আইন প্রণয়নে ক্ষমতাশালীর যথেচ্ছাচারের সম্ভাবনা থাকলেও এর মূল উদ্দেশ্য কিন্তু মহৎ। তা হল সমাজের দুর্বল বা সবল সবার জন্য আইনের প্রয়োগ সমান হবে, যাতে সমাজের দুর্বলেরা সবলের দ্বারা অত্যাচারিত না হয়। বা অপরাধী ক্ষমতাবান হলেও দুর্বলের প্রতি অপরাধ করে রেহাই না পায়। সমাজের শাসক সেটা নজরে রাখবেন। অন্তত হাম্মুরাবি তাঁর আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যকে সে ভাবেই ব্যখ্যা করেছেন। বলেছেন একজন বিধবা বা একজন অনাথও যাতে পীড়িত না হয় সেই উদ্দেশ্যে তিনি এই আইন পাথরে খোদাই করে গেলেন।
একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তাদের অতীতে। তারপরে তা বহন করে চলে পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে।
যেমন একটি মেয়ে ও একটি ছেলে দিনের আলোর পরে একত্র থাকায় আপত্তি বা নিরালায় বসায় আপত্তি, হাত ছোঁয়া এমনকি কথা বলাতেও রয়েছে বিধি নিষেধ। এবং এগুলোকেও পর্দা প্রথার অঙ্গ বলা হচ্ছে। তার সাথে বলা হচ্ছে এ সবই ঐতিহ্য। এসবই ধর্মের জাতির বেড়া টপকে চুঁইয়ে গেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। ক্রমে আমরা ভাবতে শিখে গেছি এ হল আমাদের ঐতিহ্য।
সহজ বোধ্যে এই প্রথাগুলো হা ভ্যান ট্যানের সংজ্ঞা মেনে ভৌগোলিক পরিবেশের থেকে উদ্ভুত অভ্যাস থেকে গড়ে ওঠা ঐতিহ্য নয়। কারন এই প্রথাগুলো ভৌগোলিক পরিবেশ থেকে গড়ে ওঠার কথাই নয়। এগুলো সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার প্রথা থেকে আসা। যা হয়ত কোন এক সমাজের ক্ষমতাশালীরা কোন অজ্ঞাত কারনে চাপিয়ে দিয়েছিল, কোন এক সুদূর অতীত কালে।
কিন্তু আসিরীয় আইনে সেদিকে তেমন নজর ছিলো না। আইনে মুখ ঢাকা চুল ঢাকার অধিকার ছিল কেবল মুক্ত নারীদের ও অবশ্যই সাধারন গৃহস্থদের। গণিকাদের মুখ ঢাকা ছিলো কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।
সমাজ পরিবর্তনশীল। তাই সামাজিক প্রথা এবং আইনও পরিবর্তনশীল হতে বাধ্য। এই পরিবর্তনের একটুখানি ছাপ পাবো পরবর্তী আসুরীয় আইনেই। টিগলাথ পাইলেসর-এর আমলে। এখানে দেখতে পাবো নারী আর পুরুষের মধ্যে কথা বলার সময়ও কতটা দুরত্ব রাখতে হবে তা বলে দেওয়া হয়েছে। এবং অপরিচিত পুরুষ নারীদের, বিশেষ করে প্রাসাদের নারীদের যাতে মুখোমুখি না হয় তারও আইন করা হয়েছে। আর হ্যাঁ এই আইনে যা মুলত প্রাসাদের প্রশাসনিক আইন, তাতে প্রথমবার দেখতে পাবো খোজাদের প্রাসাদ রক্ষীর ভুমিকায়।
নীচে আইনগুলো থাকলো। এগুলো আক্কাদ লিপিতে আসিরীয় ভাষায় লেখা আইনের ইংরেজী অনুবাদের দুর্বল বঙ্গানুবাদ। অনুবাদে ভুল থাকবেই। সেটাতে খুব অসুবিধা হবার কথা নয়। কারন আমাদের দরকার শুধু একটা ধারনার সৃষ্টি করা।
গণিকা মুখ ঢাকবে না, মাথাও খোলা রাখতে হবে।
কোন গণিকাকে মুখ ঢাকা দেখলে, তাকে ধরে, সাক্ষী যোগাড় করে, রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসতে হবে।
প্রাসাদ দ্বাররক্ষীরা গণিকার গয়না নিতে পারবে না, কিন্তু যে ধরেছে সে পুরস্কার বাবদ গণিকার পোষাক খুলে নিয়ে নেবে। রক্ষীরা অপরাধী গণিকাকে ৫০ঘা লাঠি মারবে ও তার মাথায় পিচ ঢেলে দেবে।
যদি কোন লোক মুখ ঢাকা গণিকাকে দেখেও ছেড়ে দেয়, শাস্তির জন্য প্রাসাদে নিয়ে না আসে তবে তাকে ৫০ঘা লাঠি মারা হবে।
যে এই অপরাধির খবর দেবে সে অপরাধীর পোষাক নিয়ে নেবে, আর তার দুই কান ফুটো করে মোটা সুতো দিয়ে পেছন দিকে বেঁধে দেবে। এছাড়াও অপরাধীকে একমাস রাজার কাজ করতে হবে।
যদি মুখ ঢাকা দাসীকে দেখেও কেউ তাকে শাস্তির জন্য প্রাসাদে না আনে তবে তার শাস্তি হবে ৫০ঘা লাঠি ও তার কান ফুটো করে মোটা সুতো দিয়ে মাথার পেছন দিকে বেঁধে রাখা হবে। আর তাকে এক মাস রাজার কাজে নিযুক্ত থাকতে হবে। যে এই অপরাধের কথা জানাবে সে অপরাধীর পোষাক নিয়ে নেবে পুরস্কার হিসাবে।
॥আইনঃ A-r ৪১॥
যদি কেউ তার উপপত্নীর মুখ ঢাকাতে চায় তবে তাকে কয়েকজনকে ডেকে সবার সামনে ঘোষণা করতে হবে এই নারী এখন থেকে আমার বিবাহিতা স্ত্রী। এই ঘোষণা করলে তবেই উপপত্নী বিবাহিতা স্ত্রীর মর্যাদা পাবে। যে উপপত্নীর পুরুষ সবার সামনে এই বিবাহিতা স্ত্রী কথাটি ঘোষণা করবে না, সে সব সময়ই উপপত্নীই হয়ে থাকবে। পুরুষ মারা গেলে উপপত্নীর সন্তানেরা কিন্তু মৃত পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবে।
রাজ সভা ও প্রাসাদের আইন।
আসিরীয় রাজা টিগলাথ পাইলেসর (Tiglath-pileser) এর আমলের আইন।
॥আইন-২১॥
বিশ্বের অধিপতি, আসুর-রেসা-ইশি র পুত্র, আসিরীয় রাজা এই আদেশনামা জারি করলেন- এই আদেশনামা কার্যকরী করার দায়িত্ব প্রাসাদ রক্ষী-প্রধানের। এই আদেশনামার অন্তর্গত কোন অপরাধ যদি রক্ষী-প্রধান শুনেও যথাযথ শাস্তি দেবার ব্যবস্থা না করেন তবে রক্ষী-প্রধানই শাস্তি যোগ্য দোষে দোষী সাব্যস্ত হবেন।
রাজকীয় খোজা বা সভার কর্মী বা সেবকদের মধ্যে কেউ প্রাসাদের কোন নারীকে গান করার সময়ে, বা সাথীদের সাথে ঝগড়া করার সময় আড়াল থেকে শোনে তবে তার শাস্তি একশ ঘা লাঠি, আর একটি কান কেটে নেওয়া হবে।
খোলা কাঁধ, সামান্যতম বস্ত্র দিয়ে ঢাকা নেই, এমন অবস্থায় "এখানে এসো আমি তোমাকে কিছু আদেশ দিতে চাই" বলে ডাকা কোন প্রাসাদ রমনীর ডাকে সাড়া দিয়ে, যদি কোন প্রাসাদকর্মী সেই নারীর সাথে কথা বলার চেষ্টাও করে, তবে তার শাস্তি ১০০ঘা লাঠি মেরে তার পোষাক খুলে বস্তা পরিয়ে দেওয়া। যে এই অপরাধের খবর দিয়েছে সে অপরাধীর পোষাক নিয়ে নেবে পুস্কার হিসাবে।
সভার কোন কর্মী যদি কোন নারীর সাথে কথা বলতে চায় তবে তাকে সাত পা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। প্রাসাদে জল ছেটানোর দায়িত্বে থাকা কর্মী যদি দেখে যে প্রাসাদের নারীরা বাস কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, তবে জল ছেটানোর দায়িত্বে থাকা কর্মী প্রাসাদ-রক্ষী-প্রধানকে খবর দেবে। প্রাসাদ রক্ষী প্রধান নারীদের ভেতরে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করবে।
ঠিগলাথ-পাইলেরসারের আসিরীয় সাম্রাজ্য |
তথ্যসূত্রঃ-
0 মন্তব্যসমূহ