তিনি নাকি জন্মেছিলেন বত্রিশ পাটি দাঁত নিয়ে! শত্রুর সম্ভাব্য বিষ-আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে রাজার খাবারে গোপনে গরল মেশাতেন প্রতি দিন! এমন বিচিত্র ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত জীবনের কেন পরিণতি হয় স্বেচ্ছামৃত্যু? এই প্রশ্নের উত্তর আজও ইতিহাসের পাতায় অধরা।
৩৩০ খ্ৰীস্টপূর্বাব্দ। মগধের সম্রাট তখন ধননন্দ। ধনে আর বলে তিনি দোর্দন্ডপ্রতাপের অধিকারী। যেমন সংকীর্ণ তাঁর নীতি তেমন খারাপ তাঁর ব্যবহার।
রাশি রাশি সেনা, অসংখ্য হাতি-ঘোড়া, গোপন কোষাগারে অগাধ ঐশ্বর্য। তবু তাঁর লোভের যেন শেষ নেই আর! তার মধ্যে হাজার রকম কর বসিয়ে প্রজাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। ক্ষিপ্ত সবাই, কিন্তু তাঁকে টলাবার সাধ্য নেই কারও!
ধননন্দের ইচ্ছে হল তাবড় পণ্ডিতদের ডেকে তাঁদের কথা শোনার। খবর পেয়ে তক্ষশীলা থেকে তাঁর রাজসভায় ছুটে এলেন চাণক্য। তারপর না-বুঝে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে বসলেন রাজপুরোহিতের ফাঁকা আসনে। চারপাশে বিদগ্ধজন আর মন্ত্রিমন্ডলী।
সভার শুরুতেই ধননন্দের চোখ পড়ল চাণক্যের উপর। রেগে আগুন ধননন্দ বললেন, ‘‘অনুমতি না নিয়ে রাজপুরোহিতের আসনে বসা কদাকার লোকটা কে?’’
অপমানিত চাণক্য উঠে দাঁড়ালেন। পরনে অন্তরীয়, গায়ে উত্তরীয়। বাঁধা চুল খুলে দিয়ে সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করলেন, দাম্ভিক, রাজধর্ম পালনে অক্ষম ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত না করে আর চুল বাঁধবেন না তিনি।
তাঁর স্পর্ধা দেখে রাজা প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন চাণক্যকে ধরার। পালালেন চাণক্য। পিছনে ছুটলেন প্রহরীরা।
প্রাণ হাতে করে, গোপন এক সুড়ঙ্গ-পথ দিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে কিছু দূরে এক জঙ্গলে পালিয়ে আসতে চাণক্যকে সাহায্য করলেন ধননন্দের উচ্চাকাঙ্খী পুত্র পর্বত। চাণক্যের হাত ধরে বাবাকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজে রাজা হবার বাসনায়।
পর্বত চাণক্যকে দেখিয়ে দিলেন বাবার লুকানো সম্পত্তির ঠিকানা। দু’জনে লুঠ করলেন গোপন রাজ কোষাগার। পর্বতকে চাণক্য বললেন, ‘‘রাজা ধননন্দকে হারাতে তাঁর চাই বিরাট এক সেনাবাহিনী, বিপুল অর্থ আর মিত্রগোষ্ঠী।’’ বললেন, পালাতে হবে তক্ষশীলায়। পরদিন সকালে পর্বতকে এক মন্দিরে বসিয়ে রেখে চাণক্য কিনে আনতে গেলেন দুটো ঘোড়া। আর পর্বতের জন্য নতুন পোশাক। চারপাশে দু’জনের খোঁজে ততক্ষণে গিজগিজ করছে রাজার গুপ্তচর।
কিছু দূর যেতেই জঙ্গলের মধ্যে তাঁর কানে ভেসে এল কথা। সাবধান হলেন চাণক্য। তারপর দেখলেন এক কিশোর বসে আছে গাছের একটা গুঁড়ির উপর। তার হাতে উদ্যত দীর্ঘ দণ্ড, মাথায় পাতার মুকুট। তাঁকে ঘিরে তার চেয়ে বড় আর ছোট ছেলেদের এক দল।
‘চোর’ সন্দেহে এর পর তারা মুকুট পরা ‘রাজা’র সামনে হাজির করল দুই বন্দিকে। ‘রাজা’ বললেন, ‘‘প্রমাণ কই?’’
নানা রকম প্রমাণ দাখিল হল। অভিযুক্তদের প্রমাণ খন্ডন করার সুযোগ দিলেন ‘রাজা’। তাঁদের যুক্তি ব্যর্থ হলে বললেন, ‘‘অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হলো।’’
তারপর শোনালেন কঠোর শাস্তি।
এই বিচার শেষ হতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে খেলার রাজার সামনে এসে দাঁড়ালেন চাণক্য।
বললেন, ‘‘কুর্নিশ, মহারাজ! আমি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ, আপনার অগাধ দয়ার অপেক্ষায়।’’
‘রাজা’ বললেন, ‘‘আচার্য, আপনার জন্য আমার উপহার দুগ্ধবতী একটি গাভী’’, বলেই চাণক্যের হাতে দিলেন একটা গাছের ডাল। গ্রহণ করে চাণক্য আশীর্বাদ করলেন রাজাকে। বললেন, ‘‘মহারাজ রাজত্ব করুন বহু বছর, জয় করুন বহু দেশ, মঙ্গল করুন অনেকের।’’
তারপর খেলার রাজার কাছে এসে বললেন, ‘‘বৎস, তোমার নাম কী? বাড়ি কোথায়? বাবা কে তোমার ?’’ খেলার কিশোর রাজা বলল, ‘‘আমি চন্দ্রগুপ্ত। বাবার নাম শ্রাবক। বাবা শিকার করেন। পাশেই আমার বাড়ি।’’
রাজা সাজা এই সপ্রতিভ কিশোরের নেতৃত্বের সহজাত প্রতিভা আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি অবাক করল চাণক্যকে। এই গুণ তিনি কখনও দেখেননি রাজসিংহাসনের প্রত্যাশায় তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করা রাজপুত্র পর্বতের ভিতর।
চন্দ্রগুপ্তের বাড়ি খুঁজে তার বাবার সঙ্গে দেখা করে চাণক্য জানলেন, তিনি ছেলেটির পালক পিতা। আর ছেলেটির গায়ে মৌর্য রক্ত। এক জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁকে। শ্রাবককে একহাজার ‘কর্ষপান’ দিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে নিজের কাছে রেখে দীক্ষা দেওয়ার সম্মতি আদায় করলেন চাণক্য।
চন্দ্রগুপ্তকে দেখে কিছুটা অবাক, কিছুটা বিরক্ত হলেন পর্বত। তারপর তিন জন রওনা হলেন তক্ষশীলার পথে। পাটুলিপুত্র আর তক্ষশীলাকে জুড়ে দিয়েছে উত্তরাপথ।
পর্বতের রাজ-পরিচয় গোপন রেখে চাণক্য তাঁর নাম রেখেছেন সিদ্ধকেতু। সিদ্ধকেতু আর চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে টুকরো আলোচনায় চাণক্য বুঝে নেবার চেষ্টা করছেন দু’জনের মনের গড়ন।
কথায় কথায় চাণক্য জানতে চাইলেন, ‘‘মাঠে গরু চরছে দেখে এক ব্রাহ্মণ এসে রাজার কাছে কয়েকটা গরু চাইলে কার সম্পত্তি না জেনে কী করে সেই গরু দান করবেন রাজা?’’
বালক চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘‘সবই রাজার সম্পত্তি, কারও অনুমতির প্রয়োজন নেই তাঁর।’’
চাণক্য জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘জঙ্গলের সুরক্ষায় কী করা উচিত?’’
সিদ্ধকেতু বললেন, ‘‘বিশেষ বাহিনী নিয়োগ করার দরকার।’’ চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘‘না, জঙ্গলকে চেনা জঙ্গলের মানুষই রক্ষা করবে জঙ্গলমহল।’’
এগিয়ে চললেন তিনজন।
কখনও বিষ্ণুগুপ্ত কখনও কৌটিল্য নামে পরিচিত। চাণক্যকে কেউ বলেন কেরলের, আবার কেউ বলেন উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ। মূলত গ্রিক, ল্যাটিন, ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ এবং জৈন উপাখ্যানে এই চাণক্যের নানা কাহিনি পাওয়া যায়। রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে তাঁর পূর্বসূরিদের ধ্যানধারণা আর তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ‘অর্থশাস্ত্র’ আর ‘নীতিশাস্ত্র’ চাণক্যকে অমরত্ব দিয়ে গেছে।
কথিত রয়েছে, বত্রিশ পাটি দাঁত নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন চাণক্য। এই ঘটনা ভবিষ্যতে রাজা হবার লক্ষণ ধরে নিয়ে তাঁর বাবা অথবা মা ভেঙে দেন চাণক্যের কয়েকটি দাঁত। নানা বর্ণনা থেকে বোঝা যায় চাণক্য ছিলেন খর্বকায় আর শ্যামবর্ণের অধিকারী। পায়ের গড়নে ছিল খুঁত। তাঁর বাবার নাম সম্ভবত চানক ছিল। নিজের জীবদ্দশায় চাণক্য খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য।
কাশীতে এসে চন্দ্রগুপ্তকে একটা তরোয়াল কিনে দিলেন চাণক্য। সেখানেই এক শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে দান হিসেবে এক ধনী ব্যক্তির থেকে দুটো সোনার হার পেলেন সিদ্ধকেতু আর চন্দ্রগুপ্ত।
এক রাত্রে সিদ্ধকেতুকে চুপিচুপি ডেকে চাণক্য দিলেন কঠিন এক কাজ। ঘুমন্ত চন্দ্রগুপ্তের গলা থেকে তাঁকে না জাগিয়ে, ফাঁস না খুলে, নিয়ে আসতে হবে সোনার হার।
এই কাজ দিয়ে শুতে গেলেন চাণক্য। বললেন, কাজ হলে তাঁকে খবর দিতে।
পরদিন ঘুম ভাঙলে দেখলেন সিদ্ধকেতু বসে আছেন নতজানু হয়ে। সিদ্ধকেতু বললেন, ‘‘অক্ষম আমি আপনার দেওয়া কাজ করতে।’’
হাসলেন চাণক্য। দিনকয়েক পর আড়ালে ডেকে একই কাজ দিলেন চন্দ্রগুপ্তকে। ঘুমন্ত সিদ্ধকেতুকে না জাগিয়ে, হারের ফাঁস না খুলে চন্দ্রগুপ্তকে বন্ধুর গলা থেকে খুলে আনতে বললেন সোনার হার। তারপর আগের দিনের মতো শুতে চলে গেলেন চাণক্য।
গভীর রাতে চন্দ্রগুপ্তের নরম ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেল চাণক্যের। ‘পেরেছি’ বলে সিদ্ধকেতুর গলার হার চন্দ্রগুপ্ত তুলে দিলেন চাণক্যের হাতে।
অন্ধকারে চাণক্য পেলেন ভেজা হারে তাজা রক্তের গন্ধ। বুঝলেন, রাজকার্য সিদ্ধির জন্য যে উপস্থিত বুদ্ধি, দৃঢ়তা, এমনকী বন্ধুর প্রতি পাষাণহৃদয় হবার সাহস প্রয়োজন, সেই সাহসের নিপুণ প্রয়োগে সতীর্থের মাথা থেকে ধড় আলাদা করে হার নিয়ে এসেছেন চন্দ্রগুপ্ত।
উত্তেজনায় উঠে বসলেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্তকে বললেন, ‘‘মগধের রাজা হবে তুমিই।’’
চন্দ্রগুপ্তের পথ থেকে বরাবরের জন্য মুছে গেলেন রাজপুত্র পর্বত।
তক্ষশীলা সে যুগের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। চাণক্য প্রথমে ছিলেন তার ছাত্র, তারপর শিক্ষক। সেখানেই ভদ্রভট্ট, পুষ্যমিত্রের মতো উজ্জ্বল ছাত্রদের সঙ্গেই চাণক্যের হাতে দীক্ষা শুরু চন্দ্রগুপ্তের।
গণিত, ইতিহাস, আইন, রাষ্ট্রনীতি, ভূগোল, অর্থনীতির পাঠ নিতে থাকেন চন্দ্রগুপ্ত। তার সঙ্গেই যুদ্ধবিদ্যা আর ধ্যানের ‘মুহূর্ত’। কঠিন সাধনায় অক্লান্ত চন্দ্রগুপ্ত।
সিন্ধু আর ঝিলম নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজা অম্ভি আত্মসমর্পণ করলেন ম্যাসিডনের সম্রাট আলেকজান্ডারের কাছে।
খুশি হয়ে আলেকজান্ডার তাঁকে দিলেন রাশি রাশি উপহার। সেই বার্তা রটে গেল তক্ষশীলার বিদ্যানিকেতনে।
ওদিকে রাজা পুরু কিছুতেই মাথা নোয়াবেন না যবন-শাসক আলেকজান্ডারের কাছে। এই সব সমীকরণ চর্চা করে, ধননন্দকে ঘায়েল করতে দুর্ধর্ষ আলেকজান্ডারকে পাশে পাবার স্বপ্ন দেখলেন চন্দ্রগুপ্ত।
চাণক্যকে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘‘শুনেছি সমস্ত পৃথিবী শাসন করার বাসনা এই যবন সম্রাটের, কিন্তু সেটা তাঁর একার কাজ নয়। তার জন্য চাই বিশ্বস্ত মিত্র শক্তি।’’ চাণক্যের অনুমতি নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত চলে গেলেন আলেকজান্ডারের দরবারে। যাওয়ার আগে, পোড়-খাওয়া রাজার সামনে মেপে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে চাণক্য সচেতন করে দিলেন তাঁর ছাত্রকে।
কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের প্রস্তাবে এতটাই রেগে গেলেন আলেকজান্ডার যে, রাতের অন্ধকারে তক্ষশীলা ছাড়তে হল চন্দ্রগুপ্তকে, যেতে হল কাছের গ্রাম জালাউনে আচার্য শালকের আশ্রয়ের উদ্দেশে।
তত দিনে অনেকেরই বুঝতে বাকি নেই মগধ-অধিপতিকে উল্টে দিতে চন্দ্রগুপ্তই চাণক্যের পাশার চাল। আলেকজান্ডারের অনুগত রাজা অম্ভি এসে চাণক্যকে ধমকে গেলেন চন্দ্রগুপ্তকে ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে ইন্ধন জোগাবার জন্য। চাণক্য বললেন, অম্ভির তাঁকে জ্ঞান দেবার প্রয়োজন নেই। এমন দিন আসবে যখন কোনও যবন শাসকের বদলে দেশের মাটি থেকেই উঠে আসবেন এক চক্রবর্তী সম্রাট।
অম্ভিকে পাশে নিয়ে অম্ভির শত্রু পুরুকে আক্রমণ করলেন আলেকজান্ডার। ঝিলমের সেই যুদ্ধ কঠিন হলেও জিতলেন তিনি। পুরুর শক্তি আর সাহসে আপ্লুত আলেকজান্ডার তাঁকে দিলেন অজস্র উপঢৌকন। ফিরিয়ে দিলেন তাঁর রাজ্যপাট।
চন্দ্রগুপ্তের কাছে চলে গেলেন আচার্য চাণক্য। দু’জনের উদ্যোগে এবার শুরু হল স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী তৈরি করে পাটুলিপুত্র আক্রমণের তোড়জোড়। চোর, ডাকাত, অরাষ্ট্রক, বহ্লিক, শকেদের মতো সম্প্রদায়ের অনেকেই যোগ দিল সেই সেনাবাহিনীতে।
তাঁদের প্রথম উদ্যোগ বড় ধাক্কা খেল সরাসরি রাজধানী পাটুলিপুত্র আক্রমণ করতে গিয়ে। বিফল হয়ে প্রাণ হাতে করে ছদ্মবেশে দু’জন লুকিয়ে বেড়ালেন কিছু দিন। গড়ে তুললেন গুপ্তচরদের নিবি়ড় এক জাল।
একদিন বাজারে এক বৃদ্ধা তাঁর খেতে বসে মুখ-পোড়ানো ছেলেকে ধমক দিয়ে বলছিলেন, ‘‘গরম খিচুড়ি মাঝখান থেকে খেলে মুখ পোড়ে চন্দ্রগুপ্তের মতো। গরম খাবার খেতে হবে থালার একেবারে ধার থেকে।’’
বৃদ্ধার এই কথাই ঘুরিয়ে দিল মগধ আক্রমণে চাণক্যের নীতি। মিত্রশক্তির সাহায্যে চারপাশ থেকে ধননন্দকে আক্রমণের পথ ধরলেন চাণক্য। সদ্য জয় করে আসা রাষ্ট্র আর জনপদগুলো দখলের পর, আগের মতো ফেলে না রেখে, বসিয়ে দিলেন নিজেদের সৈন্য। তারপর এগোতে থাকলেন পাটুলিপুত্রের দিকে। সঙ্গে পেলেন হিমালয় এলাকার শাসক প্রভতককে। আচার্য চাণক্যকে দেখে শ্রদ্ধায় নত প্রভতক।
চাণক্য তাঁকে বললেন, ‘‘আপনার আছে লোকবল, আর আমাদের আছে স্থানীয় জ্ঞান, দুর্ধর্ষ জনসংযোগ, অসংখ্য গুপ্তচর।’’ যুদ্ধে জয়ী হলে পাটুলিপুত্রসহ সাম্রাজ্যের অর্ধেক হবে তাঁর, সেই শর্তসাপেক্ষে চন্দ্রগুপ্তের মিত্র হতে রাজি হলেন প্রভতক। বোঝাপড়া হতেই মগধের রাজা ধননন্দের বিপুল বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল চাণক্য, চন্দ্রগুপ্ত আর প্রভতকের মিত্রশক্তি। বুদ্ধিদীপ্ত ছল, চাতুরি, জনপদে কানে কানে নানা কৌশলী প্রচার, গুপ্তচরদের খবর আর সর্বোপরি ধননন্দের প্রজাবিরোধী নীতির থেকে উঠে আসা জনরোষকে প্রবলভাবে কাজে লাগলেন চাণক্য মগধের অপ্রিয়, দুর্বিনীত আর ক্ষমতাবান রাজাকে ধরাশায়ী করার কাজে।
দুর্দান্ত এক যুদ্ধের শেষে মগধের রাজপ্রাসাদে জয়ী চাণক্য আর চন্দ্রগুপ্ত। সামনে পরাজিত ধননন্দ। পরাজয়ের গ্লানিতে ম্লান, সন্ত্রস্ত। এত দিনে প্রবাদ হয়ে যাওয়া সেই অপমানের জন্য ক্ষমা চেয়ে চাণক্যকে করজোড়ে ধননন্দ বললেন, ‘‘আপনার হাতে আমার স্ত্রী-কন্যাদের সম্মানের কথা ভেবে কেমন বিচার আশা করতে পারি?’’
চাণক্য বললেন, ‘‘নারীর উপর হিংসা বর্ষণ করেন না বিষ্ণুগুপ্ত। আর বিজয়ে হৃদয়বান হতেও তিনি অনন্য।’’
একটা রথে যতটা ধরে ঠিক ততটা সম্পদ নিয়ে ধননন্দকে পরদিন সপরিবারে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিলেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্ত দেখলেন তাঁর গুরুর দৃষ্টি স্থির ধননন্দের মেয়ের দিকে। কিছু বলার আগে তাঁকে চাণক্য বললেন, ‘‘এই কুমারী তোমার প্রেমে বিভোর। এই হবে তোমার স্ত্রী।’’
‘‘এই অস্থির সময়ে বিয়ে? তাও আবার শত্রুর মেয়ের সঙ্গে?,’’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন চন্দ্রগুপ্ত।
চাণক্য বললেন, ‘‘ভালোবাসাকে আঘাত দিতে নেই।’’
বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন চন্দ্রগুপ্ত। আপত্তি করলেন না ধননন্দও।
বিয়ে হয়ে গেল চন্দ্রগুপ্ত আর দুর্ভারার। কিছু দিনের মধ্যেই খবর এল দেশ ছেড়ে যাবার পথে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন ধননন্দ।
চাণক্যের গুপ্তচরেদের থেকে নিয়মিত খবর আসছে নানা সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের। যার মধ্যে প্রধান চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার ছক। এইসব বিধ্বংসী শক্তি, বিশেষত ধননন্দের মন্ত্রীদের থেকে নীরবে চন্দ্রগুপ্তকে আগলে রাখছেন চাণক্য। মিত্রতার শর্ত অনুযায়ী, পাটুলিপুত্রের মুকুট যে এবার প্রভতকের পরার কথা, সে-কথা চাণক্যকে স্মরণ করিয়ে দিলেন চন্দ্রগুপ্ত। বললেন, মিত্রশক্তির সঙ্গে সংঘাতে যাবার মতো আত্মশক্তি অথবা কারণ তৈরি হয়নি তখনও, তাই প্রভতকের মাথায় তুলে দিতে হবে মুকুট। চাণক্য মুখে বললেন, ‘‘বিলক্ষণ।’’ কিন্তু মনে কী ভাবলেন কে জানে!
এর পর একদিন চন্দ্রগুপ্তের কাছে খবর নিয়ে এলেন চাণক্যই। এক বিষকন্যার সংসর্গে প্রাণ হারিয়েছেন প্রভতক।
বললেন, ‘‘ওঁকে সাবধান করেছিলাম, শোনেননি আমার কথা।’’ যদিও চাণক্যর চোখ বলল অন্য কথা। চাণক্যের গোপন কৌশলে পাটুলিপুত্রের সিংহাসনের রাস্তা থেকে মুছে গেলেন পথের-কাঁটা প্রভতক।
বিশাখদত্তের সংস্কৃত নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’-এ পাওয়া যায়, ধননন্দের মন্ত্রী রাক্ষস, চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার জন্য পাঠিয়েছিলেন এক বিষকন্যাকে।
এই গোপন তথ্য জেনে ফেলে চতুর চাণক্য সেই বিষকন্যার পথ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন যুদ্ধে মিত্র, আদপে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভতকের খোলা দরজার অভিমুখে।
মগধের সিংহাসনে বসলেন চন্দ্রগুপ্ত। প্রায় দশ বছর পর আবার চুল বাঁধলেন প্রধানমন্ত্রী আচার্য চাণক্য।
এরপরে সন্তানসম্ভবা দুর্ভারা। চন্দ্রগুপ্তের চোখেমুখে গভীর আনন্দ, তীব্র উৎকণ্ঠা। একদিন চন্দ্রগুপ্ত নিজের খাবারের থালা থেকে খাবার ভাগ করে তাঁর স্ত্রীকে খাওয়াতে গিয়েই ঘটল চূড়ান্ত বিপদ। হঠাৎই দুর্ভারার শরীরে দেখা দিল বিষক্রিয়ার লক্ষণ। দুর্ভারার বিষক্রিয়ার খবর পেয়ে ছুটে এলেন চাণক্য। তখন বিষের তেজে এলিয়ে পড়েছেন দুর্ভারা। খাবারের থালা হাতে দুর্ভারার পাশে চন্দ্রগুপ্তকে দেখে চমকে উঠলেন চাণক্য। চাইলেন একটা ছুরি। দুর্ভারার গর্ভ থেকে তারপর তুলে আনলেন এক শিশুপুত্রকে। চন্দ্রগুপ্তের কোল আলো করে এলেন বিন্দুসার আর মন কালো করে চলে গেলেন দুর্ভারা।
সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যাওয়ায় ভারত অধিগ্রহণের পরিকল্পনা বাতিল করে এক সময় ফিরে যান আলেকজান্ডার। থেকে গিয়েছিলেন তাঁর কিছু সেনাপতি। পঞ্জাব অঞ্চলে আলেকজান্ডারের রেখে যাওয়া সেনাপতিদের যুদ্ধে হারিয়ে দিলেন চন্দ্রগুপ্ত। পরাজিত সেলুকাসকে পাঁচশ হাতি আর ছয় লক্ষ সেনা উপহার দিয়ে সম্পূর্ণ মন জয় করে নিলেন তাঁর। শুধু তাই নয়, তাঁর পরিবারের মেয়েকে বিয়েও করলেন।
পারস্যের সীমানা অবধি নিজের সাম্রাজ্য নিয়ে গেলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তত দিনে সাবালক এবং শিক্ষিত হয়েছেন বিন্দুসার। চাণক্যের সঙ্গে থেকে বাবার মতোই বিন্দুসারও তত দিনে আত্মস্থ করেছেন রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। শিখেছেন, প্রজার হিতসাধনই রাজার মূল কর্তব্য, প্রজাবিদ্বেষই বিনাশের কারণ, জেনেছেন অর্থই সব কিছুর মূলে। জেনেছেন দুর্বল রাজার ক্ষত, সবল রাজার মূলধন, জেনেছেন প্রচার আর গুজব হতে পারে পরিকল্পিত আক্রমণের মোক্ষম অস্ত্র।
এরপরে একদিন রাজ্য জুড়ে দেখা দিল খরা। রাজ্য জুড়ে অপ্রতিরোধ্য খরার মুখে এবার যেন ভেঙে পড়লেন চন্দ্রগুপ্ত। আচার্য চাণক্যের কাছে এসে চাইলেন ক্ষমতা থেকে বিদায়। চাণক্য বাধা দিলেন না। চব্বিশ বছরের প্রজাকল্যাণমুখী রাজশাসনের উপান্তে বিন্দুসারকে রাজ্যপাটের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চললেন শ্রবণবেলগোলের পথে, নিজের স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অভীপ্সায়।
জৈনমতে উপবাসী হয়ে সেখানেই প্রয়াত হলেন চন্দ্রগুপ্ত।
এত দিনের প্রিয় শিষ্যকে হারিয়ে তখন গভীর এক শূন্যতায় ডুবে আছেন চাণক্য। জনজীবন থেকে ক্রমশই যেন দূরে সরে যাচ্ছিলেন তিনি। ভাবছিলেন বিন্দুসারকে বলে, সুযোগ্য শিষ্য রাধাগুপ্তকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে রাজকার্য থেকে এবার বিদায় নেবেন তিনিও। তার মধ্যেই একটা খবর যেন একেবারে দুর্বল করে দিল তাঁকে। রাধাগুপ্তের থেকে শুনলেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিন্দুসারের কান ভাঙিয়ে তাঁকে ভয়ংকর খেপিয়ে তুলেছেন ক্ষমতাপিয়াসী সুবন্ধু।
সুবন্ধুর কথায় বিন্দুসার নিশ্চিত, চাণক্যই বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন তাঁর জন্মে-হারানো মা-কে। একেবারে যেন পাথর হয়ে গেলেন চাণক্য। রাধাগুপ্তকে বললেন, উপবাসের মাধ্যমে তাঁর স্বেচ্ছা-মৃত্যুর বেদী রচনা করতে। ওদিকে ক্রোধে, বিস্ময়ে আর সত্যের আশঙ্কায় কাঁপছেন বিন্দুসার। চাণক্যকে রাজসভায় ডেকে পাঠালেন তিনি। রাজপ্রহরীকে ফিরিয়ে দিলেন আচার্য চাণক্য। বললেন, তাঁর স্বেচ্ছা মৃত্যুর প্রহর আসন্ন, তিনি আর যাবেন না রাজদরবারে।
তখন ‘বিশ্বাসঘাতক’ চাণক্যের অপেক্ষায় অস্থির প্রহর গুনছেন বিন্দুসার, রাজসভায় ছুটে এলেন এক পরিচারিকা। বললেন, সত্যের সূত্র ধরিয়ে দিতে চান সম্রাট বিন্দুসারকে, না হলে ভয়ানক অবিচার হবে চাণক্যের প্রতি। বললেন, তিনিই সেই নারী, বিন্দুসারের জন্মের লগ্নে, রানির মৃত্যুর প্রহরে উপস্থিত ছিলেন যিনি। বিন্দুসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘পরিচারিকাদের সাক্ষ্য গ্রহণের সময় তাহলে আসেননি কেন আপনি?’’
মাথা নিচু করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, শত্রুর সম্ভাব্য বিষের আক্রমণ থেকে তাঁর পিতাকে বাঁচাতে চন্দ্রগুপ্তের খাবারে প্রতিদিন গোপনে সামান্য বিষ মেশাতেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্তের শরীর এক সময় যে কোনও বিষের দংশন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পাবে ভেবে। কিন্তু অভ্যাস ভেঙে নিজের খাবার যেদিন চন্দ্রগুপ্ত ভাগ করে খেতে গেলেন দুর্ভারার সঙ্গে, সেই সামান্য বিষই কেড়ে নিল গরলে অনভ্যস্ত তাঁর অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীর জীবন।
বৃদ্ধা বললেন, চাণক্য নির্দোষ তাঁর মায়ের মৃত্যুর ঘটনায়। আরও বললেন, ‘‘মহারাজ, বিষের আক্রমণ থেকে বিদগ্ধ ক্ষিপ্রতায় আপনাকে বাঁচিয়ে সেদিন পৃথিবীর মুখ দেখান আচার্যই। তবু একবিন্দু বিষ মাতৃগর্ভে ছুঁয়ে ফেলে আপনার কপাল। তাই মহারাজের কপালে আজও একটি নীল টিকা, তাই মহারাজের নাম বিন্দুসার।’’
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হলেন বিন্দুসার।
প্রহরী বললেন, চাণক্য বলেছেন আসবেন না তিনি রাজসভায়, কেননা নিজের মৃত্যু রচনায় তিনি নিবেদিত। আচার্যের বাড়ির দিকে ছুটলেন বিন্দুসার। রাস্তায় শুনলেন নিজের পার্থিব ধনসম্পদ বিলিয়ে দিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে স্থির আচার্য চাণক্য।
তাঁর প্রাঙ্গণে যখন পৌছলেন, তখন ধ্যানস্থ চাণক্য। ক্ষমা চাইলেন বিন্দুসার। মৃদু হাসলেন আচার্য। তার পরই হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তাঁর ধ্যানের বেদী। যাঁরা সেখানে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ দেখলেন, আগুন লাগিয়ে দূরে দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছেন কুচক্রী সুবন্ধু। চাণক্যকে উদ্ধার করে আনা হল যখন, ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছে তাঁর শরীর।
(তথ্যসূত্র:
১- চাণক্য নীতি এবং কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র প্রশাসন বিধি ও শাসন কলা, ভিএস এডিটরিয়াল বোর্ড (২০১৫)।
২- Chanakya: The Kingmaker and the Philosopher, Anu Kumar, Hachette India (২০১৩)।
৩- Inside Chanakya’s Mind: Aanvikshiki and the Art of Thinking, Radhakrishnan Pillai, Penguin Random House (২০১৬)।
৪- ‘The Arthashastra’, Kautilya, Tr. L.N. Rangarajan, Penguin Books India (১৯৯২)।
৫- Chandragupta Maurya and His Times, Radha Kumud Mookerji, Motilal Banarsidass (১৯৯৯)।
৬- Chanakya: The Master of Statecraft, Deepa Agarwal, Penguin India (২০১৩)।)
1 মন্তব্যসমূহ