বৃহন্নলার অন্তরসত্তা পুরুষ, না নারী? কে বলল, সর্বদা সবাইকে দুই-এর ছকে ধরা যায়? প্রামাণিক বিচারের
শেষে দ্বিধাহীন রায় দেওয়া যায়: ‘হয় তুমি এই, নয় তুমি ওই’? স্মরণ করুন বৃহন্নলা/অর্জুনের সেই আত্মপরিচিতি: ‘তৃতীয়াং প্রকৃতিং গতঃ।’
নারী-পুরুষের পারস্পরিক স্বভাব-বৃত্ত বা দেহভাব অঙ্গীকারের মধ্যে কোনও স্বাভাবিকতা আছে কি না জানি না, কিন্তু অর্ধনারীশ্বরের কল্পনাটা বৃথা নাও হতে পারে। পানের দোকানের ক্যালেন্ডারে শিব-রাম-কৃষ্ণ যাঁরই প্রতিচ্ছবি থাকুক, শিল্পী সমস্ত সৌন্দর্য ঢেলে ছবি তৈরি করেছেন, কানে কুণ্ডল, বাহুতে অঙ্গদ, গলায় মৌক্তিকের মালা, আর মুখখানি রমণীর সৌন্দর্যে ভরা। কিন্তু এমন মেয়েলি মুখের ইষ্টদেবতার হাতে ধনুক-বাণ কিংবা শিব-নেত্রে যোগ-সমাধি, অথবা আরও মেয়েলি কৃষ্ণের ‘করতলে বেণুঃ করে কঙ্কণম্’। এর বিপরীতে অশেষ রমণীকুলের মনে পুরুষায়ণী বৃত্তিটা বেশ ভাবনায় ফেলে। নারীবাদিনীরা বলেন বটে, পুরুষের অনুকার, অর্থাৎ পুরুষ যেমন ‘বিহেভ’ করছে, শার্ট-জিনস্ পরছে, এমনকী দ্বিধাহীন নির্লজ্জতায় কথা বলছে, তেমনটা করতে পারার অধিকার-স্বাতন্ত্র্যই তাঁদের কাম্য। কিন্তু, যেমনটি উনিশ শতকের ব্রিটিশ কবি-ঔপন্যাসিক জর্জ মেরিডিথ বলেছিলেন, মেয়েদের এত কিছু করার দরকার নেই, ‘ব্রেকফাস্ট’-এর আগে ঠান্ডা মাথায় আধ ঘণ্টা রাস্তা দিয়ে উচ্চাবচ হেঁটে এলেই যথেষ্ট। এই পরিস্থিতিতে ছেলেদের কথাটাই বোধ হয় বিপ্রতীপ ভাবে বেশি সমস্যার যারা রমণীয়তার অঙ্গীকার ঘটাতে চায় কখনও কখনও।
মহাভারতের অম্বা-শিখণ্ডিনীকে জানি, তিনি নারী থেকে পুরুষ হতে চেয়েছিলেন। মহাভারতের অম্বা-উপাখ্যানটি শিখণ্ডিনীর বৃত্তান্ত থেকে ছেঁটে দিলে নিষ্কর্ষ-কাহিনি দাঁড়াবে এই যে, তিনি মেয়ে হয়েই জন্মেছিলেন, আমাদের মতে হয়তো বা নপুংসকই। পাঞ্চাল দ্রুপদ শিখণ্ডিনীকে পুত্রের পরিচয়ে বড় করে তোলেন। হয়তো বা তাঁর নপুংসকত্বের মধ্যে পুংভাব বেশি ছিল বলেই দ্রুপদের পক্ষে তাঁর কন্যাভাবটুকু লুকিয়ে পুংভাবের প্রচার করা সম্ভব হয়েছে: ‘ছাদয়ামাস তাং কন্যাং পুমানিতি চ সো’ব্রবীৎ’। তাঁর নামও দৃঢ় ভাবে প্রচার হল শিখণ্ডী। কিন্তু যখন দ্রুপদ দশার্ণ-রাজ হিরণ্যবর্মার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন শিখণ্ডীর, সে কন্যার কাছে ধরা পড়ে গেলেন দ্রুপদের ‘পুত্র’।
দশার্ণ-দেশের ধাত্রীরা, যারা এসেছিল রাজপুত্রীর সঙ্গে, পরীক্ষা ও নিরীক্ষা করে খবর দিল হিরণ্যবর্মাকে। এই গভীর বঞ্চনা সহ্য করতে না পেরে তিনি পঞ্চাল আক্রমণ করবেন বলে ঠিক করলেন। পিতার লজ্জিত অবস্থা দেখে শিখণ্ডী আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে নিষ্ক্রান্ত হলেন, কিন্তু যক্ষ স্থূণাকর্ণের সঙ্গে দেখা হল তাঁর, একে অপরের যৌনাঙ্গ প্রতিস্থাপন করলেন তাঁরা; শিখণ্ডিনী শিখণ্ডী হলেন, স্থূণাকর্ণ হলেন স্ত্রী: ‘ততঃ শিখণ্ডী পাঞ্চাল্যঃ পুংস্ত্বমাসাদ্য পার্থিবঃ’।
সেই কবে ‘ট্রান্স-সেক্সুয়ালিটি’র কথা ভেবেছেন মহাভারতের কবি। আর এই ভাবনার আবর্তের মধ্যেই মহাবীর অর্জুনের মতো এক নায়ক-পুরুষের জীবনে স্ত্রীভাব অঙ্গীকারের প্রশ্ন আসে। অর্জুনের ঘটনাটা আরও বেশি কৌতূহল তৈরি করে, কারণ তাঁর পৌরুষ, তাঁর বীরত্ব, তাঁর নায়কোচিত উদাত্ত গুণগুলি আমরা জানি। হঠাৎ করে এই চিরপরিজ্ঞাত সত্য এবং তথ্যগুলি ধাক্কা খায়, যখন স্বর্গসুন্দরী উর্বশী অর্জুনকে অভিশাপ দিয়ে বসেন। প্রত্যেক রমণী উর্বশীর মতোই জানে যে, তার আকর্ষণ আছে, কাম্যতা আছে। পুরুষের দ্বারা প্রতিপদে যাচিতা রমণী যদি কাম্য পুরুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হন, তবে উর্বশীর অভিশাপ নেমে আসে: পুরুষের অভিমান তোমার থাকবে না, মেয়েদের মধ্যেই তুমি ঘুরে বেড়াবে। লোকে দেখবে, তুমি পুরুষ নও, তুমি ষণ্ঢ: ‘অপুমানিতি বিখ্যাতঃ ষণ্ঢবৎ বিচরিষ্যতি’।
‘ষণ্ঢ’ শব্দটি ক্লীব বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, তবে নপুংসকতার চেয়ে শব্দটিতে নিষ্ফলতা এবং পৌরুষেয় বীজহীনতার প্রতি তাচ্ছিল্যই যেন বেশি। পাশাখেলায় পরাজিত যুধিষ্ঠিরের প্রতিজ্ঞায় পাণ্ডবরা যখন আবদ্ধ, তখন সেই নিষ্ক্রিয়তা ও নিষ্ফল ক্রোধের সুযোগ নিয়ে সামান্য দুঃশাসনও বলেছিলেন, কৌরবদের মধ্য থেকে অন্য একটা স্বামী বেছে নাও দ্রৌপদী; তোমার পাঁচটা স্বামীই এখন ‘ষণ্ঢতিল’, যার বীজ থেকে গাছ হয় না, ওরা ‘কাকযব’, যে যবের বীজস্থান কালো হয়ে গেছে; এমন নিষ্ফল স্বামী নিয়ে তুমি কী করবে, হরিণের গায়ে বাঘ-সিংহের চামড়া থাকলেই কি বাঘ-সিংহ হয় সে: ‘যথাফলা ষণ্ঢতিলা যথা চর্মময়া মৃগাঃ’।
বনপর্বের শেষ পর্যায়ে যখন অজ্ঞাতে থাকার পরিকল্পনা হচ্ছে, তখনও কিন্তু অর্জুন উর্বশীর অভিশাপ-যুক্তিটুকু শোনাননি, বরঞ্চ এক মহাবীর যদি স্ত্রীভাবে বিরাট-নগরে প্রবেশ করেন, তবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয় অনেক। অর্জুন বলেছেন, আমি বলব আমি ‘ষণ্ঢ’-নপুংসক বটে, তবে এই কিণাঙ্কিত বাহুতে হাতের গুল্ফে যে কড়া পড়েছে, ওটা লুকিয়ে ফেলব বড় বড় দু’টো বালা পরে: কানে পরব দুল, মাথায় বেণী, আমার নাম হবে বৃহন্নলা; আমি কথা বলব ঠিক মেয়েদের মতো, জমিয়ে দেব মেয়েমহলের আড্ডা, আমার মনোরঞ্জনের তালিকায় আর একটা বস্তু আমি বিরাট রাজার মেয়েমহলে গান শেখাব, শেখাব নাচ এবং বাজনা: ‘গীতং নৃত্যং বিচিত্রঞ্চ বাদিত্রং বিবিধং তথা’।
যুধিষ্ঠিরের চিন্তা ছিল, কী ভাবে লুকোবেন অর্জুনকে, তাঁর শরীর, তাঁর মহিমা। অর্জুন বৈপরীত্য বেছে নিয়েছেন, স্ত্রীভাবে থাকবেন তিনি: ‘স্ত্রীভাবেন পুনঃ পুনঃ’। স্ত্রীভাব তাঁর মেদবর্জিত পেশি-স্ফুটিত শরীরে মানাবে না, তা তিনি জানতেন, এবং জানতেন বলেই চেহারাটা অবশ্যম্ভাবী এক নপুংসক ক্লীবের চেহারা হয়ে ওঠে। মহাভারতের টীকাকাররা প্রশ্ন তুলেছেন, নপুংসক তো দুই প্রকারের হয়, প্রকৃতির তফাত যেহেতু সেটা, তাই অর্জুন নিজেই বলেছেন তৃতীয়া প্রকৃতি: ‘তৃতীয়াং প্রকৃতিং গতঃ’। ‘প্রকৃতি’ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই একটা সামাজিক স্বাভাবিকতা চলে আসে, অর্থাৎ এমনটা হতেই পারে। এবং এই প্রকৃতির মধ্যে কখনও পুরুষ ভাবের আধিক্য, কখনও বা স্ত্রী ভাবের: ‘তন্নপুংসকত্বঞ্চ দ্বিবিধং স্ত্রীপ্রকারং পুংপ্রকারঞ্চ’। অর্জুন প্রথমটা বেছে নিয়েছেন বলেই তাঁর হাতে বালা, মাথায় বেণী।
কিন্তু অর্জুনের এই স্ত্রী ভাব মানাচ্ছিল না; দীর্ঘ শরীরে অলংকার, দুই কানে দু’টি বড় বড় দুল, হাতে শঙ্খ-বলয়, সোনার কেয়ূর, এ সব দেখে বিরাট রাজা প্রথমেই বলেছিলেন, তোমার এই কালো রং, এই শরীর, তাতে হাতির বল তোমার গায়ে, তার মধ্যে এই বেণী, এই কানের দুল, মানাচ্ছে না, মিলছে না, এমন মানুষ ক্লীব হতে পারে নাকি? অর্জুন বললেন, দেখুন, আমি গান গাই, নাচি এবং বাজনা বাজাই: গায়ামি নৃত্যাম্যথ বাদয়ামি, আপনার মেয়ে উত্তরাকে দিন আমার হাতে, আমি তাকে নাচ শেখাতে চাই। আর আমাকে দেখে, আমার চেহারায়, কথায়, ভাবে আপনার যে সন্দেহটা হচ্ছে, সে সব অনেক কষ্টের কথা, পরে শোনাব। এখন শুধু এইটুকু জানুন, আমার নাম বৃহন্নলা, আমার বাপ-মা বর্জন করেছে আমাকে, কিন্তু আপনি আমাকে আপনার ছেলেও ভাবতে পারেন, মেয়েও ভাবতে পারেন: ‘বৃহন্নলাং মাং নরদেব বিদ্ধি বৈ/ সুতং সুতাং বা পিতৃমাতৃবর্জিতাম্’।
অর্জুনের নপুংসকতার পরীক্ষা কী ভাবে হয়েছিল আমাদের জানা নেই, তবে পাঁচ ভাই পাণ্ডব এবং দ্রৌপদীও যে ভাবে অতি সহজে বিরাট রাজার বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন, তাতে এই পরীক্ষায় খুব যে কঠোরতা ছিল, তা মনে হয় না। অর্জুন যে দিন অন্তঃপুরে নৃত্য-প্রশিক্ষণের বরাত নিয়ে প্রবেশ করলেন, তখন যৌবন-সন্ধিনী উত্তরার মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা জানাননি মহাকাব্যের কবি, তবে আমরা এটুকু জেনেছি যে, কিছু দিনের মধ্যেই অর্জুন বেশ প্রিয় হয়ে উঠলেন অন্তঃপুরের মেয়েদের কাছে: ‘প্রিয়শ্চ তাসাং স বভূব পাণ্ডবঃ’। জানি, খুব ভাল জানি যে, সম্পূর্ণ অস্পৃষ্টতায়, অসংশ্লেষে আর যা-ই হোক, নৃত্যশিক্ষা হয় না। এক একটি প্রত্যঙ্গ-মুদ্রার সময়-সুস্থিতি বোঝানোর জন্য বার বার অর্জুনকে স্পর্শ করতে হয়েছে উত্তরার শরীর, বার বার ঠিক করতে হয়েছে করাঙ্গুলির সংস্থান, হস্ত-মণিবন্ধ থেকে জানু-জঘন-পদন্যাসের পরিবর্তন, বিপরাবর্তন, হয়তো নিরাসক্ত প্রশিক্ষণ-প্রয়োজনেই; কিন্তু এমন অঙ্গ-নখ-স্পর্শেও আচার্য এবং যুবতী শিষ্যার মনে সামান্যতম বিকারও হয় না? মনোগহন বড় জটিল স্থান। গুরুর মন! শিষ্যার মন!
আর ওই স্ত্রীবেশের মধ্যে যদি পৌরুষেয় মানস এতটুকুও না থাকত, তা হলে দ্রৌপদীর মতো পঞ্চঘরনি কেন ভীমের কাছে গিয়ে অর্জুনের জন্য দুঃখ করে বলেন, আমি সহ্য করতে পারছি না ওই ধনুর্ধর লোকটাকে, যখন তাকে বেণী দুলিয়ে মেয়েদের মধ্যে ঘুরতে দেখি: ‘তং বেণীকৃতকেশান্তং ... কন্যাপরিবৃতং দৃষ্ট্বা ভীম সীদতি মে মনঃ’। আরও রাগত দেখি কৃষ্ণা-দ্রৌপদীকে, যখন কীচক-বধ হয়ে গেছে, অথচ দ্রৌপদী ভীমের কাছে না গিয়ে এসে পৌঁছেছেন অন্তঃপুরের নাচঘরে। নাচিয়ে মেয়েদের সঙ্গেই বেরিয়ে এলেন অর্জুন। দ্রৌপদী খোঁটা দিয়ে বললেন, সৈরিন্ধ্রী কোন বিপদ থেকে বাঁচল না বাঁচল তা দিয়ে তোমার কাজ কী, বৃহন্নলা? তুমি তো এই মেয়েদের মধ্যে বেশ আছ: ‘যা ত্বং বসসি কল্যাণি সদা কন্যাপুরে সুখম্’। অর্জুনের উত্তরে হেঁয়ালি ছিল কে কার মন বোঝে কল্যাণী হা অভিমানিনী নারী, সত্য শুনে কী হইবে সুখ?
তার পর, বিরাট-পর্বের শেষে, কুমার উত্তর দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবেন, তিনি উপযুক্ত সারথি খুঁজছেন। দ্রৌপদীর ভূমিকা এখানে দেখার মতো। তিনি সারথি হিসেবে বৃহন্নলার উচ্চকণ্ঠ প্রশংসা করে যাঁকে দিয়ে রাজি করাতে বললেন তাঁকে, তিনি কুমারী উত্তরা। দ্রৌপদী রাজপুত্র উত্তরকে বলেছিলেন, ওই আপনার বোন, কুমারী এবং নিতম্বিনী উত্তরা, সে যদি এক বার তাকে অনুরোধ করে, তবে সে ফেলবে না তার কথা। সত্যিই তো, উত্তরা যখন এসে পৌঁছচ্ছেন অর্জুনের কাছে, তখন কবির উপমা ভেসে আসছে যেন নাগবধূ এসে পৌঁছল যূথপতি হস্তিনায়কের কাছে: ‘নাগবধূবি দ্বিপম্’। বৃহন্নলা উত্তরাকে বলছেন, কী সুন্দরী! মুখখানা এমন শুকনো কেন? কী হয়েছে বলো তাড়াতাড়ি!
বৃহন্নলার প্রতি ষোড়শীর প্রণয় মাখিয়ে উত্তরা বলেছিলেন, আমার দাদার সারথি হওয়ার প্রসঙ্গে সৈরিন্ধ্রী তোমার অগাধ প্রশংসা করছিল; তুমি নাকি অর্জুনের সারথি ছিলে; তোমাকে আজ উত্তরের সারথি হতে হবে। তার কুমারী মনে বৃহন্নলা সম্বন্ধে আরও কিছু ‘আমি-আমার’ গোছের অস্পষ্ট বোধ ছিল নাকি! যাতে বৃহন্নলার স্বীকার-উত্তর পাওয়ার আগেই উত্তরা বলছেন, আমি! আমি তোমাকে অনুরোধ করেছি; আমি বলেছি এই সারথ্যের কাজটুকু করে দিতে হবে, এখন ‘আমি’ বলা সত্ত্বেও যদি তুমি আমার কথা না শোনো আর কেন শুনবেই বা না তুমি, আমি অনেক ভালবাসা নিয়েই তোমাকে বলেছি যেহেতু তবুও যদি না শোনো, তবে জেনো আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে নিশ্চয়: ‘প্রণয়াদ্ উচ্যমানা ত্বং পরিত্যক্ষ্যামি জীবিতম্’।
মহাকাব্যের কবি এমন করেই এক নপুংসক-প্রমাণ মানুষের জন্য উন্মীলন করেছেন প্রিয়শিষ্যা এক রমণীর হৃদয়-কমল-কলিকা। যার জন্য প্রৌঢ় নপুংসক ভোলেনি, ঘোর যুদ্ধকালেও উত্তরার পুতুলখেলার জন্য চিত্রবিচিত্র শীর্ষ-বসন নিয়ে যেতে হবে শত্রুবীরের মাথা থেকে খসিয়ে। মহাকাব্যের কবি বেশি তো কথা বলেন না, কিন্তু কোন যুক্তিবলে বিরাট রাজা এই প্রৌঢ় নপুংসকের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন উত্তরার, আর কেনই বা অর্জুন অর্জুন-প্রমাণ অভিমন্যুর সঙ্গে বেঁধে দিলেন প্রণয়-পরম্পরার ঘটমান অতীত সম্বন্ধকে!
দুঃশাসন নয়। যুধিষ্ঠিরও নয়। দ্রৌপদী যাঁকে পরম সহায় হিসেবে পেলেন, তিনি কৃষ্ণ। তাঁর বন্ধুত্বে
দখলদারি নেই। অধিকারের হিসেব না কষে ভালবাসার ধর্মে পৌরুষ নিজেকে শুদ্ধ করতে পারে।
হস্তিনাপুর। কৌরবদের সভা। পাণ্ডবদের বড়দাদা যুধিষ্ঠির পণ রেখে পাশা খেলতে গিয়ে দানের পর দান হারছেন। হারতে হারতে শেষে যুধিষ্ঠির বললেন, ‘যিনি নাতিহ্রস্বা, নাতিদীর্ঘা, নাতিকৃশা ও নাতিস্থূলা, ... কেশকলাপ দীর্ঘ, নীল ... ভর্ত্তার অভিলষিত গুণসমুদয়ে বিভূষিতা ... যাঁহার সস্বেদ মুখপঙ্কজ মল্লিকার ন্যায়; মধ্যদেশ বেদীর ন্যায়, সেই সর্বাঙ্গসুন্দরী দ্রৌপদীকে পণ রাখিলাম।’ চুল কেমন, উচ্চতা কতটা, সবই বলে দিয়েছেন। আর যে ভরণ-পোষণ করে, সেই ভর্ত্তা বা স্বামী যা যা গুণ চায়, সবই মেয়েটির আছে। ঘামলে কেমন অপরূপ দেখায় তাঁকে, তাও বলেছেন। কখন ঘেমে ওঠে মেয়েদের মুখ? শ্রমে, রতিশ্রমেও। অন্যান্য শ্রমের সময় তো দ্রৌপদীকে এত ‘ইন্টিমেট’ ভাবে যুধিষ্ঠিরের দেখার কথা নয়। বনবাস তো তখনও ঘটেনি, রানি দ্রৌপদীর খুব একটা শারীরিক ধকল হয় না নিশ্চয়ই, দাসী-বাঁদি আছে। তা হলে? ঘেমে ওঠা মুখ মল্লিকার মতো, এই বিবরণ কি রতিকালের! হওয়া সম্ভব। খুবই সম্ভব। এর আগে পর্যন্ত ভাইদের যখন পাশায় পণ রাখছিলেন বড়দা, তখন তাদের গুণের কথাই বলছিলেন। ভীম ইন্দ্রের মতো যুদ্ধ করে, অর্জুন সব্যসাচী দু’হাতেই সমান দক্ষতায় তির ছুড়তে পারে, এই সব। দ্রৌপদীর বেলায় শরীর, শরীর। পাশা খেলায় মত্ত ধর্মরাজ অধিকারপরায়ণ স্বামী তখন, দ্রৌপদীর বন্ধু নন। বন্ধু হলে, সখা হলে বুঝতেন, এ ভাবে মেয়েটিকে জনসমক্ষে তুলে ধরা যায় না।
তার পর সেই ভয়ানক দৃশ্যের জন্ম হল। আজকের দিল্লিতে যা হয়েছে, সে দিনের হস্তিনাপুরে তা-ই হয়েছিল, অন্য ভাবে। যুধিষ্ঠির যে ভাবে দ্রৌপদীর বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাতে তো এমনিতেই কর্ণ-দুঃশাসনদের আনন্দের সীমা ছিল না। আর যুধিষ্ঠির হারলেন যখন, তখন কি আর তর সয়! এই তো সেই মেয়ে, যার স্বয়ংবর সভায় কৌরবেরা কিছু করে উঠতে পারেনি। এই তো সেই মেয়ে, যে কর্ণকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এই বার এই বার সুযোগ এসেছে, সুতরাং অন্তঃপুর থেকে প্রকাশ্য রাজসভায় টেনে আনা যাক। চুল ধরে টেনে এনে যুধিষ্ঠির বর্ণিত এই রমণীর শরীরকে বস্ত্রহীন করার চেষ্টা না করলে সমবেত উল্লাস উপভোগ করা যাবে কেন! পুরুষেরা সবাই মিলে চেটেপুটে খেলে তবেই তো আনন্দ। দেখার, চাখার আনন্দ। যে মেয়েকে পেতে চেয়ে তারা পায়নি, তার ওপর এ বার প্রতিশোধ। ঘৃণা আর হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া।
সভাপর্বের এই ঘটনা পৌরুষের এক বিশেষ চেহারাকে তুলে ধরে। এই পুরুষ নারীকে পণ্য বলে মনে করে। যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মাত্মা পুরুষও পাশা খেলায় মত্ত অবস্থায় নারীকে উপভোগ্য সামগ্রী হিসেবেই বর্ণনা দেন। আর বস্তু যখন, তখন তার দখল নেওয়ার জন্য হামলে পড়ে পুরুষেরা। বস্তুর ইচ্ছে থাকে না, অনিচ্ছে থাকে না। আমরা তো এখনও বলি, যৌনকর্মীকে চাইলেই ধর্ষণ করা যায়, বিয়ে করা বউয়ের সঙ্গে বিহারের জন্য অনুমতি নিতে হয় না।
কিন্তু মহাভারতে পৌরুষের অন্য রকম রূপও আছে। সভাপর্বে সে দিন ভীষ্ম দ্রোণরা তমস্তকে বসে থাকলেও দ্রৌপদীর হয়ে এক জন গলা ফাটিয়েছিলেন। বিকর্ণ। দুর্যোধনের এই ভাইটির বীর হিসেবে বড় একটা খ্যাতি নেই। কিন্তু সে দিন তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেছিলেন, দ্রৌপদীর প্রতি যা হয়েছে তা অভব্যতা। যুধিষ্ঠির অন্যায় করেছেন। অন্তত এক জন পুরুষ ছিলেন রাজসভায়, যিনি দখল করেন না, যখন দরকার তখন আপ্রাণ প্রতিরোধ করতে পারেন। পৌরুষের দেখনপনা নেই, প্রতিরোধের সাহস আছে তাঁর।
না, শুধু বিকর্ণ নয়, এই পর্বেই আমরা দ্রৌপদীর এক বন্ধুকে দেখলাম, যিনি শরীরের দিক দিয়ে পুরুষ, আচরণে বা মানসিকতার দিক দিয়ে চেনা পৌরুষের অবয়ব নয়। তিনি কৃষ্ণ। সখা কৃষ্ণ। সখা শব্দের যেন কোনও লিঙ্গ পরিচয় নেই। একটি মেয়ে তার চূড়ান্ত অপমানের দিনে যে বন্ধুটির কাছে সাহায্য নিচ্ছে, সে লিঙ্গময় পুরুষ নয়, সখা। তাকে সব বলা যায়, অপকটে চাওয়া যায় সহায়তা। সখা কৃষ্ণ তাঁর রমণীয় বন্ধুকে বস্ত্র প্রদান করেছিলেন। এই কৃষ্ণ নিষ্কাম সন্ন্যাসী নন। তীব্র ভালবাসায় সমর্থ মানুষ তিনি। কিন্তু দখলদার নন। সখা যে, বন্ধু যে, বন্ধুর জন্য তার মন-কেমন করতে পারে, অভিমান হতে পারে, বন্ধুর প্রতি তার গভীর ভালবাসা, কিন্তু অধিকারবোধ নেই। সে বলে: ‘তোমায় আমি পালতে চাই না, কাড়তে চাই না, চাইছি তোমার বন্ধুতা।’ কাজটা কঠিন, অসম্ভব নয়।
মেয়েদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টি আর আচরণ এক সুতোয় বাঁধা। একটা না পালটালে অন্যটা পালটাবে কী করে? সেই পালটানোর একটা উপায় দু’পক্ষের সহজ সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ কাজে দখলদার পুরুষদের এগিয়ে এসে নিজেদের সংশোধন করা চাই। এই ইতিবাচক কথাটা বলা ও ভাবা দরকার। সব পুরুষ রাতারাতি বদলে যাব না। কিন্তু চেষ্টা করতে পারি। সেই চেষ্টায় আমাদের সহায় কৃষ্ণ। রতিরসিক, বর্ণময়, রমণীমোহন, আবার নাগরিক, ভদ্র। সখা কৃষ্ণ।
(তথ্যসূত্র:
১- মহাভারতের অষ্টাদশী, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৬)।
২- সার্দ্ধ চারিসহস্র বাক্য-প্রতিবাক্যে মহাভারত, মল্লিকা ঘোষ, পুস্তক বিপণি (২০১৩)।
৩- The Secret of the Druids, Christopher C. Doyle, Westland (২০১৬)।
৪- Mahabharata Secret, Christopher C. Doyle, Om Books International Ltd. (২০১৩)।
৫- মহাভারত, রাজশেখর বসু, বুক চয়েস।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা: ১৪ই জুলাই ও ৩০শে ডিসেম্বর ২০১২।)
1 মন্তব্যসমূহ
মহাভারতের উপর এমন আরও লেখা চাই।