সে ছিল তাঁর দ্বিতীয় বার কলকাতায় আসা। অচেনা শহর, কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন কিছুই জানা নেই। অগত্যা উঠলেন রাজভবনের বিপরীতে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। বিকেল কাটালেন থিয়েটার দেখে। এ সময়ে ওই হোটেলেই তাঁর পরিচয় হয় দৈনিক টেলিগ্রাফের সাংবাদিক জন এলারথ্রপের সঙ্গে। তিনি তখন থাকতেন সাহেবদের ডেরা বেঙ্গল ক্লাবে। গান্ধীজির সান্নিধ্য এলারথ্রপের ভাল লেগেছিল। তিনি তাঁকে বেঙ্গল ক্লাবে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। গান্ধীজিও না করতে পারেননি। যথাসময়ে হাজির হন সেখানে। কিন্তু বিধি-বাম। বেঙ্গল ক্লাব ড্রয়িংরুমে গান্ধীজিকে ঢুকতে দিল না। সে কালের ঐতিহ্যমণ্ডিত ইউরোপিয়ান ক্লাবের বসার ঘরে ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। অগত্যা এলানথ্রপ তাঁকে তার শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। লজ্জিত হলেন গান্ধীজির কাছে। স্থানীয় ইংরেজদের প্রতি এই বিরুদ্ধভাবের জন্য ক্ষমাও চাইলেন। কলকাতা শহরে গান্ধী-বিমুখতার প্রথম নজির। সময় যত গড়িয়েছে গান্ধীজির অনুরূপ অভিজ্ঞতার সংখ্যা মাত্রাহীন হয়েছে।
এসেছিলেন এ শহের দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে, সেখানকার ভারতীয়দের দুরবস্থার কথা সকলকে অবহিত করতে। কিন্তু এখানে বাধ সাধল, পরিচিতির অভাব। ঠিক করলেন বাংলার সর্বজনমান্য ব্যক্তিত্ব সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। এক দিন উপস্থিত হলেন তার ডেরায়। সুরেন্দ্রনাথ তখন বাংলার ডাকসাইটে নেতা। সর্বদা অনুগামী পরিবৃত। সবাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায়। তবু তারই মাঝে গান্ধীজি তাঁর আগমনের হেতু রাষ্ট্রগুরুর সমীপে পেশ করলেন। গান্ধীজির উদ্দেশ্যও তার বাস্তবায়ন সম্পর্কে রাষ্ট্রগুরু দ্বিধায় পড়লেন। জানালেন, তাঁর এ কাজে কলকাতাবাসী মনোযোগ দেবে বলে মনে হয় না। এখানে নানান ঝঞ্ঝাট। ওই বিষয়ে তবু সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। পরামর্শ দিলেন যোগাযোগ করতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের সঙ্গে ও রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় আর মহারাজ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। এরা উদার প্রকৃতির ও জনসেবামূলক কাজে উৎসাহী। অগত্যা এদের সবার সঙ্গেই গান্ধীজি দেখা করলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। তারা কেউ গা লাগালেন না। দু’জনেই বললেন, কলকাতায় জনসভার আয়োজন করা সহজ নয়। আর যদি কিছু করতেই হয়, তবে সুরেন্দ্রনাথের উপরে নির্ভর করেই করতে হবে। হতাশ হলেন ভবিষ্যতের জাতির জনক। ভুললে চলবে না, এ গান্ধী তখনও মহাত্মা নন। কেবলই মোহনদাস মাত্র।
কলকাতার নেতৃবৃন্দ তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল না। অগত্যা প্রাথমিক হতাশা কাটিয়ে তিনি এ বার হানা দিলেন শহরের পত্র-পত্রিকার অফিসগুলিতে। সে সময়ে কলকাতার দুই নামজাদা পত্রিকা অমৃতবাজার পত্রিকা আর বঙ্গবাসী। প্রথমে হাজির হলেন অমৃতবাজার দফতরে। সেখানে গিয়ে যার সঙ্গে কথা বললেন, তিনি গান্ধীজিকে ভবঘুরে ভাবলেন। ফলে কাজের কাজ কিছুই হল না। এর পরে বঙ্গবাসীর অফিসে গেলেন। সেখানেও নাকালের একশেষ হলেন। সম্পাদক তাঁকে বসিয়ে রাখলেন। গান্ধীজি অপেক্ষা করতে করতে দেখলেন, লোকে সম্পাদকের কাছে যাচ্ছে আর আসছে। কিন্তু তাঁর দিকে ফিরে তাকাবারও সময় নেই তাঁর। অগত্যা ঘণ্টা খানেক পর তিনি নিজেই সম্পাদকের কাছে গিয়ে তার নিজের কথা বলতে শুরু করলেন। এতে রুষ্ট সম্পাদক তাঁকে এক হাত নিলেন। বললেন—‘আপনি দেখছেন না, আমার হাতে কত কাজ আছে, আপনার মতে বহু লোক আমার কাছে আসে যায়। আপনি চলে যেতে পারেন। আমি আপনার কথা শুনতে পারব না’। এ শ্লেষ বাক্য গান্ধীজির মনে আঘাত হানল। দুঃখিত হলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সম্পাদকের অবস্থাও উপলব্ধি করলেন। বঙ্গবাসী কলকাতার নাম করা কাগজ। সেখানে আলোচ্য বিষয়ের অভাব নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার নাম তখনও এখানে কেউ শোনেনি। অগত্যা গান্ধী নিরস্ত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, যারা সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে, তারা নিজ নিজ দুঃখকেই বড় বলে মানে। প্রতি জম জন মনে করে সম্পাদকের মস্ত বড় একটা শক্তি আছে। কিন্তু সম্পাদকের কর্তৃত্ব তো তার অফিস ঘরের দরজার বাইরে এক পা-ও নয়।
খানিকটা হতাশ হলেও গান্ধীজি হাল ছাড়লেন না। ভুলে গেলে চলবে না, তিনি সহজে ভেঙে পড়ার লোক ছিলেন না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বার অন্য কাগজের দফতরে সম্পাদকদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করলেন। এমনকি ইংরেজ পরিচালিত সংবাদপত্র অফিসেও। সে সময়ে ‘স্টেটসম্যান’ ও ‘ইংলিশম্যান’ ছিল শহরের দুই বড় ইংরেজি সংবাদপত্র। গান্ধীজি তাদের দরজায়ও কড়া লাড়লেন। উভয় কাগজই দক্ষিণ আফ্রিকার গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। তারা গান্ধীজির বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে শুনলেন। স্টেটসম্যান কাগজের এক সাংবাদিক গান্ধীজির সাক্ষাৎকার নিলেন। ১১ই নভেম্বর, ১৮৯৬-এর কাগজে তা ছাপা হল— ‘Aggrieved Indians in South Africa/ Interview with Mr. M.K. Gandhi’ শিরোনামে। কলকাতার কাগজে প্রকাশিত এটা গান্ধীজির প্রথম সাক্ষাৎকার।
সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের উপর শ্বেতাঙ্গ অত্যাচারের প্রধান কারণ হিসেবে ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের বাণিজ্যিক হিংসাকেই দায়ী করেন। ভারতীয়দের শ্রমের উপর নির্ভর করেই ঔপনিবেশিকেরা সে দেশে যাবতীয় কর্মকাণ্ডও করে থাকে। কিন্তু সেই ভারতীয়রা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বাধীন উদ্যোগ শুরু করে ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের প্রতিযোগিতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, তখনই তাদের উপর ঔপনিবেশিক আইন খড়্গহস্ত হয়। নেমে আসে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের অসম্মান ও অমর্যাদার সুসংগঠিত সাঁড়াশি আক্রমণ। ঔপনিবেশিক আইনেও তার আঁচ লাগে।
সেই সময় ইংলিশম্যানের সম্পাদক সনডার্স সাহেবের সঙ্গে গান্ধীজির যখন পরিচয় হল, তিনি তাঁকে আপন করে নিলেন। তবে তার আগে কম জেরা করেননি। শেষে যখন বুঝলেন গান্ধী নিরপেক্ষ, দক্ষিণ আফ্রিকার শেতাঙ্গ স্বার্থও তিনি পক্ষপাতশূন্য দৃষ্টিতেই দেখছেন, তখন তার অফিস ব্যবহারের অনুমতিই শুধু দিলেন না, অবাধে তার কাগজখানাও যথেচ্ছ ব্যবহারে সম্মতি দিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের প্রতি বর্ণ বিদ্বেষ প্রসঙ্গে সনডার্স যে সব সম্পাদকীয় কলম লিখলেন, সেখানে প্রয়োজন মত কলম চালাতে গান্ধীজিকে অবাধ স্বাধীনতা দিলেন। ক্রমে অল্প কয়েক দিনেই উভয়ের মধ্যে ভাব জমে ওঠে, পরে গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গেলেও এ সম্পর্ক অটুট রয়ে যায়। কলকাতায় দেশীয় নেতৃবৃন্দ ও সংবাদপত্রের উপেক্ষার পাশে শ্বেতাঙ্গ কাগজের তরফে এ রূপ অপ্রত্যাশিত সাহায্য শহরে জনসভা করার গান্ধীজির প্রত্যাশাকে খানিকটা উসকে দিল। কিন্তু আচমকা সাগরপারের এক টেলিগ্রাম পৌঁছল গান্ধীজির হাতে। ডারবান থেকে প্রেরিত সে তার বার্তা নিয়ে এল—‘জানুয়ারিতে পার্লামেন্ট, শীঘ্র ফিরে আসুন’। নিরুপায় গান্ধীজি রওনা দিলেন মুম্বই। দিনটা ছিল ১৪ই নভেম্বর, ১৮৯৬। পিছনে পড়ে রইল আমাদের কলকাতা।
পুনশ্চ, যা বলা হয়নি এই ঘটনার আরও বছর ছয়েক পরে (১৯০২) কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক জনসভা হয়। সেখানে সভাপতিত্ব করে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার বর্ষীয়ান সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন। লক্ষণীয়, এ সভার সলতে পাকানোর আয়োজন যিনি করেছিলেন তিনি কোনও রাজনীতিক নন, প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায়। কলকাতার বুকে এটাই গান্ধীর প্রথম জনসভা।
ভগত সিংহের ফাঁসির হুকুম যখন হয়, তখন কলকাতায় একটি প্রতিবাদসভায় নেতাজি ও অন্যান্যদের ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। সেই সভায় উত্তেজনা হতে পারে এই আশঙ্কায় হোম সেক্রেটারি এইচ ডব্লিউ এমারসন গান্ধীজিকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির উত্তরে গান্ধীজি লেখেন,
"I thank you for your letter just received. I knew about the meeting you refer to. I have already taken every precaution possible and hope that nothing untoward will happen. I suggest that there should be no display of police force and no interference at the meeting. Irritation is undoubtedly there. It would be better to allow it to find vent through meeting, etc."
গান্ধীজি ভারতের এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁকে ভুল বোঝা ভারতবর্ষে কোনও নতুন ব্যাপার নয়, তার সঙ্গে আবার যদি ভুল বঙ্গানুবাদ জনিত বিশ্বাসও এ ভাবে পল্লবিত হতে থাকে, তা হলে তো গোটা ইতিহাসটাই এক দিন বারোয়ারি বিপন্নতায় আক্রান্ত হবে।
উপরোক্ত চিঠিটি পড়ে অনেকেই মনে হয় বা মনে হতে পারে, গান্ধীজি ব্রিটিশদের সমর্থন করছেন এবং চাইছেন মিটিংটা আটকাতে! অথচ চিঠিটির অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ করলে উল্টোটাই সত্যি মনে হচ্ছে, হিংসা বা অশান্তির মতো অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার সম্ভাবনা তো উড়িয়ে দিচ্ছেনই, উল্টে শাসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন এই বলে যে, সভাস্থলে যেন কোনও পুলিশ না থাকে। তিনি এও বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, মানুষের মনে প্রবল ক্ষোভ আছে। এই ভাবে নানা কর্মসূচির মাধ্যমেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দিতে হবে।’’
আশা করছি ইতিহাসের পাতা থেকে আরও দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করলে, ভগৎ সিংহের ফাঁসির আগে ও পরে গান্ধীজির অবস্থান ঠিক কেমন ছিল তা সকলে ধারণা করতে পারবেন। ভগৎ সিংহ, রাজগুরু ও সুখদেবের ফাঁসি স্থগিত করার জন্য গান্ধীজির প্রয়াস সম্পর্কে অনেকেই জানেন না।
১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে গান্ধীজি তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইনের সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে বিপ্লবী ভগৎ সিংহের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়। গান্ধীজি ভাইসরয়কে বলেন, ভগৎ সিংহের ফাঁসি কার্যকর না করে যদি মুলতুবি বা প্রত্যাহার করা যায়, তা হলে ইংরেজদের সঙ্গে ভারতবাসীর শান্তি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এর পর মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভাইসরয়ের সঙ্গে গান্ধীজির পুনরায় কথা হয়। গান্ধীজি বলেন, ভগৎ সিংহের দণ্ডাদেশ কি ফাঁসি ব্যতীত অন্য কোনও শাস্তি হতে পারে না অথবা ফাঁসি কি মুলতুবি রাখা যায় না? প্রত্যুত্তরে আরউইন বলেছিলেন, তিনি এই মামলাটি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখেছেন এবং এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে তিনি কোনও ভাবেই এই দণ্ডাদেশ পরিবর্তন করতে বা মুলতুবি রাখতে পারবেন না।
তাঁর করাচি যাত্রা পিছিয়ে দিয়ে তিনি ১৯৩১ সালের ১৮ই মার্চ, তার পর ১৯শে, ২১শে, ও ২২শে মার্চ তিনি ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে বারংবার একই অনুরোধ করেন। ২২শে মার্চ তারিখের বৈঠকে কিছুটা আশ্বাস পাওয়ার পরেও, গান্ধীজি এতটাই মরিয়া ছিলেন যে ২৩ তারিখ সকালেও এই মৃত্যুদণ্ড আটকাবার জন্য ভাইসরয়কে তিনি ব্যক্তিগত চিঠি পাঠান, তাতে জনমত, অভ্যন্তরীণ শান্তি ইত্যাদি নানা কারণ দেখানো ছাড়াও, ভাইসরয়কে তাঁর খ্রিস্টধর্মের শিক্ষা মনে করাতেও পিছপা হননি।
ভগৎ সিংহের ফাঁসি রদ করা নিয়ে গান্ধীজি একাধিক বার লর্ড আরউইনকে মানবিক অনুরোধ করেছেন। এ বার তিনি যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন। ২৩শে মার্চ কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় যোগদান করার জন্য সন্ধ্যায় করাচির উদ্দেশে ট্রেন ধরার ঠিক আগে লর্ড আরউইনকে চিঠি লিখে তিনি বলেন, ‘‘ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা এক সংশোধনাতীত কাজ।’’ তাই তিনি (আরউইন) যদি মনে করেন এই রায়দানে সামান্যতম ভুলের সম্ভাবনা আছে, তা হলে তাঁর উচিত এই দণ্ডাদেশ কার্যকর না করে পুনরায় বিবেচনা করা।
কিন্তু তাঁর সমস্ত চেষ্টা বিফলে গেল।
পঞ্জাবের ইউরোপিয়ান আইএএস ও আইপিএস অফিসারদের লাগাতার হুমকির কাছে মাথা নত করলেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইন। ১৯৩১ সালের ২৩শে মার্চ সন্ধ্যায় ফাঁসি হয়ে গেল ভারতমাতার তিন বীর সন্তানের।
প্রসঙ্গত, গান্ধীজি যখন ট্রেনে ছিলেন, তখনই লাহোরে ভগৎ সিংহ এবং তাঁর সহযোগীদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়।
১৯৩১ সালের ৩১শে মার্চ ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গান্ধীজি, ভগৎ সিংহকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে উল্লেখ করে লেখেন,
‘‘তাঁদের মুক্তির জন্য আমাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। ভগৎ সিংহ অহিংসায় বিশ্বাস করতেন না কিন্তু রাষ্ট্রীয় হিংসার কাছেও আত্মসমর্পণ করেননি। অসহায়তার কারণেই তাঁকে বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করতে হয়েছিল।’’
একই সাথে ব্রিটিশদের তীব্র নিন্দা করে লেখেন,
‘‘এই বীরদের মুক্তির জন্য জাতির সর্বসম্মত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ইংরেজ সরকার এই দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনাটুকুও বিনষ্ট করলেন।’’
উল্লিখিত সত্য জানার পরও কি গান্ধীজিকে অভিযুক্ত করা যায় যে ফাঁসি প্রদানকারী বিদেশি প্রশাসকের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল?
স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিসমূহ গান্ধীর বিশালকায় ভাবমূর্তির সঙ্গে কেবলই ছায়াযুদ্ধ করে চলেছে। যার ফলস্বরূপ তৈরি হচ্ছে অপব্যাখ্যা ও বেশ কিছু মিথ্যাচার। সবারই এতে কমবেশি অবদান আছে। তাই আমাদেরই সচেতন থাকতে হবে। আমাদের ভুল বোঝার ফল যেন ইতিহাসের বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।
তখন স্বাধীনতার ব্রাহ্মমুহূর্ত এসে পড়েছে প্রায়। আর মোটে চার দিন বাকি। আটাত্তর বছরের বিধ্বস্ত, ক্লান্ত বৃদ্ধ কলকাতায়। বেলেঘাটার বাড়ি তাঁর আস্তানা। বিবিসি তাঁর কাছ থেকে বার্তা চাইল। শুধু ইংরেজি নয়, তাঁর সেই বার্তা সম্প্রচারিত হবে বিশ্ব জুড়ে বেশ কয়েকটি ভাষায়।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কি কিছুই বলবেন না! একটি শব্দও না! সঙ্গী নির্মল বসুকে বললেন, ‘‘আই মাস্ট নট ইলড টু দ্য টেম্পটেশন।’’ বললেন, ওরা ভুলে যাক যে আমি ইংরেজি জানি। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োকে বলেছিলেন, ‘‘আই হ্যাভ রান ড্রাই।’’
তিনি নীরব থাকতে চেয়েছিলেন, কারণ এই স্বাধীনতা তিনি চাননি। তাঁর মনে হয়েছিল, সত্যিই তাঁর কিছু বলার নেই। চার দিকে এত রক্তারক্তি, হানাহানি, অবিশ্বাস, ঘৃণার বাতাবরণ! মাস কয়েক আগেই তো ঘুরে এসেছেন নোয়াখালিতে। অমৃতবাজার পত্রিকা লিখল, ‘‘গান্ধীজি’স এপিক ট্যুর বিগিনস।’’ সাতান্ন দিনে সাতচল্লিশটা গ্রাম খালি পায়ে ঘুরলেন মানুষের বিবেক আর চৈতন্য ফেরাতে। এবং হাতে বাঁশের লম্বা লাঠি, অন্য হাত মনুর (গান্ধী) কাঁধে। সফরসঙ্গীদের হিসেব বলে, ১১৬ মাইল সব মিলিয়ে। মোহনদাসের নিজের কথায়, এটা তাঁর তীর্থযাত্রা।
এই তীর্থযাত্রায় তাঁকে কী করা হল? হ্যান্ডবিল ছড়িয়ে হুমকি দেওয়া হল, ‘‘আমরা তোমাকে অনেক সাবধান করেছি, ফিরে যাও, না হলে কপালে দুঃখ আছে।’’ তাঁর যাত্রাপথে বিষ্ঠা ছড়িয়ে দেওয়া হল। বার বার অপমানিত হলেন পথে ঘাটে। কিন্তু তিনি দমেননি। মনে গভীর দুঃখ নিয়েও দমেননি।
সেই বিষাদ তিনি ব্যক্ত করেছিলেন ১৫ই অগস্ট ১৯৪৭-এ, বাংলার রাজ্যপাল রাজাগোপালাচারির কাছে। মোহনদাস উঠে পড়েছিলেন রাত দু’টোয়। প্রার্থনা সেরে চরকা কেটেছিলেন নিয়মমাফিক। সারা দিন শুধু ফলের রস খেয়ে ছিলেন। বেলেঘাটার বাড়ির বাইরে সকাল থেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। যাঁরা কিছু দিন আগেই এই শহরে পরস্পরের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন শানিত অস্ত্র নিয়ে। রাজাগোপালাচারি এলেন এই ‘চমৎকারের কারিগর’ বৃদ্ধকে অভিনন্দন জানাতে। কিন্তু গান্ধীর মনে শান্তি কোথায়? এত উল্লাস উন্মাদনা, আলোর রোশনাইয়ের মধ্যেও গান্ধীজির শান্তি কোথায়? তিনি বললেন, ‘মানুষের হৃদয় পরিবর্তন না হলে কী অর্থ এই স্বাধীনতার? উৎসবের আবহ কয়েক দিনের মধ্যেই শান্ত হবে। ভেতরের পরিবর্তন না হলে অন্ধকার ঘুচবে কি, আতসবাজির উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও?’
একাকী, ব্যথিত বৃদ্ধ তাঁর যাবতীয় সংশয়কে সত্য প্রমাণিত করে বুকে বুলেট নিলেন ঠিক সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায়। কিন্তু তাঁর শাস্তির আরও বাকি ছিল। সত্তর বছর পরে পোরবন্দরের এই গুজরাতি বানিয়ার ‘চাতুর্য’ আবিষ্কার করেন তাঁরই এক দেশোয়ালি উত্তরপুরুষ। দেশ জুড়ে উন্নয়নের স্বপ্নকে গাজর হিসেবে ঝুলিয়ে দিল্লি দখল করে যিনি ও তাঁর অগ্রজ ভ্রাতৃপ্রতিম, শিশুর সারল্য নিয়ে একের পর এক এমন কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাসকে, ভরসাকে, আস্থাকে এমন ভাবে ভেঙেচুরে দিচ্ছেন নানা কায়দায়, যা আন্দাজ করার দূরদৃষ্টি, চাতুর্য সত্যিই ছিল মোহনদাসের।
মুদ্রার এক পিঠে যদি এই চিত্র হয়, অন্য দিকে কে বা কারা? নোয়াখালিতে গান্ধীকে মুখের উপর বলা হয়েছিল, ‘ভন্ডামি ছাড়ুন, পাকিস্তানকে মেনে নিন ভালয় ভালয়।’ অবিভক্ত ভারতবর্ষ, অবিভক্ত মানবসমাজ তাঁরা সে দিন চাননি। সেই ভাবনার অনুসারীরা সংহতিকে টুকরো টুকরো করার জন্য আজও দ্বিধা করেন না রক্তপাতে।
সারা জীবন নিজেকে নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো বৃদ্ধটি বলতেই পারেন— পরীক্ষায় ডাহা ফেল করলাম নাকি? অন্ধকার ঘুচল কোথায়?
১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয়ে স্বাধীন হবার পরবর্তী সময় ...
"যে তিক্ততা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলছে, সরকার এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজেছে। জাতীয় স্বার্থের হানি না করে, ভারত দু’দেশের মধ্যে সংঘর্ষের কারণগুলি দূর করতে বদ্ধপরিকর।"
এই বিবৃতিটি সদ্য স্বাধীন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এসেছিল।
১৯৪৮ সালের ১৫ই জানুয়ারি, এক বিবৃতিটি করা হয়েছিল ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। এই বিবৃতির পরেই ভারত, পাকিস্তানের প্রাপ্য ৫৫ কোটি টাকা মিটিয়ে দেয়। তার কয়েক দিন আগে, জানুয়ারির শুরুতেই রাষ্ট্রপুঞ্জে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে গিয়েছে ভারত। সব মিলিয়ে, সে বড় সুখের সময় নয়।
পাকিস্তানের এই টাকাটা স্বাধীনতার সময়কার পাওনা। ’৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় বলা হয়েছিল, ব্রিটিশ শাসিত ভারতের অবশিষ্ট ৩৭৫ কোটি টাকা দুই দেশের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ হবে।
কিন্তু ’৪৭ সালের অক্টোবরে পাক হানাদারেরা কাশ্মীরে হামলা করার পর অবস্থা ও পরিস্থিতি বদলে যায়। স্বাধীন ভারতের প্রথম 'প্রধানমন্ত্রী' জওহরলাল নেহরু ও 'উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী' বল্লভভাই প্যাটেল মিলিত ভাবে স্থির করেন, টাকাটা পাকিস্তানকে দেওয়া হবে না। তার বদলে যে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল জনতা এ দেশে চলে আসছে, তাঁদের পুনর্বাসনে লাগানো হবে।
শরণার্থী আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সদ্যোজাত দু’টো দেশই তখন বিধ্বস্ত। এক দিকে লাহৌর, করাচি থেকে আসা হিন্দু শরণার্থী বোঝাই ট্রেন মাঝপথে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্য দিকে দিল্লির পাহাড়গঞ্জ, করোলবাগের মুসলিম বাসিন্দারা আশ্রয় নিয়েছেন হুমায়ুনের সমাধিতে, বিভিন্ন ত্রাণশিবিরে।
১৯৪৭ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর।
এই রকম উত্তাল পরিস্থিতিতেই কলকাতা থেকে দিল্লি পৌঁছলেন প্রায় ৭৯ বছরের বৃদ্ধ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এই বয়সেও টানা তিন দিন অনশন করেসছিলেন কলকাতার দাঙ্গার আগুন নেভানোর জন্য। শেষ অবধি হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লিগ ও শিখ নেতারা সকলে এসে তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, আর কোনও দিন এ রকম ঘটবে না। বেলেঘাটার বাড়িতে হিন্দু-মুসলিম-শিখরা এসে তাঁকে যে সব অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো দেখতে দেখতে গান্ধী মন্তব্যও করেছিলেন, ‘‘এটা স্টেন গান বুঝি? জীবনে প্রথম দেখলাম।’’
মোহনদাস এ বার দিল্লি হয়ে যাবেন পঞ্জাব। সেখানেও দাউদাউ ছড়িয়ে পড়ছে দাঙ্গা।
পঞ্জাব আর যাওয়া হয়নি তাঁর। উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেলের নির্দেশে ভোরবেলায় দিল্লির আগে শাহাদারা স্টেশনে নেমে পড়তে হয়েছে তাঁকে। প্যাটেল তাঁকে নিতে অপেক্ষা করছিলেন সেখানে।
প্যাটেলের থেকেই বাকি খবর পেয়েছিলেন গান্ধী।
দিল্লিও আর নিরাপদ নয়।
করোলবাগ, সবজিমন্ডির মুসলমানরা প্রাণ বাঁচাতে ত্রাণশিবিরে। পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীরা প্রবল উগ্রতা আর অসহিষ্ণুতায় বলে বেড়াচ্ছে, দিল্লি হিন্দুদের শহর। মসজিদে ভাঙচুর করে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, গুন্ডারা মুসলমানদের বাড়ি থেকে উৎখাত করে সেখানে হিন্দুদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে গান্ধীর ভাঙ্গি কলোনির বাড়িও আর নিরাপদ নয়। প্যাটেল বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গান্ধীকে নিয়ে গেলেন শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লার বাড়িতে।
গান্ধী অবাক হয়ে দেখলেন এই তাঁর সাধের দিল্লি?
এই রাজধানী শহরেই ২৪ বছর আগে খিলাফত নেতা মহম্মদ আলির বাড়িতে বসে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য তিনি ২২ দিন অনশন করেছিলেন?
তিনি বিকেলেই কমিউনিস্ট নেতা পি সি জোশীকে বললেন, ‘‘বিভ্রান্তিকর! এত গোলমেলে ব্যাপার আগে বুঝিনি।’’
কিন্তু বিভ্রান্তিতে আটকে থাকার লোক নন তিনি। তিনি তখন সকলকে বোঝাচ্ছেন, বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ‘‘দিল্লি হিন্দু-মুসলমান দুইয়ের শহর। মহাভারতে ইন্দ্রপ্রস্থ ছিল, মুঘলরা বাইরে থেকে এসেছিল।’’
কিন্তু কাকে তিনি বোঝাবেন?
বারংবার বলেছিলেন,
‘‘আগে দিল্লিকে ঠান্ডা হতে হবে। দিল্লি শান্ত হলে লাহৌর, রাওয়ালপিন্ডি, করাচিতেও শান্তি আসবে। ... পাকিস্তান সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বর নীতি নিয়েছে। ভারতের হিন্দু ও শিখরা ঠিক সেই ভাবে চোখের বদলে চোখ উপড়াতে চাইছে। আমি গুজরাতি বানিয়া। তাই জানিয়ে রাখি, যে আমার ভাল করবে, আমি শুধু তাঁরই ভাল করব, এটা ভুল বানিয়া নীতি।’’
কিন্তু তখন রক্তের গন্ধে উন্মত্ত এক দেশে সে সব শোনে কে?
বছরের শেষ মাসে দিল্লির রামলীলা ময়দানে আরএসএস-এর সভা, সেখানে বক্তৃতা দিতে এলেন সঙ্ঘগুরু গোলওয়ালকর। তিনি গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে এলে তাঁকে গান্ধী সরাসরি অভিযোগ জানালেন, দিল্লির দাঙ্গায় আপনাদের হাত আছে। গোলওয়ালকর বললেন, সঙ্ঘ মুসলিম-হত্যায় বিশ্বাসী নয়। গান্ধী বললেন, তা হলে সেটি মানুষকে জানান। গোলওয়ালকর বললেন, ‘‘আমি আর কী বলব? আপনি বরং আমার নাম করে সবাইকে জানিয়ে দিন।’’ গান্ধী সেই সন্ধ্যার প্রার্থনাসভায় সে রকমই জানালেন। সঙ্ঘগুরু নিজ মুখে ওই বিবৃতি আর দিলেন না।
কিন্তু তখন সমস্যা কি একটা?
ডিসেম্বরেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঠান্ডা লড়াই তুঙ্গে।
দু’জনেই গান্ধীকে লেখা আলাদা চিঠিতে ইস্তফা দিতে চাইলেন। গান্ধী প্যাটেল কে বললেন, সরকার হয় তুমি চালাও, নয় জওহর।
জবাবে প্যাটেল জানালেন, সরকার চালানোর শারীরিক ক্ষমতা তাঁর নেই। জওহর চালাক, তিনি বাইরে থেকে সমর্থন করবেন।
গাঁধী তখনই রায় দিলেন না, সময় চেয়ে নিলেন।
এই রকম টালমাটাল পরিস্থিতিতেই সত্যাগ্রহী শুনতে পেলেন তাঁর হৃদয়ের ডাক।
১২ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল।
সেদিন সকালে বিড়লা হাউসে চা পানে এসেছিলেন গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন। পঞ্জাবের পরিস্থিতি, দিল্লির উন্মত্ততা নিয়ে দু’জনে নানা কথা হল। পাকিস্তানের প্রাপ্য ৫৫ কোটির কথাও তুললেন মাউন্টব্যাটেন। তিনি জানালেন, ভারত টাকাটা না দিলে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার নজরে সে নীচে নেমে যাবে, চুক্তিভঙ্গকারীকে কেউ বিশ্বাস করবে না।
সে দিনটা ছিল সোমবার। নিজের নিয়ম মেনে গান্ধীর মৌনব্রতের দিন। তিনি কোনও উত্তর দিচ্ছিলেন না। হাতে লিখে জবাব দিচ্ছিলেন।
দুপুরবেলায় বিড়লা হাউসের লনে বসে সে ভাবেই কিছু লিখলেন, বিকেলের প্রার্থনাসভায় সেটি পড়ে শোনানো হল,
"সত্যাগ্রহী নিজেকে কখনও অসহায় মনে করে না। অনশন তাঁর শেষ তরবারি। আমি এই ভাবে ভারতীয় সভ্যতার ধ্বংসের নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারব না। পাকিস্তানও যদি অচিরে সব ধর্মকে সমান স্বীকৃতি না দিতে পারে, তাঁদের ধ্বংস অনিবার্য।"
তাঁর জীবনের সপ্তদশতম, শেষ অনশনটি তিনি শুরু করলেন দুই দেশকে ভ্রান্তি থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য।
১৩ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল।
অনশন শুরুর দিন সকালে ছুটে এলেন নেহরু ও প্যাটেল। ঠিক এর আগের দিনই দু’জনে আলাদা ভাবে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, কিন্তু গান্ধী কাউকে তাঁর সিদ্ধান্তের বিন্দুবিসর্গও জানতে দেননি।
এ দিন দেখা গিয়েছিল দু’জনেই সমান বিভ্রান্ত।
প্যাটেলের ধারণা ছিল, তাঁকে সরিয়ে জওহরলালকে সর্বেসর্বা করার জনাই এই অনশন করছেন গান্ধী। তাই ফের সরকার থেকে ইস্তফার প্রস্তাব রেখেছিলেন তিনি।
কিন্তু গান্ধী তাঁকে জানিয়েছিলেন, প্যাটেল ও নেহরু দু’জনকেই এখন সরকারে থাকতে হবে। পাকিস্তানের প্রাপ্য ৫৫ কোটি টাকার কথাও তুলেছিলেন প্যাটেলের কাছে।
শেখ আবদুল্লা এক সময় এসে বললেন, ‘‘কাশ্মীরের আজ আপনাকে দরকার।’’
উত্তরে গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন, এই অনশন কাশ্মীরের জন্যও। অল-ইনক্লুসিভ অনশন। হিন্দুরা যদি ভাবে মুসলমানদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দেবে, মুসলমানরা যদি ভাবে হিন্দুদের পাকিস্তান থেকে মেরে তাড়াবে, আজ তাঁর অনশন ছাড়া গত্যন্তর নেই।
১৪ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল।
মকরসংক্রান্তি।
প্রবল শীতেও দিল্লি, পঞ্জাব তখন উত্তপ্ত।
রটে গেল বুড়ো গান্ধী মুসলিমদের বাঁচাতে অনশনে বসেছেন! প্রশ্ন উঠে গেল, তাঁর এত মুসলিম প্রীতি কেন?!
বিকেলে বিড়লা হাউসের লনে মন্ত্রিসভা বসল, ঠিক হল পাকিস্তানের ৫৫ কোটি আটকে রাখা নিয়ে ফের চিন্তাভাবনা হবে। গান্ধী বললেন, ‘‘পাকিস্তানকে এ বার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, হিন্দু এবং শিখরা যত দিন না সেখানে ফিরতে পারছেন, তারা বিশ্রাম নেবে না। সে দেশের দরিদ্রতম সংখ্যালঘু মানুষটিও সসম্মানে জীবন, সম্পত্তি রক্ষার অধিকার পাক।’’
তিনি বলছেন এক, মানুষ বুঝছে আর এক।
এত পাকিস্তান-প্রেম কেন?
পঞ্জাব থেকে আসা হিন্দু ও শিখ উদ্বাস্তুরা রাতে ঘিরে ফেলল বিড়লা হাউস।
তাঁদের মুখে তখন স্লোগান, "খুনকা বদলা খুন। গাঁধীকো মরনে দো।"
সেই সময়েই বিড়লা হাউস থেকে বেরোচ্ছিল প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি। নেহরু নিজে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন, ‘‘কে বলল, গাঁধীকো মরনে দো? সাহস থাকলে সামনে এসে বল।’’
লোকগুলো দুদ্দাড়িয়ে পালাল।
১৫ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল।
অনশনের তৃতীয় দিন সকাল থেকেই গান্ধীর শরীর দুর্বল। বাথরুমে হেঁটে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। তাঁর জন্য তৈরি তিন সদস্যের চিকিৎসক বোর্ড জানাল, "শরীরের ওজন কমে আসছে। কিডনি খারাপ, প্রস্রাবে অ্যাসিটোন বডি মিলছে।"
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় প্রার্থনাসভায় যাওয়ার ক্ষমতাও অবশিষ্ট ছিল না তাঁর। তাই তাঁর বিছানার পাশেই মাইক্রোফোন দেওয়া হল। দুর্বল কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না, প্রার্থনার শেষে শায়িত অবস্থায় বারান্দায় নিয়ে আসা হল তাঁকে।
সেদিন বিকেলে হিন্দু-মুসলিম-শিখ অধ্যুষিত এক সভায় ভাষণ দিলেন নেহরু। বললেন, মহাত্মা গান্ধীর জীবনহানি মানে ভারতের আত্মার নির্বাপিত হওয়া। এই সাম্প্রদায়িক হানাহানি অচিরে শেষ না হলে কিন্তু আমাদের স্বাধীনতারও চিরসমাপ্তি।
সেই একই দিন, নেহেরুর ভাষণের একটু আগেই বিড়লা হাউসের লনে ৫৫ কোটি টাকা মেটানোর জরুরি মিটিংও হয়ে গিয়েছিল। নেহরু, প্যাটেলরা তাঁদের মত আর আঁকড়ে থাকেননি। এক দিন এই বিষয়ে প্যাটেল বলেছিলেন, ওই টাকাটা ছাড়লেই কাশ্মীর দখলে আনতে পাকিস্তান বুলেট কিনবে।
কিন্তু ১৯৪৭ সালের ৬ই জুলাই এই অস্ত্রদৌড় থেকেই তো গান্ধী সবাইকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘পাকিস্তান বলবে, ভারতের থেকে বাঁচতে তারা সৈন্যসংখ্যা বাড়াবে। ভারত পালটা একই কথা শোনাবে। দু’টো দেশই তা হলে তাদের সম্পদ শিশুদের শিক্ষার বদলে বারুদ-বন্দুক কিনে খরচ করবে?’’
ভারত সরকার ৫৫ কোটি টাকা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
সেদিন গান্ধী শিষ্য প্যাটেল কাঁদছেন, কাঁদছেন গান্ধীও!
সে দিনই গান্ধী এক বিবৃতিতে জানালেন, ‘‘যে যাই বলুক, পণ্ডিত নেহরু ও আমাকে গাছে তুলে বল্লভভাইয়ের মতো বিশ্বস্ত বন্ধুর থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।’’
প্যাটেলের মন্তব্যও ছিল অনুরূপ, ‘‘কেউ যেন বলার সুযোগ না পায়, দুনিয়ার মহত্তম মানুষের নেতৃত্ব পাওয়ার যোগ্য আমরা নই।’’
১৬ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল।
গান্ধীর স্বাস্থ্য সকাল থেকেই সংকটজনক। অনশনে কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত। দু’পাউন্ড ওজন কমে গিয়েছে। বলা হল, পাকিস্তানকে টাকা দেওয়া হচ্ছে। এ বার তিনি মুখে কিছু দিন।
উত্তরে গান্ধী জানালেন, ‘‘দিল্লির হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টানদের মধ্যে বন্ধুত্বই হতে পারে আমার অনশনের উত্তর।’’
পাকিস্তানের জন্য বললেন, ‘‘আমাদের সরকার একটা উদার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাকিস্তান কী ভাবে এর প্রতিদান দেবে?’’
১৭ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল।
সকালে এলেন নেহরু। খবর দিলেন দিল্লির অবস্থা অনেকটাই ভালো। অনুরোধ করলেন গান্ধীকে অনশন তুলে নেবার জন্য। কিন্তু সেদিনও শিষ্যের অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, ‘‘তাড়াহুড়ো দরকার নেই। যা করবে, তার মধ্যে যেন সততা থাকে।’’
সন্ধ্যায় শরীর আরও খারাপ হল।
তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের বাড়িতে বসল ১৩০ সদস্যের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি। প্রস্তাব হল, ‘সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব জাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করব আমরা।’
রাতেই গান্ধীর কাছে সেই প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু এ বারও তিনি নারাজ। সব দল সই করলেও হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ যে নেই!
১৮ই জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল।
সেদিন ছিল রবিবার।
তিনি তখন জীবনের বিপদপ্রান্তে পৌঁছেছেন। পেটে ব্যথা, ওজন কমে যাচ্ছে।
অন্য দিকে ফের শান্তি কমিটির মিটিং হলো। এবারে সেই মিটিংয়ে হাজির হলেন হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস-এর প্রতিনিধি গণেশ দত্ত। প্রস্তাবে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএসের পক্ষ থেকে সই করলেন তিনি।
‘মুসলমানেরা যাঁরা দিল্লি থেকে চলে গিয়েছেন, ফের এখানে এলে আপত্তি নেই। আমরা পুলিশ বা সেনা ছাড়াই সর্বতো ভাবে সাহায্য করব,’ লেখা হল সেই প্রস্তাবে।
সত্বর সকলের সই করা সেই প্রস্তাব পাঠানো হল বিড়লা হাউসে, গান্ধীর কাছে।
মোহনদাস এবারে আশ্বস্ত হলেন।
দুপুরে অনশন ভাঙলেন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর হাতে তুলে দিলেন কমলালেবুর রসের গ্লাস।
বিকেলে প্রার্থনাসভায় গিয়ে সেদিন তিনি জানালেন, ‘‘সত্যের নামে অনশনে গিয়েছিলাম। ঈশ্বরের নামে এত দিন আমরা লুঠপাট, গণহত্যা, ধর্মান্তর, মেয়েদের অপহরণ ও ধর্ষণকে প্রশ্রয় দিয়েছি। জানি না, সত্যের নামে কেউ এই জিনিস করার সাহস পায় কি না।’’
এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে গেল তাঁর পরবর্তী কর্মসূচি। ৮ই বা ৯ই ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তান যাবেন। দু’দেশেরই গরিব মানুষকেই বাঁচাতে হবে।
পাকিস্তান যাওয়াটা অবশ্য হয়ে ওঠেনি।
রবিবার দুপুরে তিনি অনশন ভাঙার আগেই কনট প্লেসের মেরিনা হোটেলে উঠে পড়েছেন পুণে থেকে আসা 'এস দেশপাণ্ডে'। এটি 'ছদ্মনাম'।
মাস ফুরনোর আগে, ৩০শে জানুয়ারি তাঁকে স্বনামেই চিনেছিল বিশ্ব, 'নাথুরাম গডসে'।
(তথ্যসূত্র:
১- আত্মকথা, মহাত্মা গান্ধী (অনুবাদ: ক্ষিতিশ রায়), হাওলাদার প্রকাশনী (২০১৪)।
২- মহাত্মা গান্ধী, হিতেশরঞ্জন সান্যাল, বাতিঘর (২০১৬)।
৩- Gandhi and His Political Philosophy, Nand Kishore Prasad, ABD Publishers (২০১৯)।
৪- Mahatma Gandhi: Truth and Non-Violence, Dr. Father Hemanto Pius Rozario, Bhashaprokash (২০১৬)।
৫- Jinnah Vs. Gandhi, Roderick Matthews, Hachette India (২০১৭)।
৬- গান্ধী, ইরা সেনগুপ্ত, ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস।
৭- গান্ধী-গবেষণা, পান্নালাল দাশগুপ্ত, নবপত্র প্রকাশন (২০১১)।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে জানুয়ারি ২০১৮ সাল।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে অক্টোবর ২০১৫ সাল।
১০- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে নভেম্বর ২০১৮ সাল।
১১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ই জুন ২০১৯ সাল।
১২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ই আগস্ট ২০১৭ সাল।)
©️রানা চক্রবর্তী©️
0 মন্তব্যসমূহ