িওয়ালার ছেলে মারা গিয়েছে। ও ঘরে ভূতের বাস।
এত বলা সত্ত্বেও কেমন করে যেন সে ঘরের তালা খুলে গেল। অবনের মেয়ে-জামাই নেলি আর নির্মল থাকতে এলেন সে বার। গগনের স্ত্রী প্রমোদকুমারী বরাবরই ডাকাবুকো। তাঁর ভয়ডর কম। তিনি দিলেন তালা খুলে। রাতবিরেতে শব্দ শোনা, হাওয়া ছাড়াই বারান্দায় কাপড় ওড়ার মতো ঘটনা ছাড়া ভূতের উপদ্রব তেমন একটা জমল না।
তবে গগনের ছেলে গেহেন্দ্র পড়লেন কঠিন অসুখে। জ্বর দেখে ডাক্তার জানালেন— টাইফয়েড।
সে অসুখ আর সারল না।
সে বার সকলে গ্রীষ্ম ঋতু শেষ হওয়ার আগেই জোড়াসাঁকো ফিরলেন। ফিরলেন না শুধু গেহেন্দ্র।
মুখ কালো করে আঁধার নামল ঠাকুরবাড়িতে। গগনের দিকে চোখ তুলে তাকানো যায় না। বছরখানেক আগেই ধুমধাম করে ষোলো বছরের ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। নববধূর গা থেকে খসে পড়ল সাধের গয়না।
গেহেন্দ্রনাথের মৃত্যু গগনেন্দ্রনাথকে পাথর করে দিল।
দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। তিনি গগন ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র কনককে পড়াতেন। গগনও তাঁকে ভরসা করতেন।
ও দিকে গেহেন্দ্রশোকে গগন শান্তি পান না। একদিন দীনেশকে ডেকে বললেন, ‘‘এ ভাবে থাকিলে আমি পাগল হইয়া যাইব। আপনি কি বলিতে পারেন কি করিলে আমি শান্তি পাইব?’’ দীনেশচন্দ্র ক্ষেত্র চূড়ামণিকে নিয়ে এলেন ঠাকুরবাড়িতে। গগনকে কথকতা শুনিয়ে তাঁর মন শান্ত করার অভিপ্রায়ে। মৃত্যুশোক ফিকে করে ক্রমশ কথকতা এগোল রামায়ণ থেকে মহাভারত, মহাভারত থেকে ভাগবতের পাতায়। কথকতার আসর যত জমল, গগনের মনের বিষাদকালো জমাট অন্ধকার ততই আলো হয়ে প্রকাশ পেল তাঁর ছবির খাতায়।
গগনেন্দ্র কখন যেন হাতে তুলে নিলেন কাগজ-পেনসিল-কালি। ফুটে উঠল ক্ষেত্র কথকের নানা মুহূর্তের অবয়ব। এর মধ্যে আবার কথকতার একঘেয়েমি কাটাতে রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়া থেকে পাঠালেন শিবু কীর্তনিয়াকে। জমে উঠল আসর। গগন এঁকে চললেন। কখনও শিবু, কখনও ক্ষেত্র, কখনও ঠাকুর-পরিবারে আশ্রিত বন্ধু ডাকবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মতিবাবু। বাদ পড়েননি খোদ দীনেশচন্দ্রও। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় দীনেশচন্দ্র লিখছেন, ‘‘গগনবাবু উপাখ্যানভাগ ও কীর্তনের ভক্তিরস সকলের সঙ্গে উপভোগ করিতেছিলেন। কিন্তু তাঁহার হাতের পেন্সিলটি একদিনের জন্যও বিরাম পায় না...’’
সন্তানের মৃত্যু দেখার চেয়ে বড় শোক আর হয় না। কিন্তু দিনের শেষে জীবন সত্য। বেঁচে থাকাটুকুই জীবন। সন্তানশোক ভুলে জীবনে ফেরায় গগনের আশ্রয় হল ছবি আঁকা।
সেন্ট জ়েভিয়ার্সে পড়ার সময়ে গগনেন্দ্রর ছবি আঁকার হাতেখড়ি। শোনা যায়, সে সময়ে আর পাঁচটা বাড়ির ছেলের মতোই গগন স্কুলে যেতেন। বাবা গুণেন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল, ছেলে সাধারণের মতো মানুষ হবে। গগনকে তিনি ঠাকুরবাড়ির সব রকমের বিলাসিতা থেকে দূরে রেখেছিলেন।
জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়িতে জন্মেছিলেন গগনেন্দ্র। গুণেন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান যখন ছেলে হল, দাই বেশ ভাল রকমের বকশিশ পেলেন। সঙ্গে সোনাদানাও। তবে যখন সতেরো বছর বয়সে গগনের বিয়ে হল প্রমোদকুমারীর সঙ্গে, তখন কোনও ধুম হয়নি। তার মাত্র তিন বছর আগেই যে পিতাকে হারিয়েছেন গগন। উৎসব করতে কারও মন চায়নি।
বালক গগনের উপরে দায়িত্ব পড়ল সংসার দেখভালের। পড়াশোনা আর শেষ করা সম্ভব হয়েছিল কি না, সে প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল। এক দিকে জমিদারি সামলানো, অন্য দিকে বিধবা মা সৌদামিনীর দেখাশোনা, ছোট ভাই-বোনের জন্য অভিভাবকত্ব, পাশাপাশি শিল্পীসত্তার মন-উচাটন।
সব দিক সামলে গগন স্থির করলেন শিল্পী যদি হতেই হয়, সঙ্গীতশিল্পী হবেন। সাহেব মাস্টার রেখে পিয়ানো বাজানো শিখলেন। নিজের ছেলেদের সঙ্গীতশিক্ষায় কোনও ক্রুটি রাখলেন না। যখন-তখন কিনে আনতেন মজার সব বাদ্যযন্ত্র, সুর নিয়ে চলত এক্সপেরিমেন্ট।
তখনও গগন জানেন না কয়েক বছর পরে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে জাপানি ব্যক্তিত্ব কাকুসো ওকাকুরার। দেশীয় অঙ্কনশিল্পের ইতিহাসে গগন ঠাকুরের নাম লেখা হয়ে যাবে ব্যতিক্রমী বিশ্বজনীনতায়। নিয়তির এঁকে দেওয়া কক্ষপথ তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে ভিনদেশীয় কিউবিক রীতির শিল্পচর্চায়।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘শুরু’ ব্যঙ্গচিত্র দিয়ে। তার নেপথ্যেও অবশ্য রঙিন গল্প রয়েছে। হাইকোর্টে জুরির কাজে প্রায়শ বসতে হত তাঁকে। বিচারকার্যের নোট নিতেন গগন। হাতে থাকত খাতা-পেনসিল। বিচারকের হাতুড়ি ঠোকা, সওয়াল-জবাব, উকিলের আনাগোনা— সবের মধ্যেই দেখা যেত, গগন মাথা নিচু করে মন দিয়ে নোট নিচ্ছেন। আদতে সে সময়ে তিনি পোর্ট্রেট আকঁতেন। উকিল, বিচারক, শ্রোতাদের চেহারার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসত বিভিন্ন চরিত্র।
আর তাঁকে দেখে লোকজন ভাবতেন— আহা! কী মন দিয়েই না কাজ করছেন গগন ঠাকুর!
কাজটা অবশ্য বরাবর মন দিয়েই করতেন তিনি। পরে যখন ব্যঙ্গচিত্রের তিনখানা বই ‘অদ্ভুত লোক’, ‘বিরূপ বজ্র’ আর ‘নব হুল্লোড়’ প্রকাশ করলেন, তাতে এই অগণন পোর্ট্রেট আঁকার অনুশীলন কাজে লেগেছিল।
রবীন্দ্রনাথ আরামকেদারায় বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছেন, এ ছবিও এঁকেছেন গগন। তাঁর ব্যঙ্গরেখা নির্মিত পোর্ট্রেটের কোপ থেকে বাদ যাননি জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মহাত্মা গাঁধী— কেউ-ই।
মাঝে কিছু দিন ফোটোগ্রাফি চর্চা চলল। কিনে আনলেন ক্যামেরা। কালো কাপড়ে মুখ-মাথা ঢেকে, বিরাট স্ট্যান্ডে রেখে চলল ছবি তোলা। এর ফাঁকে তেল রঙেও কিছু ছবি আঁকলেন। জমল না।
কোনও উস্তাদ হাতে ধরে তাঁকে ছবি আঁকা শেখাননি কখনও। তবে গগনের দেখার চোখ ছিল। আর ছিল শিল্পের সূক্ষ্ম বোধ। কখনও সে শিল্পবোধ ধরা দিল তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে, কখনও নাটকের মঞ্চসজ্জায়, কখনও পুরী-রাঁচি-দার্জিলিং সিরিজ়ের চিত্রে।
গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্র, সমরেন্দ্র। গুণেন্দ্রনাথের তিন ছেলেই ঠাকুরবাড়ির শিল্পময় লগ্নে জন্ম নেন। বাড়ির পরিবেশ, রবিকাকার সান্নিধ্য এ সব তো ছিলই। সঙ্গে ছিল শিল্পভাবনার উৎকৃষ্ট মন। শিল্পভাবনার পাশাপাশি স্ত্রী প্রমোদকুমারীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করেছেন গগন। প্রমোদও শিল্পভোলা মানুষটিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। দক্ষিণের বারান্দায় বসে দিনের পর দিন যখন ছবি এঁকেছেন গগন, যাবতীয় দায়িত্ব সেরে নিঃশব্দে এসে বসেছেন স্বামীর পাশে, তাঁর আঁকার পাশে। মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাননি।
এক বার বিকেলের দিকে ছবি আঁকতে বসলেন গগন। কখন যেন দক্ষিণের বারান্দা জুড়ে সন্ধে নেমে এসেছে। তিনি ছবির নির্মাণে এতটাই মগ্ন, সে দিকে খেয়াল নেই। কাঠের গোল সিঁড়ি দিয়ে দোতলার বারান্দায় নেমে এলেন প্রমোদকুমারী। অন্ধকারে দু’হাত দূরে কিছু দেখা যায় না— অথচ অন্ধকারে বসে গগনেন্দ্র কী যেন এঁকেই চলেছেন। প্রমোদ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, এই অন্ধকারে তিনি দেখতে পাচ্ছেন কী করে! সে শব্দে গগন চমকে মাথা তুলে তাকান। পরক্ষণেই ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘কই, কিছুই তো দেখতে পাইনি।’’
ছবি ঘিরে ভাব-তন্ময়তায় এক নিজস্ব গণ্ডি তৈরি করে নিয়েছিলেন গগন ঠাকুর। সেখানে গনগনে গ্রীষ্মের রোদ, বাড়ির কচিকাঁচাদের চিৎকার, সূর্যের ঢলে পড়া বা সাংসারিক শোক-তাপ তাঁকে স্পর্শ করত না। সকল শিল্পবিঘ্ন ঘটানোর ষড়যন্ত্র পরাস্ত হত গগনের শিল্পীমনের দুয়ারে এসে।
অবন-গগন পাশাপাশি বসে দক্ষিণের বারান্দায় বহু ছবি এঁকেছেন। সে সব লিখতে বসলে একটা মহাকাব্য রচনা হয়ে যায়। তবে ছবির স্ট্রোকের ঘোরে গগনের সাদা-পাজামায় অবনের তুলি থেকে কালো রং ছেটানোর গল্পটি না বললেই নয়। মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘গগনেন্দ্রনাথ’-এ তাঁর দাদামশাইয়ের স্মৃতিচারণকালে জানা যায়, অবনের ছবি আঁকার সময়ে ধ্যানভঙ্গ করবেন না বলে গগন নিঃশব্দে রং-ভরা পোশাক বদলে এসেছেন। কিন্তু ভাইকে চিত্র সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে বিচ্যুত করেননি। শিল্পীমনই জানে অপর শিল্পীমনের প্রসবকালীন বেদনা।
গগন-অবন দু’জনেই মায়ের কাছছাড়া হতেন না বড় একটা। জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে নড়ানো যেত না গগনকে। রবীন্দ্রনাথ বহু বার চেয়েছেন গগনেন্দ্রকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে বিদেশি রীতির স্থাপত্য-চারুশিল্পে শিক্ষিত করতে। কিন্তু জোড়াসাঁকোর গলির বাইরে গগনকে পা রাখানোয় সমর্থ হননি রবিকাকা।
১৯১৬ সালের ৮ই অগস্ট। রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে গগনেন্দ্রকে লিখছেন— ‘‘গগন, তোমরা কবে ঘর থেকে একবার বিশ্বজগতে বেড়িয়ে পড়বে? তোমাকে তোমার নামের সার্থকতা করা উচিত। কিন্তু তোমাদের তাড়া দেওয়া মিথ্যে।’’
তার পরেই লিখছেন, ‘‘শেষ কালে অনেক ভেবেচিন্তে টাইক্কানের পরামর্শে আরাই নামক এক আর্টিষ্টকে তোমাদের ওখানে পাঠাচ্চি। এঁর ইচ্ছা বছরদুয়েক ভারতবর্ষে থেকে ভারতবর্ষীয় আর্ট চিনবেন এবং ভারতবর্ষীয় ছবি আঁকবেন। অন্তত ছমাস যদি ইনি আমাদের বাড়িতে থেকে তোমাদের শেখান তাহলে অনেক উপকার হবে। বাইরে থেকে একটা আঘাত পেলে আমাদের চেতনা বিশেষভাবে জেগে ওঠে— এই আর্টিষ্টের সংসর্গে অন্তত তোমাদের সেই উপকার হবে।’’
তাঁকে জাপান থেকে আঁকা শেখাতে আসবেন চিত্রশিল্পী। পাঠাবেন রবীন্দ্রনাথ। আঁকা শিখবেন গগনেন্দ্রনাথ। কিউবিজ়মে পারদর্শী হয়ে নিত্যনতুন রহস্য তৈরি করবেন। এত সহজ ছিল না গগনের চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার কক্ষপথ। ওকাকুরার সান্নিধ্য, রবিকাকার পাঠানো বিভিন্ন বিদেশি আর্টের বইপত্তর, ছবি দেখার অভ্যেস, কিংবা জাপানি শিল্পীর আঁকা কিউবিক আর্টের সঙ্গে পরিচয়— সবই ঘটেছে অনেক পরে।
তার অনেক আগে গগনেন্দ্র দক্ষিণের বারান্দায় বসে বিকেলে চা-পাউরুটি খেতে খেতে কার্নিশে পাউরুটি ছড়িয়ে দিতেন। কাকেরা আসত তা খেতে। তাদের বসে থাকা, হাঁটাচলা, ঘাড় ঘোরানোর মুখভঙ্গি, খুঁটে খাওয়া নিবিষ্ট হয়ে দেখেছেন শিল্পী। কালির টানে একের পর এক ফুটিয়ে তুলেছেন কাকের ছবি। ছোটরা কেউ কাকের কাছে যেতে গেলে গগন তাদের বলতেন— ‘‘এই কাছে যাস নে। ওরা এখন ছবি আঁকাচ্ছে।’’
কুড়ির দশকের প্রথম দিকে গগনেন্দ্র ‘কিউবিক’ অর্থাৎ জ্যামিতিক চিত্রাঙ্কন শুরু করেন। তাঁর ফ্যান্টাসি চিত্রনির্মাণের উৎস এই কিউবিজ়ম। নিজের কল্পনার সঙ্গে আন্দাজ মতো মেশালেন এই রীতিকে। ত্রিভুজ, বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত বা ‘কোন’ অবলম্বনে গবেষণা শুরু করলেন।
সে সময়ে ইউরোপে কিউবিজ়ম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। গগনও লেগে রয়েছেন নিজের মতো করে। আলো-আঁধারি আর রহস্যে মোড়া রঙের খেলায় তাঁর ছবি সে ধারাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত করল। এ ছবি অনেকটাই অন্য রকম।
গগনেন্দ্রর কিউবিজ়ম ধারার প্রথম পর্যায়ের কয়েকটি ছবি ‘রূপম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। স্টেলা ক্র্যামরিসের একটি প্রবন্ধের সঙ্গে সেগুলি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রকাশ পেলেও চিত্রকরের নামের উল্লেখ ছিল না। ‘অ্যান ইন্ডিয়ান কিউবিস্ট’ হিসেবে সেই প্রবন্ধে স্টেলা যে গগনেন্দ্রকে উল্লেখ করেছিলেন, তা অনেক পরে জানা যায়। ‘রূপম’ সম্পাদক জানিয়েছিলেন আলোচ্য শিল্পী স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রবন্ধের সঙ্গে মুদ্রিত কিউবিস্টিক চিত্রগুলি তাঁরই।
চট্টগ্রামের জমিদার যামিনীকান্ত সেনের সঙ্গে পাশ্চাত্যের শিল্পীদের ছবি নিয়ে গগনের অনেক কথা হত। যামিনী ছিলেন ভারতীয় চিরায়ত ও আধুনিক আর্টের সমঝদার। একই সঙ্গে তিনি গগাঁ, সেজান, রেনোঁয়া নির্মিত শিল্পের রসজ্ঞ। গগন সে সব শুনে বোঝার চেষ্টা করতেন। বইয়ের দোকান থেকে ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পীদের আঁকা ছবির বই কিনে নিয়ে এলেন। সঙ্গে এল শিল্পীদের সম্পর্কে লেখা বইও। দিন-রাত পড়াশোনায় ডুবলেন গগন। এই চর্চার ফলে শিল্পীমনে যে প্রতিফলন দেখা গেল, তা কাগজে চিত্রিত হয়ে রূপ নিল গগনেন্দ্রর কিউবিস্ট ধারার ছবি।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র প্রচ্ছদে থেকে গেল গগনের মনের সে নির্মাণ।
ক্যালাইডোস্কোপ বা প্রিজ়মের মধ্য দিয়ে শিল্পী যা দেখতেন, তাকে রঙে লেপে শরীর দিতেন গগন। যা দ্যুতিতে, বর্ণের বিচিত্র বিচ্ছুরণে কোনও এক ইন্দ্রলোকের সন্তান। ফ্যান্টাসি সেখানে একা নয়, পাশে হাত ধরে আছে রোম্যান্টিসিজ়মও। যেমন, ‘ড্রিমল্যান্ড’ ছবিটি। অর্ধগোলাকৃতি খিলানের নীচ দিয়ে আজব দেশের উদ্দেশে ভেসে চলেছে এক কাগজের নৌকা। তার উপরে ইন্দ্রধনুর মতো আলোর বিচ্ছুরণ। নৌকার ডান পাশের স্তম্ভটি নাট্যমঞ্চের দৃশ্যপটের এক ‘উইং’। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর পরীক্ষাগারে কর্মরত ছবি ‘ক্যাপটিভ লাইট’ এই ধারার ছবি বলে অনেকে মনে করেন।
রূপকথা ধরা দিয়েছিল তাঁর স্বতন্ত্র শিল্পচর্চার তুলিতে। কয়েকটি ছবিতে উপস্থাপনা আর কৌশলের গুণে এক অন্য জগতের ছবি তৈরি হয়েছে। চিত্র-বিশেষজ্ঞরা যাকে ‘ওয়ান্ডার ল্যান্ড’ বা আজব দেশের চিত্রকল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। সাদা আর হাল্কা নীল রঙের ঘোড়া ছুটিয়ে এসে অরণ্যের প্রান্তে থমকে দাঁড়িয়েছেন রূপকথার রাজপুত্র। তার সামনে এক জলাশয়। অরণ্যে নেমেছে জমাট অন্ধকার। পাতায় পাতায় প্রতিভাত হচ্ছে বৃত্তাকার বা অর্ধবৃত্তাকার দ্যুতিময় রঙিন ফানুস। দু’টি পেঁচা বৃক্ষকোটরে বসে রাজপুত্রকে লক্ষ করছে। তার হাতে তির-ধনুক, মাথায় মুকুট, অসিবন্ধে তরবারি। কিন্তু রাজপুত্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে জলাশয়ের দিকে।
ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী কিংবা রূপকথার রাজপুত্র। এ জগতের সন্ধান কালি-কলমে গগন-অবন ব্যতীত আর ক’জন শিল্পীই বা দিতে পেরেছেন এ ভাবে!
দিঘা-পুরী-দার্জিলিং, মানে দিপুদা। বাঙালির খিদে পেলে খায় মুড়ি আর ঘুরতে যায় দার্জিলিং, দিঘা আর পুরী। এ মজার ঠেসটি বহু দিন ধরেই প্রচলিত ঘরকুনো বাঙালিদের জন্য। গগন ঠাকুর কিন্তু দিঘাটিকে বাদ দিয়েও দার্জিলিং আর পুরী গিয়েছেন বহু বার। আর তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ছবিতে বারবার ধরা পড়েছে পুরীর সমুদ্র আর দার্জিলিঙের নিসর্গদৃশ্য। পাহাড়ের কোলে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ফুটিয়ে তোলার নেশায় তিনি কখনও সাদা-কালোকে মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন করেছেন, কখনও সোনালি কাগজে বর্ণের সমাবেশে জীবন্ত হয়েছে পর্বতশৈল।
মা সৌদামিনীর প্রায় শেষ বয়স, জগন্নাথ দর্শনের ইচ্ছে জানালেন। মায়ের ইচ্ছেয় পুরীতে সমুদ্রের ধারে বাড়ি তৈরি করে ফেললেন ছেলেরা। নাম পাথার পুরী। মাঝেমাঝেই আস্তানা গাড়তেন সেখানে। ভুবনেশ্বর মন্দির, পুরী মন্দির, কোনারকের মন্দির, তীর্থযাত্রীদের ভাবভঙ্গি... কোনও কিছুই বাদ পড়েনি গগনের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি থেকে। ছবিগুলি কোনওটি রঙিন, কোনওটি আঁকা হয়েছে সাদা-কালোর বুনটে।
পাণ্ডাদের ছবিও এঁকেছেন গগন। পুরী সিরিজ়ে পাণ্ডাদের ১৫টি ছবির নিদর্শন পাওয়া যায়। রাঁচি সিরিজ়ের ছবিতে ধরা পড়েছে বনজঙ্গল, গাছপালা, আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশু-সহ বাস্তব যাপনের ছবি।
দুর্গা বিসর্জনের রাতের মতো তাঁর চৈতন্য সিরিজ়ের ছবিও জগদ্বিখ্যাত। গগন ‘চৈতন্যদেবের মুত্যু’ নামে একটি ছবি আঁকেন, যেখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে শুধু চৈতন্যদেবের মুখটুকুই দেখা যায়। বাকি সব বিলীন হয়েছে সমুদ্রে। হাল্কা সবুজ রঙে আঁকা এই ছবিতে জাপানি রীতির প্রভাব স্পষ্ট। কুড়ির দশকে বিভিন্ন সময়ে চৈতন্য সিরিজ়ের এই ছবিগুলি ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টসে প্রদর্শিত হয়েছিল। বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রতিটি ছবির দাম রাখা হয় দুশো থেকে তিনশো টাকা।
গগন ঠাকুর যখন পুরীতে বসে ছবি আঁকছেন, তখন অবন ঠাকুরও তাঁর পাশে বসে তুলি-রং নিয়ে সৃষ্টির খেলায় মগ্ন। আর গগন সমুদ্রের সামনে বসে এঁকে চলেছেন সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়া নুলিয়ার শরীরের রং, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে আলোছায়ার ওঠাপড়া।
দার্জিলিঙেও তিনি সৃষ্টিশীল। শিল্পীমনের তুলি দিয়ে প্রকৃতির রং শুষে নিয়ে তাকে ছবিতে বুলিয়ে দেন গগন। মেয়ে সুজাতা বাবার কারসাজির বর্ণনা দিচ্ছেন তাঁর এক লেখায়, ‘‘দার্জিলিংয়ে দেখেছি বাবা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। শিল্পীর চোখে তিনি যা দেখেছিলেন, আমাদেরও তাই দেখতে শেখালেন। মহাদেব শুয়ে আছেন— নাক, মুখ, চোখের রেখা তখন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের চোখ ফুটিয়ে দিলেন, তাই, না হলে আগে শুধু বরফের পাহাড় বলেই দেখেছিলাম।’’
মানচিত্রের গণ্ডি না মানা শিল্পের নিজস্ব বিশ্বপরিসর তাঁকে সব সময়ে সত্যের পথ দেখিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার বিপ্লবীদের পাশে থেকেছেন নানা ভাবে। তাঁর কাছে আসতেন কারমাইকেল, রোনাল্ডসে, মন্টেগুর মতো শিল্প অনুরাগী সাহেবরা। অন্য দিকে, দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে গোপন কাজকর্ম আলোচনা করতে আসতেন বারীন ঘোষ, কানাইলাল দত্ত, নরেন গোঁসাইরা। গগনের অর্থসাহায্য পেতেন বিপ্লবীরা। কখনও অনুশীলন সমিতি বা যুগান্তর দলকে নতুন সাইকেল কিনে দিয়েছেন দ্রুত যোগাযোগের প্রয়োজনে। বিপ্লবীদের চাঁদা দিয়েছেন। এক বার বারীন ঘোষের ঠেকে তল্লাশি চালিয়ে মিলল বোমা বানানোর মশলাপাতি। সঙ্গে ওই সাইকেল। রাষ্ট্রচিহ্নিত ‘সন্ত্রাসবাদী’দের সঙ্গে সুসম্পর্কের প্রমাণ ইংরেজ পেলে তাঁর যে জেল হত, গগন তা জানতেন। কিন্তু তার পরেও তিনি নরেন গোঁসাই খুনের পিস্তল এক রাত নিজের কাছে রেখেছেন। নরেন ধরা পড়ার পরে পুলিশের কাছে খোচরবৃত্তি করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাইলেও আলিপুর জেলের মধ্যে তাঁকে খুন করেন বিপ্লবী কানাই আর সত্যেন।
কোনও মতে সে বার হাতকড়া পরা থেকে বাঁচলেন গগন। মা সৌদামিনীর পরামর্শে বাড়িতে পাহাড় করে জমিয়ে রাখা সমস্ত স্বদেশি বই আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বিলিতি পর্দা, বিলিতি আসবাব, বিলিতি তেল রঙের ছবি দূর করেছেন গগন। বদলে ঠাকুরবাড়িকে সাজিয়েছেন দেশীয় শিল্প-স্থাপত্যে। ‘বেঙ্গল হোম ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ে বাংলার কুটির শিল্পকে প্রাণ দিলেন। এক দিকে যখন লাট রোনাল্ডসে শিল্পী গগন ঠাকুরের শিল্প ভাবনায় মুগ্ধ হয়ে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস’-এর জন্য মাসিক সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করছেন, অন্য দিকে সোসাইটির সম্পাদক তথা প্রতিষ্ঠাতা গগনও স্থির করে ফেলেছেন ইংরেজ সরকারের তাবেদারি করবে না তাঁর শিল্পবোধপ্রসূত সংস্থাটি। লাটসাহেবও চিনতেন গগনকে। তিনি লিখলেন, ‘‘দি অ্যাকসেপ্টেন্স অব দিস গ্রান্ট বাই দ্য সোসাইটি নাইদার অফিশিয়াল ইনস্পেকশন নর কন্ট্রোল। দ্য স্কুল অব পেন্টিং ইজ় ইন নো সেন্স আ গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট।’’
এই রোনাল্ডসেই আবার আন্দামান জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বারীন ঘোষের রাজনৈতিক গতিবিধি জানতে শরণাপন্ন হলেন গগনেন্দ্রনাথের। অরবিন্দ ঘোষের অনুজ এই বিপ্লবী আর রোনাল্ডসের একদিন টানা দু’ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস ভবনে। বৈঠকের মধ্যস্থতাকারী গগন।
শোনা যায়, তখন ইংরেজদের দেওয়া ‘ব্ল্যাক আন্ড হোয়াইট ক্লাব’ নামের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। ওই ক্লাব গড়লেন কলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজ সাহেবরা। ভারতীয়দের দাক্ষিণ্য দেখিয়ে সাদা আর কালোয় ছাপা হল সভ্য কার্ড। ওই ক্লাবের সভ্য তিনিও। গগন রুখে দাঁড়ালেন। চলল প্রচার, আন্দোলন। শেষে সাহেবরা ওই নাম প্রত্যাহার করে নিল।
সেটিই এখন এ শহরের ‘ক্যালকাটা ক্লাব’। বাংলার বাবুদের বিত্ত হয়তো এ কালেও বজায় থাকত। তবে গগন ঠাকুর না থাকলে আত্মসম্মানটি থাকত না!
তত দিনে গগন ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের জোব্বা পোশাক পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। তত দিনে রবীন্দ্রনাথের নাটকে রাজার ভূমিকায় জমিয়ে অভিনয় করে গগন এমন মুগ্ধতা অর্জন করে ফেলেছেন রবিকাকার যে, তিনি গগনকে পার্ট দেবেন বলে ‘শারদোৎসব’ নাটকে নতুন করে রাজার চরিত্র জুড়ছেন। তত দিনে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে গগনকে চিঠি লিখছেন নিজের আঁকা ছবির বিষয়ে পরামর্শ করতে চেয়ে, ‘‘আমার ছবির নেশা আজও কাটল না। ...তোমরা কাছে থাকলে ভরসা পেতুম, কোন রাস্তায় চলছি সেটা তোমাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে পারতুম।’’
তত দিনে শিল্পীও বিছানা নিয়েছেন। আর আঁকতে পারেন না। ১৯৩০ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর থেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলেন। ওই অবস্থার মধ্যেও যামিনী রায়ের আঁকা ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন।
তার পরে একদিন দেহের বিচারে মারা গেলেন গগন। বেঁচে রইল তাঁর রং-তুলি আর নামের সার্থকতা।
রবীন্দ্রনাথ গগন-স্মরণে লিখলেন,
‘‘রেখার রঙে তীর হতে তীরে
ফিরেছিল তব মন
রূপের গভীরে হয়েছিল নিমগন।
গেলা চলি তব জীবনের তরী
রেখার সীমার পার,
অরূপ ছবির রহস্য মাঝে
অমল শুভ্রতার।’’
(তথ্যসূত্র:
১- ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
২- The Southern Veranda, Mohonlal Gangopadhyay, Indian Publishing House.
৩- পেন্টিংস অব গগনেন্দ্রনাথ টেগোর, আর শিবকুমার, প্রতিক্ষণ (২০১৯)।
৪- রূপদক্ষ গগনেন্দ্র, কমল সরকার।
৫- গগনেন্দ্রনাথ, মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৯ সাল।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩শে ডিসেম্বর ২০১৮ সাল।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই মার্চ ২০১৫ সাল।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১লা ডিসেম্বর ২০১৮ সাল।
১০- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে আগস্ট ২০১৯ সাল।
১১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯শে মে ২০১২ সাল।)
0 মন্তব্যসমূহ